উপসংহার – ডাক্তারের পত্র

উপসংহার – ডাক্তারের পত্র

দত্ত সাহেবের প্রতি বেন্টউড – প্রথম পত্র

আলিপুর, কলিকাতা

প্রিয় সুহৃদ!

সহসা সুরেন্দ্রনাথকে জীবিত দেখিয়া আপনারা তখন এমনই আনন্দাকুল হইয়া উঠিয়াছিলেন যে, আমার কথা আপনাদিগের মনেই ছিল না। সুবিধা বুঝিয়া আমিও ঘর হতে বাহির হইয়া পড়িলাম। যে ঘরে অমরেন্দ্রের মৃতদেহ পড়িয়া ছিল, সেই ঘরে যাইয়া তাহাকে পুনর্জীবিত করিয়া তুলিলাম। আমি সুরেন্দ্রনাথকেও পুনর্জীবিত করিয়াছিলাম।

মৃত ব্যক্তি যে কিরূপে পুনর্জীবিত হইল, এবং আমার এই সকল কাণ্ডকারখানার অর্থ কি, তাহা জানিতে অবশ্যই আপনি প্রভূত পরিমাণে কৌতূহলাক্রান্ত হইয়াছেন, সন্দেহ নাই। এই পত্রের দ্বারা আপনার সেই কৌতূহল চরিতার্থ হইবে। আমার সহিত দেখা করিতে কষ্ট করিয়া আপনাকে আর এতদূর আসিতে হইবে না। যদি আসেন, দেখা হইবে না। এই পত্র যখন আপনার হাতে পড়িবে, তখন আমি কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া অনেক দূরে গিয়া পড়িয়াছি, জানিবেন। আমি যে শীঘ্রই কলিকাতা ত্যাগ করিব, তাহা আপনি একদিন আমার মুখে শুনিয়াছেন। বিশেষতঃ, আমার সহিত আর দেখা-সাক্ষাৎ হয়, সে ইচ্ছাও আপনার নাই। আপনার অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিশেষ প্রয়োজন বশতঃ আমি উপযাচক হইয়া একবার আপনার সহিত দেখা করিয়াছিলাম—

আর সেরূপ করিবার আবশ্যকতা দেখি না। আমার কাজ ফুরাইয়াছে, অতএব আমি চিরদিনের মত আপনার নিকট হইতে বিদায় লইলাম। আর আমার দেখা পাইবেন না। আপনি ধর্ম্মভীরু, সহৃদয়, উদারচেতা, সরল প্রকৃতি। আমি ঠিক তাহার বিপরীত; এরূপ স্থলে আমাদিগের মধ্যে স্থায়ী বন্ধুত্ব দুর্ঘট। যাহা হউক, সেজন্য আমাদিগের কাহারও বিশেষ কোন ক্ষতি-বৃদ্ধি নাই। এখন শীঘ্র শীঘ্র কাজের কথাগুলি লিখিয়া শেষ করিয়া ফেলি।

