ঋগ্বেদ ০৯।১০৭
ঋগ্বেদ সংহিতা ।। ৯ম মণ্ডল সূক্ত ১০৭
পবমান সোম দেবতা। ভরদ্বাজ কশ্যপ প্রভৃতি সপ্ত ঋষি।
১। এই যে সোম, যিনি সৰ্বশ্রেষ্ঠ যজ্ঞীয়দ্রব্য, যিনি যজ্ঞাধ্যক্ষদিগের হিতসাধন করিতে করিতে জলের মধ্যে অন্তর্ধান হয়েন, যাহাকে প্রস্তরের দ্বারা নিষ্পীড়নপূর্বক প্রস্তুত করা হইয়াছে, সেই নিষ্পীড়িত সোমকে এই দিকে উত্তমরূপে সেচন কর।
২। হে দুর্ধর্ষ সোম! তুমি চমৎকার সৌরভ ধারণপূৰ্ব্বক মেষলোমদ্বারা শোধিত হইতে হইতে শীঘ্র ক্ষরিত হও। প্রস্তুত হইবার পর তোমাকে জলের সহিত, দুগ্ধের সহিত এবং আহার সামগ্রীর সহিত মিশ্রিত করিয়া আনন্দের সহিত সেবন করিব।
৩। সোম কর্মিষ্ঠ, উজ্জ্বল ও দেবতাদিগের মত্ততা উৎপাদনকর্তা, তিনি চতুর্দিক দেখিবার জন্য ক্ষরিত হইতেছেন।
৪। হে সোম! তুমি শোধিত হইতে হইতে জলের সহিত মিশ্রিত হইয়া ধারার আকারে যাইতেছ। হে দেব! তুমি সুবর্ণের আকরস্বরূপ, তুমি উত্তম উত্তম বস্তু দিবে বলিয়া যজ্ঞস্থানে উপবেশন করিতেছ।
৫। আকাশস্বরূপ গাভীর উধঃ হইতে হইতে অতি মধুর বৃষ্টি বারি দোহন করিতে করিতে সোম তাহার চিরপরিচিত যজ্ঞস্থানে যাইয়া উপবেশন করিতেছেন। সেই সৰ্ব্বদ্রষ্টা সোমকে সঞ্চালনপূর্বক যজ্ঞাধ্যক্ষগণ শোধন করিলেন। তিনি তখন দ্রুতবেগে যজ্ঞের অবলম্বনস্বরূপ যজ্ঞকর্তা ব্যক্তিকে সম্ভাষণ করিতে চলিলেন।
৬। হে সতর্ক সোম! তুমি শোধিত হইতে হইতে অতি সুন্দররূপে মেষলোমের সর্বাংশে বিস্তারিত হইলে। তুমি মেধাবী এবং অঙ্গিরা নামক পিতৃলোকদিগের শ্রেষ্ঠ হইয়াছ, মধুপূর্ণ রসের দ্বারা আমাদিগের যজ্ঞ অভিষিক্ত কর।
৭। সোমের তুল্য পথ দেখাইয়া দিবার লোক আর কেহ নাই, ইনি পণ্ডিত ও মেধাবী ও ঋষিতুল্য, ইনি রস সেচন করিতে করিতে ঝরিতেছেন। হে সোম! তুমি কবি, তুমি দেবতাদিগের নিকট সর্বশ্রেষ্ঠ কাম্যবস্তু হইয়াছ, তুমি সূর্যকে আকাশে আরোহণ করাইয়াছ।
৮। নিষ্পীড়নকর্তারা সোমকে প্রস্তুত করিতেছেন, তিনি উচ্চস্থানস্থিত মেষলোমের পবিত্ৰদ্বারা ঝরিতেছেন। তাহার উজ্জ্বল ধারা ঘোটকের ন্যায় দ্রুত যাইতেছে, তিনি আনন্দ বর্ধনকারী ধারার আকারে যাইতেছেন।
৯। সোম দুগ্ধবিশিষ্ট, কেননা দুগ্ধ দোহনপূর্বক তাহার সহিত মিশ্রিত করা হইয়াছে, তিনি তৎসংশ্লিষ্ট হইয়া ক্ষরিত হইলেন। তাঁহার যে সকল রস সকলে ভাগ করিয়া লইতে হইবেক, তাহারা যেন সমুদ্রের মধ্যে (অর্থাং কলসের মধ্যে ) প্রবেশ করিল। তিনি মত্ততার উৎপাদনকর্তা, মত্ততার জন্য তাহাকে আঘাত করিতেছে (থেৎলাইতেছে)।
১০। হে সোম! প্রস্তরের দ্বারা তুমি নিষ্পীড়িত হইতে হইতে মেষের লোমকে আচ্ছাদন করিতেছ। দুই ফলকের উপরিস্থিত কলসের মধ্যে সোম প্রবেশ করিতেছেন, যেন কোন ব্যক্তি নগর মধ্যে প্রবেশ করিতেছে। পরে উজ্জল হইয়া ভিন্ন ভিন্ন কাষ্ঠনির্মিত পাত্রে স্থান গ্রহণ করিতেছেন।
১১। মেষলোম আচ্ছাদন কালে সোমকে শোধন করিতেছে, তিনি যেন যুদ্ধের ঘোটেকের ন্যায় সজ্জিত হইতেছেন। তিনি যখন ক্ষরিত হয়েন, স্তবকারী মেধাবী পন্ডিতদিগের উচিত তাহাকে অভিনন্দন করা।
১২। হে সোম যেমন নদী জলের দ্বারা স্ফীত হয়, তদ্রুপ তুমি দেবতাদিগের পানের জন্য স্ফীত হইতেছ। মদিরার ন্যায় তুমি সতেজ, তুমি তোমার লতার রস লইয়া মধুক্ষরণকারী কলসের মধ্যে যাইতেছ ।
