উনিশ-বিশ – ২

অতীন উঠে বসলে ওকে অস্বাভাবিক দেখাচ্ছিল। যদিও বলল ঠিক আছে কিন্তু আমার মনে হল কথাটা সত্যি নয়। ও অবশ্য একটু আগের জলের মতো মিথ্যে কথা বলেছে আর আমি অবাক হয়েছি। কিন্তু এখন তো মিথ্যে বলার দরকার ছিল না। প্রায় দুঘণ্টা হল আমরা ট্রেনে উঠেছি। যাত্রীরা নিজের বাঙ্কে বিছানা করে রাত্রের খাওয়া শুরু করেছে। আমাদের সঙ্গে ওসব কিছুই নেই বলে সবার চোখে পড়েছি। এই সময় টি টি কাছে এসে দাঁড়াল, ‘ঠিক আছ ভাই?’

অতীন মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। লোকটি বলল, ‘আমি মালদায় নেমে যাব। তবে তোমাদের ভয় নেই, আমি ওখান থেকে যে টি টি উঠবে তাকে বলে যাবে, মানে এই বার্থ দুটোর জন্যে বুঝলে?’

অতীন আবার ঘাড় নাড়ল। এবং সেই সময় ট্রেনটার স্পিড কমে আসতে টি টি বলল, ‘বর্ধমান আসছে।’ বলে চলে গেল।

অতীন উঠে দাঁড়াল। আমি এটা একদম চাইছিলাম না। ওর চোখের রং এখনও লালচে। সেটা তো মিথ্যে নয়। আর-একটু শুয়ে থাকতে পারত। কিন্তু ও ততক্ষণে এগিয়ে গেছে বেসিনের দিকে। জলে মুখ ধুয়ে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। মুখে জল চকচক করছে। এগিয়ে এসে বলল, ‘ব্যাগটা দে তো, তোয়ালে বের করব।’

পেছন থেকে ব্যাগটা বের করে এগিয়ে দিতে গিয়ে নিজেই সেটাকে খুললাম। তোয়ালেটা একদম ওপরেই ছিল। সেটা তুলে নিয়ে ওর হাতে দিলাম। মুখ মুছে পরিষ্কার হয়ে আমায় ফেরত দিতে আমি ওটাকে স্বস্থানে রেখেছিলাম। অতীন বলল, ‘এর পরে কোথায় থামবে জানি না, তাই রাতের খাবার বর্ধমান থেকেই কিনে নেব। কী খাবি?’

আমার খিদে লাগছে না, খাব না। সত্যি আমার ওসব বোধ ছিল না।

‘বোকার মতো কথা বলিস না। অতটা রাত সামনে, না খেলে শরীর খারাপ করবে। আমার ওপর রাগ করে নিজের শরীরটাকে কষ্ট দেবার কোনও মানে হয় না।’

‘আমি কারও ওপর রাগ করিনি।’

‘করেছিস।’

কী বলব আমি। মুখ ফিরিয়ে নিলাম। ভাগ্য ছাড়া আমি কার ওপর রাগ করতে পারি! এইসময় ট্রেনটা প্ল্যাটফর্মে ঢুকতেই যাত্রীরা দরজার দিকে ছুটল। অতীনও আর দাঁড়াল না। আমি বেঞ্চের ওপর পা তুলে ঠেস দিয়ে বসলাম। প্যাসেজের পাশের ডবল বাথটা আমাদের দেওয়া হয়েছে। ফলে গায়ের ওপর দিয়ে লোক যাচ্ছে ঘনঘন। এই কদিন আগে বাবার সঙ্গে রাঁচিতে গিয়েছিলাম ফার্স্টক্লাসের কুপে। অফিস থেকে বাবা খরচ পান। একটা ঘরে আমরা ছাড়া আর কেউ ছিল না। কী আরামেই সেই যাওয়া। তারপরেই মনে পড়ল আমার ক্লাসটেস্ট। সেই পরীক্ষা আমি দিতে পারব না। আমার জন্যে হয়তো কোনও ভালো জিনিস আর কখনও অপেক্ষা করবে না। এই সময় কানে এল মাইকে ঘোষণা করছে—ডাউন হাওড়া লোকাল দু-নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে এখনই ছাড়বে। মনের মধ্যে আনচান করে উঠল, ওই ট্রেনে গিয়ে উঠলে আজকের রাত্রেই নিশ্চয়ই কলকাতা পৌঁছে যেতে পারি। উঠে দাঁড়ালাম তড়াক করে। আর তখনি অতীন বিরাট ঠোঙা হাতে নিয়ে এগিয়ে এসে বলল, ‘ধর। আমি হাত ধুয়ে আসি।’

ঠোঙাটা নিয়ে আমি ধীরে-ধীরে বসলাম! জানালা দিয়ে দেখলাম ওপাশে দাঁড়ানো একটা খালি ট্রেন বিপরীত দিকে চলতে শুরু করল। শক্ত চোখে ট্রেনটার চলে যাওয়া দেখলাম। আমি কাঁদলাম না। কী হবে কেঁদে। আমার ভাগ্যে কী হবে আমি জেনে গেছি।

হাত ধুয়ে এসে অতীন বলল, ‘খুব খিদে পেয়েছে। তুই হাত ধুবি না?’

একটুও ইচ্ছে করছিল না। খাওয়ার কোনও বাসনাই নেই। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম উলটোদিকের বেঞ্চিতে বসে সেই মহিলা এবং অন্যান্যরা আমাদের দেখছেন। অতএব আমি উঠলাম। বেসিনে হাত ধুয়ে এসে ঠোঙা খুললাম। গরম পুরি-তরকারি আর জিলিপি এনেছে অতীন। বেশিরভাগ ওকে দিয়ে নিজের জন্যে সামান্য রাখলাম। খাওয়া শেষ হলে হাত ধোওয়ার পর অতীন বলল, ‘যাঃ, জল খাব কী করে? এই জল তো খাওয়া যাবে না!’

মহিলাটি বললেন, ‘তোমরা আমাদের জল নিতে পারো।’ বলে একটা জলের বোতল এগিয়ে দিলেন। অতীন একটুও দ্বিধা না করে তা থেকে কয়েক ঢোক খেয়ে ঢেঁকুর তুলল। আমি সামান্য খেয়ে বোতলটা এগিয়ে দিতে মহিলা বললেন, ‘তোমরা একদম খালি হাত হয়ে এসেছ, কী ব্যাপার?’

অতীন বলল, ‘একটা বাস্কেটে ওসব ছিল। তাড়াহুড়োতে ট্যাক্সি থেকে নামবার সময় ফেলে এসেছি।’

‘ওমা! পুলিশকে খবর দিয়েছ?’

‘দিলে তো আর পাওয়া যেত না এখনই। সুর্মি, তুই এখনই শুয়ে পড়বি?’

আমি বুঝলাম ও কথা ঘোরাচ্ছে। অতীন এখনও কী সুন্দর মিথ্যে কথা বলল। ও যে এ ব্যাপারে এত পোক্ত তা আমি জানতাম না। বললাম, ‘তুই শুয়ে পড়।’

‘আমি ওপরে শুচ্ছি, তুই নিচে শো।’ ব্যাগটা ওপরের বাঙ্কে রেখে অতীন তা থেকে একটা চাদর বের করে নিচের বেঞ্চিতে পেতে দিয়ে বলল, ‘এই ব্যাগে মাথা রেখে শুয়ে পড়।’

আমি অবাক গলায় বললাম, ‘তুই?’

ও হাসল, ‘আমার দরকার হবে না। আমার আরাম আমি পেয়ে গেছি।’

বুঝলাম না কথাটা। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কোথায়?’

চাপা গলায় ও উত্তর দিল, ‘এই তো আমার সামনে দাঁড়িয়ে। এখন আমার চেয়ে সুখী পৃথিবীতে আর কেউ নেই। বালিশের, চাদরের তাই দরকার হবে না।’

দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে আমি শুয়েছিলাম। ট্রেন হুহু করে ছুটছে। ওপরে ওঠার আগে জানলাটা বন্ধ করে দিয়েছে অতীন। ও যে আমার কোনও কষ্ট না হয় তার জন্যে সজাগ রয়েছে। ও যা বলছে তা কি ঠিক? ও কি সত্যি আমাকে এরকম ভালোবাসে? হঠাৎ আমার বুকের ভেতর কাঁপুনি এল। পাগল হয়ে অতীন রাস্তায় চিৎকার করেছিল, আই লাভ ইউ সুর্মা। পাগলরা নিশ্চয়ই মিথ্যে কথা বলে না।

চোখ বন্ধ করতেই বাবার মুখটা ভেসে উঠল। বাবা এখন কী করছেন? মা? উর্মি? এখন রাত কত আমি জানি না! নিশ্চয় স্বপ্নাদের বাড়িতে খোঁজ নেওয়া হয়ে গেছে। বাবা এতক্ষণে পাগলের মতো চারধারে খুঁজছেন আমাকে। মা কান্নাকাটি করা ছাড়া আর কী করতে পারেন! বাবার মুখ মনে পড়তেই চাপা কান্নাটা ছিটকে এল। আমি দাঁতে দাঁত চেপে শুয়ে রইলাম। দেওয়ালের দিকে মুখ ফেরানো বলে কেউ আমাকে দেখতে পাচ্ছে না। আমাদের দুজনকে যদি কেউ ট্যাক্সিতে দেখে থাকে তাহলে বাবা নিশ্চয়ই অতীনের বাড়িতে যাবেন। বাবা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারবেন না আমি অতীনের সঙ্গে এভাবে কোথাও চলে যাব! আমার এতদিনের শিক্ষা, রুচির সঙ্গে মিলিয়ে এটা কখনও হতে পারে না। আমি জানি আজ রাত্রে ওরা কেউ ঘুমুতে পারবেন না। হয়তো পুলিশে খবর দেবেন বাবা। কিন্তু অতীন যে দার্জিলিং যাচ্ছে সেটা তো কেউ জানতে পারবে না। আমি যেভাবে চলে এসেছি খালি হাতে তাতে আমার পক্ষে বেশি দূর যাওয়া তো সম্ভব নয়। আমি যেন দেখতে পেলাম বাবা বলছেন, ‘সুর্মি আমাকে না বলে চলে গেল! কী দুঃখ ছিল ওর যে আমাকে একবার বললও না।’