আপনি আমাকে কেবল চিকিৎসক বলিয়াই জানেন; কিন্তু তাহা ঠিক নহে। চিকিৎসা ছাড়া আমি আরও অনেক বিষয়ের চর্চ্চা করিয়া থাকি। সকল দিকেই আমার মাথা বেশ পরিষ্কার জানিবেন; কিন্তু অর্থাভাবে মাথা খেলাইতে পারি না। দস্তরমত অর্থ থাকিলে, আমি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় এমন অনেক বিষয় আবিষ্কার করিতে পারিতাম, যাহাতে জগৎ স্তম্ভিত হইয়া যাইত। বিজ্ঞান ও রসায়নে আমার অপরিমিত বুৎপত্তি থাকিলেও, আমি অর্থাভাবে কিছুই করিতে পারিলাম না। সেই অর্থাভাব দূর করিবার জন্য আমি সেলিনাকে বিবাহ করিতে ব্যগ্র হইয়া উঠিয়াছিলাম। নানাদেশ ঘুরিয়া, বহু চেষ্টায়, বহু অধ্যবসায়ে আমি অনেক গুপ্তবিদ্যা শিক্ষা করিয়াছি। আপনারা যে সকল গুপ্তবিদ্যা মন্ত্র তন্ত্র হাসিয়া উড়াইয়া দেন, তাহা না করিয়া, আমি বহু আলোচনার দ্বারা সেই সকলের ভিতর হইতে সত্য আবিষ্কার করিবার চেষ্টা করিয়াছি—অনেক স্থলে চেষ্টা সফল হইয়াছে। হিমালয়ের উত্তরে দুর্গম পার্বত্যপ্রদেশ তিব্বতে গিয়া ছদ্মবেশে অনেক সিদ্ধযোগী মায়াবী লামার সঙ্গে মিশিয়াছি—কতবার ধরা পড়িয়া নিজের জীবনকে সঙ্কটাপন্ন করিয়াছি। তাহাদের অদ্ভুত ক্ষমতা—তাহারা ভীষণ ঐন্দ্রজালিক—তাহারা না পারে, এমন কাজ নাই। আমি আপনাকে যে হিপ্‌নটিজম্ দেখাইয়াছিলাম, তাহাদিগের আবালবৃদ্ধবনিতা উহাতে বিশেষ পারদর্শী—উহাকে তাহারা একটা বিদ্যার মধ্যে গণনা করে না। তাহারা মরা মানুষকে বাঁচাইতে পারে; মনে করিলে, গৃহে বসিয়া দূরদেশস্থ কোন শত্রুকে নিপাত করিতে পারে। ইহা কি সামান্য শক্তির কাজ! যে সকল আপনারা বিশ্বাস করেন না—তাহা আমি প্রত্যক্ষ করিয়াছি! আমি গুপ্ত বিদ্যা শিক্ষার জন্য সমগ্র জগৎ ঘুরিয়াছি—প্রাণপণ করিয়াছি — ছোটনাগপুরের খাড়িয়াদের নিকটে অনেক শিখিয়াছি, তাহাদিগের কাঁউরূপী, সিঙ্গিবোঙ্গা সম্বন্ধে অনেক বিষয় জানি। তাহাদের টম্বরু প্রস্তরের যে সকল গুণ আছে, তাহাও বড় সহজ নহে। চেষ্টা করিয়া সেই টম্বরুও আমি সংগ্রহ করিয়াছিলাম। অর্থাভাবে অনেক স্থানে যাইতে পারি নাই, অনেক চেষ্টা বিফল হইয়া গিয়াছে।

যখন অর্থের জন্য একান্ত লালায়িত, সেই সময়ে আমি সেলিনার সংবাদ পাই। সেলিনাকে বিবাহ করিলে, আমার গন্তব্যপথ অনেকটা সুগম হইবার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সেলিনা আমাকে বিবাহ করিতে সম্মত হইল না। দেখিলাম, সুরেন্দ্রনাথ তাহার হৃদয় অধিকার করিয়াছে। তথাপি আমি তাহার আশা ত্যাগ করিতে পারিলাম না। মনে করিলাম, আমার অভীষ্টসিদ্ধির একমাত্র প্রতিবন্ধক সুরেন্দ্রনাথকে সরাইতে হইবে–একেবারে এ জগৎ হইতে সরাইবার ইচ্ছা আমার ছিল না—তাহা আমিও করি নাই। কাহারও প্রাণহানি না হয়, অথচ আমার কার্য্যোদ্ধার হয়— – সেলিনাকে লাভ করিতে পারি, আমার এইরূপ ইচ্ছাই ছিল।

