উনিশ-বিশ – ৩

সুনীল আমাদের অনেকটা পথ এগিয়ে ফিরে গেল। বাইরে এত ঠান্ডা যে আমি কাঁপছিলাম। এই সোয়েটারে কোনও কাজ হচ্ছে না এখন। রাস্তায় একটাও লোক নেই। দোকানপাটও বন্ধ হচ্ছে। সন্ধেবেলায় যখন মহিলার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পথে নেমেছিলাম তখন দার্জিলিংকে দেখে চোখ জুড়িয়ে গিয়েছিল। আলোর হীরে গলায় দুলিয়ে দার্জিলিং তখন হাসছে। জিজ্ঞাসা করে-করে সুনীলের হোস্টেলে গিয়ে পৌঁছেছিলাম ঠিকই। ওদের দারোয়ান আমাকে সুনীলের খোঁজ দিল। সুনীল তখন হোস্টেলে নেই। ম্যালের কাছে একটা রেস্তঁরার ঠিকানা দিয়ে সেখানে খোঁজ নিতে বলল। ম্যালের পথে সাজুগুজু লোকের ভিড়। বেশিরভাগই বাঙালি। যদি চেনা-লোকের মুখোমুখি হতে হয় তাই সাবধানে হাঁটছিলাম।

রেস্তরাঁ যে বেশ বড়লোকি তা দূর থেকে বুঝতে পারলাম। ওটা আসলে বার। বেশ ঝকমকিয়ে বাজনা বাজছে এবং একদল নারী-পুরুষ সেই বাজনার সঙ্গে নৃত্য করছে। আমি দরজার সামনে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে সুনীলকে খুঁজতে লাগলাম। ওই আলো-আঁধারিতে চট করে কাউকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তা ছাড়া, সিগারেটের ধোঁয়ায় হল ভরতি। আমাকে একটা টেবিল দেখিয়ে বসতে বলল বেয়ারা। আমি তাকে সুনীলের নাম বললাম সে মাথা নেড়ে দ্রুত ভেতরে চলে গেল। আমি আর অপেক্ষা না করে তাকে অনুসরণ করলাম। নাচিয়ে নারী-পুরুষের শরীর বাঁচিয়ে এগিয়ে গেলাম ভেতরে। কোণের দিকে জনাপাঁচেক ছেলেমেয়ে প্রায় নেতিয়ে বসে রয়েছে। সুনীলকে বেয়ারা কিছু বলামাত্র সে মুখ তুলে আমাকে দেখে প্রথমে যেন চিনতেই পারল না। তারপর বোধহয় খেয়াল হতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘হাই! কবে এসেছ?’

বললাম, ‘একটু আগে।’

‘কোথায় উঠেছ?’ ও আমার সঙ্গে হাত মেলাল।

‘ঠিক কোথাও উঠিনি এখনও। আমার চিঠি পেয়েছ?’

‘পেয়েছি। সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি বসো তো আগে। কী খাবে বলো?’

চেয়ার টেনে বসলাম। ‘কিন্তু আমার থাকার জায়গাটা—।’

‘আরে তুমি দার্জিলিং-এ আছ, কলকাতায় নয়। আজ রাত্রে তুমি আমার হোস্টেলে থাকবে। এই বেয়ারা, আউর এক হুইস্কি।’ সুনীল চেঁচিয়ে হুকুম করল। ওরা মদ্যপান করছিল বুঝতে পারছি। সুনীলের এই অভ্যাসটার কথা আমার জানা ছিল না। অন্য চারজন আমায় দেখছে। এই পরিবেশে কী কথা বলব বুঝতে পারছি না। আমার বাঁ-পাশের মেয়েটা বলে উঠল, ‘এক নেহি টু।’ সুনীল হাত নাড়ল, ‘নো। তোমার প্রচুর হয়ে গেছে। মিট মাই ফ্রেন্ড ফ্রম ক্যালকাটা, অতীন। এরা আমার বন্ধু। শ্যাম, লিলি, হ্যারি আর লায়লা।’

ওরা একসঙ্গে বলে উঠল, ‘হা-ই!’

আমি কী করব বুঝতে না পেরে বোকার মতো হাসলাম।

আমার বিস্ময় কমার আগেই বেয়ারা হুইস্কি আর জল রেখে গেল। আমি বললাম, ‘সুনীল, আমি ড্রিঙ্ক করিনে।’

সঙ্গে-সঙ্গে আমার বাঁ পাশের মেয়েটি ছোঁ মেরে গেলাসটা তুলে নিয়ে ঝুঁকে আমাকে আলটপকা চুমু খেল, ‘ওঃ হাই নাইস য়ু আর। আই অ্যাম হেল্পিং য়ু আর।’ বলে সামান্য জল মিশিয়ে ঢক করে গিলল মদ।

সুনীল চিৎকার করে উঠল, ‘ইউ বিচ।’ অন্য সবাই খিলখিল করে হাসতে লাগল সুনীলের চিৎকার শুনে। এই সময় একটি নেপালি ছেলে দ্রুত আমাদের টেবিলে এসে সুনীলের পাশে গিয়ে তার কানে-কানে কিছু বলল। সুনীলকে খুব অবাক দেখাচ্ছে। সে চাপা গলায় কিছু জিজ্ঞাসা করল। ছেলেটি চটপট উত্তর দিয়ে বেরিয়ে গেল।

তৎক্ষণাৎ সুনীল উঠে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে দুটো একশো টাকার নোট বের করে টেবিলে ফেলে বলল, ‘এনজয় ইওরসেলফ। কেউ যদি আমাকে খোঁজে, বলবে দ্যাখোনি।’ তারপর আমাকে ইশারা করে বাঁ-দিকে চলে গেল। আমি যেদিক দিয়ে ঢুকেছিলাম এটা তার উলটো দিক। একটা দরজা ঠেলে করিডোর দিয়ে এগিয়ে আর-একটা দরজার সামনে পৌঁছে সুনীল দাঁড়াল, ‘কী ব্যাপার তোমার?’

‘মানে?’

‘তোমার সঙ্গে জড়িয়ে পুলিশ আমাকে খুঁজছে কেন?’

‘পুলিশ তোমাকে খুঁজছে?’

‘হ্যাঁ, এইমাত্র জানতে পারলাম। তুমি কি আমার হোস্টেলে গিয়েছিলে?’

‘হ্যাঁ। দারোয়ানের কাছে শুনলাম তুমি এখানে।’

‘তুমি চলে আসার পরই পুলিশ সেখানে গিয়েছে। যদি দারোয়ান তাদের বলে দেয় জায়গাটার কথা। নাউ, লেটস মুভ। ‘পেছনের সিঁড়ি দিয়ে সুনীল আমাকে নিচে নামিয়ে আনল। তারপর জোরে পা চালিয়ে বেশ কয়েকটা গলি পেরিয়ে একটা দর্জির দোকানে ঢুকে পড়ল। দোকানে তখন বুড়ো বসে ঢুলছে। তাদের বিদেয় করে সুনীল বলল, ‘কী হয়েছে বলো, শুনি।’

আমি তখন তাকে সবকথা খুলে বললাম। সুর্মাকে আমার সঙ্গে আনার কোনও পরিকল্পনা ছিল না। ওকে আনার ফলেই এক সমস্যা এসেছে। আমরা পুলিশ স্টেশনে, শিলিগুড়িতে এবং সম্ভবত এখানকার বাসস্ট্যান্ডে ফাঁকি দিয়েছি। পুলিশ কিছুতেই জানতে পারেনি আমরা দার্জিলিং-এ এসেছি।

সুনীল হাসল, ‘তুমি তো দারুণ রোমান্টিক! মেয়েটি দেখতে কেমন?’

‘আমার চোখে ওর মতো সুন্দরী কেউ নেই।’

‘ইজ ইট? কিন্তু এই রাত্তিরে তাকে রেখেছ কোথায়?’

তখন আমি ওই মহিলার কথা বললাম। আমি তার নাম জানি না কিন্তু চেহারা, আর গাড়ির বর্ণনা দিতেই সুনীল বুঝে ফেলল, ‘আই সি! শি ইজ কলড দার্জিলিং কুইন। বিরাট লাইন ওর পেছনে। ইউ আর লাকি! ওই যে শ্যামকে দেখলে, ওর মেয়েকে শ্যাম সিডিউস করেছিল।’

‘ওর মেয়ে? ওর বড় মেয়ে আছে?’

‘ইয়েস। সি ইজ অ্যারাউন্ড আওয়ার এজ। তুমি কি কচি খুকি ভেবেছিলে? ছেড়ে দাও। চেষ্টা করো ওখানে আজকের রাতটা থেকে যেতে।’

‘কী করে বলব?’

‘বলবে আমার দেখা পাওনি। ট্রাই টু ম্যানেজ হার। তোমার ভাগ্য খুবই ভালো যে হোটেলে ওঠনি। আর হ্যাঁ, ওকে আমার নাম বলবে না। আমি আজ রাত্রেই কার্শিয়াং-এ নেমে যাচ্ছি। তুমি কাল সকালে তোমার প্রেমিকাকে নিয়ে কার্শিয়াং চলে এসো। স্টেশনের বাঁ দিকে পানবাহার নামে একটা দোকান আছে। সেখানে আমার কথা বললে তুমি পৌঁছে যাবে। ও কে?’

