আহুল – ৬

লোকগুলো চলে যাবার পর তারা বেশ কিছুক্ষণ মড়ার মতো শুয়ে রইল। সারা শরীরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা। উঠবার শক্তি তাদের ছিল না। তারপর ধীরে ধীরে একে একে উঠে বসল সবাই। সুদীপ্ত, হেরম্যান, পিনাক…প্রায় পঞ্চাশ ফুট নীচে বেশ একটা চওড়া গর্তের মধ্যে আটক করা হয়েছে তাদের। মাথার ওপরে ফাঁকা জায়গা দিয়ে মেঘাচ্ছন্ন সলকের ধূসর আকাশ দেখা যাচ্ছে।

গর্তর ভিতরটা ভেজা স্যাঁতসেঁতে। গর্তের মাথার ঠিক ওপরেই একটা গাছ আছে। বছরের পর বছর ধরে গর্তের মধ্যে খসে পড়া রাশি রাশি পাতা তলদেশে পুরু একটা আস্তরণ তৈরি করেছে। তার ওপর ফেলা হয়েছিল সুদীপ্তদের। ফলে পতনজনিত কারণে চোট লাগেনি তাদের।

হেরম্যানই প্রথম মুখ খুললেন। চারপাশটা ভালো করে দেখে নিয়ে তিনি মন্তব্য করলেন, সম্ভবত কোনো একটা ক্রেটারের ভিতর ওরা আমাদের ছুড়ে ফেলে দিয়ে গেছে। সুদীপ্ত বলল, জংলিগুলো আমাদের নিয়ে কী করবে বলে মনে হয়?

হেরম্যান জবাব দিলেন, ক্যানিবল হলে আমাদের মেরে খাবে। তবে জাভার জঙ্গলে ক্যানিবল আছে বলে শুনিনি।

পিনাক বলল, আমিও জঙ্গলে অনেক ঘুরেছি। এ জঙ্গলে মানুষখেকো মানুষের কথা আমিও শুনিনি। আমরা যখন ধরা পড়লাম তখনই ওরা আমাদের মেরে ফেলতে পারত। কিন্তু তা না করে এত পরিশ্রম করে ওরা যখন আমাদের এতটা পথ বহন করে আনল, তখন এর পিছনে তাদের নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে।

হেরম্যান আর সুদীপ্তরও মনে হল পিনাকের অনুমান ঠিক।

সুদীপ্ত বলল, কিন্তু এখন কী করব আমরা?

হেরম্যান বললেন, আপাতত তো কিছু করার দেখছি না। এই মুহূর্তে পালাবার কোনো উপায় নেই। আমাদের হাত বাঁধা। ওপরে ওঠা যাবে না। তাছাড়া গর্তের বাইরে নিশ্চয়ই ওরা পাহারা দিচ্ছে। হাতিয়ার ছাড়া কীভাবে মোকাবিলা করব ওদের?

পিনাক বলল, হাত দুটো যদি কোনোভাবে খুলতে পারি তবে মরার আগে দু-চারটাকে মেরে ফেলব। এ হাতেই বাঘের টুটি চেপে ধরেছিলাম আমি।

লোকগুলোর প্রতি প্রচণ্ড আক্রোশ ফুটে উঠেছে পিনাকের মুখে। এরপর পিনাক হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে পাথুরে দেওয়ালের গায়ে তার হাতটা জোরে ঘরতে লাগল।

ঘাসের শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়েছে সুদীপ্তদের হাত। এ দড়ি সহজে ছেঁড়ার নয়। দড়ি আর পাথরের ঘষাতে কিছুক্ষণের মধ্যেই পিনাকের হাতের ছাল উঠে রক্ত বেরোতে শুরু করল। কিন্তু পিনাকের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। পাগলের মতো সে হাতটা ঘষছে। অতিরিক্ত উত্তেজনায় পিনাক কি শেষে পাগল হয়ে গেল? হেরম্যান তাকে নিবৃত্ত করার জন্য বলে উঠলেন, এ তুমি কী করছ পিনাক! শান্ত হও।

