পাঁচ
এডেনের পথে সংক্ষিপ্ত যাত্রার বেশিরভাগ সময়টুকু নীরবে কাটাল ডিলাক।
এটা সত্যি, জেনারেল গ্যাগারিনের স্পেসশিপ নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার কিছু নেই। মহাকাশযানটা ছোট আর অন্ধকার, ভিতরটা ধাতব। টু-ম্যান ককপিটের যন্ত্রপাতিগুলো বাতিল প্রায়। একসার খটখটে আসন যাত্রীকে আর কতটুকুই বা আরাম দিতে পারে।
পটোম্যাক কন্ট্রোলে রয়েছে, তার পিছনে গ্যাগারিন। ডিলাক পোশাক-পরিচ্ছদে হুবহু হিরন পাশা সেজে তার পাশে বসে রয়েছে।
তাদের পিছনের সারিগুলো ভরিয়ে রেখেছে গ্যাগারিনের গ্যাটাকরা, নিঃশব্দে বিচিত্র অস্ত্রের সংগ্রহ আঁকড়ে ধরে বসে আছে তারা। জানে না, এবং জানতে চায়ও না কোথায় চলেছে। শীঘ্রি কোথাও না কোথাও নামবে তারা, এবং তারপর বরাবরের মত লুটতরাজে মেতে উঠবে। সেটাই যথেষ্ট। হাজার হলেও, তারা গ্যাটাক।
কালিগোলা ভিশন স্ক্রীনে ভেসে উঠল এক গ্রহের আকৃতি। পটোম্যাক আঙুল নির্দেশ করল।
‘এডেন। অ্যাটমসফেয়ারিক এন্ট্রির দশ সেকেণ্ড বাকি। অ্যাকটিভেটিং হিট শিল্ডস।’ একটা কন্ট্রোলে বুড়ো আঙুল দাবাল, এবং ভারী যন্ত্রপাতির পরস্পর মৃদু ঘর্ষণের শব্দ শোনা গেল।
‘হিট শিল্ড,’ বলল ডিলাক। ‘কী দারুণ একটা স্পেসশিপ এটা।’
ওর কণ্ঠের তাচ্ছিল্য ধরতে পারল গ্যাগারিন।
কাজ তো করে। এটা না থাকলে আপনি এখনও আলফা-তুরায় পটের ভিতরে থাকতেন।’
মুখ ফিরাল পটোম্যাক।
‘মেইন সিটি এন্ট্রান্স দেখা যাচ্ছে। নামব ওখানে?’
সামনাসামনি আক্রমণ গ্যাগারিনের ধাতে নেই।
‘না। জাঙ্গল ল্যাণ্ডফল, খানিকটা উত্তর দিকে।’
‘স্ট্যাণ্ডবাই ফর ল্যাণ্ডিং,’ বলল পটোম্যাক। ‘জঙ্গলে ঢুকছি।’
রেট্রো-রকেটগুলো থেকে অগ্নিশিখা বেরোচ্ছে, পতিত উল্কার মত বনভূমিতে আছড়ে পড়ল গ্যাযটাকদের মহাকাশযানটা।
.
পাওয়ার রূম অ্যানেক্সের নিভু-নিভু আলোয় ইসাস অপেক্ষা করছেন।
একটু পরে, পাওয়ার রূম থেকে বেরিয়ে এলেন গ্রেবা। তাঁর মুখের চেহারা গোমড়া।
‘তো, গ্রেবা?’ প্রশ্ন করলেন ইসাস।
গ্রেবা জবাব দিলেন না।
দূর থেকে একটা বিস্ফোরণের আওয়াজ ভেসে এল, ওটাকে অনুসরণ করল ক্ষীণ চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দ। গ্রেবা আর ইসাস দু’জনেই জানেন, টেকনিশিয়ান আর মেডিকেল টিম ছুটে যাবে আরেকটি সঙ্কট মোকাবেলা করতে। বিদ্যুতের বাড়া-কমা ইদানীং আগের চাইতে অনেক ঘন-ঘন হচ্ছে।
অনিচ্ছুক কণ্ঠে গ্রেবা বললেন, ‘এই হিরন পাশা এখানে এলেই মনে হয় ভাল হয়।’
‘আপনি তাঁকে ডোডেকাহেড্রন পরীক্ষা করতে দেবেন?’
‘এক শর্তে। তাঁকে ডিয়ন শপথ নিতে হবে।’
‘না! সেটা আমাদের মেহমানের জন্যে অপমানজনক হবে। একজন পৃথিবীবাসীকে কীভাবে আমরা এডেনের দেবতা এডের আনুগত্য স্বীকার করতে বলি?’
শীতল হাসলেন গ্ৰেবা।
‘আমাদের সবাইকে আপনার কূটনীতি দিয়ে মুগ্ধ করার আরেকটা সুযোগ পাচ্ছেন আপনি।’
.
