উনো, হিন্দি, ক্রিকেট
প্রাতঃস্মরণীয় কবিরাজ সুকুমার রায় বলেছেন,
‘গোঁফকে বলে তোমার আমার– গোঁফ কি কারও কেনা?
গোঁফের আমি গোঁফের তুমি, তাই দিয়ে যায় চেনা।’
অর্থাৎ মানুষ দিয়ে গোঁফের বিচার হয় না– গোঁফ দিয়ে মানুষের বিচার করতে হয়।
কথাটা আমাদের কাছে আজগুবি মনে হলেও আসলে তা নয়। চোখ খোলা রাখলে নিত্যি নিত্যি তার উদাহরণ স্পষ্ট দেখতে পাবেন। এই মনে করুন কলকাতা শহর। কি লোকসংখ্যা, কি আয়তন, কি ব্যবসাবাণিজ্য, কি জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা সবদিক দিয়েই কলকাতা শহর দিল্লিকে এক শ’ বার হার মানাতে পারে, কিন্তু হলে কী হয়, দিল্লি যে রাজধানী! অতএব দিল্লির মাহাত্ম কলকাতার চেয়ে বেশি।
অর্থাৎ রাজধানীর গোঁফ দিয়ে শহর যাচাই করতে হয়। শহরের প্রাধান্য থেকে রাজধানী হয় না।
তবেই দেখুন, সুকুমার রায়ের বাণীটি আপ্তবাক্য কি না।
তাই দিল্লির ধারণা ইউএনও’র পালা-পর্ব করার অধিকার তারই সবচেয়ে বেশি এবং এ সপ্তাহে দিল্লি বিস্তর ঢাক-ঢোল বাজিয়ে সে পর্ব সমাধান করেছেও বটে।
মেলা গুণী বিস্তর ভাষণ দিয়েছেন। কি গলা, কি বলার ধরন, কি হাত-পা নাড়া, কি উচ্ছ্বাস– সব দেখে শুনে মনে কণামাত্র সন্দেহ আর থাকে না, এরা যদি দিল্লিতে বক্তৃতা না দিয়ে উনোতে দিতেন, তবে অনায়াসে আমাদের জন্য কাবুল-কান্দাহার জয় করে আনতে পারতেন।
এঁরা কী বক্তৃতা দিলেন? আমার নীরস ভাষা দিয়ে তাঁদের বক্তব্য প্রকাশ করলে শুণীদের প্রতি অবিচার। করা হবে, তাই প্রতাঁকের সাহায্যে, অর্থাৎ অ্যালজেব্রা দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করব।
এঁদের প্রায় সকলেই একই কথা বললেন। সেটা হচ্ছে এই; যদিও উনো ক, খ, গ করতে সক্ষম হননি, তবু চেষ্টা করলে ভবিষ্যতে চ, ছ, জ হয়তো-বা করলে করতেও পারেন। এবং ট, ঠ, চ-ও যে তাদের পক্ষে সম্পূর্ণ অসম্ভব একথাই-বা বুক ঠুকে বলতে পারে কে?
যেন ইস্কুলের মাস্টারমশায় জমিদারবাবুর ফেল করা ছেলের প্রোগ্রেস-রিপোর্ট লিখছেন। জমিদারবাবুকে না চটিয়ে তার গর্দভ ছেলের হাল-হকিকত বাতলানো সোজা কর্ম নয়। উনোর প্রশস্তি-গায়করা সেই টাইপ-রোপ-ডানসিং কর্মটি দিল্লিতে সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছেন।
হায় কাশ্মির, হায় কোরিয়া, হায় ইন্দোচীন, হায় তুনিস, আরও কত হায়, হায়!
আমি কিন্তু উনোর কাম্-কেরানি থেকে দুটো শিক্ষা লাভ করেছি।
প্রথমত, মিটিঙে গালিগালাজ মারামারি না করা। কিছুদিনের কথা, ফ্রান্সের পার্লিমেন্টে সদস্যেরা অন্য কোনও অস্ত্র-শস্ত্র পাননি বলে গলার চেন খুলে একে অন্যকে জোরসে ঠুকেছেন– ফলে রক্তারক্তিও নাকি হয়েছিল। বাঙলা দেশের পার্লিমেন্টেও নাকি অনেক কিছু হয়েছে, যদিও রক্তারক্তি হয়েছে বলে স্মরণ হচ্ছে না। তবে মারামারিই তো শেষ কথা নয়। ভাষা অনেক সময় ডাণ্ডার চেয়েও কঠিন কঠোরতর। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, মাস্টাররা এখন ছেলেদের চাবুক মারেন না বটে, তবে সে চাবুক এসে আশ্রয় নিয়েছে তাঁদের জিভে; তাঁদের জিভ এখন চাবুকের চেয়ে নিষ্ঠুরতর।
কিন্তু সে তত্ত্বালোচনা উপস্থিত থাক।
আমার কাছে আশ্চর্য বোধ হয়, এখনও উনোতে হাতাহাতি কিংবা পুরোদস্তুর একে অন্যকে অপমান না করেও তাঁর কাজকর্ম (তা সে যতই নগণ্য কিংবা অর্থহীন হোক না কেন) সমাধান করছেন কী করে?
