আহুল – ৩

কাঠের মোটা মোটা গুঁড়ি দিয়ে তৈরি একটা বাড়ি। ছিরিছাদহীন বাড়িটাতে দরজা-জানলার কোনো অস্তিত্ব নেই। সুদীপ্তরা বাড়িটার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। হঠাৎ তাদের কানে এল চিৎকার—হল্ট!

থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সুদীপ্তরা। প্রথমে তারা শব্দের উৎস বুঝতে পারল না। তারপর তারা দেখতে পেল তাদের কিছুটা তফাতে বাড়িটার গায়ের একটা গাঠের গুঁড়ির আড়াল থেকে একটা রাইফেলের নল বেরিয়ে আছে। তারপর সেখান থেকে ধীরে ধীরে উঁকি দিল একটা মানুষের মাথা, তারপর তার শরীরটা।

রাইফেল হাতে বেরিয়ে এল একজন লোক। আর তার পিছন পিছন আরও দুজন। তাদের হাতে ধরা আছে বোলো। প্রথম লোকটা বিদেশি, তামাটে, চশমা পরা, একটু ছোটখাটো চেহারা। পিছনের লোক দুজন সম্ভবত এদেশীয়। সোনালি চশমা পরা লোকটা রাইফেল উঁচিয়ে সুদীপ্তদের উদ্দেশ্যে বলল, তোমরা কারা?

হেরম্যান কয়েক-পা সামনে এগিয়ে বললেন, আমরা জাভা ক্রনিকাল নামে একটা খবরের কাগজের লোক। জঙ্গল দেখতে এসেছি।

হেরম্যানের চেহারা দেখে আর কথা শোনার পর সেই লাল চুল সম্ভবত আশ্বস্ত হল। সে বলল, আমি একজন বিজ্ঞানী। গবেষণার কাজে এখানে এসেছি।

এই বলে সে কয়েক-পা এগিয়ে এসে হেরম্যানের উদ্দেশ্যে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আপনাদেরকে রাইফেলের নল উঁচিয়ে পরিচয় দিতে বলার জন্য দুঃখিত। আসলে আমি শুনেছি যে সমুদ্র থেকে উঠে এসে জলদস্যুরা মাঝে মাঝে এ বনে হানা দেয়। তাই সতর্কতা অবলম্বন করতে হচ্ছে। আপনিও তো দেখছি আমার মতো বিদেশি। আপনার পরিচয়?

হেরম্যান জবাব দিলেন, আমি হেরম্যান। জার্মানি থেকে এসেছি। আর আমার এই বন্ধু সুদীপ্ত, ইন্ডিয়ান। সুদীপ্তও এরপর করমর্দন করল লোকটার সঙ্গে।

সে এবার সুদীপ্তদের উদ্দেশে বলল, আমার নাম নাগোয়া তানাকা। আমি জাপান থেকে এসেছি। তা আপনারা দুজন তো দেখছি বিদেশি। এখানকার কাগজের অফিসে চাকরি করেন নাকি?

হেরম্যান হেসে বললেন, না, ঠিক চাকরি করি না। আমি একজন প্রকৃতিবিদ। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের জঙ্গলে জীববৈচিত্র্য অনুসন্ধানের জন্য ঘুরে বেড়াই। এ জঙ্গলে নতুন কিছু তথ্য পেলে সেটা জাভা ক্রনিকালকে দেব এই শর্তে। তারা আমাদের এই অরণ্য অভিযান স্পনসর্ড করছে। নিজের পরিচয় তিনি কৌশলে দিলেন।

হেরম্যানের কথা শুনে তানাকা বললেন, তাহলে আমরা তো প্রায় সমগোত্রীয়। আমি এসেছি এই প্রকৃতির আড়ালে যেসব প্রাণী লুকিয়ে থাকে তাদের সন্ধানে। চমকে উঠলেন হেরম্যান, সুদীপ্ত। প্রকৃতির আড়ালে লুকিয়ে থাকা প্রাণী! এ ভদ্রলোকও কি ‘আ-হুল’-এর সন্ধানে এখানে এসেছেন?

