আয়নার সামনে আর ভেতরে যে দুজন, তারা কি একটুও আলাদা নয়? ওই চোখ, চোখের টান, কিংবা কপালের কোণে আধভাঙা চুল এবং সব মিলিয়ে উপচে পড়া এক আলো যা কিনা সমস্ত শরীরকে জড়িয়ে রেখেছে লাবণ্য হয়ে, এসবই কি একজনের? এই আঠারো-উনিশ বছর বয়সটার? সুর্মা অপাঙ্গে আয়নাকে দেখল। তারপর ধীরে-ধীরে কাছে এগোল। আয়নার কাছে সে-ও এগিয়ে আসছে। নাকের কাছে নাক, চোখের হাসিতে ছোঁয়াছুঁয়ি, সুর্মা বুক উজাড় করে শ্বাস ফেলল আর তখনই ঝাপসা হয়ে গেল আয়নার মুখের চিবুক, ঠোঁট। জলজ বাতাস সাদা করে দিল কাচটাকে। সুর্মা হেসে উঠে সরে এল। সরে আসতেই চোখে পড়ল দরজায় স্বপ্না দাঁড়িয়ে।
‘ওমা, কী করছিস? আয়নাকে চুমু খাচ্ছিস?’ স্বপ্না অবাক গলায় শুধাল।
‘চুমু? চোখে কী পড়েছে দেখছিলাম।’ সুর্মা চটপট কথা সাজাল।
‘চোখে তোর কাজল ছাড়া আর কী পড়বে! চোখ খোলা রাখলে দেখতে পেতিস তোকে নিয়ে কী কাণ্ডটাই পাড়ায় হয়ে গেল।’ স্বপ্না ঠোঁট বেকিয়ে হাসল। স্বপ্নার হাসি মাড়িকে দেখায়। এ পাড়ায় ওই সুর্মার বন্ধু। একসঙ্গে সেই ক্লাস ওয়ান থেকে টুয়েলভ ক্লাসে এসেছে। ওরা অবশ্য নিজেরা বলে সেকেন্ড ইয়ার। স্কুলের গন্ধটাকে ঝেড়ে ফেলতে চায়। স্বপ্নার চেহারা একটু ক্ষয়াটে ফর্সা। কিন্তু খুব বুদ্ধিমতী, ইংরেজিতে বেশ ভালো।
‘কী হয়েছে রে?’ সুর্মা জিজ্ঞাসা করল। আজ সকালেই ওরা ফিরেছে রাঁচি থেকে। সামারের প্রায় পঁচিশ দিন ওখানে খুব হইহই করে কাটিয়ে এল ওরা। সুর্মার বাবা স্বপ্নেন্দু মাস ছয়েক আগে রাঁচিতে বদলি হয়েছেন। তিনি একাই কোয়ার্টার্সে থাকেন, সুর্মাদের নিয়ে যাননি পড়াশুনায় বিঘ্ন হবে বলে। এবার সুর্মা মা আর বোনের সঙ্গে ঘুরে এল রাঁচি থেকে। ওখান থেকে তিনখানা চিঠি দিয়েছে সে স্বপ্নাকে, উত্তরও পেয়েছে। কিন্তু তাতে তো পাড়ার কোনও উল্লেখযোগ্য খবর ছিল না।
‘অতীন পাগল হয়ে গিয়েছিল’। স্বপ্না আস্তে-আস্তে বলল।
‘সে কি! কবে? কী করে পাগল হল! যাঃ, সত্যি বলছিস?’ একসঙ্গে এতগুলো প্রশ্ন করে বসল সুর্মা। ওর কথাটা বিশ্বাসই হচ্ছিল না।
‘তোরা চলে যাওয়ার দিন ছয়েক পরেই। এই তো গতকাল হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরেছে। পাড়ার সবাই জানে একথা।’ স্বপ্নার মুখ গম্ভীর।
‘তুই আমাকে লিখিসনি তো চিঠিতে?’
‘লিখলে তোর ভালো লাগত না।’
‘কেন?’
‘ও তোর জন্যেই পাগল হয়েছিল।’
কথাটা কানে যাওয়ামাত্র সুর্মার শরীর অবশ হয়ে গেল। প্রথমে সে কথাটার কোনও মানে খুঁজে পেল না। অতীন তার জন্যে কেন পাগল হবে? সে কখনও অতীনের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেনি। অতীনরা আগে ওদের পাশের বাড়িতে থাকত। এখন পাড়ার মোড়ে মিষ্টির দোকানের ওপরে উঠে গেছে। কলেজে পড়ে অতীন, পড়াশুনায় খুব একটা ভালো নয়। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই ওকে দেখে আসছে সুর্মা। ছেলেবেলায় নাকি এই বাড়িতেই সারাদিন পড়ে থাকত। ছিপছিপে লম্বা, বয়সের তুলনায় বেশ লম্বা, ইদানীং লালচে লোমে মুখ ঢাকা, চোখদুটো খুব সুন্দর। সুর্মার সঙ্গে এককালে খুব মারপিট হতো, সেই কোনকালের ছেলেবেলায়। তার জন্যে এখন পাগল হওয়ার কোনও মানে হয় না। বড় হয়ে যাওয়ার পর অতীন কেমন গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। এ বাড়িতে মাঝেমধ্যে আসে, সুর্মার মায়ের সঙ্গে কথা বলে, সামনে পড়লে সুর্মাকে দু-একটা প্রশ্ন করে এবং চলে যায়। এমনকী যেদিন রাত্রে ওরা রাঁচিতে গেল সেদিনও তো এসেছিল। সেই বিকেলে স্বপ্নেন্দু চা খাচ্ছিলেন আর সুর্মা কোন-কোন গল্পের বই সঙ্গে নেবে তাই ভাবছিল। দরজায় শব্দ হতেই কাজল বললেন, ‘যা তো, দ্যাখ কে এল?’
সুর্মা দরজা খুলতেই দেখল পাজামা-পাঞ্জাবি পরে অতীন দাঁড়িয়ে। ওকে দেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি, এর মধ্যেই রেডি?’
‘বাঃ, এখনই রেডি হব কেন? ট্রেন তো সেই রাত্তিরে।’
‘বাচ্চা মেয়েরা সকাল থেকে তৈরি হয় যাওয়ার জন্যে।’
সুর্মা একটা কড়া কথা বলতে যাচ্ছিল এমন সময় মায়ের গলা শোনা গেল, ‘কে এল রে?’
সুর্মা কিছু বলার আগেই অতীন চেঁচাল। ‘আমি মাসিমা।’
অতীনের পিছু-পিছু ঘরে ঢুকতেই সুর্মা শুনতে পেল স্বপ্নেন্দু বললেন, ‘এই যে অতীন, কেমন আছ?’
‘ভালো। আপনি?’
‘ওই আর কী! ওখানে একা থাকতে কি আর ভালো লাগে! এবার ওরা যাচ্ছে, কদিন বেশ হইচই করা যাবে।’
সুর্মার মা এসে দাঁড়ালেন, ‘হ্যাঁরে অতীন, আমাদের পাড়ার মোড়ে রাত্রে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকে না?’
‘হ্যাঁ, কেন?’
‘উনি চিন্তা করছেন ট্যাক্সি পাওয়া যাবে কি না।’
‘ও, এই ব্যাপার। কটায় বের হবেন আপনারা? আমি ট্যাক্সি ডেকে দেব।’
স্বপ্নেন্দু যেন এইটেই চাইছিলেন, ‘বাঃ, খুব ভালো। আটটায় বেরিয়ে পড়ব।’
সুর্মার মা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দ্যাখ, পারবি তো?’
অতীন হাসল, ‘বাঃ, আমি কি আর ছোট আছি?’ তারপরে সুর্মার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুই কিন্তু মাসিমার কাছছাড়া হবি না, হারিয়ে যেতে পারিস।’
স্বপ্নেন্দু বললেন, ‘না-না মেয়ে আমার লেডি হয়ে গেছে, ওখানে আমি একটা খুব ভালো ছেলে দেখে রেখেছি। এবার গিয়ে লাগিয়ে দেব বিয়ে।’
সঙ্গে-সঙ্গে সুর্মা চেঁচিয়ে উঠল নাকিসুরে, ‘বাবা তুমি না। ওমা দ্যাখো বাবা কী বলছে।’
সুর্মার মা হাসলেন, ‘সে তো ভালোই হয়। পছন্দমতো অল্পবয়সি ছেলে যদি পাওয়া যায় তো দায় চুকিয়ে ফেলাই ভালো। সব মেয়েকেই তো একদিন না একদিন বাপের বাড়ি ছেড়ে যেতেই হবে, কী বলিস অতীন?’
এখন মনে পড়ছে তখন অতীন কোনও উত্তর দেয়নি। শুধু সুর্মার মুখের দিকে তাকিয়েছে। তার খানিক বাদেই দু-একটা কথা বলে সে চলে গেল। অন্তত সেদিন ওর কোনও পরিবর্তন চোখে পড়েনি। তবে হ্যাঁ, রাত আটটায় ট্যাক্সি নিয়ে অতীন আসেনি। স্বপ্নেন্দুকেই ট্যাক্সি ডেকে আনতে হয়েছিল। স্বপ্নেন্দু রেগে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ইরেসপনসিবল। করবি না তো আগ বাড়িয়ে বললি কেন? কলকাতার ছেলেদের মধ্যে কোনও ডিসিপ্লিন নেই!’
সুর্মার মা অস্বস্তি নিয়ে বলেছিলেন, ‘অতীনটা তো এরকম নয়! ওকে সেই ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি! কিছু হল কি না কে জানে!’