এখন অবশ্যই আপনি বুঝিতে পারিবেন, কেন আমি আপনার নিকট হইতে বিষ-গুপ্তি ক্রয় করিতে চাহিয়াছিলাম। আপনার কাছে যে বিষ-গুপ্তি ছিল, আমি তাহা অনেকদিন হইতে জানিতাম। যাহা হউক, আপনার বিষ-গুপ্তি হস্তগত করিবার জন্য টম্বরুর ভয় দেখাইয়া আমি জুলেখাকে আগে হস্তগত করিলাম। জুলেখাও আমার কথামত চলিতে সম্মত হইল। সে বিষ-গুপ্তির বিষ তৈয়ারী করিতে জানিত।

বিষ-গপ্তির বিষে মানুষ শীঘ্র মরে না। তবে এরূপ নিঃসংজ্ঞ হইয়া পড়ে যে, কোন সুবিজ্ঞ ডাক্তার তাহা বুঝিতে পারেন না; যদি বেশী দিন নিঃসংজ্ঞ অবস্থায় থাকে, এবং প্রতিষেধক ঔষধ না পড়ে, তাহা হইলে মৃত্যু নিশ্চিত। বেশীদিন অজ্ঞান অবস্থায় রাখিতে হইলে, যন্ত্রের সাহায্যে দুগ্ধ কিম্বা অন্য কোন পুষ্টিকর সামগ্রী খাওয়ান দরকার করে।

জুলেখার নিকট হইতে আমি বিষ-গুপ্তির বিষের প্রতিষেধক ঔষধ তৈয়ারি করিতে শিখিয়াছিলাম। বলিতে কি, সেইজন্যই আমি বিষ-গুপ্তি ব্যবহার করিতে সাহসী হইয়াছিলাম। জানিতাম, মনে করিলেই যখন ইচ্ছা সুরেন্দ্রনাথকে আবার পূর্ব্বৎ সুস্থ করিতে পারিব। এখন বুঝিতে পারিলেন কি কেন আমি সামুদ্রিকগণনার অছিলায় জীবমৃত্যু ঘটিবে বলিয়া সুরেন্দ্রনাথকে ভয় দেখাইয়াছিলাম; এবং সতর্ক হইতে বলিয়াছিলাম। যাহা হউক, আমার গণনা সফল হইল— কিন্তু আশা সফল হইল না। সুরেন্দ্রনাথ তাহাতে ভীত হইল না—সতর্কও হইল না—বরং সেলিনাকে বিবাহ করিবার জন্য আরও ব্যগ্র হইয়া উঠিল। আমিও বদ্ধপরিকর হইয়া উঠিলাম।

বিষ-গুপ্তি সংগ্রহের জন্য জুলেখার সহিত পরামর্শ করিলাম, সে মিসেস্ মার্‌শনকে হিপ্‌নটাইজ করিয়া বিষ-গুপ্তি সংগ্রহ করিতে সম্মত হইল। আপনার অবশ্য স্মরণ আছে, একদিন আমি আপনার নিকট হইতে এই বিষ-গুপ্তি কিনিতে চাহিয়াছিলাম—আপনি অসম্মত হইলেন; অগত্যা আমাকে অসদুপায় অবলম্বনে ঐ বিষ-গুপ্তি হস্তগত করিতে হইল। মিসেস্ মার্শনের দ্বারা বিষ-গুপ্তি অপহরণ করিবার আরও একটা কারণ ছিল—পরে তাঁহাকে চুরির দাবীতে ফেলিয়া, ভয় দেখাইয়া হাতে রাখিতে পারিব বলিয়া, এরূপ করিয়াছিলাম। যাহা হউক, পরে হিপ্‌নটাইজ করিয়া তাঁহারই দ্বারা বিষ-গুপ্তি সংগ্রহ করিলাম; অথচ তিনি নিজে কিছুই জানিলেন না। তাহার পর নূতন বিষের দ্বারা জুলখা বিষগুপ্তি ঠিক করিয়া রাখিল। আমারই আদেশমত একদিন সে সেলিনাকে হিপ্‌নটাইজ করিল, এবং তাহার হাতে সেই বিষ-গুপ্তি দিয়া সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিতে পাঠাইয়া দিল। সুরেন্দ্রনাথ খুন হইল—খুন ঠিক নহে—কারণ বিষ-গুপ্তির বিষে মানুষ মরে না। সেলিনার মাতার দ্বারা বিষ-গুপ্তি অপহরণের ন্যায় সেলিনাকে দিয়া এই কাজ শেষ করিবার তেমনই একটা উদ্দেশ্য ছিল; খুনের অপরাধে ফেলিয়া সেলিনাকে নিজের বশে রাখিব, মনে করিয়াছিলাম। ভাবিয়া দেখুন দেখি, সেলিনাকে বিবাহ করিবার জন্য আমি কি ভীষণ ষড়যন্ত্রের সৃষ্টি করিয়াছিলাম। কি লোমহর্ষণ ব্যাপারে লিপ্ত হইয়াছিলাম! আশা করি, অবশ্যই আপনি আমার এই বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করিবেন।

