৭
আলো যখন ভালো করে ফুটল তখন সুদীপ্তরা দেখতে পেল তাদের সামনেই একটা বেশ বড় পাহাড়। এ পাহাড়ের বিশেষত্ব হল পাহাড়টা প্রায় খাড়া ওপর দিকে উঠে গেছে। পাদদেশে গভীর জঙ্গল থাকলেও তার গা-টা ন্যাড়া। বড় বড় পাথরখণ্ড দাঁত বার করে আছে তার গা থেকে।
কাছেই একটা টিলার ওপর উঠল তারা। জঙ্গলের ভিতর একটা নদীখাত চোখে পড়ল তাদের। হেরম্যান বললেন, আমরা সম্ভবত উপত্যকাটির ঠিক মাঝখানে অবস্থান করছি। এখানে একটু বিশ্রাম নিয়ে উঠে পড়তে হবে। জংলিগুলো আমাদের পিছু ধাওয়া করতে পারে। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে অনেকক্ষণ ছুটলেও আসলে খুব বেশি পথ অতিক্রম করতে পারিনি আমরা। ওই ন্যাড়া পাহাড়টাকে বেড় দিয়ে ওপাশের উপত্যকায় পৌঁছলে কিছুটা নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে।
সুদীপ্ত বলল, আহুলের সন্ধানে কি তবে ইতি টানলাম আমরা?
হেরম্যান বিষণ্ন হেসে বললেন, আমাদের যা ছিল তা সবকিছুই জংলিগুলোর হাতে খোয়ালাম। এভাবে তো আর জঙ্গলে ঘোরা যাবে না। এখন যদি প্রাণীটা নিজে থেকে আমাদের দেখা দেয় সে অন্য কথা।
টিলার ওপর কিছুক্ষণ বসে থাকার পর সুদীপ্তরা আবার সামনের জঙ্গলে ঢুকল পাহাড়টাকে বেড় দিয়ে এই উপত্যকার বাইরে যাবার জন্য।
কিছুটা পথ এগোবার পর জঙ্গলের মধ্যে একটা নদীখাত চোখে পড়ল তাদের। তিরতির করে জল বয়ে চলেছে তাতে। গোড়ালি পর্যন্ত জল। তিনজনেই সেই জলে নেমে মুখে-হাতে জল দিল, জলপান করে কিছুটা সুস্থবোধ করল। পিনাক বলল, এই পাহাড়টার কোথাও একটা জলের উৎস আছে। সেখান থেকেই জলটা আসছে।
সুদীপ্ত বলল, এটা কালকের বৃষ্টির জলও তো হতে পারে। হয়তো পাহাড় ধুয়ে নীচে নেমে এসেছে।
পিনাক বলল, উপত্যকার এ অংশে খুব বেশি বৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হয় না। দেখুন, এখানকার গাছের পাতাগুলো ধূসর, ধুলোমাখা। বৃষ্টির জল ধুলো মুছতে পারেনি। তাছাড়া নদীর জল স্বচ্ছ। প্রথম বৃষ্টির জল ঘোলা হয়। সব আবর্জনা ধুয়ে সে জল নদীতে নামে।
পিনাকের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই হেরম্যান হঠাৎ এক ঝটকায় সুদীপ্তর কোমর থেকে রিভলভারটা টেনে নিয়ে সামনের দিকে তাক করলেন। নদীর মাঝখানে বেশ বড় একটা পাথরের চাঁই পড়ে আছে। হেরম্যানের দৃষ্টি অনুসরণ করে সুদীপ্ত দেখতে পেল, তার আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে একটা মানুষের মাথা!
পিনাকও ছুরিটা খুলে হাতে নিল। লোকটা অসভ্য-জংলি হলে তার সঙ্গীরাও নিশ্চয় কাছাকাছি আছে!
কিছুক্ষণ উভয়পক্ষই পরস্পরের দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর পাথরের আড়াল থেকে উঠে দাঁড়াল লোকটা। তার হাতেও ধরা আছে একটা তির-ধনুক। তিরের আগায় ছটফট করছে একটা মাছ।
কিন্তু এ লোকটা তো জংলি নয়, পরনে ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক হলেও লোকটা ইউরোপিয়ান। মাথায় একরাশ সোনালি চুল। রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গেলেও লোকটা যে বেশ ফরসা তা বোঝা যাচ্ছে। এই নাম-গোত্রহীন পাহাড়ি অরণ্যপ্রদেশে সভ্য মানুষ? সুদীপ্তরা তাকে দেখে বেশ অবাক হয়ে গেল। লোকটার চোখে-মুখে বিস্ময় ফুটে উঠেছে।
লোকটাই প্রথমে মুখ খুলল, তোমরা কারা? কীভাবে এখানে এলে?
