আহুল – ১

‘আ-আ-হু-উ-উ-ল…!’ আধো ঘুমের মধ্যে শব্দটা যেন শুনতে পেলাম আমি। শঙ্খনাদের মতো গম্ভীর অথচ তীক্ষ্ণ একটা শব্দ। বার কয়েক যেন শব্দটা স্পষ্ট শুনলাম। শব্দটা সত্যি কিনা তা ভালো করে বোঝার আগেই ইরিয়ানের ধাক্কায় ধড়মড় করে উঠে বসলাম। একটা ছোট্ট পেট্রম্যাক্স জ্বলছে তাঁবুর এক কোণে। তাছাড়া বাইরে থেকে চাঁদের আলো তাঁবুর পাতলা কাপড় ভেদ করে ভিতরে ঢুকছে। আমরা দুজনেই মাটিতে শুয়েছিলাম। ধাক্কা খেয়ে উঠে বসে আমার মালয় কুলি ইরিয়ানের মুখের দিকে তাকাতেই দেখি তার মুখ যেন রক্তশূন্য হয়ে গেছে। আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু তার আগেই আমাকে সে ইশারায় চুপ থাকতে বলে তর্জনী নির্দেশ করল তাঁবুর মাথার দিকে।

প্রথমটা আমি সেদিকে তাকিয়ে কিছু বুঝতে পারলাম না। কয়েক মুহূর্ত লাগল চোখ সইয়ে নিতে। তারপর আমি দেখতে পেলাম একটা অদ্ভুত জিনিস। তাঁবুটা হালকা, পর্দাটা প্রায় স্বচ্ছ, সিল্কের তৈরি। সেই পর্দা দিয়ে আমি দেখতে পেলাম তাঁবুর ঠিক মাথার ওপর ভাসছে একটা বিরাট বাদুড়! কিন্তু বাবুড় কি এত বড় হয়? তার দুটো ভানার বিস্তার যেন আমাদের পুরো তাঁবুটাকেই ঢেকে দিতে পারে। তাঁবুর মাথার ওপর পনেরো থেকে কুড়ি ফুট ওপরে মৃদু মৃদু ভানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে প্রাণীটা ভাসছে। মাঝে মাঝে তার ডানার ছায়া ঢেকে দিচ্ছে পুরো তাঁবুটাকেই। ঢেকে দিচ্ছে বাইরে মাথার ওপর অত বড় চাঁদটাকেও। অন্ধকার নেমে আসছে তাঁবুর ভিতর! আমার কানের পাশে ইরিয়ানের .ভয়ার্ত গলা শুনতে পেলাম— সাহেব, আ-হুল!!

সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ে গেল ইরিয়ানের মুখে আজ বিকালে শোনা গল্পটা। কারণে এখানে তাঁবু ফেলার মতো এত সুন্দর জায়গা পেয়েও ইরিয়ান তাঁবু খাটাতে ইতস্তত করছিল। তাহলে ওটা কি সত্যিই ইরিয়ানদের গল্পকথার উড়ুক্কু দানব আহুল? ওই শঙ্খের মতো তীক্ষ্ণ ধ্বনি স্বপ্নে নয়, সত্যি শুনলাম আমি! হতভম্বের মতো আমি তাকিয়ে রইলাম তাঁবুর ছাদের দিকে। ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম প্রাণীটাকে। মাথাটা ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না তার। ঘাড়ের ওপর ছুঁচলো কান দুটোই শুধু উঁকি মারছে। কারণ প্রাণীটা সম্ভবত তার মাথাটা নীচের দিকে ঝুঁকিয়ে উড়তে উড়তে তাঁবুটা লক্ষ করছে।