তানাকা এরপর হেসে বললেন, আসলে আমি একজন জীববিদ। আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, ‘এন্টেনোলজিস্ট’। কীটপতঙ্গ নিয়ে কাজ করি। সলকের পাদদেশের বর্ষাবনে নানা ধরনের পোকামাকড় মেলে। তারই খোঁজে সেদিকে যাচ্ছি। সুদীপ্তরা এবার আশ্বস্ত হল তার কথা শুনে।

তানাকা এরপর বললেন, আসুন, বাড়ির ভিতর আসুন। দুটো ঘর আছে। একটা ঘর আপনাদের ছেড়ে দিচ্ছি। অবশ্য কাল যদি এখানেই থাকেন পুরো বাড়িটাই ব্যবহার করতে পারবেন। কারণ, কাল ভোরেই আমি সলকের দিকে যাত্রা শুরু করব।

হেরম্যান হেসে বললেন, আমরাও কাল থাকব না। আমাদেরও সলকের দিকে যাবার ইচ্ছা।

বাড়িটার ভিতরে ঢুকল সবাই। কাঠের তৈরি মেঝে। একটা ঘরের কোণায় তানাকাদের কিছু ছোটখাটো যন্ত্রপাতি রাখা আছে। সে ঘরটা দেখিয়ে তিনি বললেন, আপনারা এ ঘরটা ব্যবহার করুন। আমার জিনিসগুলো আমি একটু পরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।

তানাকা পাশের ঘরে চলে গেলেন। পিঠ থেকে মালপত্র নামিয়ে রেখে সুদীপ্তরা সে ঘরে রাত্রিবাসের প্রস্তুতি শুরু করল। মেঝেতে শোবার জন্য ম্যাট পাতা হল। পিনাক স্টোভ জ্বালিয়ে ফেলল রান্না করার জন্য। ঘরের কোণায় আরো কিছু ছোটখাটো যন্ত্রপাতির সঙ্গে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার বা অনেকটা ঘাস ছাঁটার যন্ত্রর মতো দেখতে লম্বা হাতলঅলা, চাকা লাগানো একটা যন্ত্র রাখা আছে। জিনিসটা আসলে কী তা বোঝার জন্য সুদীপ্ত গিয়ে যন্ত্রটা নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। মাটির সমান্তরাল ছোট টেলিভিশনের পর্দার মতো একটা জিনিস যন্ত্রটাতে লাগানো। বেশ কিছু নানা ধরনের বোতামও আছে তার হাতলে। ইলেকট্রনিক গ্যাজেট। হেরম্যানও এগিয়ে এসে যন্ত্রটা দেখতে দেখতে যন্ত্রের গায়ে এক জায়গাতে আবিষ্কার করলেন একটা লেখা—রেডিও অ্যাক্টিভ ডিভাইস। হেরম্যান বললেন, এ যন্ত্রটা সাধারণত ধাতু অনুসন্ধান লাগে। মিস্টার তানাকার কী কাজে লাগে কে জানে!

