ঋতালী
ইসমাইলি খোজা সম্প্রদায়ের গুরুপুত্র প্রিন্স আলী খানের সঙ্গে শ্রীমতী ঋতা (স্পেনিশ ভাষায় যখন ( অক্ষরের উচ্চারণ বাংলা ত’য়ের মতো হয় তখন r টাকে ‘ঋ’ বানাতে কারও বড় বেশি আপত্তি করা উচিত নয়) হেওয়ার্থের শাদি হয়েছে আর বিয়ের দাওয়াতে নাকি হাজার দেড়েক বোতল শ্যাম্পেন খাওয়া হয়েছে।
ফ্রান্সের যে অঞ্চলে শাদিটা হয়েছে সেখানে শ্যাম্পেন মাগগি নয়। তবু যে বেশ কিছু পয়সা খরচা হয়েছে, সে বিষয়ে আমাদের মনে কোনও সন্দেহ নেই; কারণ জর্মনরা নাকি ফ্রান্স ত্যাগ করার পূর্বে প্রাণভরে শ্যাম্পেন খেয়ে ফ্রান্সের তাবৎ শ্যাম্পেনের গুদোম উজাড় করে দিয়ে যায়। বছর সাতেক না যাওয়া পর্যন্ত ১৯৪৫-এর শ্যাম্পেন খাওয়ার মতো ‘পরিপক্ব’ হবে না। কাজেই আলী খান নিশ্চয়ই ৪৫-এর আগেকার লুকোনো মাল গৌরীসেন পয়সা দিয়ে কিনেছেন। তা কিনুন, তাঁর পয়সার অভাব নেই। কিন্তু প্রশ্ন, মুসলমানধর্মে যখন মদ বারণ তখন ধর্মগুরুর বড় ব্যাটা (পরে ইনিই শুরু হবেন) এ খবরটা ছাপতে দিলেন কোন্ সাহসে?
বোম্বায়ে যখন বাস করতুম তখন আলী খানের খোজা সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছিল। তখন কিছুদিন তাদের ইতিহাস, শাস্ত্র, আচার-ব্যবহার নিয়ে নাড়াচাড়া করেছিলুম। সেগুলো সত্যিই বহু রহস্যে ভরা।
খোজাদের বিশ্বাস, আদমকে সৃষ্টি করার সময় আল্লা তার জ্যোতির খানিকটা তার শরীরে ঢেলে দেন। সে জ্যোতি আদম থেকে বংশানুক্রমে মহাপুরুষ মোসেজ (মুসা), নোয়া (নুহ), ইব্রাহাম (ইব্রাহিম), সলমন (সুলেমান), ডেভিড (দায়ুদ) হয়ে হয়ে শেষটায় মহাপুরুষ মুহম্মদের পিতামহে পৌঁছায়। তারই এক অংশ তখন বর্তে মুহম্মদে, অন্য অংশ তাঁর খুড়োর ছেলে আলীতে। আলী মুহম্মদের মেয়েকে বিয়ে করেন। তাঁর ছেলে হুসেনের শরীরে আবার সেই দ্বিখণ্ডিত জ্যোতি সংযুক্ত হয়। তার পর সেই জ্যোতি বংশানুক্রমে চলে এসেছে প্রিন্স আলী খানের পিতা আগা খানের শরীরে। তিনি মারা গেলে আলী খান সেই জ্যোতি পাবেন।
কিন্তু এই বিশ্বাসের সঙ্গে ভারতবর্ষের খোজারা আরেকটা বিশ্বাস জুড়ে দিয়েছেন। সে মত অনুসারে খোজারা বিশ্বাস করেন, বিষ্ণু নয়বার মৎস্য, কূর্ম ইত্যাদি রূপে পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছেন এবং দশমবারে কল্কিরূপে যে অবতীর্ণ হওয়ার কথা আছে, সে-ও খাঁটি; কিন্তু হিন্দুরা জানে না যে কল্কি বহুদিন হল অবতীর্ণ হয়ে গিয়েছেন আলীরূপে মক্কা শহরে। এবং শুধু তাই নয়, সেই কল্কি অবতারের জ্যোতি তাঁর ছেলে হুসেনে বর্তে ক্রমে ক্রমে বংশপরম্পরায় নেমে এসে উপস্থিত বিরাজ করছে আলী খানের পিতা আগা খানের শরীরে।