আর কয়েক মুহূর্ত মাত্র। আর তারপরই প্রাণীটা যেন তাঁবুটাকে লক্ষ্য করেই নীচে নেমে আসতে লাগল। তার বিশাল ডানার ছায়াতে ঢেকে যেতে লাগল তাঁবুটা। ইরিয়ান আতঙ্কে একটা অস্পষ্ট আর্তনাদ করে উঠল। উড়ুক্কু প্রাণীটা তাঁবুর প্রায় মাথায় নেমে এসেছে! নিজের অজান্তেই পাশ থেকে কখন যে রিভলভারটা তুলে নিয়েছিলাম খেয়াল নেই। সে তাঁবুর ওপর নেমে আসতেই তাকে লক্ষ্য করে অটোমেটিক রিভলভার থেকে চালিয়ে দিলাম গুলি! রিভলভারের শব্দ আর প্রাণীটার ডানা ঝাপটানোর শব্দে খান্‌খান্ হয়ে গেল রাত্রির নিস্তব্ধতা। ভয় পেয়ে কোথা থেকে যেন একদল পাখি কর্কশ শব্দে ডেকে উঠল! আর সেই উড়ন্ত প্রাণীটা যেন তাঁবুর ওপর থেকে ছিটকে পড়ল কোথাও। বেশ কিছুক্ষণ ধরে বাইরের পাহাড়-জঙ্গলে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল গুলি আর অন্যান্য মিলিত শব্দ। তারপর বাইরের পৃথিবী আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেল। বাইরে থেকে শুধু ভেসে আসতে লাগল ক্রেটারের গা বেয়ে নেমে আসা ঝরনার ঝরঝর শব্দ।

ইরিয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে তখনও ঠকঠক করে কাঁপছে। আমি হতভম্ব কম হইনি। কিন্তু আমি আমার কর্তব্য ঠিক করে নিলাম। আমার সাহস বরাবরই বেশি, হয়তো বা তাকে দুঃসাহসই বলা যায়। নইলে আমার মতো কোনো ধাতুবিদ এই শ্বাপদসঙ্কুল, আগ্নেয়পর্বত অধ্যুষিত জাভার জঙ্গলে একজন কুলি আর একটা রিভলভার সম্বল করে ধাতু খুঁজতে আসে?

আমি তাঁবুর বাইরে বেরুব। দেখতে হবে ব্যাপারটা কী। রিভলবারের ছ-টা গুলিই খালি করে দিয়েছিলাম । নতুন ম্যাগাজিন ভরে আমি উঠে তাঁবুর দরজার সামনে দাঁড়ালাম। সাবধানে পর্দা ফাঁক করে বাইরে তাকালাম। জ্যোৎস্না-বিধৌত পৃথিবী। কিছু দূরে ক্রেটারের গা বেয়ে নেমে আসা ঝরনাটা ঝলমল করছে চাঁদের আলোতে। তার আড়ালে সেই গুহামুখটাও যেন দেখা যাচ্ছে। এই ছোট্ট কালো আগ্নেয় পাহাড়টার ঠিক নীচেই আমাদের তাঁবু ছোট্ট একটা সমতল জায়গাতে। একদিকে পাহাড়, ঝরনা আর অন্য তিনদিকে বাঁশ, আর অন্যান্য গাছের ঘন জঙ্গল। ঝরনার জল একপাশের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গিয়ে হারিয়ে গেছে অন্য কোথাও। চারপাশে যতটা দেখা যায় দেখার চেষ্টা করলাম ৷ মাথার ওপর চাঁদ হাসছে। শান্ত-সুন্দর পৃথিবী। কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটা যেন নেহাতই স্বপ্ন।

তবুও সাবধানে তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়ালাম। সব কিছু তো ঠিকঠাকই বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এরপরই কিছুটা তফাতে একটা জিনিস নজরে পড়ল আমার। জ্বালামুখ বা ক্রেটারের বাইরের গা বেয়ে নেমে আসা ঝরনাটা নীচে নেমে প্রথমে একটা ছোট্ট ডোবা মতো সৃষ্টি করেছে। তার পাড়ে তাঁবু থেকে আনুমানিক ষাট-সত্তর ফুট তফাতে কী যেন একটা নড়ছে! তবে জিনিসটা বিরাট কোনো প্রাণী নয়, ছোটখাটো কিছু হবে। যাই হোক, সাহসে ভর করে রিভলভার তাক করে এগোলাম সেদিকে।