সুদীপ্তরা এরপর ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল। আকাশে লাল আবির গুলে সলকের মাথায় সূর্যাস্ত হচ্ছে। সুদীপ্তদের সামনের ফাঁকা জমির মাথার ওপর দিয়ে বিরাট একটা কাকাতুয়ার ঝাঁক উড়ে গেল জঙ্গলের দিকে। আশ্চর্য সুন্দর লাগছে চারপাশটা। হেরম্যান সুদীপ্তর কাঁধে হাত রেখে বললেন, ক্রিপ্টিডের খোঁজে হিমালয় থেকে আফ্রিকার গভীর জঙ্গলে কত পরিশ্রম, কত বিপদকে অগ্রাহ্য করে ঘুরে বেড়াই আমরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অধরাই থেকে যায় আমাদের ক্রিপ্টিড। কত লোক হাসাহাসি করে আমাদের পাগলামি নিয়ে। এক এক সময় যখন সেসব ভাবি তখন মন খারাপ হয়ে যায়। পাহাড়-পর্বত বনে-জঙ্গলে না ঘুরে আমি তো বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার চাকরি নিতে পারতাম। সে যোগ্যতা আমার ছিল। আর তা না হলে পারিবারিক ব্যবসা করে আরও অনেক টাকা করতে পারতাম। কিন্তু তারপরই আবার একটা কথা ভাবলে মন ভালো হয়ে যায়। এই যে আমরা এত দেশ ঘুরলাম, প্রকৃতির এত সৌন্দর্য দেখলাম, এত অভিজ্ঞতা হল, এ তো খুব কম মানুষেরই হয়। ঘরে বসে থাকলে কি প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য ধরা দিত? তোমার মনে আছে আফ্রিকার বুরুভিতে সবুজ বানর খুঁজতে গিয়ে টাঙ্গানিকার তীরে সূর্যাস্ত দেখেছিলাম আমরা? হ্রদের জলে একদল জলহস্তী খেলে বেড়াচ্ছিল!

সুদীপ্ত হেসে জবাব দিল, হ্যাঁ, মনে আছে। আপনার সঙ্গে যেবার হিমালয়ের বেসক্যাম্পে ‘বরফ দেশের ছায়ামানুষ’ খুঁজতে গিয়ে প্রথম পরিচয় হয়, সেই বেসক্যাম্প থেকে নন্দা দেবীর মাথায় সূর্যাস্ত দেখাও আমার মনে আছে।

বেশ কিছুক্ষণ ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করল তারা দুজন। তারপর হঠাৎই যেন সূর্য ডুবে গেল। অন্ধকার নেমে এল চারপাশে।

ঘরে ফিরে এসে একটা পেট্রোম্যাক্স জ্বালিয়ে নিয়ে অলিভিয়েরার ভায়েরি আর কাগজ-পেন্সিল নিয়ে কাজ করতে বসলেন হেরম্যান। আর সুদীপ্ত মনোনিবেশ করল এয়ারপোর্ট থেকে কেনা জাভার ইতিহাসের একটা হ্যান্ডবুকে। পিনাক রান্না চাপিয়ে দিয়েছে। পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে মিস্টার তানাকা আর তাঁর সঙ্গীদের টুকরো টুকরো কথাবার্তার শব্দ। সময় এগিয়ে চলল।

সে এক সোনালি অতীত! খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে সুদীপ্তদের পূর্বপুরুষের মকরমুখী পালতোলা জাহাজে চেপে প্রথম একদিন পা রেখেছিল এই দ্বীপ রাজ্যে, কঠোর পরিশ্রমে ও বাহুবলে শ্বাপদসঙ্কুল দ্বীপমালায় সভ্যতার গোড়াপত্তন করেছিল। সুমাত্রা ও জাভা দ্বীপে প্রতিষ্ঠা করেছিল সুপ্রসিদ্ধ শ্রীবিজয় রাজ্য। হিন্দু ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির বিস্তার ঘটিয়েছিল এদেশে। দ্বাদশ শতকে সমগ্র দ্বীপরাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা দখল করল পরাক্রমশালী মাজাপাহিত হিন্দু রাজারা। মহাকালের রথের চাকা বেয়ে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে আরব ও ভারতীয় মুসলমানরা এদেশে উপস্থিত হয়ে বালি দ্বীপ ছাড়া অন্যান্য দ্বীপে প্রতিষ্ঠা করল তাদের অধিকার। পতন ঘটল হিন্দু রাজাদের। চতুর্দশ খ্রিস্টাব্দে পোর্তুগীজ বাণিজ্যপোত এসে ভিড়ল মশলা দ্বীপ বা মোল্লাকায়। দ্বীপটা ভালো লাগল তাদের। সেখানে রয়ে গেল তারা। তাদের কিছু লোক স্বদেশে ফিরে গিয়ে আরো লোকজন ডেকে আনল। তাদের সঙ্গে এল সঙিনঅলা বন্দুক, পারকামান পিস্তল, কামান, গোলাবারুদ। হঠাৎই একদিন তারা দখল নিয়ে ফেলল এদেশ। মাঝে কিছুদিন ইংরেজও শাসন করল দেশটা। ১৯৪২ সালে ওলন্দাজদের থেকে জাপান ছিনিয়ে নিল দেশটা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পতন ঘটলে ইন্দোনেশিয়ার ন্যাশনাল পার্টি এদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করল…

