আহুল – ৯

তানাকা চলে যাবার পর অলিভিয়েরা কিছুক্ষণ গরাদে মাথা রেখে মুহ্যমান হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। সুদীপ্তরা হতভম্ব। হেরম্যান অলিভিয়েরার পিঠে হাত রেখে বললেন, ব্যাপারটা কী একটু বুঝিয়ে বলুন আমাদের। এখান থেকে আমাদের তো বেরোবার উপায় খুঁজতে হবে।

মুখ তুললেন অলিভিয়েরা। তারপর সুদীপ্তদের উদ্দেশে বললেন, আমি একটা ব্যাপার আপনাদের কাছে গোপন করলেও আমার নাম, পরিচয়, এখানে কীভাবে এলাম, হার্জেলের ঘটনা, কোনো ব্যাপারেই এক বিন্দু মিথ্যা বলিনি।

হেরম্যান বললেন, আপত্তি না থাকলে বলবেন সেই গোপনীয় ব্যাপারটা কী? অলিভিয়েরা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে জবাব দিলেন, এখানে একটা দুর্মূল্য ধাতুর খনি আছে। যার খবর কেউ রাখে না।

ধাতুর খনি! সোনার খনি নাকি? সুদীপ্ত উত্তেজিতভাবে প্রশ্ন করল।

অলিভিয়েরা বললেন, না সোনা নয়। হয়তো বা আরও দুর্মূল্য ধাতু। তেজস্ক্রিয় ধাতুর খনি। যে ধাতু দিয়ে পরীক্ষা চালানো হত বন্দিদের ওপর।

কী ধাতু? এ জন্যই যাত্রাপথে তানাকার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তার কাছে ‘রেডিয়ো অ্যাকটিভ ডিভাইস’ দেখেছিলাম,

‘মলিবডেনম’। ওই কালো পাহাড়টা আসলে আগ্নেয় পাহাড়। ওর নীচে মলিবডেনম আছে। কোনো কালে অগ্নি উদ্‌গীরণের সময় মাটির নীচ থেকে উঠে এসেছিল ওই ধাতু। এখান থেকে একটা রাস্তা সেই খনিতে চলে গেছে। আমি অবশ্য যাইনি সেখানে। এ ব্যাপারটা জানতামও না। ঘটনাচক্রে অসভ্যদের তাড়া খেয়ে এখানে চলে আসি হার্জেলই আমাকে ব্যাপারটা জানায়। হার্জেল একটা ম্যাপও আমাকে দিয়েছিল, যেটা তানাকা নিয়ে গেলেন।

হেরম্যান এরপর তাকে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা আহুল প্রসঙ্গে তানাকা যা বলে গেলেন তা কি সত্যি?

অলিভিয়েরা বিমর্ষভাবে জবাব দিলেন, ইরিয়ান আর হার্জেলের মৃত্যু আমি দেখেছি, সেই ভয়ংকর চোখ দুটো দেখেছি। এখন সেটা যদি অন্য কোনো হিংস্র প্রাণীর চোখ হয় তবে…।

হেরম্যান একটু চুপ করে থেকে মৃদু হতাশভাবে যেন বললেন, হয়তো বা তাই হবে। এখন আমাদের বেরোবার পথ খুঁজতে হবে।

সুদীপ্ত হেরম্যানের কথা শুনে বুঝতে পারল যে তানাকার কথা আর অলিভিয়েরার অস্পষ্ট উত্তর হতাশার ছাপ ফেলেছে হেরম্যানের মনে। সুদীপ্ত বলল, এবার চেষ্টা করা যাক, কোনোভাবে দরজা খোলা যায় কিনা।

কাজ শুরু হল। গরাদের বাইরে খোঁটাটা অনেক দূরে। সে পর্যন্ত হাত পৌঁছবে না। গরাদের ফাঁক গলিয়ে হাত বাড়িয়ে লোহার শেকলটা টেনে ঝাঁকিয়ে চেষ্টা করা হল সেটা খোলার। কিন্তু পিনাকের আসুরিক শক্তিও ব্যর্থ হল শেষ পর্যন্ত। প্রচণ্ড গরম লাগছে। ঘামে ভিজে যাচ্ছে সবার শরীর। অলিভিয়েরা আবার বললেন, এতদিন এই মাটির নীচে আছি, এত প্রচণ্ড গরম কিন্তু কোনোদিন দেখিনি।

