ঋগ্বেদ ১০।০৭১

ঋগ্বেদ ১০।০৭১
ঋগ্বেদ সংহিতা ।। ১০ম মণ্ডল সূক্ত ৭১
ব্রহ্মজ্ঞান দেবতা। বৃহস্পতি ঋষি।

১। হে বৃহস্পতি! বালকেরা সর্ব প্রথম বস্তুর নাম মাত্র করিতে পারে, তাহাই তাহাদিগের ভাষাশিক্ষার প্রথম সোপান। তাহাদিগের যাহা কিছু উৎকৃষ্ট ও নির্দোষ জ্ঞান হৃদয়ের নিগূঢ় স্থানে সঞ্চিত ছিল, তাহা বাগদেবীর করুণাক্রমে প্রকাশ হয়(১)।

২। যেমন চালনীর দ্বারা শক্তুকে পরিষ্কার করে, তদ্রুপ বুদ্ধিমান বুদ্ধিবলে পরিষ্কৃত ভাষা প্রস্তুত করিয়াছেন। সেই ভাষাতে বন্ধুগণ বন্ধুত্ব, অর্থাৎ বিস্তর উপকার প্রাপ্ত হয়েন। তাঁহাদিগের বচনরচনাতে অতি চমংকার লক্ষ্মী সংস্থাপিত আছে।

৩। বুদ্ধিমানগণ যজ্ঞদ্বারা ভাষার পথ প্রাপ্ত হয়েন। ঋষিদিগের অন্তঃকরণ মধ্যে যে ভাষা সংস্থাপিত ছিল, তাহা তাহারা প্রাপ্ত হইলেন। সেই ভাষা আহরণপূর্বক তাহারা নানাস্থানে বিস্তার করিলেন। সপ্তছন্দ সেই ভাষাতেই স্তব করে।

৪। কেহ কেহ কথা দেখিয়াও কথার ভাবার্থ গ্রহণ করিতে পারে না, কেহ শুনিয়াও শুনে না। যেমন প্রেম পরিপূর্ণ। সুন্দর পরিচ্ছদধারিণী ভার্যা আপন স্বামির নিকট নিজ দেহ প্রকাশ করেন, তদ্রুপ বাগদেবী কোন কোন ব্যক্তির নিকট প্রকাশিত হয়েন।

৫। পণ্ডিত সমাজে কোন কোন ব্যক্তির এই প্রতিষ্ঠা হয় যে, সে উত্তম ভাবগ্রাহী, তাঁহাকে ছাড়িয়া কোন কাৰ্য্য হয় না। কেহ বা পুষ্পফল বিহীন অর্থাৎ অসারবাক্য অভ্যাস করে, তাহার যে বাক্য, উহা যেন বাস্তৰিক দুগ্ধ প্ৰদ গাভী নহে, কাল্পনিক মায়াময় গাভী মাত্র।

৬। বিদ্বান্ বন্ধুকে যে ত্যাগ করে, তাহার কথায় কোন ফল নাই। সে যাহা কিছু শুনে, বৃথাই শুনে; সে সৎকর্মের পন্থা অবগত হইতে পারে না।

৭। যাহাদিগের চক্ষু আছে, কর্ণ আছে, এরূপ বন্ধুগণ মনের ভাব প্রকটন বিষয়ে অসাধারণ হইয়া উঠিলেন। যে হ্রদের জলে কেবল মুখা বা কক্ষ পর্যন্ত নিমগ্ন হয়, সে যেমন অগভীর, কেহ কেহ তেমনি অগভীর। কেহ কেহ বা স্নান করিবার উপযুক্ত সুগভীর হ্রদের ন্যায় দৃষ্ট হইয়া থাকেন।

৮। যখন অনেক স্তোতা (২) একত্র হইয়া মনের ভাব সমস্ত হৃদয়ে আলোচনা পূর্বক অবধারিত করিতে প্রবৃত্ত হয়েন, তখন কোন কোন ব্যক্তির কিছুই জ্ঞান জন্মে না। কেহ কেহ স্তোত্রজ্ঞ (৩) বলিয়া পরিচিত হইয়া সর্বত্র বিচরণ করেন।

৯। এই যে সকল ব্যক্তি, যাহারা ইহকাল, বা পরকাল কিছুই পৰ্যালোচনা করে না, যাহারা স্তুতি প্রয়োগ, বা সোমযাগ কিছুই করে না (৪), তাহারা পাপযুক্ত, অর্থাৎ দোষাশ্রিত ভাষা শিক্ষা করিয়া নির্বোধ ব্যক্তির ন্যায় কেবল লাঙ্গল চালনা করিবার উপযুক্ত হয়, অথবা তন্তুবায়ের কার্য্য করিবার উপযুক্ত হয়।

১০। যশ মিত্রের ন্যায় কাৰ্য্য করে, ইহা সভাতে ও প্রাধান্য প্রদান করে, সেই যশ প্রাপ্ত হইলে সকলেই আহলাদিত হয়, কারণ যশের দ্বারা দুর্নাম দুর হয়, অন্নলাভ হয়, বল প্রাপ্ত হওয়া যায়, নানা প্রকারে উপকৃত হওয়া যায়।

১১। একজন প্রচুর পরিমাণে ঋকসমূহ উচ্চারণ করত যজ্ঞের অনুষ্ঠানকল্পে সাহায্য করেন, আর এক জন গায়ত্রীছন্দে সাম গান করেন; যিনি ব্রহ্মা নামক পুরোহিত, তিনি জাতবিদ্যা বিষয় ব্যাখ্যা করেন, অপর এক জন পুরোহিত যজ্ঞানুষ্ঠানের ভিন্ন ভিন্ন কাৰ্য্যগুলি ক্রমশ সম্পন্ন করেন।

————

(১) এই সূক্তটি অতিশয় জ্ঞাতব্য। ইহাতে ভাষা ও বাক্য ও অর্থের কথা সমালোচিত হইয়াছে।

(২) মূলে “ব্রাহ্মণা” আছে। অর্থ “ব্রহ্ম,” বা স্তোত্র উচ্চারণকারী।

(৩) মূলে “ব্ৰহ্মাণঃ” আছে। অর্থ “ব্ৰহ্ম,” বা স্তোত্রবিশারদ।

(৪) মূলে আছে “ন ব্রাহ্মণাসঃ ন সুতে করাসঃ।” “ব্রাহ্মণ” শব্দে আধুনিক অর্থ করিলে, এখানে কোন সঙ্গত অর্থ হয় না। “যাহারা ব্রাহ্মণ নহে এবং সোমযাগ করে না, তাহারা পাপযুক্ত হইয়া,”—ইত্যাদি অর্থ সঙ্গত হয় না। ফলতঃ এই ঋকদ্বারা স্পষ্টই প্রতীয়মান হইতেছে যে, ইহার রচনাকালে জাতি বিভাগ ছিল না। যাহারা ইহকাল ও পরকাল পৰ্যালোচনা করিত ও স্তুতি অভ্যাস ও সোমযাগ করিত, তাহারাই স্তোতা হইত, জাতিগুণে স্তোতা হইত না। যাহারা ঐ ধর্ম ক্রিয়া সাধনে অসমর্থ, তাহারা কৃষক, বা তন্তুবায় হইত, জাতিদোষে কৃষক বা তন্তুবায় হইত না। বুদ্ধি বা কর্ম অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসায় অবলম্বন করিত, জন্ম অনুসারে নহে।