আহুল – ৫

ভোর হল একসময়। তাঁবু থেকে বাইরে এসে সুদীপ্তরা খাঁচাটার কাছে গিয়ে বেশ অবাক হয়ে গেল। খাঁচাটার ভিতর নতুন কোনো প্রাণী তো নেই-ই, এমনকী মৃত ওরাং-ওটাংটার দেহটাও নেই! খাঁচা পরীক্ষা করে বোঝা গেল তার ঝাঁপটা পড়ে খাঁচার মুখ বন্ধ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেটাকে আবার ঠেলে ওপর দিকে তুলে ফাঁক করা হয়েছে। বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খাঁচার কজাগুলো। যে প্রাণীটা খাঁচাতে ঢুকেছিল সে ওই ফাঁক গলে মৃত প্রাণীটাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়েছে।

সাধারণ ইতর শ্রেণির প্রাণীর এমন বুদ্ধি হয় না, কিন্তু ওরাং-ওটাং, শিম্পাঞ্জিরা হাতের ব্যবহার জানে, কোনো কিছু ছুড়ে মারতেও জানে, কোনো কোনো প্রজাতি গাছের ডালকে লাঠির মতো ব্যবহার করতেও পারে। দলবদ্ধভাবে খাঁচাটা নাড়াচাড়া করতে করতে কোনোভাবে হয়তো ওরা বুঝতে পেরেছিল যে খাঁচার দরজা ওপর দিকে খোলে। তারপর সবাই মিলে টেনে ফাঁক করেছে দরজা। যাই হোক, খাঁচাটা এবার খুলে নিয়ে তাড়াতাড়ি রওনা হতে হবে। আজ সন্ধ্যার আগে আমাদের দলকের পাদদেশে ওই উপত্যকার কাছে পৌঁছতে হবে।

তিনজন মিলে চটপট খুলে ফেলল খাঁচাটা। সেটা নিয়ে এরপর তারা যখন তাঁবুর দিকে পৌঁছতে যাচ্ছে ঠিক তখনই কিছুটা তফাতে মাটির ওপর সাদা মতো একটা ছোট্ট জিনিস পড়ে থাকতে দেখে হেরম্যান সেটা কুড়িয়ে হাতে নিয়ে বললেন, আরে এ কী? ইঞ্চি ছয় লম্বা একটা হাড়। খুব মসৃণ চকচকে তার বাইরেটা। ভিতরটা সম্ভবত ফাঁপা। একটা ছিদ্রও আছে। হাড়টা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে সেটা তিনি তুলে দিলেন সুদীপ্তর হাতে। সে-ও দেখল সেটা। খুব মসৃণ তার গা-টা। পিনাক জিনিসটা দেখে বলল, এটা বড় বানর জাতীয় প্রাণীরই হাড় হবে। রোদ-জলে দিনের পর দিন পড়ে থাকতে

থাকতে ওর গা-টা অমন মসৃণ হয়েছে। ঠিক যেভাবে নুড়ি-পাথর মসৃণ হয়।

হেরম্যান জিনিসটা আর একবার হাতে নিয়ে সেটা পরীক্ষা করে মন্তব্য করলেন, পিনাক ঠিকই বলছে, এটা কোনো বানর গোত্রের প্রাণীরই হাতের হাড় হবে। হয়তো ওরাং-ওটাংগুলো এটা কোথা থেকে কুড়িয়ে এনেছিল, অথবা জিনিসটা এখানেই পড়েছিল আমরা খেয়াল করিনি। এই বলে তিনি হাড়টা ছুড়ে ফেলে দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু পিনাক বলল, ফেলবেন না, ওটা আমাকে দিন, আমি ওটা দিয়ে ছুরির হাতল বানাব।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁবু গুটিয়ে এদিনের যাত্রা শুরু করল তারা। নুড়ি-পাথর বিছানো পথ ভেঙে ক্রমশ ওপরের দিকে তারা এগোতে শুরু করল। দিনটা আজ কেমন অন্যরকম।

সলকের মাথাটা ছাই রঙের মেঘে ঢাকা। বাতাসে একটা গুমোট ভাব। বেলা বাড়ছে, কিন্তু সলকের মেঘ কাটছে না। উঁচু জায়গাগুলো থেকে অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। সলকের পাদদেশে ছোট ছোট পাহাড়, তার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দেওয়া জঙ্গল, মৃত নদীখাত, কিন্তু এ সবই যেন কেমন থমথমে। একটা পাখির ডাকও কানে আসেনি সকাল থেকে। যেন প্রাণের কোনো অস্তিত্ব নেই এ তল্লাটে !

