নয়
পাওয়ার রূম অ্যানেক্সে মন্ত্রোচ্চারণ করছে উত্তেজিত ডিয়নরা। তাদের লাল, গোলাপি আলখিল্লা আর সুসজ্জিত হেড-ড্রেসগুলো দেয়ালে সারিবদ্ধ মশালের উজ্জ্বল আলোয় চমকাচ্ছে।
গ্রেবা ভাষণ দিচ্ছেন।
‘আমাদের অবশ্যই বিশ্বাস থাকতে হবে। বিশ্বাস!’
‘এড! এড! এড!’ সায় জানাল ডিয়নরা।
‘বিশ্বাস থাকলে আমরা আবারও ডোডেকাহেড্রন প্রতিষ্ঠা করতে পারি।’ চেঁচালেন গ্ৰেবা।
আবারও গর্জন শোনা গেল, ‘এড! এড! এড!’
গ্রেবা একটা হাত তুললেন, এবং কামরাটা নীরব হয়ে গেল।
‘আমরা ডোডেকাহেড্রন প্রতিষ্ঠা করতে পারি, যদি ক্রুদ্ধ দেবতার উদ্দেশে একটা বলি দিই।’ নাটুকে ভঙ্গিতে আঙুল নির্দেশ করলেন। ‘ওটা ফিরে পাওয়ার বদলে উৎসর্গ। এর জীবন, যার বিনিময়ে আমরা আমাদের সবার জীবন আলোকিত করা সেই মহান আলো ফেরত পাব।’
‘এড! এড! এড!’ ডিয়নরা গলা মেলাল।
হিরু চাচা মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে। তাকে ঘিরে রেখেছে উন্মাদের মত মন্ত্রোচ্চারণরত ক্রুদ্ধ ডিয়ন জনতা। ছাদের দিকে চাইল হিরু চাচা, উপলব্ধি করল তাকে এবারই প্রথম উৎসর্গের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে না, তবে এবারের ব্যাপারটা সবচাইতে জঘন্য।
.
বেঁচে-যাওয়া জনা কয়েক গ্যাযটাক বিজয়ীর ভঙ্গিতে বনভূমি ভেদ করে ফিরে চলেছে, পিছনে ফেলে যাচ্ছে ব্লাস্টার-ফায়ারের শব্দ।
হাজার হলেও ওরা একটা শহর ধ্বংস করেছে…অন্তত একটা সিটি গেট আরকী। এবং তারা লুটপাটও করেছে…এডেনের মৃত গার্ড আর নিজেদের মৃত সহযোগীদের পকেট কাটাকে যদি সম্মান করে লুটপাট বলা যায় তবেই। যাকগে, ওরা খানিকটা অ্যাকশন দেখেছে, এবং বিজয়ীর বেশে জীবিত ফিরেছে, যদিও ওদের বেশিরভাগ সঙ্গী- সাথী মারা পড়েছে। বেচারাদের দুর্ভাগ্য, কী আর করা যাবে।
শেষমেশ স্পেসশিপটার কাছে পৌঁছল ওরা, দলে-দলে ভিতরে ঢুকল। এবার গ্যাগারিন কন্ট্রোল নিল। শেষ গ্যাযটাকটি ওঠার পর পটোম্যাক শহর লক্ষ্য করে কয়েকটা গুলি ছুঁড়ল।
‘আমরা পেরেছি! আমরা পেরেছি!’ চেঁচাল ও। ‘পুরোপুরি সফল হয়েছি!’
‘আমরা এখন টেক অফ করতে যাচ্ছি, পটোম্যাক,’ শুকনো কণ্ঠে বলল গ্যাগারিন। ‘তুমি যেতে চাইলে জলদি ভিতরে এসে দরজাটা লাগিয়ে দাও!’
পটোম্যাক দড়াম করে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে ঝটপট ভিতরে প্রবেশ করল। ডিলাকের পাশে বসে সপ্রশংস দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।
এমনকী ডিলাকও ওর বিজয়ের মুহূর্তে এমন খোলামেলা মুগ্ধতা দেখে অভিভূত হলো।
‘ওয়েল ডান, পটোম্যাক,’ আন্তরিক গলায় বলল। ‘গন্তব্য আলফা-তুরা, জেনারেল গ্যাগারিন।
টেক-অফের জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগল গ্যাগারিন।
‘আশা করি এতসব ঝামেলার পর উপযুক্ত প্রতিদান পাওয়া যাবে।’
ডিলাক পাশে বসা পটোম্যাকের ছিন্নভিন্ন উর্দির দিকে চেয়ে তারপর চোখ রাখল দীপ্তিমান ডোডেকাহেড্রনের দিকে।
‘সে আর বলতে!’
.
সিটি লাউডস্পিকারগুলো থেকে ঈষৎ হিস্টিরিয়াগ্রস্ত কণ্ঠ ককিয়ে উঠছে।
‘ডক্টর পালিয়ে গেছে। শহরের দরজাগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে। সব গার্ড এখুনি গেটের কাছে আসুন।’
ওয়কওয়ে ধরে দ্রুত গতিতে হেঁটে যাওয়ার সময় ক্যারির গল্পটা শুনছিল কিশোর। বেশিরভাগটুকুরই কোন অর্থ নেই, কিন্তু ও আসল অংশটা লুফে নিল।
‘তারমানে আপনার সাথে যাকে দেখেছি সে ডক্টর হিরন পাশা নয়, ওটা ডিলাক নামের একটা প্রাণী, যে ক্যাকটাসটা হিরু চাচার রূপ ধরেছে?’