পিনাক তাঁর কথায় ভ্রূক্ষেপ না করে মাথার ওপর ওঠানো হাত দুটো পাথরের গায়ে ঘষেই যেতে লাগল। তার দড়িবাঁধা ক্ষতবিক্ষত কব্জি থেকে রক্তের ধারা মাটিতে পড়তে লাগল। পিনাক হয়তো সত্যি পাগল হয়ে গেছে। তাকে থামানো দরকার, এই ভেবে উঠে দাঁড়াল সুদীপ্ত। ঠিক সেই সময় পট্ করে একটা শব্দ হল। মাথার ওপর থেকে তার রক্তাক্ত হাতটা নামিয়ে আনিল পিনাক। অসহ্য যন্ত্রণাতেও তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। ধন্য তার ক্ষমতা, সহ্যশক্তি, দড়িটা ছিঁড়ে গেছে।

অবাক হয়ে সুদীপ্ত পিনাকের মুখের দিকে তাকিয়ে তারপর তাকাল পিনাক যেখানে হাত ঘষছিল সে জায়গাতে। পাথুরে দেওয়ালের গায়ে সে জায়গাতে পিনাকের হাতের এক টুকরো চামড়া লেগে আছে।

পিনাক মাটিতে বসে পড়ে বেশ কিছুক্ষণ হাঁফিয়ে নিয়ে হেসে বলল, বাঘের কামড় সহ্য করেছি তার তুলনায় এ আর কী যন্ত্রণা! তবে আঙুলগুলো অসাড় হয়ে গেছে। ঠিক হতে একটু সময় লাগবে।

সত্যি এ লোকটা বড় অদ্ভুত। সুদীপ্ত আর হেরম্যান অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে।

বেশ কিছুক্ষণ সময় কেটে গেল। পিনাক তারপর সুদীপ্তদের দিকে এগিয়ে এল দড়ির বাঁধন খোলবার জন্য। হেরম্যান তাকে বললেন, তোমাকে বেশি কষ্ট করতে হবে না। আমার বুটের মধ্যে একটা ছুরি লুকোনো আছে। ডান পা-টা পিনাকের দিকে বাড়িয়ে দিলেন তিনি। পিনাক ছুরিটা বার করে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সুদীপ্তদের বন্ধনমুক্ত করল। নিজের হাতটা পেটের কাছে নামাতেই জামার নীচে একটা জিনিসের স্পর্শ অনুভব করে সুদীপ্ত হেরম্যানকে বলে উঠল, আপনার রিভলভারটা আমার জামার তলায় কোমরে রয়ে গেছে! উত্তেজনায় ব্যাপারটা খেয়াল করিনি!

হেরম্যান শুনে বলে উঠলেন, যাক, ছুরি আর রিভলভারটা যখন আছে তখন মরতে হলে তার আগে লড়াই দেওয়া যাবে। ওরা রাইফেল-বন্দুক চালাতে জানে না। পিনাকের রাইফেল সে জায়গাতেই ছেড়ে এসেছে ওরা।

আর আমার হাতটাও আছে। বন্দুক-রাইফেলের চেয়ে কম ভয়ংকর নয়।—এই বলে তার মুষ্টিবদ্ধ হাত দেখাল পিনাক। এত কষ্টের মধ্যেও তার কথা শুনে হেসে ফেলল সুদীপ্তরা। হেরম্যান তাকে বললেন, হ্যাঁ, একদম ঠিক কথা। এরপর তিনি বললেন, দড়িগুলোকে আবার হাতের মধ্যে পেঁচিয়ে ফেলতে হবে। যাতে জংলিগুলো কিছু বুঝতে না পারে। বাঁধন খুলে যাওয়ায় আর রিভলভারটা থাকায় বেশ ভরসা পাচ্ছি।

কীভাবে মুক্তির উপায় খোঁজা যায় তা নিয়ে আলোচনা করছিল সুদীপ্তরা। হঠাৎ তাদের মনে হল ক্রেটারের ভিতর আলো যেন ধীরে ধীরে কমে আসছে। মাথার ওপর তাকাতেই তারা দেখতে পেল সলকের আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে! পিনাক বলল, বৃষ্টি নামবে!