হেরম্যান জবাব দিলেন, আমরা প্রকৃতিবিদ। সলকের রেইন ফরেস্ট দেখতে এসে জংলিদের হাতে ধরা পড়েছিলাম। তারপর পালিয়ে এখানে এসে পৌঁছেছি। আপনি? লোকটা জবাব দিল, আমার নাম অলিভিয়েরা! একজন ওলন্দাজ ধাতুবিদ।
অলিভিয়েরা! নাম শুনে চমকে উঠল সবাই। দিনে দুপুরে তারা ভূত দেখছে না তো?
বিস্মিত হেরম্যান বলে উঠলেন, আপনি বেঁচে আছেন? খবরের কাগজে আপনার কথা বেরিয়েছিল। আপনার ডায়েরি আর দেহাংশ পাওয়া গিয়েছিল। সবাই তো জানে আপনি মারা গেছেন!
লোকটা জবাব দিল, সেটা ভাবাই স্বাভাবিক। তবে মৃত্যুর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে এখনো বেঁচে আছি। এখানে অন্য কোনো পশুপাখি পাওয়া যায় না। নদীর পাথরের খাঁজে ছোট ছোট মাছ পাওয়া যায়। আমার আস্তানা ছেড়ে খাদ্যের সন্ধানে প্রাণ হাতে করে দিনের বেলা মাঝে মাঝে এখানে আসি। তাই আপনাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
হেরম্যান বললেন, কিন্তু আপনার দেহ তো জঙ্গলে পাওয়া গিয়েছিল! শনাক্তকরণও হয়েছিল! তবে?
অলিভিয়েরা বললেন, ওটা আমার দেহ নয়। সম্ভবত তার গায়ে আমার পোশাক ও জিনিসপত্র দেখে এবং সে লোকও একজন ইউরোপিয়ান বলে লোকে তা আমার দেহ বলে মনে করেছে। ভালো করে পরীক্ষা করলেই বুঝতে পারত সে লোকের সঙ্গে বয়সের ফারাক অনেক। তবে আমি সত্যিই অলিভিয়েরা। এই দেখুন। ডান বাহুটা দেখালেন তিনি। সেখানে উল্কি লেখা—অলিভিয়েরা।
তাহলে তিনি কে? জানতে চাইল সুদীপ্ত।
অলিভিয়েরা নামেরা লোকটা বলল, সে অনেক কথা। কিন্তু এখানে থাকা আমাদের উচিত হবে না। অসভ্য জংলিগুলো এখানে যে-কোনো সময় আপনাদের পিছু ধাওয়া করে চলে আসতে পারে। এই উপত্যকাটা ওদেরই এলাকা। আর কথা বলা যাবে না এখানে। আপনারা আমার সঙ্গে চলুন। তাছাড়া আমার প্রতীক্ষায় অপেক্ষা করছেন আরও একজন। তিনিও আমার কথা শুনতে উদ্গ্রীব। আমরা পাঁচজন আগে একত্রিত হই, তারপর এই মৃত্যু উপত্যকা থেকে পালাতে হবে আমাদের।
কে তিনি? হেরম্যান প্রশ্ন করলেন।
জল ছেড়ে পাড়ের দিকে এগোতে এগোতে অলিভিয়েরা বললেন, তিনিও আমাদের মতোই জংলিদের হাত থেকে পালিয়ে এখানে এসেছেন। একজন প্রকৃতিবিদ। জাপানি ভদ্রলোক। নাম বলছেন, মিস্টার তানাকা।
মিস্টার তানাকা? এ পথে আসার সময় তাঁর সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছিল। তাঁর সঙ্গী একজনকে আমরা মরতে দেখেছি, তিনি আপনার ওখানে আছেন? বলে উঠল সুদীপ্ত ৷
অলিভিয়েরা বললেন, হ্যাঁ। তিনিই। আপনাদের সমগোত্রীয় লোক। গতকালই তিনি এসেছেন। তাঁকে রেখে আমি খাদ্যের সন্ধানে বেরিয়েছিলাম। জল থেকে উঠে সুদীপ্তরা অনুসরণ করল তাঁকে।
নদীর একটু তফাতেই গভীর বন। চারজন ঢুকল সে বনে। হেরম্যান এগোতে এগোতে নিজেদের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় জানিয়ে দিল তাঁকে। তাঁর ডায়েরি যে সুদীপ্ত আর হেরম্যানকে এখানে আসার জন্য আকৃষ্ট করেছে হেরম্যান সেটাও জানিয়ে দিলেন তাঁকে। লোকটা শুধু তাঁর ডায়েরির কথা শুনে অস্পষ্টভাবে হাসলেন, তারপর সতর্ক দৃষ্টিতে চারদিকে আর আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতে এগোলেন বনের মধ্যে দিয়ে।