‘কিন্তু সুনীল, আমার একটা চাকরি চাই!’ আমি ওর হাত ধরলাম।

‘সিওর। আমি ব্যবস্থা করব। কিন্তু আগে হাওয়াটাকে ঠান্ডা হতে দাও। আমার বাড়িতে তোমরা স্রেফ থাকবে! চলো তোমাকে এগিয়ে দিই।’

আমরা একটু ঘুরপথ হয়েই বোধহয় বড় রাস্তায় এলাম। আর আসতেই ওর দলটার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। লায়লা বলে মেয়েটি একটা ছেলেকে খুব সাধছিল কিন্তু সে আপত্তি করছে। সুনীলকে দেখামাত্র লিলি ছুটে এল, ‘তুমি বেরিয়ে যাওয়ামাত্র পুলিশ এসেছিল।’

‘কী বললে?’

‘বললাম তোমায় আমরা দেখিনি। কী ব্যাপার?’

‘কিছু না। গুডনাইট।’

লায়লা বলল, ‘সুনীল, আই অ্যাম নট ফিলিং ওয়েল, একটু এগিয়ে দেবে?’

সুনীল একমুহূর্ত চিন্তা করে বলল, ‘বাঃ, ভালোই হয়েছে। তুমি যেদিকে যাবে সেদিকেই লায়লা যাচ্ছে! তোমরা একসঙ্গে যাও, সুবিধে হবে। লায়লাকে সবাই চেনে এখানে। আমার আর দেরি করা উচিত নয়! চলো, তোমাদের ওই মোড় অবধি আমি এগিয়ে দিচ্ছি।’ লায়লা আর আমি পাশাপাশি ওর সঙ্গে মোড়ে আসতেই ও হাত নেড়ে বলল, ‘কাল সকালে।’ বলে ডানদিকের রাস্তা দিয়ে চলে গেল।

লায়লার পায়ের ব্যালান্স ছিল না। আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কোথায় যাবে?’ আমি তো নাম জানি না, তাই জবাব দিলাম, ‘মিনিট দশেকের রাস্তা।’

‘গুড। তাহলে আমার বাড়ি আগেই পড়বে। তুমি একটু ধরো আমাকে। আমি টিপসি হয়ে গেছি। কী যেন নাম তোমার, অতীন? ইজনট ইট?’

‘হ্যাঁ।’ আমাকে ধরতে হল না। লায়লা আমাকে জড়িয়ে ধরল তারপর আমার শরীরের ওপর সমস্ত ভর দিয়ে হাঁটতে লাগল। এভাবে আমার হাঁটা অভ্যাস নেই। তারপর এরকম রাস্তায় এর আগে হাঁটিওনি। ভাগ্যিস রাস্তায় এখন একদম লোক নেই। দোকানপাটও বন্ধ। এই ঠান্ডায় লায়লা একটা স্কার্ট আর জ্যাকেট পরেছে।

আমি বললাম, ‘অত ভর দিও না।’

লায়না বলল, ‘উম। তুমি ভার বইতে পারো না? ঠিক আছে, আমাকে জড়িয়ে ধরে হাঁটো। তোমার পক্ষে ইজি হবে। আই অ্যাম রিয়েল টিপসি।’

মনে হল সেইটেই সহজ। আমি ওর পিঠের ওপর একটা হাত দিয়ে ধরে হাঁটতে শুরু করতে ও আর একটা হাতে আমার কোমর জড়িয়ে ধরল। একরকম ভঙ্গিতে অচেনা অজানা পুরুষের সঙ্গে হাঁটতে ওর একদম সঙ্কোচ হচ্ছে না। হঠাৎ আমার শরীরের মধ্যে কী রকম করতে লাগল। ওর শরীরের সঙ্গে যতই ঘর্ষণ হচ্ছে ততই এই অনুভূতিটা বাড়তে লাগল। কান-মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। এরকম আমার কখনই হয়নি। গলা শুকিয়ে গেল! হঠাৎ লায়লা বলল, ‘তুমি কাঁপছ কেন?’ আমার হাত সত্যি কাঁপছিল এবং তা ঠান্ডায় নয়। আমি কোনও কথা বলতে পারলাম না। ও হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরল, ‘ইউ আর বিউটিফুল। আই নেভার হ্যাড ইট উইথ এ বেঙ্গলি। আমি তোমাকে তখন চুমু খেয়েছি তুমি এখন রিটার্ন দাও।’

সেই নির্জন রাত্রে উন্মুক্ত আকাশের তলায় প্রচণ্ড শীতে দাঁড়িয়ে আমি ঘেমে উঠলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম এটা অন্যায়, আমার কিছুতেই এরকম করা উচিত নয়! কিন্তু শরীরে একটুও শক্তি ছিল না। বলতে কী আমার শরীর যে বিদ্রোহ করতে পারে সেই সময় আমি আবিষ্কার করলাম। লায়লার ঠোঁট আমার ঠোঁটের কাছে। উচ্চতায় আমার সমান। ওর নিশ্বাসের হল্কা লাগছে আমার নাকে। জোঁকের মতো ওর ঠোঁট আমার ঠোঁটে আটকে গেল। কতক্ষণ ওই অবস্থায় ছিলাম জানি না। হঠাৎ লায়লার গলা শুনতে পেলাম, ‘আমার বাড়ি ওইটে! তুমি ঠিক আধঘণ্টা পরে ডানদিকে জানালায় নক করো, কেমন? উই উইল এনজয় দ্য নাইট। কিন্তু একদম শব্দ করো না। আমার মা একটি হাউন্ড। আধঘণ্টা পরে। গুডবাই!’ আমি দেখলাম ও ধীরে-ধীরে নিচে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। পরপর চারটে জানলা বাড়িটার।

হঠাৎ যেন হু-হু করে ঠান্ডা বাতাস আমার শরীরে ঢুকতে লাগল। নিজের অজান্তেই আমি চিৎকার করে উঠলাম, ‘না।’ তারপর ছুটতে লাগলাম। খুব নোংরা লাগছিল নিজেকে। চোখের সামনে সুর্মার মুখটা চলে আসতেই ভীষণ কষ্ট হতে লাগল। এ কী করলাম আমি। আমি সুর্মাকে মুখ দেখাব কী করে! রাস্তার পাশে একটা কল থেকে জল পড়ছিল। একটুও ভ্রূক্ষেপ না করে সেই ঠান্ডা জলে মুখ ধুলাম! ঠোঁট ঘষতে লাগলাম! কনকনে শীতও আমার উপযুক্ত শাস্তি নয়। আমি কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলাম না।

বাড়ির গেট পার হতেই একটা লোক আমার পথ আটকাল, ‘কিসকো চাহিয়ে?’ সেই বিকেলের দারোয়ানটা নয়, নতুন লোক। আগাগোড়া শীতযন্ত্রে মোড়া এই লোকটাকে কী করে বোঝাই কাকে চাই! বিকেলের ঘটনাটা বললাম। লোকটা হাসল ‘নিকাল যাইয়ে হিঁয়াসে, নেহিতো—।’ লোকটার একটা হাত কোমরে। সেখানে কুকরি ঝুলছিল।

আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, ‘এ কী বলছ? তোমার মেমসাহেব আমাদের নিয়ে এল—!’

‘ফির ঝুট বাৎ, কোই মেমসাব ইয়ে কুঠিমে নেহি রহতা হ্যায়।’ প্রায় আমাকে ঠেলে বার করে দিল সে রাস্তায়। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। সুর্মা ভেতরে আছে অথচ—! এই রাত্রে আমি কার কাছে সাহায্যের জন্যে যাব? ভীষণ ভয় করতে লাগল আমার! ভাবলাম এখানে দাঁড়িয়ে সুর্মার নাম করে চেচাই। একটু সরে আসতে পাশের বাড়িটার দিকে নজর পড়ল। হুবহু এক রকমের গেট, একই রকমের বাড়ি। সঙ্গে-সঙ্গে ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ল। আমি ভুল বাড়িতে গিয়েছি! হঠাৎ একধরনের আনন্দে শিহরিত হলাম। এবার আর আমাকে বাধা দিল না। সটান ভেতরে দরজায় পৌঁছে বেল বাজালাম। সেই দারোয়ানটা দরজা খুলে আমায় দেখে সেলাম করল। আমি হলঘরের উত্তাপে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকালাম। সুর্মা এখানে নেই। দারোয়ানটা বলল, ‘উপরমে যাইয়ে সাব!’

কাঠের রঙিন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে-উঠতে বুঝলাম মহিলা খুব বড়লোক। একটি অল্পবয়সি মেয়ে আমাকে দেখে এগিয়ে এল, ‘আইয়ে, ডিনার রেডি।’ নিজেকে হঠাৎ নবাব মনে হচ্ছিল। কিন্তু আমি সুর্মাকে দেখার জন্যে ভেতরে-ভেতরে ছটফট করছিলাম। ওরা সোফায় বসে গল্প করছিল। ওদিকে টেবিলে খাবার সাজানো হচ্ছে। মহিলা আমায় দেখে উঠে দাঁড়ালেন, ‘এসো অতীন, সুনীলকে পেলে?’

বুঝলাম সুর্মার সঙ্গে ওর এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমি বললাম, ‘না! ও দার্জিলিং-এ নেই!’