তার কাছে গিয়ে ভালো করে তাকিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই হেসে ফেললাম আমি। না এটা ‘আহুল’ নয়, তবে একটা বাদুড়। তবে একটু বড় আকারের। আসলে চাঁদের আলোতে, সিনেমার পর্দার মতো তাঁবুর গায়ে তার ছায়াটা ছায়াবাজির মতো বড় আকারে ধরা দিয়ে আমাদের দৃষ্টিবিভ্রম ঘটিয়েছিল।

প্রাণীটা তখনও নড়ছে।

তাঁবুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম ইরিয়ান বাইরে বেরিয়ে এসেছে। হাত নেড়ে তাকে ডাকতেই সে আমার কাছে এগিয়ে এল। তার হাতে ধরা আছে একটা ধারালো ‘দা’ বা ‘বোলো’। চাঁদের আলোতে ঝিলিক দিচ্ছে সেটা। তবে তখনও তার মুখে আতঙ্কের স্পষ্ট ছাপ।

আমি প্রাণীটাকে দেখিয়ে তার উদ্দেশ্যে বললাম, এই যে তোমার ‘আহুল’ এখানে শুয়ে আছে।

প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। ক্রমশই চওড়া হল তার হাসি। সে হাসি শুধু আতঙ্ক অবসানের জন্য নয়, অন্য একটা কারণও আছে তার পিছনে। ইরিয়ানরা বাদুড় খায়। আমাদের এই যাত্রা শুরুর দ্বিতীয় দিনে একটা বাদুড় মেরে পুড়িয়ে খেয়েছিল সে। ফল খায় বলে বাদুড়ের মাংস নাকি খুব সুস্বাদু হয়। যদিও বাদুড়ের মাংস খেতে আমার রুচি হয়নি, বরং ইরিয়ানের খাওয়া দেখে আমার গা গুলিয়ে উঠেছিল। বাদুড়টার দিকে তাকিয়ে ইরিয়ান একটু লজ্জিতভাবে হেসে বলল, আসলে ‘আ-হুলের’ গল্প ছোটবেলা থেকে এত শুনেছি যে মনের মধ্যে গেঁথে আছে ব্যাপারটা। তাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তবে তাঁবুর ভিতরে এটা নিয়ে ঢোকা চলবে না। যা দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে প্রাণীটার গা থেকে। এটা নিয়ে গেলে বাকি রাতটা আর গন্ধে ঘুমানো যাবে না।

ইরিয়ান বলল, ঠিক আছে, ভিতরে নেব না।

এই বলে সে তার দা-টা বাগিয়ে বাদুড়টার আরও কাছে এগিয়ে গেল প্রাণীটার মৃত্যুযন্ত্রণা শেষ করার জন্য। কিন্তু প্রাণীটার দেহে তখনো মনে হয় কিছুটা জীবনীশক্তি অবশিষ্ট ছিল। ইরিয়ান তার ওপর ঝুঁকে পড়তেই সে হঠাৎ তার ভাঙা ডানা ঝাপটিয়ে মাটি ছেড়ে উঠে আমাদের মাথার ওপর দিয়ে শেষ একবার পালানোর চেষ্টা করল। আবার একটা গুলি চালালাম আমি। আবার নিস্তব্ধতা ভঙ্গ হল। রিভলবারের শব্দ পাহাড়-জঙ্গলে অনুরণিত হল বেশ কিছুক্ষণ ধরে। লক্ষ্য কিন্তু অব্যর্থ। তবে উড়ন্ত অবস্থায় গুলির অভিঘাতে প্রাণীটা ছিটকে গিয়ে পড়ল পঞ্চাশ ফুট দূরে পাথরের গা বেয়ে ঝরনাটা যেখান দিয়ে নামছে তার কাছে একটা পাথরের ওপর। তার আছড়ে পড়ার ধরন দেখেই বুঝলাম সে আর কোনোদিন উড়বে না। ডোবার পাড় বেয়ে পাথর বিছানো একটা রাস্তা আছে ঝরনার কাছে পৌঁছবার। চাঁদের আলোতে ঝরণর আড়ালের অন্ধকার গুহামুখটা এখন অনেকটাই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমি ইরিয়ানকে বললাম—এবার তুমি তোমার কাজ করো। আমি শুতে চললাম। কাল ভোরেই রওনা হব। ক্রেটারের মাথায় উঠে দেখতে হবে রাস্তার কোনো চিহ্ন চোখে পড়ে কিনা?

