আহুল – ১০

১০

সুড়ঙ্গর ভিতর থেকে বাইরেটা ভালো করে দেখার চেষ্টা করতে লাগল সবাই। না, কোথাও কোনো জংলিকে দেখা যাচ্ছে না। তবে চারদিকে কেমন যেন থমথমে পরিবেশ। সলকের মাথাটা ছাই রঙের মেঘে ঢাকা। তার চুড়ো দেখা যাচ্ছে না। বাইরের বাতাস সুড়ঙ্গর মতো গরম না হলেও সেখানেও বাতাসে গুমোট ভাব। পিনাক আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, এই মেঘটা সত্যিই বর্ষার মেঘ। আজ-কালের মধ্যেই বর্ষা নামবে!

সুদীপ্ত বলল, সে জন্যই কি পোকা-মাকড়গুলো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে? পিনাক জবাব দিল, তা হতে পারে, আবার ভূমিকম্প হবারও সম্ভাবনা আছে। হেরম্যান বললেন, আজ রাতে বৃষ্টি নামলেই ভালো। আমাদের পালানোর সুবিধা হবে।

অলিভিয়েরা বললেন, কী করবেন? জংলিগুলোকে তো দেখা যাচ্ছে না। বাইরে বেরিয়ে জঙ্গলের কিছুটা তফাতে ওই গিরিশিরার ভগ্নাবশেষে গা ঢাকা দেওয়া যেতে পারে প্রথমে। তারপর অন্ধকার নামলে জঙ্গলে ঢুকব। নাকি একেবারে রাত নামার জন্য অপেক্ষা করবেন?

সুড়ঙ্গমুখের ঠিক বিপরীত দিকে কালো পাহাড়টা। তার থেকে একটু কোণাকুণিভাবে মাটির ওপর ছোট ঢিপির মতো জেগে আছে পাহাড়েরই একটা অংশ। দেখতে অনেকটা নীচু প্রাচীরের মতো। ঝরনার জল নীচে নেমে যে জলাটা সৃষ্টি করেছে, সেটা সুদীপ্তদের ডানদিকে। বাঁদিকে পাথুরে দেওয়াল অর্ধবৃত্তাকারে এগিয়ে জঙ্গলের কিনারে শেষ হয়েছে। কিছুটা ঘাস জমি পেরিয়েই তারপর জঙ্গল। সুড়ঙ্গর মুখ থেকে সেই পাথুরে দেওয়ালও অন্তত পাঁচশো মিটার। সেটাও ঘাসজমি। বুকে হেঁটে সেটা পেরোতে হবে। নইলে দূর থেকে তাদের কেউ দেখে ফেলতে পারে। সুড়ঙ্গর মাথার ওপরই রয়েছে একটা টিলা।

হেরম্যান বাইরের দিকে তাকিয়ে বললেন, রাতে বেরোলে অন্য সমস্যা হতে পারে। প্ৰাণীটা বা প্রাণীগুলো যদি গুহা ছেড়ে বেরিয়ে আসে তখন সামনের ফাঁকা জমি পেরোনো যাবে না। জংলিরাও এদিকে চলে আসতে পারে। আর পিনাকের কথামতো যদি ভূমিকম্প হয় তবে পাথর চাপা পড়ে মরব আমরা। তার চেয়ে চারদিক দেখে নিয়ে বেরিয়ে পড়াই ভালো।

অবস্থা খতিয়ে দেখে শেষ পর্যন্ত হেরম্যানের প্রস্তাবেই সায় দিল সবাই। ঠিক হল, দুজন দুজন করে বাইরে বেরোনো হবে। সম্বল বলতে সুদীপ্তর কাছে থাকা রিভলভারের একটামাত্র গুলি।

হেরম্যান আর অলিভিয়েরার কাছে দুটো ছুরি আছে। ঠিক হল, প্রথমে বাইরে যাবেন হেরম্যান আর পিনাক। তাদের গুহার মধ্যে থেকে রিভলভার হাতে পাহারা দেবে সুদীপ্ত। পাথুরে দেওয়ালটার ওপাশে পৌঁছে রুমাল নাড়িয়ে সংকেত দিলে সুদীপ্তরা বাইরে আসবে।

