ইংরেজি বনাম মাতৃভাষা

ইংরেজি বনাম মাতৃভাষা

‘হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড’-এ সুপণ্ডিত, প্রাতঃস্মরণীয় শ্রীযুক্ত যদুনাথ সরকার ‘কম্পালসরি হিন্দি– ইটস্ এফেক্ট অন্ এডুকেশন’ শীর্ষক একটি সুচিন্তিত প্রবন্ধ লিখেছেন। প্রবন্ধের পূর্বার্ধে তিনি দুটি প্রশ্ন জিগ্যেস করেছেন। প্রথমত, অ-হিন্দি অঞ্চলের আপন ভাষা– যথা বাংলা, মারাঠি, দক্ষিণি ভাষাগুলোর স্থান হিন্দি দখল করে নিয়ে যেসব অঞ্চলে একে অন্যের যোগসূত্রের এবং সাহিত্যে কলাসৃষ্টির মাধ্যম হতে পারবে কি? দ্বিতীয়ত, এই প্রতিদ্বন্দিতার জগতে আমরা যদি দূরদৃষ্টি দিয়ে দেখি, তবে এটা কি কাম্য হবে যে, হিন্দি ইংরেজির জায়গা দখল করে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হয়ে উঠুক?

নানা যুক্তিতর্ক দিয়ে শ্রীযুত সরকার সপ্রমাণ করেছেন, বাংলা, মারাঠি ইত্যাদির স্থান হিন্দি কখনও দখল করতে পারবে না। আমরাও তাঁর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত।

দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, ইংরেজির স্থলে হিন্দি কাম্য হতে পারে না। শ্ৰীযুত সরকার তাই ব্যবসা-বাণিজ্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার জন্য ভারতবর্ষে ইংরেজিই চালু রাখতে চান। বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি ইংরেজিকেই শিক্ষার মাধ্যমরূপে রাখতে চান না হিন্দি, না বাংলা, এবং তাঁর লেখাতে তিনি এমন কোনও ইঙ্গিতও দেননি যে, আজ হোক কিংবা এক শ বছর পরেই হোক, শেষ পর্যন্ত বাংলাই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মাধ্যম হবে। তার ব্যবস্থা অনুযায়ী দেখতে পাচ্ছি, ইংরেজিই অজরামররূপে চিরকাল আমাদের শিক্ষা দীক্ষার মাধ্যম হয়ে থাকবে।

সরকার মহাশয় ইংরেজি ভাষার যে গুণকীর্তন করেছেন তার সঙ্গে আমরা সম্পূর্ণ একমত। ইংরেজির মতো আন্তর্জাতিক ভাষা পৃথিবীতে আর নেই, অদ্যকার (বিশেষ জোর দিয়ে আমিও বলছি অদ্যকার) দিনে জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং দর্শনের চর্চা করতে হলে ইংরেজি ভিন্ন গত্যন্তর নেই।

কিন্তু ইংরেজি চিরকাল এদেশের শিক্ষার মাধ্যম, তথা উচ্চাঙ্গ জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার বাহন হয়ে থাকবে এ ব্যবস্থা আমরা কাম্য বলে মনে করিনে।

এ কথা ঠিক যে, আজই যদি আমরা ইংরেজি বর্জন করি তবে সমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হব, কিন্তু কোনওদিনই শিক্ষার মাধ্যমরূপে বর্জন করতে পারব না একথা আমরা বিশ্বাস করিনে।

পৃথিবীর অন্যান্য প্রাচ্যদেশের অবস্থা আজ কী? আরব ভূখণ্ড বিশেষ করে মিশরে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা কি দিল্লি-কলকাতার চেয়ে অনেক কম? মিশরে জ্ঞানচর্চার মাধ্যম আরবি, ইংরেজি না ফরাসি? ‘অজহর’ মুসলিম শাস্ত্রালোচনার পীঠস্থল- সেখানে যে আরবি মাধ্যম হবে, তাতে আর কী সন্দেহ। তাই সে দৃষ্টান্ত দেব না, কিন্তু ইয়োরোপীয় ঢঙে নির্মিত বাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মাধ্যম তো ফরাসি নয়, ইংরেজিও নয়। অথচ তারা দিব্য আরবির মাধ্যমেই অ্যালোপ্যাথি, ইয়োরাপীয় ইঞ্জিনিয়ারিং শিখছে, তাদের পুরাতত্ত্ব বিভাগের প্রতিবেদন (রিপোর্ট) আরবিতেই বেরোয়। বিদেশি অধ্যাপকদের আরবি শিখে সে-ভাষাতেই পড়াতে হয়।

আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যম ফরাসিস? বা তেহরানে?

এই যে চীনে এতবড় রাজনৈতিক ও সামাজিক নবজাগরণ হয়েছে সে কি রাশানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যম করে? না, আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাশান শিক্ষার মাধ্যম, কিংবা চীনারা তাঁদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা রাশান ভাষায় আরম্ভ করে দিয়েছেন? পণ্ডিতজি তার চিন্তার ফল ইংরেজিতে প্রকাশ করেন, কিন্তু মাও সেতুঙ রাশানে কেতাব লিখেছেন, এ কথা তো কখনও শুনিনি।

জাপানে শিক্ষার মাধ্যম কি ইংরেজি? জাপানিদের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ বেরোয় কোন ভাষায়?