সুদীপ্তর বেশ লাগছিল বইটা পড়তে। হঠাৎ হেরম্যানের গলার স্বরে মুখ তুলে তাকাল সুদীপ্ত।

এটা দেখো—এই বলে তিনি সুদীপ্তর হাতে একটা কাগজ তুলে দিলেন।

কাগজে আঁকা আছে একটা ম্যাপ। সুদীপ্ত জানতে চাইল, কিসের ম্যাপ এটা? হেরম্যান জবাব দিলেন, আমাদের যাত্রাপথের। ঠিক যে পথ ধরে এগিয়েছিলেন অলিভিয়েরা। তাঁর ডায়েরির বিবরণ অনুসরণ করে এঁকে ফেললাম। তবে সেই পাহাড় আর ঝরনার অবস্থান এ ম্যাপে দেখানো নেই। পথ হারিয়েই তিনি সেই ঝরনার কাছে পৌঁছেছিলেন। আগের রাতে বাজ পড়ে তার কম্পাসটা খারাপ হয়ে যায়। ঝরনাটা সে জায়গা থেকে একদিনের পথ। ম্যাপটা যেখানে শেষ হয়েছে মাইল কুড়ি ব্যাসার্ধ নিয়ে চারপাশটা খুঁজলেই আশা করি ঝরনাটা পেয়ে যাব।

এরপর বেশ কিছুক্ষণ ধরে ম্যাপটার খুঁটিনাটি সুদীপ্তকে বোঝালেন হেরম্যান। খাওয়া সারা হল তাদের। তারপর তারা তিনজনে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল। বাড়িটার সামনে একটা অগ্নিকুণ্ড জ্বালানো হয়েছে, তার সামনে বসে আছেন মিস্টার তানাকা আর তাঁর দুজন লোক। সুদীপ্তদের দেখে তানাকা তাদের সেখানে বসার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। সুদীপ্তরাও গিয়ে বসল তানাকাদের কাছে। চারপাশে নিঝুম অরণ্য। আকাশের চাঁদটাকে বড্ড বেশি ফ্যাকাশে লাগছে। তার আলোতে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় গাছগুলো।

মিস্টার তানাকাই প্রথমে মুখ খুললেন, কোন পথ ধরে এগোবেন আপনারা? হেরম্যান জবাব দিলেন, পশ্চিমদিকে একটা মৃত নদীখাত আছে বলে শুনেছি। তার পাড় ধরেই এগোব ভাবছি। আপনারা?

তানাকা বললেন, আমরা একদম সোজা এগোব জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। সলকের অধিত্যকায় যেখানে ছোট পাহাড়গুলো আছে সেখানে পৌঁছে কাজ শুরু করব আমি ওই আগ্নেয়ভূমির নীচে নানা ধরনের পোকামাকড়ের সন্ধান মেলে।

হেরম্যান বললেন, হয়তো যাত্রাপথে আবার আমাদের দেখা হয়ে যাবে।

তানাকা বললেন, হ্যাঁ, তা হতেই পারে। আমাদের দু-দলের কাছেই বলুক আছে। তেমন কিছু প্রয়োজন হলে বলুক ছুড়ে আমরা পরস্পরকে ডাকতে পারব। সংকেতটা জানেন তো? ওয়ান-টু-থ্রি। অর্থাৎ ধরুন আমি একবার ফায়ার করলাম, আপনি তার জবাব দিলেন, তারপর আমি শেষ ফায়ার করে আপনাকে কাছে ডাকলাম।