আমি বাবাগো বলে ডুকরে উঠতে গিয়ে কোনওরকমে নিজেকে একটু সামলালাম। ঠিক করলাম যেখানে যাচ্ছি সেখানে পৌঁছেই বাবাকে একটা চিঠি লিখব। সব কথা স্পষ্ট করে লিখে বলব, ‘বাবা তুমি এসো’ কথাটা ভাবতে বুকের ভেতরটা একটু সহজ হল। আমি স্থির হলাম।

হঠাৎ হাতের ওপর স্পর্শ পেতে চমকে সোজা হলাম। ট্রেনের ভেতর এখন ঘুমের রাজত্ব। কোথাও মানুষের শব্দ নেই। একটানা গাড়ির চাকার ধাতব আওয়াজ ছাড়া কিছু নেই। আমার পায়ের কাছে অতীন বসে আছে। কখন নেমে এসেছে জানি না, চোখাচোখি হতেই বলল, ‘সুর্মি, প্লিজ, প্লিজ, কাঁদিস না। তুই বিশ্বাস কর, তুই ছাড়া আমার কেউ নেই। তোকে আমি—।’ ও আমার হাত আঁকড়ে ধরল, ‘তুই আমার ওপর একটু আস্থা রাখ, দেখবি তোকে কখনও কষ্ট দেব না। সুর্মি আমাকে একটু ভালোবাসা দে, আমি আর কিছু চাই না।’

কেন জানি না, এখন এই রাত্রে যে আমি একটু আগে বাবার জন্য কাঁদছিলাম সেই আমার মনে ক্রমশ একটা মায়ার আকাশ তৈরি হয়ে গেল। আমার এই বয়স পর্যন্ত কোনও পুরুষের মুখে এমন আকুতি শুনতে পাইনি। অতীন ভিক্ষে চাওয়ার মতো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কোনওরকমে বললাম, ‘ঠিক আছে। আমি আর কাঁদব না, যা তুই শুয়ে পড়।’

সুর্মার মা স্বপ্নাদের বাড়ি থেকে নেমে এসে কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না। একটু আগে স্বপ্নেন্দু ফিরেছেন। ওঁর আজ রাঁচিতে যাওয়া হয়নি। অফিসের কাজ শেষ হয়নি এখনও। একটু আগে বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি এসে সুর্মাকে না দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বৃষ্টি ধরতেও যখন এল না তখন সুর্মার মা নিজে এসে খোঁজ নিয়েছিলেন স্বপ্নাদের বাড়িতে। সুর্মা নাকি সেই বিকেলবেলায় ডায়েরি নিয়ে বেরিয়ে গেছে, বেশিক্ষণ বসেওনি।

বাড়ি গিয়ে দেখলেন সুর্মা আসেনি। বৃষ্টিতে পথে আটকে থাকলে এতক্ষণে ফিরে আসা উচিত ছিল। স্বপ্নেন্দু বললেন, ‘ও তো এরকম কখনও করে না। দিনকাল ভালো নয়, অ্যাক্সিডেন্ট হল কি না কে জানে।’

সুর্মার মা বললেন, ‘পাড়ার মধ্যেই ছিল, সেরকম কিছু হলে জানতাম না?’

নটা বেজে গেলে অস্থির হয়ে স্বপ্নেন্দু বের হলেন। দুবার পাড়াটা পাক দিয়ে ইয়ং বুলেটস-এর সামনে এসে দাঁড়ালেন। কয়েকটি ছেলে বারান্দায় এসে আড্ডা মারছে। এদের তিনি খুবই অপছন্দ করেন। তবু মনে হল এরা দেখে থাকতে পারে সুর্মাকে। ওদের মধ্যে একটি পরিচিত মুখকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা, তোমরা এখানে কতক্ষণ ধরে আছ?’

‘কেন বলুন তো!’

‘আমার মেয়ে সুর্মাকে তো চেনো! ও বাড়ি ফেরেনি তাই—।’

স্বপ্নেন্দুর কথাটা শেষ করতে অস্বস্তি হচ্ছিল। এখনই কথাটা হাওয়ায় ভেসে বেড়াবে।

‘না তো ওকে দেখিনি। কোথায় গিয়েছিল?’ ছেলেরা উৎসুক হল।

‘ওর বন্ধু স্বপ্নার বাড়িতে। তা সেখান থেকে বিকেলেই বেরিয়ে পড়েছে। কোথায় যে গেল। ওর মা কান্নাকাটি করছে। আচ্ছা ভাই চলি!’ স্বপ্নেন্দু পা বাড়াতেই ছেলেটা বলল, ‘আমরা তো বৃষ্টির পর এসেছি। ঠিক আছে, আমরা দেখছি।’

স্বপ্নেন্দু বড় রাস্তা অবধি এসে আবার ফিরে গেলেন। মনে হল বাড়িতে ফিরে নিশ্চয়ই মেয়েকে দেখতে পাবেন। দরজায় স্ত্রী দাঁড়িয়ে, ওঁকে দেখেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পেলে?’

‘বাড়িতে আসেনি?’

‘না।’

‘তাহলে—?’ স্বপ্নেন্দুর ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। আর তখনই সুর্মার মা ডুকরে কেঁদে উঠলেন, ‘কী হল মেয়েটার! তুমি খোঁজ নাও, আমার ভয় করছে।’

পাশের ফ্ল্যাটের লোকজন বেরিয়ে এল। মুহূর্তেই সমস্ত পাড়াময় খবরটা চাউর হয়ে গেল। সুর্মাকে পাওয়া যাচ্ছে না, বিকেলে বেরিয়ে বাড়ি ফেরেনি। এক-একজন এক-একরকম পরামর্শ দিতে লাগল। পুলিশে খবর দেওয়ার আগে একবার ওর মামির বাড়িটা দেখে আসা দরকার। কোনও অভিমান করে মেয়ে যদি সেখানে গিয়ে বসে থাকে। অবশ্য সেরকম মেয়ে সুর্মা নয়, তবু স্বপ্নেন্দু কোনও চান্স নিতে চাইলেন না। বাড়ি থেকে বের হতেই ইয়ং বুলেটস-এর ছেলেগুলোকে দেখতে গেলেন তিনি। ওরা বোধহয় তাঁর কাছেই আসছিল। পরিচিত ছেলেটি বলল, ‘কাকাবাবু, একটা হদিশ পেয়েছি।’

বুকের মধ্যে ঢেউ উঠল যেন ছলাৎ করে। স্বপ্নেন্দু তাকালেন।

‘বৃষ্টির জন্যে পাড়ার ফুচকাওয়ালা পালিয়ে যাচ্ছিল তাড়াতাড়ি, তখন ও দেখতে পেয়েছে সুর্মা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে অতীনের সঙ্গে কথা বলছিল।’

‘অতীনের সঙ্গে!’ স্বপ্নেন্দু অবাক হলেন।

‘হ্যাঁ। আপনি অতীনের কেসটা জানেন তো?’

‘না!’

‘অতীন আপনারা রাঁচি চলে যাওয়ার পর পাগল হয়ে গিয়েছিল! রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করত সুর্মার নাম ধরে।’

‘সেকি! কেন?’

ছেলেগুলো উত্তর না দিয়ে নিজেদের মধ্যে হেসে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।

‘না-না, এ তোমরা ঠিক বলছ না!’ স্বপ্নেন্দুর পায়ের তলার মাটি যেন টলছিল। সুর্মা এই বয়সে অতীনের মতো ছেলেকে কখনই প্রশ্রয় দেবে না। এরা সত্যি কথা বলছে না।

ছেলেটি বলল, ‘সুর্মার দোষ আছে কি না জানি না, কিন্তু অতীনের ঘটনাটা সত্যি। আমাদের মনে হয় একবার অতীনের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ করলে সুর্মা কোথায় আছে জানা যাবে। আপনি আমাদের সঙ্গে চলুন।’

স্বপ্নেন্দু কিছুতেই মানতে পারছিলেন না। সুর্মার সঙ্গে অতীনের কোনও যোগ থাকতে পারে না। হয়তো পথে দেখা হয়েছে, দু-একটা কথা বলেছে আর তখন ফুচকাওয়ালা দেখে থাকতে পারে। তার মানেই সুর্মা আর অতীন কোথাও গিয়েছে এ তিনি মানতে পারেন না। ফুচকাওয়ালা অবশ্য সুর্মাকে অনেকদিন থেকেই চেনে কিন্তু তার কথাটাই…ছেলেটিকে বললেন, ‘তুমি একা গিয়ে অতীনকে ডেকে আনো। দলবেঁধে যেও না, আমি এখন অপেক্ষা করছি।’

ছেলেটি একটু বাদেই একা ফিরে এল। এসে বলল, ‘অতীন বাড়িতে নেই কাকাবাবু। আজ বিকেলে কোথায় চলে গেছে।’

স্বপ্নেন্দু চিন্তিত হলেন, ‘অতীন বাড়িতে নেই!’ তাহলে—! আর অপেক্ষা করতে পারলেন না তিনি। সোজা চলে এলেন অতীনের বাড়িতে। এদের সবাইকে তিনি চেনেন। একসময় পাশের বাড়িতে থাকতেন এঁরা।

অতীনের মা, প্রৌঢ়া এবং সাদাসিধে মহিলা, বললেন, ‘সে বাড়িতে নেই।’

স্বপ্নেন্দু বললেন, ‘শুনলাম। আমার মেয়েকেও পাচ্ছি না। খবর পেলাম আজ বিকেলে ওদের দেখা হয়েছিল। অতীন কোথায় গিয়েছে?’