সবাই মাটিতে বসে ভাবতে লাগল কী করা যায়? মাটিটাও যেন তেতে উঠছে। কিছুক্ষণ ভাবার পর অলিভিয়েরা বললেন, শেষ একটা চেষ্টা করা যায়। গরাদগুলো লোহার প্যানেলের ওপর যেখানে বসানো সেখানে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে একটা গরাদও যদি খোলা যায় তার ফাঁক গলে সুদীপ্ত বাইরে যেতে পারবে।

কিন্তু কী দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাবেন? জানতে চাইল সুদীপ্ত।

অলিভিয়েরা বললেন, কার্তুজের বারুদ দিয়ে এভাবে ছোট বিস্ফোরণ ঘটাতে দেখেছি। বাইরে বেরিয়ে যদি জংলিদের মুখোমুখি হতে হয় তবে এই কার্তুজগুলোই শেষ ভরসা ছিল। কিন্তু এ ঘরের বাইরে যাবার এটাই শেষ চেষ্টা। অগত্যা অলিভিয়েরার রাইফেল আর হেরম্যানের কার্তুজের খোল থেকে বারুদ বার করে নেওয়া হল। রিভলভারের কার্তুজ শুধু শেষ সম্বল হিসাবে রাখল সুদীপ্ত। অলিভিয়েরা জামা ছিঁড়লেন। তা দিয়ে বারুদের পুঁটলি বানিয়ে সেটা গুঁজে দেওয়া হল দুর্বলতম গরাদটার গর্তে। ঘরের এক কোণে সরে এল সবাই। পিনাক পলতেতে আগুন দিয়ে সরে এল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে একটা বিস্ফোরণ ঘটল প্রচণ্ড শব্দে। ধোঁয়ায় ভরে গেল সারা ঘর। বিস্ফোরণের শব্দ অনুরণতি হতে থাকল বাইরের অলিন্দে। ধোঁয়া কমলে কাশতে কাশতে গরাদের কাছে গিয়ে দাঁড়াল সবাই। হ্যাঁ, সেই গরাদের জোড়ের মুখটা একটু ফাঁক হয়ে গেছে, তবে সম্পূর্ণ খোলেনি। তবে কি বাইরে বেরোনো যাবে না! আবার একটা নিরাশা তৈরি হল। গা থেকে জামা খুলে ফেলল পিনাক। মশালের আলোতে তার পেশিগুলো দেখে মনে হচ্ছে যেন তা পাথর কুঁদে তৈরি। নীচু হয়ে বসে একটা ভয়ংকর শপথ উচ্চারণ করে পিনাক তার দেহের সব শক্তি দিয়ে গরাদ ধরে টান দিল। কড়াং করে ধাতব শব্দ তুলে গরাদটা নীচ থেকে খুলে গেল! উল্লাসে চিৎকার করে উঠল সবাই। অলিভিয়েরা পিনাকের ঘর্মাক্ত দেহ জড়িয়ে ধরে বললেন, যদি এখান থেকে সভ্য পৃথিবীতে ফিরতে পারি তবে এই শর্তে সরকারকে ওই খনির খবর দেব, যেন তাঁরা ওই পাহাড়ের নাম ‘পিনাক হিল’ রাখেন।

পিনাক হাসল তার কথা শুনে। সে বলল, আমরা কি আর অতবড় মানুষ সাহেব! আপনাদের ভালোবাসাই যথেষ্ট। গরাদের ফাঁক গলে বাইরে এসে শিকলটা খোঁটা থেকে খুলে ফেলল সুদীপ্ত। ঝাঁপ উঠিয়ে বাইরে এল সবাই। তারপর ফিরে এল সে ঘরটাতে। যেখানে তাদের জিনিসপত্র রাখা আছে।