১৩। যেরূপ প্রিয় পুত্রকে সুশোভিত করিতে হয়, তদ্রুপ সোমকে সুশোভিত করিতে হয়; তিনি উজ্জ্বল হইয়া শুভ্রবর্ণ পবিত্রের উপর বিস্তারিত হইলেন। দুই হস্তের অঙ্গুলিগণ তাহাকে জলের দিকে চালাইয়া দিতেছে। যেন বলবান্ লোকে রথ চালাইয়া দিতেছে।
১৪। এই সমস্ত সোমরস, যাহার দ্রুতগামী, পণ্ডিত, আনন্দকর এবং তাবৎ বস্তু দিতে পারে, তাহারা কলসের উপরিস্থিত উন্নত পবিত্রে ক্ষরিত হইতেছে।
১৫। সোম যিনি, তিনি রাজা, তিনি দেব, তিনি প্রধান, সত্য, তিনি তরঙ্গে তরঙ্গে ক্ষরিত হইয়া কলসে যাইতেছেন। মিত্র ও বরুণের নিমিত্ত প্রস্তুত হইয়া তিনি চলিয়াছেন। তিনি অতি প্রধান সত্যস্বরূপ।
১৬। এই উজ্জ্বল সতর্ক রাজার ন্যায় সোমদেব কলসের মধ্যে যজ্ঞের অধ্যক্ষদিগের কর্তৃক সংধাবিত হইতেছে।
১৭। মরুৎ পরিবেষ্টিত ইন্দ্রের জন্য প্রস্তুত হইয়া, মত্ততার উৎপাদনকারী সোম ক্ষরিত হইতেছেন। তিনি সহস্রধারায় মেষলোমকে অতিক্রম করিতেছেন। পুরোহিতগণ তাহাকে সুশোভিত করিতেছেন।
১৮। বুদ্ধিমান্ সোম দুই ফলকের উপর শোভিত হইতেছেন এবং স্তুতি বাক্য উৎপাদন করিতে করিতে দেবতাদিগের নিকট যাইতেছেন। তিনি জলের বস্ত্র পরিধানপূর্বক এবং মস্তকে ক্ষীর ধারণ করিয়া কাঠময় পাত্রে উপবেশন করিতেছেন এবং তাহাকে আচ্ছাদন করা হইতেছে।
১৯। হে সোম! তোমার বন্ধুত্ব লাভের জন্য আমি প্রত্যহ তোমাকে আহ্বান করি। বিস্তর রাক্ষস আমার প্রতি অত্যাচার করিতেছে এবং আমাকে ঘেরিয়া দাঁড়াইয়াছে। হে পিঙ্গলবর্ণধারি! আমাকে রক্ষা কর, রাক্ষসদিগকে নিধন কর।
২০। হে সোম! কি দিন, কি রাত্রি, আমি তোমার বন্ধুত্ব লাভের জন্য তোমর নিকট উপস্থিত আছি। হে পিঙ্গলবর্ণধারি! তুমি নিজ কিরণে সূৰ্য্য অপেক্ষাও অধিক দীপ্তিশালী, তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ স্থানে অধিষ্ঠান কর। যেরূপ পক্ষিগণ সূৰ্য্যকে অতিক্রম করিয়া যায়, তদ্রুপ আমরা তোমার নিকট যাইতে ব্যস্ত।
২১। হে সুন্দর অঙ্গুলধারী সোম! তুমি কলসের মধ্যে শোধিত হইবার সময় শব্দ করিতে থাক। হে ক্ষরণশীল! সুবর্ণময়, পিঙ্গলবর্ণ, সর্বজন কামনীয় তুমি বিস্তর অর্থ আনিয়া দিয়া থাক।
২২। মেষলোমের উপর ক্ষরিত হইয়া তুমি শোধিত হইতে হইতে রস বর্ষণ কর এবং জলের মধ্যে শব্দ করিতে থাক। হে ক্ষরণশীল সোম! দুগ্ধের সহিত মিশ্রিত হইয়া তুমি দেবতাদিগের ভবনে গমন কর ।
২৩। হে সোম! সর্বপ্রকার কবিতার প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া অন্ন লাভের নিমিত্ত গমন কর। হে সোম! তুমি শ্রেষ্ঠ এবং দেবতাদিগের আনন্দবিধাতা। তুমি কলসকে ধারণ করিয়া (আশ্রয় করিয়া) থাক।
২৪। হে সোম! পুনঃ পুনঃ তোমাকে সঞ্চয় করা হইতেছে, তুমি মর্ত্য লোকে ও দিবালোকে ক্ষরিত হও। হে পণ্ডিত! মেধাবী ব্যক্তিরা তোমাকে মনন ও ধ্যান করিতে করিতে তোমার শুভ্রবর্ণ রস চালাইয়া দিতেছেন।
২৫। এই যে সোমরস সকল, যাহাদিগের সঙ্গে দেবতারা আছেন, ইন্দ্র যাহাদিগকে সেবন করেন, যাহারা স্তব ও অন্ন লাভের জন্য যাইয়া থাকেন, তাহারা ধারার আকারে প্রস্তুত হইয়া পবিত্রকে অতিক্রম করিতেছেন।
২৬। প্রস্তুতকর্তারা চালাইয়া দিতেছে, সোম জলের বস্ত্র পরিধানপূর্বক কলসের দিকে যাইতেছেন, তিনি জ্যোতিঃ উৎপাদন করিতেছেন, ক্ষীরের সহিত মিশ্রিত হইয়া ধৌত বস্ত্রের ন্যায় হইতেছেন এবং স্তুতির প্রার্থনা করিতেছেন।