শেষবারের মতো একবার ভালোভাবে দেখে নিয়ে হেরম্যান আর পিনাক বাইরে বেরিয়ে পড়লেন। ঘাসজমির মধ্যে দিয়ে বুকে হেঁটে তারা এগোতে লাগলেন পাথরের প্রাচীরটার দিকে। উদ্যত রিভলভার হাতে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল সুদীপ্ত। শ্বাসরুদ্ধ করা মুহূর্ত। এই বুঝি জংলিদের কোলাহল শোনা যায়! কিন্তু শেষ পর্যন্ত তেমন কিছু ঘটল না। নির্বিঘ্নেই হেরম্যানরা পৌঁছে গেলেন ঘাসজমির ওপাশে পাথুরে দেওয়ালের আড়ালে। সেখানে পৌঁছে হেরম্যান সংকেত করলেন। সুদীপ্তরাও বেরিয়ে পড়ল তারপর। শেষ পর্যন্ত তারাও পৌঁছে গেল পাথুরে দেওয়ালের আড়ালে।

সেখানে তারা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল। ভালো করে চারদিক দেখে নিল। না, কেউ কোথাও নেই। এবার এগোতে হবে জঙ্গলের দিকে। সূর্য হাঁটতে শুরু করেছে সলকের আড়ালে। দিন শেষ হতে চলেছে। সলকের মাথায় আরও মেঘ জমতে শুরু করেছে। ধূসর থেকে তারা কালো বর্ণ ধারণ করছে ক্রমশ।

এরপর আবার বুকে হেঁটে জঙ্গলের দিকে যাবার পালা। এবারও প্রথমে হেরম্যান আর পিনাক বুকে হেঁটে এগোতে শুরু করল জঙ্গলের দিকে। তাদেরকে কিছুটা তফাতে অনুসরণ করল সুদীপ্তরা। সামনের দুজনের সঙ্গে পিছনের দুজনের হাত-পঞ্চাশ মতো ব্যবধান। মাটি খুব গরম। হাতে, পিঠে যেন ছেঁকা লেগে যাচ্ছে। জমিটা ঢালু, মাঝে মাঝে ছোট ছোট গর্ত আছে। ঝরনার জল, বা দুদিন আগের বৃষ্টির জল জমা হয়েছে সেই ডোবাগুলোতে। সুদীপ্তরা সেই ডোবাগুলোর পাশ দিয়ে বুকে হেঁটে যেতে গিয়ে একটা অদ্ভুত জিনিস খেয়াল করল। বুড়বুড়ি কাটছে জল। প্রচণ্ড উত্তাপে ফুটতে শুরু করেছে ডোবার জল!