‘বলে যায়নি।’

‘কখন ফিরে আসবে বলেছে?’

‘না। একটা ব্যাগে জিনিসপত্র নিয়ে চলে গেছে।’

‘কী আশ্চর্য! আপনার ছেলে কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞাসা করলেন না?’

‘আজকাল আমাদের সঙ্গে কথা বলত না ও। আপনার মেয়ের জন্যেই তো এই দশা!’

‘আমার মেয়ে? কী বলছেন আপনি?’

‘ঠিকই বলছি! আপনার মেয়ের জন্যেই আমার ছেলে পাগল হয়ে গিয়েছিল। ওইটুকু ছেলের মনে দুঃখ দিলে ভগবান সইবেন না।’ অতীনের মা মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। স্বপ্নেন্দু বিরক্ত হলেন, ‘আপনি কিছু না জেনে কথা বলছেন। আপনার ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ের কোনও সম্পর্ক ছিল না। ইদানীং কথাও বলত না ওরা। অতীন যদি মনে কিছু ভাবে তার জন্যে কেউ দায়ী নয়। কিন্তু আপনি মা হয়ে ছেলেকে একবার জিজ্ঞাসাও করলেন না সে কোথায় যাচ্ছে! কোথায় যেতে পারে সে?’

‘আমি জানি না। ইদানীং কেউ ওকে পছন্দ করত না। কাল রাত্রে বলছিল কোথায় গেলে চাকরি পাবে! হয়তো দুর্গাপুরে গিয়েছে।’ অতীনের মা জানালেন।

‘দুর্গাপুরে কে আছেন?’

‘ওর কাকা।’

‘ওখানে কখনও অতীন এর আগে গিয়েছে?’

‘না।’

স্বপ্নেন্দু কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না। এইসময় ইয়ং বুলেটস-এর একটি ছেলে বলে উঠল, ‘মাসিমা, অতীন যাওয়ার সময় কী-কী জিনিস নিয়ে গেছে?’

‘তেয়ালে, সোয়েটার বের করে নিল আলমারি থেকে।’

‘সোয়েটার? এখন সোয়েটার নেবে কেন? দুর্গাপুরে তো প্রচণ্ড গরম! ব্যাপারটা ভালো লাগছে না। কাকাবাবু আপনি থানায় খবর দিন।’ ছেলেটি বলল।

সেই রাত্রেই থানায় এলেন স্বপ্নেন্দু। এসে অবাক হলেন। ওঁর কলেজজীবনের সহপাঠী প্রণব এখন ওই থানায় পোস্টেড। এত বছর বাদেও চিনতে কোনও অসুবিধে হয়নি। স্বপ্নেন্দু সব খুলে বলার পর প্রণব ডায়েরিতে লিখে নিল। তারপর বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে তোমার মেয়েকে ছোকরাই লোপ করেছে।’

‘কিন্তু কী করে করবে? ওরা তো সমবয়সি বলা যায়! পাড়া থেকে ধরে নিয়ে গেলে সে একা পারবে কেন? আর পাড়ার লোক জানবে না?’ স্বপ্নেন্দু প্রতিবাদ করলেন। প্রণব হাসল, ‘কিছু মনে করো না, তুমি কী করে নিশ্চিন্ত হচ্ছ যে তোমার মেয়ে ছোকরার প্রেমে পড়েনি?’

‘আমি আমার মেয়েকে চিনি।’

‘তোমার মেয়ে কোনও লাগেজ নেয়নি সঙ্গে?’

‘কিছু না। সত্যি কথা কী ও বাড়ি থেকে বের হতেই চায়নি।’

‘এই জায়গাটায় আমার গুলিয়ে যাচ্ছে। প্ল্যান করে গেলেও সঙ্গে জামাকাপড় নিত। ছেলেটার কোনও বন্ধুবান্ধব আছে?’ প্রণব জিজ্ঞাসা করল।

‘আমি জানি না। তুমি যে করেই হোক মেয়েটাকে ফিরিয়ে আনো ভাই।’ স্বপ্নেন্দু সহপাঠীর হাত জড়িয়ে ধরলেন। প্রণব বলল, ‘একটু শক্ত হও। আমাদের চেষ্টার ত্রুটি হবে না। এখন চলো তো ছেলেটার সম্পর্কে খোঁজ নিই!’

পুলিশের গাড়ি করে স্বপ্নেন্দু পাড়ায় ফিরে এলেন। রাত দশটা বেজে গেছে তবু রকে-রকে ভিড়। শুধু মেয়ে নয় সঙ্গে একটি ছেলেও উধাও, এই রসময় বার্তা সবাইকে বেশ তপ্ত করেছিল। অতীনের পাগল হওয়ার পেছনে সুর্মার সক্রিয় হাত ছিল তা এতদিনে প্রমাণিত হল পাড়ার লোকের কাছে। প্রণব স্বপ্নেন্দুকে তাঁর বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে অতীনের বাড়িতে চলে গেল। স্বপ্নেন্দুর নিজের বাড়িতে ঢুকতে ভয় করছিল। সুর্মার মা এখন কী অবস্থায় আছে কে জানে! সামনের বাড়ির এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়েছিলেন সামনে, বললেন, ‘আপনাদের সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।’

স্বপ্নেন্দু ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।’

‘আজকালকার ছেলেমেয়ে, এদের জোর করে বাধা দিলে এইরকম হয়!’

স্বপ্নেন্দু অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালেন। তিনি কী করে এদের বোঝাবেন যে সুর্মা তেমন মেয়ে নয়। বাধা দেওয়ার কোনও কথাই ওঠেনি। এই মুহূর্তে তাঁর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল মেয়ের ওপর। এতদিন ধরে তিলে-তিলে মনের মতো করে যাকে গড়েছেন সব ভালোবাসা, রুচি দিয়ে, সে এইভাবে শাস্তি দিল?’

একটু বাদেই প্রণব ফিরে এল গাড়ি নিয়ে। নেমে জিজ্ঞাসা করল, ‘দিলীপ কে? কোথায় থাকে জানো?’

ইয়ং বুলেটস-এর একটি ছেলে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, দিলীপ গাঙ্গুরামের পাশের বাড়িতে থাকে। অতীনের বন্ধু।’

দিলীপ বাড়িতেই ছিল। পুলিশ দেখে মুখ শুকিয়ে গেছে ছেলেটার। বড়জোর বছর সতেরো বয়স হবে। ওর বাড়ির লোক হতভম্ব। প্রণব তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার নাম তো দিলীপ। অতীনের বন্ধু?’

দিলীপ কিছু বলল না। বোধহয় ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করছিল।

‘অতীন কোথায় গিয়েছে?’

‘জানি না।’

‘সঙ্গে কে গিয়েছে?’

‘আমি কিছুই জানি না।’

‘জানো না! তোমার সঙ্গে ওর কবে দেখা হয়েছিল?’

একটু ইতস্তত করে দিলীপ বলল, ‘গতকাল।’

‘কী কথা হয়েছিল?’

‘তেমন কিছু না। ও হাসপাতাল থেকে এসে খুব কম কথা বলত।’

‘কোথায় চাকরি করতে যাবে বলেনি?’

‘না। বিশ্বাস করুন, আমি কিছু জানি না।’

‘সুর্মাকে চেন?’

‘চিনি। কিন্তু কখনও কথা বলিনি।’

‘সুর্মার কথা অতীন তোমাকে বলত?’

‘এখন বলত না।’

প্রণব খানিক ভাবল তারপর বলল, ‘হুম। তুমি আমার সঙ্গে চলো।’

‘কোথায়?’

‘থানায়। কারণ তুমি সত্যি কথা বলছ না।’ প্রণব ওর হাত ধরল।

‘বিশ্বাস করুন, আমি কিছু জানি না।’ প্রায় ককিয়ে উঠল দিলীপ।

স্বপ্নেন্দু এতক্ষণ শুনছিলেন, এবার বললেন, ‘ভাই, তুমি যা জানো বলে দাও, খামোকা দেরি করলে মেয়ের বিপদ হতে পারে!’

‘আমি কিছু জানি না।’ দিলীপ শরীর বেঁকাচ্ছিল।

প্রণব একজন কনস্টেবল ডাকতেই দিলীপ বলে ফেলল, ‘ও দার্জিলিং-এ গিয়েছে। আজকের ট্রেনে।’

সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, ‘দার্জিলিং!’

প্রণব কড়া গলায় ধমকাল, ‘এতক্ষণ মিথ্যে কথা বলছিলে কেন?’