শ্রীযুক্ত সরকার বলেছেন,– “Even in the Latin Republics of South America, English is fast advancing as the medium of commercial communication and displacing (except for petty purely local transactions’) Portuguese and in some of the States corrupt Spanish by the people.”

লাতিন আমেরিকা সম্বন্ধে আমার সাক্ষাৎ জ্ঞান নেই, তাই ‘পেটি পুরলি লোকাল ট্রানজ্যাকশন’ বলতে শ্রীযুক্ত সরকার কী বলতে চেয়েছেন, ঠিক বুঝতে পারলুম না। তবে কি ওইসব অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি? এমন কথা তো কখনও শুনিনি– বরঞ্চ আমার ঠিক ঠিক জানা আছে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পূর্বে, জর্মনির ইস্কুলে যারা লাতিন-গ্রিক পড়ত না তাদের বাধ্য হয়ে ইংরেজি, ফরাসি এবং স্প্যানিশের মধ্যে যে কোনও দুটো শিখতে হত এবং লাতিন আমেরিকায় ইংরেজির চেয়ে স্প্যানিশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো চলবে এ তত্ত্ব জানা থাকায় বহু ছেলেমেয়ে স্প্যানিশ শিখত।

লাতিন আমেরিকা অনেক দূরের পাল্লা– এবারে ইংলন্ডের খুব কাছে চলে আসা যাক– ইংরেজি ভাষার গুণ-গরিমা প্রতিবেশী হিসেবে যারা সবচাইতে বেশি জানে এবং বোঝে। এরা সংখ্যায় খুব নগণ্য তবু ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যম করে নেয়নি। ইল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কি শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি, না তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করে ইংরেজিতে? এদের ব্যবসা-বাণিজ্যের বেশ একটা বড় হিস্যা ইংলন্ডের সঙ্গে, কিন্তু কই, তারাও তো তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি অবশ্যপাঠ্য করেনি? আজকের দিনের সঠিক খবর বলতে পারব না, তবে যতদূর জানা আছে, যারা উচ্চশিক্ষাভিলাষী তাদের হয় শিখতে হয় লাতিন-গ্রিক, নয় ইংরেজি, ফরাসি, জর্মন, স্প্যানিশ ইত্যাদির যে-কোনও দুটো ভাষা।

এখন প্রশ্ন, যারা মাতভাষা ভিন্ন অন্য একটি কিংবা দুটি ভাষা শেখে তাদের জ্ঞানগম্যি ওসব ভাষাতে কতখানি হয়? পণ্ডিতদের কথা হচ্ছে না, তাঁদের সংখ্যা অতিশয় নগণ্য। জর্মন পণ্ডিতমাত্রই ক্লাসিস্ এবং ফরাসি, ইংরেজি, ইতালীয় পড়ে বুঝতে পারেন, ইংরেজ পণ্ডিতদের বেশিরভাগ ফরাসি-জর্মন পড়তে পারেন– বিশেষ করে যাঁরা অর্থনীতির চর্চা করবেন তাঁদের মাসিক পত্রিকায় জমবার্ট, শুমপেটার পড়ার জন্য বাধ্য হয়ে জর্মন শিখতে হত। অ্যাটম-বমের গবেষণা করেছেন আমেরিকাতে বসে জর্মনরাই, কিংবা যাঁরা জর্মন জানতেন।

কিন্তু ইয়োরোপে আর যারা দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি শেখে, ইস্কুল-কলেজ ছাড়ার পর তারা ওই ভাষাতে জ্ঞানচর্চা করে কতটুকু? উচ্চশিক্ষিত ইংরেজমাত্রই অন্তত আট বছর ফরাসি শেখেন- কিন্তু কলেজ ছাড়ার বছর পাঁচেক পরই এঁরা আর ফরাসি বই কেনেন না। আমি এঁদের বাড়ির কেতাবের শেলফ মনোযোগ করে দেখেছি– পাঠ্যাবস্থায় যেসব ফরাসি বই তারা কিনেছিলেন তার ওপর আর কিছু কিনবার প্রয়োজন বোধ করেননি। এদের ‘দ্বিতীয় ভাষা’ সম্বন্ধে জ্ঞান শেষ পর্যন্ত কতটুকু থাকে সে সম্বন্ধে জেরম কে জেরমের ঠাট্টা মস্করা পড়ে দেখবেন।

