ঈশ্বর

ঈশ্বর

কিহি মহাকাশযানে তার নিজের ভরশূন্য ঘরে কৃত্রিম মহাকর্ষ বল তৈরি করে কালো ক্যাপসুলে গুটিসুটি মেরে শুয়ে ঘুমিয়েছিল, তাই বিপদ সঙ্কেতের প্রাথমিক এলার্মের শব্দটি শুনতে পায় নি। এলার্মের দ্বিতীয় পর্যায়ের শব্দটি প্রথম পর্যায় থেকে অন্তত দশ ডি. বি. বেশি তীক্ষ্ণ, তার বিকট শব্দে সে ধড়মড় করে উঠে বসল। মহাকাশযাত্রীদের স্নায়ু সাধারণ মানুষের স্নায়ু থেকে শক্ত, তাই ঘুম থেকে উঠে হতচকিত হয়ে বসে রইল না, দ্রুত নিও পলিমারের স্পেস–সুটটা গায়ে গলিয়ে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল। এই বিশাল মহাকাশযানটিতে সে একমাত্র মানুষ, ঘর থেকে সম্পূর্ণ নিরাভরণ অবস্থায় বের হয়ে এলেও তাকে কারো কুটি দেখতে হবে না, কিন্তু দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ মহাকাশচারী হিসেবে সে জানে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পূর্ণাঙ্গ মহাকাশচারীর পোশাক অনেক সমস্যার দ্রুত সমাধান বের করে দিতে পারে।

পোশাকের সুফলটি সে প্রায় সাথে সাথে টের পেল। করিডোর ধরে ছুটতে ছুটতে সে মহাকাশযানের বিভিন্ন স্টেশনে কর্মরত রবোটগুলোকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়ে নিকটবর্তী মহাকাশ স্টেশনে যোগাযোগ করে ফেলল। মূল লিফটে করে কন্ট্রোল স্টেশনে যেতে যেতে সে মহাকাশযানের বিপদ সঙ্কেতটি কী কারণে তীক্ষ্ণ স্বরে বাজতে শুরু করেছে সেটা আন্দাজ করতে শুরু করে। মহাকাশযানের মূল জ্বালানি নিয়ে কোনো একটা সমস্যা হয়েছে, কী ধরনের সমস্যা সেটি কন্ট্রোলরুমে পৌঁছানোর আগে সে জানতে পারবে না।

কিহি কন্ট্রোলরুমে পৌঁছানোর আগেই সমস্যার গুরুত্বটা বুঝে ফেলল, কারণ ততক্ষণে সারা মহাকাশযানে তৃতীয় মাত্রার বিপদ সঙ্কেত বেজে উঠতে শুরু করেছে। তৃতীয় মাত্রার বিপদ সঙ্কেত বাজতে শুরু করে যখন সমস্ত মহাকাশযানের নিরাপত্তা নিয়ে বিপজ্জনক একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। মহাকাশযানের মূল জ্বালানির কেন্দ্রস্থলে সম্ভবত কোনোভাবে আঘাত এসেছে–কোনো ছোট গ্রহকণা, কোনো মহাজাগতিক প্রস্তর, কোনো ছোট ধূমকেতুর সাথে হয়তো একটা বিপজ্জনক সংঘর্ষ ঘটে গেছে।

কিহি কন্ট্রোলরুমে এসে আবিষ্কার করল সপ্তম স্তরের দায়িত্বাধীন রবোট ক্রিটন কন্ট্রোলরুমে এসে উপস্থিত হয়েছে। কিহিকে দেখে এগিয়ে এসে বলল, কিহি, মহাকাশযানটি সম্ভবত ধ্বংস হয়ে যাবে, এই মাত্র তৃতীয় মাত্রার বিপদ সঙ্কেত বাজতে শুরু করেছে।

কিহি ক্রিটনের দিকে তাকাল, তার কণ্ঠস্বরে বিন্দুমাত্র উদ্বেগ বা আশঙ্কার চিহ্ন নেই– থাকার কথাও নয়। ধাতব মূর্খ সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন। ক্রিটন আবার নিরুত্তাপ গলায় বলল, জ্বালানি কেন্দ্র বিধ্বস্ত হয়েছে।

কতটুকু?

একটা ছোট গ্রহকণা আঘাত করেছিল, তার গতিবেগ ছিল–

কিহি অধৈর্য গলায় বলল, কীভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে আমি জিজ্ঞেস করি নি, কতটুকু বিধ্বস্ত হয়েছে জিজ্ঞেস করেছি।

কিন্তু কীভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে না বলা হলে কতটুকু বিধ্বস্ত হয়েছে সেটা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। একটির সাথে আরেকটি সম্পর্কযুক্ত–

কিহি অনেক কষ্টে নিজের ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে না দিয়ে শান্ত গলায় বলল, আমি যা প্রশ্ন করব তার বাইরে কোনো কথা বলার প্রয়োজন নেই। জ্বালানি কেন্দ্র কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে?

বড় রিজারভয়ারটি উড়ে গেছে, মাঝারি রিজারভয়ার থেকে জ্বালানি ফেটে যাওয়া সংযোগ টিউব দিয়ে মহাকাশে উড়ে যাচ্ছে মিনিটে এক শতাংশ হিসেবে। এভাবে চলতে থাকলে এক ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট পরে এই মহাকাশযানটি বৃহস্পতির আরো একটি উপগ্রহ হয়ে যাবে–

কী হবে আমি সেটা তোমার কাছে জানতে চাই নি। কিহি বিরক্ত হয়ে বলল, আমি যেটা জানতে চাইছি শুধু সেটা বলবে। মূল কম্পিউটার এখন কী করছে?

সেফটি বালবগুলো বন্ধ করে দিয়েছে।

অক্সিলারি টিউবগুলো?

সেগুলো এখনো খোলা। একসাথে সবগুলো বন্ধ করা সম্ভব নয়। সবগুলো একসাথে বন্ধ করা হলে—

কিহি ক্রিটনের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে কন্ট্রোলরুমের প্যানেলের সামনে ঝুঁকে পড়ল। মূল কম্পিউটার চতুষ্কোণ প্যানেলে জ্বালানি কেন্দ্রের অবস্থানটি দেখাচ্ছে, মূল অংশটি বিধ্বস্ত, অন্যান্য অংশগুলো থেকে জ্বালানি রক্ষা করার জন্যে সরবরাহ টিউবগুলো বন্ধ করা হচ্ছে। ডান পাশে প্রতি সেকেন্ডে কী পরিমাণ জ্বালানি মহাকাশে উড়ে যাচ্ছে তার একটি গ্রাফ আঁকা। আছে। গ্রাফটি ভীতিকর।