‘বাঃ গুড। আজকের রাতটা তাহলে এখানেই থেকে যাও। এসো, খেয়ে নিই আমরা।’

খাওয়ার টেবিলে বসে আবিষ্কার করলাম আমি সুর্মার মুখের দিকে কিছুতেই তাকাতে পারছি না। একটু আগে লায়লার সঙ্গে যে ঘটনা ঘটল তা কিছুতেই ভুলতে পারছি না। আমরা প্রায় নিঃশব্দেই খেয়ে নিলাম। যা কিছু কথা মহিলার সঙ্গে হচ্ছিল।

খাওয়া-দাওয়ার পর মহিলা বললেন, ‘তোমাদের কি ওয়াইন খাওয়ার অভ্যেস আছে?’ আমরা দুজনে একসঙ্গে মাথা নাড়ালাম। উনি হেসে সেলার থেকে ওয়াইন গ্লাসে ঢেলে একটা সিগারেট ধরিয়ে সোফায় ফিরে এলেন, ‘তোমরা নিশ্চয়ই খুব টায়ার্ড। ঘুম পাচ্ছে?’

সত্যি ক্লান্ত লাগছিল। উনি সেই মেয়েটিকে ডেকে আমাকে ঘর দেখিয়ে দিতে বললেন। আমি উঠে দাঁড়াতে বললেন, ‘আমার স্বামীর একটা স্লিপিং গাউন আছে ও ঘরে, চেঞ্জ করে নিও! আর হ্যাঁ, গুডনাইট!’

আমি এবার সুর্মার দিকে তাকালাম। নতুন পোশাকে ওকে বেশ দেখাচ্ছে। আর হঠাৎ আমার শরীরে সেই উত্তাপটা ফিরে এল। আমি কোনওরকমে বললাম, ‘কাল খুব ভোরে আমাদের বেরিয়ে যেতে হবে।’ তারপর আর দাঁড়ালাম না।

ঘরে এসে নিজের বিছানায় আলো নিভিয়ে শুয়েও আমার ঘুম এল না। লায়লা আমার শরীরে আগুন জ্বেলে গিয়েছে। বারংবার সুর্মার মুখ মনে পড়ছে। সুর্মাকে আমি ভালোবাসি। অমরা এক বাড়িতে আছি অথচ—। আমার খুব ইচ্ছে করছিল সুর্মাকে চুমু খেতে। কিন্তু ওই মহিলা, সুর্মা মহিলাকে কতটুকু বলেছে কে জানে! সুর্মাকে কোন ঘরে শুতে দিতে পারে আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম! ওপরে তো তিনটে শোওয়ার ঘর লক্ষ করেছি। নিশ্চয়ই পরেরটা। মাঝখানে একটা দরজা আছে এবং সেটা ভারী পর্দাতে ঢাকা। দরজাটা কি খোলা? আমি বিছানায় উঠে বসলাম। আমার কিছুতেই ঘুম আসছে না।

প্রায় ঘণ্টাখানেক আমি নিঃশব্দে বসে থাকলাম। সুর্মাকে এবার দেখার বাসনা তীব্র হয়ে উঠেছে। পা টিপে-টিপে পর্দাটা সরালাম। সামান্য চাপ দিয়ে বুঝলাম দরজাটা ওপাশ থেকে বন্ধ। এটা কি কখনও খোলা হয় না। ভাবলাম বাথরুমে গিয়ে মুখে জল দিলে ঘুম আসবে। ঝকঝকে বাথরুমে ঢুকে নীলচে আলো জ্বালাতেই নজরে পড়ল ওপাশে আর-একটা দরজা আছে। দুটো ঘরের জন্য কমন বাথরুম? খুব সন্তর্পণে ঠেলতেই দরজা খুলে গেল। আমি চোরের মতো অন্য ঘরটিতে প্রবেশ করলাম। কোনও আলো জ্বলছে না। অন্ধকারে নিজের চোখকে অভ্যস্ত করতে কিছু সময় নিলাম। ঘরের ঠিক ডানদিকে একটা খাট আর তাতে গলা অবধি কম্বল ঢাকা দিয়ে কেউ শুয়ে আছে। এগিয়ে যেতেই চমকে উঠলাম। খাটের ওপাশে কাঠের মেঝেতে বিছানা করে আর একজন শুয়ে। অনুমানে বুঝলাম সেই মেয়েটি নিশ্চয়ই সুর্মা। কিন্তু সুর্মা না হয়ে যদি ওই মহিলা হন, বুকে কাঁপুনি এল। এই ঘরে রাত্রে ওর কাছে ধরা পড়লে কী পরিণতি হবে বলা মুশকিল। তবু আমি শেষবার খাটে শোওয়া শরীরটির মুখ দেখতে চাইলাম। অন্ধকার মানুষের মুখকে এত আড়ালে রাখে কেন? আমি আবার নিঃশব্দে আমার ঘরে ফিরে এসে বিছানায় আছড়ে পড়লাম।

নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে ট্রেনটা বেশি দেরিতেই পৌঁছেছিল। স্বপ্নেন্দু সুর্মার মাকে নিয়ে একটা ট্যাক্সি করলেন। বললেন, ‘ভাই খুব বিপদে পড়ে এসেছি কার্শিয়াং-এ পৌঁছে দিন।’

ড্রাইভার নেপালি হলেও পরিষ্কার বাংলা বোঝে এবং বেশ বয়স্ক বলেই বিপদের কথা শুনে একটু সচকিত হল। গাড়ি চালু করে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেউ হাসপাতালে আছে?’

‘না ভাই। আমার কলেজে পড়া মেয়েকে ওই বয়সি ছেলে ভুলিয়ে নিয়ে এসেছে এখানে গতকাল। আমরা তাকে খুঁজতে যাচ্ছি।’ স্বপ্নেন্দু বললেন।

অন্যসময় হলে চট করে কাউকে এরকম কথা তিনি বলতে পারতেন না। কিন্তু এখন বলে-বলে এই বলাটা তাঁর কাছে সহজ হয়ে গিয়েছে।

ড্রাইভার বলল, ‘পুলিশে খবর দিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ।’

হঠাৎ ড্রাইভারের কিছু মনে পড়ল। সে সামনের কাচে চোখ রেখে শুধোল, ‘আপনার মেয়ে কি প্যান্ট পরে? সুন্দরী?’

সুর্মার মা এতক্ষণ এদের কথা শুনছিলেন এবার সোৎসাহে বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ও প্যান্ট-শার্ট পরেই এসেছিল। আপনি দেখেছেন?’

ড্রাইভার বলল, ‘ছেলেটি ওর চেয়ে অল্পবয়সি? মুখে দাড়ি আছে?’

স্বপ্নেন্দু বললেন, ‘না অল্পবয়সি নয়, তবে দাড়ি আছে। ঠিকই দেখেছেন আপনি। ও ভগবান! যাক তাহলে আমরা ভুল জায়গায় যাচ্ছি না। ভাই, ওদের আপনি কোথায় দেখেছেন?’

ড্রাইভার জানাল, কাল বিকেলে সে যখন কার্শিয়াং যাচ্ছিল তখন ওই দুটি ছেলেমেয়ে হাত তুলে তার গাড়ি থামাতে চেয়েছিল। ওরকম সাধারণ পাহাড়ি গাঁয়ে এইরকম চেহারার বাঙালি ছেলেমেয়ে দেখতে পাওয়া যায় না। কিন্তু সঙ্গে যাত্রী থাকায় সে আর থামেনি। এই ছেলেমেয়ে দুটিকে ফেরার পথে কিন্তু চোখে পড়েনি। তার মানে ওরা গাড়ি পেয়ে গিয়েছিল।

স্বপ্নেন্দু উৎসাহ পেলেন। মেয়েকে তিনি ফিরিয়ে নিয়ে যাবেনই।

পাহাড়ে যখন গাড়িটা উঠছিল তখন স্বপ্নেন্দুর মন খারাপ হয়ে গেল। অনেক জায়গায় সুর্মাকে নিয়ে তিনি বেড়াতে গিয়েছেন, কিন্তু এই দার্জিলিংটা হয়ে ওঠেনি। সেই এলেন, কীভাবে এলেন? গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে ভাবছিলেন, দুটো রাত কেটে গেল। কীরকম আছে সুর্মা কে জানে!

কার্শিয়াং পুলিশ স্টেশনে পৌঁছে ট্যাক্সিটাকে ছেড়ে দিলেন না স্বপ্নেন্দু। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে অফিসারের সঙ্গে দেখা করলেন। অফিসার ইন চার্জ বাঙালি, রিটায়ার্ড হতে আর বেশি দেরি নেই। স্বপ্নেন্দু ওঁর সমস্যার কথা বলতে ভদ্রলোক বললেন, ‘হ্যাঁ তারা তো কার্শিয়াং আসেনি।’

‘আপনি কি এ ব্যাপারে নিশ্চিত?’

‘সিওর। এখানাকার সব হোটেলে সার্চ করেছি। গতকাল অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে পেলেই জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তাই নিয়ে কী ঝামেলাটাই না হল। উফ। না, কার্শিয়াং-এ আপনার মেয়ে আসেনি।’

‘সুনীল, সুনীল প্রধানের বাড়িতে—।’

অফিসার বললেন, ‘সুনীল দার্জিলিং-এর হোস্টেলে। কাল বিকেলে খোঁজ নেওয়া হয়ে গিয়েছে। না মশাই, আমার মনে হচ্ছে আপনার মেয়ে এদিকে মোটেই আসেনি। এলে স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড এবং এই কার্শিয়াং-এর বাস স্টপেজে ধরা পড়ে যেতই। আজকালকার ছেলেমেয়েরা বড্ড ব্লাফ দেয়।’

স্বপ্নেন্দু মাথা নাড়লেন, ‘না, ওরা এদিকেই এসেছে। আমাদের ট্যাক্সি ড্রাইভার গতকাল ওদের দেখেছে হাত নেড়ে লিফট চাইতে। আমি একবার সুনীলের বাড়িতে যেতে চাই। কীভাবে যাব?’