বস্তুত বহু গবেষণা করে শিক্ষকগণ এই চূড়ান্ত নিষ্পত্তিতেই এসেছেন যে, মানুষকে ব্যাপকভাবে দোভাষী করা যায় না। গোলামদের কথা আলাদা। তারা যখন দেখে অর্থাগমের একমাত্র পন্থা মুনিবের ভাষা শেখা তখন সবকিছু বিসর্জন দিয়ে প্রভুর ভাষা শেখে- আমি যেরকম শিখেছিলুম, ফলে আজ না পারি উত্তম বাংলা বলতে, না পারি মধ্যম ইংরেজি লিখতে। কিন্তু আমার ছেলে গোলাম নয়– আমার আশা সে একদিন বাংলাতেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করবে। আমার ছেলে না পারুক, যদি আপনার ছেলে পারে তাতেই আমি খুশি এবং যদি সেদিন তার খ্যাতিতে আকৃষ্ট হয়ে ইংরেজ-ফরাসি আপন আপন মাতৃভাষাতে তার কেতাব অনুবাদ করে আজ যেরকম মাও সেতুঙের চীনা বই বেরুনোমাত্রই ইংরেজ গায়ে পড়ে তৎক্ষণাৎ স্ব-ভাষায় তার অনুবাদ করে, এখনও যেরকম ইংরেজ শকুন্তলা নাট্যের অনুবাদ করে–তবে আমি অমর্ত-লোক থেকে তাকে দু হাত তুলে আশীর্বাদ করব। অনন্তকাল ধরে আমরা শুধু ইংরেজি থেকে নেবই, কিছু দেবার সময় কখনও আমাদের আসবে না, এ-কথা ভাবতেও আমার মন বিরূপ হয়।

তবে কি বাংলাভাষী লোকসংখ্যা পৃথিবীতে এতই কম যে, আমরা কখনও বাংলাকে ফরাসি কিংবা জর্মনের মতো সমৃদ্ধিশালী করতে পারব না?

ভাষা              ভাষীদের সংখ্যা (হাজার সমষ্টিতে)

বাংলা  —       ৬০০০০

আরবি  —      ২৫০০০

চীন  —         ৪৩০০০০

গ্রিক  —        ৫৫০০

জাপানি  —     ৫৫০০০

জর্মন  —        ৮০০০০

হিন্দুস্তানি (অর্থাৎ হিন্দি-উর্দু মিলিয়ে না হলে
সুদ্ধ হিন্দিভাষীর সংখ্যা বাংলার চেয়ে কম)  —    ৯০০০০

ওলন্দাজ  —     ১০০০০

ইংরেজি  —      ১৮০০০০

ফরাসি  —       ৪৫০০০

রুশ  —           ৮৫০০০

তুর্কি —           ৭০০০

এবারে ভাষার ভিত্তিতে না নিয়ে লোকসংখ্যা নিন; কারণ, যে বর্ষপঞ্জি থেকে এই সংখ্যাগুলো পেয়েছি, দুর্ভাগ্যক্রমে তাতে নরইউজিয়ন, সুইডিশ, ডেনিশ, ফিনিশ ভাষীর সংখ্যা দেওয়া হয়নি।

নরওয়ে —         ২৯৫২

 ডেনমার্ক  —       ৩৯৭৩

ফিনল্যান্ড  —      ৩৭৩৪

আমার যতদূর মনে পড়ছে, চীনা, ইংরেজি, রুশীয়, জর্মন এবং স্প্যানিশের পরেই পৃথিবীতে বাংলার স্থান।

নরওয়ে, সুইডেন তাদের ২৯,৫২; ৬৫,২৩ নিয়ে আপন আপন ভাষায় দর্শন লেখে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করে, ডাক্তারি শেখে, ইঞ্জিনিয়ারি করে আর আমরা ৬০,০০০ হয়েও চিরকাল ইংরেজির ধামাধরা হয়ে থাকব?

১৮৪০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি আমরা কল্পনা করতে পারিনি, ফার্সি যদি এদেশ থেকে চলে যায়, তবে আমরা রাজকার্য চালাব কী করে! ইংরেজ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, ইংরেজিতেও চালানো যায়। আজ আমরা কল্পনা করতে পারছিনে, ইংরেজি ছেড়ে আমরা যাব কোথায়?

কিন্তু অধমের বক্তব্য এইখানেই শেষ নয়।

.

বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন, পণ্ডিতজনের মতের বিরুদ্ধে যেও না, কারণ পণ্ডিতের জ্ঞান আছে, তোমার নেই।

তবে কি মূখের বিরুদ্ধে মতানৈক্য প্রকাশ করব? সে তো আরও ভয়ঙ্কর। আমার আপন অজানাতে যেসব অসিদ্ধ যুক্তি-তর্ক উত্থাপন করব, যেসব ভুল ঐতিহাসিক তথ্য পেশ করব, মূর্খ অজ্ঞতাবশত সেগুলো মেনে নিয়ে আমাকে আরও বিপদে ফেলবে।

