ঋগ্বেদ ০৬।১৬

ঋগ্বেদ ০৬।১৬
ঋগ্বেদ সংহিতা । ৬ষ্ঠ মণ্ডল । সূক্ত ১৬
অগ্নি দেবতা । ভরদ্বাজ ঋষি ।

১। হে অগ্নি ! তুমি দেবগণ কর্তৃক মনুর সন্তান মানবগণেব সমস্ত যজ্ঞে হোতারূপে নিয়োজিত হইয়াছ ।
২ । তুমি আমাদিগের যজ্ঞে পুজনীয় শিখাসমূহ দ্বারা মহং দেবগণের যাগ কর। দেবগণকে এস্থানে আনয়ন কর ; তাহাদিগকে হব্য প্রদান কর।
৩। হে সৃষ্টিকারক, সংকৰ্ম্মের অনুষ্ঠানকারী, দেব অগ্নি ! তুমি যজ্ঞ সকলে মহামার্গ ও ক্ষুদ্র পথ অবগত আছ ।
৪ । হে অগ্নি ! তুমি দ্বিত । হব্যদাতা ঋত্বিগ্‌গণের সহিত সুখের উদ্দেশে ভরত রাজা তোমার স্তব করিয়াছিলেন। তুমি যজ্ঞে যজ্ঞার্থ। তিনি তোমার যাগ করিয়াছিলেন (১) ।
৫ । হে অগ্নি ! সোমাভিষবকারী দিবোদাসকে এই সমস্ত নানাবিধ মুখ যেরূপ প্রদান করিয়াছিলে, সম্প্রতি হব্যদাতা ভরদ্বাজকে সেইরূপ সমুদয় প্রদান কর ।
৬ । তুমি অমর দূত ; মেধাবী ভরদ্বাজের শোভন স্তোত্র শ্রবণ করিয়া তুমি দেবগণকে এস্থানে আনয়ন কর ।
৭ । হে দেব অগ্নি ! ধাৰ্ম্মিক মনুষ্যগণ দেবগণের তৃপ্তি সাধনার্থ যজ্ঞ সকলে তোমার স্তব করেন ।
৮ । হে অগ্নি! তুমি দানশীল, আমি তোমার মনোহর দীপ্তির এবং কাৰ্য্যের পূজা করিতেছি। যাহারা তোমার অনুগ্রহে পূর্ণকাম হইয়াছে তাহারা সকলেই তোমার পরিচর্য্যা করে।
৯ । হে অগ্নি ! তুমি শিখারূপ মুখদ্বারা হব্যবহনকারী ও স্ববিচক্ষণ, তোমাকে মনু হোতৃকার্য্যে নিয়োজিত করিয়াছেন। অতএব তুমি স্বৰ্গীয় ব্যক্তিগণের যাগ কর ।
১০ । হে অগ্নি ! তুমি হব্যভক্ষণার্থ আগমন কর এবং দেবগণের নিকট হব্যবহনাৰ্থ স্তুতিভাজন হইয়া হোতাস্বরূপ কুশোপরি উপবেশন কর ।
১১ । হে অঙ্গিরা ! আমরা ইন্ধন ও আজ্যদ্বারা তোমাকে প্রবর্দ্ধিত করিতেছি, অতএব হে যুবতম অগ্নি ! তুমি নিরতিশয় দীপ্তিলাভ কর।
১২ । হে দেব অগ্নি ! তুমি আমাদিগকে প্রশস্ত পুত্রপৌত্ৰাদি সহকারে বিপুল উৎকৃষ্ট ধন প্রদান কর ।
১৩ । হে অগ্নি ! অথর্বা ঋষি শিরোবৎ বিশ্বের ধারণকারী পুষ্কর হইতে মন্থন করিয়া তোমাকে নিঃসারিত করিয়াছেন (২) ।
১৪। অথর্বার পুত্র দধীচি তোমাকে প্ৰজ্জ্বলিত করিয়াছেন। তুমি বৃত্ৰহন্তা ও পুরচিনাশক ।