কাষ্ঠরসিকেরা এর উত্তরে কী বলবেন তা-ও আমি বিলক্ষণ জানি। তাঁরা বললেন, “আরে বাপু, যেখানে শুধু তর্কাতর্কি বাকযুদ্ধ, যেখানে কোনও প্রকারের জীবন-মরণ সমস্যার সমাধান হবে না, যেখানকার কোনও বাগাড়ম্বরই আমার আপন দেশে কোনও প্রকারের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে না অর্থাৎ আমার দেশকে এক গিরে জমি কিংবা এক কড়ির আমদানি খোয়াতে হবে না, সেখানে মারামারি হাতাহাতি করতে যাব কোন দুঃখে? ’
হক কথা। দুনিয়ার বহু জাতই এ তত্ত্ববাক্যে সায় দেবে। কিন্তু আমি বাঙালি। আমার মন বলে কথাটা হক হলেও টুক করে মেনে নিতে আমার বাধছে। ‘মোহনবাগান’-ইস্টবেঙ্গলের খেলাতে কে জেতে কে হারে, তাতে আমার কণামাত্র ক্ষতিবৃদ্ধি নেই, তবু তো তাই নিয়ে তর্ক করে আমি সেদিন দুটো চড় খেয়েছি, তিনটে কিল মেরেছি। সে রাত্রে না খেয়ে শুতে গিয়েছি, পাশের বাড়ির শা-রা সাত টাকা সেরে ইলিশ কিনে ফিষ্টি করেছে।
দ্বিতীয় তত্ত্ব ততোধিক গুরুত্বব্যঞ্জক (সোজা বাংলায় ইম্পর্টেন্ট) হিন্দি ভাষা রাষ্ট্রভাষা। তাঁর জয় হোক। তিনি দেশ-বিদেশ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ুন; আমার বুক ফাটবে না! কিন্তু যখন বলা হয়, হিন্দি না শিখলে (এবং ইংরেজি বর্জন করার পর) আমরা দিল্লির পার্লিমেন্টে একে অন্যকে বুঝব কী করে, তাই সবাই হিন্দি শেখ, তখন আমার মনে আসে উনোর কথা। সেখানে কত গণ্ডা ভাষা নিয়ে কারবার চলে ঠিক বলতে পারব না, তবে বিবেচনা করি ভারতে যে কটি ভাষা চালু আছে, তার চেয়ে বেশি ভাষা-ভাষী সেখানে জমায়েত হন। তাঁদের বেশিরভাগই বক্তৃতা দেন আপন আপন মাতৃভাষাতে। বর্মার সদস্য যখন আপন মাতৃভাষায় বক্তৃতা দেন, সঙ্গে সঙ্গে সে বক্তৃতা ইংরেজি, ফরাসি, স্পেনিশ ইত্যাদি বহু ভাষায় অনূদিত হয়। প্রত্যেক সদস্যের কানে ইয়ারফোন লাগানো। সমুখে ছোট একটি কল। তিনি যে ভাষায় অনুবাদ চান, সে ভাষার ওপর কলের কাঁটাটি লাগিয়ে অনুবাদটি শুনে নেন! যেমন যেমন বক্তৃতা হয়, অনুবাদও সঙ্গে সঙ্গে চলে। বক্তৃতা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনুবাদ শেষ হয়– সব সদস্যই জেনে যান, বক্তা কী বললেন। যেসব সদস্য বক্তার মাতৃভাষা জানেন, একমাত্র তাঁরাই ‘ইয়ারফোন’ ব্যবহার করেন না।
তবে দিল্লির পার্লিমেন্টেই-বা এ ব্যবস্থা হতে পারে না কেন? ভারত-সুদ্ধ লোককেই-বা হিন্দি-উর্দু-হিন্দুস্তানি শিখতে হবে কেন?