তার কথাই কিছুক্ষণের মধ্যে সত্যি হল। আকাশ থেকে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামতে শুরু করল গর্তের ভিতর। প্রথম এক ফোঁটা, দু-ফোঁটা। তারপর ঝমঝম করে।

পিনাক বলল, বর্ষাবনের বৃষ্টি প্রথম দু-একদিন নামবে, থামবে। তারপর থেকে শুরু হয় টানা বৃষ্টি। পাহাড়ি নদীগুলো দু-দিনেই ফুলে-ফেঁপে ওঠে। বৃষ্টিতে সব কিছু মুছে যায় তখন।

হেরম্যান বললেন, এই বৃষ্টির সুযোগটা তো কাজে লাগানো যেতে পারে। যদি ওরা অন্য কোথাও চলে গিয়ে থাকে তবে পালাতে পারি আমরা। ওপরটা দেখে এলে হয়।

তার কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল সুদীপ্ত। যেদিক দিয়ে তাদের নীচে নামানো হয়েছে সেদিকে পাথুরে দেওয়ালের গায়ে ধাপ মতো আছে। সুদীপ্তকে দেখে হেরম্যানও উঠে দাঁড়ালেন। সেই দেওয়ালটার কাছে এগিয়ে দাঁড়ালেন দুজন। হেরম্যানের কাঁধো পা রেখে সুদীপ্ত পৌঁছে গেল নীচের তাকটাতে। তারপর ধাপ বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল। বাইরের পৃথিবীর বৃষ্টির জল এবার ওপর থেকেও দেওয়ালের গা বেয়ে নামতে শুরু করেছে। যে-কোনো মুহূর্তে হাত-পা পিছলে যেতে পারে। অতি সাবধানে ওপরে উঠতে লাগল সে। নীচে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন হেরম্যান আর পিনাক।

বেশ কষ্ট করেই সুদীপ্ত গর্তের মুখের কাছে উঠল। সে ইশারা করলেই হেরম্যানরা ওপরে উঠতে শুরু করবে। অতি সন্তর্পণে বাইরে তাকাল সুদীপ্ত। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাদের আশাভঙ্গ হল। প্রবল বর্ষণের মধ্যেও গর্ত আগলে বসে আছে দলটা। একজনকে তো সে হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবে! ব্যাপারটা দেখার সঙ্গে সঙ্গেই সে আবার নামতে শুরু করল।

গর্ভের নীচে বসে বসে সারাদিন ধরে তিনজন ভিজতে লাগল। মাঝে দু-একবার গর্তের ওপর থেকে কয়েকজন উঁকি দিয়ে দেখল তাদের। বিকেল নাগাদ অবশেষে বৃষ্টি থামল। চব্বিশ ঘণ্টা হয়ে গেল একটা দানা পড়েনি পেটে। তার ওপর টানা বৃষ্টিতে ভেজা। শরীর কাহিল হয়ে পড়েছে তিনজনের। বৃষ্টিটা হওয়াতে অবশ্য তৃষ্ণা নিবারণ সম্ভব হয়েছে।

বৃষ্টি থামার কিছু পরই বেশ কয়েকজন নীচে নামতে শুরু করল। নীচে নামার পর তাদের ঘিরে ধরে তির দিয়ে খুঁচিয়ে ওপরে ওঠার জন্য সুদীপ্তদের ইঙ্গিত করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের সঙ্গে গর্তের বাইরে বেরিয়ে এল তারা। একটা দড়ি দিয়ে তাদের তিনজনকে বেঁধে ধাক্কা মেরে মাটিতে বসিয়ে তির-ধনুক হাতে পাহারায় বসল ক’জন জংলি। কিছুটা তফাতে একটা অগ্নিকুণ্ড জ্বালানো হয়েছে। তার ওপর ঝলসাচ্ছে চামড়া সমেত একটা ওরাং-ওটাং-এর দেহ। মাংস পোড়ার উৎকট গন্ধ বেরোচ্ছে। সে জায়গাটা ঘিরে বসে আছে সেই উল্কি আঁকা জংলি আর বাকিরা।