১৫। হে বর্ষণকারী অগ্নি ! তুমি দস্যুহন্তা ও প্রতিযুদ্ধে ধনবিজয়ী, ঋষি পাথ্য তোমাকে উদ্দীপিত করিয়াছিলেন ।
১৬। হে অগ্নি ! তুমি আগমন কর, কারণ আমি তোমার নিকট এইরূপে স্তোত্র উচ্চারণ করিব। তুমি এই সমস্ত সোমদ্বারা বৰ্দ্ধিত হও ।
১৭। হে অগ্নি ! তুমি যে কোন স্থানে, যে কোন যজমানের প্রতি চিত্ত সমৰ্পিত কর, সেই যজমানকে প্রকৃষ্ট বল প্রদান কর এবং তথায় তুমি অবস্থিতি কর ।
১৮। হে অগ্নি ! ত্বদীয় পূর্ণদাপ্ত যেন দৃষ্টিবিঘাতক না হয়। হে উপাসকগণের গৃহপ্রদাতা ! তুমি আমাদিগের পূজা গ্রহণ কর ।
১৯। আমরা হব্যবাহক, দিবোদাসের শত্রুনিধনকারী, সৰ্ব্বজ্ঞ ও সাধুরক্ষক অগ্নিকে এস্থানে আনয়ন করিয়াছি ।
২০ । নিজ মহিমাদ্বারা শক্রসংহারকারী, অধৃষ্য ও অপ্রতিহত অগ্নি আমাদিগকে প্রচুর পরিমাণে অখিল পার্থিব ধন প্রদান করুন।
২১। হে অগ্নি ! তুমি প্রাচীনবৎ নবীন দীপ্তিদ্বারা এই বিস্তীর্ণ অন্তরিক্ষ আচ্ছন্ন করিয়া রহিয়াছ ।
২২ । হে বন্ধুগণ ! তোমরা শত্ৰুহন্ত ও বিধানকৰ্ত্তা অগ্নির স্তোত্র গান কর এবং তাহাকে হব্য প্রদান কর ।
২৩। যিনি মানবগণের প্রতিযুগে দেবগণের আহ্বানকারী, প্রকৃষ্ট প্রজ্ঞ, দেবগণের দূতস্বরূপ ও হব্যবাহক, সেই অগ্নি যেন আমাদিগের যজ্ঞে উপবেশন করেন ।
২৪ । হে গৃহপ্রদাতা অগ্নি ! তুমি এই যজ্ঞে দুই দীপ্তিমান ও বিশুদ্ধ কৰ্ম্মকারী দেব, মিত্র ও বরুণ এবং আদিত্যগণ, মরুতগণ, স্বর্গ ও পৃথিবীর যাগ কর ।
২৫ । হে শক্তিপুত্র অগ্নি ! তুমি অবিনশ্বর, তোমার প্রশস্ত দীপ্তি মর্ত্য উপাসককে অন্ন প্রদান কর।
২৬ । হে অগ্নি । হব্যদাতা অদ্য কাৰ্য্যদ্বারা তোমার পরিচর্য্যা করিয়া অতি প্রশংসনীয় ও মহৈশ্বৰ্য্যশালী হউক। সেই মানব সৰ্ব্বদা যেন সম্যকরূপে ত্বদীয় স্তোত্র উচ্চারণ করে।
২৭। হে অগ্নি ! ত্বদীয় যে সকল স্তোত্রকারী তোমাকর্তৃক রক্ষিত হয়, তাহার। অল্প কামনা করিয়া আক্রমণকারী শত্রগণকে পরাজিত ও বিনষ্ট করিয়া সমস্ত অন্নলাভ করে ।
২৮। অগ্নি যেন নিজ তীক্ষ্ণ দীপ্তিদ্বার হব্য গ্রহণ করিয়া শত্ৰু সংহার করেন এবংআমাদিগকে ধন প্রদান করেন।
২৯। হে সৰ্ব্বদশী জা স্তবেদ ! তুমি শোভন পুত্রপৌত্ৰাদিসম্পন্ন ধন আহরণ কর। হে সংকন্মের অনুষ্ঠানকারী ! তুমি রাক্ষসগণকে বিনাশ কর।
৩০ । হে জাতবেদা ! তুমি আমাদিগকে পাপ হইতে রক্ষা কর। হে মন্ত্রের উৎপাদক অগ্নি ! তুমি বিদ্বেষকারী হইতে আমাদিগকে রক্ষা কর।
৩১। হে অগ্নি ! যে দুষ্টাভিপ্রায় মানব ভীষণ অস্ত্রদ্বারা আমাদিগকে ভয় প্রদর্শন করে, তাহা হইতে এবং পাপ হইতে আমাদিগকে রক্ষা কর।
৩২। হে দীপ্তি সম্পন্ন অগ্নি ! যে মানব আমাদিগকে বধ করিতে ইচ্ছ করে, সেই দুষ্কৰ্ম্মকারী মনুষ্যকে জ্বালা রূপ জিহ্বাদ্বারা অপসারিত কর।
৩৩। হে শত্রুবিজয়ী অগ্নি ! তুমি ভরদ্বাজকে অপরিমিত সুখ ও বাঞ্ছিত ধন প্রদান কর ।
৩৪। স্তুতিদ্বারা প্রসাদিত, হব্যরূপ ধন লিন্স, প্রজ্বলিত, শুভ্র বর্ণ, অগ্নি শক্ৰদিগকে নাশ করিবার নিমিত্ত হব্যদ্বারা আহুত হইয়াছেন ।
৩৫। মাতা পৃথিবীর গর্ভ ভূত অক্ষয় বেদির উপর দীপ্তিসম্পন্ন এবং পিত। স্বৰ্গলোকের পালনকারী অগ্নি যজ্ঞের উত্তর বেদি নামক স্থানে উপবিষ্ট আছেন।
৩৬। হে সৰ্ব্বদর্শী জাতবেদা ! তুমি আমাদিগের নিকট সন্ততিসহকারে এরূপ অন্ন আনয়ন কর, যাহা স্বৰ্গলোকে দীপ্তি প্রকাশ করে ।
৩৭ । হে শক্তিপুল অগ্নি। তুমি রম্য দর্শন, আমরা হব্যরূপ অন্নপ্রদান পূৰ্ব্বক তোমার নিকট স্তোত্র উচ্চারণ করিতেছি।
৩৮। হে অগ্নি ! তুমি রমণীয় তেজঃসম্পন্ন ও দীপ্তিশালী, তোমার আশ্রয় আমরা ছায়ার ন্যায় গ্রহণ করিতেছি ।
৩৯ । হে অগ্নি ! তুমি বাণদ্বারা শক্রনিহন্ত, প্রচণ্ড বলশালী, ধামুক্ষের ন্যায় এবং তীক্ষশৃঙ্গ বৃষভের ন্যায় পুরী সকল নষ্ট করিয়াছ ।
৪০। ঋত্বিগগণ হব্য ভোজী শোভন যাগ নিম্পাদক যে অগ্নিকে সদ্যজtত শিশুর ন্যায় হস্তে ধারণ করেন সেই অগ্নির পরিচর্যা কর ।
৪১ ৷ দেবগণের ভক্ষ্যদ্রব্যের ভারগ্রহণ করিবার নিমিত্ত প্রকৃষ্ট ধন প্রদাতা দেব অগ্নির আহরণ কর। সেই অগ্নি নিজ উচিত স্থানে উপবেশন করুন।
৪২। প্রাদুর্ভূত, অতিথিবৎ প্রিয়, গৃহাধিপতি অগ্নিকে জ্ঞানপ্রদায়ক আহরণীয় অগ্নিতে সংস্থাপিত কর ।
৪৩। হে দীপ্তিসম্পন্ন অগ্নি ! তুমি সেই সকল স্বশিক্ষিত অশ্বগণকে নিজরখে যোজিত কর, যে সকল অশ্ব তোমাকে শীঘ্ৰ যজ্ঞে আনয়ন করে।
৪৪। হে অগ্নি ! তুমি আমাদিগের অভিমুখে আগমন কর। হব্য ভোজন এবং সোমরস পান করিবার নিমিত্ত দেবগণকে এস্থানে আনয়ন কর।
৪৫। হে হব্যবাহক অগ্নি ! তুমি উদ্ধতভাবে প্রদীপ্ত হও। হে অক্ষয় দীপ্তিসম্পন্ন অমর | তুমি বিশিষ্টরূপে প্রকাশিত হও ।
৪৬। যে কোন হব্য প্রদানকারী মনুষ্য হব্যদ্বারা দেব পূজা করিবেন, তিনিই স্বর্গ ও পৃথিবীর হোতৃভূত, সত্য সহকারে যাগকারী অগ্নির পূজা করেন। তিনি যেন বদ্ধাঞ্জলি হইয়া হব্যদ্বারা অগ্নির পূজা করেন।
৪৭। হে অগ্নি ! আমরা তোমাকে হৃদয়দ্বারা সংস্কৃত ঋক্ রূপ হব্য প্রদান করিতেছি। বলশালী বৃষভ ও ধেনুগণ তোমার নিকট পূৰ্ব্বোক্তরূপ হব্য হউক (৩) ।
৪৮। অগ্নি শক্রর ধন হরণ করিয়াছেন এবং রাক্ষসগণের সংস্থার করিয়াছেন। দেবগণ অগ্নিকে প্রধান ও প্রধানতঃ বৃত্ৰহন্তা বোধ করিয়া উদ্দীপিত করেন ।

———————
( ১ ) সায়ণ এই ঋকের উল্লিখিত ভরতকে দুষ্মন্ত তনয় ভারত মনে কfরয়াছেন । “দ্বিত” অর্থে দুই গুণ যুক্ত অথবা দুই কাষ্ঠ হইতে উৎপন্ন। ফলতঃ “ত্রিত” শব্দের দেখাদেখি “একত” ও “দ্বিত” শব্দ দুটী উৎপন্ন করা হইয়াছে। ১।৫২।৫ ঋকের টীকা দেখ।
(২) অথর্বা পুষ্কর হইতে অগ্নিকে মন্থন করিয়া উৎপন্ন করিয়াছিলেন, ইহার অর্থ কি? সায়ণ প্রজাপতিদ্বারা পদ্মপত্রের উপর জগতের সৃষ্টির পৌরাণিক কথা অবলম্বন করিয়া পুষ্কর অর্থে এখানে পদ্ম করিয়াছেন। সামবেদের টীকাকার মহীধর পুষ্কর অর্থে জল এবং অথর্বা অর্থে বায়ু করিয়া একটি অর্থ করিয়াছেন। ফরাসী পণ্ডিত লাংলোয়া পুষ্কর অর্থে করিয়াছেন অরণি কাষ্ঠের ছিদ্র যাহা হইতে অগ্নি উৎপন্ন হয়। আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, যে সমস্ত ঋষিগণ প্রথমে আর্য্যাবর্ত্তে অগ্নির যজ্ঞ বিশেষরূপে প্রচার করেন, অথর্বা ও তৎপুত্র দধীচি ও তাহাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন। ১।১১।৩ ঋকের টীকা দেখ। অতএব এই ঋকেও সেই অথর্বা ঋষি কর্তৃক অগ্নি উৎপাদনের কথারই উল্লেখ আছে মাত্র। পরের দুইটি ঋক দেখ।
(৩) এখানে গো ও বৃষ আহুতি প্রদানের উল্লেখ পাওয়া যায়।