এগোচ্ছিল সুদীপ্তরা। কিন্তু হঠাৎ সামনে হেরম্যানেরা যেখানে এগোচ্ছিল, ঠিক সেখানে ঘাসজমি ফুঁড়ে উঠে দাঁড়াল দুজন জংলি। সম্ভবত হেরম্যান আর তারা পরস্পরকে দেখে ফেলেছে! সুদীপ্তদের দিকে পিছন ফিরে জংলি দুজনের একজন ধনুকে তির লাগাতে গেল। ঠিক সেই সময় ঘাসজমি থেকে স্প্রিং-এর মতো লাফিয়ে উঠে তার ঘাড় চেপে ধরল। বেশ কিছুটা দূর থেকেও সুদীপ্তদের কানে একটা শব্দ এল—মট! জংলিটা ঘাসবনে লুটিয়ে পড়ল। দ্বিতীয় জংলিটা হতবাক হয়ে গেছিল ব্যাপারটা দেখে। সে পালাতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার হাত চেপে ধরল পিনাক। হেরম্যান ততক্ষণে তার পাশে উঠে দাঁড়িয়েছে। স্থান-কাল ভুলে উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়েছে সুদীপ্তরাও। একটা ঝটাপটি শুরু হল দ্বিতীয় জংলিটা আর পিনাকের মধ্যে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে পিনাক তাকে মাথায় উঠিয়ে দূরে ছুড়ে ফেলল। তারপর হেরম্যান আর পিনাক ছুটতে শুরু করল জঙ্গলের দিকে। কিন্তু মাটিতে পড়ার পরই দ্বিতীয় লোকটা অদ্ভুত স্বরে আর্তনাদ করে উঠল। সুদীপ্তরাও জঙ্গলের দিকে ছুটতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই পাশের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল একদল জংলি। তাদের প্রথমেই নজর পড়ল সুদীপ্তদের ওপর। হেরম্যানরা তখন ঢুকে পড়েছে অন্যদিকের জঙ্গলে। জংলিরা সুদীপ্তদের দেখামাত্রই জান্তব আক্রোশে চিৎকার করে উঠল। জঙ্গলের দিকে এগোবার কোনো উপায় নেই। সুদীপ্তরা একটু বাঁক নিয়ে তিরের মতো ছুটল কাছেই একটা পাথুরে দেওয়ালের দিকে। সুদীপ্তদের পাশ দিয়ে শিসের মতো শব্দে করে হাওয়া কেটে বেরিয়ে গেল জংলিদের বেশ কয়েকটা তির। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা পৌঁছে গেল সেই পাথুরে দেওয়ালের আড়ালে। সুদীপ্তদের পিছনে একটু কোণাকুণি বেশ খানিকটা তফাতে সেই কালো পাহাড় আর গুহামুখের অবস্থান। দেওয়ালের দিকে অর্ধবৃত্তাকার ব্যূহ রচনা করে এগিয়ে আসতে লাগল জংলিদের দলটা। তাদের সবার আগে তির উঁচিয়ে ব্যাঙের উল্কি গায়ে আঁকা সর্দারটা। তার ঠোঁটের কোণে যেন হাসি ফুটে উঠেছে! সুদীপ্তরা বুঝতে পারল তারা এবার ফাঁদে পড়ে গেছে। গর্ত থেকে ইঁদুর টেনে বার করার মতো টেনে বার করে তাদের হত্যা করবে জংলিরা। হেরম্যানদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র নেই। তারা বেরিয়ে এসে এতগুলো লোকের বিরুদ্ধে লড়তে পারবে না।

জংলিরা ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে দেওয়ালের দিকে। বৃত্ত ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। সর্দারটা এক সময় দেওয়ালের হাত কুড়ি সামনে চলে এল। শেষ বিকেলের আলো এসে পড়েছে তার মুখে। সে মুখে ফুটে উঠেছে জিঘাংসা। শ্বাপদের মুখও এত হিংস্র হয় না। তার অনুচরদের চোখেও জান্তব দৃষ্টি। সুদীপ্তদের ঘিরে ফেলেছে তারা। মরার আগে অন্তত একটা কিছু শেষ চেষ্টা করতে হবে। একদম কাছে এসে গেছে জংলিটা। রিভলভার বার করে মুহূর্তের জন্য সর্দারটাকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে দিল সুদীপ্ত। অব্যর্থ লক্ষ্য। বীভৎস আর্তনাদ করে মাটি ছেড়ে শূন্যে লাফিয়ে উঠল লোকটা। তারপর শূন্যে ঘুরপাক খেয়ে ছিটকে পড়ল মাটিতে। সঙ্গে সঙ্গে এক ঝাঁক তির ছুটে এল সুদীপ্তদের দিকে। একটা তির সুদীপ্তর মাথার চুল ছুঁয়ে উড়ে গেল আকাশের দিকে। গুলি চালিয়েই সে বসে পড়েছিল। এক মুহূর্ত সময়ের ব্যবধানে মৃত্যুকে ফাঁকি দিতে পারল সে। অন্য তিরগুলো পাথরের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে আগুনের ফুলকি তুলে ছিটকে পড়ল এদিক-ওদিক। তবে সর্দারের মৃত্যু দেখে কয়েক পা পিছু হটে দাঁড়াল জংলিগুলো। ধনুকে তির লাগিয়ে পাথুরে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে তারা সুদীপ্তদের মাথা তোলার প্রতীক্ষা করতে লাগল। সুদীপ্তরাও দেওয়ালের ফাঁকের ফাটল দিয়ে তাদের দেখতে লাগল। সুদীপ্ত চাপাস্বরে অলিভিয়েরাকে বলল, আমাদের পিছনটাও তো অরক্ষিত। ওরা যদি ঘুরপথে আমাদের পিছনে আসে তাহলে আর কিছু করার নেই।