ঘণ্টা পাঁচেক এক নাগাড়ে চলল তারা। গুমোট গরমে গায়ের জামা ভিজে জবজব করছে। সবার পিঠেই আছে মালপত্র। তার ওপর আবার উদয় হয়েছে একঝাঁক মাছি। ভনভন শব্দে সঙ্গে চলছে তারা। বিরক্তিকর ব্যাপার! অবশেষে এক জায়গাতে থেমে পিঠ থেকে ব্যাগপত্তর নামালেন হেরম্যান। কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম প্রয়োজন। অবশ্য এখন তারা উপত্যকার প্রবেশমুখে পৌঁছে গেছে। সামনে দুটো অনুচ্চ পাহাড়। তার মধ্যে দিয়ে নদীখাত ধরে উপত্যকায় ঢুকতে হবে। সুদীপ্তরা বেশ উঁচুতে উঠে এসেছে। তাদের ফেলে আসা যাত্রাপথের অনেকটাই দেখা যাচ্ছে সে জায়গা থেকে। হেরম্যান রুটি চিবুতে চিবুতে বললেন, সলকের পাদদেশে আমরা যেসব ছোট ছোট পাহাড় দেখছি সেগুলোও কিন্তু আসলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জ্বালামুখ। অগ্ন্যুৎপাতের সময় মূল জ্বালামুখের আশপাশেও মাটি ফুঁড়ে অনেক জায়গা থেকে লাভাস্রোত বেরিয়ে আসে। তবে বহু বছর ধরে মাটি জমতে জমতে ক্রেটারগুলো বুজে গেছে। পিনাক বলল, কিন্তু সলকের মাথার মেঘটা বড় সুবিধার মনে হচ্ছে না। দাঁড়ান একটা

জিনিস দেখি…

এই বলে সে তার সঙ্গে আনা একটা মুখবন্ধ মাটির হাঁড়ি প্রথমে মাটিতে নামিয়ে রাখল। পিনাকের নিজস্ব জিনিস এটা। হাঁড়ির মুখে ঢাকা দেওয়া পর্দাটা সে সরাতেই বেশ অবাক হয়ে গেল সুদীপ্তরা। পিনাকের সঙ্গে এই পাত্রটাকে তারা আগে দেখে জলের পাত্র ভেবেছিল। পাত্রর ভিতর জল আছে ঠিকই, কিন্তু তার মধ্যে রয়েছে একটা মাগুর জাতীয় মাছ! হেরম্যান বিস্মিতভাবে বললেন, কী হবে এটা দিয়ে?

পিনাক হেসে বলল, আপনারা জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান নানা যন্ত্রপাতি নিয়ে। আমাদের তো ওসব দামি জিনিস কেনার পয়সা নেই। আমাদের নিজেদেরও অনেক সময় একলা জঙ্গলে পাহাড়ে আসতে হয়, তখন এসব জিনিস আমাদের যন্ত্রপাতির কাজ করে।

কিছুদূরে মাটিতে পাথরের ফাঁকে সামান্য জায়গা নিয়ে ফুটখানেক গভীর জল জমে আছে। পিনাক হাঁড়িটা নিয়ে সেখানে এগোল। তার পিছনে কৌতূহলী সুদীপ্তরা।

জায়গাটায় পৌঁছে মাছটাকে বার করে সেই অতিক্ষুদ্র ডোবার মতো জায়গাতে ছেড়ে দিয়ে পিনাক বলল, মাগুর গাছ, পিঁপড়ে এসব প্রাণী আবহাওয়ার আগাম পরিবর্তন, যেমন বৃষ্টিপাত, ভূমিকম্প, এসব বুঝতে পারে। তবে আপনারা মাছটাকে দেখে কিছু বুঝতে পারবেন না, কিন্তু আমি পারব। এর জন্য অভ্যাসের প্রয়োজন হয়।

মাছটা ছাড়া পেয়েই প্রথমে বেশ কয়েকবার লাফিয়ে উঠল জলের মধ্যে। তারপর এদিক-ওদিক একটু ছোটাছুটি করে জলতলে স্থির হয়ে ভাসতে থাকল। পিনাক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল তার দিকে। তার প্রতিটা নড়াচড়া সে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। প্রায় দশ মিনিট তাকে দেখল সে। তারপর বলল, হ্যাঁ, কিছু একটা হবে। ক্রমশ ওপরে উঠে আসছে মাছটা। হয়তো বৃষ্টিপাত বা অন্য কিছু।

হেরম্যান বললেন, হ্যাঁ তাহলে হয়তো বৃষ্টি নামবে। বাতাসে কেমন একটা গুমোট ভাব!