যাক্, আর বাজে কথা বলিয়া পত্র দীর্ঘ করিবার দরকার নাই। এখন দুই-একটি কাজের কথা বলিয়া আমার বক্তব্য শেষ করি। জুলেখার সাহায্যে আমিই সুরেন্দ্রনাথের দেহ অপহরণ করিয়াছিলাম। সুরেন্দ্রনাথকে বাঁচাইবার জন্যই আমি এরূপ করিয়াছিলাম। সত্যকথা বলিতে কি, সুরেন্দ্রনাথের প্রাণহানি করিতে আমার আদৌ ইচ্ছা ছিল না। যতদিন আমি সেলিনার আশা ত্যাগ করিতে পারি নাই, ততদিন সুরন্দ্রনাথকে অজ্ঞানাবস্থায় ফেলিয়া রাখিয়াছিলাম। নিয়মিত সময়ে তাহাকে দুগ্ধাদি খাওয়াইতাম। সেইজন্য তাহার স্বাস্থ্যের কোন হানি হয় নাই। যখন আমি হাজতে বন্দী ছিলাম, আমার আদেশে জুলেখা সুরেন্দ্রনাথের রক্ষণাবেক্ষণ করিতে। সুরেন্দ্রনাথকে আমার বাড়ীতে রাখি নাই, সেইজন্য পুলিসের অনুসন্ধান সফল হয় নাই। কোথায় লুকাইয়া রাখিয়াছিলাম, তাহা বলিবার আবশ্যকতা নাই—তাহা জানিয়া আপনার আর লাভ কি?

সেদিন আদালতে অমরেন্দ্রনাথকে একান্ত নির্ব্বোধের ন্যায় আত্মহত্যা করিতে দেখিয়া, আমি হাল ছাড়িয়া দিলাম। বুঝিলাম, সেলিনা-লাভ আমার অদৃষ্টে নাই, তবে কেন অনর্থক অমরেন্দ্রের জীবন নষ্ট হয়। অমরেন্দ্রের ন্যায় সরলপ্রকৃতির লোক এ জগতে অতি অল্প। সেদিন আদালতে তাহাকে আত্মহত্যা করিতে দেখিয়া আমি যেমন চমৎকৃত হইয়াছিলাম, তেমনই দুঃখিত ইয়াছিলাম। যদি অমরকে বাঁচাইতে হয়, তবে সুরেন্দ্রনাথকে আর মৃতকল্প অবস্থায় ফেলিয়া রাখিয়া, লাস-চুরির অপরাধে কেন নিজে অভিযুক্ত থাকি? যখন সেলিনাকে পাইলাম না, তখন সকল গোলযোগ মিটিয়া যাওয়াই ভাল। দুজনকেই প্রতিষেধক ঔষধে আমি প্রকৃতিস্থ করিলাম। সুরেন্দ্রনাথকে সুস্থ করিয়া আমি আপনার নিকটে লইয়া গেলাম। আপনি আপনার হারানিধি পাইলেন। সম্ভব, শীঘ্রই সেলিনার সহিত তাহার বিবাহ হইবে। তাহা হউক, সেজন্য আমি দুঃখিত নহি; পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, অর্থাকাঙ্ক্ষায় সেলিনাকে বিবাহ করিবার জন্য আমি বদ্ধপরিকর হইয়াছিলাম। কিন্তু, অমরেন্দ্রের জন্য আমার বড়ই দুঃখ হয়—সেলিমার উপরে তাহার প্রগাঢ় ভালবাসা, সেলিনার উপরে তাহার আন্তরিক অনুরাগ, সেলিনার জন্য অমর নিজের প্রাণ দিয়াছিল। এখন অমরেন্দ্র, সেলিনাকে সুরেন্দ্রনাথের অঙ্কশোভিনী দেখিয়া—তাহার কি কষ্ট হইবে, কে জানে? অমরেন্দ্র সারাজীবন জীবন্বত হইয়া থাকিবে। অমরেন্দ্রকে বাঁচাইয়া ভাল করিয়াছি কি মন্দ করিয়াছি, বুঝিলাম না।