স্বপ্নেন্দু বলেছিলেন, ‘কিছুই হয়নি। কোথাও আড্ডা মারছে। এখনকার ছেলেদের তুমি চেনো না। শোনো, ওকে অত ঘনঘন বাড়িতে আসতে দিও না।’
সুর্মা বন্ধুর দিকে তাকাল। এইতো সেদিনের ঘটনা এগুলো। এই ঘটনার জন্যে কোনও মানুষ পাগল হয় নাকি? সে এগিয়ে এসে স্বপ্নার হাত ধরল, ‘কী হয়েছে আমায় খুলে বল।’
স্বপ্না ইতস্তত করল। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকাল। তারপর বলল, ‘এখানে নয়। মাসিমা এলে শুনে ফেলবে। তার চেয়ে তোদের ছাদে চল।’
সুর্মাদের এই ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদটায় বিকেলে যেন হাট বসে যায়। সব ফ্ল্যাটের মেয়ে-বাচ্চা সেজেগুজে চলে আসে এখানে। এক-এক দলের পৃথক আড্ডা বসে। আশেপাশের নিচু ছাদগুলোকে পরিষ্কার দেখা যায়। সুর্মা ইদানীং ছাদে উঠত না। আজেবাজে কিছু ছেলে অন্য ছাদ থেকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে এইদিকে। ছেলেদের এইরকম অসভ্যতা ভীষণ খারাপ লাগে ওর। বুড়ো-বুড়ো লোকগুলো পর্যন্ত ওর দিকে এমন ভঙ্গিতে তাকায় যে গা জ্বলে যায়।
ছাদের ঠিক মাঝখানে ওরা বসল। এখন রোদ্দুর নেই কিন্তু ছায়াতে আলো মাখানো। আকাশটা আজ কাচের মতো ঝকমকে।
সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে সুর্মা বলল, ‘এবার বল কী হয়েছিল?’
স্বপ্না বলল, ‘তোরা রাঁচি চলে যাওয়ার তিনদিন পর ঘটনাটা ঘটল। রবিবার দিন দুপুরবেলায় আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অতীন চিৎকার করতে লাগল তোর নাম করে। মুখচোখ লাল হয়ে গেছিল, কী বীভৎস দেখাচ্ছিল ওকে।’
সুর্মা অবাক হয়ে গেল, ‘আমার নাম ধরে? কী বলছিল?’
হেসে ফেলল স্বপ্না, ‘আই লাভ ইউ সুর্মা, আই লাভ ইউ সুর্মা।’
‘যাঃ।’ সুর্মার দুই গাল বিকেলের আকাশ।
‘হ্যাঁরে। আমরা তো সবাই অবাক। পাড়ার ছেলেরা ধরাধরি করে ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসেছিল। শুনলাম খুব ভয়ঙ্কর হয়ে গেছে ও, দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছে, সারাক্ষণ গালাগালি করছে আর মাঝে-মাঝে ওই কথা বলছে। শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল ওর মা।’ একটু থেমে স্বপ্না বলল, ‘যাই বলিস, ওর মাকে আমার একদম পছন্দ হয় না।’ সুর্মা অবশ হয়ে গিয়েছিল। কোনওরকমে কথা বলল, ‘কেন?’
‘কেমন যেন স্বার্থপর-স্বার্থপর। নিজের ছেলের দোষ দিল না। উলটে তোর বাবার নামে সাত-পাঁচ বলে বেড়িয়েছে।’
‘আমার বাবার নামে? সেকি! কী বলেছে?’
‘তোরা অ্যাদ্দিন মেশামিশি করার পর এখন তোর বাবা রাঁচিতে নিয়ে গিয়ে তোর বিয়ে দিচ্ছে। এইসব। আমি তো শুনে একদম বিশ্বাস করিনি। তোর বিয়ে হলে আমি জানতে পারতাম না, বল?’ স্বপ্না তাকাল।
হাসবে না কাঁদবে, বুঝতে পারছিল না সুর্মা। রাঁচিতে যাওয়ার দিন বাবা স্রেফ রসিকতা করে যে কথাটা বলেছিল তা শুনে অতীন পাগল হয়ে গেল? এরকম কখনও হয়?
হঠাৎ স্বপ্না জিজ্ঞাসা করল, ‘একটা কথা সত্যি বলবি?’
‘বল।’
‘তোর সঙ্গে অতীনের, মানে, লাভটাভ হয়েছিল বলিসনি কেন?’
‘যাঃ।’ তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করে উঠল সুর্মা, ‘তোকে ছুঁয়ে বলছি স্বপ্না, আমার সঙ্গে ওর কিছুই হয়নি। ওকে তো ছেলেবেলা থেকে আমি দেখছি, কিন্তু কখনও মনের মধ্যে অন্য চিন্তা আসেনি। ইদানীং তো আমার সঙ্গে কথাও বলত না অতীন, খুব মুখোমুখি না পড়লে আমিও বলতাম না। ও যে এইসব যা-তা ভাবছে তাও আমাকে কখনও বলেনি। আমার এমন লজ্জা করছে এখন, পাড়ার সবাই কী ভাবছে বল।’ সুর্মার সত্যিই লজ্জা করছিল। পাগল হয়ে রাস্তায় তার নাম ধরে চেঁচামেচি করেছে ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিল।
স্বপ্না বলল, ‘ছেড়ে দে এসব কথা। এখন তো অতীন ভালো হয়ে গিয়েছে। আজ সকালেই দেখলাম খুব গম্ভীর মুখে হেঁটে যাচ্ছে। তুই যখন এসবের সঙ্গে জড়িত নোস, তখন তুই ভাববি কেন?’ স্বপ্না বোঝাল।
সন্ধে ঘন হতে ওরা নেমে এল ছাদ থেকে। কদিন বাদেই একটা পরীক্ষা। স্বপ্না আর বেশিক্ষণ থাকল না। দরজা অবধি পৌঁছে দিয়ে ফিরে এল সুর্মা। ওর খুব ইচ্ছে করছিল মায়ের কাছে এইসব কথা খুলে বলে। অতীনের সঙ্গে তার যে কোনও সম্পর্ক নেই, বা ওইসব ভাবার মতো মন তার তৈরি হয়নি, একথা আর কেউ না জানুক মা জানে। কিন্তু কথাটা বলতে যে তার খুব সঙ্কোচ হচ্ছিল। সে অপেক্ষা করছিল, মা যদি কারও কাছে ঘটনাটা শোনে, তা হলে নিজে থেকেই জিজ্ঞাসা করবে, তখনই বলা সহজ।
আজকাল বাবা বেশিরভাগ সময় রাঁচিতে থাকেন। বাবার জন্যে আমার খুব মন কেমন করে! আমরা তো দুই বোন। ছোট বোন এত ছোট যে আমার বন্ধু হতে পারে না। মায়ের কাছে আমি অনেক কথা বলি, কিন্তু সব কথা বলতে পারি না। পারলে তো স্বপ্নার কথাটা বলতে পারতাম। কাল রাত্তিরে মায়ের পাশে শুয়েও যখন ঘুম আসছিল না তখনও বলতে পারিনি। একথা ঠিক, বাবাকেও কথাটা বলতে পারতাম না। কিন্তু কিছুদিন থেকে বাবাকে আমার খুব কাছের মানুষ বলে মনে হচ্ছে। আমি যেই বড় হয়ে উঠলাম অমনি মনে হল বাবার অনেক কিছু আমার ভালো লাগে। আজকাল বাবা যখন আমার সঙ্গে রসিকতা করেন তার মধ্যে একটি বয়স্ক মত কাজ করে। এই সেদিন সন্ধেবেলায় আমরা গাড়িতে বেরিয়ে রাঁচিতে ফিরছিলাম, বাবা বললেন, ‘দ্যাখ সুর্মি, আকাশটাকে দ্যাখ! যেন কলজে ফেটে রক্ত ঝরছে।’
আমার খুব ভালো লাগল। আমি বুঝলাম খুব কষ্টের রঙ মাঝে-মাঝে লাল। সূর্যের জন্যে আকাশের যে কষ্ট সেটা যে দেখছে তার মধ্যেও ছড়িয়ে গেল। বাবা এভাবে আমাকে ভাবতে সাহায্য করেন। কিন্তু মা আমার আটপৌরে, এমনিতে খুব ভালো, যতটা ভালো একজন মা হতে পারে। কিন্তু মায়ের সঙ্গে কথা বললে মনের বয়স বাড়ে না। আর এই সময়টায় বাবা রাঁচিতে চলে গেলেন বদলি হয়ে। কদিন রাঁচিতে আমি খুব সুন্দর কাটিয়েছি।
জীবনে এরকম রাত ওই প্রথম, যে রাতে আমার চোখে ঘুম আসেনি। অতীনটা এমন কাণ্ড করল কেন? আমি তো ওর সঙ্গে কখনও তেমন ব্যবহার করিনি। আমার ক্লাসের অনেক মেয়ের লাভার আছে। ব্যাপারটায় শুধু একটা ছ্যাবলামি বলে আমার মনে হল। আমাদের এই বয়সে ওসব মানায়? বাবা বলেন, সব কিছুর একটা নিয়ম প্রকৃতি বেঁধে দিয়েছে। ভোরের ছায়ার সঙ্গে বিকেলের কেমন একটা মিল আছে কিন্তু তাই বলে কি ও দুটো এক! ভোরের ছায়ায় একটা শিরশিরে আনন্দ মেশানো থাকে আর বিকেলের ছায়ায় তিরতিরে দুঃখ। কিংবা ফলের মতো। অকালে কারবাইড দিয়ে পাকালে আসল স্বাদ কি মেলে? আমাদের এখন পড়াশুনার সময়। ক্লাসের পড়া ছাড়া পৃথিবীতে এত বই আছে যা না পড়লে মানুষ হিসাবে জন্মানোর কোনও মানে হয় না। একথাটাও বাবার কাছ থেকে শেখা। পশুর সঙ্গে মানুষের প্রভেদ হল মানুষ রিলে রেসের মতো সভ্যতাকে বয়ে নিয়ে যায়, আর পশু একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। আমার তাই ওসব মোটেই পছন্দ হয় না।