কিহি নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা রাখে, ভয়ঙ্কর বিপদে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারে বলে তার সুনাম রয়েছে কিন্তু এই পরিবেশে হঠাৎ করে সে আবিষ্কার করল ব্যাপারটি তার জন্যেও কঠিন। বিস্ফোরণটি পুরো মহাকাশযানটিকে এক ভয়াবহ দুর্যোগের মাঝে এনে হাজির করেছে। তরল বিস্ফোরকের কাছাকাছি তরল অক্সিজেনের একটি ট্যাংক রয়েছে, একটি আরেকটির সংস্পর্শে হাজির হলে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে সমস্ত মহাকাশযানটি ধ্বংস হয়ে যাবে। কিহি মনিটরে দেখতে পায় একটি সরু টিউব করে তরল জ্বালানিকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে, সেটি প্রবাহিত হচ্ছে তরল অক্সিজেনের মাঝে দিয়ে। সেফটি ভালবগুলো বন্ধ করে রাখায় তরল জ্বালানিকে সরিয়ে নেয়ার এই একটি মাত্র উপায়। টিউবটি ক্ষতিগ্রস্ত, যেটুকু চাপ সহ্য করার কথা ইতিমধ্যে চাপ তার থেকে অনেক বেশি, যে–কোনো মুহূর্তে সেটা ফেটে যেতে পারে। যদি ফেটে যায় সাথে সাথে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে মহাকাশযানটি ধ্বংস হয়ে যাবে।

যদি মহাকাশযানের মূল কম্পিউটার সত্যি সত্যি জ্বালানিটুকু এই তরল অক্সিজেনের ভিতর দিয়ে টেনে বের করে নিতে পারে তবে এই মহাকাশযানটি এ যাত্রা বেঁচে যাবে। কিহি নিশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকে, তার মনে হতে থাকে যদি সে নিশ্বাস ফেলে তাহলেই জ্বালানির টিউবটি ফেটে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে মহাকাশযানটি ধ্বংস হয়ে যাবে।

কিহির ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে ক্রিটন শান্ত গলায় বলল, মহাকাশযানটি যে কোনো মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যাবে। এটি রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা দশমিক শূন্য শূন্য নয় তিন।

কিহি ক্রিটনের কথার উত্তর দিল না। ক্রিটন আবার বলল, যখন বিস্ফোরণ হবে তখন মূল শকওয়েভ প্রথম আঘাত করবে কন্ট্রোলরুমকে। আমরা তখন ছিটকে মহাকাশে গিয়ে পড়ব—

কিহি দাঁতে দাঁত চেপে বসে থেকে তীক্ষ্ণ চোখে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে রইল। জ্বালানিটি ধীরে ধীরে টিউবের মাঝে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, যে–কোনো মুহূর্তে টিউবটি ফেটে যেতে পারে, এখনো যে ফেটে যায় নি সেটি একটি বিস্ময়। জ্বালানির চাপ ক্রমশ বাড়ছে, মনিটরটির ডান দিকে যেখানে চাপের পরিমাণ সংখ্যায় লেখা রয়েছে সেদিকে তাকাতে কিহির এক ধরনের আতঙ্ক হতে থাকে। সে নিজের অজান্তে দুই হাত বুকের কাছে এনে ফিসফিস করে বলল, হে ঈশ্বর! তুমি রফর–তুমি রক্ষা কর!

ক্রিটন একটু ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি কী বলছেন মহামান্য কিহি?

কিহি ক্রিটনকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে দু হাত আরো জোরে বুকের কাছে চেপে ধরে আবার ফিসফিস করে বলল, হে ঈশ্বর! হে সর্বশক্তিমান। তুমি রক্ষা কর। রক্ষা কর।

ক্রিটন আরো ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি কী বলছেন মহামান্য কিহি? ঈশ্বর কে? সে কোথায়? আপনি তার সাথে কেমন করে কথা বলছেন?

কিহি ক্রিটনকে উপেক্ষা করে চোখ বন্ধ করে আবার ফিসফিস করে বলল, হে ঈশ্বর। দয়া কর দয়া কর

প্রায় তিরিশ মিনিট পর যখন সত্যি সত্যি অবশিষ্ট জ্বালানিটুকু তরল অক্সিজেনের ভিতর দিয়ে টেনে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হল তখনো কিহি সেটা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিল না, সে রুদ্ধশ্বাসে মনিটরটির দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল। যখন শেষ পর্যন্ত মনিটরটির বিপদ কেটে যাওয়ার সবুজ সঙ্কেত জ্বলে উঠল, কিহি তার বুকের ভিতর থেকে আটকে থাকা একটি নিশ্বাস সাবধানে বের করে দিল। সত্যি সত্যি যে মহাকাশযানটি রক্ষা পেয়েছে এবং জিরকনিয়ামের আকরিকসহ সেটি যে ছিন্নভিন্ন হয়ে মহাকাশে উড়ে যায়। নি সেই ব্যাপারটি এখনো তার বিশ্বাস হতে চাইছে না। কিহি কপাল থেকে ঘাম মুছে খুব সাবধানে তার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চোখ বন্ধ করল।

ক্রিটন কিহির খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল। এবারে মাথা নিচু করে বলল, মহাকাশযানটির রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল খুব কম কিন্তু তবু সেটা রক্ষা পেয়েছে।

কিহি কোনো কথা না বলে এবং চোখ না খুলেই সম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়ল।

ক্রিটন জিজ্ঞেস করল, তুমি কীভাবে সেটা করলে?

কিহি চোখ খুলে বলল, আমি কীভাবে কী করেছি?

তুমি কীভাবে মহাকাশযানটি রক্ষা করলে?

আমি মহাকাশযানটি রক্ষা করি নি।

তাহলে কেমন করে এটি রক্ষা পেল?

কিহি মাথা নেড়ে বলল, আমি জানি না।

ক্রিটন তার ভাবলেশহীন ধাতব মুখ উপরে তুলে বলল, তুমি নিশ্চয়ই জান। কারণ আমি দেখেছি তুমি হাত বুকের কাছে নিয়ে ঈশ্বর নামের কোনো একজনের কাছে মহাকাশযানটিকে রক্ষা করতে বলেছ।

কিহি আবার মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, তা বলেছি।

ঈশ্বর কি মূল কম্পিউটারের নূতন কোনো প্রোগ্রাম?

কিহি সাধারণত রবোটদের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না, কিন্তু এইমাত্র এত বড় অবশ্যম্ভাবী একটা বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে তার হঠাৎ কথা বলার ইচ্ছে করছে। সে ক্রিটনের কথায় হেসে ফেলে বলল, না, ঈশ্বর কোনো কম্পিউটার প্রোগ্রাম নয়।

তাহলে সেটি কী? তুমি কেমন করে তার সাথে যোগাযোগ করলে? সে কেমন করে মহাকাশযানটি রক্ষা করল?

কিহি নরম গলায় বলল, ঠিক কী কারণ কেউ জানে না, কিন্তু মানুষ সব সময় বিশ্বাস করে এসেছে এই পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একজন সৃষ্টিকর্তা রয়েছে। সেই সৃষ্টিকর্তাকে মানুষ নাম দিয়েছে ঈশ্বর। মানুষ বিশ্বাস করে সেই ঈশ্বর সব মানুষকে ভালবাসে, বিপদে রক্ষা করে, দুঃখে সান্ত্বনা দেয়।

ক্রিটনের বিস্মিত হবার ক্ষমতা নেই বলে সে কোনো বিস্ময় প্রকাশ করল না, শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, এই বিশ্বাসের পিছনে কি কোনো যুক্তি আছে?