তাই আমি শ্ৰীযুত যদুনাথ সরকার মহাশয়ের সঙ্গেই মতানৈক্য প্রকাশ করছি। তিনি জ্ঞানবৃদ্ধ, বয়োবৃদ্ধ এবং সুপণ্ডিত; আমার মতো অর্বাচীনের যুক্তি-তর্কে, বিশেষত ঐতিহাসিক নজির পেশ করার সময় যদি ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটে, তবে তিনি সেগুলো সানন্দে এবং অনায়াসে মেরামত করে দিয়ে আমার জ্ঞানবৃদ্ধি করে দেবেন। বাঘা টেনিস-খেলোয়াড় টিডেনও বলেছেন, ‘সবসময় তোমার চেয়ে ভালো খেলোয়াড়ের সঙ্গে খেলবে না হলে খেলাতে তোমার কখনও উন্নতি হবে না।’ ইতিহাসে শ্ৰীযুত সরকার ভুবন-বিখ্যাত– তাঁর সঙ্গে দ্বিমত হয়ে আমিই লাভবান হব।

ইংরেজি ভাষার জ্ঞানভাণ্ডার দেখে আমরা আজ কিছুতেই কল্পনা করতে পারিনে, এ-ভাষা বাদ দিয়ে আমরা চলব কী করে? বাংলায় এরকম ভাণ্ডার নির্মাণ করব কী প্রকারে?

ইতিহাস বলেন, একদা ইয়োরোপের সর্বত্র জ্ঞানচর্চা হত লাতিনের মাধ্যমে। ইংরেজি, ফরাসি, জর্মনের নামও তখন কেউ মুখে আনত না। ওইসব অপোগণ্ড অর্বাচীন ভাষা যে কখনও জ্ঞানচর্চার মাধ্যম হতে পারে একথা কেউ বললে তখন নিশ্চয়ই তাকে পাগলা-গারদে পাঠানো হত, কিংবা ডাইনি ‘ভর করেছে’ ভেবে জ্যান্ত পুড়িয়ে ফেলা হত। অথচ এমন দিনও এল যখন ফ্রান্সের লোক লাতিন বর্জন করে ফরাসি ভাষাকেই জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চার মাধ্যম বলে মেনে নিল। জর্মনি তখনও শিক্ষাদীক্ষায় ফ্রান্সের অনেক পিছনে, তাই জর্মন রাজা-রাজড়া, নবাব-সুবেদাররা উত্তম ফরাসি-চর্চা করাটাই জীবনের সর্বপ্রধান কাম্য বলে ধরে নিয়েছিলেন। কাচ্চা-বাচ্চাদের পর্যন্ত ফরাসি ‘পার্লিয়েরেন’ (‘স্প্রেয়েন’ ক্রিয়া খাঁটি জর্মন, তার অর্থ ‘কথা বলা’ কিন্তু জর্মনরা তখন অনুকরণে এমনি মত্ত যে ফরাসি ‘পার্লে’ ক্রিয়া পর্যন্ত ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছে— তুলনা দিয়ে বলি, আমি ছেলেবেলা থেকে ইংলিশ স্পিক’ করে আসছি) করতে শেখানো হত এবং জর্মন ভাষাটাকে চাকরবাকরের ভাষা (গ্রেজিনডে-স্প্রাখে) বলে গণ্য করা হত। ফ্রিডরিক দি গ্রেট মাতৃভাষা জর্মনকে হেয় জ্ঞান করে ফরাসিতে কবিতা লিখতেন এবং সেই রদ্দি কবিতা মেরামত করতে গিয়ে গুণী ভলতেয়ারের নাভিশ্বাস উঠত।

তার পর একদিন ফরাসি নিজের থেকেই ব্যাঙাচির ন্যাজের মতো খসে পড়ল। জর্মনই জ্ঞানচর্চার মাধ্যম হয়ে গেল।

তার পর জর্মন এল ইংরেজির আওতায়। শ্ৰীযুত যদুনাথ এই সম্পর্কে লিখেছেন–

“The late German Emperor, Wilhelm II, before world-war No. I, had made English a compulsory second language in all the secondary schools of his Empire. Was that a sign of his slavery to the British people? No, like a shrewd practical politician he felt that this was the best way of promoting Germany’s trade all over the world.” (Hindusthan Standard, Feb. 1st, ‘53.)

এবার দেখা যাক এই ইংরেজির প্রভাব খোদ জর্মনরা পরবর্তী যুগে কী চোখে দেখেছে।

 ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শ্ৰীযুত য়োহান ভিসনার ‘জর্মন-ভাষা শিক্ষা’ (‘ডয়েচশে স্প্রাখলোরে’) নামক একখানি পুস্তিকা লেখেন। এ পুস্তিকা অষ্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির শিক্ষা-বিভাগ (কুলটু মিনিস্টেরিয়ুমের) কলেজের জন্য পাঠ্যপুস্তক হিসেবে নির্বাচন করেন।

জমনের ওপর লাতিন, ফরাসি তথা ইংরেজির প্রভাব আলোচনা করতে গিয়ে অধ্যাপক ভিসনার যা বলেছেন সেটি আমি তুলে দিচ্ছি। অনুবাদের সঙ্গে মূল জর্মন এখানে তুলে দেওয়ার উদ্দেশ্য যে, অনুবাদে কোনও ভুল থাকলে গুণী পাঠক সেদিকে আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে পারবেন। (ডবল স্পেস-ওলা শব্দগুলো ইংরেজি– পাঠকের দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষণ করছি)।