কিন্তু অতীনটা এমন কাণ্ড করল কেন? ও কি আমার কথা ভাবত? আমাকে, যাকে বলে ভালোবাসা, তাই বাসত? আমি তো কখনও সেরকম বুঝতে পারিনি। কাউকে ভালোবাসার কথা আমার মনেই আসেনি। অতীন এত কাছের ছেলে যে ওর সম্পর্কে এসব চিন্তা আমার মাথায় আসেনি! কোনও রক্তমাংসের পুরুষকে যদি আমি ভালোবাসি তো তিনি হলেন আমার বাবা। তারপরেই দুজন, আগে-পরে। একজন রবীন্দ্রনাথ অন্যজন জীবনানন্দ দাশ। এই দুজন মনের আকাশে একটার পর একটা তারা জ্বেলে দিয়ে যান আর বাবা সেই আকাশটাকে গড়ে দিয়েছিলেন। আমি যদি কাউকে ভালোবাসি তাহলে তাকে হতে হবে ওই তিনজনের সমান মনের মানুষ। অতীন তো সেরকম নয়। ও তো খুবই বলেছিল, একটু চোয়াড়ে। বইপত্র খুব পড়ে বলে জানি না। দুদিন সাদামাটা সিরিজ না কি ছাই ওরকম বই হাতে দেখেছিলাম। মাকে বলে মোহন দারুণ বই, ধরলে ছাড়া যায় না। তখন বাবা এখানে ছিলেন। জিজ্ঞাসা করায় বলেছিলেন, ‘নাবালক মানসিকতার মানুষের খাদ্য ওগুলো।’
কিন্তু সেই অতীন রাস্তায়-রাস্তায় চিৎকার করবে আই লাভ ইউ সুর্মা? কোনও কারণ ছাড়াই? একি সেই খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি আমার মনের ভিতরে? যেই শুনল রাঁচিতে গিয়ে আমার বিয়ে দেওয়া হবে অমনি সব ওলট-পালট হয়ে গেল? সেইজন্যেই কি কথা দিয়েও ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে এল না? আর ওই চিন্তায় পাগল হয়ে গেল? ও কি গোপনে আমাকে এতখানি ভালোবাসত। পাগল! এরকম একতরফা ভালোবাসার কী মূল্য? কিন্তু বুঝতে পারছিলাম অতীনের জন্যে মনে কেমন একটা মায়া মিশছে। আহা বেচারা। একে কি করুণা বলে? জানি না। তবে ওকে সামনে পেলে আমি সুন্দর করে বুঝিয়ে সহজ করতাম। তার পরেই মনে হল, এসবের কী দরকার। এই ঘটনাকে খামোকা এত গুরুত্ব দিচ্ছি কেন! আমি যেমন আছি তেমন থাকব। আমার তো ওর ওপর কোনও দুর্বলতা নেই। তা ছাড়া, অতীন তো আবার সুস্থ হয়ে গিয়েছে। ভালো থাক এই যথেষ্ট।
সুর্মাদের এই বাড়িটা কলকাতার আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত সংসার থেকে পৃথক নয়। স্বপ্নেন্দুর ভালো চাকরির কল্যাণে এখানে কখনও অভাব ঢোকেনি বটে কিন্তু সবকিছুই একটা গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সুর্মার মায়ের ওপরই এখন সংসারের পুরো দায়িত্ব। স্বপ্নেন্দু মাসে একবার আসেন হয়তো। ছোটবোন উর্মিকে সামলাতেই মায়ের সময় কেটে যায়। সুর্মা যেমন শান্ত, উর্মি ঠিক তার বিপরীত। বড় মেয়ে সম্পর্কে সুর্মার মায়ের দুশ্চিন্তা নেই। সারাদিন বই মুখে নিয়ে ব্যস্ত আছে। প্রথম-প্রথম বড়দের বই পড়া নিয়ে রাগারাগি করতেন সুর্মার মা। এই বয়সে এত পাকা বই পড়বে কেন? সেই ক্লাস এইটে বঙ্কিমচন্দ্র শেষ করেছে বাবার প্রশ্রয়ে। প্রথম-প্রথম স্বামীর ওপর খুব রাগ হতো। মেয়েকে এত লাই দেওয়া ঠিক হচ্ছে না মনে হতো। কিন্তু এখন ধারণা পালটাচ্ছেন। সুর্মা যে আর পাঁচটা ফাজিল মেয়ের মতো নয় উপলব্ধি করে নিশ্চিন্ত হয়েছেন। এটা খুব বড় রকমের শান্তি।
আজ রবিবার। দুপুরে খেয়েদেয়ে মায়ের পাশে শুয়ে পড়েছিল সুর্মা। উর্মিকে জোর করে ঘুম পাড়াতে হয়েছিল কিন্তু সুর্মা কখন নিজেই ঘুমিয়ে কাদা। কদিন থেকে মেয়েটা বলছিল চোখ ব্যথা করে। ভাবছিলেন এবার একজন চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন। দিনরাত বই মুখ করে বসে থাকলে চোখের আর কী দোষ।
বিকেলে মেমের ডাকে ঘুম ভাঙল। দুই মেয়ে তখনও ঘুমিয়ে। ঠেলা দিয়ে সুর্মাকে তুললেন তিনি, ‘সন্ধে হয়ে আসছে ওঠ।’
আলস্যে শরীর বেঁকাল সুর্মা, ‘উমম। আর-একটু ঘুমুই।’
‘না, আর আলসেমি করতে হবে না। উঠে পড়।’
বাধ্য হয়ে সুর্মা উঠল। উঠে বারান্দায় মোড়ায় বসে মেঘ দেখতে লাগল। হাতের কাজ সারতে তাড়া দিলেন সুর্মার মা, ‘এই তুই এখনও বসে আছিস। যা চুল বাঁধ, জামা ছাড়।’
সুর্মা বলল, ‘দ্যাখো মা, মেঘগুলো কী ভীষণ রাগী।’
সুর্মার মায়ের কপালে ভাঁজ পড়ল, ‘তোর চোখ নিশ্চয়ই খারাপ হয়েছে। কালই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে দেখছি। নইলে মেঘের রাগ দেখতে পাস।’
সুর্মা বলল, ‘চোখ থাকলে সব দেখা যায়। দুই চোখের মধ্যে আর-একটা চোখ।’
সুর্মার মা বললেন, ‘দরকার নেই আমার তৃতীয় নয়নের। তুমি আর তোমার বাবা নেই নয়নেই দেখো। এখন দয়া করে ওঠ।’
চুলটুল বেঁধে হঠাৎ খুব সাজতে ইচ্ছে করল সুর্মার। এরকম মেঘের বিকেলে মন ভীষণ ভালো হয়ে যায় ওর। রাঁচি থেকে কেনা জিনসের প্যান্ট আর শার্টটা পরে ফেলল ও। সচরাচর প্যান্ট পরে না সুর্মা। স্বপ্নেন্দু রাঁচিতে কিনে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘বাইরে বেড়াতে গেলে এটা পরবি। আজকাল তো সব মেয়েই প্যান্ট পরে। তা পাহাড়ে ওঠা-নামা করতে সুবিধে হবে বেশ। প্যান্ট পরলে তোকে বেশ স্মার্ট দেখাবে।’
মজা লেগেছিল সুর্মার। কদিনের আড়ষ্টতা ঘুচেছিল। নিজেকে ঠিক ছেলে-ছেলে লাগে প্যান্ট পরলে। শুধু হিপের ওপর লাগানো কোম্পানির ধাতব লেবেলটি খুলে ফেলেছিল প্যান্ট থেকে। অন্যের বিজ্ঞাপন অকারণে শরীরে বইবে কেন? সুর্মার মা-ও প্যান্ট দেখে মজা পেয়েছিলেন। ভাবখানা এরকম, আর তো পরতে পারবে না, এইবেলা পরে নিক।
তা শার্ট-প্যান্ট পরে চুল আঁচড়ে ঘরে আসতেই উর্মি বলল, ‘এই দিদি তুই কোথায় যাচ্ছিস রে?’
‘কেন?’
‘এত সেজেছিস, তোকে দেখে সবাই হাঁ হয়ে যাবে।’
‘মারব এক থাপ্পড়।’ কপট রাগে হাত তুলল সুর্মা। সঙ্গে-সঙ্গে উর্মি চেঁচাল, ‘মা দ্যাখো, দিদি আমাকে মারছে।’
উর্মির মুখের দিকে তাকিয়ে সুর্মা হেসে ফেলল, ‘তুই বড় হলে বিরাট ক্রিমিনাল হবি। এখন থেকে যা মিথ্যে বলিস!’
পড়ার টেবিলে এসে সুর্মার মনে পড়ল আজ স্বপ্না আসেনি। অথচ স্বপ্নাকে পইপই করে সে বলে দিয়েছিল ডায়েরিটা ফেরত দিতে। আগামী কালই একটা টেস্ট আছে। সেটার জন্যে ডায়েরিটা দরকার। সমস্ত ক্লাস-নোট রয়েছে ওটাতে।
সুর্মা চেঁচিয়ে বলল, ‘মা, উর্মিকে স্বপ্নাদের বাড়িতে পাঠাবে?’
সুর্মার মা বললেন, ‘কেন?’
‘আমার ডায়েরিটা ফেরত আনতে। ও দিয়ে যায়নি।’
ওপাশ থেকে উর্মি চেঁচাল, ‘আমি যেতে পারব না। ওদের একতলায় বিরাট কুকুর এসেছে। ভয় লাগে।’
সুর্মা বলল, ‘ফের মিথ্যে কথা!’
উর্মি মাথা ঝাঁকাল, ‘মিথ্যে তো মিথ্যে। তোর দরকার তুই যা না।’
সুর্মা অনুযোগ করল, ‘শুনলে মা, ও কীভাবে কথা বলছে!’