অফিসার খুব জোরে মাথা নাড়লেন, ‘সে চেষ্টা একদম করবেন না। খুব ডেঞ্জারাস এলাকায় ওদের বাড়ি। আমি ফোর্স না নিয়ে যাই না। ওর বাবার খুব পয়সা আছে, কিন্তু এই শহরের এক নম্বর কুখ্যাত লোক, খুনজখম ওই বস্তিতে লেগেই আছে। আপনি বরং এক কাজ করুন, সোজা দার্জিলিং-এ গিয়ে সুনীলের সঙ্গে দেখা করুন।’

স্টেশনের পাশে একটি হিন্দুস্থানীর দোকান থেকে ওরা সকালের চা খেলেন। তারপর ট্যাক্সিতে ফিরে গিয়ে বললেন, ‘দার্জিলিং-এ যেতে হবে।’ লোকটা সম্মতি জানাল। সুর্মার মাকে গাড়িতে বসিয়ে দুটো পান কিনে দিয়ে স্বপ্নেন্দু যখন ফিরছেন তখন উল্টোদিকে একটা শাটল জিপ থেকে ওরা নামল। অতীন পানের দোকানের ওপর ইংরেজিতে পানবাহার কথাটা লক্ষ করে সুর্মাকে দাঁড়াতে বলে এগিয়ে এল। আর তখনই স্বপ্নেন্দু ট্যাক্সির দরজা বন্ধ করে স্ত্রীর হাতে পান দিলেন। ট্যাক্সিতে বসে ঘাড় ঘোরালেই মেয়েকে দেখতে পেতেন কিংবা সুর্মা চলে যাওয়া ট্যাক্সিটার দিকে আর-একটু আগে তাকালেই বাবাকে দেখতে পেত। দুজনের কেউ জানল না, জানতে পারল না।

অতীন সুনীল প্রধানের নাম বলতেই পানের দোকানের লোকটা একটা ছোকরাকে ডাকল, ‘এ কাঞ্চা, এত্তা আও।’

ছোকরা যেন নির্দেশিত ছিল। সে অতীনকে বলল, ‘চলিয়ে।’ অতীন সুর্মাকে ইশারায় ডেকে ওর সঙ্গে চলতে শুরু করল। দার্জিলিং থেকে এসে এই জায়গাটাকে তেমন পছন্দ হচ্ছিল না সুর্মার। অবশ্য দার্জিলিং-এর কিছুই সে দেখতে পায়নি। তবু জিনা দোরজির জন্যে দার্জিলিংটাকে ওর বেশ পছন্দ হচ্ছিল! আজ ভোরে ঘুম ভেঙে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে যখন আকাশের দিকে তাকিয়েছিল তখন সেদিকটা ছিল ঘোলাটে আচ্ছন্ন। তারপর হঠাৎ একটা লালচে সোনার মুকুট উঁকি দিল কুয়াশা ফুঁড়ে। তখনি চট করে সরে যেতে লাগল কুয়াশারা, আর ঝকমকিয়ে উঠল কাঞ্চনজঙ্ঘা। সুর্মা এক অনির্বচনীয় আনন্দে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঠিক সেই সময় পেছনে হাতের ছোঁয়া পেয়ে চমকে দেখল জিনা পেছনে দাঁড়িয়ে। হেসে বলল, ‘ওই দিকে তাকালে পৃথিবীর সব অহঙ্কার ভেঙে যায় তাই না? কেমন ঘুম হয়েছে?’

ঘাড় কাৎ করে সুর্মা বলেছিল, ‘ভাল।’

‘আজ তো তোমরা কার্শিয়াং-এ চলে যাবে?’

সুর্মা মাথা নাড়ল। কী বলবে সে!

‘শোনো, এভাবে পালিয়ে থেকে জীবনে সুখী হওয়া যায় না। যা সত্যি তার মুখোমুখি হওয়া সবচেয়ে ভালো। তুমি যদি চাও আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি! তোমাদের কলকাতার বাড়িতে টেলিফোন আছে?’

সুর্মা মাথা নেড়ে না বলল।

‘ভেবে দ্যাখো, তুমি চাইলে আমি পুলিশকে খবর দিতে পারি যাতে তোমার বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করে।’

‘কিন্তু—?’ অতীনের মুখ মনে পড়ল সুর্মার। বাবা কি কখনও তাকে ক্ষমা করবেন? করলেও অতীনকে মেনে নেবেন? সে যতদূর জানে কখনও তা সম্ভব নয়। সে মাথা নাড়ল, না। আর অতীনকে ছেড়ে যাওয়ার কোনও প্রশ্ন ওঠে না। এখন যা হোক তা একসঙ্গেই হবে। জিনা দোরজি হেসেছিল, ‘জীবনটা কখনই অ্যাডভেঞ্চার নয়। আমার উচিত ছিল তোমাদের এইভাবে ছেড়ে না দেওয়া, কিন্তু তোমরা যখন নিজেই চাইছ। যা হোক, দার্জিলিং-এর কাছাকাছি থেকে যদি বিপদে পড় তাহলে সোজা আমার কাছে চলে এসো।’

কার্শিয়াং-এ আসার পথে সুর্মা ভাবছিল কেন জিনা দোরজি তাদের পুলিশে না ধরিয়ে দিয়ে অমন যত্ন-আত্তি করল? কিছুতেই একটা সন্তোষজনক ব্যাখ্যা তৈরি করতে পারল না সে।

কিন্তু এখন অতীনের সঙ্গে হাঁটতে-হাঁটতে ওর ক্রমশ ভালো লাগছিল। বেশ উত্তেজনা আছে এইভাবে পালিয়ে বেড়ানোর মধ্যে। বিদেশি বইতেই শুধু এইরকম অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ পাওয়া যায়।

বড় রাস্তা থেকে অনেকটা নিচে নেমে এল ওরা। খুব গরিব এলাকা দিয়ে কিছুটা হাঁটার পর ছেলেটা বলল, ‘আ গিয়া।’

খুব সাধারণ একটা কাঠের বাড়ির বারান্দায় সুনীল দাঁড়িয়েছিল। ওদের দেখে নেমে এল সহাস্যে, ‘হ্যালো, গুড মর্নিং।’

অতীন হাসল। তারপর সুনীলের প্রসারিত হাতে হাত রাখল, ‘তোমার বাড়ি?’ সুনীল মাথা নাড়ল, ‘ইয়েস। তোমার গার্ল ফ্রেন্ডের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দাও!’ অতীন তাড়াতাড়ি সুর্মাকে বলল, ‘এই হল সুনীল, তুই তো নাম জানিস। আর এই হল সুর্মা।’

‘সুর্মা! বাঃ দারুণ নাম! অতীন ইউ আর লাকিয়েস্ট ম্যান অফ ওয়ার্ল্ড! আপনি খুব সুন্দরী, রিয়েলি।’ সুনীল হ্যান্ডশেক করার জন্যে হাত বাড়ালে সুর্মা কী করবে বুঝতে পারল না। এইভাবে তাকে কখনও সামনাসামনি কেউ রূপের প্রশংসা করেনি। সে কোনওরকমে হাত ছুঁইয়ে নামিয়ে নিল।

সুনীল বলল, ‘নাউ, লেটস মুভ। আমার বাড়িতে পুলিশ আসতে পারে তাই তোমাদের জন্যে আলাদা ব্যবস্থা করেছি।’ ছোকরাটিকে বিদায় করে সে ওদের নিয়ে চলল। সুর্মা লক্ষ করল সুনীল খুব সেজেছে। জিনস-এর প্যান্টটা এত চাপা যেন ওর শরীর আঁকড়ে আছে। ভালো করে তাকাতে লজ্জা করল সুর্মার। ওপরে একটা চামড়ার জ্যাকেট, মাথায় কায়দা করা টুপিতে খুব স্মার্ট লাগছে ছেলেটাকে। কিন্তু প্রথমবার দেখেই সুর্মার ওকে পছন্দ হয়নি। ছেলেটার চাহনির মধ্যে এমন কিছু আছে যা অতীনের নেই। ছেলেটিকে ঈশ্বর সরলতা দেননি।

সুনীল দুঘরের একটা বাড়িতে ওদের তুলল। একজন বুড়ি নেপালি মহিলা সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছিল, সুনীল তাকে বলল, ‘দিদি এরা আমার বন্ধু, তোমার কাছে কদিন থাকবে!’

বুড়ি পেতলে বাঁধানো দাঁত দেখিয়ে হাসল। ঘরে ঢুকে সুর্মা দেখল একটা খাটের ওপর পাতলা তোষক, চাদর আর টেবিল ছাড়া আর কোনও সরঞ্জাম নেই। সুনীল বুড়িকে বলল, ‘কম্বল ছইনা?’

‘ছ।’

সুনীল বলল, ‘পাশেই বাথরুম আছে। দিদি তোমাদের খাবার তৈরি করে দেবে। ওকে রোজ বিশ টাকা দিতে হবে। তোমার কাছে টাকা আছে অতীন?’