সুদীপ্ত চারপাশে ভালো করে তাকাল। অনুচ্চ পাহাড়টার নীচে কিছুটা ফাঁকা জায়গা। তার গায়ে একটা জলা। সেই জলাটা মনে হয় ব্যাঙে ভর্তি। এত ওপর থেকেও ব্যাঙের ডাক শোনা যাচ্ছে। এরপর ওপরে মাথার দিকে তাকাতেই বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল সুদীপ্ত। বর্ষণসিক্ত সলকের আকাশ। জল পেয়ে শৃঙ্গগুলো যেন ঝলমল করছে। পাদদেশের ঘন জঙ্গল যেন পান্না-সবুজ রং ধরেছে। আর এ সবের মাথার ওপর শেষ বিকেলে একটা রামধনু দেখা যাচ্ছে! কী আশ্চর্য সুন্দর সেই দৃশ্য! হেরম্যান সেদিকে তাকিয়ে চাপাস্বরে তারিফ করে বললেন, এবার মরলেও ক্ষতি নেই। মরার আগে এমন দৃশ্য দেখার সৌভাগ্যই বা ক’জনের হয়! সব কিছু ভুলে তারা বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইল সেই অপার্থিব সৌন্দর্যের দিকে।

এক সময় সলকের মাথায় সূর্য ডুবে গেল। মুছে গেল রামধনু। আঁধার নেমে আসতে লাগল উপত্যকায়। ওরাং-ওটাং-এর মাংস সিদ্ধ হয়ে গেছে। আগুন থেকে সেটা নামিয়ে ছুরি দিয়ে খণ্ড খণ্ড করে কেটে সেই উল্কি আঁকা লোকটা তার সঙ্গীদের মধ্যে পোড়া মাংস বিতরণ শুরু করল। শুরু হল তাদের ভোজসভা।

পিনাক বলল, এরা আমাদেরও পুড়িয়ে খাবে কিনা কে জানে?

হেরম্যান বললেন, দেখা যাক কী হয়। অন্ধকার না নামলে পালাবার চেষ্টা করা যাবে না। হাত তো খোলাই। তেমন হলে লড়ব।

সুদীপ্তদের সামনে বসেই ওরাং-ওটাং-এর পোড়া মাংস বেশ তৃপ্তি করে চেবাচ্ছিল। হঠাৎ তার মুখে শক্ত একটা জিনিসে কামড় পড়তেই সে সেটা থুঃ করে মুখ থেকে বাইরে ফেলল। সেই ‘ছোট্ট চকচকে জিনিসটা গড়িয়ে এসে থামল সুদীপ্তদের পায়ের কাছে। রাইফেলের বুলেট!

হেরম্যান বললেন, এ ওরাং-ওটাংটা আমাদের সেই প্রাণীটাই। এ মাংস ওদের খুব প্রিয় দেখছি। তাহলে সেদিন খাঁচার চারপাশে অন্ধকারে যাদের ঘুরতে দেখেছিলাম তারা আসলে এ লোকগুলোই। খাঁচার ঝাঁপ ঠেলে এরাই প্রাণীটাকে নিয়ে গিয়েছিল! বুলেট রয়ে গিয়েছিল প্রাণীটার দেহে।

. সেই জান্তব ভোজসভা যখন শেষ হল তার বহুক্ষণ আগেই অন্ধকার নেমে গেছে। আবছা চাঁদ উঠতে শুরু করেছে সলকের মাথায়। ভোজ শেষে পরিতৃপ্ত জংলিরা সবাই উঠে দাঁড়াল। সুদীপ্তদের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে সেই উল্কিঅলা অসভ্যটা কী যেন নির্দেশ দিল সঙ্গীদের। অগ্নিকুণ্ড থেকে মশাল জ্বালিয়ে নিল তারা। সুদীপ্তদের সঙ্গে নিয়ে পাহাড়ের ওপর থেকে ঢাল বেয়ে নীচে নামা শুরু হল।