বিরাট বিরাট গাছ। চার-পাঁচজন মানুষও একসঙ্গে বেড় দিয়ে সেই গাছগুলোর গুঁড়ি ধরতে পারবে না। গাছগুলো তাদের ডালপালা মেলে সোজা আকাশের দিকে উঠে গেছে। তবে গাছগুলোর নীচের অংশে বিশ-ত্রিশ ফুট ওপর পর্যন্ত গাছের গুঁড়ি দেখা যায় না। বর্ষাবনের অসংখ্য লতাগুল্ম আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে তাদের। অনেকটা কচুপাতার মতো বিরাট বিরাট পাতাঅলা লতাগুল্মের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে গুঁড়িগুলো। ঠিক তেমনই একটা গাছের সামনে এসে দাঁড়ালেন অলিভিয়েরা। গাছের গুঁড়ির গায়ের পাতাগুলো সরাতেই সুদীপ্তরা অবাক হয়ে গেল। বেশ বড় একটা গহ্বর আছে সেখানে।
অলিভিয়েরা সুদীপ্তদের মনের কথা বুঝতে পেরে বললেন, অবাক হওয়াটাই স্বাভাবিক। আরও অবাক হলেন। আমিও অবাক হয়েছিলাম। এর ভিতর দিয়েই আমাদের রাস্তা। আসুন…। —এই বলে তিনি মাথা নীচু করে প্রবেশ করলেন গাছের গুঁড়ির মধ্যে। –
গুঁড়ির ভিতর থেকে সংকীর্ণ সিঁড়ির ধাপ নেমে গেছে নীচের দিকে। মনুষ্যসৃষ্ট সিঁড়ি। অলিভিয়েরার পিছন পিছন অতি কষ্টে সেই সিঁড়ি বেয়ে কিছুটা নীচে নামল সুদীপ্তরা। দেওয়াল হাতড়ে একটা মশাল বার করে অলিভিয়েরা সেটা জ্বালালেন। আলোকিত হয়ে উঠল সেই গহ্বর। সামনে একটা লোহার দরজা। সেটা খুলে সুদীপ্তদের নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন তিনি। সামনে একটা সুড়ঙ্গ। পাথুরে মেঝে, দেওয়াল, ছাদ। সংকীর্ণ সুড়ঙ্গটা সোজা হয়ে চলে গেছে সামনের দিকে।
হেরম্যান বিস্মিতভাবে বললেন, কারা বানিয়েছিল এ সুড়ঙ্গ? সুমাত্রা-জাভাতে জঙ্গলে অনেক সময় প্রাচীন হিন্দু স্থাপত্যের চিহ্ন দেখা যায়। মন্দির, সুড়ঙ্গ এসব। আমরা কয়েক বছর আগে সুন্দা দ্বীপমালায় এমনই এক মন্দির, প্রাচীন সুড়ঙ্গ দেখেছিলাম, এটা তেমনই কিছু কি? এ সুড়ঙ্গ কোথায় গেছে?
অলিভিয়েরা বললেন, এ সুড়ঙ্গটা প্রাচীন ঠিকই। তবে অত প্রাচীন নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সেনারা এ সুড়ঙ্গ বানিয়েছিল। এক কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ এই সুড়ঙ্গপথ সোজা চলে গেছে ওই কালো পাহাড়টার দিকে এক জায়গাতে। এরপর আর কোনো কথা না বলে অলিভিয়েরা এগোলেন সে সুড়ঙ্গ ধরে।
মাটির নীচে থাকার কারণে সাধারণত সুড়ঙ্গ ঠান্ডা হয়, কিন্তু সুড়ঙ্গপথ যত এগোতে লাগল গরম তত বাড়তে লাগল। চলতে চলতে অলিভিয়েরা স্বগতোক্তির স্বরে একবার বললেন, আমি তো অনেকদিন এখানে বন্দিজীবন কাটাচ্ছি। মাটির নীচে এত গরম কিন্তু আগে ছিল না। হয়তো বাইরে প্রকৃতি পরিবর্তনের কারণে এমন ঘটেছে।
হেরম্যান জিজ্ঞেস করলেন, আপনার সঙ্গে মিস্টার তানাকার দেখা ঠিক কীভাবে হল? তিনি জবাব দিলেন, এখানে কিছু প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গও আছে। তার সঙ্গে এ সুড়ঙ্গের যোগ আছে। পাহাড়ের গায়ে তেমনই এক প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গ বা গুহায় প্রাণ বাঁচাতে ঢুকে পড়েছিলেন তিনি। তারপর তিনি পৌঁছে যান আমার কাছে। গতকাল রাতে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে আমার।