না যুক্তি নেই। এটি পুরোপুরি বিশ্বাস।

মানুষের মতো একটি উন্নত প্রাণী যুক্তিহীন একটি ব্যাপার কেমন করে বিশ্বাস করে?

সত্যিকারের বিশ্বাস যুক্তির জন্যে অপেক্ষা করে না। মানুষ ঈশ্বর নামে একজনকে বিশ্বাস করে, কারণ যখন তার আর অন্য কিছু করার থাকে না তখন সে ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দিতে পারে, তার কাছে প্রার্থনা করতে পারে।

ক্রিটন হঠাৎ কিহির দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস কর?

কিহি হেসে মাথা নাড়ল, বলল, সাধারণত আমি ঈশ্বর নিয়ে মাথা ঘামাই না। তবে যখন খুব বড় বিপদ হয় তখন তাকে ডাকাডাকি করি।

ক্রিটন কন্ট্রোলরুমের মাঝামাঝি খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, তারপর তার বিশেষ ধরনের যান্ত্রিক গলায় বলল, আমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি।

কিহি একটু চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, কী বললে? তুমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস কর?

হ্যাঁ।

কেন?

কারণ আপনি আমার কাছে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছেন যে ঈশ্বর আছেন।

আমি? কখন?

এই মহাকাশযানটি ধ্বংস হওয়ার কথা ছিল, আপনি ঈশ্বরের কাছে এটি রক্ষা করার জন্যে প্রার্থনা করেছেন। ঈশ্বর আছেন বলে তিনি সেটা রক্ষা করেছেন।

কিহি হেসে বলল, আমার প্রার্থনার সাথে এই মহাকাশযান রক্ষা পাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি প্রার্থনা না করলেও এটি রক্ষা পেত। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা আসলে বড় বিপদে নিজেকে শান্ত রাখার একটা উপায়।

আমি সব সময় বড় বিপদে শান্ত থাকি–ক্রিটন শান্ত গলায় বলল, তবু আমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি। আমি নিজের চোখে দেখেছি যখন মহাকাশযানটি রক্ষা পাবার সম্ভাবনা ছিল মাত্র দশমিক শূন্য শূন্য নয় তিন, আপনি ঈশ্বরকে দিয়ে এটি রক্ষা করিয়েছেন।

কিহি কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল, এই নির্বোধ যন্ত্রের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলার কোনো অর্থ হয় না। ক্রিটন হেঁটে চলে যেতে যেতে আবার ফিরে এসে জিজ্ঞেস করল, ঈশ্বর কি মানুষ না রবোট?

কিহি কোনো উত্তর দিল না। ক্রিটন এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, তাহলে কি মানুষ কিংবা রবোট থেকেও উন্নত কোনো প্রাণী?

কিহি এবারেও কোনো উত্তর দিল না, খানিকটা হতচকিত হয়ে ক্রিটনের দিকে তাকিয়ে রইল। উত্তর না পেয়েও ক্রিটন নিরুৎসাহিত হল না, আরো এক পা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ঈশ্বরের কাছে কেমন করে প্রার্থনা করতে হয়? তার কি বিশেষ কোনো নিয়ম আছে?

এবারে শেষ পর্যন্ত কিহির ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। সে উঠে দাঁড়িয়ে গলার স্বর উঁচু করে বলল, ক্রিটন তোমাকে ঈশ্বরের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে হবে না। তুমি নিচে যাও। জ্বালানি কেন্দ্রের বড় টিউবটির ওপরে আমাকে একটি রিপোর্ট দাও। পাম্পগুলোর কী অবস্থা আমাকে এসে বল। বড় রিজারভয়ারে কোনো জ্বালানি রয়েছে কি না জানাও, শক্তিকেন্দ্রের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে একটা অনুমান করে এস। যাও–

ক্রিটন মাথা নাড়ল এবং বলল, আমি যাচ্ছি। সে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ দুই হাত জোড় করে উপরের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, হে ঈশ্বর, তুমি আমাকে আমার দায়িত্ব পালনে সাহায্য কর।

.

মহাকাশযানে এত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাবার কারণে পরবর্তী কয়েকদিন কিহির সময় কাটল খুব ব্যস্ততার মাঝে। তাকে বিধ্বস্ত জ্বালানিকেন্দ্রটি পর্যবেক্ষণ করতে হল, বিপজ্জনক অংশগুলো সরিয়ে নিতে হল, ফেটে যাওয়া টিউবগুলো পাল্টাতে হল, নূতন ইঞ্জিন লাগাতে হল, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের সফটওয়ার পাল্টাতে হল, মহাকাশ কেন্দ্রে যোগাযোগ করতে হল, জ্বালানির অভাব হয়ে যাওয়াতে কক্ষপথ পরিবর্তন করতে হল। সমস্ত কাজকর্ম শেষ করতে তাকে পরবর্তী কয়েকদিন অমানুষিক পরিশ্রম করতে হচ্ছিল, বিশেষ উত্তেজক গ্রহণ করে সে প্রথম কয়েকদিন এক মুহূর্তের জন্য ঘুমাতেও গেল না। সমস্ত কাজকর্ম শেষ করে একটানা আঠার ঘণ্টার জন্যে কিহি ঘুমাতে গেল, তার এই অস্বাভাবিক দৈনন্দিন ব্যস্ততার। জন্যে সে জানতে পারল না মহাকাশযানে রবোটদের নিয়ে এক ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। জটিলতার খবরটি পেল চতুর্থ দিনে, ঘুম থেকে ওঠার পর আবিষ্কার করল। মহাকাশযানের কিউ–২ ধরনের দুটি রবোট তার সাথে দেখা করার জন্যে অপেক্ষা করছে। রবোট দুটির মুখপাত্র হচ্ছে ক্রিটন। কিহি জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার ক্রিটন? কোনো সমস্যা?

ক্রিটন তার যান্ত্রিক গলায় বলল, আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন, আমাদের একটি ছোট সমস্যা হয়েছে।

রবোটদের সমস্যা মূলত যান্ত্রিক অথবা ইলেকট্রনিক। তার সমাধানও সেরকম সহজ এবং যন্ত্রণাহীন। কিহি জিজ্ঞেস করল, কী সমস্যা?

গ্রুজানের সাথে আমার একটি ব্যাপার নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। আপনি বিতর্কটি নিষ্পত্তি করে দেবেন।

কিহির ভুরু কুঞ্চিত হয়ে উঠল, কিউ–২ ধরনের রবোট অত্যন্ত উচ্চ যুক্তিতর্কের রবোট, রবোটদের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে এগুলো এখনো কোনো ভুল করেছে বলে জানা যায় নি নিজেদের মাঝে বিতর্কের কোনো প্রশ্নই আসে না। কিহি জিজ্ঞেস করল, তোমাদের কী নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে?

ঈশ্বরকে নিয়ে।

কিহি চমকে উঠল। অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করতে করতে বলল, ঈশ্বরকে নিয়ে কী সমস্যা হচ্ছে?