আমার কথা শুনে সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে ভেজা পাথরের ওপর পা ফেলে ইরিয়ান এমনভাবে ঝরনার দিকে এগোল যে আমি বুঝতে পারলাম কাল ভোরে ওই হতভাগ্য বাদুড়টার চামড়া ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। ইরিয়ান এগোল সেদিকে আর আমি এগোলাম তাঁবুর দিকে। ঘুমিয়ে নিতে হবে।

৩াবুর মধ্যে পা রেখে হঠাৎই আমার একটা ব্যাপারে খটকা লাগল। আহুলরূপী উড়ন্ত প্রাণীটা নয় বাদুড়, কিন্তু সেই বিচিত্র শব্দটা! যে শব্দটা আমার কানে গিয়েছিল? সেটা কি তবে ঘুমন্ত অবস্থায় শোনা কল্পনা? ইরিয়ান কি শোনেনি সেই শব্দ?

এ ব্যাপারটা ভাবতে না ভাবতেই হঠাৎই একটা তীব্র আর্তনাদ ভেসে এল বাইরে থেকে। আরে এ যে ইরিয়ানের আর্ত চিৎকার! মাটির ওপর পড়ে থাকা টর্চটা তুলে নিয়ে রিভলভার হাতে সঙ্গে সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এলাম। ইরিয়ানের যেখানে থাকার কথা সে সেখানে নেই! সে জায়গার দিকে ছুটলাম আমি। ডোবার পাড়ে পিছল পাথরে পা রেখে কোনোরকমে পৌঁছে গেলাম ঝরনার সামনে। সেই বাদুড়টা এখনো একই জায়গাতে পড়ে আছে, কিন্তু ইরিয়ান কোথাও নেই! চারপাশে তাকে দেখতে না পেয়ে আমি চিৎকার করে উঠলাম, ইরিয়ান? ইরিয়ান? আমার চিৎকার প্রতিধ্বনিত হতে লাগল পাহাড়ের গায়ে। আর এরপরই একটা অস্পষ্ট শব্দ পেলাম আমি। সে শব্দ সম্ভবত ঝরনার আড়ালে গুহামুখের ভিতর থেকে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে আমি টর্চের আলো ফেললাম সে দিকে। ওপর থেকে নেমে আসা জলস্রোত ভেদ করে ওপাশে সামান্য কিছুটা আলো গিয়ে পৌঁছল গুহার ভিতরে। মুহূর্তের জন্য কেন জানি না মনে হল একজোড়া উজ্জ্বল লাল চোখ গুহার ভিতর থেকে চেয়ে আছে আমার দিকে। আর তারপরই সেই অন্ধকার গুহার ভিতর থেকে জলস্তর ভেদ করে কী একটা জিনিস যেন ছিটকে বেরিয়ে এসে ঠং করে আমার কিছুটা তফাতে পাথরের ওপর পড়ল। জিনিসটার দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম আমি। কনুই থেকে ছিন্ন হয়ে যাওয়া মানুষের একটা হাত! সে হাতে তখনো ধরা আছে একটা ‘বোলো’! ইরিয়ানের ‘দা’ ধরা হাতটা! টর্চটা আমার হাত থেকে খসে পড়ার আগে আমি স্পষ্ট দেখলাম গুহার ভেতর থেকে লাল রঙের একটা ধারা যেন বাইরে এসে মিশছে ঝরনার জলের সঙ্গে! টর্চটা খসে পড়ল হাত থেকে। একটু তফাতেই মাটির ওপর পড়ে আছে ইরিয়ানের কাটা হাতটা। হঠাৎই যেন আতঙ্ক পেয়ে বসল আমাকে। ঝরনার আড়ালে গুহামুখ লক্ষ্য করে পরপর বেশ কয়েকটা গুলি ছুড়লাম, তারপর ছুটতে শুরু করলাম তাঁবুর দিকে।