সুর্মার মা ঘরে এলেন, ‘থাক ওর গিয়ে দরকার নেই, বৃষ্টি আসছে। সুযোগ পেলেই ভিজে এসে জ্বর বাধাবে। তার চেয়ে তুই যা, সন্ধের আগেই ঘুরে আয়।’
সুর্মার বাড়ি থেকে বের হতে একটুও ইচ্ছে করছিল না। এখনও শরীর থেকে আলসেমিটা যায়নি। আর-একটু ঘুমোতে পারলে বেশ হতো। তা ছাড়া, এই শার্ট-প্যান্ট পরে পাড়ার চেনা লোকদের সামনে হাঁটতে একদম ইচ্ছে করছিল না। কেউ যদি কিছু বলে সেটা খুব লজ্জার হবে। আবার এগুলোকে ছাড়তেও আলিস্যি লাগছিল। এছাড়া আর-একটা লজ্জা লুকিয়ে আছে। সবাই তো এখন তার দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকবে। কেউ কি বিশ্বাস করবে অতীনের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক কখনও ছিল না? ভীষণ রাগ হচ্ছিল ওর অতীনের ওপর।
কিন্তু তারপরেই ও মত বদলাল। সে যত ঘরের মধ্যে বসে থাকবে তত তো লোকে সন্দেহটাকে সত্যি ভাববে। তা ছাড়া, তাকে কলেজে যেতে হবেই যখন, তখন লজ্জা করে কী লাভ! বরং সবাইকে দেখিয়ে দেওয়াই ভালো এসব সে গ্রাহ্য করে না। কেউ জিজ্ঞাসা করলে মুখের ওপর বলে দেবে ওসব নোংরা ব্যাপারের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। সুর্মা ঘর থেকে বেরিয়ে এল, ‘মা, আমি স্বপ্নাদের বাড়িতে যাচ্ছি।’
‘তাড়াতাড়ি আসিস। আর হ্যাঁ, বৃষ্টি আসতে পারে, তুই ছাতাটা নিয়ে যা।’ সুর্মার মা ছাতা খুঁজতে লাগলেন।
সুর্মা বাধা দিল, ‘দূর, এখান থেকে এটুকু, ছাতা নেব না।’
বলে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে তরতর করে নেমে এল। বড়রাস্তা দিয়ে মিনিট তিনেক গেলেই স্বপ্নাদের বাড়ি। দোতলার ফ্ল্যাটে ওরা থাকে। মেঘের জন্যেই আকাশ বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছিল। রাস্তায় লোকজন কম। এক-আধজন ছাড়া চেনা লোক চোখে পড়ছিল না। চারধারে একটা পালানো-পালানো ভাব দেখে মজা লাগছিল ওর। এখন অন্তত কলকাতার এই পাড়ার কেউ কারও দিকে নজর দিচ্ছে না।
স্বপ্নাদের একতলার দরজায় বিকেল বেলায় কিছু মেয়ে ভিড় করে থাকে। ওরা বোধহয় পেছন দিকের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা। মিছিল দেখতে বা বাজনা শুনতে যেমন ওখানে ছুটে আসে তেমনি মেঘ জমতে দেখাও বুঝি একটা কাজ ওদের। সুর্মা কোনওদিকে না তাকিয়ে সদর দরজা দিয়ে ঢুকতেই একটা বিস্মিত কণ্ঠ কানে এল, কেউ কাউকে সচেতন করিয়ে দিচ্ছে, ‘এই!’ আর একটি মেয়ে শব্দ করে হেসে উঠল। কিন্তু সুর্মা কিছুই পরোয়া করে না এমন ভাব দেখিয়ে উঠে এল।
স্বপ্নাই দরজা খুলল। ওকে দেখে ও একেবারে হতভম্ব, ‘ওমা তুই প্যান্ট পরেছিস! ইস, কী সুন্দর দেখাচ্ছে তোকে। রাঁচিতে গিয়ে বানিয়েছিস না?’
সুর্মা ভেতরে ঢুকে এমন ভঙ্গিতে হাসল যেন প্যান্টটা কোনও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়ই নয়। কিন্তু ও স্বপ্নার চোখের লোভ পড়তে পারল। স্বপ্না এখন চাইবে দ্রুত একটা ভালো প্যান্ট হোক। সুর্মা বলল, ‘তুই গেলি না যে বড়! ডায়েরিটা দে।’
ওরা কিছুক্ষণ গল্প করার পর স্বপ্নার মা এলেন, ‘বাবা কিনে দিল বুঝি।’
সুর্মা বুঝতে পারেনি, ‘কী মাসিমা?’
‘ওই পোশাক!’
‘হ্যাঁ। রাঁচিতে গিয়ে বললেন এটা পরলে পাহাড়ে ওঠার সুবিধে হয়।’
‘তা কলকাতাতেও বুঝি পাহাড় বয়ে নিয়ে এসেছিস। কী যে সব রুচি হচ্ছে।’ স্বপ্নার মা উদাস মুখে তাকালেন।
সুর্মার খুব লজ্জা করছিল। ঠিক এইরকম আঘাত দিয়ে স্বপ্নার মা কখনও কথা বলেন না। ও বলল, ‘স্বপ্না, আমি চলি।’
স্বপ্না ঘাড় কাত করল। ওই মুহূর্তে ওকে কেমন দুঃখী-দুঃখী দেখাচ্ছিল। দরজার কাছে পৌঁছতেই স্বপ্নার মা বললেন, ‘হ্যারে অতীন আজ তোদের বাড়িতে গিয়েছিল?’
সুর্মার মুখে রক্ত জমল। সে কোনওরকমে ঘাড় নাড়ল, ‘না তো।’
‘কী যে করিস তোরা! স্বপ্না অবশ্য বলছিল তুই ইনভলভড নস। কিন্তু পাড়ার লোকে সেকথা বিশ্বাস করবে কেন? এক হাতে তো আর তালি বাজে না। তা একটু সাবধানে যাস, পাগলটা নাকি প্রায়ই ঘোরাফেরা করে। আমার তো বাবা পাগল দেখলেই বুক হিম হয়ে যায়।’ স্বপ্নার মায়ের কথা শেষ হওয়া মাত্র সুর্মা দরজা ডিঙিয়ে গেল। উঃ মানুষ কী দ্রুত পালটে যায়। সে ঠিক করল আর কখনও স্বপ্নাদের বাড়িতে আসবে না। চোখে জল এসে গিয়েছিল সুর্মার। দ্রুত মুছে নিয়ে নিজেকে শক্ত করল। না, কে কী বলল তাই নিয়ে কষ্ট পাওয়ার কোনও মানে হয় না।
দরজায় সেই মেয়েরা তখনও দাঁড়িয়ে। তাদের একটুও পাত্তা না দিয়ে সুর্মা রাস্তায় নামল। ডায়েরিটা বাঁ হাতে নিয়ে ফুটপাত দিয়ে একটু এগোতেই চমকে উঠল। সুর্মার সমস্ত শরীরে কাঁপন এল। ও কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। মুহূর্তেই অসাড়তা কেটে গেলে সে অন্য ফুটপাতের দিকে তাকাল। না, কোনওভাবেই পাশ কাটানোর উপায় নেই! পরক্ষণেই মনে হল আশপাশের বাড়ির লোক জানলা দিয়ে তাকে দেখছে কি না! স্বপ্নাদের বাড়ির সদর দরজা এখান থেকে দেখা যায় না এটুকু বাঁচোয়া। সে ঠিক করল পাশ কাটিয়ে চলে যাবে।
অতীনের এক হাতে কিটস ব্যাগ, অন্য হাত মুঠো করা, মাথা নিচু করে আসছিল। মুখোমুখি হতেই যেন দুচোখ জ্বলে উঠল ওর, ‘আরে তুই? কবে এলি?
উত্তর দেবে কি দেবে না বুঝতেই ঠোঁট থেকে শব্দ বের হল, ‘আজ।’ তারপরেই পা বাড়াল সুর্মা।
‘দাঁড়া, তোর সঙ্গে কথা আছে।’
‘না, কোনও কথা নেই।’
‘আছে কি না আছে সে আমি বুঝব। রাঁচিতে পাত্র জুটল না?’
‘আমার পথ ছাড়।’
হঠাৎ অতীনের গলার স্বর পালটে গেল, ‘তুই এমন কেন রে?’
সুর্মার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। ওর মনে হচ্ছিল অতীন বোধহয় এখনও পুরোপুরি সুস্থ নয়। ওর কথাগুলো কেমন যেন নিঃশ্বাস জড়ানো।
‘আমি যাই।’
‘যাবিই তো। আমার জন্যে তুই থাকবি কেন?’ অতীনের কণ্ঠস্বর ক্রমশ উঁচু পর্দায় উঠল। সুর্মা দেখল ওর চোখের আলো নিভে গেছে। কেমন ঠান্ডা স্যাঁৎসেতে ভাব সেখানে। যদি এখনই আচমকা চিৎকার করে ওঠে, যদি পাগল হয়ে যায় ফের। সে যদি দৌড়ে বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করে তাহলে কি অতীনও পেছনে দৌড়াবে? ঠিক সেই সময় রাস্তার ওপাশের বাড়িটার জানলা খুলে গেল। একটা বউ হাঁ করে তাদের দেখতে লাগল সেখানে দাঁড়িয়ে।
অতীন বলল, ‘যাক আমি চলে যাচ্ছি আজকে।’
‘কোথায়?’
‘দার্জিলিং-এ। ওখানে আমার এক নেপালি বন্ধু চাকরি দেবে বলেছে। আর তোকে কখনও বিরক্ত করব না আমি। শুধু যাওয়ার আগে কয়েকটা কথা বলতে চাই।’
‘বাড়িতে চল।’
‘না ওসব কথা বাড়িতে বসে বলা যায় না।’
‘কী কথা?’
‘আমি কেন পাগল হয়েছিলাম।’
‘আমি তার কী জানি!’
‘তোর জন্যে। শুধু তোর জন্যে। আমার বেশি সময় নেই, তুই আমার কথা শুনবি কি না বল!’ কথা শেষ করতে না করতেই হাত তুলে একটা ট্যাক্সিকে থামাল অতীন। তারপর দরজা খুলে ডাকল, ‘উঠে পড়, যেতে-যেতে কথা বলব।’
‘আমি কোথায় যাব?’
‘স্টেশনে। আমাকে তুলে দিয়ে ফিরে আসবি। নইলে তোকে আর কোনওদিন আমার বলা হবে না। আয় তোর পায়ে পড়ি, আয়।’ ভিক্ষে চাওয়ার গলায় বলল অতীন।
‘বাড়িতে রাগ করবে। আমি যেতে পারব না।’
‘আধঘণ্টার জন্যে, কেউ টের পাবে না! আয় সুর্মি!’
সুর্মা মুখ তুলতেই দেখতে পেল দূরে পাঁচ-ছয়জন ছেলে আসছে! ওরা যদি এই দৃশ্য দেখে তাহলে আর দেখতে হবে না। ওর হঠাৎ মনে হল যদি আধঘণ্টা ওর সঙ্গে থেকে ও শান্ত হয় তাহলে একটা ঝামেলা থেকে বাঁচা যায়। সে তো কোনও বিরাট অন্যায় করছে না। আর এই সময়ে টুপটুপ করে বৃষ্টি ঝরতে শুরু করল। যারা রাস্তায় ছিল তারা ছুটোছুটি করে মাথায় ছাদ খুঁজতে লাগল। প্রায় চিৎকার করে উঠল অতীন। ‘আয় ভিজে যাবি!’
বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্যেই কিংবা দায় এড়ানোর ভঙ্গিতে সুর্মা ট্যাক্সিতে উঠল। অতীন দরজা বন্ধ করে বলল, ‘শেয়ালদা স্টেশন!’
ট্যাক্সিতে উঠেই সুর্মার মনে হল, এ কী করল সে! কেন সে আচমকা উঠে পড়ল। এখন যদি পাড়ার কেউ দেখে তাহলে হাজার বললেও বিশ্বাস করবে না। মায়ের কানে গেলে তো আর আস্ত রাখবে না। সে আসতে চায়নি এ কী কাউকে বোঝানো যাবে? গাড়িটা ততক্ষণে ট্রাম লাইনের ধার ঘেঁসে ছুটছে। সুর্মা নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে জানলা ঘেঁসে বসল। বাইরে তখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। সাদা দেখাচ্ছে চারধার। ট্যাক্সির ছাদে চটর-পটর শব্দ হচ্ছে।
একটু বাদে সুর্মা মুখ ঘোরাল। ওপাশের জানালার গায়ে প্রায় নেতিয়ে শুয়ে আছে অতীন। এই কদিনেই কী ভীষণ রোগা হয়ে গেছে, মুখে দাড়ি থাকা সত্বেও শীর্ণ-ভাবটা চোখে পড়ছে। চুলগুলো উস্কোখুস্কো, একদৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে। ওদের বাড়ি থেকে ট্যাক্সিতে শিয়ালদায় পৌঁছতে মিনিট দশেক লাগে। এই সময়ের মধ্যে অতীন কী বলবে বলে নিতে পারে। কিন্তু ওর তো কোনও ব্যস্ততা দেখতে পাচ্ছি না ট্যাক্সিতে ওঠার পর। সুর্মা জিগ্যেস করল, ‘কী বলবি বলছিলি?’
অতীন ঘোলাচোখে তাকাল। ওর চোখের পাতা কাঁপতে লাগল। তারপর সুর্মাকে চমকে দিয়ে হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠল দুহাতে মুখ ঢেকে। কান্নার বেগটা এমন ঢেউ-এর মতো আসছে যে মনে হচ্ছিল মোচার খোলার মতো ভাসছে ও। সুর্মা এত নার্ভাস হয়ে পড়ল যে কী করবে বুঝতে পারছিল না। ওর প্রথমে মনে হল অতীন কি আবার পাগল হয়ে গেল? পাগলরা কি এমন আকস্মিক কাঁদে! কিন্তু এরকম কান্না খুব গভীর দুঃখ না পেলে বুক থেকে উঠে আসে না। এই সময় ট্যাক্সিওয়ালা মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘ক্যা হুয়া?’
অতীনের পক্ষে জবাব দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, বিব্রত মুখে সুর্মা বলল, ‘কিছু না।’ লোকটা কী বুঝল কে জানে, আবার গাড়ি চালাতে শুরু করল। অতীন-এর অবস্থা এমন যে সুর্মার ভয় হল ও বোধহয় ট্যাক্সি থেকে নামতেই পারবে না। ক্রমশ ছেলেটার ওপর ভীষণ মায়া হল সুর্মার। শৈশব থেকে ওকে কখনই এমন করে কাঁদতে দেখেনি। একবার দোতলা থেকে পড়ে গিয়ে পায়ের হাড় ভেঙেছিল অতীন, তখন বছর সাতেক বয়স বোধ হয়, তখনও তো এমন করে কাঁদতে দেখেনি সুর্মা। সে একটু সরে বসে অতীনের বাজুতে হাত রাখল, ‘এই কাঁদছিস কেন?’
অতীন জবাব দিল না। ও যেন একটা কান্নার নেশায় আচ্ছন্ন সুর্মা আবার ডাকল, ‘এই অতীন, প্লিজ কাঁদিস না। আমাকে কী বলবি বলেছিলি বল।’
একটু-একটু করে নিজেকে সামলাল অতীন, কিন্তু ততক্ষণে স্টেশন এসে গিয়েছে। চোখের জল মুছে সোজা হয়ে বসল যখন তখন ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াল। সুর্মা দেখল অতীন পকেট থেকে এক গোছা টাকা বের করে ভাড়া মেটাল। অত টাকা সুর্মা একসঙ্গে কখনও হাতে নেয়নি। ওদের বাড়িতে ছোটদের হাতে টাকা দেওয়ার নিয়ম নেই। অতীনের কাছে অত টাকা এল কী করে?
দরজা খুলে অতীন ওকে ইঙ্গিতে নামতে বলে স্টেশনের ওপরের ঘড়ির দিকে তাকাল। ওর গলার স্বরে তখনও কাঁপুনি। ভিজে-ভিজে, ‘এখনও আধঘণ্টা আছে, তুই আমার সঙ্গে প্ল্যাটফর্মে চল।’
সুর্মা বলল, ‘না। আমি বাড়ি যাব।’
‘এই বৃষ্টি না থামলে যাবি কী করে? মিনিট পনেরো অপেক্ষা করে না হয় চলে যাস।’ অতীনের গায়ে বৃষ্টির জল পড়ছে। বাধ্য হয়ে সুর্মা ট্যাক্সি থেকে নেমে প্রায় দৌড়ে স্টেশনের ভেতরে ঢুকে পড়ল। চারধারে মানুষরা বৃষ্টির জন্যে আটকে থাকায় গমগম শব্দ হচ্ছে। ওদের ভিজে যাওয়া চেহারার দিকে অনেকেই তাকিয়েছিল। সুর্মা আড়ষ্ট হল। এই ভিড়ের মাঝে পাড়ার কেউ নেই তো! থাকলে আর মুখ দেখাতে হবে না! হঠাৎ ওর খেয়াল হল পকেটে একটা পয়সাও নেই। ফিরে যাওয়ার সময় বাসে টিকিট কাটতে হবে! এতদূরে সে কখনও একা আসেনি। কিন্তু চেনা বাস তো এ পাড়াতে আসে। অতীনের কাছে চাইবে নাকি! না চেয়ে কোনও উপায় অবশ্য নেই। সে হঠাৎ আবিষ্কার করল একা দাঁড়িয়ে আছে। রাত্রের আলোগুলো জ্বলছে এবং অতীন নেই! নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল ওর। চারপাশে তাকিয়ে অতীনকে দেখতে পেল না। এইভাবে তাকে ফেলে কি অতীন চলে যাবে? তাহলে নিয়ে এল কেন? সুর্মা কী করবে বুঝতে পারছিল না। মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে থাকার পর যখন দূরে অতীনকে দেখতে পেয়ে প্রায় দৌড়ে গেল ও, ‘কোথায় গিয়েছিলি না বলে?’
অতীনের যেন কোনও বোধশক্তি নেই এমন ভঙ্গিতে বলল, ‘চল।’
‘কিন্তু আমার কাছে বাড়ি ফেরার পয়সা নেই।’
‘দিয়ে দেব।’
প্ল্যাটফর্মের বাইরে দাঁড়িয়ে ট্রেনটা ভিজছে। বৃষ্টির জন্যে কি না কে জানে যাত্রীরা এখনও অল্প। একটা বেঞ্চিতে ব্যাগ রেখে অতীন বসল। সুর্মা সামনে দাঁড়িয়ে ট্রেনটাকে দেখে জিগ্যেস করল, ‘সত্যি চলে যাচ্ছিস?’
মাথা নাল অতীন। ‘হ্যাঁ।’
‘চাকরি করবি?’
‘হুঁঃ।’
‘যদি না পাস?’
‘পাবই। সুনীল আমাকে কথা দিয়েছে।’
‘বাড়িতে জানে?’
‘না।’
‘তাহলে টাকা পেলি কোথায়?’
‘পেয়েছি।’
‘সত্যি বলতো কেন যাচ্ছিস?’
‘তুই কি বুঝিস না? আমি যে তোকে ভালোবাসি তুই জানিস না?’
‘কিন্তু আমি তো তোকে—। বিশ্বাস কর—। এরকম পাগলামি।’
‘ও। এখন তো তুই আমাকে পাগল বলবি। জানি আমি তোর যোগ্য নই। আমার চেয়ে অনেক ভালো ছেলে পাবি। ও ভগবান!’
‘অতীন। এরকম করে বলিস না। তোর সঙ্গে আমার কোনওদিন কিছু হয়নি।’
‘কে বললে কিছু হয়নি? আমি তো তোকে ভালোবেসে এসেছি। প্রতিদিন তোর কথা ছাড়া অন্য চিন্তা করতাম না। আমি জানি তুই আমার চেয়ে অনেক মূল্যবান। কিন্তু আমি যে তোকে ভালোবাসি, কী করব বল? না, ওখানে আমি যাব না! তোকে আমি পাব না এটা আমি ওখানে বসে ভাবতে পারি না। সুর্মি, তুই আমাকে একটু ভালোবাস।’
সুর্মা কী বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না। হঠাৎ অতীন ওর দুটো হাত আঁকড়ে ধরল, ‘তুই আমার সঙ্গে চল সুর্মি। আমি চাকরি করব, বিয়ে করে আমরা খুব সুখে থাকব। আমি বেঁচে যাব সুর্মি।’
সুর্মা দ্রুত মাথা নেড়ে চিৎকার করে উঠল, ‘না, সে হয় না, না!’ ওরা এতক্ষণ লক্ষ করেনি দু-একজন করে মানুষ জমছিল কাছাকাছি। সুর্মা চিৎকার করে উঠতেই একজন এগিয়ে এল, ‘কী হয়েছে?’
সুর্মা ততক্ষণে হাত ছাড়িয়ে নিয়েছে। লোকটি আবার কড়া গলায় বলল, ‘কী ব্যাপার? তখন থেকে দেখছি একটা গোলমাল হয়েছে মনে হচ্ছে।’
সুর্মা কী বলবে বুঝতে পারছিল না। ওর সমস্ত শরীর হিম। অতীন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কিছুই হয়নি। আপনার কী দরকার?’
লোকটি শক্ত চোখে ওর দিকে তাকাল, ‘আপনাদের আমার সঙ্গে আসতে হবে।’
‘কেন, কোথায়?’ অতীনের গলা কাঁপছিল না।
লোকটা পকেট থেকে কার্ড বের করে দেখাল। এই সময় আর-একটি মোটা মতন বয়স্ক লোক কাছে এলেন, ‘কী হয়েছে শ্যাম?’
‘এদের মধ্যে একটা গোলমাল আছে স্যার!’ লোকটি জানাল।
আশেপাশে তখন বেশ ভিড় জমে গেছে। সুর্মার মনে হল সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। এরা নিশ্চয়ই পুলিশের লোক। ওদের যদি অ্যারেস্ট করে নিয়ে যায় তা হলে আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনও উপায় থাকবে না। পাড়ার লোক দূরের কথা, মা-বাবাকেই মুখ দেখাতে পারবে না সে। মোটা লোকটি ওদের সামনে এসে দাঁড়াল, ‘কী নাম?’
‘আমি অতীন সেন আর ও সুর্মা। ‘
‘কোথায় যাচ্ছ?’
‘শিলিগুড়িতে।’
‘কেন?’
‘মাসিমার বাড়িতে।’
‘এখানে কোথায় থাকো?’
‘বাহান্নর এ বাই টু চক্রবেড়িয়া।’
‘ও কে হয় তোমার?’
একটুও ইতস্তত না করে অতীন বলল, ‘আমার বোন।’
‘কীরকম বোন?’
‘নিজের।’
লোকটা সুর্মার দিকে ঘুরে বলল, ‘ও সত্যি কথা বলছে?’
সুর্মা সম্মোহিতের মতো মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ।’
‘মাসিমার বাড়িতে একা-একা যাচ্ছ কেন?’
‘মাসতুতো বোনের বিয়ে তাই। বাবা-মা দুদিন পরে আসবেন।’ অতীন জবাব দিল। প্রথম লোকটা এবার জিগ্যেস করল, ‘তাহলে তখন তুমি চেঁচাচ্ছিলে কেন?’ প্রশ্নটা সুর্মাকে উদ্দেশ্য করে।
‘ও একা যেতে চাইছিল না তাই!’ অতীন বলে উঠল। মোটা লোকটা জিজ্ঞাসা করল, ‘একা কেন? তুমি তো আছ?’
অতীন বেমালুম বলল, ‘আমাদের তো রিজার্ভেশন নেই। তাই আমি ওকে বললাম তুই জেনারেল কম্পার্টমেন্টে উঠতে পারবি না, যা ভিড়! বরং লেডিজ কম্পার্টমেন্টে গিয়ে বোস। সঙ্গে-সঙ্গে ও চিৎকার করতে লাগল একা-একা সারা রাত্রি যেতে পারবে না।’
সুর্মা এরকম অবাক কখনও হয়নি। অতীন এত চমৎকার মিথ্যে অনায়াসে বলতে পারে! ওর মনে হচ্ছিল এই মিথ্যেটা লোকগুলো বিশ্বাস করুক তাহলে আর হাঙ্গামা হবে না। এখন কোনওরকমে বাড়ি ফিরে যেতে পারলেই সে বাঁচে। মোটা লোকটা ঘাড় বেঁকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘তাই নাকি?’
সুর্মা নীরবে মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ।’
এই সময় ট্রেনটা হুইসল দিয়ে উঠল। অতীন ব্যস্ত চোখে সেদিকে তাকাতে মোটা লোকটা সঙ্গীকে বলল, ‘না হে মনে হচ্ছে ডালমে কোই কালা নেহি, তুমি এক কাজ করো, থ্রিটায়ারের টি টি-কে আমার নাম করে বলো ওদের একসঙ্গে জায়গা করে দিতে! এই সময় ট্রেনটা ঘনঘন নিঃশ্বাস ছাড়ছিল! যাত্রীরা যে যার কামরায় ওঠার জন্যে ব্যস্ত। প্রথম লোকটি ওদের তাড়া দিল, ‘চলো, এক্ষুনি গাড়ি ছাড়বে’ প্রায় তাড়িয়ে নিয়ে এল লোকটা থ্রিটায়ারের কাছে। দরজায় দাঁড়ানো টি টি-কে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘স্যার আপনাকে এদের দুটো জায়গা দিতে বলেছেন।’ টি টি ঘাড় কাত করতেই অতীন লাফিয়ে উঠে পড়ল। লোকটি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো সুর্মাকে তাড়া দিল, ‘ওঠ, ওঠ, এক্ষুনি ছেড়ে দেবে গাড়ি।’
সুর্মা চিৎকার করে বলতে গেল আমি যাব না, আমার যাওয়ার কোনও কথা নেই। কিন্তু সেই মুহূর্তে ট্রেনটা দুলে উঠল। লোকটা তাকে যেন সাহায্য করার জন্যেই পেছন থেকে ঠেলে দিল আর অতীন তৎক্ষণাৎ হাত বাড়িয়ে ওকে টেনে তুলল গাড়িতে। স্থির হয়ে দাঁড়াবার মুহূর্তে সুর্মা বুঝল প্ল্যাটফর্মের আলো ছাড়িয়ে ঘন অন্ধকারে ট্রেনটা ঢুকে পড়েছে। হঠাৎ তার মনে হল সে অন্ধ হয়ে গিয়েছে, কিছুই চোখে পড়ছে না। তারপর অনুভব করল অতীনের হাতে তার হাত। সে ক্রমশ অতীনের মুখ দেখতে পেল। কী শান্ত এবং আনন্দিত। চলন্ত ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে সুর্মা বাইরে মুখ ফেরাল। কলকাতায় বাড়িঘরের আলো দূরে-দূরে ছিটকে যাচ্ছে। আর তক্ষুনি বাবা, মা এবং উর্মির মুখ একসঙ্গে মনে পড়তেই সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। অতীন চাপা গলায় অনুনয় করছিল, ‘কাঁদিস না, লোকে সন্দেহ করবে।’
টি টি ভেতরে চলে গিয়েছিল। করিডোরে কেউ নেই। সুর্মা পাগলের মতো কাঁদছিল। তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। কাঁদতে-কাঁদতে ও হাঁটু গেড়ে নিচে বসে পড়ল।
আমি কী করব বুঝতে পারছি না। আমার এত আনন্দ হচ্ছে, জীবনে এরকম কখনও হয়নি। ভগবান সুর্মিকে পাইয়ে দিলেন কী অদ্ভুতভাবে। অন্তত আজকের রাতটার জন্যে তো বটেই। এবং আজকের রাত হলে আমি চিরজীবন ওকে ছাড়ব না। অথচ আজ সকালেও আমি চিন্তা করিনি ব্যাপারটা এমনভাবে ঘটবে! ওদের বাড়িতে তো যাওয়ার কোনও প্রশ্নই উঠছিল না। ওর সঙ্গে দেখা হবে তাও ভাবিনি। কিন্তু ভগবান সেটা করিয়ে দিলেন এবং এই যে ও এখন ট্রেনের মেঝেতে বসে কাঁদছে সেটাও তাঁরই ইচ্ছায়। সত্যি কথা বলতে কী আজকের আগে আমি ভগবানকে পছন্দই করতাম না!
দরজাটা নড়ছে। হাওয়া ঢুকছে হুহু করে। বৃষ্টি কমে এসেছে। আমি ধীরে-ধীরে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম, বেশ ঘরের মতো হয়ে গেল। সুর্মি এখনও কাঁদছে। অন্য সময় হলে এবং জায়গাটা নিরিবিলি হলে ওকে কাঁদতে দিতাম। শুনেছি খুব কাঁদলে মন হালকা হয়ে যায়। কিন্তু এখন, যে কেউ এসে পড়লে বিশ্রী ব্যাপার হবে। আমি ওর কাঁধে হাত রেখে ডাকলাম, ‘সুর্মি, এই সুর্মি প্লিজ কাঁদিস না।’
সুর্মি আমার দিকে তাকাল। দুটো চোখ ফুলে উঠেছে, গাল জলে মাখামাখি। অদ্ভুত করুণ গলায় বলল, ‘তুই আমার এ কি সর্বনাশ করলি? আমি এখন মুখ দেখাব কী করে?’
কথাটা শুনে আমার মন কেঁপে উঠল। আমি ওর সর্বনাশ করলাম? যাকে আমি নিজের চেয়েও ভালোবাসি; তার সর্বনাশ করা যায়? তবু বললাম, ‘উপায় ছিল না, আমি তো তোকে নিয়ে যেতে চাইনি, পুলিশরাই তো জোর করে তোকে তুলে দিল।’
সুর্মি উঠে দাঁড়াল। এবং এতক্ষণে আমার খেয়াল হল ওর পোশাক ছেলেদের মতো। শার্ট-প্যান্ট পরতে এর আগে আমি কখনও দেখিনি। আমার অস্বস্তি হলেও বুঝতে পারলাম না এই পোশাকে ওকে চমৎকার মানিয়েছে, বেশ স্মার্ট দেখাচ্ছে। দাঁতে ঠোঁট চেপে সুর্মি আমাকে দেখল, তারপর বলল, ‘তুই মিথ্যেবাদী!’
‘তার মানে? এই কথা মিথ্যে?’ আমি অবাক গলায় বললাম।
‘তুই ওই লোকগুলোর কাছে কীরকম মিথ্যে বললি! ছি-ছি!’
‘ও, তখন মিথ্যে না বললে এতক্ষণ থানায় পচতিস তা জানিস? বেশ, আমি তো তোর মুখ বন্ধ করে রাখিনি, তুই কেন পুলিশকে বললি না সব কথা! তাহলে তো এখন আফসোস করতে হতো না?’
