উনিশশো একাত্তর
মা, তোমার কিশোরী কন্যাটি আজ নিরুদ্দেশ
মা, আমারও পিঠোপিঠি ছোট ভাইটি নেই
নভেম্বরে দারুণ দুর্দিনে তাকে শেষ দেখি
ঘোর অন্ধকারে একা ছুটে গেল রাইফেল উদ্যত।
এখন জয়ের দিন, এখন বন্যার মতো জয়ের উল্লাস
জননীর চোখ শুকনো, হারানো কন্যার জন্য বৃষ্টি নামে
হাতখানি সামনে রাখা, যেন হাত দৰ্পণ হয়েছে
আমারও সময় নেই, মাঠে কনিষ্ঠের লাশ খুঁজে ফিরি।
যে যায় সে চলে যায়, যারা আছে তারাই জেনেছে
একা একা হাহাকার; আজিজুর, আজিজুর, শোন—
আমার হলুদ শার্ট তোকে দেবো কথা দেওয়া ছিল
বেহেস্তে যাবার আগে নিলি না আমার দেহ ত্ৰাণ?
লিকলিকে লম্বা ছেলে যেন একটা চাবুক, চোয়ালে
কৈশোরের কাটা দাগ, মা’র চোখে আজও পোলাপান
চিরকাল জেদী! বাজি ফেলে নদীর গহ্বর থেকে মাটি তুলে আনতো
মশাল জ্বলিয়ে আমি ভাগাড়ের হাড়মুণ্ডে চিনবো কি তাকে?
মা, তোমার লাবণ্যকে শেষ দেখি জুলাইয়ের তেসরা
শয়তানের তাড়া খেয়ে ঝাঁপ দিল ভরাবষ নদীর পানিতে
জাল ফেলে তবুওকে টেনে তুললো, ছটফটাচ্ছে যেন
এক জলকন্যা
স্টিমারঘাটায় আমি তখন খুঁটির সঙ্গে পিছমোড়া বাঁধা।
ক’টা জন্তু নিয়ে গেল টেনে হিঁচড়ে, হঠাৎ লাবণ্য মুখ ফিরিয়ে
তাকালো সবার চোখে, দৃষ্টি নয়, দারুণ অশনি
ঐটুকু মেয়ে, তবু এক মুহুর্তেই তার রূপান্তর ত্রিকাল-মায়ায়
কুমারীর পবিত্ৰতা নদীকেও অভিশাপ দিয়ে গেল।
মা, তোমার লাবণ্যকে খুঁজেছি প্রান্তরময়, বাঙ্কারে ফক্সহোলে
ছেঁড়া ব্ৰা রক্তাক্ত শাড়ি–লুষ্ঠিত সীতার মতো চিহ্ন পড়ে আছে
দূরে কাছে কয়েক লক্ষ আজিজুর অন্ধকার ফুঁড়ে আছে
ধপধাপে হাড়ে
কোথাও একটি হাত মাটি খিমচে ধরতে চেয়েছিল।
যে যায় সে চলে যায়, যারা আছে তারাই জেনেছে
বাঁ হাতের উল্টেপিঠে কান্না মুছে হাসি আনতে হয়
কবরে লুকিয়ে ঢোকে ফুল চোর, মধ্য রাত্রে ভেঙে যায় ঘুম
শিশুরা খেলার মধ্যে হাততালি দিয়ে ওঠে, পাখিরাও
এবার ফিরেছে।