হিন্দি-উর্দু-হিন্দুস্তানির কথায় মনে পড়ল ক্রিকেট-কমেন্টারির কথা।
এবারকার ক্রিকেট টেস্টম্যাচের খেলাতে হিন্দিতেও ‘সমসাময়িক টীকা’ ধাবমান মন্ত্রীনাথ (রানিং কমেন্টারি) দেওয়া হয়েছে। যেদিন আপিসের অত্যাচারে খেলা দেখতে যেতে পারিনি, সেদিন লাঞ্চের সময় টীকা শুনে দুধের আশ ঘোল নয়, জল দিয়ে মিটিয়েছি। মাঝে মাঝে হিন্দি টীকাও ইচ্ছা-অনিচ্ছায় শুনতে হয়েছে।
সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা।
এক টীকাকার যুক্তপ্রদেশের অতি খানদানি ঘরের ছেলে। তিনি জানেন, আমির এলাহি বহুদিনের মুরুব্বি খেলোয়াড়। তাই তিনি বারবার বললেন, ‘এরপর আমির ইলাহি সাহেব বড়ি খুবসুরতকে সাথ (বড় সৌন্দর্যের সঙ্গে) গেন্দ (বল) পাকডুলি (ফিল্ড করলেন)। আমির ইলাহিকে ‘সাহেব’ বলার পূর্বে তিনি অন্য দু একজনকে ‘সাহেব’ উপাধি দেননি, এরপর তাঁর মনে হল সবাইকে ‘সাহেব’ বলা উচিত, তাই তিনি আঠার বছরের ছোকরা হাফিজকেও ‘সাহেব’ সম্বোধন করতে লাগলেন।
ক্রিকেট গণতান্ত্রিক খেলা। ক্রিকেটর দেবেন্দ্র ব্র্যাডমানকেও কোনও ইংরেজি টীকাকার মিস্টার ব্রাডমান কিংবা ‘রেসপেকটেড’ ব্র্যাডমান বলে উল্লেখ করেন না, কিন্তু ভারতবর্ষ সৌজন্য-ভদ্রতার দেশ, ক্রিকেট খেলি আর যাই খেলি, পিতৃবয়স্ক আমির ইলাহি, কিংবা মুরুব্বি অমরনাথকে ‘সাহেব’ না বলে বাক্য-স্ফুরণ করি কী প্রকারে।
টীকাকার আবার হিন্দি-উর্দু দুই-ই জানেন। আবার তিনি এ তথ্যও জানেন, করাচি-লাহোরে বিস্তর মুসলমান তার টীকা রেডিওর পাশে বসে কান পেতে শুনছেন। তারা কট্টর হিন্দি বুঝতে পারেন না– টীকাকার তাঁদেরই-বা নিরাশ করেন কী প্রকারে? তাই সমস্তক্ষণ তিনি ছিলেন আপসের তালে।
দৃষ্টান্ত দিই।
পাকিস্তানের ‘অবস্থা তখন বড়ই বিপদসঙ্কুল’ হিন্দিতে প্রকাশ করতে গেলে বলতে হয়, ‘বিপদজনক পরিস্থিতি’, উর্দুতে, বলতে হয়, ‘খতরনাক হালৎ’! টীকাকার দু কুল রক্ষা করলেন, ‘খতরনাক পরিস্থিতি’। আশা করলেন, পাকিস্তান-হিন্দুস্তান উভয়েই বুঝে যাবে ‘অবস্থা সঙ্গিন’!
আমি কিন্তু সত্যই স্বীকার করি, ভাষার ওপর ভদ্রলোকের দখল আছে। মাঁকড় ‘আরামকে সাথ’ (অক্লেশে, আরামের সঙ্গে) গেন্দ (বল) বোলারকে ফিরিয়ে দিলেন, পঙ্কজবাবু ‘আহসানিসে’ (অনায়াসে, অবহেলায়) বলটাকে পাকড়ে নিলেন, গুলমহম্মদ বড় ‘শানদার’ (মহিমাময়) খেলা দেখালেন, নাজির মহম্মদ ‘কাইম’ (‘কায়েমি’–অর্থাৎ সেটেলড ডাউন) হয়ে গিয়েছেন আরও কত কী!
আর অদ্ভুত তাঁর নিরপেক্ষতা। বরের মাসি, কনের পিসি। একে বলেন, সাধু সাধু, ওকে বলেন শাবাশ শাবাশ! কেউ ক্যাচ ধরলে তিনি ‘অচৈতন্নি’, কেউ সিঙ্গল করলে তিনি ‘বেহুঁশ’।
খেলা না দেখেও খেলা দেখার আনন্দ পেয়েছি ॥