ঘরটাতে ফিরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল সবাই। খুব গরম লাগছে। যাত্রাপথের জন্য অতি প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস সঙ্গে নিল তারা। তারপর আর রাত বাড়ার অপেক্ষা না করে বাইরে যাবার জন্য আবার সুড়ঙ্গে পা বাড়ানো হল।

যে ঘরে তারা কিছুক্ষণ আগে বন্দি ছিল তার পাশ দিয়ে সুদীপ্তরা সোজা এগোল। অলিভিয়েরা বললেন, এ পথটাই সোজা বাইরে নিয়ে যাবে। সুড়ঙ্গটার দু-পাশ থেকে অন্য নানা পথ বেরিয়েছে। আধঘণ্টা চলার পর হঠাৎই তাদের একটা বন্ধ দরজার সামনে থামতে হল। পুরু ইস্পাতের পাত লাগানো দরজা। ওপাশে কিছু দেখা যাচ্ছে না। অলিভিয়েরা বিস্মিতভাবে বললেন, দরজাটা তো খোলা ছিল, বন্ধ কেন?

মশালটা তিনি নীচে নামালেন। মেঝের ধুলোতে জেগে আছে জুতো পরা পায়ের ছাপ! তানাকার পায়ের ছাপ! দরজাটা অনেক টানাটানি করেও শেষ পর্যন্ত খোলা গেল না। অলিভিয়েরা বললেন, ওপাশ থেকে তানাকা বন্ধ করে দিয়েছেন এ দরজা। ওপাশে কিছুদূর এগোবার পর ডানদিকে আর একটা সুড়ঙ্গ বেরিয়েছে। সেটা চলে গেছে সোজা সেই খনিতে। হার্জেল আমাদের বাইরে থেকে সুড়ঙ্গটা দেখিয়েছিল। ম্যাপ দেখে তানাকা ঠিক পথেই যাচ্ছেন। তবে শেষ পর্যন্ত তার ভাগ্যে—কী আছে জানি না!

হেরম্যান বললেন, আমরা অলিভিয়েরা একটু ভেবে নিয়ে বললেন, আরও দুটো পথ আমার জানা আছে। একটা পথ নদীর দিকে সেই গাছের গুঁড়ির আড়াল থেকে বেরিয়েছে। যে পথে আপনারা এসেছিলেন এখানে। তবে সে পথে বেরোলে আমরা জংলিদের হাতের মধ্যেই থাকব। বিপদ হতে পারে। আর একটা পথে আমি যাইনি কোনোদিন। হার্জেল দেখিয়েছিল সে পথটা। সেটা নাকি একটু ঘুরপথে বহু দূরে গিয়ে শেষ হয়েছে।

এখন কী করব? আমাদের ভাগ্য লিখন কি এখানেই থাকা?

কিছুক্ষণ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, দ্বিতীয় পথটাই ধরা হবে। সেই মতো আবার কিছুটা পিছিয়ে এসে সুদীপ্তরা প্রবেশ করল নতুন এক সুড়ঙ্গপথে।

এ যেন এক অন্তহীন চলা! সুদীপ্তরা মশাল জ্বেলে এগোতে লাগল। কখনো সোজা, কখনো এঁকেবেঁকে এগিয়েছে সুড়ঙ্গ। পাথুরে মেঝেতে পুরু ধুলোর আস্তরণ। বহু বছর কোনো পদচিহ্ন পড়েনি এ সুড়ঙ্গে। মাঝে মাঝে মাথার ওপর থেকে পাথরের চাঙড় খসে পড়েছে। সেগুলো সরিয়ে এগোতে হচ্ছে। ধুলোতে মাখামাখি সবাই। দেখে মনে হচ্ছে তারা নির্ঘাত কোনো প্রেতাত্মা। যুগ যুগ ধরে তারা পদচারণা করছে সলক উপত্যকার পাদদেশের এই সুড়ঙ্গে। শ্বাস নিতে মাঝে মাঝে কষ্ট হচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে তারা যত এগোতে লাগল, গরম যেন তত বাড়তে লাগল। গায়ের জামা খুলে ফেলল সবাই। হেরম্যান বললেন, বাইরে পৌঁছে যাবার আগেই সিদ্ধ হয়ে যাব মনে হয়। তবু তারা মুক্তির সন্ধানে এগোতে থাকল।