যাহা হউক, আপনি এখন আপনার দুই’ স্নেহাস্পদকে রক্ত মাংসের শরীরে পুনর্জীবিত পাইয়াছেন, অবশ্যই এখন আপনার মনে আর কোন কষ্ট নাই—যথেষ্ট আনন্দিত হইয়াছেন। আমার উপরে আপনি এখন সন্তুষ্ট কি অসন্তুষ্ট, তাহা আপনিই জানেন। আমার তাহা জানিবার আবশ্যকতা নাই। আপনি মনে মনে যে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ আমাকে পিশাচ মূর্তিতে চিত্রিত করিয়াছেন, আমি নিজে ঠিক তাহা নাহি।

আমার সকল উদ্যম, সকল আগ্রহ, সকল চেষ্টা বিফল হইল—তবে আর এখানে থাকিয়া লাভ কি? দেখি, আর কোথায় যদি সেলিনার মতো ঐশ্বর্য্যবর্তী কোন পাত্রী পাই। জুলেখাকেও একবার অনুসন্ধান করিয়া দেখিতে হইবে–সে আমাকে বড় ফাঁকি দিয়াছে—যেমন করিয়া হউক, তাহার নিকট হইতে টম্বরুর পুনরুদ্ধার করিতে হইবে। এখন আমার বক্তব্য শেষ হইয়াছে। আপনি এতদিন যে রহস্যের মধ্যে আত্মহারা হইয়া পড়িয়াছিলেন, এখন তাহা পরিষ্কার হইয়া গেল। আমিও বিদায় লইলাম।

দ্বিতীয় পত্র

আর, বেন্টউড।

ছোটনাগপুর

প্রিয় সুহৃদ!

প্রায় চারিপাঁচ মাস গত হইল, আপনাকে একখানি পত্র লিখিয়া ছিলাম। সেই সকল দুর্ঘটনা সম্বন্ধে যাহা কিছু বলিবার, বুঝাইবার, আপনাকে সেই পত্রে সমুদয় বুঝাইয়া বলিয়াছি। এখন আমি আপনার নিকটে দুই-একটি বিষয় জানিতে চাই; সেই উদ্দেশ্যে আমি আপনাকে এই পত্র লিখিলাম। আশা করি, পত্রোত্তরে আমার কৌতূহল নিবৃত্তি করিবেন।

জুলেখার সন্ধানে আমি এখানে আসিয়াছি। এখনও তাহার কোন সন্ধান পাই নাই; বোধ করি, আমাকে আরও কিছুদিন এখানে থাকিতে হইবে। জুলেখার সন্ধান না করিয়া আমি এখান হইতে এক পা নড়িতেছি না।