তাহলে কি যে শব্দটা শুনে আমি উঠে বসেছিলাম সেটা সত্যি? ঝরনার আড়ালে গুহার ভিতর থেকে উঁকি দেওয়া চোখ দুটো কিসের?

সে ঘটনার পর ঘণ্টা পাঁচেক সময় কেটে গেছে। বাইরে আর কোনো শব্দ পাইনি। ঘড়ির কাঁটা বলছে ভোর হয়ে এল। দু-একটা পাখির ডাকও মনে হয় শোনা যাচ্ছে। দিনের আলো ভালো করে ফুটলেই এ জায়গা ত্যাগ করব আমি। ইরিয়ান নিশ্চয়ই আর ফিরবে না। একলাই এগোতে হবে আমাকে। আমার অনুমান উত্তর দিকে আর কিছুটা এগোলেই সমুদ্রর দেখা মিলে যাবে। হয়তো বা সেটা আর মাত্র একটা দিনের পথ…।

হাতে ধরা কাগজ থেকে উপরের অংশটা পাঠ করলেন হেরম্যান। লেখাগুলো একটা দিনলিপির শেষাংশ। মূল ডায়েরিটা অবশ্য নয়। সে ডায়েরি থেকে লেখাগুলো উঠিয়ে কাগজে টাইপ করা হয়েছে। একগোছা কাগজ হেরম্যানের হাতে। হেরম্যানের পড়া শেষ হতেই টেবিলের ওপাশে বসা মাঝবয়সি লোকটা সুদীপ্তদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর অলিভিয়েরা নামক ওই ওলন্দাজ ধাতুবিদ সমুদ্রতীর পর্যন্ত পৌঁছতে পারেননি। একদল মালয় জেলে জঙ্গলে ঢুকেছিল কাঠ আনতে। সমুদ্রতীর থেকে বেশ গভীরে একটা ছোট আগ্নেয় পর্বতের পাদদেশে ওই ভদ্রলোকের ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ আবিষ্কার করে তারা। দেহের একটা বড় অংশ কোনো একটা প্রাণী খেয়ে গিয়েছিল। আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিল তার কিছু জিনিসপত্র। ডায়েরিটাও ছিল তার মধ্যে। এই ডায়েরিটা দেখেই তাকে শনাক্ত করা হয়।

হেরম্যান জানতে চাইলেন, আসল ডায়েরিটা এখন কোথায়?

জাভা ক্রনিকালের বান্দুং দপ্তরের প্রধান মিস্টার আলি জবাব দিলেন, ওটা পুলিশের হেফাজতে আছে। তবে চিন্তা নেই, যে কাগজগুলো আপনাদের দিলাম তা হুবহু ওই ডায়েরি থেকে কপি করা। এরপর একটু থেমে তিনি বললেন, আমাদের সংবাদপত্রের জাকার্তার হেড অফিস থেকে আমাকে আপনাদের সবরকম সাহায্য করতে বলা হয়েছে। আপনাদের সাংবাদিকের পরিচয়পত্রও তৈরি। কিন্তু একটা কথা, আপনারা দুজন নাকি আসলে ক্রিপ্টোজ্যুলজিস্ট? এ শব্দটা আমার অজানা। এর মানেটা কী? আপনাদের অভিযানের বিবরণ যে আপনারা আমাদের হাতে তুলে দেবেন, সে মর্মে আমাদের কাগজের সঙ্গে চুক্তির কথাটাও আমার জানা। শুধু অভিযানের কারণ জানা নেই। হেড অফিস থেকে বলা হয়েছে, সেই গোপনীয় ব্যাপারটা আপনারাই আমাকে জানাবেন৷