‘অতীন আমাকে শপথ করিয়েছিল যেন কাউকে না বলি। বিশ্বাস করুন এর বেশি কিছু জানি না!’ প্রায় কেঁদে ফেলল দিলীপ।

‘দার্জিলিং-এ কার কাছে গিয়েছে?’

‘আমাদের সঙ্গে পড়ত একটি নেপালি ছেলে, তার কাছে।’

‘কী নাম তার?’

‘সুনীল প্রধান। ওখানকার কলেজে পড়ে। কার্শিয়াং-এ থাকে।’

‘দার্জিলিং না কার্শিয়াং?’

‘কার্শিয়াং।’

‘অতীন একা গিয়েছে?’

‘হ্যাঁ। আজ সকালে টিকিট একটা কিনেছে ও।’

‘টাকা পেল কোথায়?’

দিলীপ আর-একবার চেষ্টা করল মিথ্যে কথা বলতে কিন্তু সে এমন ভেঙে তেরোশো টাকায় সে হারটা কিনেছে। মাঝরাত্রে স্বপ্নেন্দুকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে প্রণব বলল, ‘মনে হচ্ছে মেয়েটা অতীনের সঙ্গেই গিয়েছে। আমি এখনই লালবাজারে খবর দিচ্ছি যাতে এন. জে. পি. স্টেশনে ওদের ধরে ফেলতে পারে। তুমি চিন্তা করো না কিছু।’

বাড়িতে ঢুকে স্তব্ধ হয়ে গেলেন স্বপ্নেন্দু। সুর্মার মা ডুকরে-ডুকরে কাঁদছে অন্ধকার ঘরে। স্খলিত পায়ে পাশের ঘরে ঢুকলেন তিনি। আলো জ্বালাতেই দেওয়ালের দিকে চোখ চলে গেল। পেছন থেকে তাঁকে জড়িয়ে ধরে সুর্মা ঘাড়ে মুখ রেখে হাসছে। সহজ ঝকঝকে হাসি। একটু মলিনতা নেই কোথাও। সন্ধে থেকে যা হয়নি, নিজেকে সামলে রেখেছিলেন প্রাণপণে, ওই ছবির দিকে তাকিয়ে আর পারলেন না। হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন স্বপ্নেন্দু। ওই উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে কান্না জড়ানো গলায় বলতে লাগলেন, ‘এ তুই কী করলি মা, আমি যে তোকে—!’

ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে গেল। কাল অনেক রাত অবধি জেগেছিলাম। সুর্মা কথা রেখেছিল, আর কন্নাকাটি করেনি। ঘুম ভাঙতেই চেয়ে দেখলাম, ও ছোট্টটি হয়ে ঘুমুচ্চে। ভীষণ মায়া হল দেখে। তারপরেই মনে পড়ল ওর টিকিট নেই। রাত্তিরে আমার অসুস্থতা কিংবা রেলপুলিশের অনুরোধে, যাই হোক না কেন, টি টি আমাদের কাছে টিকিট চায়নি। মালদা থেকে যে উঠেছিল তাকে আমাদের কথা বলে গিয়েছিল লোকটা। কিন্তু মেইন গেট পেরোতে গেলেই তো টিকিট দেখাতে হবে। আমি নামলাম। নতুন টি টি বসে ঢুলছিল। তার কাছে গিয়ে বললাম, ‘শুনুন, আপনাকে একটা কথা বলব!’

লোকটা চোখ খুলে আমায় দেখল। তারপর বলল, ‘কী কথা?’

আমি অম্লান বদলে বললাম, ‘আপনার আগের টি টি আপনাকে পনেরোটা টাকা দিতে বলে গেছেন!’ কথা শেষ করেই ওর হাতে টাকাটা গুঁজে দিলাম। লোকটা সেটাকে বেমালুম পকেটে ঢুকিয়ে বলল, ‘আমার সঙ্গে বের হতে হবে। ট্রেন থামলেই নেমে পড়বে।’

একটা ফাঁড়া কাটল। বাইরে তখন আলো ফুটছে! বেশ ঠান্ডা-ঠান্ডা ভাব। দূরে পাহাড়ের রেখা দেখা যাচ্ছে আকাশের গায়ে। এদিকে আমি কখনও এর আগে আসিনি। ঠিক করলাম, কোনও ঝুকি নেব না।

সুর্মার পায়ের পাশে বসতেই ওর ঘুম ভেঙে গেল। মুখচোখ ফোলা, কপালের ওপর ভাঙা চুল, চট করে উঠে বসল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেমন লাগছে এখন?’ প্রশ্নটা করার কোনও মানে নেই, তবু কিছু বলতে হবে তো! ও আমার দিকে তাকাল। ট্রেনটাকে দেখল, তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘কটা বাজে!’ আমার হাতে ঘড়ি নেই। আন্দাজে বললাম, ‘ছটা বেজে গেছে মনে হয়।’

ও উদাস চোখে কামরার ভেতরে তাকাল। ও কী ভাবছে এখন? এই সময় কলেজে যাওয়ার কথা, ওর কি তাই মনে পড়ছে? আমি উঠে জানলার খড়খড়ি তুলে দিলাম। টাটকা বাতাস এসে শরীর জুড়িয়ে দিল। দূরে পাহাড়ের আদল এখন অনেকটা স্পষ্ট। অতি দ্রুত বলে উঠলাম, ‘দ্যাখ-দ্যাখ কী সুন্দর পাহাড়!’

সুর্মা মুখ ফিরিয়ে তাকাল। ওর চোখে মুখে ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়তেই আমার মন ভরে গেল। মুগ্ধ হয়ে সুর্মা উত্তর বাংলার প্রকৃতি দেখছে। উলটো দিকে সূর্য উঠছে কিন্তু তার আলো মাখছে এদিকের আকাশ। মাঠ-জঙ্গলকে দুপাশে ছুড়ে ফেলে আমাদের ট্রেনটা ছুটছে। কিছু দূরে ভিজে পিচের রাস্তায় ভারী-ভারী লরি চলেছে একের পর এক।

হঠাৎ আমার মনে হল কাল রাত থেকে একবারও আমি বাড়ির কথা ভাবিনি। মা কিংবা দাদাদের মুখ একবারের জন্যেও মনে পড়েনি। আর সে কথা একটুও ভাবতে চাই না। নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে কখনও ভাবব না। আমার অতীত আমি এই মুহূর্তে একদম ভুলে যেতে চাই। দার্জিলিং কিংবা কার্শিয়াং-এ আমি চাকরি পেলেই একটা বাড়ি ভাড়া নেব। সুর্মার যদি ইচ্ছে হয় তাহলে পড়াশুনা করবে, আমি কোনও আপত্তি করব না। ব্যাপারটা ভাবতেই আমার খুব ভালো লাগছিল।

ট্রেনের স্পিড কমে আসতে আমি দূরে লোকালয় পেলাম। সুর্মা চুপচাপ বসেছিল। আমি তোয়ালেটা বের করে বললাম, ‘যা, বেসিন থেকে মুখ ধুয়ে আয়।’

ও ক্লান্ত চোখে আমার দিকে তাকাল, কী ভাবল, তারপর ধীরে-ধীরে উঠে গেল টয়লেটে। আমি ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে অন্য টয়লেট থেকে পরিষ্কার হয়ে বেরিয়ে আসতেই দেখলাম সুর্মা ব্যাগটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে। যাত্রীদের ঠেলাঠুলির মধ্যে আমরা চেকারের পেছন-পেছন বেরিয়ে এলাম। সবাই যেদিকে যাচ্ছে চেকার সেদিকে গেল না। বাঁদিকের একটা ঘরের মধ্যে ঢুকে বলল, ‘ওই দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাও।’ সেখানে আরও কিছু কালোকোট পরা লোক ছিল তারা আমাদের দেখে হাসল। আমি আর কথা বাড়ালাম না। সুর্মাকে নিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে একটু ঘুরে ওভারব্রিজ পেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। এক দঙ্গল রিকশা আর ট্যাক্সির সঙ্গে কয়েকটা বাস দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে চায়ের স্টল দেখে সুর্মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘চা খাবি?’

সুমা মাথা নাড়ল, ‘আমি চা খাই না।’ তারপর একটু থেমে বলল, ‘আমরা কোথায় যাব?’

‘কার্শিয়াং।’

খোঁজাখুঁজির পর একটা ছোট বাস আমরা উঠলাম। বাসটা দার্জিলিং যাচ্ছে। বেশিরভাগ লোকই দেহাতি, দু-তিনজন বাঙালি অবশ্য আছে। আমরা জানলার ধারে জায়গা পেয়ে গিয়েছিলাম। গাড়িটা যখন ছেড়েছে ঠিক তখনই নজরে পড়ল একটা পুলিশের জিপ দ্রুত এসে স্টেশনের বাইরে থামল। জিপটাকে দেখেই আমার বুক ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল। আমি জানি না কী জন্যে জিপটা স্টেশনে এল, কিন্তু মনে হল আমরা যে সময়মতো বাসে উঠে বসেছি সেটা ভাগ্য ভালো বলেই। কথাটা সুর্মাকে বলব কি না বুঝতে পারছি না। ও যদি নার্ভাস হয়ে যায় কিংবা পুলিশে কাছে ধরা দেয়? আমি এখনও ওকে এ ব্যাপারে বিশ্বাস করব না। একটু বাদেই বুঝলাম এই বাসটাতে টুরিস্টদের ভিড় নেই কেন। এমন লড়ঝড়ে বাস পাহাড়ে উঠতে পারবে কি না আমার সন্দেহ হচ্ছিল।

মনের মধ্যে পুলিশ দেখার পর যে ভয়টা জন্মেছিল সেটা তাড়বার জন্য সুর্মার সঙ্গে কথা বললাম, ‘এই তুই এর আগে কখনও দার্জিলিং যাসনি তো, না?