ইতিমধ্যে অমরেন্দ্রকে আমি একখণ্ড পত্র লিখিয়াছিলাম। আমার দ্বারা মৃত্যুমুখ হইতে রক্ষা পাইয়াছে, ইত্যাদি লিখিয়া অমরেন্দ্র পত্রোত্তরে আমার নিকট খুব কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিয়াছে। হত্যাপরাধ হইতে আমাকে রক্ষা করিবার জন্য অমরেন্দ্রও আমার হইয়া অনেক চেষ্টা করিয়াছে— যাহা কেহ করে না, তাহা করিয়াছে। সেজন্য আমার পত্রেও আমি তাহাকে যথেষ্ট ধন্যবাদ করিয়াছি। কিন্তু, অমরেন্দ্র পত্রোত্তরে যে কথা লিখিয়াছে, তাহাতে আমাকে একান্ত বিস্মিত হইতে হইয়াছে। অমর যদিও মিথ্যাকথা লিখিবে না—আমি তাহাকে জানি—তথাপি বিশ্বাস করিতে পারিতেছি না। আপনি আমাকে সবিশেষ লিখিয়া জানাইবেন।

অমরেন্দ্রের পত্রে জানিতে পারিলাম, সেলিনা, সুরেন্দ্রনাথকে বিবাহ করিতে আর সম্মত নহে। সুরেন্দ্রনাথও সেজন্য আদৌ দুঃখিত নহে। শুনিলাম, সুরেন্দ্রনাথ স্ব-ইচ্ছায় আমিনাকেই বিবাহ করিয়াছে। ভালই হইয়াছে, সরলা আমিনা সুরেন্দ্রনাথের চিরানুরাগিণী। এ মিলনে আমি খুব সুখী হইলাম। কিন্তু সুরেন্দ্রনাথের এরূপ মতি-পরিবর্তনের কারণ কি, বুঝিতে পারিলাম না; সেলিনার জন্য এত বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করিয়া, এত কষ্ট স্বীকার করিয়া, শেষে সুরেন্দ্রনাথ সেলিনাকে ছাড়িয়া সহসা আমিনাকে বিবাহ করিল কেন? আপনি পত্রোত্তরে তাহা আমাকে বুঝাইয়া দিবেন। অমরেন্দ্রনাথ লিখিয়াছে, পূর্ব্বে আমিনার উপরেই সুরেন্দ্রনাথের অনুরাগ বদ্ধমূল ছিল; মধ্যে সুরেন্দ্রনাথ কি জানি, কোন কারণে সেলিনাকে বিবাহ করিবার জন্য ব্যগ্র হইয়া উঠিয়াছিল। সুরেন্দ্রনাথ চিরকালই বড় অস্থির-প্রকৃতি। অমর যাহা লিখিয়াছে, তাহাই কি ঠিক?

অমরেন্দ্রনাথের পত্রে আমি আরও জানিতে পারিলাম, সেলিনা এখন অমরেন্দ্রনাথকেই বিবাহ করিবে। এই মাসেই তাহাদিগের বিবাহ হইবে। শুনিয়া বড়ই সুখী হইলাম—সুখী হইলাম শুনিয়া, বিস্মিত হইবেন না—সেলিনার আশা আমি সেই একদিনেই একেবারে ত্যাগ করিয়াছি; সুতরাং অসুখী হইবার আর কোন কারণ দেখি না। যাহা হউক, অমরেন্দ্রের নিঃস্বার্থ প্রেমের এরূপ প্রতিদানই বাঞ্ছনীয়। কেবল সেলিনা কেন, কোন্ রমণী এমন প্রগাঢ় প্রাণপণ ভালবাসার এইরূপে প্রতিদান না করিয়া থাকে?

