উপসংহার
বিজয় তার ঘরের কড়িকাঠ থেকে ঝুলছিল। তার লেখার টেবিলে কবিতার খাতায় তার জবানবন্দী পাওয়া যায়। বিজয় লিখেছিলঃ
“আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। জানি, আমার জন্য সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবে জয়। জয়ার মনটা শক্ত। সে সহ্য করতে পারবে। জয়ের জন্যেই মরতে একটু দ্বিধা ছিল। নইলে ৯ই সেপ্টেম্বর রাতেই ঠিক করেছিলুম আমি মরব। পারিনি। শেষে শরদিন্দু খুন হল। তখন ঠিক করলাম, যে পাপ করেছি-জয়ের প্রতি বিশ্বাসভঙ্গের মহাপাপ, তার প্রায়শ্চিত্ত করার আগে অন্তত একটা ভাল। কাজ করে যাই। জয়কে জানয়ে দিই যে সত্যি আমি রমলাকে খুন করিনি। শরদিন্দুর খুনী যে, সেই রমলার খুনী। কিন্তু জয় আমার কথা যদি আর বিশ্বাস না করে! তাই কলকাতায় গিয়ে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে নিয়ে এলাম। আমার বিশ্বাস ছিল, কর্নেল শরদিন্দুর মৃত্যুরহস্য ভেদ করলেই রমলার মৃত্যুরহস্য জেনে ফেলবেন এবং জয়কে জানিয়ে দেবেন যে বিজয় রমলাকে খুন করেনি–জয়ের ধারণাটাই ভুল। কিন্তু কর্নেলের দেখলুম পাখি-প্রজাপতির দিকে যত মন, আমার কাজটার দিকে তত নেই। ওয়ার্থলেস! আমি চাইছিলুম, উনি নিজের বুদ্ধির জোরে সব জেনে নিন। তাহলে জয়ের বিশ্বাস হবে। আমি বলেছি শুনলে জয় বিশ্বাস করবে না। কারণ জয়ের বিশ্বাস হারিয়েছি কলকাতায় থাকার সময়েই।
হা–আমার পাপের সূত্রপাত কলকাতায় থাকার সময়।
রমলা আমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে কোনো তফাত বুঝতে পারত না প্রথম প্রথম। শুধু চেহারার জন্য নয়, জয় আমাকে রমলার ব্যাপারে কোনো কথা গোপন করত না বলেই। রমলা আমাকে জয় ভেবে সেইরকম ব্যবহার করত এবং আমি সেই সুযোগ নিতুম। জয়ের মেজাজ নকল করতুম। জয় ওর সঙ্গে মেলামেশার জন্য গোপনে ফ্রিস্কুল স্ট্রিটে একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিল। জয়ের অনুপস্থিতির সুযোগে রমলাকে সেখানে নিয়ে যেতুম। বিস্তারিত লেখার প্রয়োজন দেখি না। এভাবেই চলছিল। কিন্তু জয় এবং রমলা দুজনেই। ব্যাপারটা ধরে ফেলেছিল কিছুদিনের মধ্যেই। তারপর জয় আমার সঙ্গে ঝগড়া করে আর এম. এ.-তে ভর্তি হল না। কলকাতা ছেড়ে চলে গেল। তারপর আমি রমলাকে পাওয়ার চেষ্টা করেছিলুম। রমলা আমাকে ঘৃণায় প্রত্যাখ্যান। করেছিল।
কিন্তু রমলাকে আমি ভালবেসে ফেলেছিলুম। তার কথা কিছুতেই ভুলতে পারিনি। তার নামে অসংখ্য কবিতা লিখেছি। সব রেখে যাচ্ছি। সে জয়ের. প্রেমিকা, তাই আমারও প্রেমিকা। কারণ জয় আর আমি যে একই আত্মার দুটি অংশ। কেমন করে ভুলব রমলাকে?