সুদীপ্ত এতক্ষণ চুপচাপ বসে মিস্টার আলি আর হেরম্যানের কথোপকথন শুনছিল। এবার সে হেরম্যানের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে মিস্টার আলির উদ্দেশ্যে বলল, হ্যাঁ, আমরা ক্রিপ্টোজ্যুলজিস্ট। আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তর দিলেই দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন। ব্যাপারটা আপনাকে সংক্ষেপে বুঝিয়ে বলি। বিভিন্ন দেশের রূপকথা, লোকগাথা, উপকথায় বিভিন্ন অদ্ভুত প্রাণীর সন্ধান পাওয়া যায়। বাস্তবের ওইসব প্রাণীর উপস্থিতি সাক্ষ্যপ্রমাণসহ না মিললেও দীর্ঘদিন ধরে ওইসব প্রাণীর কথা শুনে আসছি আমরা। এই যেমন হিমালয়ের তুষার মানব বা ‘ইয়েতি’, আমেরিকার ‘বিগফুট’, আফ্রিকার ‘সিংহ-মানুষ’, মাদাগাস্কারের ‘নরখাদক গাছ’, স্কটল্যান্ডের ‘লেকনেসির জলদানব’ বা ভারতের লোকগাথার কথা-বলা পাখি ‘ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী’। এমনকি ‘টেরডাকটাইলের’ মতো প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর উপস্থিতি আজও বোর্নিওর জঙ্গলে আছে বলে অনেকের ধারণা। এইসব লোককথা-উপকথা বা প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীকে বলা হয় ‘ক্রিপটিড’। আর যাঁরা সেসব প্রাণী নিয়ে অনুসন্ধান করেন তাঁদের বলা হয় ‘ক্রিপ্টোজ্যুলজিস্ট’।

সুদীপ্তর কথা শুনে মিস্টার আলি অবাক হয়ে বললেন, বুঝলাম, তার মানে আপনারা এসেছেন ‘আ-হুলের’ খোঁজে! কিন্তু এসব ব্যাপার তো ফ্যান্টাসি! তার জন্য আপনারা একজন ইন্ডিয়ান, অন্যজন জার্মানি থেকে এই জাভায় ছুটে এসেছেন।