পিনাক সেই জল থেকে মাছটা তুলে নিয়ে আবার পাত্রের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার যাত্রা শুরু করল তারা। তারা প্রবেশ করতে শুরু করল উপত্যকার ভিতর।

ছোট ছোট পাহাড় দিয়ে ঘেরা এ জায়গা যেন বাইরের পৃথিবী থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। পাহাড়গুলোর ঢালে গভীর জঙ্গল। কোথাও বাঁশ গাছের দুর্ভেদ্য প্রাচীর, কোথাও আবার বর্ষাবনের আদিম বিরাট বিরাট গাছ আকাশের দিকে মাথা তুলে উদ্ধৃত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। ভার্জিন রেন ফরেস্ট। ওসব জঙ্গলে সভ্য মানুষের পায়ের ছাপ পড়েনি কোনোদিন। সূর্যকিরণ প্রবেশ করে না সেখানে। গাছগুলোর গায়ে শ্যাওলার পুরু আস্তরণ। বিচিত্র ধরনের পরজীবী ছত্রাক ফুলের মতো ফুটে আছে তার গায়ে। পৃথিবীর মধ্যেই অন্য এক পৃথিবী যেন ঘুমিয়ে আছে এখানে। কখনো বোলো দিয়ে গাছ কেটে, কখনো জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে উপত্যকার গভীরে প্রবেশ করতে লাগল তারা। শেষ দুপুরে তারা একটা পাহাড়ের ঢালে কিছুটা উন্মুক্ত স্থানে এসে দাঁড়াল। তাদের চারদিকে গভীর জঙ্গল ছাওয়া নানা পাহাড়ের ঢাল। একটা পাহাড়ের দু-পাশ দিয়ে দুটো নদীখাত নেমেছে। একটা নদীখাত শুষ্ক, অন্যটায় তিরতির করে সামান্য জল বইছে।

হেরম্যান বললেন, ঠিক এ জায়গা পর্যন্ত বিবরণ অলিভিয়েরার ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করা আছে। এর পরই তিনি পথ হারিয়ে অবশেষে সেই ঝরনার সামনে এক বিকেলে তাঁবু ফেলেছিলেন। ঠিক সে জায়গাটা সম্ভবত একদিনের পথ। যে খাতটা দিয়ে জল প্রবাহিত হচ্ছে, সে পথই ধরব আমরা। এমন হতে পারে এ পথটাই আমাদের পৌঁছে দেবে সেই ঝরনার কাছে। সুদীপ্ত সহমত জানাল তাঁর কথায়৷ সে-পথেই এগোল তারা। আরও নিবিড় জঙ্গল, আরও নিস্তব্ধতা চারপাশে।

এগোচ্ছিল তারা। হঠাৎই সেই নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে যেতে লাগল প্রচণ্ড শব্দে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সকলে। রাইফেলের শব্দ! একটা নয় বেশ কয়েকটা শব্দ হল পরপর। আর সেই শব্দগুলো চারপাশের পাহাড়ের ঢালে ধাক্কা খেয়ে ঘুরপাক খেতে লাগল উপত্যকায়।

হেরম্যান বললেন, শব্দটা আসছে আমাদের ডানদিকের পাহাড়ের ঢাল থেকে। সম্ভবত তানাকারা আছেন ওখানে। গুলি চালিয়ে দেখি কোনো প্রত্যুত্তর পাই কিনা?