গত ৯ই সেপ্টেম্বর যখন জয় আমাকে জানাল, রমলার চিঠি এসেছে–আজই সাড়ে ছটায় আপ দিল্লি এক্সপ্রেসে সে আসছে, আমি লোভে অস্থির হয়ে উঠলুম। জয়ের জুতে গিয়ে সাপটার খাঁচা খুলে দিলুম। জানতুম, জয় সাপটাকে আগে না খুঁজে কোথাও যাবে না। রমলার চেয়েও ওর এই নেশাটা এখন বেশি। স্টেশনে রমলা আমাকে ভাল করে যাচাইয়ের চেষ্টা করছিল। কিন্তু তার চিঠিটা আমার কাছে। জয় আমাকে দিয়েছে সেটা। রমলা আমাকে জয় না। ভেবে যাবে কোথায়? ওকে মিথ্যা করে বললুম, এখন সরাসরি বাড়ি নিয়ে। গেলে স্ক্যাণ্ডাল উঠবে–রাজবাড়ির ব্যাপার। তাই আপাতত আউটহাউসে যাই। কিন্তু জয়ের কথা ভেবে ওকে হরটিলার দিকে নিয়ে চললুম। আমনি রমলার। সন্দেহ হল। সে টিলার নিচে গিয়ে বেঁকে দাঁড়াল। আমি তখন ওকে পাওয়ার জন্য উন্মাদ। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। নির্জন জঙ্গল। আমি ওকে জড়িয়ে ধরলুম। সে আমাকে চড় মারল। গালাগালি দিতে শুরু করল। জানাজানির ভয়ে আমি তখন ওকে ফেলে দৌড়ে পালিয়ে গেলুম। হঠকারিতায় এতখানি এগিয়ে আমার জ্ঞান ফিরে এসেছিল এতক্ষণে।
তারপর লজ্জায়, দুঃখে, অনুতাপে আমি আর বাড়ি থেকে বেরোইনি। প্রতিমুহূর্তে ভাবছি, জয় এসে আমাকে চার্জ করবে। কিন্তু জয়ের সাড়া নেই। রঙ্গিয়া খেতে ডাকতে এল। বললুম, “খাব না। শরীর ভালো নেই।” রাত দশটায় হঠাৎ বুদ্বুরাম এসে সেলাম দিল। বললুম “কী চাই?” বুদ্বুরাম একটু হেসে বলল, “হরটিলার নিচের জঙ্গলে একটা লাশ পড়ে আছে।” চমকে বললুম, “কী বাজে কথা বলছিস হতভাগা?” বুষ্টু বলল যে, লাশটার কথা সে কাউকে বলবে না–যদি আমি তাকে একশো টাকা দিই। থরথর করে কেঁপে উঠলুম। রমলাকে কি জয়ই রাগের বশে খুন করে ফেলেছে? তবে সেই শুরু হল বুদ্বুরামের ব্ল্যাকমেল করা। যখন-তখন সে টাকা দাবি করে। শুধু জয়ের কথা ভেবে মুখ বুজে থাকি। টাকা দিই। অবশেষে শরদিন্দুকে গোপনে ব্যাপারটা জানালুম। শরদিন্দু বলল, যে একজন প্রাইভেট ডিডেটিভ লাগিয়ে রমলার ডেডবডিটা উদ্ধার করে বুন্ধুকে সরিয়ে দেওয়া দরকার। কারণ তার বিশ্বাস খুনটা বুদ্বুই করেছে। অথচ, মাধবজি আভাসে বলেছেন, হরটিলার নিচে একটা ডেডবডি পড়ে থাকতে দেখেছিলেন। বিপ্রদাসজিকে গোপনে বলে সেটা গুম করে দিয়েছেন। তার আগে জয়কে নাকি ওখান থেকে পালিয়ে আসতে দেখেছিলেন। শুনে আমি আরও ভয় পেয়ে গেলুম। শরদিন্দুই আমাকে কর্নেলের কথা বলেছিল।
১৩ সেপ্টেম্বর রাতে শরদিন্দু চিতাবাঘের হাতে মারা পড়ল। তখনও তলিয়ে কিছু ভাবিনি। পরদিন বুদু আবার টাকা চাইতে এসে বলল যে, সেই মেয়েটার ডেডবডি কোথায় পোঁতা আছে সে জানে। কাজেই তাকে দ্বিগুণ টাকা দিতে হবে।