সুর্মা মাথা নাড়ল, ‘না’।

আমি বললাম, ‘আমাকে একটু ভালোবাসতে পারবি তো?’

ওর ঠোঁটে একটুকরো হাসি উঁকি দিয়েই মিলিয়ে গেল। আমার খুব ইচ্ছে করছিল ওর হাত ধরি, কিন্তু সাহস পাচ্ছিলাম না। আজ সকাল থেকেই কেন জানি না মনে হচ্ছে সুর্মা আমার চেয়ে অনেক বেশি বোঝে, আমার চেয়ে ও অনেক গম্ভীর। নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে ওর তুলনায়। অথচ ও তো আমার চেয়ে দশ মাসের ছোট।

বেশ জমজমাট একটা শহরে আমরা এলাম। প্রচুর লোক আর রিকশা দাঁড়িয়ে আছে এখানে-ওখানে। সুর্মাকে বললাম, ‘কিছু খাবি না? খুব খিদে পেয়েছে।’

‘কী খাবি?’

‘দাঁড়া, তুই বোস আমি দেখে আসি কী পাওয়া যায়! ব্যাগটাকে লক্ষ রাখিস।’

বাস থেকে কোনওমতে নামলাম। কারণ প্রচুর নেপালি ওঠার জন্যে ঠেলাঠুলি করছে। বেশ ঠান্ডা লাগল মাটিতে নেমে। জায়গাটা মোটেই পাহাড়ি নয়। আমি একটা মিষ্টির দোকানে ঢুকে সিঙাড়া আর জিলিপি কিনলাম। তারপর চট করে এক গেলাস চা নিয়ে চুমুক দিলাম। সুর্মা খায় না তাই খাবার খাওয়ার আগেই চা খেয়ে নিই।

বাসটা হর্ন দিচ্ছিল আর কন্ডাক্টর চেঁচাচ্ছিল। আমি তাড়াতাড়ি বাসের দরজায় পা রাখলাম। মানুষের ঠাসাঠাসি হয়ে গিয়েছে ভেতরটা। একে ঠেলে ওকে ঠেলে কোনওরকমে যখন সুর্মার পাশে বসলাম তখন দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়! আমার ঘাড়ের কাছে একটি নেপালি বউ ঝুঁকে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে যে খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। সুর্মার হাতে ঠোঙাটা দিতে ও নিচু গলায় বলল, ‘পুলিশ এসেছিল।’

নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল আমার। বললাম, ‘কখন?’

‘তুই নামবার পরেই। জানলা দিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করল কী নাম আমার?’

‘তুই কী বললি?’

‘মিথ্যে বললাম। তারপর জিজ্ঞাসা করল, সঙ্গে কে আছে? আমি বললাম, মামা। লোকটা আমাকে ভালো করে দেখে জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাচ্ছি?’

‘তুই কার্শিয়াং বললি?’

‘না, শুকনা বললাম।’

আমি অবাক হলাম। শুকনা যে এই রাস্তার কোনও জায়গার নাম আমিই জানি না। সুর্মা হেসে বলল, ‘কন্ডাক্টর জায়গার নাম ধরে চেঁচাচ্ছিল তাই জেনেছিলাম।’

‘লোকটা কী বলল?’

‘আর কিছু না বলে চলে যাচ্ছিল। আমিই জিজ্ঞাসা করলাম, কেন প্রশ্ন করছেন? ও উত্তর দিল, আমরা দুটো বাচ্চাকে খুঁজছি। মনে হয় আমার কথা অবিশ্বাস করেনি।’

কথাটা শোনামাত্র আমার ভয় কেটে আনন্দ হল। গাড়ির চাকা ঘুরতেই আমি খপ করে ওর হাত চেপে ধরলাম খুশিতে। সুর্মা হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘আঃ লাগছে।’

খাবারটা খেয়ে নিয়ে আমি চোখ বন্ধ করলাম। তাহলে সত্যি পুলিশ আমাদের খুঁজছে। আমরা যে এদিকে এসেছি তাও টের পেয়ে গেছে। তার মানে দিলীপ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। অথচ ও শপথ করেছিল—কোনওদিন যদি ব্যাটাকে পাই আমি দেখে নেব। দিলীপ যদি সব কথা বলে থাকে তাহলে সুনীল প্রধানের নামও পুলিশ জেনে যাবে। অথচ ওর ওখানে না গিয়েও তো আমাদের কোনও উপায় নেই। কী যে করি বুঝতে পারছি না। তবে পুলিশ যখন শিলিগুড়ি কিংবা স্টেশনে আমাদের সন্ধান পায়নি তখন হয়তো ভাবতে পারে আমরা দার্জিলিং-এ যাচ্ছি না। সেইটুকুই যা চান্স। দেখি, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করতে হবে।

তবে আমার যেটা লাভ হল সেটার সঙ্গে এই দুশ্চিন্তার কোনও তুলনা হয় না। সুর্মা আমার দলে এসে গিয়েছে। পুলিশের লোকটাকে ও যেভাবে কাটিয়েছে তার তুলনা হয় না। ও তো স্বচ্ছন্দে পুলিশকে সব কথা বলে দিতে পারত। কিন্তু তা করেনি। এতেই বোঝা যাচ্ছে ওর কাছ থেকে আমার কোনও ভয় নেই। কাল রাত্রে আমি ভাবছিলাম স্টেশনে চমৎকার অভিনয় করেছি রেলের পুলিশের সঙ্গে। কিন্তু তখন ও যা করেছে তা আমার চেয়ে কম কিছু নয়। আমরা দুজনে একসঙ্গে যদি ফন্দি আঁটতে পারি তাহলে পুলিশকে এড়ানো সম্ভব হবেই।

এই সময় সুর্মা বলল, ‘দ্যাখ কী সুন্দর!’

আমি বাইরে তাকালাম। যদিও নেপালি বউটা আমায় খুব চাপ দিচ্ছে তবু পাহাড়টাকে এগিয়ে আসতে দেখে খুব ভালো লাগল। আমরা এখন লোকালয় ছাড়িয়ে এসেছি! চারধারে গাছপালা এবং সূর্য বেশ ওপরে। সুর্মা বলল, ‘ওগুলো নিশ্চয়ই চায়ের গাছ, না রে?’

চা-গাছ আমি কখনও দেখিনি। তবে ছবিতে চা-তোলা কামিনদের ছবি দেখেছি। বললাম, ‘হ্যাঁ।’

সুর্মা বলল, ‘বিউটিফুল! এরকম জায়গায় আমি সারাজীবন থাকতে পারি!’ সুর্মার কথা বলার ভঙ্গি এখন বেশ সহজ, সাবলীল। তার মানে ও এতক্ষণে মন ঠিক করে নিতে পেরেছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এখানে তাহলে নামি, কী বল?’

ও চকচকে চোখে হাসল, ‘তুই না—’

‘আমি কী?’

‘মিথ্যেবাদী।’ বলে মুখ ঘুরিয়ে নিল সুর্মা।

আমি বললাম, ‘নিজে কী? পুলিশটাকে যা বললি তাতে আমার চেয়ে কম যাস না।’ আমি কী শেষপর্যন্ত সুর্মার মন পেয়ে গেছি! ব্যস, আমার মনের সব কষ্ট দূর হয়ে গেল।

লালবাজার থেকে দুপুরে খবর এল নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে দার্জিলিং মেল থেকে যারা নেমেছে তাদের মধ্যে সুর্মাদের পাওয়া যায়নি, শিলিগুড়ি শহরেও চেক করা হয়েছে! দার্জিলিং-এর এস.পি.কে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে, যদি কোনও ফাঁকে ওরা ওখানে পৌঁছে যায় তাহলে লোকেট করতে। কিন্তু সেই সঙ্গে প্রণব যে খবরটা আনল তাতে স্বপ্নেন্দু উত্তেজিত হলেন। গতকাল সন্ধেবেলায় শিয়ালদার প্লাটফর্মে দুটি তরুণ-তরুণী ঝগড়া করছিল। রেলের পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে জানে তারা ভাইবোন। মেয়েটিও একই কথা বলায় পুলিশ তাদের ট্রেনে তুলে দিয়েছে। পোশাকের বর্ণনা শুনে কারও বুঝতে বাকি রইল না মেয়েটি সুর্মা।

প্রণব বলল, ‘ওরা পুলিশকে ধাপ্পা দিয়েছে। তোমার মেয়ে যদি ছেলেটির সঙ্গে প্ল্যান না করে থাকে তা হলে সে-ও মিথ্যে বলল কেন?’

স্বপ্নেন্দু নার্ভাস গলায় বললেন, ‘আমি বুঝতে পারছি না। হয়তো লজ্জা কিংবা আমাদের অপমান হবে ভেবে, কী জানি। সুর্মি এত সেন্টিমেন্টাল, চাপা, যে ওর মনে কী হচ্ছে বোঝা মুশকিল। কিন্তু ওদের যদি ট্রেনে তুলে দেওয়া হয়ে থাকে তা হলে কোথায় গেল? নিউ জলপাইগুড়িতে পাওয়া যায়নি বলছে!’