অমর লিখিয়াছে, হিপ্‌নটাইজড্ অবস্থায় সেলিনা যে সুরেন্দ্রনাথকে খুন করিয়াছিল, তাহা এখন তাহারা দুইজনেই শুনিয়াছে, সেইজন্যই তদুভয়ের মধ্যে মনোমালিন্য ঘটিয়াছে। এবং সুরেন্দ্রনাথ সেইজন্য সেলিনাকে ছাড়িয়া আমিনাকে বিবাহ করিয়াছে। আমারও তাহাই অনুমান; হিপ্‌নটিজমে অভিভূত হইয়া হউক, আর যেরূপে হউক, যে স্ত্রীলোক একবার প্রাণনাশ করিতে উদ্যত হইয়াছে, তাহার প্রতি অনুরাগের লাঘব হওয়াই ঠিক। বোধ করি, এইরূপ একটা কারণে সেলিনারও মত ফিরিয়াছে। বিনা দোষে সেলিনা যে সুরেন্দ্রনাথকে খুন করিতে চেষ্টা করিয়াছিল, সুরেন্দ্রনাথকে দেখিয়া দিবারাত্র সেই ভয়ানক কথাই তাহার মনে উদিত হইত। সেলিনা বুঝিতে পারিয়াছে, সুরেন্দ্রনাথকে বিবাহ করিয়া সে সুখী হইতে পারিবে না—সুরেন্দ্রনাথকেও সুখী করিতে পারিবে না—সেই হত্যাকাণ্ড তাহাদিগের ভালবাসার উপরে চিরকাল এমনই একটা ছায়াপাত- করিয়া থাকিবে যে, পরস্পর কেহই সুখী হইতে পারিবে না—কাহাকেও কেহ সুখী করিতে পারিবে না। ইহাতে আশ্চর্য্যের কিছুই নাই; বিশেষতঃ সেলিনা সেদিন আদালতে অমরেন্দ্রনাথের নিঃস্বার্থ প্রণয়ের যে প্রকৃষ্ট পরীক্ষা পাইয়াছে, তাহাতে তাহার এরূপ মতি-পরিবর্ত্তন না হওয়াই আশ্চৰ্য্য; আমার ত এইরূপ অনুমান; এ বিষয়ে আপনি কি বোধ করেন, পত্রোত্তরে সবিশেষ লিখিয়া জানাইবেন।

জুলেখার সন্ধানে আমাকে এখানে কিছুদিন থাকিতে হইবে। এইখানকার ঠিকানায় পত্র লিখিবেন।

তৃতীয় পত্ৰ

বোম্বে

প্রিয় সুহৃদ!

দুই-তিন মাস পূর্ব্বে একখানি পত্র লিখিয়াছিলাম। দুঃখের বিষয় আপনি আমার পত্রের কোন উত্তর দিলেন না। অমরের পত্রে জানিতে পারিলাম, তাহার সহিত সেলিনার বিবাহ হইয়াছে। আমিনারও মনোভিলাষ সিদ্ধি হইয়াছে, সে এখন সুরেন্দ্রনাথের বিবাহিতা পত্নী। এরূপ অচিন্তনীয় ঘটনায় আমাকে যথেষ্ট বিস্মিত হইতে হইয়াছে। আপনাকে ইহার কারণ লিখিতে বলিয়াছিলাম, কিন্তু আপনি এমনই ভয়ানক লোক, আমার পত্রের উত্তরও লিখিলেন না। তা’ আপনি নাই লিখুন, আমার পূর্ব্বপত্রের অনুমানই ঠিক। আপনার এরূপ ব্যবহারে আমি বিশেষ দুঃখিত হইলাম।

এখন আমি আরও দুই-তিন সপ্তাহ বোম্বে থাকিব। টম্বরু প্রস্তর পাওয়া গিয়াছে। জুলেখার মৃত্যু হইয়াছে। কাঁউরূপীর সাধনা করিতে গিয়া সে কাউরূপীর হাতেই মরিয়াছে।

আমার কুশল জানিবেন।

আর, বেন্টউড।

***