Dem 19 Jhdt war es vorbehalten, unser Deutsch mit englischen Woertern xu ueberfluten. Die weit verbreitete, Kenntnis der englischen Weltsprache, dazu der maechtige Einfluss englischer Sitte und Mode bewirkten, dass der deutsche Gentleman m Smoking oder S water wenlgstens bis zum Weltkriege den Dnglaender ebenso nachaeffte wie frueher der deutsche Cavalier den Franzosen, Jede kneipe bis dahin warein B a r, jedes Dampfschiff ein Steame r. jeder. Fahrstuhl ein Lift (mit einen Lift boy) jede Fuellfeder eine Fountain-pen. jeder Fuenfuhr-Tee ein Five o’clockte a. Deutsche Fbrikanten schrieben auf ihre fuer Deutschland bestimmten Erzeugnisse k oh-i-no or made by L. & C. Hardmuthin Austria, British grap hite drawingpencil, compressedle a d. Am ueppigsten wucherte das englische natuerlich auf dem Gebiete des Sports; deutsehe Mittelschulen verdnstalten Foot-ball meetings und la w n-tennis-matches wobci alles englisch war, auch das Zaehlen, nur nicht die Auesprache. Wie leichtfertin der Deutsche sein Volkstum vollends preisgibt, wenner mit dem Auslande in unmittelbare Beziehung tritt, sieht man an der gemixten Sprache des Deutsch-Amerikhaners; immer bissitg (busy), kauft sich dieser ein goldene Wats hen(watc h) startetforhom (geht nach Hause) und ringt die Bell (laeutet die Glocke) order bellt (laeutet einfach)
–ভিসনার, ডয়েচশে স্প্রাখলেরে, পৃ. ৮৫।

“আর ঊনবিংশ শতাব্দী রইলেন আমাদের জর্মন ভাষা ইংরেজি শব্দের বন্যায় ভাসিয়ে দেবার জন্য। বিশ্বভাষা হিসেবে ইংরেজির প্রসার এবং ইংরেজি রীতিনীতির প্রভাব হওয়ার ফলে বিশ্বযুদ্ধ (প্রথম) না লাগা পর্যন্ত জর্মন Gentleman Smoking কিংবা Sweater পরে পরে বাঁদরের মতো ইংরেজের অনুকরণ করেছিল– একদা যেরকম জর্মন Cavalier ফরাসির অনুকরণ করেছিল। স্কাইপেকে বলা হত bar, ডামপফশিফকে বলা হত steamer, ফারস্টলকে lift (এবং তার ভেতরে থাকত lift-boy), ফুলফেডারকে Fountain-pen, ফুফউরটিকে five O’ clock tea. জর্মন কারখানাওয়ালারা জর্মনিরই জন্য নির্মিত মালের উপর লিখতেন, Koh-i-noor made by L. &. c. Hardmuth in Austria, British graphite drawing pencil, compressed lead. G. (7695) আগাছা অবশ্য সবচেয়ে বেশি পল্লবিত হল Sports-এর জমিতে। জর্মন হাইস্কুলগুলো football meetings এবং Lawn-Tennis-matches-এর ব্যবস্থা করল এবং সেখানে সবই ইংরেজিতে চলত, এমনকি, সংখ্যা গোনা পর্যন্ত একমাত্র উচ্চারণটি ছাড়া (লেখক ব্যঙ্গ করে ইঙ্গিত করেছেন ওই কর্মটি সরল নয় বলেই)। বিদেশির সঙ্গে সোজা সংস্পর্শে এলে জর্মন কী অবহেলায় তার জাত্যাভিমান বর্জন করে তার উদাহরণ দেখা যায় তার খিচুড়ি জর্মন মার্কিন ভাষাতে, ‘বিজিক’ (Busy) ঘড়ি কিনলে সেটা Watschen (Watch) startet for hom (বাড়ি রওনা দিল) এবং ringt die bell (ঘণ্টা বাজায়) কিংবা শুধু belt (এখানে লেখক একটু রসিকতা করেছেন, শুদ্ধ জর্মনে belt অর্থ ‘ঘেউ ঘেউ করা’)।”

তার পর লেখক দুঃখ করেছেন যে, এই করে করে জর্মন ভাষা একটা জোব্বার মতো। হয়ে উঠল যার সর্বাঙ্গে রঙিন তালি এবং সে তালির টুকরোগুলো নানা রঙের নানা জামা থেকে ছিঁড়ে নেওয়া।

আমি অধ্যাপক ভিসনারের সঙ্গে ষোল আনা একমত নই। বাংলা এখনও অতি দুর্বল ভাষা; তাকে এখনও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রচুর বিদেশি শব্দ নিতে হবে। আমি যে এই নাতিদীর্ঘ উদাহরণটি অতি কষ্টে নকল এবং অনুবাদ পেশ করলুম (ভুল করলুম, অ্যাদ্দিন বাজারে জোর ঢোল বাজিয়েছি, আমি খুব ভালো জর্মন জানি, এইবারে অনুবাদের বেলায় ধরা পড়ব) তার উদ্দেশ্য এই যে, জর্মন যদি সুসময়ে এই পাগলামি বন্ধ না করত তবে সে এতদিনে কথামালার চিত্রিতা গর্দভী হয়ে যেত।