প্রণব বলল, ‘সেটাই কথা। হয়তো মাঝখানের কোনও স্টেশনে নেমে গেছে। যাই বলো, এখন মনে হচ্ছে তোমার মেয়ের সহযোগিতা আছে।’

স্বপ্নেন্দু কথাটাকে কিছুতেই মানতে পারছেন না, অথচ প্রতিবাদ করার কোনও উপায় নেই। সুর্মা তো স্বচ্ছন্দে পুলিশকে সব কথা বলতে পারত।

স্বপ্নেন্দু অসহায় চোখে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। কাল সারারাত কান্নাকাটির পর আজ সুর্মার মা অনেক শক্ত হয়ে গেছেন। তিনি চুপচাপ এঁদের কথা শুনছিলেন। এবার বললেন, ‘পুলিশ তো ভুল করতেও পারে। আমার মনে হচ্ছে ওরা দার্জিলিং-এ গেছে। তুমি আমাকে আজই সেখানে নিয়ে চলো।’

স্বপ্নেন্দু বিহ্বল গলায় বললেন, ‘দার্জিলিং-এ যাবে?’

সুর্মার মা বললেন, ‘হ্যাঁ! আমি নিজে গিয়ে ওকে নিয়ে আসব। আজকেই কোনওমতে ওখানে পৌঁছনো যায় না?’ প্রশ্নটা প্রণবের উদ্দেশ্যে।

প্রণব ঘড়ি দেখল, ‘না, আজ ওখানে পৌঁছনোর কোনও উপায় নেই। প্লেন ধরতে পারবেন না। যদি যেতেই হয় তা হলে দার্জিলিং মেল ধরাই ভালো।’

স্বপ্নেন্দু বললেন, ‘টিকিট পাওয়া যাবে?’ বলেই লজ্জিত হলেন। কাল ওই বাচ্চা মেয়েটা তো বিনা টিকিটেই হয়তো ট্রেনে উঠেছে আর তিনি টিকিটের কথা চিন্তা করছেন।

প্রণব উঠল, ‘আমি ব্যবস্থা করছি। তুমি একবার থানা ঘুরে যেও!’ প্রণবকে গাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে ফিরছেন এমন সময় স্বপ্নেন্দু দেখলেন অতীনের বড়দা আসছে। যতীন বোধহয় ভদ্রলোকের নাম, স্বপ্নেন্দু গুলিয়ে ফেললেন।

যতীন কাছে আসতেই স্বপ্নেন্দু বললেন, ‘আমরা খবর পেয়েছি যে ওরা দার্জিলিং গিয়েছে। পুলিশ ওদের খুঁজছে যদিও, তবু আজ আমরা ওখানে রওনা হচ্ছি। আপনারা কেউ আমার সঙ্গে যাবেন?’

যতীন বিরক্ত হল, ‘পুলিশে খবর দিতে গেলেন কেন? ঘরের কথা খবর কাগজে বের হবে! না, আমাদের যাওয়ার সময় নেই।’

স্বপ্নেন্দু অবাক হলেন, ‘ওরা অল্পবয়সি, যে কোনও মুহূর্তে বিপদে পড়তে পারে, আপনাদের দুশ্চিন্তা হচ্ছে না?’

‘দুশ্চিন্তা করে কী করব বলুন! ওইটুকু ছেলে একটা মেয়ের জন্যে পাগল হয়ে যাবে ভাবা যায়? তা ছাড়া, হাসপাতাল থেকে বলেছে ও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়নি। ওর মনের চাহিদা পূরণ না হলে হয়তো আবার পাগল হয়ে যেতে পারে। আপনার মেয়ে সঙ্গে যাওয়ায় মা খুব নিশ্চিন্ত হয়েছেন। ওঁর ধারণা যে অতীন যদি বিয়ে করতে পারে সুর্মাকে, তা হলে আর পাগল হবে না। সে ক্ষেত্রে খামোকা চেজ করতে যাব কেন?’

যতীন চলে গেলে স্বপ্নেন্দু খানিকক্ষণ আচ্ছন্ন হয়ে রইলেন। এ কী যুক্তি তিনি শুনলেন? তারপরেই খেয়াল হল মেয়েটা একটা পাগলের সঙ্গে রয়েছে। যদিও ওই পাগলের হাতে বেশ কিছু টাকা আছে এই মুহূর্তে, তবু কোনওমতেই বিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি কী করতে পারেন! যদি যাওয়ার চিন্তাটা আর-একটু আগে মাথায় আসত তা হলে আজই প্লেন ধরতে পারতেন। গত রাতটা ওরা ট্রেনে কাটিয়েছে, আজ কোথাও ওঠার আগেই যদি ধরতে পারতেন! সুর্মার যা অভ্যেস, তাতে ও এখন একা-একা কী করছে কে জানে। যে মেয়ে রাত্তিরে একা শুতে পারে না সে কী করে—! কথাগুলো যত ভাবছিলেন তত বুকের মধ্যে হিম ঝরছিল। তিনি চেয়ে দেখলেন সকালের কলেজ ছেড়ে পাড়ার মেয়েরা বাড়ি ফিরছে। দাঁতে ঠোঁট চাপলেন স্বপ্নেন্দু। তারপর কিশোরীদের দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই বললেন, ‘বোকা মেয়েরা।’

পাহাড় যে এত সুন্দর হয় জানতাম না। অনেকের কাছে শুনেছি পাহাড়ে উঠতে গেলে মাথা ঘোরে, বমি হয়, কিন্তু আমার কিছুই হয়নি। জানলা অবশ্য বন্ধ করে দিতে হয়েছিল খানিক পরেই, কারণ ঠান্ডা বাতাস আসছিল। আমার সঙ্গে তো কোনও দ্বিতীয় রুমাল পর্যন্ত নেই। কী করে পাহাড়ের ঠান্ডায় থাকব বুঝতে পারছিলাম না। বাসি জামাকাপড় কাল থেকে পরে আছি, কিন্তু মনে কোনও বিকার হচ্ছে না। মা থাকলে হয়ে যেত আমার! আজ সকাল থেকে মা-বাবার জন্য কষ্ট হচ্ছে যদিও, তবু বুঝতে পারছি আর আমার ফেরার কোনও উপায় নেই। বাবাকে সব কথা খুলে চিঠি লিখব, আমি ঠিক জানি বাবা আমাকে বুঝতে পারবেন। উনি বলেন, মানুষ ভুল করে এবং মানুষ বলেই সেটা শুধরে নেয়। কিন্তু আমি তো কোনও ভুলই করিনি। একথা, জানি এখন কেউ বুঝবে না। বাবাও কি বুঝবেন না?

অতীন সেই পাহাড়ে ওঠার পর থেকেই সিটে মাথা এলিয়ে ঘুমুচ্ছে। ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আমার কেন জানি না অন্যরকম লাগছিল। কী সরল, এবং ভালো মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে খুব অসহায়ও। আসলে অতীন তো ঠিক ক্রিমিনাল কিংবা লম্পট নয়। এটুকু বুঝতে পেরেছি, আমি না চাইলেও ও আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। কী জানি কেন, এতে আমার বেশ গর্ব হচ্ছে। আমার জন্যে একটা ছেলে এরকম ঝুঁকি নিচ্ছে। বোধহয় এই কারণেই আমি শিলিগুড়িতে মিথ্যে কথা বললাম পুলিশের কাছে। মিথ্যে কথা একবার বলতে আরম্ভ করলে আর অসুবিধে হবে না। বেশ নাটক-নাটক মনে হয়।

এবার আমার বেশ শীত করছে। শীত-শীত ভাবটা অনেকক্ষণ থেকেই ছিল, এবার জাঁকিয়ে এল। আমার তো গরম জামাকাপড় নেই, বাসে যায় দিকেই তাকাই তার গায়ে কিছু না কিছু রয়েছে। এভাবে দার্জিলিং-এ নিশ্চয়ই কেউ যায় না। অতীনের বোধহয় শীত করছিল কারণ ও বেশ কুঁকড়ে আছে। হঠাৎ চোখ মেলে বলল, ‘খুব শীত করছে রে!’ তারপর দ্রুত ব্যাগটা টেনে নিয়ে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে সোয়েটার বের করল। তারপর আর-একটা। বলল, ‘ভাগ্যিস আসার সময় দুটো এনেছিলাম। ময়লা হলে অন্যটা পরব ভেবেছিলাম। তুই এই লালটা পর।’

দুটোই ফুল-স্লিভ! আমি আর দ্বিরুক্তি করলাম না। সোয়েটারটা মাথা গলিয়ে নিলাম। একটু টাইট হলেও বেশ ভালো লাগছে। আমারটা গলা তোলা, আর শীত লাগছে না। নিজেকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল কিন্তু উপায় নেই। অতীন হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বুঝলাম আমাকে নিশ্চয়ই সুন্দর দেখাচ্ছে। আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। গাড়িটা এখন এঁকেবেঁকে শুধু উঠছে তো উঠছেই। মাঝে-মাঝে জনবসতি পেলেই কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিচ্ছে। বাঁ দিকে গভীর খাদ আর ডান দিকে খাড়া পাহাড়, একটু বেঁকে গেলেই নিচে গড়িয়ে পড়ব। হঠাৎ হাতস্পর্শ পেতেই ফিরে তাকালাম। অতীন একটা ছোট চিরুনি এগিয়ে দিচ্ছে। মনে পড়ল আমি সকাল থেকে চুল আঁচড়াইনি। কৃতজ্ঞ হলাম, অতীনের ওপর মনটা খুশিতে ভরে গেল। অত ছোট চিরুনিতে আমার চুল ম্যানেজ করা যায় না ভালো করে, তবু গুছিয়ে নিলাম। অতীন ফিসফিস করে বলল, ‘আমি তোকে ভীষণ ভালোবাসি সুর্মি!’