হেরম্যান হেসে বললেন, হ্যাঁ, জানি। এটা ইন্টারন্যাশনাল এস.ও.এস. কোড। তানাক বললেন, আমার ভয় বৃষ্টি নামলে। তাহলেই কাজ পণ্ড হয়ে যাবে। শুনেছি এ জঙ্গলে বর্ষা খুব ভয়ংকর।

পিনাক বসেছিল সুদীপ্তর পাশেই। একটা শুনে সে বলল, হ্যাঁ সাহেব, এ বনে বর্ষা খুব ভয়ংকর। যেটা হয়তো আগের দিন পথ ছিল, পরদিনই সেটা ভয়ংকর নদী হয়ে যায়। পা পড়লেই আপনাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। কত প্রাণী যে সেসময় ভেসে যায় ! প্রতি বর্ষায় নতুন নতুন নদীখাত তৈরি হয় এখানে। হ্যাঁ, বর্ষা মনে হয় এখানে এবার তাড়াতাড়ি নামবে।

তাড়াতাড়ি মানে? জানতে চাইলেন তানাকা।

পিনাক প্রথমে জবাব দিল, তাড়াতাড়ি মানে সাতদিনের মধ্যেও হতে পারে। সলকের মাথায় মেঘ জমতে শুরু করেছে। ওই যে দেখুন আকাশের ওদিকেও মেঘ দেখা যাচ্ছে। পিনাকের কথা শুনে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আকাশের দিকে তাকাল সবাই। হ্যাঁ, সলকের দিকের আকাশটা কেমন যেন অস্পষ্ট। এক জায়গাতে একখণ্ড কালো মেঘও দাঁড়িয়ে আছে।

পিনাক তার অভিজ্ঞ চোখে মেঘটার দিকে তাকিয়ে বলল, ওই কালো মেঘটা অবশ্য স্থানীয় মেঘ। ক’দিনের মধ্যে ভেঙে গিয়ে জল ঝরাবে ওটা। বর্ষাবনে এমন হয়। তবে তা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।

সুদীপ্তরা তাকিয়েছিল সেই কালো মেঘটার দিকে, হঠাৎ মিস্টার তানাকার সঙ্গী দুজনের একজন বলে উঠল, সাহেব ওই দেখুন জঙ্গলের মাথায় অমন একটা কালো মেঘ। লোকটার দৃষ্টি অনুসরণ করে অন্যরা তাকাল সেদিকে। হ্যাঁ, জঙ্গলের মাথায় একখণ্ড কালো মেঘ যেন ভাসছে। তানাকা এরপর বললেন, আমার কাজ দিন সাতেকের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে আশা করি। আপনারা ক’দিন থাকবেন এ জঙ্গলে?

হেরম্যান জবাব দিলেন, আমাদের তেমন কিছু ঠিক নেই এখন। দেখা যাক… তানাকা জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, আপনারা কি এ বনে নতুন কোনো প্রজাতির ব্যাঙের সন্ধানে এসেছেন? শুনেছি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি প্রজাতির ব্যাঙ পাওয়া যায় এই বর্ষাবনে।

হেরম্যান হেসে জবাব দিলেন, হ্যাঁ, পাওয়া যায়, তবে নতুন ধরনের যে-কোনো প্রাণীই আমাদের গবেষণার বিষয়।

কথাবার্তা চলছিল। সুদীপ্তর হঠাৎ চোখ পড়ল জঙ্গলের মাথায় সেই একখণ্ড কালো মেঘের দিকে। সুদীপ্তর কেন জানি মনে হল মেঘটা জঙ্গলের মাথার ওপর আরো যেন এগিয়ে এসেছে। আকাশে তেমন আলো নেই। তবু সেদিকে তাকিয়ে সুদীপ্তর মনে হতে লাগল সেই মেঘটা যেন নড়ছে। আর এর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই মেঘটা জঙ্গলের মাথার ওপর দিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসতে লাগল সুদীপ্তদের দিকে। সে অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করাবার জন্য আকাশের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, কী ওটা?