তাই হজরত আলী হলেন কল্কি অবতার এবং সেই কল্কির জ্যোতি আগা খানের শরীরে আছে বলে তিনিও কল্কি অবতার। তাই খোজা ধর্মগ্রন্থে আগা খানের সম্পূর্ণ নাম লেখা হয় ‘দশবাঁ নকলঙ্কি অবতার আগা সুলতান মুহাম্মদ শাহ’।
কিন্তু প্রশ্ন, খোজারা এই অদ্ভুত সংমিশ্রণ করল কী প্রকারে অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, দশম-একাদশ শতাব্দীতে ইরানের ইসমাইলি সম্প্রদায় আপন দল বাড়াবার জন্য চতুর্দিকে মিশনারি পাঠান। (আরও নানা সম্প্রদায় তখনকার দিনে ইরানের বন্দর আব্বাস থেকে জাহাজে করে সমুদ্রতীরবর্তী সিন্ধু প্রদেশ আর কাঠিয়াওয়াড়ে এসে আপন আপন মতবাদ প্রচার করতেন। এই মিশনারিদের ওপর কড়া হুকুম ছিল, দল বাড়াবার জন্য কারও ধর্মত যদি খানিকটা গ্রহণ করতে হয় তাতে কোনও আপত্তি নেই- মোদ্দা কথা হচ্ছে, সংখ্যাবৃদ্ধি যে করেই হোক করতে হবে।
এই মিশনারিদের একজন এসে কাজ আরম্ভ করেন কাঠিয়াওয়াড় এবং কচ্ছের লোহানা রাজপুত সম্প্রদায়ের মধ্যে। এঁরা ছিলেন বৈষ্ণব– কিন্তু পাঞ্চরাত্র মতবাদের। এঁরা ইসমাইলি মতবাদের দিকে কেন আকৃষ্ট হলেন তার খবর পাওয়া যায় না। কিন্তু এরা যে এই নতুন ধর্ম গ্রহণ করার সময় বিষ্ণুর অবতারবাদটা সঙ্গে এনেছিলেন, সেকথাটা আজও খোজাদের ‘জমাতখানা’তে (খোজারা অন্যান্য মুসলমানদের মসজিদে যান না, তাঁদের আপন মসজিদের নাম ‘জমাতখানা’ বা সম্মেলনালয়) প্রকাশ পায় তাদের উপাসনার সময়। সর্বপ্রথম বিষ্ণুর নয় অবতারের নাম স্মরণ করা হয় বসে বসে এবং দশম অবতার আলী এবং হিজ হাইনেস দি আগা খানের নাম আরম্ভ হতেই সবাই উঠে দাঁড়ান।
গোঁড়া খোজারা বিশ্বাস করেন, স্বর্গে ঈশ্বর নেই। তিনি শরীর ধারণ করে আছেন। আগা খান রূপে।
চন্দ্র, সূর্য তার আদেশে চলে, তিনিই ইচ্ছে করলে একমুহূর্তে সর্বসৃষ্টি ধ্বংস করতে পারেন, নতুন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডও সৃষ্টি করতে পারেন।
এরকম বিশ্বাস যে বিংশ শতাব্দী– বা অন্য যে কোনও শতাব্দীতে– কেউ করতে পারে সেটা আমার ধারণার বাইরে ছিল, কিন্তু যখন স্বকর্ণে শুনলুম, তখন আর অবিশ্বাস করি কী প্রকারে?