নীচে ছোট্ট ফাঁকা জায়গাটার দু-পাশে ঘন জঙ্গল, একপাশে পাহাড়ের ঢাল, আর ঠিক তার বিপরীত ফাঁকা জায়গার শেষে বদ্ধ জলাশয়টা। পৃথিবীর সব ভেক যেন আজ এসে জমা হয়েছে বদ্ধ জলাটাতে। একটানা কোলাহলের সঙ্গে জলের ওপর তারা লাফাচ্ছে। প্রথম বৃষ্টির জল পেয়ে তাদের যেন আনন্দের সীমা নেই। তবে বড্ড নোংরা জায়গা। ভ্যাপসা পচা গন্ধ উঠছে জলা থেকে। ফাঁকা জায়গার ঠিক মাঝখানে বেশ কয়েকটা খুঁটি পোঁতা। সেখানে সুদীপ্তদের নিয়ে দাঁড় করানোর পর জংলি সর্দারটা বেশ কিছুক্ষণ ধরে দুর্বোধ্য ভাষায় কী যেন বলল। তারপর তাদের তিনজনের কোমরে দড়ি দিয়ে বেশ শক্ত করে একটা খুঁটির সঙ্গে দাঁড় করিয়ে বাঁধল। লোকগুলো এরপর আকাশের দিকে একবার ভালো করে তাকাল। তাদের দৃষ্টি অনুসরণ করে পিনাক বলল, আকাশ মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে। আবার বৃষ্টি নামবে।

জংলিগুলোর কাজ শেষ হবার পর সর্দার একটু ঝুঁকে পড়ে নিজের কোমরে কী যেন খুঁজে দুর্বোধ্য ভাষায় কী একটা বলল তার সঙ্গীদের। তারা যেন বেশ উত্তেজিত হল সর্দারের কথা শুনে। দুজন সঙ্গে সঙ্গে ছুটল পাহাড়ের মাথায়, কিছুক্ষণ পর আবার খালি হাতে ফিরেও এল। উল্কিঅলা লোকটা কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করল অন্য জংলিদের সঙ্গে। আর মাঝে মাঝে আকাশের দিকে আঙুল তুলে দেখাতে লাগল। তাদের কথার ধরন দেখে সুদীপ্তরা অনুমান করল তারা বেশ উত্তেজিত। চাঁদ উঠল আকাশে। তবে মাঝে মাঝে ভাসমান মেঘ ঢেকে দিচ্ছে তাকে। লোকগুলো যেন চাঁদ ওঠার জন্যই অপেক্ষা করছিল। সুদীপ্তদের খুঁটির মধ্যে বেঁধে রেখে দলবেঁধে তারা এগোল জলার দিকে। জলার পাড়ে ভেজা মাটিতে মশালগুলো পুঁতে জলে নামল তারা। পাড়ের দিকে খুব বেশি জল নেই। হাঁটু সমান জল হবে। সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অনেকটা ব্যাঙের মতোই দু-পা ফাঁক করে অদ্ভুতভাবে বসল লোকগুলো। তারপর ঠিক ব্যাঙের মতোই জলা থেকে আকাশের দিকে মাথা তুলে তারা অদ্ভুত স্বরে ডাকতে লাগল! তাদের এই অদ্ভুত কাণ্ড দেখে হেরম্যান-সুদীপ্তরা বেশ অবাক হয়ে গেল।

সুদীপ্তদের যেখানে বেঁধে রাখা হয়েছে সেখান থেকে জলার দূরত্ব অন্তত দেড়শো ফুট হবে। হেরম্যান বললেন, আমাদের ডানপাশের জঙ্গলে যদি ঢুকে পড়ে যায় তবে পালাবার একটা উপায় হতে পারে। রাতে ওদের তির-ধনুক তেমন কাজ দেবে না। পিনাক বলল, আর কিছু সময়ের মধ্যেই বৃষ্টি নামবে। সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে। এই বলে হাতের বাঁধন খুলে সে সন্তর্পণে ছুরি বার করল কোমরের দড়ির বাঁধন কাটার জন্য।