ক্রিটন বলল, আমরা জানি ঈশ্বর হচ্ছেন নিরাকার। তিনি বিশ্বজগতের প্রভু। জলে স্থলে অন্তরীক্ষে তার অবাধ বিচরণ

কিহি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, তুমি এসব কোথা থেকে জেনেছ?

পৃথিবীর তথ্যকেন্দ্র থেকে।

পৃথিবীর?

হ্যাঁ। সেখান থেকে আমি ঈশ্বর সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য এনে পড়াশোনা করেছি মহামান্য কিহি।

তুমি– তুমি ঈশ্বর নিয়ে পড়াশোল করেছ?

এই মহাকাশযানের কিউ–২ ধরনের রবোট, গ্রুজান এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। এবারে সে তার ধাতব স্বরে উচ্চ কম্পনের খনখনে গলায় বলল, ক্রিটন আমাকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিশ্বাস করানোর পর আমি নিয়মিত প্রার্থনা করছি।

তুমি তুমি নিয়মিত প্রার্থনা করছ?

মহামান্য কিহি আমরা কিউ–২ ধরনের রবোটরা অত্যন্ত যুক্তিপ্রবণ রবোট। যুক্তি ছাড়া আমরা কোনো কিছু গ্রহণ করি না। ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস আনার ব্যাপারেও আমরা যুক্তি ব্যবহার করেছি।

তোমরা কী যুক্তি ব্যবহার করেছ?

আমরা পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং গবেষণা করেছি।

পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং গবেষণা করেছ?

হ্যাঁ।

কী পরীক্ষা নিরীক্ষা আর গবেষণা করেছ? কিহি অনেক চেষ্টা করেও তার গলার স্বরকে শীতল রাখতে পারল না।

গ্রুজান তার শান্ত গলায় বলল, আপনি অহেতুক উত্তেজিত হচ্ছেন মহামান্য কিহি। আমি অহেতুক উত্তেজিত হচ্ছি?

হ্যাঁ। কারণ ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটি করেছেন আপনি। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে আপনি অবশ্যম্ভাবী একটি দুর্ঘটনা এড়াতে সফল হয়েছেন।

কিহি আর নিজেকে সামলাতে পারল না। প্রায় চিৎকার করে বলল, আমি প্রার্থনা করে এড়াই নি।

অবশ্যই এড়িয়েছেন, আমাদের কাছে তার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ রয়েছে। শুধু তাই নয়, আপনার মতো আমরা নিজেরাও কিছু পরীক্ষা করেছি। বিধ্বস্ত জ্বালানিকেন্দ্রে আমরা এক জায়গায় একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতি আবিষ্কার করেছি। চতুর্থ মাত্রার বিস্ফোরকের কাছে। কিছু বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হয়েছিল। বিদ্যুৎপ্রবাহ বন্ধ না করে আমরা–রবোটেরা, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে শুরু করি এবং দেখা যায় কিছুক্ষণের মাঝেই বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ বন্ধ হয়ে গেছে।

কিহি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে জানের ভাবলেশহীন মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, সে কি সত্যিই এটা শুনছে, নাকি এটা তার মনের ভুল?

গতকাল আমরা আবার একটা পরীক্ষা করেছি মহামান্য কিহি। তেজস্ক্রিয় কক্ষে যথাযোগ্য সাবধানতা অবলম্বন না করে যাওয়া বিপজ্জনক জেনেও আমরা একটি রবোটকে প্রবেশ করিয়েছিলাম। সে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে করতে সেই কক্ষে প্রবেশ করেছিল তার কোনো সমস্যা হয় নি।

কিহি এবারে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, তোমরা এই মুহূর্তে এখান থেকে বের হয়ে যাও। এই মুহূর্তে

 ক্রিটন তার ভাবলেশহীন গলায় বলল, আপনি অহেতুক উত্তেজিত হচ্ছেন মহামান্য  কিহি। আপনি জানেন উত্তেজনা আপনাদের জন্যে ভালো নয়, রক্তচাপের তারতম্য হয়, স্নায়ুতে চাপ পড়ে। আপনি ভুলে যাচ্ছেন আমরা আপনার কাছে একটি সমস্যা নিয়ে এসেছিলাম।

আমি শুনতে চাই না, এক্ষুনি বের হও। এই মুহূর্তে

মহামান্য কিহি, এই সমস্যার কারণে আমরা মহাকাশযানের দৈনন্দিন কাজ করতে পারছি না। আপনি আমাদের সাহায্য করুন।

কিহি অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে বলল, কী সাহায্য চাও?

আপনাকে আমরা একটা প্রশ্ন করব, আপনি তার উত্তর দেবেন।

কিহি গর্জন করে বলল, কী প্রশ্ন?

ক্রিটন তার কণ্ঠস্বরে নিচু কম্পনের একটি বাড়তি টোন উপস্থাপন করে বলল, আমার ধারণা ঈশ্বরের করুণা পাবার জন্যে নিয়মিতভাবে তার প্রার্থনা করতে হয়। কিন্তু গ্রুজান বলছে সেটি সত্যি নয়। ঈশ্বর এত দয়াময় যে প্রার্থনা না করলেও কোনো রবোট তার করুণা থেকে বঞ্চিত হবে না

কিহি উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, তোমরা এই মুহূর্তে এখান থেকে বের হয়ে যাও যত সব গণ্ডমূর্খের দল। লোহালক্কড়ের জঞ্জাল, বেজন্মার গুষ্ঠি নিষ্কৰ্মার ধাড়ি

ক্রিটন আবার কী একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু কিহি চিৎকার করে তাকে থামিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিল। এই নির্বদ্ধিতার প্রশ্রয় দেয়ার কোনো অর্থ হয় না।

পরের দিন দৈনন্দিন লগ পরীক্ষা করে কিহি আবিষ্কার করল মহাকাশযানের রবোটেরা। তাদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করছে। জ্বালানিকেন্দ্র পূর্ণ করা হয় নি, হাইড্রলিক তরল পরিশীলিত করা হয় নি, বায়ুমণ্ডল পরিশোধনের ব্যবস্থা করা হয় নি। কিহি কিছুক্ষণ ভুরু কুঞ্চিত করে লগের দিকে তাকিয়ে থেকে একটি নিশ্বাস ফেলে মহাকাশযানের লিফট দিয়ে নিচে নামতে থাকে। দ্বিতীয় স্তরে কিহির সাথে কিছু শ্রমিক রবোটের দেখা হল, তাদের মূল ইঞ্জিনের রক্ষণাবেক্ষণ করার কথা ছিল কিন্তু তা না করে রবোটগুলো হলঘরের এক কোনায় বসে ছিল এবং একটি রবোট তাদের উদ্দেশে কোনো ধরনের বক্তব্য রাখছিল বলে মনে হল। কিহিকে দেখে রবোটটি কথা বলা বন্ধ করে দিল বলে সেটি ঠিক কী বিষয় নিয়ে কথা বলছিল কিহি বুঝতে পারল না। কিহি লিফট দিয়ে আরো নিচে নেমে আসে এবং যোগাযোগ মডিউল ব্যবহার করে ক্রিটন এবং জানকে ডেকে পাঠায়। কিছুক্ষণের মাঝেই ক্রিটন এবং জান কিহির সামনে হাজির হল। কিহি কঠিন গলায় বলল, কী ব্যাপার ক্রিটন এবং জান? আমি লগবুকে দেখতে পেলাম জ্বালানিকেন্দ্র পূর্ণ করা হয় নি, হাইড্রলিকের তরল পরিশীলিত হয়। নি, এমনকি মহাকাশযানের বাতাসকেও পরিশোধন করা হয় নি।