কতক্ষণ চলেছে খেয়াল ছিল না সুদীপ্তদের। হঠাৎ বাঁকের মুখে থমকে দাঁড়িয়ে অলিভিয়েরা ঘড়ি দেখে বললেন, রাত শেষ হতে চলল, আর কতটা পথ এগোতে হবে কে জানে! এবার একটু বিশ্রাম নিতে হবে। তার মানে সুড়ঙ্গপথে সুদীপ্তরা সারা রাত হেঁটেছে। এবার সত্যিই একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। তারা ধুলোমাখা মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে পড়ল। আধ ঘণ্টা মতো বসে থাকার পর জল খেয়ে সবাই উঠে দাঁড়াল। শুরু হল আবার চলা। আরো কিছুক্ষণ চলার পর হঠাৎ পিনাকের সতর্ক কান সবাইকে থামিয়ে দিল। কোথায় যেন একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে? কয়েক মুহূর্তের মধ্যে শব্দের উৎস স্পষ্ট হয়ে গেল। বাঁকের ওপাশ থেকে কেউ যেন খচমচ শব্দ করে ছুটে আসছে! সে কে? সেই উড়ন্ত দানব নাকি? জংলিরা কেউ?

সঙ্গে সঙ্গে দেওয়ালের গা ঘেষে সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল। সুদীপ্ত রিভলভারের একটা মাত্র কার্তুজ সম্বল করে প্রস্তুত হল আগন্তুকের মোকাবিলা করার জন্য। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বাঁকের মুখে আবির্ভূত হল এক ছায়ামূর্তি। মেঝেতে একটা পাথরের খণ্ড পড়েছিল। টলমল পায়ে বাঁক ফিরতে গিয়ে পাথরে হোঁচট খেয়ে মাটিতে ছিটকে পড়ে সেই ছায়ামূর্তি আর্তনাদ করে উঠল, হায় ঈশ্বর!

পিনাক মশালটা তুলে ধরল। আরে এ যে তানাকা!

সবাই ঝুঁকে পড়ল তার ওপর। রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার দেহ! ছিন্নভিন্ন পোশাক! কেউ যেন ছুরি দিয়ে ফালা ফালা করে চিরেছে তাকে। বীভৎস দৃশ্য। হাঁফাতে হাঁফাতে তানাকা বললেন, জল দাও, জল!

সুদীপ্ত তাড়াতাড়ি বোতল থেকে জল ঢেলে দিল তার মুখে। অলিভিয়েরা তাঁকে প্রশ্ন করলেন, আপনার এ অবস্থা কীভাবে হল? আপনি কি সেখানে পৌঁছেছিলেন? প্রচণ্ড যন্ত্রণাতেও যেন আবছা হাসি ফুটে উঠল তানাকার ঠোঁটে। তিনি বললেন, হ্যাঁ পৌছেছিলাম। আমি আবিষ্কার করেছি সে গুহা।

হেরম্যান বললেন, আপনি কী দেখলেন সেখানে?

তানাকা দম নিয়ে বললেন, ম্যাপটা পৌঁছে দিয়েছিল সে গুহাতে। বিরাট বড় গুহা। মাথার অনেক উঁচুতে ছাদ। বাইরে দিনের আলো তখন ফুটেছে। দেওয়ালের গায়ে একটা ফোঁকর দিয়ে বাইরে একটা ঝরনা নামতে দেখা যাচ্ছে ঠিক সেই গর্তর গা বেয়েই। বাইরে আলো দেখা যাচ্ছিল। গুহাটার মেঝেতে অনেক গর্ত। ঝরনার জল কিছুটা চুঁইয়ে ভিতর ঢুকে সেই গর্তগুলোকে ছোট ছোট ডোবাতে পরিণত করেছে। দেখলাম সেই ডোবার জলগুলো টগবগ করে ফুটছে! অসহ্য গরম গুহার ভিতর। যেন চামড়া জ্বলে যাচ্ছে। আমি দেখতে লাগলাম খনিটা। প্রচণ্ড দুর্গন্ধ খনির ভিতর। মাংস-পঁচা গন্ধ! রুমাল বার করে আমি নাক চাপা দিতে যাচ্ছি, ঠিক তখনই…। তানাকা কথা বন্ধ করলেন, অলিভিয়েরা সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলেন, তখন কী?