অলিভিয়েরা বললেন, ও পথে ওরা সম্ভবত আসবে না। কারণ তাহলে গুহার সামনে দিয়ে ওদের আসতে হবে। ও জায়গাটা ওরাও ভয় করে। নইলে এতক্ষণে নিশ্চয়ই ওরা ওই পথও ধরত। অন্ধকার নামলে আমরা সোজা ছুটব জঙ্গলের দিকে। তারপর অদৃষ্টে যা আছে হবে।

বাতাসে গরমের ভাব আরও বেড়ে চলেছে। দু-দলই নিজেদের জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষা করছে। জংলিরা সর্দারের হত্যাকারীদের কিছুতেই পালাতে দেবে না। কখন তারা বাইরে বেরোবে জংলিরা তার প্রতীক্ষা করছে। আর সুদীপ্তরা প্রতীক্ষা করছে অন্ধকার নামলে জংলিদের চোখে ধুলো দিয়ে পালাবার। মেঘ জমছে সলকের মাথায়। এক সময় সূর্য ডুবল দলকের আড়ালে। নামতে শুরু করল অন্ধকার। কিন্তু জংলিরা সম্ভবত সুদীপ্তদের মতলব অনুমান করতে পারল। অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গেই তারা বেশ কয়েকটা মশাল জ্বালিয়ে ফেলল। আলোকিত হয়ে উঠল সামনেটা। তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে আর অন্ধকারে পালানো সম্ভব নয়। মশালের আলোতে মুখে সাদা রং আর বিচিত্র রংমাখা অসভ্য বর্বর লোকগুলো ঠিক যেন প্রেতমূর্তি। মৃত্যুর পরে পৃথিবীতে সুদীপ্তদের নিয়ে যেতে এসেছে তারা। সময় এগিয়ে চলল।

চাঁদ উঠল একসময়। মেঘের আড়ালে ফ্যাকাশে চাঁদ। গরম আরও বাড়ছে। থমথমে বাতাসে কী একটা ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে আসতে লাগল। অলিভিয়েরা বললেন, সম্ভবত গন্ধকের গন্ধ। কোথা থেকে আসছে কে জানে! সুদীপ্তদের মনে হল জংলিদের মধ্যে একসময় একটু চঞ্চলতা দেখা দিল। তারা দু-একজন মুঠো ভর্তি মাটি তুলে নিয়ে শুঁকতে থাকল। কয়েকজন সুদীপ্তদের পিছনে কালো পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে কী যেন বলাবলি করল! তারপর কয়েক পা আরও এগিয়ে আবার থমকে দাঁড়াল।

অলিভিয়েরা বলল, ওদের ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে অধৈর্য হয়ে উঠছে তারা। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে এগিয়ে আসবে আক্রমণের জন্য।

কার্তুজ শেষ। তবুও সুদীপ্ত কিছুটা অবচেতনেই তার জামার নীচে হাত দিল কোনো অস্ত্র আছে কিনা তা দেখার জন্য। একটা লম্বা শক্ত জিনিসে তার হাত ঠেকল। সুদীপ্ত সেটা বার করল। এই অবস্থার মধ্যেও সেটা দেখে হাসি পেল সুদীপ্তর। সেই হাড়ের টুকরোটা! অলিভিয়েরা বলল, এটা কী?