আকাশের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত স্বরে ডেকে চলেছে অসভ্য মানুষগুলো। কখনো একটানা, কখনো বা থেমে থেমে। জঙ্গলের আদিম অসভ্য মানুষদের অদ্ভুত সব রীতি থাকে। সুদীপ্তর মনে হল আকাশের দিকে তাকিয়ে ওই অদ্ভুতভাবে লোকগুলো হয়তো আকাশদেব বা বর্ষার আরাধনা করছে। কিন্তু খুঁটির সঙ্গে কেন তাদের এমনভাবে বাঁধা হল সেটা বুঝতে পারছে না। ঘণ্টাতিনেক সময় এভাবে কেটে গেল। সময় এগোবার সঙ্গে সঙ্গে আকাশও মেঘে ঢেকে গেল। তারপর ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি নামল। ব্যাঙের ডাক আর অসভ্যদের অদ্ভুত চিৎকার আরও যেন বেড়ে গেল। হেরম্যান বলল, তৈরি হয়ে থাকো। আমি বললেই জঙ্গলের দিকে দৌড়বে।

দেখতে দেখতে কিছু সময়ের মধ্যেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। বৃষ্টির শব্দ, ব্যাঙের কলতান, অসভ্যদের চিৎকারে মুখরিত হয় উঠল জায়গাটা। বৃষ্টির জলে মশালগুলো নিভে গেল। মেঘ মাঝে মাঝে ঢেকে দিচ্ছে চাঁদের ক্ষীণ আলোটুকুও। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ভেকে যাচ্ছে পৃথিবী। ঠিক তেমনই একবার মেঘ ঢেকে দিল চাঁদকে। আর কেন যেন ঠিক সেই মুহূর্তে ব্যাঙের ডাক, অসভ্যদের শব্দ সব থেমে গেল। হেরম্যান শুধু বললেন, দৌড়াও। অমনি সুদীপ্তরা ছুটতে শুরু করল জঙ্গলের দিকে।

সুদীপ্ত সব শেষে ছুটছিল। তারা তখন জঙ্গলের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। হঠাৎই মেঘ সরে গেল। পলায়মান সুদীপ্তদের দেখতে পেয়ে কয়েকজন জংলি জল ছেড়ে উঠে চিৎকার করে পিছু ধাওয়া করল তাদের। জঙ্গলে ঢোকার ঠিক আগের মুহূর্তে সুদীপ্তর হঠাৎ মনে হল একখণ্ড কালো মেঘ যেন আকাশ থেকে নেমে এসে তার মাথার ওপর দিয়ে জলার দিকে উড়ে গেল। তার সঙ্গে একটা উৎকট পচা গন্ধও মুহূর্তের জন্য তার নাকে এসে লাগল। আর তারপরই তাকে অনুসরণকারী একজন অসভ্য মানুষের রক্ত জল-করা আর্তনাদ তার কানে এল। কিন্তু ব্যাপারটা কী হল তা ফিরে দেখার মতো সুযোগ সুদীপ্তর ছিল না। হেরম্যানদের পিছন পিছন সে-ও জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। সেই নাম-না-জানা জঙ্গলে, অন্ধকারের মধ্যে গাছে ধাক্কা খেতে খেতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে তারা ছুটতে লাগল বৃষ্টির মধ্যে প্রাণ বাঁচাবার জন্য।

কতক্ষণ, কোন দিকে ছুটছে হুঁশ ছিল না সুদীপ্তদের। এক সময় থামল তারা। জঙ্গল অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছে। ঢালু হয়ে তা আবার নীচের দিকে নেমেছে। বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে জিরিয়ে নিল সকলে। হেরম্যান তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো আবার এগোতে হবে।

আবার তারা এগোতে শুরু করল। তবে এবার আর দৌড়ে নয়। শক্তি ফুরিয়ে এসেছে, ধীর পদক্ষেপে ঢাল বেয়ে নামতে লাগল তারা। এক সময় আকাশে শুকতারা ফুটে উঠল ধীরে ধীরে আবছা আলো যেন দেখা দিতে লাগল পশ্চিম আকাশে।