সবাই তাকাল সেদিকে। তারপর মুহূর্তেই মিস্টার তানাকার একজন অনুচর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল, গুলি চালাও সাহেব, গুলি চালাও।

কেউই তাৎক্ষণিকভাবে ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকাল লোকটার দিকে। উড়ন্ত মেঘটা তখন প্রায় ফাঁকা জমির মাথায় চলে এসেছে। সেই লোকটা আর দেরি করল না। মিস্টার তানাকার পাশে পড়ে থাকা রাইফেলটা তুলে নিয়ে গুলি চালিয়ে দিল সেই কালো মেঘটাকে লক্ষ্য করে। মুহূর্তের মধ্যে প্রকৃতির নিস্তব্ধতা চুরমার হয়ে গেল। জঙ্গলের মধ্যে থেকে কর্কশ আর্তনাদ করে উঠল আতঙ্কিত কাকাতুয়ার ঝাঁক। আর সেই কালো মেঘটা ঝুপ করে খসে পড়ল অগ্নিকুণ্ডের কিছুটা তফাতে।

সবাই ছুটে গিয়ে দেখল ডানা ছড়িয়ে বিরাট একটা বাদুড় মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে। ইন্দোনেশিয়ান জায়েন্ট ব্যাট!

প্রাণীটাকে দেখে মিস্টার তানাকা বিস্মিতভাবে তার সঙ্গীকে প্রশ্ন করলেন, এই নিরীহ প্রাণীটাকে দেখে ভয় পেয়ে গুলি চালালে কেন?

লোকটা তানাকার কথার জবাব না দিয়ে মাথা নীচু করে তাকিয়ে রইল মাটিতে পড়ে থাকা প্রাণীটার দিকে। তার দেহটা যেন মৃদু মৃদু কাঁপছে। সুদীপ্ত একবার তাকাল হেরম্যানের দিকে। তাঁর ঠোঁটের কোণে যেন আবছা হাসি ফুটে উঠেছে। তানাকা তাঁর প্রশ্নের জবাব না পেয়ে লোকটাকে তিরস্কার করে বললেন, বাদুড়ে তোমার এত ভয় জানা ছিল না! আমার দেশ হলে এ প্রাণী মারার অপরাধে তোমার কোর্ট মার্শাল হতো! ,

লোকটা এবারও তাঁর কথার কোনো জবাব দিল না।

মিস্টার তানাকা এরপর হেরম্যানের উদ্দেশ্যে বললেন, বেশ গল্প চলছিল, কিন্তু এই মূর্খ লোকটা এ প্রাণীটাকে মেরে আমার মেজাজটাই নষ্ট করে দিল। আমি দুঃখিত। কাল ভোরে সবাইকে বেরোতে হবে। এবার ঘরে ঢুকব।

সুদীপ্তরা ঘরে ফিরে এল। তারা শোয়ার বন্দোবস্ত করছে। ঠিক এমন সময় তাদের ঘরে ঢুকল মিস্টার তানাকার সেই সঙ্গী। সে বলল, সাহেব, যন্ত্রপাতিগুলো নিয়ে যাব। ঘরের কোণ থেকে যন্ত্রপাতি নিয়ে লোকটা বেরোতে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময় হেরম্যান তার কাছে গিয়ে লোকটার কাঁধে হাত রেখে বললেন, আমি জানি তুমি কেন ভয় পেয়েছিলে।

লোকটা একটু অবাক হয়ে তাকাল হেরম্যানের দিকে।

হেরম্যান হেসে বললেন, তুমি ওই বাদুড়টাকে ‘আহুল’ ভেবেছিলে তাই না? এ জঙ্গলেই তো তার বাস? হেরম্যানের কথা শুনে তার চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল। মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেল তার। সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

হেরম্যান সুদীপ্তর উদ্দেশ্যে বললেন, এত মানুষ বিশ্বাস করে ব্যাপারটা! পুরোটাই কি একটা মিথ্যা ব্যাপার! দেখা যাক।