অতীন বলল, ‘হ্যাঁ।’

‘ঠিক আছে। আমি এখন যাচ্ছি, তোমরা ঘর থেকে বেশি বেরিয়ো না। যত কম লোকে তোমাদের দেখে তত ভালো। আই হোপ য়ু উইল লাইক টু স্টে ইন দিস কোজি রুম! বাই।’ সুনীল একটা চোখ টিপে চলে গেল।

দার্জিলিং থানার অফিসার ইনচার্জ-এর বক্তব্য শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন স্বপ্নেন্দু। না, সুর্মারা এখানেও আসেনি। প্রতিটি হোটেল চেক করা হয়েছে কিন্তু ওদের পাওয়া যায়নি। এবং সুনীল প্রধানকে কাল বিকেলের পর ওর হোস্টেলে পাওয়া যাচ্ছে না। স্বপ্নেন্দু কী করবেন প্রথমে ভেবে পেলেন না। তিনি অফিসারকে ট্যাক্সি ড্রাইভার যা দেখেছিল তাই বললেন। শুনে ভদ্রলোকের কপালে ভাঁজ পড়ল। তিনি বললেন, ‘আমার সঙ্গে চলুন আপনারা। উই শুড ফাইন্ড হিম ফার্স্ট। ছেলেটির মোটেই সুনাম নেই। আপনার মিসেস ইচ্ছে করলে এখানে অপেক্ষা করতে পারেন।’

কিন্তু সুর্মার মা বেঁকে বসলেন, ‘না, আমিও যাব।’

অফিসারের সঙ্গে হেঁটে ওরা হোস্টেলে এলেন। সুনীলের রুমমেট কিছুই বলতে পারল না। অনেক প্রশ্ন করে ক্লান্ত হয়ে ওঁরা যখন বেরিয়ে আসছেন তখন স্বপ্নেন্দু দারোয়ানকে দেখতে পেলেন। তিনি দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা ভাই, সুনীল কোথায় গিয়েছে জানো?’

‘নেহি সাব।’

অফিসার প্রশ্ন করলেন, ‘কাল কোথায় গিয়েছিল?’

‘শায়েদ ব্লু বয় রেস্টুরেন্টে। ওহি জায়গাতে ডেইলি যাতা থা।’

স্বপ্নেন্দু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কাল ওকে কেউ খুঁজতে এসেছিল?’

‘পুলিশ আয়া থা রাতমে।’

‘আর কেউ?’

‘হ্যাঁ সাব। এক বাঙালি লেড়কা আয়া থা সাত বাজে।’

অফিসার সচকিত হলেন, ‘বাঙালি? কীরকম দেখতে?’

‘থোড়াসা দাড়ি হ্যায়।’

স্বপ্নেন্দু চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘অতীন। নিশ্চয়ই অতীন।’

দারোয়ানের কথামতো ওরা ব্লুবয়-তে উপস্থিত হল। এখন বার একদম ফাঁকা। পুলিশ অফিসারকে দেখে ম্যানেজার এগিয়ে এল, ‘ইয়েস স্যার?’

‘আপনার এখানে রোজ সন্ধেবেলায় সুনীল প্রধান আসে?’

ম্যানেজার একটু ইতস্তত করে বলল, ‘ইয়েস।’

‘গতকাল এসেছিল?’

‘হ্যাঁ।’

‘ওর টেবিলে কোন বেয়ারা ছিল?’

বেয়ারাকে ডেকে আনা হলে সে জানাল সুনীল তার চার বন্ধু-বান্ধবীকে নিয়ে বিকেল থেকে এখানে বসে ড্রিঙ্ক করেছে। হ্যাঁ, একজন বাঙালি ছেলে ওর খোঁজে এসেছিল। তার মুখে দাড়ি আছে। তাকে মনে আছে যে সুনীল প্রধানের এক বান্ধবী তার ড্রিঙ্কস নিয়ে চুমু ছুঁড়ে দিয়েছিল। স্বপ্নেন্দু অবাক হলেন। অতীনকে অপরিচিত মেয়ে চুমু খাচ্ছে? কী কাণ্ড।

বেয়ারা তারপর আর ওদের লক্ষ করেনি বলে জানাল। অফিসার মেয়েটির নাম জেনে হেসে ফেললেন, ‘সি ইজ হেডেক অফ হার ফ্যামিলি। দার্জিলিং-এর ছেলেদের নষ্ট করছে। কুড়ি বছর বয়সেই কতবার যে প্রেমিক চেঞ্জ করল কে জানে। ওকে চাপ দিলে মনে হয় কিছু খবর পাওয়া যাবে।’

লায়লাকে বাড়িতেই পাওয়া গেল। স্বপ্নেন্দু দেখলেন মেয়েটির শরীরে যৌবন যেন বিপর্যস্ত। একটা হালকা হাউসকোট পরে আছে। ওর মা কড়াগলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী দরকার আমার মেয়ের সঙ্গে?’

‘আমি ওকে কয়েকটা প্রশ্ন করব। সুনীল প্রধান কোথায়?’

লায়লা হাসল, ‘আই ডোন্ট নো। কাল রাত্রে আমাদের ছেড়ে ও একা চলে গেছে। আপনারা তো সন্ধে থেকে ওর পেছনে লেগেছেন!’

‘আচ্ছা, তুমি জানো?’

‘ইয়া। সেটা শুনেই ও ছেলেটাকে নিয়ে ব্লু-বয় থেকে পালিয়েছিল। অবশ্য কিছুক্ষণ বাদেই রাস্তায় আমাদের দেখা হয়েছিল। হি ইজ হিরো।’

‘হুম, ছেলেটা কোথায়?’

‘দ্যাট বেঙ্গলি বয়? বোনলেস ক্রিয়েচার! আমার সঙ্গে এই বাড়ি অবধি এগিয়ে গেল। আশেপাশের কোনও বাড়িতে উঠেছে সে।’

‘তুমি ঠিক বলছ? দাড়িওয়ালা বাঙালি ছেলে?’

‘ইয়া। আই অ্যাম লি ফিলিং হিজ বিয়ার্ড। বাট হি ইজ নট এ ম্যান।’ ঠোঁট বেঁকাল লায়লা। আর সঙ্গে-সঙ্গে ওর মা চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওঃ লায়লা, শাট আপ!’

রাস্তায় নেমে অফিসার বললেন, ‘মিস্টিরিয়াস। ওরা এখানে কার বাড়িতে উঠতে পারে? চেনাশোনা হল কী করে?’

ভদ্রলোক স্বপ্নেন্দুদের নিয়ে বাড়ি-বাড়ি ঘুরে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। অনেকগুলো বাড়ির পর একটা দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। হ্যাঁ, এই বর্ণনায় একটি ছেলে অনেক রাত্রে বাড়িতে ঢুকতে চেয়েছিল। কিন্তু সে তাকে ঢুকতে দেয়নি। কারণ ছেলেটি একজন মেমসাহেবের খোঁজ নিচ্ছিল আর বলছিল তার কাছে ছেলেটির আত্মীয়রা আছে। তাড়া খেয়ে ছেলেটির পাশের বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। পাশের বাড়িতে নক করে পুলিশ অফিসার বললেন, ‘এখানে কী করে আসবে বুঝতে পারছি না। মিসেস দোরজি খুব রেসপেক্টবল মহিলা।’

মিসেস দোরজি নিজেই নেমে এলেন, ‘ইয়েস অফিসার।’

‘আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত। গতকাল আপনার এখানে দুটো অল্পবয়সি বাঙালি ছেলেমেয়ে এসেছিল?’

জিনা স্বপ্নেন্দু এবং সুর্মার মাকে দেখলেন, ‘হ্যাঁ, এসেছিল।’

স্বপ্নেন্দু উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘এসেছিল! তারা আছে?’

মাথা নাড়লেন জিনা, ‘না। তারা আজই কার্শিয়াং চলে গেছে।’

অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কার্শিয়াং-এ কোথায়?’

‘আই ডোন্ট নো। কাল বাগডোগরা থেকে ফেরার পথে ওরা আমার কাছে লিফট চাইল। রাত হয়ে গেছে এবং ওরা নিউকামার বলে আমার একটু সফট হতে ইচ্ছে করল। ছেলেটি যার ওপর ডিপেন্ড করেছিল তাকে এখানে পায়নি। ফলে আমার এখানে শেল্টার নিয়েছিল ওরা। আজ সকালে ওরা চলে গেছে। হোয়াই, এনিথিং রং?’ মিসেস দোরজি জিজ্ঞাসা করলেন!

‘হ্যাঁ। ওরা পালিয়ে এসেছে। এঁরা হলেন মেয়েটির মা-বাবা। ওই ছেলেটি সুস্থ নয়। অনেক ধন্যবাদ।’ অফিসার উঠে দাঁড়ালেন।

‘এক মিনিট!’ জিনা এগিয়ে এলেন সুর্মার মায়ের কাছে, ‘আমি আপনার কষ্ট বুঝতে পারছি। আপনার মেয়ের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। শি ইজ গুড গার্ল। কী নরম। এটুকু বলতে পারি এখনও অবধি সে ভালো আছে।’

সুর্মার মা হঠাৎ কেঁদে ফেললেন। তাঁর শরীর কাঁপতে লাগল। স্বপ্নেন্দু নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করলেন, ‘যে মেয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে তার জন্য কাঁদছ কেন? চলো।’

মিসেস দোরজি বললেন, ‘অফিসার, মে আই গিভ ইউ লিফট?’

‘আপনি বেরুবেন?’