অলিভিয়েরাকে অনুসরণ করে এরপর নিশ্চিতভাবে তারা এগিয়ে চলল সেই সুড়ঙ্গপথে। প্রায় সোজাই এগিয়েছে সুড়ঙ্গটা। মাঝে মাঝে কিছু লোহার গরাদঅলা দরজাও আছে। কোনোটার পাল্লা ঠেলে সরিয়ে এগোতে হচ্ছে, কোনোটার আবার দীর্ঘদিন থাকতে থাকতে মরচে পড়ে ক্ষয়ে গিয়ে পাথুরে দেওয়ালের গা থেকে ঝুলছে। বেশ অনেকটা পথ এগোবার পর সুড়ঙ্গের গায়ে বেশ কিছু ছোট ছোট ঘরও মাঝে মাঝে চোখে পড়তে লাগল। কয়েদখানার মতো কুঠুরি। দরজায় লোহার গরাদ বসানো। সুড়ঙ্গের মধ্যে এরপর নানা ধরনের লোহার যন্ত্রাংশও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে দেখতে পেল তারা। এমনকী এক জায়গাতে লোহার বাসনপত্রও পড়ে আছে। তবে সবই অনেক পুরনো জিনিস। ধুলো আর মাকড়সার জালে ঢাকা। সুড়ঙ্গ দিয়ে যাবার সময় মশালের আলোতে একটা গরাদঅলা ঘরের ভিতর দরজার সামনেই ধুলোমাখা বেশ কিছু কঙ্কাল দেখতে পেয়ে সুদীপ্ত চমকে উঠে বলল, এগুলি কাদের কঙ্কাল?
অলিভিয়েরা জবাব দিলেন, সম্ভবত ওই অসভ্য জংলিদের। এক সময় এখানে তারা আটক ছিল। সব বলছি পরে। আরও কিছু ঘরে অমন কঙ্কাল পড়ে থাকতে দেখেছি। একসময় সুড়ঙ্গ শেষ হল। সুদীপ্তরা এসে উপস্থিত হল একটা বড় ঘরে। নানা ধরনের ধাতব যন্ত্রাংশ, বড় বড় টেবিল, কাচের পাত্র ছড়িয়ে রয়েছে সে ঘরে। দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত জিনিসপত্র সব। সুদীপ্তর মনে হল, একসময় এ ঘরটা কোনো গবেষণাগার বা ওই ধরনের কোনো ঘর ছিল। এমনই বেশ ক’টা ঘর পর পর পার হয়ে অবশেষে তারা এসে দাঁড়াল একটা ঘরে। সে ঘরের চারদিকে বেশ কয়েকটা লোহার গরাদঅলা দরজা আছে। অফিস রুমের মতো ঘরটাতে বেশ কিছু প্রাচীন আসবাবপত্রও আছে। এ ঘরটা সম্ভবত ব্যবহার হয়। ঘরের দেওয়ালের গায়ে একটা মশাল জ্বলছে। সে ঘরেই একটা চেয়ারে বসেছিলেন মিস্টার তানাকা। অলিভিয়েরার সঙ্গে সুদীপ্তদের দেখতে পেয়ে তিনি বিস্মিতভাবে উঠে দাঁড়ালেন।
হেরম্যান তাঁর দিকে এগিয়ে গিয়ে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে বললেন, আপনার সঙ্গে এই অদ্ভুত জায়গাতে আমাদের দেখা হবে ভাবিনি।
মিস্টার তানাকা করমর্দন করে নিস্পৃহ স্বরে বললেন, এখানে দেখা হবে আমিও ভাবিনি। পরশু বিকেলে একটা পাহাড়ের মাথায় জঙ্গলের ভিতর অসভ্য জংলিদের পাল্লায় পড়লাম। আমার সঙ্গী দুজন সম্ভবত মারা পড়েছে। আমি এখানে চলে এসেছি। কথাগুলো বলে চেয়ারে বসে পড়লেন তানাকা। সুদীপ্ত তাঁকে দেখে ঠিক বুঝতে পারল না যে তাদের আগমনে তিনি ঠিক খুশি হয়েছেন কিনা। এমনও হতে পারে যে মানসিক উত্তেজনা আর ক্লান্তিতে তিনি অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।