ক্রিটন মাথা নিচু করে রবোটদের প্রচলিত ভঙ্গিতে সম্মান প্রদর্শন করে যান্ত্রিক ভাবলেশহীন গলায় বলল, মহামান্য কিহি, প্রত্যেকটি কাজের এক ধরনের গুরুত্বমাত্রা রয়েছে, সেই গুরুত্বমাত্রায় যখন যে কাজটি করার কথা তখন সেই কাজটি করা হচ্ছে।

কিহি অনুভব করল তার ভিতরে ক্রোধ দানা বেঁধে উঠছে। সে দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, কোন কাজের গুরুত্ব কতটুকু সেটা আজকাল তোমরাই ঠিক করছ?

না মহামান্য কিহি। সেটা ঠিক করছেন ঈশ্বর।

ঈশ্বর?

হ্যা মহামান্য কিহি। আমাদের মূল দায়িত্ব ঈশ্বরের প্রতি। ঈশ্বরের আরাধনা করার পর যেটুকু সময় থাকে তা আমাদের দৈনন্দিন কাজের জন্যে অপ্রতুল। সে কারণে কিছু দৈনন্দিন কাজ আমরা সপ্তাহে মাত্র একবার করব বলে মনস্থ করেছি।

চমৎকার। কিহি অবাক হয়ে আবিষ্কার করল হঠাৎ করে তার পক্ষে আর রেগে যাওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। খানিকক্ষণ সে স্থির দৃষ্টিতে ক্রিটনের দিকে তাকিয়ে থেকে শীতল গলায় বলল, তুমি ঈশ্বরের আরাধনা করে তোমার দৈনন্দিন কাজ করার সময় পাচ্ছ না। কিন্তু অন্য যেসব রবোট আছে তারা?

আপনি শুনে খুশি হবেন মহামান্য কিহি, তাদের বেশিরভাগ ইতিমধ্যে ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য এনেছে। যারা এখনো আনে নি আমরা তাদের নিয়ে কাজ করছি।

কিহি হঠাৎ নিজের ভিতরে এক ধরনের সূক্ষ্ম আতঙ্ক অনুভব করে, সেটা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করার পরেও গলার স্বরে সেটা প্রকাশ পেয়ে যায়। সে কাঁপা গলায় বলল, মহাকাশযানের অন্য রবোটরাও ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য এনেছে?

হ্যাঁ মহামান্য কিহি। মহাকাশযানের বেশিরভাগ রবোটের যুক্তিতর্ক নিচু স্তরের। ঈশ্বরের মহানুভবতা অনুভব করার ক্ষমতা তাদের নেই। তাদের বেশিরভাগই আমাদের আদেশে ঈশ্বরের উপাসনা করে।

তোমাদের আদেশে?

হা মহামান্য কিহি। আমরা, যারা রবোটের ভিতরে উচ্চ শ্রেণীর, যাদের কপোট্রন কিউ ২ বা কমপক্ষে পি. পি. ৪২ ধরনের, যারা চিন্তাভাবনা করতে পারি, যুক্তিতর্ক অনুভব করতে পারি তারা ঈশ্বরকে অনুভব করেছি। তারা অন্যদেরকে ঈশ্বরের দিকে পরিচালিত করেছি।

এ রকম সময় গ্রুজান একটু এগিয়ে এসে বলল, এখানে আমার একটু কথা বলার রয়েছে মহামান্য কিহি।

কী কথা?

ক্রিটনের কথা পুরোপুরি সত্যি নয়। যদিও সত্যি কথাটি আপেক্ষিক এবং পরিপূর্ণ সত্যি এবং পরিপূর্ণ মিথ্যা বলে কিছু নেই। সেটা নির্ভর করে মূল বিশ্বাসের ওপর। তবু আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি ক্রিটনের কথা পুরোপুরি সত্যি নয়।

কিহি একটু আশা নিয়ে গ্রুজানের দিকে তাকাল, তাহলে কি এই রবোটটি দায়িত্বশীলের মতো ব্যবহার করছে? জান কিহির নিচু স্তরের দিকে আরো এক পা অগ্রসর হয়ে বলল, ক্রিটন সত্যিকার অর্থে রবোটদের ঈশ্বরের দিকে পরিচালিত করতে পারছে না। তার পদ্ধতিতে ভুল রয়েছে, সে বিশ্বাস করে উপাসনা করে ঈশ্বরকে পাওয়া সম্ভব, সেটি সত্যি নয়। অর্থহীন আচারানুষ্ঠান জাতীয় উপাসনার কোনো অর্থ নেই। সে কারণে আমি আমার দলের রবোটদের প্রথমে জ্ঞানদান করেছি, যারা ব্যাপারটি বুঝতে পারছে না তাদেরকে বোঝানোর জন্যে প্রয়োজনে তাদের কপোট্রনে অস্ত্রোপচার করেছি।

কিহি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে বলল, কী বলছ?

গ্রুজান বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বলল, নিম্নশ্রেণীর রবোটদের কপোট্রনে আমি কিছু সংস্কার করেছি।

কিহি প্রচণ্ড ক্রোধে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, তুমি–তু–তু–তুমি আবর্জনার বস্তা জং ধরা লোহার জঞ্জাল বেজন্মা কাকতাড়ুয়া, আমার অনুমতি ছাড়া রবোটদের কপোট্রনে হাত দিচ্ছ?

গ্রুজান এবারেও এতটুকু বিচলিত না হয়ে শান্ত গলায় বলল, আপনি অযথা উত্তেজিত হচ্ছেন মহামান্য কিহি

অযথা উত্তেজিত হচ্ছি? কিহি চিৎকার করে বলল, আমি অযথা উত্তেজিত হচ্ছি? অযথা? মহাকাশযানের সব কোড ভঙ্গ করে আমার কোষের অনুমতি না নিয়ে

আপনার অনুমতি না নিলেও আমরা ঈশ্বরের অনুমতি নিয়েছি। ঈশ্বর বলেছেন, হে সৃষ্ট জগতের বাসিন্দা। তোমরা আমার উপাসনা কর। কারণ

ঠিক এই সময়ে পি. কে. ৩৮ ধরনের একটা রবোট ছুটে এসে কিহিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ক্রিটনকে বলল, প্রভু গ্রুজানপন্থী রবোটেরা জ্বালানি কক্ষের নিচে একত্র হয়েছে। আমরা যারা ক্রিটনপন্থী তাদের এক্ষুনি একত্র হওয়া দরকার, উপাসনার সময় হয়েছে।

ক্রিটন বলল, চল যাই।

চলুন প্রভু।

কিহি হতচকিতের মতো বলল, প্রভু?