‘হ্যাঁ।’

ওঁরা মিসেস দোরজির গাড়িতে থানায় ফিরে এলেন। এখন দুপুর পেরিয়ে গেছে। সারাদিন ওঁদের খাওয়া হয়নি। কিন্তু সামান্য ক্ষুধা বোধ করছিলেন না। অফিসারের ধারণা ওরা সুনীলের কাছেই গিয়েছে। সুনীলকে অ্যারেস্ট করে আনতে হবে। এস. পি-র কাছ থেকে ফোর্স নিয়ে যাওয়ার অর্ডারটা আনতে সামান্য দেরি হবে। ওদের কোনও রেস্টুরেন্টে খেয়ে নিয়ে নিতে বললেন অফিসার। জিনা আর অপেক্ষা করেননি, উনি বুঝতে পারছিলেন কাজটা ঠিক হয়নি। সুনীল মোটেই ভালো ছেলে নয়! তবু ওর কথা এঁদের বলতে পারলেন না। এই টিন-অ্যাডভেঞ্চারটা তিনি কেন জানেন না পছন্দ করে ফেলেছেন। নিজের মেয়ে হলে নিশ্চয়ই বাধা দিতেন, কিন্তু নিজে ওই বয়সে এমন ভেসে পড়তে পারলে হয়তো খুশি হতেন। এই চল্লিশ বছর বয়সে কাউকে বিয়ে করতে যে দ্বিধা আসছে তার ছেলেমেয়েদুটোর তা নেই। নিজের ইচ্ছেটা গোপনে-গোপনে ওদের মধ্যে কি দেখতে পেয়েছেন তিনি? সুর্মার মাকে দেখে তাঁর খুব অস্বস্তি হচ্ছিল তাই পালিয়ে বাঁচলেন। কাজ আছে বলে বিদায় নিয়েছেন। খুব তাড়াতাড়ি দুপুরটা ফুরিয়ে আসছিল দার্জিলিং-এ।

একটু আগে ভাত আর মাংসের ঝোল খেয়েছি আমরা। রান্নাটা মোটেই ভালো নয়। অতীন দেখলাম খুব খেল। আমি সামান্য। খাওয়া-দাওয়ার পর অতীন খাটে শুয়ে পড়লে আমি কী করব বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ খেয়াল হল, এই ঘরে আমাকে অতীনের সঙ্গে থাকতে হবে। সঙ্গে-সঙ্গে খুব অস্বস্তি হল, সেই সঙ্গে লজ্জা। আমাদের মধ্যে এমন কোনও সম্পর্ক এখনও গড়ে ওঠেনি যে এভাবে থাকা যায়। স্বামী-স্ত্রী ছাড়া কেউ এরকম থাকে? আমি যদি পাশের ঘরে বুড়ির সঙ্গে থাকি? এই সময় অতীন আমাকে ডাকল, ‘এই, তুই কী ভাবছিস?’

‘কিছু না।’ আমি টেবিলের ওপর পড়ে থাকা একটা ভারী লোহার রড স্পর্শ করলাম।

‘দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এখানে আয়।’

‘কেন?’

‘বারে। ওইভাবে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকবি?’

‘আমি তোর সঙ্গে একঘরে থাকতে পারব না!’ কথাটা বলেই ফেললাম।

‘কেন?’ অতীন উঠে বসল।

‘বাঃ। থাকা যায়?’

‘কেন? থাকা যায় না কেন?’

আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। ও কি কিছু বোঝে না? না কোনও ফন্দি করে এই কথা বলছে! বললাম, ‘যায় না তাই।’

অতীন নেমে এল। এসে আমার কাঁধে হাত রাখল, ‘এই সুর্মি, তুই আমাকে একটুও ভালোবাসিস না? আমি তোর জন্যে প্রাণ দিতে পারি!’

কথাটা শোনামাত্র আমি থরথর করে কেঁপে উঠলাম। ও হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরল, ‘এই কী হয়েছে তোর? কাঁপছিস কেন?’

আমি বললাম, ‘ছেড়ে দে, আঃ।’

ও বলল, ‘না ছাড়ব না। আমি তোকে ভালোবাসি, তাই এভাবে বুকে জড়িয়ে ধরব।’ ও আমাকে ছাড়ছিল না, কিন্তু বুঝলাম ও হাঁপাচ্ছে। আমি প্রাণপণে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু অতীনের গায়ের জোর যেন অনেক গুণ বেড়ে গেছে। আমরা সারা ঘরে যেন লড়াই করতে লাগলাম। বুঝতে পারলাম অতীনের মুখ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, নিশ্বাস গরম। শেষ পর্যন্ত আমরা খাটের ওপর আছড়ে পড়লাম। আমার পিঠে খুব ব্যথা করল আর আমি হেরে গেলাম। অতীন তখনি আমার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট রাখল। এই প্রথম কোনও পুরুষ আমাকে চুম্বন করল। অতীন পাগলের মতো আমাকে চুমু খেয়ে যাচ্ছে, ঠোঁটে, গালে, চোখে, গলায়। আমি স্থির হয়ে পড়ে আছি। এবং এই সময় আমার কান্না পেতে লাগল। হঠাৎ অতীন চুমু খাওয়া থামিয়ে বলল, ‘সুর্মি, তুই আমাকে চুমু খা। একটু চুমু, প্লিজ। তোকে আমি কী ভীষণ ভালোবাসি!’ ও আমার কাছে ভিক্ষে চাওয়ার মতো বলতে লাগল। তারপরেই ওর চোখ পড়ল আমার চোখে। দেখলাম অতীনের ঠোঁট নেমে আসছে। দুহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে পরম যত্নে ও ঠোঁট দিয়ে আমার চোখের জল শুষে নিল। তারপর আমার গলায় মুখ রেখে পড়ে রইল। কী হল জানি না, এই প্রথম আমি ওকে অস্বীকার করতে পারলাম না। অজান্তেই ওর মাথায় আমার ডান হাতে উঠে এল। আমি চুপচাপ সেই অবস্থায় ওর চুলে বিলি কাটতে লাগলাম। এবং এই প্রথম আমি, কেমন করে জানি না, অতীনকে ভালোবেসে ফেললাম।

এই ঘরে ইলেকট্রিক আলো নেই। আমার পাশে শুয়ে অতীন বলল, ‘আজ থেকে তুই আমার বউ। আমার হাতে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা কর কোনও অবস্থায় আমাকে ছেড়ে যাবি না।’

আমি ওর হাতে হাত রেখে হাসলাম, ‘ঠিক আছে।’

‘না ঠিক আছে বললে চলবে না। পুরোটা বল।’

আমি হাসলাম, ‘তুই ভীষণ ছেলেমানুষ।’

ওর দুই চোখ তৃপ্তিতে ভরে গেল। আবার চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল আমার পাশে। এখন ঘরে বেশ ঘন ছায়া। সারাটা দুপুর ও আমাকে আদর করেছে। কিন্তু মেয়ে বলে আমি যে কারণে সিঁটিয়ে ছিলাম ও তার ধার দিয়েই গেল না। শুধু চুমু আর স্পর্শেই ওর শান্তি। মাঝে-মাঝে মনে হচ্ছিল ও মোটেই বড় হয়নি। আমার চেয়ে অনেক কম বোঝে। তাই বোধহয় স্বস্তিতে ছিলাম। ক্রমশ আমার মনে হতে লাগল আমি যা বলব ও তাই করবে। একধরনের নিরাপত্তা বোধ এল এই অহঙ্কার থেকে।

এই সময় দরজায় কেউ শব্দ করল। অতীন ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কে রে?’

‘বুড়িটা হতে পারে! দ্যাখ না।’

অতীন উঠে দরজা খুলল। একটা বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। বলল, ‘আপকো বোলাতা হ্যায়।’

‘কৌন?’

‘সুনীল।’

আমি খাটে উঠে বসেছিলাম, অতীন বলল, ‘কী ব্যাপার কে জানে। তুই ঘরে থাক আমি ঘুরে আসছি।’

‘তাড়াতাড়ি আসিস।’

অতীন আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর ছেলেটার সঙ্গে বেরিয়ে গেল। আমি উঠলাম। অন্যমনস্কভাবে চুলে হাত দিতে গিয়ে মনে পড়ল আমার চিরুনি নেই। অতীনকে বলতে হবে কয়েকটা জিনিস কিনতে। আমার আর-একটা পোশাক দরকার। এই শার্ট-প্যান্টে কতদিন থাকা যায়!

আমার আজ বেশ ভালো লাগছিল। আমার ভেতরে যে আর-একটা আমি আছে তা আজ প্রথম টের পেলাম। অতীনটা সত্যি ছেলেমানুষ। সত্যি।

বাইরে কারও জুতোর শব্দ হল। তাকিয়ে দেখলাম সুনীল দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখের দৃষ্টি অদ্ভুত। আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘মিস্টার কোথায়?

কথাটা আমার একটুও ভালো লাগল না। তবু জবাব দিলাম, ‘আপনার কাছে গেল। একটা ছেলে ডাকতে এসেছিল।’

‘কিন্তু আমি অপেক্ষা করে চলে এলাম! তোমাদের আগে ডিস্টার্ব করতে চাইনি। সারাটা দুপুর কেমন এনজয় করলে?’

আমার মাথা গরম হয়ে গেল। আমি কী বলব ওকে? অতীন এখনও আসছে না কেন? সুনীল ভেতরে ঢুকল, ‘তুমি দারুণ দেখতে। অতীনকে আমি একটা চাকরি জুটিয়ে দেব। কিন্তু তোমাকে আমার অন্য কাজে দরকার হবে।’

‘কী কাজ?’