সুদীপ্ত সেটা তার হাতে দিয়ে বলল, একটা হাড়ের টুকরো। আমরা পথে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। সম্ভবত জংলিদের কিছু হবে। পিনাক এই ফাঁপা হাড়টা দিয়ে ছুরির হাতল বানাবে ভেবেছিল।

জংলিদের জিনিস! হাড়টাকে আবছা আলোতে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে হঠাৎই যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল অলিভিয়েরার চোখ। বিড়বিড় করে তিনি বললেন, হার্জেল আমাকে এমন একটা জিনিসের কথা বলেছিল। হয়তো এটাই আমাদের রক্ষা করতে পারে। কীভাবে? প্রশ্নটা করেই সুদীপ্ত দেওয়ালের ফোকর দিয়ে দেখতে পেল জংলিরা মশাল হাতে এগিয়ে আসছে দেওয়ালের দিকে। সে চাপাস্বরে অলিভিয়েরাকে সতর্ক করল, ওরা এগিয়ে আসছে!

অলিভিয়েরা একবার সেই ফাটল দিয়ে দেখল তাদের। তারপর সেই ফাঁপা হাড়ের টুকরোটাতে মুখ দিয়ে জোরে ফুঁ দিতেই সুদীপ্ত চমকে গেল। একটা তীক্ষ্ণ গম্ভীর শব্দ বেরিয়ে এল সেই হাড়ের টুকরো থেকে—‘আ-হু-উ-উ-ল!’

শব্দটা কানে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই জংলিরা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

অলিভিয়েরা আবার ফুঁ দিলেন। আবার বাতাসে শব্দ ছড়িয়ে পড়ল—‘আ-হু-উ-উ-ল!’ আর এর পরই যেন কালো পাহাড়ের দিক থেকে একটা তীক্ষ্ণ প্রত্যুত্তর ভেসে এল—‘আ-হু-উ-উ-ল…!’

আতঙ্ক ফুটে উঠল জংলিদের চোখে। সামনে না এগিয়ে এবার তারা পিছনে ফিরে দৌড়তে শুরু করল।

সুদীপ্তদের পিছনে পাহাড়ের দিকে একটা অস্পষ্ট শব্দ হল। অলিভিয়েরা সুদীপ্তর হাতে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বললেন—শুয়ে পড়ুন! দেওয়ালের গা ঘেঁষে অন্ধকারে শুয়ে পড়ল দুজনে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সেই পাহাড়ের দিক থেকে ডানা মেলে একটা কালো ছায়া উড়ে এল। গন্ধকের গন্ধ ছাপিয়ে পুতি গন্ধে ভরে উঠল আকাশ। বিশ্রী দুর্গন্ধ! মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাবার সময় মুহূর্তের জন্য একবার তার হিংস্র লাল চোখ আর ছুরির মতো নখওলা থাবাগুলো সুদীপ্ত যেন দেখতে পেল। কি বীভৎস সেগুলো! উড়ন্ত দানবটা সুদীপ্তদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে দেওয়াল ভিঙিয়ে গিয়ে পড়ল পলায়মান জংলিদের মাঝখানে। প্রচণ্ড আর্তনাদ শুরু হল জংলিদের মধ্যে। সাথীহারা ক্রুদ্ধ প্রাণীটা প্রচণ্ড আক্রোশে ফালা ফালা করে চিরছে তাদেরকে। অলিভিয়েরা সুদীপ্তকে বলল, উঠে পড়ুন, এবার পালাতে হবে। দুজনে মিলে সেই পাথুরে দেওয়ালের আড়াল থেকে বেরিয়ে দৌড় লাগাল জঙ্গলের যে অংশে হেরম্যানরা তাদের প্রতীক্ষায় আছেন সে দিকে। জঙ্গলের ভিতরে ঢুকেই দেখা হলো তাদের সঙ্গে। হেরম্যান আর পিনাক দীর্ঘক্ষণ ধরে জঙ্গলের আড়াল থেকে লক্ষ করছিল এই ভয়ংকর চিত্রনাট্য। সুদীপ্তকে জড়িয়ে ধরলেন হেরম্যান। তারপর আর সময় নষ্ট না করে চারজনেই জঙ্গল ভেঙে ছুটতে শুরু করল। পিছন থেকে ভেসে আসতে লাগল জংলিদের অস্পষ্ট আতনাদ।