‘হ্যাঁ। ও নিজেই আমাকে বলেছে, ও ডক্টর নয়।’
‘তা হলে হিরু চাচা কোথায়? আসল জনের কথা বলছি।’
‘আমার জানা নেই। তুমি ঠিক জানো উনি এখানে?’
‘হ্যাঁ।’
‘তা হলে চলো আমরা ওঁকে খুঁজে বের করি।’
ওরা দু’জন হনহন করে এগিয়ে চলল।
.
‘ও, মহান দেবতা এড,’ আওড়ালেন গ্রেবা। ‘আমরা আপনাকে এই বলিটা উৎসর্গ করছি। আর অনুরোধ করছি ডোডেকাহেড্রনটা ফিরিয়ে দিতে। সমস্ত ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য!
‘সমস্ত ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য!’ সমবেত ডিয়নরা প্রতিধ্বনি করল।
হিরু চাচার শুয়ে-থাকা শরীরের ঠিক উপরে তিনকোনা বিশাল পাথরটা উঁচু ছাদ থেকে ঝুলছে। কামরার মাঝখানে একসময় বসানো ছিল ওটা। তিন কোনায় তিনটে দড়ি দিয়ে ঝোলানো হয়েছে পাথরটাকে। পুলি হুইলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রশি তিনটে নীচে নেমে এসেছে, এবং ওখানে আবারও আলাদা হয়েছে। খানিক দূরে-দূরে বসানো তিনটে রিং বোল্টের মাধ্যমে মাটিতে গাঁথা হয়েছে ওগুলো। প্রকাণ্ড পাথরটার চাপে টানটান হয়ে রয়েছে রশি তিনটে।
সঙ্কেত দেয়ার ভঙ্গিতে হাত তুললেন গ্রেবা, এবং এক সন্ন্যাসী তিনটি রশির একটিতে জ্বলন্ত এক মশাল ধরল।
দারুণ উদ্ভাবনী কল্পনাশক্তি, ভাবল হিরু চাচা। প্রথম রশিটা ছুটে গেলে পাথরটা ঝুলবে দুটো রশির উপর, এবং পরেরটা ছিঁড়ে গেলে একটায় ভর দিয়ে ঝুলে থাকবে। দড়ি নাও ছিঁড়তে পারত, কিন্তু এরা তো মশাল ব্যবহার করছে। ফলে, দড়ি ছিঁড়ে পাথরটা আছড়ে পড়বে হিরু চাচার উপরে, তাকে পিষে দিয়ে এডের উদ্দেশে উৎসর্গ দেবে।
প্রথম দড়িটা জ্বলতে জ্বলতে ছিঁড়ে গেল। বাকি দুটো রশি চাপ পড়াতে কাঁপতে লাগল।
মশালধারী সন্ন্যাসী দ্বিতীয় দড়িটার কাছে গেল। পুড়তে শুরু করল ওটা…..
.
দু’জন ডিয়ন গার্ড ইসাস আর হ্যান্সিকে সিটি গেটের দিকে নিয়ে চলেছে, এসময় ক্যারি আর কিশোরের মুখোমুখি পড়ে গেলেন তাঁরা—উল্টোদিকে যাচ্ছে ওরা। ক্যারি দৌড়ে এল ইসাসের দিকে।
‘আপনার বন্ধু ডক্টর হিরন পাশা নির্দোষ! আলফা-তুরা থেকে ডিলাক নামে আরেকটা ভিনগ্রহী এসেছিল। সে ডক্টরের রূপ ধরে ডোডেকাহেড্রন চুরি করেছে।’ হ্যান্সির দু’হাত চেপে ধরল ও। ‘জিনিসটাকে ও ছোট করে ফেলেছে, হ্যান্সি। আমি ওটা দেখেছি। ওর হাতের তালুতে।’
‘তা হলে ডক্টরের কথাই ঠিক-মানে আসল ডক্টর,’ বলে ক্যারিকে জড়িয়ে ধরলেন হ্যান্সি। ‘উনি বলেছিলেন নকল কেউ এসেছে!’
দুই ডিয়ন গার্ডের দিকে চাইল কিশোর।
‘আপনারা এখানে কী করছেন? আপনাদের না গেটে থাকার কথা? শহরে আক্রমণ হয়েছে।’
ইসাস আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন।
‘আক্রমণ হয়েছে? কারা করল?’
‘ওরা নিজেদের গ্যাটাক বলে। আমি সার্ফেসে ওদের সামনে পড়ে যাই। গোটা স্পেসশিপ ভরা বদমাশ লোক এসেছে। অস্ত্রধারী। আমি যখন চলে আসি, আপনার গার্ডদের অবস্থা কাহিল করে ছাড়ছিল ওরা।
ইসাস হতভম্ব ডিয়ন গার্ডদের উদ্দেশে ঘুরে দাঁড়ালেন।
‘শুনলে তো। তোমাদের যেখানে কাজ আছে সেখানে যাও।’
‘কিন্তু গ্রেবার আদেশ-’
‘এডেনের নেতা গ্রেবা না আমি?’ বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে বললেন ইসাস। ‘যাও!’
হতবুদ্ধি গার্ডরা চলে গেল।
‘আপনারা জানেন ডক্টর এখন কোথায়?’ কিশোর জানতে চাইল।
‘ডক্টর!’ সভয়ে শ্বাস চাপলেন ইসাস। ‘গ্রেবা ওঁকে উৎসর্গ করতে নিয়ে গেছে। এখন সময় মত পৌঁছতে পারলে হয়।’ সবাইকে পিছনে নিয়ে পাওয়ার রূমের দিকে দৌড়তে লাগলেন তিনি।