‘নট সো কুইক। ইউ ডোন্ট লাভ হিম, ইজন্ট ইট? তোমাকে একবার দেখেই বুঝতে পেরেছি অতীন তোমাকে জোর করে নিয়ে এসেছে।’ ও হাসল, ‘আমাকে তোমার কেমন লাগছে?’ সুনীল আমার দিকে এগিয়ে আসছিল। আমার খুব ভয় করল। ওর মতলব যে ভালো নয় তা বুঝতে পারছি।

আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘আপনি এগিয়ে আসছেন কেন?’

‘টু সেভ ইউ ফ্রম পুলিশ। একটা চুমু খাও তো আমাকে। দেখি ওটা মিষ্টি না নোনতা? মাইন্ড ইট, এই কথা অতীনকে বললে আমি তোমাদের পুলিশে ধরিয়ে দেব।’ ও চোখ বন্ধ করে আমার দিকে মুখ বাড়িয়ে দিল।

রাগে আমার মাথা ঘুরে গেল। টেবিলের ওপর পড়ে থাকা লোহার রডটা তুলে প্রাণপণে ওর মাথায় আঘাত করতেই সুনীলের দুটো চোখে অবাক বিস্ময়ে ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। আমি দেখলাম ওর শরীরটা যেন খসে পড়ল মাটিতে আর মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগল! আমি চিৎকার করতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলাম। তারপরে অতীনের ব্যাগটা তুলে নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে এলাম বাইরে। বুড়িকে চোখে পড়ল না, আর তখনই অতীনকে দেখতে পেলাম। দ্রুত ফিরে আসছে। আমাকে দেখে অবাক হয়ে বলল, ‘কোথায় যাচ্ছিস?’ আমি কথা বলতে পারছিলাম না। দ্রুত ওর হাতে ধরে নিশ্বাস নিলাম। ‘তাড়াতাড়ি চল।’

‘কোথায়?’

‘এখান থেকে পালিয়ে যাব। প্লিজ, পরে কথা হবে।’

‘কিন্তু সুনীলকে পেলাম না। ওর সঙ্গে দেখা না করে চলে যাব কেন?’

‘পরে, পরে কথা বলব।’ আমি ওকে নিয়ে প্রায় দৌড়াচ্ছিলাম। অতীন নিশ্চয়ই খুব অবাক হচ্ছিল। বস্তিটা পেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে আমরা গাড়ির শব্দ পেলাম। খুব জোরে আসছে। আমার কী মনে হল জানি না, তাড়াতাড়ি একটা গাছের আড়ালে অতীনকে টেনে নিয়ে দাঁড়ালাম। এখন সন্ধের অন্ধকার নেমে আসছে। পুলিশের দুটো জিপকে ছুটে যেতে দেখলাম। অতীন ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ওরা আমাদের জন্যে আসছে নিশ্চয়ই।’

গাড়িদুটো চোখের আড়ালে যেতেই আমরা ছুটতে লাগলাম। রাস্তার লোকজন অবাক হয়ে আমাদের দেখছে। স্টেশনের কাছে এসে অতীন বলল, ‘কী করবি? কোথায় যাবি?’

আমি বললাম, ‘জানি না।’

সেইসময় একটা ট্রেন স্টেশন থেকে হুইসেল দিতে-দিতে বের হল। ছোট ট্রেনটা আমাদের সামনে দিয়ে এগোচ্ছে। আমরা আর কোনও চিন্তা না করে দৌড়ে ওই ধীরে চলা ট্রেনটায় উঠে পড়লাম।

সুনীলের বাবা পুলিশের কাছে সম্পূর্ণ অস্বীকার করল। না, এরকম কোনও বাঙালি ছেলেমেয়ে আজ তাদের কাছে আসেনি। পুলিশ তন্নতন্ন করে খুঁজল। অনেককে জেরা করল। স্বপ্নেন্দু দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখলেন। অফিসার বলছিলেন, ‘মুশকিল কী জানেন, এরা একজন যে কথা বলে আর কেউ তার উলটো বলতে পারে না কিছুতেই। সত্যি কথাটা এদের মুখ থেকে বের করা যায় না।’ স্বপ্নেন্দু ভাবছিলেন সুর্মা কী করে এইরকম পরিবেশে আসবে? মেয়েটার এত বছরের সংস্কার, অভ্যাস একদিনেই পালটে গেল।

সন্ধে সাতটা নাগাদ পুলিশ চলে গেলে সুনীলের বাবা খবরটা পেলেন। সেই বুড়ি একটু আগে সুনীলকে আবিষ্কার করেও পুলিশের ভয়ে কিছু বলেনি। তার ফলে বেশ দেরি হয়ে গেছে। সুনীলকে বাঁচানো গেল না।

মৃতদেহ সামনে নিয়ে সুনীলের বাবা কিছুক্ষণ বসে থাকল। তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না ওই ছেলেমেয়ে দুটো এই হত্যার জন্য দায়ী। কিন্তু এই কথা এখন পুলিশকে জানানো যাবে না। যাদের অস্তিত্বের কথা সে নিজে অস্বীকার করেছে তারাই যে ছেলেকে খুন করতে পারে এখন আর বলা যায় না। সে আটজন বিশ্বাসী লোককে ডাকল। তাদের ওপর দায়িত্ব দিল যেমন করেই হোক ওই বাঙালি ছেলেমেয়ে দুটিকে খুঁজে নিয়ে আসতে। পুলিশ যখন ওদের খুঁজছে তখন তারা কিছুতেই বেশিদূর যেতে পারবে না। নিজের সন্তানের মৃত্যুর বদলা নিয়ে তবে অন্য কথা। দুটো জিপ সঙ্গে-সঙ্গে দুদিকে বেরিয়ে গেল। তন্নতন্ন করে তারা খুঁজতে লাগল শহরের সব অলিগলি। তারপর রাত হলে বেরিয়ে পড়ল একদল দার্জিলিং-এর পথে আর একদল শিলিগুড়ির দিকে। প্রতিটি লোকই নিরুত্তাপ কিন্তু নির্দয়।

কার্শিয়াং থানায় বসে প্রথমে পুলিশ এসব টের পায়নি। দার্জিলিং-এর অফিসার বললেন, ‘আমার বিশ্বাস সুনীলের বাবা মিথ্যে কথা বলছে। ওরা এখানেই এসেছিল এবং সুনীল ওদের নিয়ে কোথাও লুকিয়ে আছে। কোথায় যেতে পারে? এক, শিলিগুড়িতে নেমে যেতে পারে। ওখানকার পুলিশকে সতর্ক করে দেওয়া হোক যাতে প্রতিটি হোটেলে সার্চ করে।

স্বপ্নেন্দুর খুব অসহায় লাগছিল! তিনি জানেন তাঁর স্ত্রী মনের জোরে হেঁটে-চলে বেড়াচ্ছেন। এই ছুটোছুটি সহ্য করার মতো শরীর তাঁর নয়। এখন তিনি কী করবেন। এইসময় একটি লোক এসে খবর দিল সুনীল প্রধানদের দুটো জিপ দার্জিলিং-এর দিকে ছুটে গেল। পানবাহার দোকানের মালিক বলছে যে ছেলেমেয়েদুটো সন্ধের ট্রেনে উঠেছে। এখান থেকে আর একটা খবর কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে যে সুনীল প্রধান নাকি খুন হয়েছে। ওই জিপ যাচ্ছে বদলা নিতে। সঙ্গে-সঙ্গে সাজ-সাজ পড়ে গেল। দার্জিলিং-এর অফিসার কার্শিয়াং-এর অফিসারকে বললেন সুনীলের ব্যাপারটা সত্যি কি না খবর নিতে।

একটু বাদেই দার্জিলিং-এর উদ্দেশ্যে দুটো জিপ বেরিয়ে এল থানা থেকে। অফিসার প্রথমে স্বপ্নেন্দুদের সঙ্গে নিতে চাইছিলেন না, কিন্তু ওঁর পীড়াপীড়িতে রাজি হলেন। পুলিশের লক্ষ এখন জিপ।

এঁকেবেঁকে ট্রেনটা চলছিল, এই প্রথম ওরা দার্জিলিং-এর টয়ট্রেনে উঠল, অথচ ওদের দুজনেরই মনে হচ্ছিল কেন সেই দার্জিলিং মেইলের মতো এই ট্রেনটা হুহু করে ছুটছে না। ট্রামের চেয়েও অল্প স্পিডে গড়িয়ে-গড়িয়ে পাহাড়ে উঠেছে গাড়িটা। মাঝে-মাঝে যখন আবার পিছিয়ে যাচ্ছে দম নিতে তখন এক ধরনের ভয় এসে জমছে, ওরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কার্শিয়াং থেকে পালাতে চায়।

বাইরে এখন চুরচুরে কুয়াশা। অন্ধকার সেই কুয়াশা মিশে গিয়ে একটা ঘোলাটে সমুদ্র হয়ে গিয়েছে। সুর্মা অতীনের দিকে তাকাল। কার্শিয়াং ছাড়াবার পর থেকেই কেমন চুপ করে গেছে ও। সমস্ত ঘটনা শোনার পর ওর দুটো হাত ধরে শুধু বলেছিল ‘তুই ঠিক করেছিস, ঠিক করেছিস।’

কিন্তু তাতে সান্ত্বনা পায়নি সুর্মা। মনের মধ্যে বিঁধে থাকা কাঁটাটা দপদপাচ্ছিল। সে খুন করল শেষ পর্যন্ত! খুনই তো! ছেলেটার মাথা থেকে যেভাবে রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরিয়েছে তাতে খুন ছাড়া কী হতে পারে! ও যদি সুনীলকে বুঝিয়ে বলত তাহলে সুনীল কি শান্ত হতো না! হঠাৎ সমস্ত শরীরে কনকনে বাতাস লাগল যেন। ও অতীনের হাত চেপে ধরল, ‘এই অতীন, খুন করলে ফাঁসি হয়, না রে?’