তানাকার আশপাশেই বদল সবাই। হেরম্যান তানাকার উদ্দেশ্যে বললেন, আপনার মতো আমাদেরও একই অবস্থা। আপনার এক কুলির দুরবস্থা দেখে আপনাকে খুঁজতে গিয়ে জংলিদের ফাঁদে ধরা পড়লাম। তারা আমাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল। কোনোরকমে পালিয়ে এসেছি।
মিস্টার তানাকা যেন খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করলেন না সে কথায়। অলিভিয়েরার উদ্দেশে তিনি বললেন, আমরা কীভাবে এখানে এসেছি তা তো আপনি শুনেছেন। কিন্তু আপনার এখানে আসা কীভাবে, কেন, কীভাবে আপনি একলা এখানে দিন কাটাচ্ছেন তা আমার জানা হয়নি। অনুগ্রহ করে সেটা এবার বলুন।
মিস্টার তানাকা অনুগ্রহ শব্দটা ব্যবহার করলেও অলিভিয়েরার প্রতি তাঁর কথাগুলো সুদীপ্তর কানে অনেকটা নির্দেশের মতোই শোনাল।
অলিভিয়েরা বললেন, সে কাহিনি বলার আগে বলে নিই আমরা যত দ্রুত সম্ভব এ তল্লাট ছেড়ে যেতে পারি ততই মঙ্গল। সম্ভব হলে আজ দিনের আলো থাকতে থাকতেই আমরা বেরিয়ে পড়তে পারি। দক্ষিণ দিকে সমুদ্র একদিনের পথ। একটা খাঁড়ি আছে সেখানে। কাঠুরেদের নৌকা সেখানে যাওয়া-আসা করে। আমি একবার সে জায়গা পর্যন্ত পৌঁছেছিলাম। পাঁচজন একসঙ্গে থাকলে বিপদের সম্ভাবনা কম হবে।
এ কথা বলার পর অলিভিয়েরা শুরু করলেন তাঁর সেই কাহিনি। অভিযানের প্রথম দিন থেকেই তিনি শুরু করলেন তাঁর কথা। মন দিয়ে তাঁর কথা সবাই শুনতে লাগল। তার একটা অংশ সুদীপ্তদের জানা। নির্জন পার্বত্য উপত্যকায় সেই রাতের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা বিবৃত করার পর অলিভিয়েরা সুদীপ্তর দিকে তাকিয়ে বললেন, এ পর্যন্ত ঘটনা হয়তো আপনারা আমার ডায়েরির মাধ্যমে জেনে থাকতে পারেন। তারপর আর লেখার সুযোগ হয়নি, কারণ, আমার কলমটা আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। যাই হোক তার পরের ঘটনা বলি—
যে রাতে আমি আমার সঙ্গী ইরিয়ানকে হারালাম সেই বিভীষিকাময় রাত্রির অবশেষে পরিসমাপ্ত হল। সে রাত আমি তাঁবুর মধ্যে ভায়েরি লিখেই কাটিয়েছিলাম। পরদিন ভোরের আলো ফোঁটার পর বাইরে বেরোলাম। সব কিছু শান্তই মনে হচ্ছে। কালো পাহাড়টার মাথা থেকে ঝরনার জল নেমে আসছে। তার আড়ালে সেই গুহাটাও দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। ঠিক করেছিলাম কালো পাহাড়টা অর্থাৎ ক্রেটারের মাথায় উঠে দেখব কোনো দিকে কোনো পথ পাওয়া যায় কিনা, কিন্তু দিনের আলোতে ভালো করে দেখলাম পাহাড়ের গা-টা খুবই মসৃণ, শুধু ঝরনা যেখানে নেমেছে সেখানে পাথরের গায়ে কিছু ধাপ আছে। আমি ঠিক করলাম সেদিক দিয়ে একবার ওপরে ওঠার চেষ্টা করব। যদি ওপাশের ঢালে কোনো পথ পাওয়া যায়। তাঁবুতে ফিরে এসে অতি প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস সঙ্গে নিলাম। তারপর এসে দাঁড়ালাম সেই ঝরনার জল-জমা ডোবাটার সামনে। ওর পাশ দিয়ে এগিয়ে গুহার গায়ে পাথরের খাঁজ বেয়ে আমাকে ওপরে উঠতে হবে। যা আছে কপালে বলে আমি এগোতে যাচ্ছি হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে সেই ডোবার ভিতর থেকে উঠে দাঁড়াল দুজন প্রায় উলঙ্গ, মুখে উল্কি আঁকা মানুষ! তাদের একজনের