বেশ কিছুটা ছোটার পর হেরম্যান অলিভিয়েরাকে জিজ্ঞেস করলেন, প্রাণীটার ডাক আপনি নকল করলেন কীভাবে? অলিভিয়েরা সেই হাড়ের টুকরোটা দেখিয়ে বললেন, এই ফাঁপা হাড়টা আসলে একটা বাঁশি। আ-হুলের ডাক বার হয়। জংলিরা এটা বাজিয়ে তাকে গুহার বাইরে ডাকত। ভাগ্যক্রমে এটা আপনাদের হাতে আসে। হার্জেল আমাকে বলেছিল এ বাঁশির কথা। সে ব্যাপারটা শুনেছিল জংলিদের হাত থেকে পালিয়ে আসা বন্দিদের থেকে।

হেরম্যান সুদীপ্তকে বললেন, যে রাতে জংলিরা জলার পাড়ে আমাদের নিয়ে গেল সেদিন বাঁশিটা ওদের কাছে থাকলে প্রাণীটাকে ডাকার জন্য ওদের অত সাধ্যসাধনা করতে হতো না। আমরাও বাঁচতাম না। মনে আছে ওদের সর্দারটা নিজের পোশাকের মধ্যে কী যেন খুঁজছিল? সম্ভবত এই বাঁশিটাই এ কথা বলার পর হেরম্যান অলিভিয়েরাকে জিজ্ঞেস করলেন, বেঁচে ফিরলে কালো পাহাড়টার কী নাম দেবেন? জংলিরা সম্ভবত আর আমাদের অনুসরণ করবে না।

অলিভিয়েরা হেরম্যানের কথার কী একটা জবাব দিতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সেই মুহূর্তে সুদীপ্তদের পায়ের তলার মাটি যেন মৃদু কেঁপে উঠল। আর তার পরই প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠল পৃথিবী। আকাশ লাল হয়ে উঠল। সুদীপ্তরা জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল দূরে পিছনে ফেলে আসা কালো পাহাড়টার মাথাটা উড়ে গেছে। লক্ষ-কোটি তুবড়ি, রংমশাল যেন ফোয়ারার মতো নির্গত হচ্ছে সেখান থেকে। অগ্ন্যুৎপাত! দীর্ঘদিন ঘুমিয়ে থাকার পর জেগে উঠেছে কালো পাহাড়টা।

অলিভিয়েরা মন্তব্য করলেন, কেন মাটি এত গরম হচ্ছিল, বাতাসে গন্ধকের গন্ধ ভাসছিল এবার বোঝা যাচ্ছে। অন্ধকার জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সুদীপ্তরা দ্রুত এগিয়ে চলল দূর থেকে দূরে। শেষ রাতে বাঁধ ভাঙা বৃষ্টি নামল সলকের পাদদেশে। সেই কালো পাহাড়, সেই দুঃস্বপ্নের জগৎকে তখন সুদীপ্তরা অনেক পিছনে ফেলে এসেছে।

পরিশিষ্ট ঃ বর্ষাবনের বৃষ্টি! যেমন ভয়ংকর, তেমনই আশ্চর্য সুন্দর তার রূপ। সলকের গা বেয়ে দুর্বার গতিতে নেমে আসা জলধারাগুলো ভরিয়ে তুলছে নদীখাতগুলোকে। জলস্রোত পাথরে ধাক্কা খেয়ে পাক খেতে খেতে উল্কার বেগে ছুটে চলেছে। তাতে পড়লে খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে সুদীপ্তরা। আবার তারই সঙ্গে সঙ্গে বড় বড় গাছগুলো তাদের ধূসরতা মুছে বৃষ্টির জলে সবুজে সবুজ হয়ে উঠছে। বড় বড় গাছগুলোর মাথা আন্দোলিত হচ্ছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে যেন আনন্দ উল্লাস করছে তারা। এ এক অদ্ভুত সৌন্দর্য। সারাদিন চলল বৃষ্টি। এগিয়ে চলল সুদীপ্তরা। চলতে চলতে অলিভিয়েরাকে হেরম্যান জিজ্ঞেস করলেন, প্রাণীটা সম্বন্ধে আপনার বক্তব্য কী?