ওর গলার স্বরে কী যেন ছিল, আমি সোয়েটারের ভেতরেও কেঁপে উঠলাম। আমি জানি না কেন, ওর দিকে আর তাকাতে পারলাম না। অতীন চোখ বন্ধ করল। আমার হাত ধরল না কিংবা অন্যভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল না। শুধু শরীরটাকে বাসের সিটে এলিয়ে দিল। যেন ডুবে থাকল।

কার্শিয়াং-এ আমরা নামলাম না। তার আগের একটা ছোট্ট বাজারমতো এলাকায় বাস দাঁড়াতেই অতীন উঠে বসল। তারপর ওপাশে দাঁড়ানো একটা নেপালিকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কার্শিয়াং আর কতদূর?’

‘দো মাইল।’

অতীন বলল, ‘এই সুর্মি, উঠে পড়। আমরা এখানেই নামব।’

‘এখানে? এটা তো কার্শিয়াং নয়।’ আমি অবাক হলাম।

‘জানি। কিন্তু কার্শিয়াং-এ নামলে বিপদ হতে পারে। এখানে নেমে তারপর ভাবব কী করে যাওয়া যায় ওখানে।’ ব্যাগটাকে হাতে নিয়ে অতীন ভিড় সরিয়ে আমাকে নামিয়ে আনল কী সুন্দর। কুয়াশারা দল বেঁধে নেমে আসছে আমাদের দিকে। ছোট-ছোট টিনের ছাদ-ওয়ালা কাঠের ঘর। দু-তিনটে সবজির দোকান। সবাই নেপালি নয়, কয়েকটি মাড়োয়ারি আছে। বাস ছাড়িয়ে আমরা একটু এগোতেই অতীন বলল, ‘দ্যাখ-দ্যাখ, ওঃ কী সুন্দর।’

ততক্ষণে আমারও চোখ পড়েছে। বাঁদিকে আকাশের গায়ে ঝকঝক করছে বরফের চূড়া। ওখানে মেঘ নেই, কুয়াশা নেই। এত নীল আকাশ, ওরকম সোনালি বরফের পাহাড় আমাকে পাথর করে দিল। নিশ্চয়ই ওটা কাঞ্চনজঙ্ঘা। আমার হঠাৎ ওই দিকে তাকিয়ে কান্না পেয়ে গেল। কেন পেল জানি না। অতীন আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সুর্মি, তুই কাঁদছিস?’

আমি দ্রুত চোখ মুছে নিলাম। তারপর বললাম, ‘কোথায় যাবি এখন?’

অতীন চারপাশে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘তোর চোখে জল দেখলে আমার নিজেকে ক্রিমিনাল মনে হয়! কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি তোকে ভালোবাসি।’

আমি হাসবার চেষ্টা করলাম, ‘না, আর কাঁদব না। তবে তুই যত তাড়াতাড়ি পারিস আমাকে একটা খাম আর কলম এনে দিবি?’

‘কেন?’

‘বাবাকে সবকথা খুলে একটা চিঠি লিখব।’

‘কেন?’

‘বাবার কাছ থেকে আমি কিছুই লুকোতে পারব না।’

‘ঠিক আছে।’ অতীন কথাটা বলল বটে কিন্তু বুঝতে পারছিলাম যে ও মন থেকে কথাটা বলল না। সামনেই একটা খাবারের দোকান দেখে ও এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে ডাকল, ‘আয়, এখানে আমরা খেয়ে নিই।’

এরকম মোটা রুটি আর তরকারি আমি কখনও খাইনি। কোনওরকমে যা পারি খেয়ে হাত ধুতেই মনে পড়ল ডায়েরিটার কথা। কাল স্বপ্নাদের বাড়ি থেকে বের হবার পর ওটা হাতে ছিল। কোথায় ফেললাম? ট্যাক্সিতে না ট্রেনে? ওতে অনেক জরুরি নোটস, ঠিকানা লিখেছিলাম। তারপরেই ভাবলাম যাক, এখন ওই ডায়েরিতে আর আমার কী দরকার!

বিকেলবেলায় আমরা সোজা দার্জিলিং-এ চলে এলাম। অতীনের এরকম ইচ্ছে ছিল না। খাওয়ার পর ও আমাকে একটা কালভার্টের ওপর বসে সব কথা বলছে। সুনীল প্রধান-এর বাড়ি যদিও কার্শিয়াং-এ কিন্তু ও পড়ে দার্জিলিং কলেজে। সুনীলের বাড়িতেই ওঠার পরিকল্পনা ছিল অতীনের। কারণ দার্জিলিং-এ সবাই বেড়াতে যায়, সেখানে চেনা লোকের দেখা পাওয়া যাবেই। আমরা ঠিক করলাম বাসে উঠব না। কারণ বাসস্ট্যান্ডে পুলিশ থাকতে পারে। অতীন বিদেশের কায়দায় হাত দেখিয়ে গাড়ি থামাচ্ছিল। আমাদের কপাল ভালো তাই দ্বিতীয় গাড়িটাই দাঁড়িয়ে গেল। একটা নেপালি মেয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। খুব স্মার্ট এবং সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে। মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘লিফট চাও?’

আমরা দুজনেই একসঙ্গে ঘাড় নাড়তে সে পেছনের দরজা খুলে দিল। গাড়িতে উঠে আমি বুঝলাম যাকে আমি মেয়ে ভেবেছি সে আসলে মহিলা। ত্রিশের অনেক বেশি বয়স। গাড়ি চালাতে-চালাতে জিজ্ঞাসা করল, ‘কোত্থেকে আসছ?’

আমি জবাব দিলাম, ‘কলকাতা।’

‘কোথায় উঠবে?’

অতীন উত্তর দিল, ‘হোটেলে।’

মহিলা সামনের আয়নার আমাদের দেখে নিল কিন্তু কিছু বলল না। একটু বাদেই কার্শিয়াং-এ এসে গেল। আমরা সাইনবোর্ডে জায়গার নাম দেখতে পেয়ে নড়েচড়ে বসলাম। একটা চৌমাথার মোড়ে ভিড়ের জন্য গাড়িটা আটকে গেল। চারজন পুলিশ দুটি অল্পবয়সি ছেলেমেয়েকে জেরা করছে। ওরা প্রচণ্ড প্রতিবাদ করা সত্বেও পুলিশরা বোধহয় বিশ্বাস করছে না। রাস্তার লোক এই দেখে মজা পেয়ে ভিড় জমিয়েছে। মহিলা গাড়ি ছাড়লে অতীন যেন নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচল। আমাকে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘কার্শিয়াং-এ নামব না, দার্জিলিং-এই চল।’ ভাগ্যিস মহিলাকে আমরা গন্তব্যস্থল বলিনি তাই তিনি প্রশ্ন না করে গাড়ি চালাতে লাগলেন একমনে। ছায়া ঘনিয়ে আসছে। শীত সোয়েটারের মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করছে। হঠাৎ মহিলা কথা বললেন, ‘তোমরা নিশ্চয়ই ভাই-বোন নও! তাই না?’ উনি আমাদের দিকে মুখ ফেরাননি। আমি অস্বস্তি বোধ করলাম, ‘কী করে বুঝলেন?’

‘তোমরা আমার বয়সে এলেই বুঝতে পারবে। দার্জিলিং-এ এর আগে এসেছ?’

‘না?’

‘কোন হোটেলে উঠবে ঠিক করেছ?’

‘গিয়ে খুঁজে নেব একটা।’

‘দ্যাটস নট সো ইজি মাই ফ্রেন্ড! এখন দার্জিলিং-এ হেভি রাশ, তার ওপর সন্ধে হয়ে যাবে পৌঁছাতে। ইউ উইল বি ইন রিয়েল ট্রাবল!’

ভয় পেয়ে যাচ্ছিলাম। শীতের মধ্যে দার্জিলিং-এ রাত্রে কোথায় থাকব? আর তারপরেই বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। রাত্রে আমি কখনও একা শুতে পারি না। ছেলেবেলা থেকেই এইরকম অভ্যেস হয়ে গেছে! আজকে আমার সঙ্গে কে শোবে? আমি অতীনের দিকে তাকালাম! অতীন? না, অসম্ভব। আমি ওর সঙ্গে এক ঘরে শুতে পারব না। আবার কান্না পাচ্ছিল কিন্তু সেই সময় অতীন চাপা গলায় বলল, ‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই! সুনীল ঠিক ম্যানেজ করে দেবে।’

দার্জিলিং-এ পৌঁছে মহিলা বলল, ‘তোমাদের কোথায় নামাব?’

অতীন জবাব দিল, ‘এখানেই নামিয়ে দিন না!’