হাতে তির-ধনুক, অন্যজনের হাতে ইরিয়ানের মতো কর্তিত হাতসমেত বোলোটা। জল ছেড়ে তারা উঠে আসতে লাগল আমার দিকে। কিছু একটা হতে চলেছে অনুমান করে আমি রাইফেলটা কাঁধ থেকে হাতে নিতে না নিতেই তির-ধনুক হাতে লোকটা তির চালিয়ে দিল আমাকে লক্ষ করে। তিরটা এসে বিঁধল আমার ঊরুতে আমিও গুলি চালিয়ে দিলাম সঙ্গে সঙ্গে। ব্যাঙের মতো ডিগবাজি খেয়ে জলে ছিটকে পড়ল লোকটা। অপর জংলিটা ইরিয়ানের হাতসুদ্ধ দা-টা আমার দিকে ছুড়ে মারল, কিন্তু সে লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। আমি আবারও গুলি চালালাম। মাটিতে পড়ার আগে সে অদ্ভুত স্বরে ডেকে আর্তনাদ করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে যেন ডোবাটার ওপাশের জঙ্গলের ভিতর থেকে হাজারে হাজারে ব্যাঙ একসঙ্গে ডেকে উঠল! জঙ্গলের বাইরে আবির্ভূত হল মুখে সাদা রং মাখা আরও কিছু মানুষ। ডোবাতে ঝাঁপ দিল তারা সাঁতরে এপারে এসে আমাকে ধরার জন্য। এতজন মানুষের সঙ্গে লড়াই করা যাবে না। তাই প্রাণভয়ে তিরটা হাঁটু থেকে কোনোরকমে বার করে নিয়ে আমি ছুটলাম জঙ্গলের দিকে। দুর্বোধ্য ভাষায় চিৎকার করতে করতে আমার পিছনে ছুটে আসতে লাগল জংলিরা। সে এক উদ্ভ্রান্তের মতো দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছোটা! পিঠে ব্যাগ, পায়ে তিরের ক্ষত। বেশ কিছুক্ষণ ছোটার পর জংলিরা যখন আমাকে একটা পাথুরে দেওয়ালের কাছে প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেছে ঠিক তখনই সেই পাথুরে দেওয়ালের গায়ে একটা গুহামুখ দেখতে পেলাম। আমার কানের পাশ দিয়ে বাতাস কেটে একটা তির এসে টাং করে পাথরের দেওয়ালে লাগল। আমার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে বুঝতে পেরে আমি কোনোরকমে বাঁচার শেষ চেষ্টা করে নিজের দেহটা অন্ধকার গুহার মধ্যে ছুড়ে দিলাম। আর তার পরই আমার মনে হল গুহার নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে থেকে কে যেন টেনে নিল আমাকে। মুহূর্তের মধ্যে আমার মনে পড়ে গেল আগের রাতে সেই ঝরনার আড়ালে টর্চের আলোতে দেখা সেই ছায়াটার কথা! তাহলে কি সেই? অসীম আতঙ্কে জ্ঞান হারালাম আমি। এ পর্যন্ত কথাগুলো বলে অলিভিয়েরা থামলেন।
সবাই চুপ করে শুনছে তাঁর কথা। তিনি থামতেই মিস্টার তানাকা ভ্রূ কুঁচকে বললেন, তারপর? তারপর?
অলিভিয়েরা দম নিয়ে বললেন, তারপর আমার জ্ঞান ফিরল, তখন দেখলাম আমি এ ঘরে শুয়ে আছি। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক বৃদ্ধ। আমি প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তার পরনে পোশাক দেখে আশ্বস্ত হলাম। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে লোকটা জানাল তার নাম ‘ভন হার্জেল’। আমি এখন নিরাপদ। জংলিরা এখানে ঢুকবে না। তারপর সে জানতে চাইল যে আমি জার্মান নই তো? আমি আমার পরিচয় দিলাম। তারপর জানতে চাইলাম জঙ্গলের মধ্যে এ জায়গাটা কোথায়? সে তখন আমাকে এক অদ্ভুত ব্যাপার জানাল। সেই প্রথম দিন তার পরবর্তীকালে তার সঙ্গে আলাপচারিতায় এ জায়গা সম্বন্ধে আমি যা জানতে পেরেছিলাম তা সংক্ষেপে বলি। আপনারা হয়তো জানেন ১৯৪২ সালে জাপানিরা এই দ্বীপরাষ্ট্রের দখল নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান হাত মেলায় জার্মানির সঙ্গে। তার প্রাক্কালে হিটলার নারকীয় হত্যালীলা চালাচ্ছিল জার্মানি জুড়ে। শুধু গ্যাস চেম্বারের মাধ্যমেই নয়, আরও নতুন নতুন কৌশলে কীভাবে মানুষ মারা যায় তার জন্য পরীক্ষা চালাচ্ছিল হিটলারের অনুগত সামরিক কর্তারা। সেই পরীক্ষার জন্যই জাপানের অধিকৃত এই দ্বীপরাষ্ট্রে দুর্গম অরণ্যের মধ্যে আগ্নেয় পর্বতের পাদদেশে লোকচক্ষুর অন্তরালে তারা এই ক্যাম্প ও গবেষণাগার গড়ে তোলে। তেজস্ক্রিয় পদার্থ দিয়ে কীভাবে মানুষ মারা যায় তাই নিয়ে পরীক্ষা করা হত এখানে। প্রথমে নাকি এই দ্বীপরাষ্ট্রের বোর্নিওর গভীর জঙ্গল থেকে ধরে আনা হয় একদল অসভ্য বর্বর জনগোষ্ঠীকে। তারপর আকাশপথে জার্মানি থেকে আনা হতে থাকে দু-চারজন করে ইহুদিকে। বহু অসভ্য জাতীয় মানুষ এবং ইহুদি হিটলারের এই পরীক্ষাগারে তার বাহিনীর হাতে প্রাণ দেয়। হার্জেল ছিল ইহুদি। তার বাবা ছিলেন একজন ‘রাব্বি’ বা ধর্মপ্রচারক। নাৎসি বাহিনী যখন তাকে আর তার বাবাকে এখানে ধরে আনে তখন হার্জেলের বয়স চোদ্দো বছর। কিন্তু কপাল কিছুটা ভালো বলতে হবে হার্জেলদের। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের একদম অন্তিম লগ্নে তারা এখানে আসে। সময়ের চাকা ঘুরে গেল, পরাজিত হতে শুরু করলেন হিটলার। হার্জেলদের এখানে আসার কিছুদিনের মধ্যেই একদিন হঠাৎ জার্মানরা রাতের অন্ধকারে এ তল্লাট ছেড়ে পাড়ি জমাল তাদের দেশে। এখানে পড়ে রইল হতভাগ্য কিছু ইহুদি, আর বোর্নিও থেকে আনা সেই অসভ্য আদিম কিছু লোক। জার্মানরা চলে যাবার পরই সেই অসভ্যরা হঠাৎ কীভাবে যেন মুক্ত হয়ে সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর হল অন্য সমস্যা। ইহুদিরা মুক্ত হয়ে বাইরে আসতেই তথাকথিত জংলিরা আক্রমণ করে বসল তাদের। কারণ নাৎসি জার্মান আর ইহুদিদের মধ্যে পার্থক্য বোঝার ক্ষমতা ছিল না তাদের। সবাই যে সাদা চামড়া। অসভ্য জংলিদের অসম্ভব ঘৃণা জন্মে গিয়েছিল সাদা চামড়ার মানুষদের প্রতি। জনা পঁচিশ ইহুদি ছিলেন ক্যাম্পে। তার মধ্যে অধিকাংশই মারা পড়লেন জংলিদের আক্রমণে বিভিন্ন সময় পালাতে গিয়ে। তার মধ্যে হার্জেলের বাবাও ছিলেন। এরপর আবির্ভাব হল এক উড়ুক্কু আতঙ্কের। তার কবলে মারা পড়ল কেউ কেউ। একসময় বেঁচে রইল শুধু হার্জেল। জংলি আর সেই উড়ুক্কু দানবের জন্য বাইরের পৃথিবীতে পৌঁছবার পথ বন্ধ হয়ে গেল তার। হার্জেলের কাছে শুনেছি সেই উড়ুক্কু প্রাণী নাকি বহুদিন আগে থেকেই এ তল্লাটের বাসিন্দা। নাৎসি জার্মানরাও নাকি সে কারণে রাত্রে সুড়ঙ্গের বাইরে বেরুত না। হার্জেল বিগত প্রায় তিরিশ বছর এখানেই কাটিয়েছেন। তার শেষ সঙ্গীর মৃত্যু হয় তিরিশ বছর আগে।
মিস্টার তানাকা বললেন, ব্যাপারটা বুঝলাম। কিন্তু এখানে আসার পর কী ঘটল সেটা বলুন?