অতীন তাকাল, ‘কী বাজে বকছিস!’ হঠাৎ তার মাথার ভেতরে দ্রিমি-দ্রিমি শব্দ শুরু হল।

‘সত্যি করে বল না। খুন করলে ফাঁসি হয়?’

‘তুই খুন করেছিস কে বলল? সুনীল তো বেঁচেও যেতে পারে। তাছাড়া কী প্রমাণ আছে যে তুই খুন করেছিস? কে দেখেছে? পুলিশ যদি আমাদের ধরে তবেই তো এসব কথা উঠবে। সে আমি ম্যানেজ করে নেব।’

‘কী করে?’

‘মিথ্যে কথা বলে। তুই তো জানিস আমি খুব সুন্দর মিথ্যে কথা বলি।’ সুর্মা ওর দিকে তাকাল। ওর খুব কান্না পাচ্ছিল। ও মনে-মনে চাইছিল সুনীল যেন কোনও বিপদে না পড়ে।

ঠিক তখনই একটা জিপের হেডলাইটের আলো এসে পড়ল ট্রেনের গায়ে। কুয়াশার জন্যে দেখা যায়নি, আচমকা বাঁক পেরিয়ে জিপটা ট্রেনের ঠিক পাশে চলে এল। অতীন প্রথমে লক্ষ করেনি কিন্তু তিনটে লোক জিপ থেকে মুখ বের করে যেভাবে তাকাচ্ছে তাতে সতর্ক হল। জিপটা সাঁ করে এগিয়ে যেতে ট্রেনটা থেমে গিয়ে খুব জোরে-জোরে হুইসল দিতে লাগল। অতীন মুখ বের করে দেখল ট্রেনের আলোয় জিপটাকে দেখা যাচ্ছে, ঠিক লাইনের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে ওটাকে। টপাটপ কয়েকটা লোক নেমে এল টর্চ হাতে। এসে প্রথম কামরায় উঠে গেল। একটু বাদেই তারা নেমে এসে আবার দ্বিতীয় কামরায় উঠল।

অতীনের মাথার ভেতরটা টলে উঠল। পুলিশ! নিশ্চয়ই তাদের খুঁজতে এসেছে। না, কিছুতেই ধরা দেবে না ওরা! ও চট করে উঠে দাঁড়িয়ে সুর্মার হাত ধরে টানল, ‘চল, পালাই, পুলিশ!’ মাথার যন্ত্রণাটাকে আমল দিল না সে।

সুর্মাও লক্ষ করেছিল, ফ্যাঁসফেসে গলার বলল, ‘কী হবে?’

‘কিছু হবে না। এই পাহাড়ে কেউ আমাদের খুঁজে বের করতে পারবে না। চল, আর কথা বলার সময় নেই।’ কামরায় অন্য যাত্রীদের অবাক করে চোখের সামনে দিয়ে ওরা লাফিয়ে পাশের রাস্তায় নামল। তারপর এক দৌড়ে উল্টোদিকের পাহাড়ের গায়ে চলে এল।

হয়তো আগে এই পথে ঝরনার জল গড়িয়ে আসত, কিন্তু এখন তার শুকনো দাগ ছাড়া কিছু নেই। অতীন সুর্মার হাত ধরে দ্রুত ওপরে উঠছিল। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না প্রায়, সুর্মা একবার আছাড় খেতে-খেতে বেঁচে গেল। ওরা যখন বেশ কিছুটা ওপরে উঠে গেছে তখনই জিপটা ঘুরে এসে ঠিক ওদের নিচে দাঁড়াল। অতীন বুঝল ওদের পালানোটা ধরা পড়ে গেছে। এখনই ওরা পিছু ধাওয়া করবে। অনেক নিচে মানুষের চিৎকার শোনা যাচ্ছে।

অতীন সামনে তাকাতেই দেখল আকাশের মেঘ কেটে যাচ্ছে আর সেখানে একটা পানসে চাঁদ। তার ফিকে আলোয় চারধার সাদা। হঠাৎ ওর চারপাশে কেউ থাকল না। সেই যন্ত্রণাটা ফিরে এল মাথায়। আচমকা নিজের চুল খিমচে ধরে চিৎকার করে উঠল সে।

সুর্মা আর পারছিল না। এর মধ্যেই ওর পা থেকে রক্ত ঝরছিল। অতীনের চিৎকারে চমকে উঠে চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে, চিৎকার করছিস কেন?’

অথচ অতীন জবাব দিল না। দ্রুত ছুটে গেল ওপরে। সেখানে পাহাড়টা আচমকা শেষ হয়ে কেমন সমান হয়ে গিয়েছে। সেই মসৃণ পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে অতীন আকাশের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত শব্দ করতে শুরু করল। সুর্মা বুঝতে পারছিল না অতীনের কী হয়েছে, এরকম আচরণ করছে কেন। সে মরিয়া হয়ে ছুটে এল ওপরে। ঠিক সেই সময় দুটো জিপ হেডলাইট জ্বালিয়ে এসে দাঁড়াল নিচে। সুর্মার কানে বোধহয় গুলির শব্দ এল। কিন্তু সেটিকে মন দেবার সময় ছিল না ওর। দুহাতে অতীনকে আঁকড়ে ধরে সে চিৎকার করে উঠল, ‘অতীন, তুই এমন করছিস কেন? কী হয়েছে, বল?’

অতীন প্রচণ্ড শক্তিতে ওকে ঠেলে মাটিতে ফেলে দিল। তারপর বিকৃত মুখে আকাশের দিকে তাকিয়ে ককিয়ে উঠল, ‘আই লাভ ইউ সুর্মা।’

সুর্মা ছিটকে পড়েছিল পাথরের ওপর। অতীন যে তাকে এভাবে জোরে ঠেলে দেবে ভাবতে পারেনি। তার পায়ে যন্ত্রণা হচ্ছিল। তবু সে উঠে দাঁড়াল তার দুহাত বাড়িয়ে কেঁদে উঠল, ‘অতীন, তোর কী হয়েছে, এমন করছিস কেন?’

অতীন ঘুরে দাঁড়াল। তার ঘোলাটে চোখ সুর্মা দেখতে পেল না আবছা চাঁদের আলোয়। নিজের চুল মুঠোয় ধরে অতীন চিৎকার করল, ‘আই লাভ ইউ সুর্মা।’

সুর্মা ছুটে গেল অতীনের কাছে। দুহাতে জড়িয়ে ধরল ওকে, তারপর হাউ-হাউ করে কেঁদে উঠল, ‘অতীন, তোকে আমি ভালোবাসি। বিশ্বাস কর, এখন আমি তোকে ভালবাসি।’

অতীন আলিঙ্গনে ছটফট করছিল। তার মুখ এখনও আকাশের দিকে। সমস্ত শরীর উত্তপ্ত। সে বিড়বিড় করছিল, ‘আই লাভ ইউ সুর্মা।’

সুর্মার সমস্ত শরীর যেন পাথর হয়ে গেল। ও হঠাৎ আবিষ্কার করল তার দুহাতের শক্ত আলিঙ্গনে আবদ্ধ থেকেও অতীন যেন তার কাছে নেই। সেই বদ্ধ উন্মাদ শরীরটার বুকে মাথা ঠুকতে-ঠুকতে ও প্রার্থনার ভঙ্গিতে বলতে লাগল, ‘অতীন, কথা বল, আমি তোকে ভালোবেসেছি রে। অতীন, কথা বল।’

অনেক নিচে অন্ধকার রাস্তায় দুজন পুলিশের সঙ্গে দাঁড়ানো স্বপ্নেন্দু কিংবা সুর্মার মা এদের দেখতে পাচ্ছিলেন না। কিন্তু সুর্মা ঘাড় ফেরালে হয়তো আবছা দেখতে পেত ওদের। উঠে আসা পুলিশের দল এর মধ্যেই বদলা নিতে আসা লোকগুলোকে কবজা করে ধীরে-ধীরে এগিয়ে আসছিল ওপরে।

ওরা হঠাৎ দেখতে পেল পাহাড়ের একেবারে চুড়োয়, যার ওপাশে অতলান্ত খাদ, সেখানে উন্মত্ত একটি তরুণকে দুহাতে আঁকড়ে একটি প্রায় তরুণী কাঁদছে। উন্মাদ চিৎকার করে উঠল আচমকা, ‘সুনীলকে আমিই মেরেছি, আমি, আই লাভ ইউ সুর্মা।’ এবার মেয়েটি যেন প্রচণ্ড বিস্ময়ে ধীরে-ধীরে মাটিতে ভেঙে পড়ে হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল। তরুণটি তখনও সম্রাটের মতো চিৎকার করছিল, ‘আই লাভ ইউ সুর্মা।’ খোলা আকাশে শব্দগুলো যেন তার সাম্রাজ্য বিস্তার করছিল।