অর্থাৎ আমরা যদি অনন্তকাল ধরে ইংরেজিরই সেবা করি, তবে আমাদের বাংলাভাষাটি বিত্রিতা মর্কটী হয়ে যাবেন।

এ বিষয়ে আরও অনেক বক্তব্য আছে। কিন্তু এতখানি লেখার পর আজ সকালের (রবিবারের) কাগজ এসে পৌঁছল। সে কাগজ পড়ে আমি উল্লাসে মুক্তকচ্ছ হয়ে নৃত্য করেছি। বাংলাভাষার প্রতি দরদী-জন মাত্রই খবরটি পড়ে উল্লসিত হবেন। খুলে কই।

আশা করি আমার পাঠকেরা বিজ্ঞানে শ্ৰীযুত সত্যেন বসু এবং শ্ৰীযুত জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের পাণ্ডিত্যে কোনও প্রকার সন্দেহ পোষণ করেন না। যেসব গুণী আমার বৈজ্ঞানিক কৌতূহলজাত প্রশ্ন এক লহমায়, বিনা কসরতে ফৈসালা করে দেন, তাঁরাই দেখছি, এই দুই পণ্ডিতের নাম উচ্চারিত হলেই মাথা নিচু করেন।

শ্ৰীযুত বসু বলেন (আমি খবরের কাগজ থেকে তুলে দিচ্ছি, সভাতে যাবার আমার অধিকার নেই– তাই প্রতিবেদনে ভুল থাকলে বসু মহাশয় যেন নিজগুণে আমাকে ক্ষমা করেন), কেউ কেউ এই ধারণা পোষণ করেন যে, অন্তত বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষাকে মাধ্যমরূপে স্বীকার করে নিতেই হবে, কিন্তু তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস (confident) যতদিন-না বাংলাতে বিজ্ঞানের চর্চা হয় ততদিন পশ্চিম বাঙলায় বিজ্ঞানের প্রসার হতেই পারবে না।

তাঁর বিশ্বাস বাংলাতেই প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক শব্দ কিছুটা আছে, কিছুটা বানানো যেতে পারে, এবং বাদবাকি বিদেশি ভাষা থেকে নিতে কোনও সংকোচ করার প্রয়োজন নেই।

অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় মহাশয়ও বলেন, বৈজ্ঞানিক শব্দের বাংলা পরিভাষা নির্মাণের সময় হয়ে গিয়েছে।

এরপর আর কী চাই? আমি যে জিনিস অন্ধভাবে অনুভব করেছি, আমার যেসব দরদী পাঠক আমার সঙ্গে এতদিন মোটামুটিভাবে একমত, তাঁরা কি এই দুই পণ্ডিতের উক্তি শুনে উল্লসিত হলেন না?

.

একটা জিনিসকে আমি বড্ড ডরাই, আপনাদের অনুমতি নিয়ে সেটি আজ আপনাদের কাছে নিবেদন করব।

গণআন্দোলন বাদ দিয়ে কোনও দেশেই কোনও বড় কাজ করা সম্ভব হয় না। যতদিন পর্যন্ত শুধু ভারতীয় মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ই স্বরাজ-আন্দোলনের জন্য চেষ্টা করেছিলেন ততদিন ইংরেজ আমাদের ঘোড়াই পরোয়া করেছিল, কিন্তু যখন ভারতের জনগণ ইংরেজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল– অবশ্য সেটা মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের আত্মত্যাগের ফলেই সম্ভবপর হল– তখন বাধ্য হয়ে ইংরেজকে এদেশ ছাড়তে হল। তাই, আবার বলছি, গণজাগরণ, গণআন্দোলনের শক্তিই আমাদের স্বরাজ এনে দিয়েছে।

এবং সবচেয়ে বড় কথা, আজ যদি ভারতীয় রাষ্ট্র তার স্বরাজ্যকে সর্বাঙ্গসুন্দর করতে চায় তবে তার দরকার অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক স্বরাজ্যলাভ। রাজনৈতিক স্বরাজ্যের আপন মূল্য আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু তার ব্যবহারিক মূল্যের দিকটা ভুললে চলবে না– রাজনৈতিক স্বাধীনতার ফলে আমাদের হাতে যে শক্তি এল তারই প্রয়োগ করে এখন আমাদের জয় করতে হবে অন্য সর্ব-স্বাধীনতা। এককথায় এখন আমাদের প্রধান কর্তব্য, নবীন রাষ্ট্র গড়ে তোলা।