সুর্মি কথাটা শোনামাত্র মুখ নামাল। ওর ঠোঁট কাঁপছে। আমার ভয় হচ্ছিল ও যেন ফের না কেঁদে ফেলে। ও যে আমাকে মিথ্যেবাদী বলল তার জন্যে রাগ হল না আমার। আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, তুই এক কাজ কর, এর পরে ট্রেন দক্ষিণেশ্বরে থামবে, সেখানে নেমে চৌত্রিশ নম্বর বাসে চেপে বাড়ি ফিরে যা।’ কথাটা বলার জন্যে বললাম, আমি কিছুতেই চাইছিলাম না ও ফিরে যাক।
সুর্মির চোখ যেন চট করে প্রাণ ফিরে পেল। ও সোজা হয়ে বলল, ‘দক্ষিণেশ্বর! এখন ফেরা যাবে?’
‘যাবে। দোহাই ততক্ষণ চুপ করে থাক। ‘আমি মুখ ফিরিয়ে নিজেকে গালাগাল দিতে লাগলাম মনে-মনে। কী দরকার ছিল রাস্তাটা বলে দেওয়ার। সত্যি যদি ও চলে যায়? আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। শরীর টলতে লাগল। সেই মাসখানেক আগে যেমন হয়েছিল।
আমি জানি আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। পাগল হওয়ার পর কী করেছিলাম সেকথা আমার মনে নেই। পরে শুনেছি বন্ধুদের কাছে। কিন্তু পাগল হয়েছিলাম বলেই বোধহয় কেউ চট করে আমার সামনে ও বিষয়ে আলোচনা করত না। সুর্মিদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমার বুকে সেদিন অদ্ভুত চাপ বোধ করেছিলাম। সুর্মিকে রাঁচিতে নিয়ে যাচ্ছে বিয়ে দেওয়ার জন্যে? ওইদিন প্রথম বুঝতে পারলাম ওকে আমি কতখানি ভালোবাসি। ইদানীং তো ওর সঙ্গে তেমন কথা হতো না। ওদের বাড়িতে সেই ছেলেবেলা থেকে যাচ্ছি, এক সময় কত খেলেছি, কিন্তু বড় হয়ে যাওয়ার পর দেখতাম ও কেমন গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। পড়াশুনার খুব ভালো, তারপর নানান রকম বই পড়ে সারাদিন। আমার আবার বইপত্তর একদম ভালো লাগে না। ওরা যেদিন রাঁচিতে গেল সেদিন আমি কেমন ঘোরের মধ্যে কাটিয়েছিলাম। সারাক্ষণ মনে হয়েছিল সুর্মিকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না। একবার ভেবেছিলাম ওদের বাড়িতে গিয়ে সুর্মিকে ডেকে সেকথা বলি। বাড়ির কাছে দুবার গিয়েও ফিরে এসেছি। সুর্মি যদি ওর বাবাকে ওই কথা বলে দেয়! ভদ্রলোক আমাকে ঠিক পছন্দ করেন না। অবশ্য মুখে কখনও সেকথা বোঝাননি। কিন্তু আমি জানি মেয়ের স্বামী হিসেবে তিনি আমাকে স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। সুর্মির স্বামী হবে কোনও অধ্যাপক অথবা বেশ সম্পন্ন মানুষ। আমার তো সেরকম যোগ্যতা কখনও হওয়ার নয়। আমার ট্যাক্সি ডেকে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কিছুতেই তা পারলাম না। আমারই ডেকে দেওয়া ট্যাক্সিতে সুর্মিকে বিয়ে দিতে নিয়ে যাবে ওরা? অসম্ভব! দূরে দাঁড়িয়ে দেখলাম সুর্মি ওর মা-বাবার সঙ্গে ট্যাক্সিতে উঠল তারপর আমার সামনে দিয়ে হুস করে বেরিয়ে গেল। আমার দিকে একবার ফিরেও তাকাল না। আর আমার মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। মনে হচ্ছিল আচমকা আমার খুব জ্বর হয়েছে, গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। পাড়ার একটা রকে চুপচাপ বসে রইলাম। সমস্ত আকাশ জুড়ে তখন সুর্মির মুখ ছাড়া কিছু নেই। তারপর হঠাৎ বুঝতে পারলাম আমার পায়ের তলায় মাটি নেই, আমি শূন্যে ভাসছি।
সেই সময়টা থেকে নাকি আমার পাগলামি শুরু হয়েছিল। আমি নাকি তারপর রাস্তায়, বাড়িতে সর্বক্ষণ চিৎকার করতাম ওর নাম ধরে।
পাড়ার লোকজন এই নিয়ে হাসাহাসি করত। আমি অবশ্য টের পেতাম না কারণ কোনও বোধ আমার কাজ করত না। তারপর হাসপাতালে শুয়ে-শুয়ে একসময় সেই মাটিটা পায়ের তলায় ফিরে এল। ডাক্তার বলেছে সাময়িক ডিসব্যালেন্স। কিন্তু তারপর থেকে আমার কথা বলতে ইচ্ছে করত না। সুবিধা ছিল এই যে আমাকে কেউ ঘাঁটাত না! হয়তো ভয় পেত, আবার যদি পাগল হয়ে যাই!
এখন আমার ঠিক সেইরকম হল। চোখের সামনেটা সাদা হয়ে যাচ্ছে। মাথার ভেতরে অদ্ভুত যন্ত্রণা হচ্ছে, পা টলছে। আমি দুহাত বাড়িয়ে দেওয়াল ধরতে চাইলাম। আমার কাঁধ থেকে ভারী ব্যাগটা পড়ে গেল, কিন্তু ওটাকে তোলার কথা মনে এল না। সুর্মির চিৎকার কানে এল, ‘এই কী হয়েছে তোর? অমন করছিস কেন?’
কিন্তু ততক্ষণে আমার হাঁটুটা ভেঙে গেছে, আমি ট্রেনের মেঝেটায় শুয়ে পড়েছি। সুর্মি আমার ওপর ঝুঁকে পড়ে বারংবার ডাকছে কিন্তু আমি সাড়া দিতে পারছি না। এই সময় অনেকগুলো পায়ের আওয়াজ পেলাম। বুঝতে পারছিলাম আমার চেতনা আছে, কিন্তু আমি প্রকাশ করতে পারছি না। আমি শূন্যে ভাসছিলাম না, এবার আমার পায়ের তলায় মাটিটা নড়েনি। একটা গলা কানে এল, ‘কী হয়েছে?’
সুর্মির নার্ভাস গলা শুনতে পেলাম, ‘হঠাৎ শরীর খারাপ হয়ে গেছে।’ এই সময় সুর্মিকে খুব আপন মনে হল, আন্তরিকতার সুর গলায় স্পষ্ট। একটা আঙুল আমার নাকের সামনে এল, ‘না, নিঃশ্বাস পড়ছে। এরকম প্রায়ই হয়?’
সুর্মি বলল, ‘না!’
আর-একটা গলা বলল, ‘অম্বলে এরকম করে। উইন্ড চাপ দিলে সেন্স থাকে না।’
প্রথম গলা বলল, ‘একটু ধরুন তো ভাই, ওকে বাথে শুইয়ে দিই। আপনি মাথায় জল বুলিয়ে হাওয়া করুন, যদি সেন্স না আসে তাহলে বর্ধমানে কিছু করা যাবে।’
সুর্মি বলল, ‘ওখানে তো ডাক্তার নেই।’
‘নামিয়ে দিতে পারি যদি চান। তবে মনে হয় জল দিলে সেন্স আসবে।’
ওরা আমাকে ধরাধরি করে একটা বেঞ্চির উপর শুইয়ে দিল। লোকটা, সম্ভবত টি টি বলল, ‘আপনাদের লাগেজ কোথায়?’
সুর্মির গলা শুনলাম, ‘এই ব্যাগটাই শুধু। জল কোথায় পাব?’
‘ওই তো ওখানে। বাইরে বেসিন থেকে নিয়ে আসুন।’
আর-একজন বলল, ‘এই মগটা নিয়ে যাও ভাই।’ কণ্ঠটি মহিলার।
একটু পরে সুর্মির নরম ভিজে হাত কপালে অনুভব করলাম। আঃ, কী আরাম। সুর্মি খুব যত্ন করে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে জল দিয়ে। ও আমার পেছনে রয়েছে। ট্রেনটা ছুটছে হুহু করে। এক সময় সুর্মি ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘এই অতীন, এখন কেমন লাগছে?’
আমি ঠোঁট খুলেই বন্ধ করলাম। না, উত্তর দেব না। যে দক্ষিণেশ্বরে নেমে যাবে তার সঙ্গে কোনও কথা বলব না। ওপাশের মহিলাটি বললেন, ‘এখন কথা বলো না ভাই, সেন্স আসতে দাও।’ আর-একজন জিজ্ঞাসা করল, ‘মৃগী নেই তো?’
সুর্মি উত্তর দিল, ‘না।’
আমি কপাল, গাল, গলায় সুর্মিকে অনুভব করছিলাম। আমি এখন এই অবস্থায় যদি মরেও যাই তাহলে এক ফোঁটা দুঃখ হবে না। সুর্মি আমাকে এমন করে ভালোবাসুক। এমন সময় ট্রেনটার গতি কমে আসছিল। এতক্ষণ আমি মড়ার মতো পড়েছিলাম। ট্রেনটা যখন থামব-থামব করছিল তখন টি টি-র গলা পাওয়া গেল, ‘কী, কেমন আছে, সেন্স আসেনি? তাহলে এখানে—’
আমি আর দেরি করলাম না। মাথা নেড়ে ‘আঃ-আঃ’ বলে উঠলাম। তাতেও শান্ত না হয়ে বললাম, ‘মা মাগো!’ সঙ্গে-সঙ্গে টি টি বলল, ‘বাঃ, এই তো সেন্স এসে গিয়েছে। এই যে ভাই, কেমন আছ?’
আমি লক্ষ করলাম লোকটা সুর্মিকে আপনি বললেও আমাকে তুমি বলল, আমি খুব ধীরে-ধীরে চোখ খুললাম। আমার চোখের পাতা কাঁপছিল। কোনওক্রমে যেন ঘাড় নাড়লাম, ভালো। টি টি জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছিল? কী খেয়েছিলে?’
‘নিমকি!’ কোনওরকমে বললাম!