হেরম্যানের ইঙ্গিতে পিনাক কাঁধ থেকে রাইফেল খুলে নিয়ে একটা ফায়ার করল। কেঁপে উঠল চারপাশের পাহাড়। সে শব্দও প্রতিধ্বনিত হল কিছুক্ষণ। তারপর সব কিছু আবার শান্ত হয়ে গেল। ওপাশ থেকে কোনো সাড়া মিলল না। হেরম্যান বললেন, ব্যাপারটা কী হল বোঝা গেল না। চলো তাহলে আমরা আমাদের মতোই এগোই। এগোতে যাচ্ছিল সুদীপ্তরা। কিন্তু তারা এরপর একটু অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেল। ডানপাশের পাহাড়ের ঢাল বেয়ে জঙ্গল ভেঙে কী যেন নেমে আসছে তাদের দিকে। অদ্ভুত খচমচ একটা শব্দ! পিনাকের রাইফেলের নল সঙ্গে সঙ্গে সেদিকে ঘুরে গেল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই পাহাড়ের ঢালে জঙ্গলের আড়াল থেকে আবির্ভূত হল একটা মানুষ! তার সামনে পড়েছিল বেশ বড় একটা পাথর। দ্রুতবেগে নামতে নামতে নিজের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সে পাথরটার ওপর পড়ল। তারপর একটা ডিগবাজি খেয়ে ওপর থেকে ছিটকে পড়ল সুদীপ্তদের কিছুটা তফাতে। তারা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেল লোকটার কাছে। হেরম্যান বিস্মিতভাবে বলে উঠলেন, আরে এ যে মিস্টার তানাকার সঙ্গী দুজনের একজন!

সুদীপ্তরাও চিনতে পারল তাকে। লোকটার সর্বাঙ্গ ভেসে যাচ্ছে রক্তে। না, পাথরে ধাক্কা খেয়ে ওপর থেকে পড়ার জন্য নয়। কেউ যেন তার শরীর ধারালো ছুরি দিয়ে ফালা করে চিরেছে! লোকটার চোখের মণি দুটো যেন আতঙ্কে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তার বুকটা হাপরের মতো উঠছে-নামছে।

হেরম্যান তার ওপর ঝুঁকে পড়ে উত্তেজিতভাবে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার এ অবস্থা কীভাবে হল? মিস্টার তানাকা কোথায়?

লোকটা প্রত্যুত্তরে অতিকষ্টে ডান হাতটা তুলে ঢালের মাথার ওপরের জঙ্গলটা যেন একবার দেখাবার চেষ্টা করল। আর তারপরই তার হাতটা বুকের ওপর নেমে এল। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় মোচড় দিয়ে লোকটার দেহ স্থির হয়ে গেল। তার ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখের মণি দুটো শুধু চেয়ে রইল পাহাড়ের মাথার ওপর কুয়াশা মাখা জঙ্গলের দিকে। উত্তেজিত হেরম্যান বলে উঠলেন, লোকটার এ অবস্থা কে করল? এ কি তাহলে ‘আ-হুল’-এর শিকার? অতবার রাইফেলের শব্দ তাহলে কোনো লড়াইয়ের শব্দ ছিল! মিস্টার তানাকাও তাহলে বিপদগ্রস্ত! তার খোঁজ করতে হবে আমাদের। এটা মানবতার ব্যাপার। এই বলে পিনাকের রাইফেলটা হাতে নিলেন তিনি, আর সুদীপ্তকে ধরিয়ে দিলেন তার রিভলভার।

পাহাড়ের সেই ঢাল বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল সবাই। প্রথমে রাইফেল হাতে হেরম্যান, তারপর সুদীপ্ত, সব শেষে বোলো হাতে পিনাক। দু-পাশে দুর্ভেদ্য জঙ্গল। আলো-আঁধারি খেলা করছে তার ভিতর। কেমন যেন ভেজা-স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ চারদিকে। কিছুটা এগোবার পর একটা অদ্ভুত শব্দ কানে আসতে লাগল তাদের। পিনাক বলল, ওগুলো আসলে বর্ষাবনের ব্যাঙের ডাক। বিভিন্ন সুরে একসঙ্গে অনেকগুলো ব্যাঙ ডাকছে বলে অদ্ভুত শোনাচ্ছে শব্দটা। এরপর সত্যিই এক জায়গাতে একসঙ্গে নানা আকারের নানা ধরনের বেশ কিছু ব্যাঙ চোখে পড়ল। যেন এই নির্জন বনে মিটিং বসিয়েছে ব্যাঙের দল! যত ওপরে উঠতে লাগল চোখে পড়তে লাগল অজস্র ব্যাঙ।

হরম্যান সুদীপ্তকে বললেন, তোমাকে মনে হয় বলেছিলাম যে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি

প্রজাতির ব্যাঙ এই সলক মাউন্টেনে পাওয়া যায়। এবার চাক্ষুস করলাম ব্যাপারটা! কিন্তু মিস্টার তানাকা বা তাঁর অপর সঙ্গীর দেখা নেই কোথাও। এদিকে বেলা ক্রমশ পড়ে আসছে। সলকের পাদদেশের এই জঙ্গলের অস্পষ্টতা ক্রমশ বাড়ছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ঢেকে যাবে জঙ্গল। হেরম্যান বললেন, পাহাড়ের মাথায় উঠে আজকের মতো তাঁবু ফেলব আমরা। তারপর কাল সূর্যের আলো ফুটলে যা করার তা করা যাবে।