আমরা ভাবি, রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য ‘চাষাভুষো’কে ‘খ্যাপাবার’ দরকার ছিল; এখন যখন স্বরাজ হয়ে গিয়েছে, তখন এদের দিয়ে আর কোনও দরকার নেই, এরা ফিরে যাক ক্ষেতে-খামারে, ফলাক ধানচাল, আর মধ্যবিত্তশ্রেণি, আমরা শহরে বসে জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা করব আর তাই দিয়ে নবীন রাষ্ট্র গড়ে তুলব! তাই আমরা সে-চর্চা ইংরেজিতে করব, বাংলায় করব, না বান্টু ভাষায় করব তাতে কিছু আসে-যায় না, আমরা বুঝতে পারলেই হল, ওরা ওদের কম-জোর মাতৃভাষা নিয়ে পড়ে থাক। ভাবতেই আমার সর্বাঙ্গ ঘেন্নায় রী রী করে ওঠে।

বহু দেশ ভ্রমণ করে, বহু গুণীর সাহচর্যে এসে, আপন মনে নির্জনে বসে বহু তোলপাড় করে আমার সুদৃঢ় প্রত্যয় হয়েছে, এ বড় ভুল ধারণা, এ অতি মারাত্মক বিশ্বাস। আমার মনে আজ কণামাত্র সন্দেহ নেই যে, জনগণের সহযোগিতা ভিন্ন আমরা নবীন রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারব না। আমি আমার সহৃদয় পাঠক-সম্প্রদায়কে কখনও কোনও তত্ত্বে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস স্থাপন করতে অনুরোধ করিনি– তার পক্ষে, স্বপক্ষে যুক্তিতর্ক পেশ করেই ক্ষান্ত দিয়েছি কিন্তু আজ যুক্তিতর্ক দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের অনুরোধ করেও বলছি, সাহস দিচ্ছি, জনগণের ভেতর বিশ্বাস অনুপ্রাণিত করুন, তাদের সহযোগিতা আহ্বান করুন– আপনারা লাভবান হবেন। এ ছাড়া অন্য পন্থা নেই।

এখন প্রশ্ন জনগণের সহযোগিতা, জনগণমন আমরা জয় করব কী প্রকারে?

বিদেশি প্রবাদ : সব লোককে কিছুদিন ঠকাতে পার, কিছু লোককে সব দিন ঠকাতে পার, কিন্তু সব লোককে সব দিন ঠকাতে পারবে না। আমাদের অধঃপতনের যুগে আমাদের সব লোককে– অর্থাৎ জনগণকে আমরা অন্ধানুকরণ করতে শিখিয়েছিলুম, কিন্তু আজ আর সে কর্ম সম্ভবপর নয়। আমরা চাইও না। আজ আমরা চাই, জনগণ যেন আমাদের আদর্শ বুঝতে পেরে, সেই মর্মে অনুপ্রাণিত হয়ে নবীন রাষ্ট্র নির্মাণে আমাদের সহায়তা করে।

তাই প্রশ্ন, জনগণ আমাদের আদর্শ বুঝবে কী প্রকারে? আমরা জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা করে, ভারতীয় ইতিহাসের ধারা অনুসন্ধান করে যদি তাবৎ বস্তু ইংরেজিতে লিপিবদ্ধ করে সপ্রমাণ করি, আমাদের পক্ষে এই কর্ম কাম্য, আমাদের পক্ষে ওই নীতি প্রয়োজনীয়, আমাদের পক্ষে আরেক পন্থা সুধর্ম, তবে তারা এ-সব বুঝবে কী করে?

চট করে আপনি উত্তর দেবেন, মাতৃভাষাতে লিখলেই কি তারা সবকিছু বুঝতে পারবে?

এর সদুত্তর দিতে হলে আপনাকে আবার একটুখানি কষ্ট স্বীকার করে ইউরোপে যেতে হবে।

ফ্রান্স, জর্মনি, হল্যান্ডে বেশিরভাগ লোক শিক্ষা সমাপন করে ম্যাট্রিকের সঙ্গে সঙ্গে। এবং ওদের ম্যাট্রিক আমাদের ম্যাট্রিকের চেয়ে উচ্চস্তরের বলে তারা আর কিছু শিখুক আর না-ই শিখুক, মাতৃভাষাটা অতি উত্তমরূপে শেখে। তার পর টাকা-পয়সা রোজগারের ধান্ধার ভেতর কেউ করে সাহিত্যের চর্চা, কেউ করে ইতিহাসের, কেউ দর্শনের– ইত্যাদি। এবং তাই প্রায়ই দেখা যায়, বহু সুসাহিত্যিক উত্তম উত্তম পুস্তক লিখে যাচ্ছেন অথচ তারা শুধুমাত্র ম্যাট্রিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছায়া মাড়াননি। আমাদের রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র এই ধরনের– রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র অন্য ধরনের। কিন্তু ইয়োরোপে রবীন্দ্র-শরতের গোষ্ঠী বৃহত্তর।