বিস্ফারিত চোখে তানাকা বললেন, তখনই আমি গুহার আধো অন্ধকারে দেখতে পেলাম প্রাণীটাকে। যার কথা আমি বিশ্বাস করিনি। কী বীভৎস তাকে দেখতে! এ পৃথিবীর চেনা কোনো প্রাণীর সঙ্গে তার মিল নেই। দেওয়ালের গায়ে একটা থাকের গায়ে ডানা ছড়িয়ে বসে ভাঁটার মতো চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে সে। ঠিক যেভাবে ইঁদুরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে পেঁচা তাকে দেখে। আবারও থেমে গেলেন তিনি। হাঁপ ধরছে। সুদীপ্ত কয়েক ফোঁটা জল দিল তার মুখে। তারপর তিনি বললেন, আমি সঙ্গে সঙ্গে রিভলভার বার করে মুহূর্তের মধ্যে ক’টা গুলি চালিয়ে দিলাম প্রাণীটার বুক লক্ষ্য করে। ‘আ-হু-উ-উ-ল’! তীক্ষ্ণ চিৎকার করে থাকের ওপর থেকে নীচে জলে পড়ে গেল গুলিবিদ্ধ প্রাণীটা। সে ছটফট করছে। আরও দুটো গুলি ছিল, সে দুটো দিয়ে প্রাণীটার যন্ত্রণা আমি শেষ করতে যাচ্ছি ঠিক তখনই আমার মাথার ওপর থেকে নেমে এল একটা ছায়া! কালো ছাদের সঙ্গে মিশে ছিল সে। আমি খেয়াল করতে পারিনি। কথা থামিয়ে আতঙ্কে চোখ বন্ধ করলেন তানাকা। তার শরীর থরথর করে কাঁপছে।

অলিভিয়েরা উত্তেজনায় বলে উঠলেন, তারপর? তারপর?

অতিকষ্টে আবার চোখ মেললেন তানাকা। কাঁপা কাঁপা হাতে হাতটা উঠিয়ে অলিভিয়েরার হাতটা ধরে বললেন, তারপর কী হল আমাকে দেখে বুঝতে পারছ না? পালিয়ে এলাম ঠিকই, তবে আমি বাঁচব না। একটা শেষ অনুরোধ। খনিটা আমি খুঁজে পেয়েছি। তুমি বেঁচে ফিরলে ও পাহাড়ের নাম রেখো ‘তানাকা হিল’। কথাটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে তার হাতটা খসে পড়ল অলিভিয়েরার হাত থেকে। একটু কেঁপে উঠে চিরদিনের মতো স্থির হয়ে গেল তার দেহ।

হেরম্যান আক্ষেপের স্বরে বললেন, লোভ মানুষকে শেষ করে। মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত নাম-যশের মিথ্যা আকাঙ্ক্ষা তার পিছু ধাওয়া করে। তানাকার শেষ অনুরোধ তার প্রমাণ ।

অলিভিয়েরা বললেন, এ লোকটাই আমাদের মেরে ফেলতে চেয়েছিল। তবে মৃত্যুপথ-যাত্রীর শেষ অনুরোধ আমি রাখার চেষ্টা করব। —এই বলে তিনি তানাকার পকেট হাতড়ে রক্তমাখা ম্যাপটা বার করে নিলেন। হেরম্যান স্বগতোক্তি করলেন, তার মানে প্রাণীটা সত্যিই আছে! একটা নয়, দুটো! অথবা তার বেশি! তানাকার দেহটা যত্ন করে সুড়ঙ্গর একপাশে শোয়ানো হল। তারপর আবার সামনে এগোল সবাই। কিছুটা