অলিভিয়েরা বললেন, এমন হতে পারে প্রাণীটা তেজস্ক্রিয়তার ফলে এমন রূপ ধারণ করেছে।

দিন শেষ হল এক সময়। রাত এল। সেই রাতও শেষ হতে চলল এক সময়। শেষ রাতে একটা টিলার ওপর উঠতেই সুদীপ্তরা দেখতে পেল সমুদ্র। বৃষ্টি তখন একটু থেমেছে। চাঁদের আলোতে দেখা যাচ্ছে সলকের তুষার ধবল শৃঙ্গ। অপূর্ব দৃশ্য। হঠাৎ পিনাক আকাশের দিকে আঙুল তুলে বলল, ওই দেখুন!

সুদীপ্তরা তাকিয়ে দেখল তাদের মাথার অনেক ওপর দিয়ে সমুদ্রের দিকে উড়ে যাচ্ছে বাদুড়ের মতো এক প্রাণী। কিন্তু বাদুড় অত বড় হয় না! সেই প্রাণীটাই হবে!

হেরম্যান সেদিকে তাকিয়ে মন্তব্য করলেন, সমুদ্রর ওপাশেই তো বোর্নিও তাই না? হয়তো প্রাণীটা ওখান থেকেই এসেছিল। সাথীহারা, বাসাহারা প্রাণীটা হয়তো ফিরে যাচ্ছে তার আদি বাসস্থান বোর্নিওর জঙ্গলে।

অন্ধকার আকাশে সমুদ্রের ওপর দিয়ে হারিয়ে গেল প্রাণীটা। অলিভিয়েরা একটা শব্দ করলেন এরপর। ‘আহু-উ-ল’ নয়, ‘অ্যাহয়!’ এ শব্দ করে জলযানকে ডাকে নাবিকরা। প্রত্যুত্তরে সমুদ্র থেকে ভেসে এল সেই শব্দ অ্যাহয়, অ্যাহয়! একটা জেলে ডিঙি এগিয়ে আসছে পাড়ের দিকে। ঢাল বেয়ে সুদীপ্তরা নামতে শুরু করল সমুদ্রের দিকে। হেরম্যান সুদীপ্তকে বলল, এরপর ভাবছি মাদগাস্কারা যাব। সেখানে নাকি শুনেছি মানুষখেকো গাছ আছে…ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগল জেলে-ডিঙিটা। সুদীপ্ত জবাব দিল আমিও যাব।

হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত, জন্ম ১৯৭৩ কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ। বর্তমান বাসস্থান কাঁচরাপাড়া। কিশোর সাহিত্যের নিয়মিত লেখক। সন্দেশ, আনন্দমেলা, কিশোর ভারতী, শুকতারা প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠিত শিশু-কিশোর পত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। বড়দের জন্যও লেখেন বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২০টি। তার সুদীপ্ত-হেরম্যানের উপন্যাস অনূদিত হয়েছে ইংরেজিতেও। জনপ্রিয় এফ.এম. চ্যানেলগুলোতে পরিবেশিত হয়েছে একাধিক গল্পর নাট্যরূপ। শখ-আড্ডা, ভ্রমণ।
 

লেখক পরিচিতি

.

হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত, জন্ম ১৯৭৩ কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ। বর্তমান বাসস্থান কাঁচরাপাড়া। কিশোর সাহিত্যের নিয়মিত লেখক। সন্দেশ, আনন্দমেলা, কিশোর ভারতী, শুকতারা প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠিত শিশু-কিশোর পত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। বড়দের জন্যও লেখেন বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২০টি। তার সুদীপ্ত-হেরম্যানের উপন্যাস অনূদিত হয়েছে ইংরেজিতেও। জনপ্রিয় এফ.এম. চ্যানেলগুলোতে পরিবেশিত হয়েছে একাধিক গল্পর নাট্যরূপ। শখ-আড্ডা, ভ্রমণ।