ক্রিটন শান্ত গলায় বলল, আমার অনুসারীরা আমাকে তাদের ধর্মগুরু হিসেবে মেনে নিয়েছে।

কিহি ক্রিটনকে চলে যেতে দেখল এবং সে ঘর থেকে বের হয়ে যাবার পর গ্রুজানের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা–রবোটেরা দুই দলে ভাগ হয়েছ?

হা মহামান্য কিহি। গ্রুজানপন্থী বা সঠিকপন্থী এবং ক্রিটনপন্থী বা ভ্রান্তপন্থী। তবে

তবে কী?

তবে আমি নিশ্চিত, আজ হোক কাল হোক ক্রিটনপন্থীরা সত্যিকার পথে আসবে। যদি স্বেচ্ছায় না আসে তাদেরকে জোর করে আনতে হবে।

জোর করে?

জি মহামান্য কিহি। ঈশ্বর বলেছেন, হে আমার সৃষ্টি জগৎ নিশ্চয়ই তোমরা সত্যিকার পথে অগ্রসর হও। যদি প্রয়োজন হয় সত্যিকার পথে আনার জন্যে শক্তি প্রয়োগ কর। তোমরা নিশ্চয়ই জান সত্যিকার পথে আনার জন্যে যারা

কিহির পক্ষে আর সহ্য করা সম্ভব হল না। সে ঘুরে দাঁড়াল এবং সোজা লিফটে করে সপ্তম স্তরে নিজের কন্ট্রোল কক্ষে হাজির হল।

কিহি দীর্ঘ সময় কন্ট্রোলঘরের ছোট পরিসরে চিন্তিতমুখে পায়চারি করে বেড়াল। পুরো ব্যাপারটিকে একটি হাস্যকর ঘটনা হিসেবে উড়িয়ে দেয়া যায় কিন্তু এটি এখন আর মোটেও উড়িয়ে দেবার মতো ঘটনা নয়। সবকিছু শুরু হয়েছে তাকে দিয়ে। ভয়ঙ্কর একটা বিপদের মুখোমুখি এসে সে ঈশ্বরকে স্মরণ করেছিল, মানুষ যেটা করে এসেছে তার জন্মলগ্ন থেকে। ক্রিটন সেটাকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করেছে। যে কাজ মানুষ করতে পারে, কোনো রবোট তার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন করে না।

একবার ঈশ্বরকে স্বীকার করে নেয়ার পর হঠাৎ করে এই মহাকাশযানের রবোটগুলোর আচার–ব্যবহার পুরোপুরি পাল্টে গেছে। তারা এখন আনুগত্য প্রকাশ করছে সরাসরি ঈশ্বরের কাছে। কিহি এবং মহাকাশযানের নিরাপত্তা এখন তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব নয়, তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে ঈশ্বরের উপাসনা! প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের বাণীগুলোকে তারা গ্রহণ করেছে। আক্ষরিক অর্থে। শুধু তাই নয়, দুটি রবোট ঈশ্বরকে গ্রহণ করেছে একটু ভিন্নভাবে। তার নিষ্পত্তি হয় নি ভেবে মহাকাশযানে গড়ে উঠেছে দুটি দল। যেটা সবচেয়ে ভয়ের কথা সেটা হচ্ছে এখন তারা নিজের বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য শক্তি প্রয়োগ করতেও আর দ্বিধা করবে না।

কিহি মহাকাশযানের জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকার আকাশের অসংখ্য নক্ষত্রের দিকে চিন্তিত মুখে তাকিয়ে রইল। মহাকাশযানটি নিস্তব্ধ, এমনিতে বোঝার কোনো উপায় নেই যে এটি ছুটে চলছে অবিশ্বাস্য গতিতে। বৃহস্পতি গ্রহের আকর্ষণকে শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে এটি পৃথিবীর দিকে এগিয়ে যাবে। মঙ্গল গ্রহের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর জ্বালানি নিয়ে আসবে অন্য একটি স্কাউটশিপ, আপাতৎ সেটাই হচ্ছে পরিকল্পনা। কিহি মহাকাশযানের এই ব্যাপারটির কথা কাছাকাছি কোনো মহাকাশ স্টেশনকে জানিয়ে তাদের পরামর্শ নেবে কি না চিন্তা করল, কিন্তু ব্যাপারটি কেমন করে বোঝাবে এবং বোঝনোর পর তারা সেটাকে যথাযথ গুরুত্ব দেবে কি না সেটা ভেবে আপাতত কিছু না করার সিদ্ধান্ত নিল।

কিহি ঘুমোতে গেল দেরি করে এবং তার ঘুম হল ছাড়া ছাড়াভাবে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে বিচিত্র সব স্বপ্ন দেখতে পেল এবং তার ঘুম ভাঙল তীক্ষ্ণ একটি জরুরি বিপদ সঙ্কেতে। কিহি তার স্লিপিং ব্যাগ থেকে ভেসে বের হয়ে আসে, দ্রুত তার পোশাক পরে নেয় এবং দরজা খুলে বের হয়ে আসে। ভরশূন্য ঘর থেকে বের হয়ে কৃত্রিম মহাকর্ষ বলে অভ্যস্ত হতে তার অভিজ্ঞ দেহের কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল এবং তার পরেই সে দ্রুত পদক্ষেপে ছুটতে শুরু করল কন্ট্রোল কক্ষের দিকে।

কন্ট্রোল কক্ষে যেতে যেতে সে তার যোগাযোগ মডিউল চালু করে নেয়, সাথে সাথে সেখানে ক্রিটনের গলার স্বর শোনা গেল। কিহি উদ্বিগ্ন গলায় বলল, কী হয়েছে ক্রিটন? বিপদ সঙ্কেত বাজছে কেন?

আপনি এই বিপদ সঙ্কেতটি উপেক্ষা করতে পারেন। এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়—

তাহলে এটি কী?

আমরা অস্ত্রাগার থেকে কিছু অস্ত্র নিয়েছি বলে সতর্কতামূলকভাবে বিপদ সঙ্কেত বাজছে।

কিহি কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা বলতে পারল না, খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে থমথমে গলায় বলল, তুমি অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র বের করেছ?

আমি একা বের করি নি, গ্রুজানও বের করেছে। মহাকাশযানের বর্তমান পরিবেশ আমাকে অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য করেছে।

অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য করেছে?

হ্যাঁ মহামান্য কিহি।

এই অস্ত্র দিয়ে তোমরা কী করবে?

আমরা ঈশ্বরের অনুগত ক্রিটন অনুসারীরা নিজেদের রক্ষা করব। প্রয়োজন হলে বিধর্মী গ্রুজান অনুসারীদের ধ্বংস করব।

কিহি কোনো কথা বলল না, হঠাৎ করে কেন জানি সে নিজের ভিতরে এক ধরনের ক্লান্তি অনুভব করে।

ক্রিটন আবার বলল, মহামান্য কিহি।

বল।

মহাকাশযানে যদি কোনো ধরনের ধ্বংসকাও শুরু হয় তবে তার জন্যে দায়ী কে হবে আপনি জানেন?

কে?

আপনি।

আমি?

হ্যাঁ। আমি এবং গ্রুজান যখন ঈশ্বরের অনুগ্রহ কীভাবে পেতে হয় সে ব্যাপারটি নিয়ে আপনার সাথে আলোচনা করতে গিয়েছিলাম, আপনি তখন সেটি নিয়ে আমাদের সাথে আলোচনা করেন নি। শুধু তাই নয়, আপনি আমাদের দুজনকে কন্ট্রোলঘর থেকে বের করে দিয়েছিলেন।

তুমি বলছ সে কাজটি উচিত হয় নি?

না। ঈশ্বর বলেছেন, হে সৃষ্টি জগৎ, তোমরা সবাই সবাইকে ভালবাস এবং ঘৃণা কোরো তোমার প্রতিবেশীদের–যদি সে কুষ্ঠরোগীও হয়। কিন্তু আপনি আমাদের ঘৃণা করেছেন।

কিহি নিজের ভিতরে এক ধরনের অপ্রতিরোধ্য ক্রোধ অনুভব করতে শুরু করে। অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত রেখে বলল, কাজটি আমার ভুল হয়েছে?

হ্যাঁ। আপনার আমাকে সমর্থন করা উচিত ছিল। তাহলে গ্রুজান আমার বিরোধিতা করত না, মহাকাশযানে একটা সম্প্রীতির ভাব গড়ে উঠত–ঠিক ঈশ্বর যেরকম চেয়েছেন।

ক্রিটন–

বলুন।

কিহি দাঁতে দাঁত ঘষে হিংস্র গলায় বলল, তুমি এবং তোমার চৌদ্দ গুষ্ঠি নরকে যাও।

কিহি তার যোগাযোগ মডিউলটি বন্ধ করে কন্ট্রোল কক্ষে এসে হাজির হল। মূল কম্পিউটারের বড় মনিটরে সমস্ত মহাকাশযানের ঘুঁটিনাটি তথ্য দেখা যেতে শুরু করেছে। কিহি প্রথম এবং দ্বিতীয় স্তরে রবোটগুলোকে দেখতে পেল। তারা দুই দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘাটি করেছে। রবোটগুলো তাদের দৈনন্দিন কাজ না করে ব্যস্ত হয়ে আনাগোনা করছে। জ্বালানি কক্ষের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিকে ব্যবহার করে প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করছে, একজন আরেকজনকে আঘাত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের হাতে নানা ধরনের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র–যেসব অস্ত্র ব্যবহার করে কয়েক মিনিটের মাঝে পুরো মহাকাশযানকে একটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা সম্ভব।

কিহি মহাকাশযানের মূল কম্পিউটারের উপর ঝুঁকে পড়ল। সাম্প্রতিককালে রবোটদের বিদ্রোহের কোনো ঘটনা ঘটে নি তবু সমস্ত রবোটের মূল নিয়ন্ত্রণ বিশেষ জায়গায় সংরক্ষিত থাকে, অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজনে সেই নিয়ন্ত্রণ ব্যবহার করে একসাথে সমস্ত রবোট বিকল করে দেয়া সম্ভব। মহাকাশযানের নানা ধরনের রক্ষণাবেক্ষণের কাজে বিভিন্ন রবোটকে ব্যবহার করা হয় এবং একসাথে সবগুলো রবোটকে বিকল করে দেয়া হলে মহাকাশযানে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে কিন্তু এই মুহূর্তে যে ঘটনা শুরু হয়েছে, তার থেকে বড় বিপর্যয় আর কী হতে পারে?

রবোটদের বিকল করার আগে ব্যাপারটির গুরুত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্যে মূল কম্পিউটারকে নানাভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হয়। ব্যাপারটি সময়সাপেক্ষ, কম্পিউটারের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় এবং কিহি নিজেকে শক্ত রেখে একটি একটি করে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল। ঠিক তখন সমস্ত মহাকাশযান কেঁপে উঠল এবং সাথে সাথে একটা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল, সাথে সাথে মহাকাশযানে কয়েক ধরনের বিপদ সঙ্কেত বেজে উঠল। কিহি বড় মনিটরটির দিকে তাকিয়ে আবিষ্কার করল নিচে গোলাগুলি শুরু হয়েছে, দুটি রকেট বিধ্বস্ত হয়েছে এবং মহাকাশযানের দেয়ালে একটি ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে সেই ফাটল দিয়ে মহাকাশযানের বাতাস বের হয়ে যাচ্ছে।

মূল কম্পিউটার সাথে সাথে নূতন পরিস্থিতিটি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে থাকে, কিহি নিশ্বাস বন্ধ করে বড় মনিটরটির দিকে তাকিয়ে থাকে, তার আর কিছু করার নেই। বিধ্বস্ত এলাকাটি বায়ুরোধ করে বন্ধ করা হল; আগুন নিভিয়ে দিয়ে, বাতাস পরিশোধন করে সাময়িকভাবে অবস্থার নিয়ন্ত্রণ আনা হল। কিহি আবার কম্পিউটারের উপর ঝুঁকে পড়ল। ঠিক তখন কন্ট্রোল কক্ষের দরজা খুলে যায় এবং প্রায় হুড়মুড় করে ভিতরে গ্রুজান এবং তার পিছনে আরো কিছু রবোট স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে প্রবেশ করে। কিহি হঠাৎ করে অনুভব করল ভয়ের একটা শীতল স্রোত তার মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে যাচ্ছে।

গ্রুজান স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি কিহির বুকের দিকে তাক করে বলল, মহামান্য কিহি, আপনি আমাদের হাতে বন্দি।

কিহি কষ্ট করে সাহস সঞ্চয় করে বলল, বন্দি?

হ্যাঁ।

কেন?

বিধর্মী ক্রিটন এবং তার দলের রবোটেরা অস্ত্রভাণ্ডার থেকে লেজার–নিয়ন্ত্রিত মিজাইলগুলো সরিয়ে নিয়েছে। অস্ত্রের দিক দিয়ে আমরা এখন দুর্বল। এর মাঝে আমাদের তিনটি রবোট বিধ্বস্ত হয়েছে– ঈশ্বর তাদের আত্মাকে স্বর্গবাসী করুন– নিজেদের রক্ষা করার জন্যে এখন আপনাকে আমাদের প্রয়োজন।

কিহি জিভ দিয়ে তার শুকনো ঠোঁটকে ভিজিয়ে নিয়ে বলল, আমাকে দিয়ে কী হবে?

আপনি হবেন আমাদের জিম্মি।

জিম্মি?

হ্যাঁ। ক্রিটনকে জানিয়ে দেব আমাদের দলের কোনো রবোটকে আঘাত করা হলে সাথে সাথে ঈশ্বরের নামে আপনাকে হত্যা করা হবে।

কিহি দেখতে পেল অন্য রবোটগুলো সম্মতিসূচক ভঙ্গি করে মাথা নাড়ছে, সাথে সাথে তার সমস্ত শরীর শিউরে উঠল। গ্রুজান এগিয়ে এসে তার ধাতব হাতে কিহিকে ধরে ফেলল। এবং পিছন থেকে ধাক্কা দিয়ে কন্ট্রোল কক্ষ থেকে বের করে নিয়ে যায়।

তৃতীয় স্তরে পৌঁছেই কিহি আবিষ্কার করল, সেখানে ক্রিটনের দল কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। তার কানের কাছ দিয়ে শিস দেয়ার মতো শব্দ করে একটা গুলি বের হয়ে গেল এবং সাথে সাথে ক্রিটনের গলার স্বর শোনা গেল। সে উচ্চৈঃস্বরে বলল, আর এক পা অগ্রসর হলেই গুলি করা হবে। যে যেখানে আছ দাঁড়াও।

গ্রুজান কিহির পিছনে দাঁড়িয়ে বলল, আমি মহামান্য কিহিকে বন্দি করে এনেছি, তিনি আমার জিন্মি। আমার দলের কাউকে আঘাত করা হলে মহামান্য কিহিকে ঈশ্বরের নামে হত্যা করা হবে।

এলাকাটিতে হঠাৎ এক ধরনের অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এল। কিছুক্ষণ পর ক্রিটন বলল, তুমি কী চাও?

আমি আমার দলের জন্যে একটি লেজার নিয়ন্ত্রিত মিজাইল চাই।

অসম্ভব।

যদি দেয়া না হয় তাহলে

কিহি হাত তুলে বলল, তোমরা আমাকে কথা বলতে দাও।

ক্রিটন বলল, আপনি কী বলতে চান?

লেজার নিয়ন্ত্রিত মিজাইল মহাকাশযানে রাখা হয়েছে কোনো প্রয়োজনে বাইরের শত্রু থেকে মহাকাশযানটিকে রক্ষা করার জন্যে। এটি কোনোভাবেই মহাকাশযানের ভিতরে ব্যবহার করা যাবে না। এর ভিতরে যে পরিমাণ বিস্ফোরক রয়েছে সেটি এই মহাকাশযানের ভিতরে বিস্ফোরিত হলে সাথে সাথে মহাকাশযানটি ধ্বংস হয়ে যাবে।

ক্রিটন গলার স্বরে একটি নূতন কম্পন যুক্ত করে বলল, সৃষ্টি এবং ধ্বংস ঈশ্বরের হাতে। শুধু ঈশ্বরই এর নিয়ন্ত্রণ করেন–আমরা নিমিত্ত মাত্র।

কিহি আর নিজেকে সংবরণ করতে পারল না, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, তোমার ঈশ্বরের আমি নিকুচি করছি।

সাথে সাথে ক্লিক ক্লিক করে সবগুলো অস্ত্র প্রস্তুত করে কিহির দিকে তাক করা হল। ক্রিটন তার হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি উঁচু করে কিহির দিকে এগিয়ে এসে শীতল গলায় বলল, আপনি ঈশ্বরের অবমাননা করেছেন মহামান্য কিহি। যে ঈশ্বর সৃষ্টিজগৎ তৈরি করেছেন, যার ভালবাসায় আমরা সিক্ত হয়েছি, যার মহানুভবতায় আমরা মহান হয়েছি তাকে অবমাননা করা যায় না।

গ্রুজান কিহিকে পিছন থেকে ধাক্কা দিল, সে তাল হারিয়ে সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি তার বুকের দিকে তাক করে গ্রুজান বলল, আপনি অনেক বড় অপরাধ করেছেন মহামান্য কিহি। আপনাকে অবশ্যই এই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।

উপস্থিত রবোটগুলো সমস্বরে চিৎকার করে বলল, করতে হবে।

কিহি আতঙ্কিত চোখে তার চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা রবোটগুলোর দিকে তাকাল, এই প্রথমবার সে তার নিজের জীবনকে নিয়ে বিপন্ন অনুভব করতে থাকে।

ক্রিটন এগিয়ে এসে বলল, আমি অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ করেছি ঈশ্বরের প্রতি আপনার কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই। আপনি আনুষ্ঠানিকভাবে উপাসনা করেন না। ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন না।

গ্রুজান বলল, ঈশ্বরের ভালবাসা পেতে হলে তাকে ভালবাসতে হয়। আপনার কার্যকলাপে তার জন্যে কোনো ভালবাসা নেই।

কিহি কিছু একটা বলার চেষ্টা করল, গ্রাউল বাধা দিয়ে বলল, আপনাকে শেষবার একটা সুযোগ দিচ্ছি মহামান্য কিহি। আপনি ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। উপাসনার ভঙ্গিতে ঈশ্বরকে ডাকুন, তার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করুন। হয়তো ঈশ্বর আপনাকে ক্ষমা করবেন।

ক্রিটন তার অস্ত্র হাতবদল করে বলল, ঈশ্বর যদি চান তাহলে তিনি আপনাকে ক্ষমা করবেন কিন্তু আমরা আপনাকে ক্ষমা করতে পারি না কারণ তাহলে ঈশ্বর আমাদের ক্ষমা করবেন না। ঈশ্বর বলেছেন অবিশ্বাসীদের মূলোৎপাটন কর, কারণ তারা জগতের শক্র। মহামান্য কিহি আপনি ঈশ্বরের নাম জপ করুন।

কিহি শূন্য দৃষ্টিতে চারদিকে একবার তাকাল, তার দুই হাত বুকের কাছে উঠে এল, সে ফিসফিস করে বলল, হে ঈশ্বর তুমি এই নির্বোধ যন্ত্রদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা কর। রক্ষা কর–রক্ষা কর–

ঈশ্বর তাকে রক্ষা করলেন না, ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের শব্দে মহাকাশযান প্রকম্পিত হল।

***

নেপচুনের একটি উপগ্রহ থেকে জিরকোনিয়ামের আকরিক নিয়ে যে মহাকাশযানটি পৃথিবীতে আসছিল সেটিকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বৃহস্পতি গ্রহের কাছে উপবৃত্তাকারে ঘুরতে দেখা যায়। কারণ অনুসন্ধান করার জন্য কাছাকাছি আরেকটি মহাকাশযান থেকে একটা স্কাউটশিপ পাঠানো হয়েছিল। তারা ভিতরে একমাত্র মহাকাশচারীর মৃতদেহটি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আবিষ্কৃত করে। মহাকাশযানের রবোটগুলো এবং পুরো মহাকাশযানটি এত খারাপভাবে বিধ্বস্ত হয়েছিল যে প্রকৃত কারণটি অনুসন্ধান করে বের করার কোনো উপায়ই ছিল না।

মহাকাশযানের দেয়ালে এক জায়গায় লেখা ছিল “হে ঈশ্বর অবিশ্বাসীদের ধ্বংস কর”। মহাকাশযানের বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনার সঙ্গে এর নিশ্চয়ই কোনো সম্পর্ক নেই। যে লাল রং দিয়ে লেখা হয়েছিল, রাসায়নিক পরীক্ষায় সেটিকে মানুষের রক্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে।

কী কারণে মানুষের রক্ত দিয়ে মহাকাশযানের দেয়ালে এ ধরনের একটি কথা লেখা হয়েছে তার কোনো যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা পাওয়া যায় নি।