ব্যস। সঙ্গে-সঙ্গে সবাই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল, নিমকি খেয়েই আমার অম্বল হয়েছে। যা-তা তেলে ওসব ভাজা হয়, এই আলোচনা চলল। টি টি বলল, ‘এখন যেতে পারবে তো?’ আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।
টি টি বলল, ‘যাক, আর কোনও চিন্তা নেই। ওকে একটু ঘুমুতে দিন।’ যখন আর কেউ ধারেকাছে নেই, সুর্মির একটা হাত আমার কাঁধের ওপর তখন ওর চাপা গলা শুনতে পেলাম, ‘আমি নামব!’
এই মুহূর্তটির জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। চোখ খুললাম। সুর্মি উঠবার জন্যে সোজা হয়ে বসেছে। ওর চোখে চোখ রেখে বললাম, ‘আমাকে ফেলে চলে যাবি?’ সুর্মি আমার চোখের দিকে তাকাল। একটু যেন কেঁপে উঠল। তারপর ধীরে-ধীরে ওর চোখ জলে ভরে গেল। আমি দেখলাম ও চোখ বন্ধ করে একটু-একটু করে দেওয়ালে হেলান দিয়ে মাথাটা বেঁকিয়ে দিল। এক ফোঁটা জল টপ করে গাল বেয়ে নেমে আমার কনুইতে পড়তেই ট্রেনটা দুলে উঠে চলা শুরু করল। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের পাশের গঙ্গার ওপর ট্রেনটা যখন গমগম করতে-করতে উঠে এল তখন সেই জলের ফোঁটাকে আমি অনুভূতিতে পাচ্ছিলাম না। আমি স্থির জানি সেটা কনুই বেয়ে গড়িয়ে পড়েনি।
আমি চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলাম। কাঠের বেঞ্চিতে শুতে বেশিক্ষণ ভালো লাগে না। আমার ব্যাগটাকে মাথার বালিশ হিসাবে ব্যবহার করা যায় কিন্তু সেটা নিজে থেকে টেনে আনি কী করে। এখন উঠে বসলে সুর্মি নিশ্চয়ই সন্দেহ করবে। ভাববে এতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে থাকার ব্যাপারটাই ভাঁওতা। একেই অনেক মিথ্যে কথা অন্যলোকের সঙ্গে বলে ওর মনে অবিশ্বাস এনে দিয়েছি। এখন এমনিভাবে কিছুক্ষণ পড়ে থাকা যাক।
ট্রেনের দুলুনিতে চোখ বন্ধ করা থাকলে ঘুম এসে যায়। আমি সত্যি বিশ্বাস করতে পারছি না যে আমি শুয়ে আছি আর আমার মাথার পাশে বসে সুর্মি কাঁদছে। যদিও ওর এখনকার কান্নার কোনও শব্দ নেই কিন্তু আমি সেটা টের পাচ্ছি। আচ্ছা, ও দক্ষিনেশ্বরে নেমে গেল না কেন? আমি তো উঠিনি, বাধাও দিতাম না। লোকজন, যারা আমার দিকে তাকিয়েছিল উদ্বেগ নিয়ে তারা তো জ্ঞান হয়েছে জেনে নিজের-নিজের কথায় ফিরে গিয়েছিল। সেইসময় টুক করে উঠে পায়ে-পায়ে দরজার কাছে গিয়ে নেমে পড়লেই হতো। স্টেশন থেকে নেমে একটা ট্যাক্সি ধরে সোজা বাড়ি ফিরে গিয়ে এসব কথা বলে মায়ের কাছ থেকে টাকা দিয়ে ভাড়া মেটাতে পারত। আমি কোনও কারণ বুঝতে পারছি না। আমি সত্যি কাতর গলায় বলেছিলাম, ‘আমাকে ফেলে চলে যাবি,’ কিন্তু সেটা শুনে ও যেন পোড়া কলাগাছ হয়ে গেল। তবে কি সুর্মিও আমাকে ভালোবাসে! আমার খুব জিগ্যেস করতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু এখন উঠে কথা বললে—।
সুনীল প্রধানের সঙ্গে ভাগ্যিস বন্ধুত্ব ছিল নইলে আজ আমি ট্রেনেও উঠতাম না আর সুর্মিও আমার মাথার পাশে বসত না। সুনীল আমার সঙ্গে একবছর পড়েছিল। কার্শিয়াং-এর ছেলে, খুব হাসিখুশি, নেপালিরা শুধু বেঁটেই হয় না তা ওকে দেখে জেনেছিলাম। সুনীলের বাবার বেশ টাকাপয়সা আছে, নইলে ও ওইরকম পোশাক আর ঠাটে হোস্টেলে থাকতে পারত না। সুনীলের সঙ্গে প্রথম বন্ধুত্ব হয়ছিল দিলীপের। দিলীপ আর আমি ছেলেবেলার বন্ধু। আমি পাগল হয়ে যাওয়ার পর, ওই শুধু আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে আসার পর আমি যখন আর কলকাতায় থাকতে চাইছিলাম না, একটা চাকরি নিয়ে কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা আঁটছিলাম তখন দিলীপই আমাকে সুনীলের কথা মনে করিয়ে দিল। কার্শিয়াং-এ সুনীলদের যা প্রতিপত্তি, ওখানে গেলে আমার চাকরির অভাব হবে না। সুনীলের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল দিলীপ। বেশ ভাব হয়েছিল আমাদের। এবছর ওর বাবা ওকে কলকাতা থেকে সরিয়ে দার্জিলিং-এ নিয়ে গেছে। ওখানকার কলেজে পড়ে ওর বাবার ব্যবসায় সাহায্য করবে। সুনীলকে চিঠি দিয়েছি আমি সব কথা জানিয়ে। সব কথা মানে, আমি যাচ্ছি, একটা চাকরি চাই। সুর্মির জন্য কলকাতা ছেড়ে যাচ্ছিলাম, সেকথা লিখিনি। আমার কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়ার খবর মাত্র দুজন জানে। দিলীপ আর সুনীল। দিলীপ কাউকে বলবে না বলে কথা দিয়েছে। এমনকী আজ সকালেও স্টেশনে এসে টিকিট কিনে দিয়ে গেছে আমার জন্যে। আর সুনীলের খোঁজ কলকাতার কেউ পাবে না। এখন সুর্মি সঙ্গে থাকায় খুব হইচই হবে নিশ্চয়ই। সুর্মির বাবা পুলিশে খবর দেবেন কি? হয়তো দেবেন। কিন্তু পুলিশ খুঁজে পাবে কী করে? সুর্মি যে আমার সঙ্গে দার্জিলিং যাচ্ছে কেউ ভাবতে পারে না।
সুনীল যদি চেষ্টা করে তা হলে দিন সাতেক হোটেলে থেকে যে কোনও একটা চাকরিতে ঢুকে পড়তে পারব। আমার পকেটে এখন বারোশো টাকা আছে। এতটাকা আমি কখনও দেখিনি। বারোশো টাকায় দুজন মানুষের কতদিন যাবে? নিশ্চয়ই তার মধ্যে আমার রোজগার শুরু হয়ে যাবে। আজই সোওয়া এক ভরি হার বিক্রি করে আমি তেরোশো টাকা পেয়েছি। উফ, বিক্রি করতে গিয়ে কী ঝামেলায় না পড়া গিয়েছিল। সোনার দোকানের লোকটা কিছুতেই বিশ্বাস করবে না ওটা চুরি করা নয়। আমরা বেশ নার্ভাস ছিলাম, তাই লোকটা আমাদের ঠকিয়ে দিল। তা তেরোশো টাকা কম কীসে। দিলীপকে একশো টাকা দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু দিলীপ নেয়নি। বলেছিল, ‘তোর এখন খুব দরকার হবে টাকার, তুই রাখ।’ দিলীপের কথাই ফলে গেল। সুর্মি সঙ্গে থাকলে টাকার তো দরকার হবেই। বাড়িতে অবশ্য এখনই খুব হইচই হবে না। আমি পাগল হয়ে যাওয়ার পর দাদারা খুব লজ্জিত এবং বিরক্ত হয়েছিল আমার জন্যে। হাসপাতাল থেকে ফিরে আমি গম্ভীর হয়ে থাকলেও সেটা বুঝতে পারতাম। অতএব আমার চলে আসাতে ওদের কিছু ক্ষতি হবে না! মা তো জন্মাবধি দেখছি সব ব্যাপারেই নির্লিপ্ত, তবে সেটা থাকবে কোনও বিয়ের নেমন্তন্ন না আসা অবধি। ততদিন মা নিশ্চয়ই তার হারের খোঁজ করবে না।
ট্রেনটা এখন হুহু করে ছুটছে। আমার বেশ ঘুম-ঘুম পাচ্ছে। একবার ঘুমিয়ে পড়লে সারারাত আমার হুঁশ থাকে না। সুর্মিকে একা বসিয়ে রেখে সেটা উচিত হবে না। তাছাড়া আজ দুপুরের পর খাওয়া হয়নি। নিমকির কথাটা মিথ্যে হলেও এখন সত্যি-সত্যি খিদে পাচ্ছে। সুর্মি কী খেয়েছে জানি না, তবে আজ রাত্রে খাবে না নিশ্চয়ই। জোর করে ঘুম তাড়াবার জন্যে উঠে বসব ভাবছি ঠিক সেই সময় সুর্মি ডাকল, ‘অতীন, এই অতীন!’
আমি খুব ধীরে-ধীরে চোখ খুললাম। সুর্মি একটু ঝুঁকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার চোখ স্পষ্ট হতেই বলল, ‘এখন কেমন লাগছে? কষ্ট হচ্ছে?’ আঃ, এর চেয়ে আনন্দ আমার আর কী হতে পারে। বুক জুড়িয়ে গেল। আমি সামান্য মাথা নেড়ে উঠে বসতে গেলাম। সঙ্গে-সঙ্গে সুর্মি বাধা দিল, ‘না না ওঠার দরকার নেই। তুই শুয়ে থাক।’
আমি সোজা হয়ে বসে বললাম, ‘না, আমি ঠিক হয়ে গেছি। তুই চোখ মোছ সুর্মি, এখনও জলের দাগ লেগে আছে।’