সুদীপ্ত হেসে বলল, ঠিক তাই। সত্যিই এক সময় ব্যাপারটাকে ফ্যান্টাসি ভাবত। অনেকে ক্রিপ্টোজ্যুলজিস্টদের ধাপ্পাবাজ বলতেও ছাড়েননি। কিন্তু আজকে অনেকেই 
আর এ ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দিতে পারছেন না। ধরুন, এক সময় সমুদ্র অভিযানের গল্পে দানব অক্টোপাসের কথা শোনা যেত। যারা শুঁড়ে পেঁচিয়ে নৌকো ডুবিয়ে দিত। ব্যাপারটাকে অনেকে ভাবতেন অশিক্ষিত জেলেদের গল্প। ক্রিপ্টোজ্যুলজিস্টরা জাপান সরকারের সাহায্যে সমুদ্রের গভীরে গিয়ে সেই ‘জায়েন্ট স্কুইডের’ চলমান ছবি তুলে পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। সিলিকাস্থ মাছের দেখা মিলেছিল ৪৯ কোটি বছরের প্রাচীন জীবাশ্মে। বিজ্ঞানীরা মানতেনই না তার উপস্থিতির কথা। ১৯৩৮ সালে ক্রিপ্টোজ্যুলজিস্টরা ‘কোমোরোম’ দ্বীপে গিয়ে প্রমাণ করলেন ‘সিলকান্থ’ এখনো বহাল তবিয়তে আছে। বিজ্ঞানীরা তখন ঢোঁক গিলে তার নাম দিলেন, ‘জীবন্ত জীবাশ্ম’। একইভাবে ক্রিপ্টোজ্যুলজিস্টরা প্রমাণ করেছেন, গল্পগাথার স্তন্যপায়ী ডিমপাড়া প্রাণী তাসমেনিয়ার ‘প্লাটিপাস’, সমুদ্রের দানব হাঙর ‘মেগামাউথ শার্ক’কে। এই আপনাদের ইন্দোনেশিয়ার ঘটনাই ধরুন না, সুন্দাদ্বীপের জেলেরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছিল ‘কোমোডো ড্রাগনের’ উপস্থিতির কথা—বিজ্ঞানীরা ব্যাপারটাকে বলতেন গাঁজাখুরি গল্প। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের দেখা মিলল। এমনকী মাত্র একশো বছর আগেও অস্ট্রেলিয়ার ক্যাঙারুকে ইউরোপের লোকেরা গল্পগাথার প্রাণী ভাবত। প্রত্যেক গল্প বা কল্পনার পিছনেই কিন্তু কিছুটা সত্যি আছে। এমন হতেই পারে যে একদিন ইয়েতির বা বিগফুটের অস্তিত্ব প্রমাণিত হতে পারে! প্রমাণ হতে পারে ‘আহুল’ বলে কিছু আছে!

একটানা কথাগুলো বলে সুদীপ্ত তাকাল হেরম্যানের দিকে। তাঁর মুখ দেখে সুদীপ্ত বুঝল তিনি বেশ খুশি হয়েছেন। মিস্টার আলি বিস্মিতভাবে বললেন, এত অদ্ভুত ব্যাপার আমার জানা ছিল না। এবার আমি পিনাকপাণিকে ডাকছি। ওর মাতৃভাষা ‘বাহাম’ কিন্তু ভালো ইংরেজি জানে। জঙ্গলটাও ভালো চেনে। ও আপনাদের একাধারে গাইড, একাধারে নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করবে। ভীষণ সাহসী ও বিশ্বস্ত।

‘পিনাকপাণি’ শব্দটা শুনে প্রথমে খুব আশ্চর্য হল সুদীপ্ত। পরক্ষণেই তার মনে পড়ে গেল হাজার বছর আগে এই যবদ্বীপ ছিল হিন্দু সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে সে ছিল এক গৌরবোজ্জ্বল দিন। এখনো বহু হিন্দু বাস করে জাভা বা যবদ্বীপে। বহু প্রাচীন হিন্দু স্থাপত্যের নিদর্শন আজও দেখতে পাওয়া যায় এখানে। কাজেই পিনাকপাণি নামটা অস্বাভাবিক নয়।

বেল টিপলেন মিস্টার আলি। দরজা খুলে একজন শক্তপোক্ত মাঝবয়সি লোক ঘরে ঢুকল। কিন্তু তাকে দেখে চমকে উঠল সুদীপ্তরা। লোকটার কপাল, গালের বাঁ পাশটা যেন কেউ রাঁদা মেরে উঠিয়ে নিয়েছে! সে দিকে চোখ-কান কিছু নেই!

লোকটা এক চোখ দিয়ে সুদীপ্তদের কিছুক্ষণ দেখে একটু হেসে বলল, জঙ্গলে বাঘ ধরেছিল। অর্ধেক মুখ জরিমানা দিতে হল ঠিকই, কিন্তু তার মাথাটাও বাড়ি নিয়ে এলাম। সাহেবরা দেখতে চাইলে দেখাতে পারি।