‘এখানে নেমে কী করবে? এখানে কোনও হোটেল নেই। এখানে তোমার জানাশোনা কেউ আছে?’ মহিলাকে চিন্তা করতে দেখলাম।

‘হ্যাঁ। কলেজ হোস্টেলে—।’

‘দ্যাটস গুড। তোমরা এক কাজ করতে পারো। আমার ওখানে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে তুমি ফ্রেন্ডকে খুঁজে বের করে হোটেল দেখে ওকে নিয়ে যেও। ওকে নিয়ে হোটেলে-হোটেলে ঘোরা ঠিক হবে না।’ বলে সম্মতির অপেক্ষা না করে গাড়ি চালাতে লাগলেন। অতীনের এই ব্যবস্থা পছন্দ হল না বুঝতে পারছি, কিন্তু আমার মন্দ লাগল না। আমার এখন বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হওয়া একান্তই দরকার।

মহিলার বাড়ি স্টেশন ছাড়িয়ে অনেকটা দূরে। এটা বলতে পারছি কারণ আসার সময় স্টেশনটাকে দেখতে পেয়েছিলাম। সুন্দর লন পেরিয়ে গাড়িটা থামল। মহিলা জানলার কাচ তুলে দিয়ে বললেন, ‘এবারে এসো।’ বাড়িটাকে স্পষ্ট বুঝতে না পারলে বুঝতে পারলাম এঁরা বেশ বড়লোক। একটা দারোয়ান গোছের লোক মহিলাকে সেলাম করল। প্রথমেই একটা বিরাট হল ঘর। পায়ের তলায় পুরু কার্পেট। মহিলা বলল, ‘তোমরা এখানে বিশ্রাম করো। ওপাশে একটা টয়লেট আছে। ইচ্ছে করলে ব্যবহার করতে পারো। আমি চেঞ্জ করে আসছি।’

অতীন খুব নার্ভাস হয়ে গেছে, আমারই মতন। কী সুন্দর সোফা, ঘরে একটা হালকা নীল আলো জ্বলছে। অতীন বলল, ‘যাচ্চলে! কোথায় এলাম।’ তারপর সোফায় বসল। দেখলাম অনেকখানি ডুবে গেল ও। আমি একটু দ্বিধা করে টয়লেটে গেলাম। এমন সুন্দর টয়লেট আমি জীবনে দেখিনি। ইংরেজি সিনেমার মতন। ইচ্ছে করছিল গরম জলের শাওয়ার খুলে স্নান করে নিই। কিন্তু নতুন জায়গায় সাহস পেলাম না। আয়নায় নিজেকে দেখলাম। ইস, মাত্র চব্বিশ ঘণ্টায় আমার চেহারা কতখানি পালটে গেছে!

চা খেতে-খেতে মহিলা জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার পরিচিতজন কোথায় থাকেন, ঠিকানাটা কী?’

অতীন সুনীল প্রধানের ঠিকানা জানাল। মহিলার কপালে ভাঁজ পড়ল, ‘একে তুমি কী করে চিনলে? ছেলেটি তো নেপালি।’

অতীন জবাব দিল, ‘আমরা একসঙ্গে পড়তাম।’

চা-খাওয়ার পর মহিলার কাছ থেকে পথের নির্দেশ নিয়ে অতীন উঠল। আমার হঠাৎ মনে হল অতীন চলে গেলে আমি খুব একা হয়ে যাব। আমিও তো ওর সঙ্গে যেতে পারি! কিন্তু অতীনটা আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছে না। অতএব এই অপরিচিত মহিলার বাড়িতে আমি একাই রয়ে গেলাম।

চা খেতে নামার সময় মহিলা পোশাক পাল্টে এসেছে। ম্যাক্সির ওপর সোয়েটার মনে হয়েছিল, কিন্তু লক্ষ করে বুঝলাম ওটা ঠিক ম্যাক্সি নয়। কলকাতায় ভুটানিদের পরতে দেখেছি। ছুম্বা না কী একটা বলে ওটাকে। মহিলা বলল, ‘এসো, তোমার সঙ্গে আলাপ করা যাক।’ বলে উঠে দাঁড়ালেন। আমি ওঁকে অনুসরণ করে কাঠের রঙিন সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় এলাম। পাশাপাশি চারটে ঘরের একটায় ঢুকে আলো জ্বাললেন। একটা ডাবল বেড সোফা এবং টি ভি সেট।

সোফায় বসে মহিলা জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার নাম কী?’

একটু ইতস্তত করে সত্যি কথা বললাম। আমার নামটা কয়েকবার উচ্চারণ করল মহিলা তারপর বলল, ‘বাঃ দারুণ নাম। পড়াশুনা করো!’

‘হ্যাঁ, কলেজে।’ কলেজ বলতে ভালো লাগল।

‘ওকে তুমি ভালোবাস?’

কী বলব? গতকাল কেউ জিজ্ঞাসা করলে আমি চিৎকার করে না বলতে পারতাম কিন্তু এখন সেকথা বলতে পারছি কি! মহিলা হাসল, ‘বুঝেছি, কিন্তু তোমরা যে এখানে এসেছ তা তোমাদের মা-বাবা জানেন?’

আমি বললাম, ‘আমি জানাবার সুযোগ পাইনি।’

‘আই সি! কী নাম ওর?’

‘অতীন।’

‘এখানে কি শুধুই বেড়াতে এসেছ?’

‘না। অতীন চাকরির খোঁজে এসেছে।’

‘আচ্ছা! সুনীল ওকে কথা দিয়েছে?’

‘হ্যাঁ!’

‘তুমি একটা বোকা, ভীষণ বোকা মেয়ে। এইভাবে অনিশ্চয়তার ভেসে পড়তে হয়? জানো না, আমাদের মেয়েদের জন্যে পায়ে-পায়ে বিপদ হাঁ করে বসে আছে। এত ইমোশনাল হলে চলে! তোমার সঙ্গে তো একটাই ব্যাগ দেখছি। জামাকাপড় ওতে আছে?’

‘অতীনের আছে, আমার নেই!’

‘স্ট্রেঞ্জ, তুমি নিশ্চয়ই বলবে না এক কাপড়ে চলে এসেছ!’

মাথা নামালাম, ‘হ্যাঁ, তাই।’

মহিলা বোধহয় কিছুক্ষণ আমায় দেখল, তারপর উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, জানি না এসব কথা এঁকে বলে ভালো করলাম কি না! অতীন জানলে হয়তো রেগে যেতে পারে। কিন্তু ওঁর কথা বলার ভঙ্গিতে এমন আন্তরিকতা মাখানো যে না বলে পারিনি। একটু বাদেই মহিলা সুন্দর একটা ম্যাক্সি আর শাল নিয়ে ফিরে এল। ‘যাও ওই টয়লেট থেকে এগুলো পরে এসো। এক জামাকাপড়ে বেশিদিন থাকতে নেই।’

আমি কখনও অন্যের জামা-কাপড় পরিনি এক অতীনের এই সোয়েটারটা ছাড়া। তবু মনে হল ওগুলো পরলে আমি ফ্রেশ হব। এ ঘরের লাগোয়া টয়লেটে চেঞ্জ করে এলাম। মহিলা বলল, ‘বাঃ, চমৎকার। তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। নাইস! বসো। তুমি তো আমার নাম জিজ্ঞাসা করলে না? আচ্ছা বলো তো আমার বয়স কত?’

আমি সত্যি অনুমান করতে পারিনি ওর বয়স এখন চল্লিশ। কথাটা মোটেই মানতে ইচ্ছে করে না অবশ্য। চব্বিশ-পঁচিশ বছরের হলে মানিয়ে যায়। কিন্তু ওর মেয়ের বয়স নাকি আঠারো। কলকাতার লরেটো কলেজে পড়ে। আজ দুপুরে বাগডোগরা এয়ারপোর্টে তাকে তুলে দিয়ে ফেরার পথে আমাদের সঙ্গে দেখা। মেয়ের ছবি আছে ওর লকেটে, দেখলাম। এতক্ষণে আমি ওঁকে বেশ শ্রদ্ধা করতে লাগলাম। মহিলার নাম জিনা দোরজি। সিকিমের মানুষ। তাই অমন লম্বাটে, নাক-চোখও চাপা নয়। স্বামী বছর তিনেক হল মারা গিয়েছে। এই বাড়িটায় মহিলা একা থাকে। ইচ্ছে করেই দার্জিলিং-এ পড়ায়নি মেয়েকে। সে নাকি পড়াশুনায় ভালো কিন্তু চেহারা এত সুন্দর যে ছেলেরা ওর মাথা খারাপ করে দিচ্ছিল। বিশেষ করে ওই সুনীল। কলকাতায় গিয়ে রপ্ত হতে-হতে কলেজটা শেষ করে ফেলবে বলে ওর বিশ্বাস। আমি আর অতীন তো প্রায় মহিলার মেয়েরই বয়সি। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি একা থাকতে পারেন?’

‘অ্যাদ্দিন পারছিলাম। ঝি-চাকর, এর সঙ্গে মেয়ে ছিল। কিন্তু এখন আর ওরা থাকতে দেবে না!’ জিনা হাসলেন।

‘কারা?’

‘ওই যারা আমাকে বিয়ে করার জন্যে উদগ্রীব হয়ে রয়েছে। আসলে, আমার এই শরীরটাও চায় না যে আমি একা থাকি। মেয়ে পর্যন্ত বলে গেল, মা তুমি বিয়ে করো। থাক আমার কথা। তোমাকে আমার বেশ লেগেছে। আমি বলি কী, তোমরা আজ রাত্রে এখানেই থেকে যাও! কাল দিনের আলোয় না হয় শিফট করো!’ প্রস্তাবটা আমার খুব পছন্দ হল এখন। এই মহিলার কাছে থাকলে আমি নিরাপদে থাকব—এইরকম মনে হচ্ছিল। জানি না অতীন এসে কী বলবে।