সূর্য ডোবার কিছু সময় আগে অবশেষে সুদীপ্তরা উঠে এল সেই পাহাড়ের মাথার ওপর। সেখানে বেশ কিছুটা জায়গা সমতল। আদিম মহাবৃক্ষরাজি দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। তার ফাঁক দিয়ে সলকের মাথায় সূর্যাস্ত দেখা যাচ্ছে। বাতাস বেশ ঠান্ডা এ জায়গাতে। সুদীপ্তরা ঠিক করল জঙ্গলের ভিতর গাছগুলোর নীচে কোনো সুবিধামতো জায়গা বেছে তাঁবু ফেলবে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জমা পাতার রাশি যেন পায়ের তলায় পুরু গালিচা বিছিয়ে রেখেছে। সেই পাতা মাড়িয়ে তারা প্রবেশ করল পাহাড়ের মাথার জঙ্গলে তাঁবু ফেলার স্থান নির্বাচনের জন্য। কিছুটা এগিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল তিনজন। গাছের ফাঁক গলে জঙ্গলের মধ্যে এক জায়গাতে শেষ বিকেলের আলো এসে পড়েছে সিনেমার ফোকাসের মতো। সেখানে পড়ে আছে একটা লাল রুকস্যাক ব্যাগ! আরে এই ব্যাগটাই তো গতদিন যাত্রা শুরুর সময় মিস্টার তানাকার পিঠে ছিল! তার মানে, তানাকা হয়তো এখানেই কোথাও থাকতে পারেন! ব্যাগটা দেখে সুদীপ্তরা এগোল সেদিকে। তাদের পায়ের তলায় পুরু পাতার রাশি। গোড়ালি, পায়ের পাতা ঢুকে যাচ্ছে তার মধ্যে। ব্যাগটার কাছে পৌঁছে হেরম্যান সেটা তুলে নিলেন। সুদীপ্তরা গাছপালার ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করতে লাগল তানাকাকে কোথাও দেখা যায় কিনা। হেরম্যান হাঁক দিলেন, মিস্টার তানাকা আপনি কোথায়? কিন্তু কোনো জবাব মিলল না।

আর এরপরই হঠাৎ একটা পাখির ডাক কানে এল তাদের।—কুইক-কু, কুইক-কু…। একটা খচমচ শব্দের সঙ্গে চারপাশের পাতাগুলো যেন মন্ত্রবলে মাটি থেকে কিছুটা ওপরে উঠে এল। সুদীপ্তরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাতার রাশি তাদের জাপ্টে ধরে মাটি থেকে শূন্যে উঠিয়ে নিল। নাগরদোলায় ওপরে ওঠার মতো কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তারা ওপরে উঠে গিয়ে সবাই মিলে জট পাকিয়ে মাটির অন্তত তিরিশ ফুট ওপরে দড়ির জালে পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকল। এমনভাবে তারা আটকে গেছে যে হাত-পাও নাড়ানো যাচ্ছে না।

ব্যাপারটা বুঝতে বেশ কিছুটা সময় লাগল সুদীপ্তদের। তারপর তারা দেখতে পেল গাছের গুঁড়িগুলোর আড়াল থেকে এক এক করে বেরিয়ে আসছে কালো কালো বেশ কিছু মানুষ। পরনে তাদের লেংটির মতো নামমাত্র পোশাক। মুখে সাদা রং মাখা। হাতে তির-ধনুক। সেগুলো তাক করে আছে শূন্যে দুলতে থাকা সুদীপ্তদের দিকে। হেরম্যান চাপা স্বরে বললেন, এরা অসভ্য জনজাতি হবে। বাঁচতে হলে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।