তারপর আর দ্বিধা না করে কর্নেলের খোঁজে কলকাতা গেলুম। পাঁচদিন কলকাতায় থাকার পর তার ঠিকানা যোগাড় করা গেল। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় একটা খবর না, পড়লে ঠিকানা যোগাড় করতে পারতুম না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী লাভ হল? উল্টে উনি আমাকেই সন্দেহ করে বসলেন। আমার ভয় হল, বুদ্বুরামের ব্ল্যাকমেলের কথা বললেই হয়তো বুদ্বুরামকে গ্রেফতার করবেন এবং বুদ্বুরাম আমাকে অথবা জয়কে ফাসাবে। মাধবজিও সাক্ষী দেবেন নিশ্চয়। তারপর কর্নেলের কথামতো বুদ্বুরামকে ভাগলপুর পাঠানোর জন্য ডাকলুম। শয়তান বুদ্বুরাম বলল যে, আরও একটা ডেডবডির খোঁজ সে পেয়েছে। সেটা আছে বিপ্রদাসজির ঘরে। বডিটা না সামলালে কুমারসাবের বিপদ হবে। ওকে জিজ্ঞেস করলুম বডিটা কাকাবাবুর কি না। বুদু বলল যে তাই বটে। ভয় পেয়ে ওকে বললুম, “বডিটা রাত্রেই সামলে দে। টাকা দিচ্ছি।” টাকা নিয়ে বুদ্ধ বলল, “নিশ্চিন্তে থাকুন ছোটোকুমারসাব। রাত্তিরেই সামলে দিব।”
কিন্তু সামলাতে পারেনি। হরটিলার শিবলিঙ্গের তলায় নাকি রমলার লাশ বিপ্রদাসজি লুকিয়ে ফেলেছেন। সকালে বুদ্ধ আমাকে সেকথা বলল। তারপর বলল, “বড়কুমারসাব কুকুর নিয়ে সারারাত পাহারায় ছিলেন। তাই লাশটা গুম করা গেল না।” বিপদ দেখে বললুম, “তুই কত পেলে চিরকালের জন্য রাজবাড়ি ছেড়ে চলে যাবি বল?” বুদু পাঁচহাজার টাকা চাইল। ওকে তাই দিলুম। কবিতার বই ছাপানোর জন্য যে পাঁচহাজার টাকা ব্যাংকে আমার অ্যাকাউন্ট থেকে তুলে এনেছিলুম, তার সবটাই চলে গেল বুদ্বুর খপ্পরে।
দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় কর্নেলের ঠিকানার খোঁজে এক সাংবাদিক ভদ্রলোকজয়ন্ত চৌধুরী বোধ করি তাঁর নাম, হাসতে হাসতে বলেছিলেন, “বুড়ো ঘুঘুকে কী দরকার? রহস্যময় কিছু ঘটছে কি?” আমি বুড়ো ঘুঘু’ কথাটা সেই প্রথম শুনি।
গতরাতে কর্নেলকে ইশারায় সজাগ করে দেবার জন্য ভূতের গল্প বলে একটা ছড়া উপহার দিয়েছিলুম বুড়ো ঘুঘুর নামে। এখন মনে হচ্ছে, উনি যদি আমাকে ছড়াটা নিয়ে জেরা শুরু করতেন তাহলে রাতেই সব কথা বলে ফেলতুম। উনি ছড়ার দিকে মনই দিলেন না। উল্টে জিগ্যেস করলেন, যে কবে থেকে আমি দাড়ি রাখছি। শুনেই বুঝলুম, রমলা ও শরদিন্দুর খুনের জন্য আমিই ওঁর সন্দেহভাজন। হায়, ওঁর সন্দেহ দূর করতে পারতেন হয়তো কাকাবাবু। তিনি জানতেন বুদ্ধ আমাকে ব্ল্যাকমেল করছে। কারণ আভাসে আমাকে বলেছিলেন, “বুদ্ধকে প্রশ্রয় দিও না।”
কিছুক্ষণ আগে কাকাবাবুর ডেডবডি উদ্ধার করা হয়েছে। বুদ্বুরাম চলে গেছে। এবার আমি কর্নেলের হাতে বিপন্ন। খাল কেটে কুমির ঢুকিয়েছি। কী নির্বোধ আমি!
পুনশ্চ : জয়ের উদ্দেশেজয়, তুই আর আমি একই আত্মার অংশ। আমরা যমজ ভাই। রমলার মেয়ে মিমি হয়তো আমার, হয়তো তোর–দুজনেরই কোনো একজনের ঔরসে জন্ম নিয়েছে। মিমির মধ্যে একই আত্মার স্বাক্ষর আছে। কি না ভেবে দেখিস। তুই ওকে মেনে নিস নিজের মেয়ে বলে। স্টেশন থেকে আসার পথে রমলা মিমির কথা বলেছিল আমাকে। আমার কী যে ইচ্ছে করছিল তাকে দেখতে। এ জীবনে তো তাকে স্নেহ দিতে পারলুম না। তুই থাকলি আমার হয়ে ওকে স্নেহ দিতে। জয়, আমার এই শেষ ইচ্ছা কি তুই। মেটাবি না? ইতি, হতভাগ্য বিজয়াদিত্য।”..