এ তো হল সৃষ্টিকর্ম– এ অনেক কঠিন কাজ– এর চেয়ে অনেক সোজা, বই পড়ে বোঝা এবং সাধনা দ্বারা ক্রমে ক্রমে সুসাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ পুস্তক অধ্যয়ন করে করে দেশের উচ্চতম আদর্শের সঙ্গে সংযুক্ত থাকা। এ জিনিসটি ইয়োরোপে অহরহ হচ্ছে এবং তাই ইয়োরোপের যেকোনো দেশে গুণীজ্ঞানী যে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরেই পাওয়া যায় তা নয়, জনসাধারণের ভেতরেও বহু বিজ্ঞ ব্যক্তি পাওয়া যায় যাঁরা অনায়াসে অধ্যাপকের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেন।

আমাদের দেশের বাংলা দৈনিকগুলো যে ইংরেজির তুলনায় পিছিয়ে আছে সেকথা আমরা সবাই জানি, তবুও দেখেছি, একমাত্র ‘আনন্দবাজার’-পড়নেওলা গ্রাম্য বাঙালি অনেক সময় ওই মারফতে এতখানি জ্ঞান সঞ্চয় করতে পেরেছে যে, ইংরেজি-জাননেওলা শহুরেকে তর্কে কাবু করে আনতে পারে।

আমার তখন বড় দুঃখ হয় যে, আমাদের বড় বড় পণ্ডিতেরা ইংরেজিতে না লিখে যদি বাংলা কাগজে লিখতেন, তবে আমার গাঁয়ের পড়ুয়া জ্ঞান-লোকে আরও কত দিগ্বিজয় করতে পারত।

মিল্টন বলেছেন : ‘ক্ষুধার্ত হৃদয় নিয়ে ঊর্ধ্বমুখে চায় এরা কে দেবে এদের খাদ্য!’

আমাদের পণ্ডিতেরা এতদিন এদের বঞ্চিত রেখেছেন; স্বরাজ পাওয়ার পরও এঁরা তাদের জন্য কিছু করতে চান না। (আমি অবশ্য এদের দোষ দিইনে– এঁদের কাছে আমরা বহু দিক দিয়ে ঋণী–কিন্তু এরা অন্য যুগের লোক, ইংরেজি লেখাতে তারা এত অভ্যস্ত যে, আজ বাংলা লিখতে এঁদের সত্যই কষ্ট হয়।)

মুসলমানেরা প্রাদেশিক ভাষাগুলোকে কিছু কিছু সাহায্য করেছিলেন সেকথা আমরা জানি, ক্রিস্টান মিশনারিরাও তাই করেছিলেন, কিন্তু একথা ভুললে চলবে না যে, মুসলমানরা ফার্সি এবং ইংরেজ ইংরেজিকেই সম্মানের স্থান দিয়েছিল। ফলে মুসলমান-যুগে যাঁরা ফার্সি জানতেন তাঁরা ছিলেন ‘শরীফ’ অর্থাৎ ‘ভদ্র’ আর ব্রিটিশ যুগে (বলা উচিত ‘ক্রিশ্চান যুগে’ কারণ ভারতের ইতিহাসের প্রথম দুই যুগ যদি ‘হিন্দু পিরিয়ড’ এবং ‘মুসলিম পিরিয়ড’ হয়, তবে তৃতীয় যুগ ‘ক্রিশ্চান পিরিয়ড’ হবে না কেন?– এ তত্ত্বটির প্রতি আমার ক্ষীণদৃষ্টি জ্যোতিষ্মান করেছেন ছন্দ-সম্রাট শ্রীপ্রবোধ সেন) যাঁরা ইংরেজি জানতেন, তাঁরা ছিলেন ‘ভডরোলোগ ক্লাস’, অর্থাৎ ‘শরীফ’ অর্থাৎ ‘ভদ্র’।

অথচ, ভদ্র, ‘ভদ্র’ বলতে আমরা আবহমানকাল এমন কিছু বুঝেছি যার সঙ্গে ফার্সি কিংবা ইংরেজি জানা-না-জানার কোনও সম্পর্ক নেই।

মুসলমান-যুগে বরঞ্চ ভদ্রে-গ্রাম্যে কিঞ্চিৎ যোগাযোগ ছিল, কারণ মুসলমান-যুগে আমাদের সভ্যতা ছিল গ্রাম্য, অর্থাৎ জনপদ সভ্যতা; কিন্তু ক্রিশ্চান আমলে সভ্যতা ইংরেজি-অভিজ্ঞ এবং ইংরেজি-অনভিজ্ঞের মাঝখানে এমনি এক বিরাট, নিরেট পাঁচিল তুলে দিল যে, আজও আমরা সে দেয়াল ভাঙতে পারিনি, এবং ভাঙবার চেষ্টা করতে চাইনে। আমরা এখন ইংরেজি-জাননেওলা আর ইংরেজি-না-জাননেওলার মাঝখানে সেই প্রাচীন

অন্ধপ্রাচীর, অচলায়তন খাড়া রাখতে চাই। এই ব্যবস্থাটাকেই আমি ডরাই, বড্ড ডরাই। এ ব্যবস্থা মেনে নিলে আপনারা একদিন আবার পরাধীন হবেন। সেকথা আরেক দিন হবে।