একে একে বেরিয়ে এল লোকগুলো। একজনের কাঁধে একটা মরা ওরাং-ওটাং। সংখ্যায় তারা অন্তত তিরিশজন হবে। তাদের মধ্যে একজন ওপর দিকে তাকিয়ে দুর্বোধ্য ভাষায় কী একটা নির্দেশ দিল। সুদীপ্তরা এবার খেয়াল করল বেশ কিছু লোক গাছের মাথাতেও বসে আছে। যারা জালের দড়ি টেনে তাদের ওপরে উঠিয়েছে। জালটা নামতে শুরু করল এরপর। সুদীপ্তরা ভূমি স্পর্শ করল এরপর। সুদীপ্তরা ভূমি স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে নীচের লোকগুলোর বৃত্তটা ক্রমশ ছোট হয়ে এল। সবার হাতেই উদ্যত তির ধনুক। মুহূর্তের মধ্যেই পিনকুশন বানিয়ে দিতে পারে সুদীপ্তদের। কয়েকজন এগিয়ে এল সুদীপ্তদের কাছে। জাল থেকে তাদের বার করে দড়ি দিয়ে হাত-পা বাঁধতে শুরু করল। এতগুলো লোকের সঙ্গে পেরে ওঠা যাবে না বলে তাদের কাজে তারা তিনজন কেউ বাধা দিল না। তাদের কাজ শেষ হবার পর ভিড়ের মধ্য থেকে সর্দার গোছের একটা লোক এসে দাঁড়াল সুদীপ্তদের সামনে। তারও মুখে সাদা রং মাখা, পরনে লেংটি। তবে তার অন্য একটা বিশেষত্ব আছে। লোকটার সারা দেহে উল্কি আঁকা। ব্যাঙের ছবি। অজস্র ব্যাঙ যেন লেপটে আছে লোকটার শরীরে!

সে লোকটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ ধরে পর্যবেক্ষণ করল সুদীপ্তদের। হেরম্যানের লাল চুল-অলা মাথাটা একবার ঝাঁকিয়ে নিয়ে সম্ভবত পরীক্ষা করে নিল তার চুলটা আসল কিনা! তারপর সে অন্য নির্দেশ দিল সঙ্গীদের। তিনটে লম্বা গাছের ডাল আনা হল। তার একটাতে সুদীপ্তদের বেঁধে ফেলে ডালগুলোকে কাঁধে তুলে নিল লোকগুলো। শিকার করা পশুদের দেহ যেমনভাবে ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, ঠিক সেভাবে লোকগুলো সুদীপ্তদের ঝুলিয়ে ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল এরপর। সলকের আড়ালে তখন সূর্য ডুবে গেছে। অন্ধকার নামছে উপত্যকায়।

আবার চাঁদ উঠল একসময়। ফ্যাকাশে পাণ্ডুর চাঁদ। লোকগুলোর ছোটার বিরাম নেই। জঙ্গল, পাহাড়-উপত্যকা ভেদ করে ছুটে চলেছে তারা। মাঝে মাঝে শুধু কাঁধ বদল করার জন্য মুহূর্তের জন্য থামছে, আবার ছুটছে। আধো অন্ধকারে সেই লোকগুলোকে প্রেতের মতো লাগছে। সুদীপ্তরা যেন প্রেতলোকের যাত্রী। প্রেতবাহকেরা বহন করে নিয়ে চলেছে তাদের। সুদীপ্তর মনে হতে লাগল সে যেন একটা স্বপ্ন দেখছে। অন্ধকারের মধ্যেই যুগ যুগ ধরে দুলতে দুলতে ছুটে চলেছে সে। কিন্তু কোথায় চলেছে তা তাদের জানা নেই। একসময় সেই দুঃস্বপ্নের মধ্যেই চোখে-মুখে প্রচণ্ড যন্ত্রণা শুরু হল। মাথা নীচু অবস্থায় ঝুলতে ঝুলতে দেহের সব রক্ত এসে জমতে শুরু করেছে তার মুখে। সুদীপ্ত জ্ঞান হারিয়েছিল। সে যখন আবার চোখ মেলল তখন ভোরের আলো ফুটেছে। সুদীপ্তরা কোথায় কতদূর এসেছে তা তাদের জানা নেই। এটুকু সে বুঝতে পারল লোকগুলো একটা পাহাড়ের মাথায় এসে দাঁড়িয়েছে। ঝুলন্ত অবস্থায় পাহাড়ের ঠিক নীচে একটা জলাশয়ও চোখে পড়ল তার।

পাহাড়ের মাথায় বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়াল লোকগুলো। তারপর পাহাড়ের মাথায় একটা বিরাট গহ্বর বেয়ে নীচে নামতে লাগল সুদীপ্তদের নিয়ে। বেশ অনেকটা নামার পর একটা তাকের মতো জায়গায় এসে দাঁড়াল সবাই। সেই লাঠিগুলো থেকে সুদীপ্তদের বাঁধন খুলে ধাক্কা মেরে তাদের তিনজনকে নীচে ফেলে লোকগুলো আবার ওপরে উঠে এল।