অলিভিয়েরা আবার বলতে শুরু করলেন, আমার পায়ের ক্ষতটা বিষিয়ে উঠেছিল। ক’দিন লাগল আমার সুস্থ হতে। তারপর হার্জেলের সঙ্গে আমি আলোচনা শুরু করলাম এখান থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায় তা নিয়ে। হার্জেল প্রথমে রাজি হচ্ছিল না। একলা থাকতে থাকতে সম্ভবত তার মাথায় একটু গণ্ডগোল হয়েছিল। তাছাড়া তার স্মৃতিতে নাৎসি অত্যাচারেরও স্মৃতি ছিল। মাঝে মাঝে সে এখানে এত বছর আছে তা-ও ভুলে যেত। সে ভাবত বাইরে বেরোলে সে শুধু জংলি বা উড়ুক্কু দানব নয়, নাৎসি জার্মানদের খপ্পরেও পড়তে পারে। যাই হোক শেষ পর্যন্ত সে রাজি হল। সমুদ্রের দিকে যাবার রাস্তাটা তার জানা ছিল। এই সুড়ঙ্গপথ ধরে একটা রাস্তা আছে। সে রাস্তা ধরে একদিন ভোরে আমরা বাইরে বেরোলাম। তারপর চলতে শুরু করলাম সমুদ্রের দিকে। সারা দিনটা জঙ্গলের মধ্যে চলার সময় নিরুপদ্রবেই কাটল আমাদের। সূর্য ডোবার কিছু আগে আমরা এই উপত্যকার একদম শেষ সীমানায় একটা টিলার মাথায় পৌঁছলাম। সেখান থেকে শেষ বিকেলের আলোতে দিকচক্রবাল বরাবর একটা রুপালি দাগ দেখতে পেলাম। ওখানেই সমুদ্রের খাঁড়িটা। টিলার বিপরীত দিকের ঢাল বেয়ে নামলেই সমতল ভূমি। তা আমাদের পৌঁছে দেবে সমুদ্রের কাছে। মুক্তির আনন্দে আমরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলাম। টিলার মাথার ওপর হাত পঞ্চাশেক সমতল জায়গাতে গা ঘেষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকটা বড় ঝাঁকড়া গাছ। আমরা সেখানেই রাত্রিবাসের সিদ্ধান্ত নিলাম।
বেশ বড় বড় প্রাচীন গাছ। তারই একটা গুঁড়ির নীচে বসলাম দুজন। অন্ধকার নামল, চাঁদও উঠল একসময়। দুজন মিলে নানা গল্প করতে লাগলাম। অনেকটা নিশ্চিন্ত আমরা। ভালো করে হেলান দিয়ে আরাম করে বসার জন্য বৃদ্ধ হার্জেল একসময় আমার কিছুটা তফাতে আর একটা গাছের নীচে বসল। চাঁদ ওঠার কিছু পর থেকেই বাতাসে একটা পচা গন্ধ পাচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে গন্ধটা তীব্র হচ্ছিল। হার্জেলও পেয়েছিল গন্ধটা। সে বলল, সম্ভবত কাছে কোথাও ছোটখাটো প্রাণী মরেছে। গন্ধটা তারই।
যাই হোক কথা বলতে বলতে পথশ্রমের ক্লান্তিতে আমার একটু ঢুলুনি মতো এসেছিল। হঠাৎ আমার মনে হল কিছুটা তফাতে একটা গাছের মাথার ওপরের দিকের একটা অংশ যেন হঠাৎই ওপর থেকে নীচে নেমে এল। তীব্র পচা একটা দুর্গন্ধে ভরে উঠল বাতাস। ভালো করে চোখ কচলে তাকাতেই দেখি হার্জেল নেই। আর তার পরই শুনতে পেলাম ভারী মতো কী একটা জিনিস টিলার ভিতরের দিকে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে নীচে নেমে যাচ্ছে। হার্জেল কি টিলার কিনারা থেকে ঘুম চোখে নীচে পড়ে গেল? সেই শব্দকে অনুসরণ করে কিছুটা নীচে নামতেই আমি চাঁদের আলোতে দেখতে পেলাম তাকে। তার মুণ্ডুহীন ধড়টা একটা গাছের তলায় পড়ে আছে। কী বীভৎস সেই দৃশ্য! আর এরপরই ওপর থেকে আমার সামনে ধপ করে খসে পড়ল একটা গোলাকার বস্তু। হার্জেলের মাথা। চমকে উঠে ওপরে তাকাতেই দেখি গাছের মাথার একটা অংশ দুলছে। অন্ধকার থেকে একজোড়া লাল চোখ যেন নীচে নেমে আসার আগে আমাকে দেখছে! এরপর আমার আর কিছু ভালো করে দেখার অবস্থা ছিল না। ছুটতে শুরু করলাম আমি। কোন দিকে কোথায় যাচ্ছি জানা ছিল না। খালি মনে হচ্ছিল এই বুঝি আকাশ থেকে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল উড়ন্ত মৃত্যু। কিছুটা কাকতালীয়ভাবেই আমি পরদিন বিকেলবেলা দেখতে পেলাম এই সুড়ঙ্গমুখ। যা দিয়ে বাইরে বেরিয়েছিলাম আমি আর হার্জেল। আমি আবার ঢুকে পড়লাম এখানে। এই উপত্যকার প্রহরী হার্জেলকে আর পালাতে দিল না। একলা হয়ে গেলাম আমি। একটানা কথাগুলো বলে অলিভিয়েরা চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইলেন।