উৎকোচ তত্ত্ব
লোকনাথ পাল জেলা জজ, অতি ধর্মভীরু, খুঁতখুঁতে লোক। তিনি সর্বদা ভয়ে ভয়ে থাকেন পাছে ধূর্ত লোকে তাঁকে দিয়ে কোনও অন্যায় কাজ করিয়ে নেয়। ছ মাস পরেই তাঁকে অবসর নিতে হবে, জজিয়তির শেষ পর্যন্ত যাতে দুর্নীতির লেশমাত্র তাঁকে স্পর্শ না করে সে সম্বন্ধে তিনি খুব সতক। উৎকোচ তত্ত্ব বিষয়ক একটি গ্রন্থ রচনার ইচ্ছা তাঁর আছে, সময় পেলেই তার জন্যে তিনি একটি খাতায় নোট লিখে রাখেন। আজ রবিবার, অবসর আছে। সকালবেলা একতলায় তাঁর অফিসঘরে বসে লোকনাথ নোট লিখছেন।–
কৌটিল্য বলেছেন, মাছ কখন জল খায় আর রাজপুরুষ কখন ঘুষ নেয়, তা জানা যায় না। কিন্তু একটি কথা তিনি বলেন নি–ঘুষগ্রাহী অনেক ক্ষেত্রে নিজেই বুঝতে পারে না যে সে ঘুষ নিচ্ছে। পাপ সব সময় স্বলরপে দৃষ্টিগোচর হয় না, অনেক সময় সক্ষম বা সক্ষমাতিসক্ষেরপে দেখা দেয়, তখন তার স্বরূপ চেনা বড়ই কঠিন। স্পষ্ট ঘুষ, প্রচ্ছন্ন ঘুষ আর নিষ্কাম উপহার—এদের প্রভেদ নির্ণয় সকল ক্ষেত্রে করা যায় না। মনে করুন, রামবাবু একজন উচ্চপদস্থ লোক, তাঁর অফিসে একটি ভাল চাকরি খালি আছে। যোগ্যতম প্রার্থীকেই মনোনীত করা তাঁর কর্তব্য। শ্যামবাবুর জামাই একজন প্রার্থী, যথানিয়মে দরখাস্ত করেছে। শ্যামবাবু রামবাবুকে বললেন, আপনার হাতেই তো সব, দয়া করে আমার জামাইকেই সিলেক্ট করবেন, হাজার টাকা দিচ্ছি, বাহাল হয়ে গেলে আরও হাজার দেব। এ হল অতি স্থূল ঘুষ, নির্লজ্জ পাকা ঘুষখোর কিংবা দুর্বলচিত্ত লোভী ভিন্ন কেউ নিতে রাজী হয় না। অথবা মনে করুন, রামবাবুর সঙ্গে শ্যামবাবুর ঘনিষ্ঠ পরিচয় আছে। এক হাঁড়ি সন্দেশ এনে শ্যামবাবু বললেন, কাশী থেকে আমার মা এনেছেন, খেয়ো। আমার জামাইকে তো তুমি দেখেছ, অতি ভাল ছোকরা। তার দরখাস্তটা একটু বিবেচনা করে দেখো ভাই, তোমাকে আর বেশী কি বলব। এও স্থূল ঘুষ, যদিও পরিমাণে তুচ্ছ। কিন্তু ধরুন, কোনও অনুরোধ না করে শ্যামবাবু এক গোছা গোলাপফুল দিয়ে বললেন, আমাদের মধুপুরের বাগানে হয়েছে। এ হল সক্ষম ঘুষ, এর ফল নিতান্ত অনিশ্চিত, তবে নিরাপদ জেনেই শ্যামবাবু দিতে সাহস করেছেন। আশা করেন এতেই রামবাবুর মন ভিজবে। আবার মনে করুন, রামবাবুর মেয়ের অসুখ, শ্যামবাবুর স্ত্রী এসে দিন রাত সেবা করলেন, অসুখও সারল এক্ষেত্রে তাঁর স্ত্রীর সেবা অনুচ্চারিত অনুরোধ অর্থাৎ অতি সক্ষম ঘুষ হতে পারে, অথবা নিঃস্বার্থ পরোপকারও হতে পারে, স্থির করা সোজা নয়। রামবাবু যদি দৃঢ়চিত্ত সাধুপুরুষ হন তবে শ্যামের জামাইএর প্রতি কিছুমাত্র পক্ষপাত করবেন না, তবে অন্যভাবে অবশ্যই কৃতজ্ঞতা জানাবেন। কিন্তু রামবাবু যদি বন্ধুবৎসল কোমলপ্রকৃতির লোক হন তবে শ্যাম-গৃহিণীর সেবা হয়তো জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে তাঁকে প্রভাবিত করবে। এ ছাড়া বাঙ্ময় ঘুষ আছে যার আর্থিক মূল্য নেই, অর্থাৎ খোশামোদ বা প্রশংসা। নিপুণভাবে প্রয়োগ করলে বুদ্ধিমান সাধুলোকও এর দ্বারা প্রভাবিত হয়–
লোকনাথের নোট লেখায় বাধা পড়ল। দরজা ঠেলে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক ঘরে এসে বললেন, কেমন আছ লোকনাথ বাবাজী, অনেক কাল তোমাদের দেখি নি। সেকি, চিনতে পারছ না? আরে আমি হলাম তোমাদের মোহিত পিসেমশাই, বেহালার মোহিত সমাজদার। কই রে, পারলে কোথা আছিস, এদিকে আয় না মা।
হাঁকডাক শুনে লোকনাথ-গৃহিণী পারুলবালা এলেন। আগন্তুক লোকটিকে চিনতে তাঁরও কিছু দেরি হল। তার পর মনে পড়লে প্রণাম করে বললেন, মোহিত পিসেমশাই এসেছেন! উঃ কি ভাগ্যি!
অগত্যা লোকনাথও একটা নমস্কার করলেন।
মোহিত সমজদার হাঁক দিলেন, রামবচন, জিনিসগুলো এখানে নিয়ে আয় বাবা। মোহিতবাবর অনুচর বাইরে অপেক্ষা করছিল, এখন ঘরে এসে মনিবের সামনে চারটে বাণ্ডিল রাখল।
একটা কার্ডবোর্ড বাক্স পারুলবালার হাতে দিয়ে মোহিতবাবু বললেন, আসল কাশ্মীরী শাল, তোর জন্যে এনেছি, দেখ তোর পছন্দ হয় কিনা।
শাল দেখে পারুলবালা আহ্লাদে গদগদ হয়ে বললেন, চমৎকার, অতি সুন্দর।
মোহিতবাবু বললেন, লোকনাথ বাবাজী, তোমার তো কোনও শখই নেই, শুধু বই আর বই। তাই একটা ওআলনট কাঠের কিতাব দান মানে বুকে ব্ল্যাক এনেছি। আর এই বাক্সটায় কয়েক গজ কাশ্মীরী তাফতা আছে, একটা শাড়ি আর গোটা দুই ব্লাউজ হতে পারবে। আর এই চুবড়িটায় কিছু মেওয়া আছে, পেস্তা বাদাম আখরোট কিশমিশ মনাক্কা এই সব।
কুণ্ঠিত হয়ে লোকনাথ বললেন, আহা কেন এত সব এনেছেন, এ যে বিস্তর টাকার জিনিস। না না, এসব দেবেন না।
মোহিতবাবু বললেন, আরে খরচ করলেই তো টাকা সার্থক হয়। তোমরা আমার স্নেহপাত্র, তোমাদের দিয়ে যদি আমার তৃপ্তি হয় তবে দেব না কেন, তোমরাই বা নেবে না কেন?
পারুলবালা বললেন, নেব বই কি পিসেমশাই, আপনার স্নেহের দান মাথায় করে নেব। তার পর, এখন কোথা থেকে আসা হল? দিল্লি থেকে? পিসিমাকে আনলেন না কেন? তিনি আর ছেলেমেয়েরা সব ভাল আছেন তো?
–সব ভাল। তাদের একদিন নিশচয় আনব। অনেক কাল পরে কলকাতায় এলুম, বেহালার বাড়িখানা যাচ্ছেতাই নোঙরা করে রেখেছে। একটু গোছানো হয়ে যাক তার পর তোর পিসীকে নিয়ে একদিন আসব। মানানানান, চা-টা কিছু নয়, আমার এখন মরবার ফুরসত নেই, নানা জায়গায় ঘুরতে হবে। আজ চললুম। ঝড়ের মতন এলম আর গেলম, তাই না? কিছ, মনে করো না। তোমরা, সুবিধে মতন আবার একদিন আসব।
পারুলবালাকে প্রশ্ন করে লোকনাথ জানলেন, মোহিতবাবু তাঁর আসল পিসে নয়, পিসের ভাই। ছেলেবেলায় তাঁর বাপের বাড়িতে আসল পিসের সঙ্গে তাঁর এই ভাইও মাঝে মাঝে আসতেন, সেই সূত্রে পরিচয়। তার পর কালে ভদ্রে তাঁর দেখা পাওয়া যেত। মোহিতবাবু নানা রকম কারবার ফেদেছিলেন। কোনওটারই এখন অস্তিত্ব নেই, কিন্তু সেজন্যে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মনে হয় না। তাঁর অবস্থা ভালই, বড় বড় লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব আছে। এখন তিনি কি করেন জানা নেই।
লোকনাথ তাঁর অফিসঘরে বসে ভাবতে লাগলেন। মামার শালা পিসের ভাই, তার সঙ্গে সম্পর্ক নাই। মোহিতবাবুর স্নেহ হঠাৎ উথলে উঠল কেন? বহুকাল আগে লোকনাথ তাঁর শ্বশুরবাড়িতে এই কৃত্রিম পিসেমশাইটিকে দেখে থাকবেন, কিন্তু এখন মনে পড়ে না। আপাতত মোহিতবার কোনও দোষও ধরা যায় না, তিনি বহুমূল্য উপহার দিয়েছেন কিন্তু কিছুই চান নি। হয়তো দিন দুই পরেই একটা অন্যায় অনুরোধ করে বসবেন।
লোকনাথ তাঁর পত্নীকে বললেন, দেখ, তোমার পিসেমশাইএর জিনিসগুলো এখন তুলে রাখ, হয়তো ফেরত দিতে হবে। ওই সব দামী দামী উপহারের জন্যে অস্বস্তি বোধ করছি, তাঁর মতলব বুঝতে পারছি না।
পারুলবালা বললেন, মতলব আবার কি, আমাদের ভালবাসেন তাই দিয়েছেন।
-উনি তোমার আপন আত্মীয় নন, ওঁর নিজের ছেলেমেয়েও আছে, তবে হঠাৎ আমাদের ওপর এত স্নেহ হল কেন?
–খুঁত ধরা তোমার স্বভাব। থাকলই বা নিজের ছেলেমেয়ে, পরের ওপর কি টান হতে নেই? পিসেমশাই বড়লোক, উঁচু নন, তিনি দামী জিনিস উপহার দেবেন তাতে ভাববার কি আছে? তোমাকে তো ঘুষ দেন নি।
যাই হক, তুমি এখন ওগুলো ব্যবহার করো না।
পারুলবালা গরম হয়ে বললেন, কেন করব না? এমন জিনিস তুমি কোনও দিন আমাকে দিয়েছ, না তুমি তার কদর জান? পিসেমশাই যদি ভালবেসে দিয়ে থাকেন তবে তুমি বাদ সাধবে কেন? আর, দামী জিনিস তোমাকে তো দেন নি, আমাকে দিয়েছেন। তুমি যে কাঠের র্যাকটা পেয়েছ সেটা না হয় ফেরত দিও।
লোকনাথ চুপ করে গেলেন।
দুদিন পরে মোহিতবাবু আবার এলেন। সঙ্গে তাঁর পত্নী আসেন নি, একজন অচেনা ভদ্রলোক এসেছেন।
মোহিতবাবু বললেন, বাড়ির সব ভাল তো লোকনাথ? ইনি হচ্ছেন শ্রীগিরধারীলাল পাচাড়ী, মস্ত কারবারী লোক, আমার বিশিষ্ট বন্ধ। ইনি একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন।
লোকনাথ ভাবলেন, এইবারে পিসের গোপন কথাটি প্রকাশ পাবে। জিজ্ঞাসা করলেন, কি প্রস্তাব?
–আচ্ছা বাবাজী, তোমার সার্ভিস শেষ হতে আর কত দেরি?
-এখন এক্সটেনশনে আছি, ছ মাস পরেই শেষ হবে।
–তার পর কি করবে স্থির করেছ?
–কিছুই করব না, লেখাপড়া নিয়ে থাকব।
হাত নেড়ে মোহিতবাবু বললেন, নানানানানা, বসে থাকা ঠিক নয়। তোমার শরীর ভালই আছে, মোটেই বুড়ো হও নি, তবে রোজগার করবে না কেন? শাস্ত্রে বলে, অজরামরবং প্রাজ্ঞো বিদ্যামর্থ চিয়েৎ। তুমি হচ্ছ প্রাজ্ঞ লোক, অর্থ উপার্জনের সঙ্গেই বিদ্যাচর্চা করবে। যা বলছি বেশ করে বিবেচনা করে দেখ বাবাজী।
মোহিতবাবু তাঁর মাথাটি এগিয়ে দিয়ে বিশ্বস্তভাবে নিম্নকণ্ঠে বললেন, এই গিরধারীলাল পাচাড়ীজী হচ্ছেন সিকিম স্টেটের মত বড় কন্ট্রাক্টার। পশম কম্বল কাঠ মগনাভি বড়-এলাচ চিরেতা মাখন ঘি এই সব জিনিস ওখান থেকে এদিকে চালান দেন, আবার সতী কাপড় চাল গম তেল চিনি নন কেরোসিন প্রভৃতি এখানে সপ্লাই করেন। সিকিমের আমদানি রপ্তানি এরই হাতে, মহারাজও একে খুব খাতির করেন, নানা বিষয়ে পরামর্শ নেন। মহারাজ একে বলেছেন, বলন নং গিরধারীবাবু, নিজেই বলুন না।
গিরধারী বললেন, শুনেন হুজুর। মহারাজ তাঁর বড় আদালতের জন্যে একজন চীফ জজ চান। ওখানকার লোকদের ওপর তাঁর বিশ্বাস নেই, মনে করেন সবাই ঘুষখোর। ভাল লোকের খোঁজ নেবার ভার আমাকেই দিয়েছেন, তাই আমি মোহিতবাবুকে ধরেছিলাম। এর কাছে শুনেছি আপনিই উপযুক্ত লোক, যেমন বিদ্বান বুদ্ধিমান তেমনি ইমানদার সাধপুরুষ।
লোকনাথ বললেন, জজের দরকার থাকে তো সিকিম সরকার ভারত সরকারকে লিখলেন না কেন?
মোহিতবাবু বললেন, লিখবেন লিখবেন। মহারাজ নিজে লোক স্থির করবেন তার পর ইণ্ডিয়া গভরমেন্টকে লিখবেন, অমককে আমার পছন্দ, তাঁকেই পাঠানো হক। কোনও বাজে লোক দিল্লি থেকে আসে তা তিনি চান না। খুব ভাল পোস্ট, দশ বছরের জন্যে পাকা। এখানকার হাইকোর্ট জজের চাইতে বেশী মাইনে, চমৎকার ফ্রী কোআর্টস, ফ্রী মোটরকার, আরও নানা সুবিধে। তুমি যদি রাজী হও তবে গিরধারীজী নিজে গিয়ে মহারাজকে বলবেন।
লোকনাথ বললেন, আমি না ভেবে বলতে পারি না।
–ঠিক কথা, ভাববে বইকি। বেশ করে বিবেচনা করে দেখ, পারলের সঙ্গেও পরামর্শ কর, অতি বুদ্ধিমতী মেয়ে। কিন্তু বেশী দেরি করো না, মহারাজ তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা সেটল করতে চান, ইনি আবার চায়না জাপান বেড়াতে যাবেন কিনা। দিন কতক পরে আবার দেখা করব।
লোকনাথের অস্বস্তি বেড়ে উঠল, তিনি আবার ভাবতে লাগলেন। এই পিসেমশাইটি অদ্ভুত লোক, কেবল অনগ্রহই করছেন, এখন পর্যন্ত প্রতিদান কিছুই চাইলেন না। দেখা যাক, আবার যেদিন আসবেন সেদিন তাঁর ঝুলি থেকে বেরাল বার হয় কিনা।
দু সপ্তাহ পরে মোহিতবাবু একাই এলেন। এসেই প্লান মুখে বললেন, গিরধারীলালজী আসতে পারলেন না, তাঁর মনটা বড়ই খারাপ হয়ে আছে।
–কি হয়েছে?
আর বল কেন, ভদ্রলোক মহা ফেসাদে পড়েছেন। তাঁর মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ পাকা হয়ে আছে, রামশরণ পোন্দারের ছেলে শিবশরণের সঙ্গে। কিন্তু শিবশরণের মাথার ওপর খাঁড়া ঝুলছে, এখন বেলে খালাস আছে। ছোকর। এদিকে ভালই, তবে বড়লোকের ছেলে, কুসঙ্গে পড়ে একটু চরিত্রদোষ ঘটেছিল। ব্যাপারটা কাগজে পড়ে থাকবে, প্রায় আট মাস আগেকার ঘটনা। তবলাওয়ালা লেনে তিতলীবাঈ নাচওআলী থাকত, তার কাছে শিবশরণ যেত, তার দু চারজন বন্ধও যেত। দুপুর রাতে তিতলী যখন বেহশ হয়ে ঘুমচ্ছিল তখন কোনও লোক তার পিঠে ছোরা মেরে পালিয়ে যায়। তিতলী বেচে আছে, কিন্তু খুবই জখম হয়েছে। পুলিস শিবশরণকেই সন্দেহ করে চালান দেয়। আমাদের সকলেরই আশা ছিল যে শিবশরণ খালাস পাবে, কিন্তু সম্প্রতি ম্যাজিস্ট্রেট তাকে দায়রা সোপর্দ করেছেন। ভাবী জামাইএর এই বিপদে গিরধারীলাল পাচাড়ী অত্যন্ত দমে গেছেন, তাঁর মেয়েও কান্নাকাটি করছে। তবে আমি বেশ ভালই জানি যে ছোকরা একবারে নির্দোষ, তার কোনও বন্ধুই এই কাজ করে সরে পড়েছে।
লোকনাথের মুখ লাল হল। বললেন, দেখুন, এ সম্বন্ধে আমাকে আর কোনও কথা বলবেন না। সেসনসে আমার কোটেই কেসটা আসবে।
প্রকাণ্ড জিব কেটে মোহিতবাবু বললেন, অ্যা, তাই নাকি? নানানানানা, তা হলে তোমাকে আর কিছুই বলা চলবে না। তবে গিরধারীর জন্যে আমারও মনটা বড় খারাপ হয়ে আছে। আচ্ছা, মকদ্দমাটা ভালয় ভালয় চুকে যাক, শিবশরণ খালাস পেলেই গিরধারী বাবু নিশ্চিন্ত হয়ে সিকিম রওনা হবেন। বসসা বাবাজী, চললম।
পাঁচ দিন পরে লোকনাথ তাঁর অফিস ঘরে বসে কাগজ পড়ছেন,। হঠাৎ গিরধারীলাল পাচাড়ী স্মিতমুখে এসে বললেন, নমস্কার
লোকনাথ বিরক্ত হয়ে বললেন, দেখুন পাচাড়ীজী, সেদিন মোহিতবাবুর কাছে যা শুনেছি তার পর আপনার সঙ্গে আমি আর কোনও কথা বলতে চাই না। আপনি এখন যান।
গিরধারীলাল হাত নেড়ে বললেন, আরে রাম রাম, সেসব কথা আপনি একদম ভুলে যান। রামশরণ আমার কেউ নয়, তার বেটা শিবশরণও কেউ নয়। সে খালাস পাবে কি না পাবে, তাতে আমার কি।
–কেন, সে তো আপনার ভাবী জামাই।
–থুঃ। আমার বেটী বলেছে, ওই লুচ্চা খুনী আসামীকে সে কিছুতেই বিয়া করবে না। এখন হুজুর যদি তাকে ফাঁসিতে লটকে দেন তাতে আমার কোনও ওজর নেই।
লোকনাথ বললেন, ওই কেস আমার কোর্টে আসবে না, অন্য জজের এজলাসে যাবে। আপনাদের প্রস্তাবের পর আমি আর এই মামলার বিচার করতে পারি না।
–বড় আফসোসের কথা। বদমাশটাকে হুজুর যদি কড়া সাজা দিতেন তো বড় ভাল হত। আচ্ছা, ভগবান সব কুছ মঙ্গলের জন্যেই করেন। তবে আমার বড়ই নকসান হল, শিউশরণকে সোনার ঘড়ি, হীরা বসানো কোটের বোতম, আঙটি এই সব দিয়েছিলাম, তা আর ফেরত দেবে না বলেছে। হুজুর যদি ওকে দশ বছর কয়েদ দিতেন তো ঠিক সাজা হত। ওই মোহিতবাবুর মারফত আরও কিছ, খরচ হয়ে গেল।
–আমাকে যে সব উপহার দিয়েছিলেন তারই জনন তো?
–হেঁ হেঁ, যেতে দিন, যেতে দিন।
–বলুন না, আপনার কত খরচ পড়েছিল।
গিরধারীলাল তাঁর নোটবুক দেখে বললেন, দুটো শাল এগার শ টাকা, তাফতা দেড় শ টাকা, কিতাবদান পঁয়তাল্লিশ টাকা, মেওয়া ছত্রিশ টাকা, ট্যাক্সি ওগয়রহ ষোল টাকা, মোট তেরো শ সাতচল্লিশ টাকা।
আশ্চর্য হয়ে লোকনাথ বললেন, শাল তো একখানা ছিল।
-বলেন কি! একটা আপনার আর একটা শ্ৰীমতীজীর জন্যে কিনবার কথা। ওই শালা মোহিতবাবু একটা শালের দাম চুরি করেছে। দেখে নেবেন, আমি ওর গলায় পা দিয়ে সাড়ে পাঁচ শ টাকা আদায় করে নেব। আমার সঙ্গে বেইমানি চলবে না, জরর আদায় করব।
—তা করবেন। বাকী সাত শ সাতানব্বই টাকার একটা চেক আমি আপনাকে দিচ্ছি, আমার জন্যে আপনার লোকসান হবে না। একটা রসিদ লিখে দিন।
গিরধারীলাল যুক্ত কর কপালে ঠেকিয়ে বললেন, ও হোহোহো, হুজুর একদম সচ্চা সাধু মহাত্মা আছেন, খুদ ভগবান আছেন, আপনার দয়া ভুলব না।
–সিকিমের চাকরিটাও চাই না।
গিরধারীলাল পাচাড়ী সলজ্জ প্রসন্ন মুখে দন্তবিকাশ করে বললেন, হেহেহে।
চেক নিয়ে পাচাড়ীজী প্রস্থান করলেন। লোকনাথের গ্লানি দূর হল, তিনি সোৎসাহে উৎকোচ তত্ত্ব রচনায় মনোনিবেশ করলেন।