এগিয়ে দেখা গেল পাশ থেকে একটা সুড়ঙ্গ এসে মিলেছে সুদীপ্তদের পথের সঙ্গে। দেওয়ালের গায়ে টাটকা রক্তের ছাপ লেগে আছে। অলিভিয়েরা বললেন, তানাকা এ পথ দিয়েই আমাদের সুড়ঙ্গে এসেছিলেন। এই ছোট সুড়ঙ্গটা সম্ভবত কালো পাহাড়ের নীচে সেই খনি-গুহাতে গেছে। সেই সুড়ঙ্গের দিকে তাকিয়ে আবার সুদীপ্তরা নিজেদের পথ ধরে চলতে লাগল। পিছনে পড়ে রইলেন তানাকা।

আরো ঘণ্টাখানেক সময় পেরিয়ে গেল। অসহ্য গরম যেন আর সহ্য হচ্ছে না। দেওয়ালে হাত ছোঁয়ালে যেন ছেঁকা লাগছে। সুড়ঙ্গর বদ্ধ বাতাস এত গরম হয়ে গেছে যে শ্বাস নেওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে। অলিভিয়েরা আক্ষেপের সুরে একবার বলে উঠলেন, এখানেই না আমাদের শেষ পর্যন্ত সমাধি হয়ে যায়! বাইরে পৌঁছতে এত দেরি হবার তো কথা নয়!

হেরম্যান বললেন, হার্জেলের ম্যাপটা একবার দেখুন না?

অলিভিয়েরা ম্যাপটা বার করলেন। হেরম্যান ঝুঁকে পড়লেন তার ওপর। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাদের মুখ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সুদীপ্তর দিকে মুখ তুলে হেরম্যান বললেন, বাইরে যাবার রাস্তাটা আমরা আজ সকালে পিছনে ফেলে এসেছি। তানাকার সঙ্গে আমাদের শেষ সাক্ষাৎ যেখানে হয় সেখানে বাঁকের মুখে আর একটা সুড়ঙ্গ ছিল। ঘটনার আকস্মিকতায় পথ ভুল করে ফেলেছি আমরা! সারাদিন ধরে সুড়ঙ্গর মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছি।

সুদীপ্ত বলল, এ সুড়ঙ্গ তবে কোথায় শেষ হয়েছে?

অলিভিয়েরা জবাব দিলেন, কালো পাহাড়টার কাছে কোনো এক জায়গাতে। তবে এ পথ শেষ হয়ে এসেছে মনে হয়। পিছনে ফেরার আর কোনো প্রশ্ন নেই, তা সম্ভবও নয়। হেরম্যান বললেন, কপালে যা আছে হবে, সামনেই এগোব।

সুদীপ্তরা আবার হাঁটতে শুরু করল। কিছুটা এগোতেই মশালের আলোতে এক অদ্ভুত দৃশ্য পেল তারা। সারা মাটি ঢেকে গেছে অজস্র পিঁপড়ে আর পোকায়। তাদের স্রোত এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। এমনকী দেওয়াল বেয়ে সেদিকে এগোচ্ছে মাকড়সারাও। প্রচণ্ড গরমে মাটির নীচ থেকে, দেওয়ালের ফাটল থেকে বেরিয়ে পড়েছে কীটপতঙ্গের ঝাঁক। পিনাক সে দিকে তাকিয়ে বলল, কিছু একটা ভয়ংকর কাণ্ড ঘটতে চলেছে। “

এরপর একটা বাঁক ফিরতেই সুড়ঙ্গর উন্মুক্ত মুখ দেখা গেল!’ঝাঁকে ঝাঁকে পোকামাকড় সেখান দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। সুদীপ্তরা সাবধানে উঁকি দিল। বিকেল হতে চলেছে বাইরে। উল্টোদিকে চোখে পড়ছে সেই কালো পাহাড়টা। তার মাথার ওপর থেকে ঝরনা নেমে এসেছে। এত দূর থেকে ঠিক সেটার অবস্থান অনুমান করতে পারল না সুদীপ্তরা। অলিভিয়েরা বললেন, এই সেই জায়গা যেখানে আমি তাঁবু ফেলেছিলাম!