ভারতবর্ষে সুন্নি সম্প্রদায় খোজাদের বিশ্বাস সম্বন্ধে অজ্ঞ। কিন্তু ইরানের সুন্নিরা অনেক কিছু জানেন বলে খোজা এবং তাদের জনক সম্প্রদায় ইসমাইলি মতবাদকে বিধর্মী বলে ফতোয়া দিয়েছেন। কোরানে যখন বিষ্ণু এবং নয় অবতারের উল্লেখ নেই, এবং যেহেতু কোরান অবতারদের বিরুদ্ধে আপন বক্তব্য সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছে তখন সুন্নি মতবাদ যে খোজা সম্প্রদায়কে বিধর্মী বলবে, তাতে আর আশ্চর্য হবার কী আছে? খোজারা অবশ্য তা নিয়ে মাথা ঘামান না, কারণ খোজারা যদিও কোরানকে ‘ভালো কেতাব’রূপে স্বীকার করেন, তবু কর্মক্ষেত্রে তারা মানেন কচ্ছি এবং গুজরাতি ভাষায় লিখিত নিজস্ব ‘গিনান’ গ্রন্থাবলিকে। ‘গিনান’ শব্দ সংস্কৃত ‘জ্ঞান’ শব্দ থেকে বেরিয়েছে এবং এসব গিনান লিখেছেন খোজা ধর্মগুরুরা।
খোজারা তিনবার নামাজ পড়েন, এবং রোজার মাসে মাত্র একদিন উপোস করেন। তা-ও বেলা বারোটা পর্যন্ত।
কিন্তু সবচেয়ে বড় তত্ত্বকথা, আগা খান এত টাকা পেলেন কোথায়? তাঁর ঠাকুর্দা তো ইরান থেকে পালিয়ে এসেছিলেন গত শতকের মাঝামাঝি। এইখানেই খোজা ধর্মের গুহ্যতত্ত্ব লুক্কায়িত।
প্রতি জমাতখানাতে একটা করে প্রকাণ্ড লোহার সিন্দুক থাকে। প্রতি অমাবস্যা পূর্ণিমায় প্রত্যেক খোজা এই সিন্দুকে আপন মুনাফা (কোনও কোনও স্থলে আমদানির) থেকে অষ্টমাংশ ফেলে দেয় এবং এইসব টাকা যায় আগা খানের তহবিলে। তাছাড়া পালা-পরবে দান বলতে যা কিছু বোঝায় সবই ফেলা হয় এই সিন্দুকে এবং বহু খোজা মরার আগে তার তাবৎ ধনসম্পত্তি গুরু আগা খানের নামে উইল করে দিয়ে যায়। খোজা সম্প্রদায়ের কারবার-ব্যবসা জগৎজোড়া শাঙ্গাই থেকে জিব্রাল্টার পর্যন্ত। কাজেই আগা খানের মাসিক আয় কত তার হিসাব নাকি স্বয়ং আগা খান ছাড়া কেউ জানে না।
তা জেনে আমাদের দরকারও নেই। এবং আমি জানি, এতসব তত্ত্বকথা শোনার পরও পাঠক শুধাবেন, কিন্তু যে শ্যাম্পেন নিয়ে আরম্ভ করেছিলে তার তো কোনও হিল্লে হল না। মদ যখন বারণ তখন আলী খান শ্যাম্পেন খান কী প্রকারে? তবে কি শ্যাম্পেন মদ নয়?
বিলক্ষণ। শ্যাম্পেনে আছে শতকরা প্রায় পনেরো অংশ মাদকদ্রব্য বা এলকহল। এবং যেহেতু শ্যাম্পেন খুললেই সোডার মতো বুজরুজ করে, তাই তাতে আছে ছোট ছোট বুদ্বুদ। সেগুলো পেটে গিয়ে খোঁচা দেয় বলে নেশা হয় চট করে এবং স্টিল ওয়াইন বা শান্ত মদের তুলনায় অনেক বেশি। তবে?
খোজারা বলেন, ‘আলী খান একদিন স্বয়ং কল্কি অবতারের জ্যোতি পাবেন বলে তিনি এখন থেকেই পূতপবিত্র। কোনও বস্তু তাকে অপবিত্র করতে পারে না। তাই অপবিত্র মদ তার হস্তস্পর্শ লাভ করা মাত্রই পবিত্র হয়ে যায়।’
এতক্ষণ যা নিবেদন করলুম, সেগুলো দলিল-দস্তাবেজ অর্থাৎ খোজাদের শাস্ত্রগ্রন্থ থেকে প্রমাণ করা যায়, কিন্তু এবারে যেটি বলব সেটি আমার শোনা গল্প এক নাস্তিক খোজার কাছ থেকে।
একদিন নাকি, খানা খেতে খেতে পঞ্চম জর্জ আগা খানকে জিগ্যেস করেন, ‘একথা কি সত্যি, ইয়োর হাইনেস, যে, আপনার চেলারা আপনাকে পুজো করে?’
আগা খান নাকি উত্তরে বলেছিলেন, ‘তাতে আশ্চর্য হবার কী আছে, ইয়োর ম্যাজেস্টি মানুষ কি গরুকেও পুজো করে না?’
উত্তরটার দর আমি আর যাচাই করলুম না।