গ্যাটাক স্পেসশিপের দরজাটা হড়কে খুলে গেল, এবং ডিলাক, গ্যাগারিন আর পটোম্যাক উদয় হলো। ছোট্ট এক পুড়ে-যাওয়া ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা, মহাকাশযানের ল্যাণ্ডিং রকেটের বিস্ফোরণে ওটা সৃষ্টি হয়েছে। চারদিক থেকে ঘন জঙ্গল যেন চেপে ধরেছে ওদেরকে। লতা-পাতা, ঝোপ-ঝাড়, নলখাগড়া এবং বিচিত্ৰ আকৃতির উদ্ভিদ জড়াজড়ি করে রয়েছে, টিকে থাকার চেষ্টা করছে।
গ্যাগারিন চারদিকে চোখ বুলিয়ে শিউরে উঠল।
‘এখানে এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে?’
মাথা ঝাঁকাল ডিলাক।
‘ঠিক এক ঘণ্টা।’
‘কোন সমস্যা হলে আমরা কি গিয়ে আপনাকে নিয়ে আসব?’
ডিলাক হিরু চাচার মৃদু হাসিটা হাসল, যদিও তাতে প্রাণ ফুটল না।
‘যদি কোন সমস্যা হয়? প্রিয় জেনারেল, মাঝে মাঝে মনে হয় আপনি ভুলে যান আমি কে!’ ঘুরে দাঁড়িয়ে গটগট কর পা চালাল, তার ভাবখানা এমন যেন জঙ্গল তার জন্য পথ করে দেবে।
‘কী মনের জোর!’ সপ্রশংস সুরে বলল পটোম্যাক। ‘আমার মনে হয় ও সব কিছু করতে পারবে। যে কোন কিছু!’
গ্যাগারিন তাদের নতুন সঙ্গীর উদ্দেশে করা প্রশংসাকে পাত্তা দিল না।
‘বেশি চিন্তা কোরো না, পটোম্যাক, তুমি কিছু একটা ফাটিয়ে ফেলবে।’
পটোম্যাক দীর্ঘদেহী ডিলাককে বনভূমির ভিতরে প্রবেশ করতে দেখল।
‘আরেকটা কথা-ওই কোটটা আমার পছন্দ হয়েছে!’ বলল পটোম্যাক।
.
হ্যান্সি আবারও সেন্ট্রাল কনসোলে ব্যস্ত, অসীম সঙ্কট মোকাবেলা করছেন। ইসাস আর গ্রেবা চেয়ে-চেয়ে দেখছেন। সর্বশেষ বার্ন- আউটের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে একটা ইমার্জেন্সি টিম পাঠিয়ে, ক্লান্ত ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে বসলেন হ্যান্সি।
‘এই হিরন পাশা কখন পৌঁছবেন, ইসাস?’
‘শীঘ্রি, খুব শীঘ্রি।’
‘তিনি পৌঁছলেই আমি চাই ক্যারি তাঁকে এখানে নিয়ে আসুক।’
‘প্রথমেই যাতে তাঁর মনে বিজ্ঞানের আজগুবী তথ্য ভরে দেয়া যায়,’ তেতো কণ্ঠে বললেন গ্রেবা।
‘আমার আশা ডক্টর আমাদের সমস্যাগুলো বুঝবেন, ইসাস,’ বললেন হ্যান্সি।
ইসাস এড়িয়ে গেলেন।
‘ডক্টর সবার দৃষ্টিভঙ্গিকেই গুরুত্ব দেবেন।’
কনসোল থেকে জরুরি এক কণ্ঠ ভেসে এল।
‘ফুড স্টোরে তাপমাত্রা বাড়ছে।’
হ্যান্সি কাজে ফিরলেন।
.
শহরের প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে রয়েছে ক্যারি। জঙ্গলের ভিতরে এক ধরনের পাথুরে ব্লকহাউসের মত জোড়া দরজা এই প্রবেশ পথটি। ভিতরে, ক্রমান্বয়ে ধাপ নেমে গেছে পাতাল-শহরের উদ্দেশে।
ক্ষুধার্ত চোখে জঙ্গলের চারধারে চোখ বুলাচ্ছে ক্যারি।
‘আমরা আবার সার্ফেসে উঠে আসতে পারি,’ ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল। ‘এই ডক্টর ভদ্রলোক ব্যর্থ হলে আমরা হয়তো বাধ্য হব উঠে আসতে!’
গেট পাহারা দিচ্ছে দু’জন কালো উর্দি পরা প্রহরি। ক্যারি চকিতে চাইল তাদের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য, কিন্তু তাদের মুখের চেহারা ভাবলেশহীন। তাদের কাছে ক্যারির কথাগুলো ধর্মদ্রোহিতা, এবং তারা পাপের শাস্তির ভয় পায়।
ঝরা পাতায় খস খস শব্দ উঠল এবং বনভূমি থেকে বেরিয়ে এল দীর্ঘদেহী, কোঁকড়াচুলো এক লোক, তার পরনে লম্বা কোট।
‘আমি ডক্টর হিরন পাশা,’ বলল ডিলাক। ‘আপনারা আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন, তাই না?’
মাথা নোয়াল ক্যারি।
‘অবশ্যই। ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। প্লিজ, আমাকে ফলো করুন।’ ডিলাককে পিছনে নিয়ে শহরের দিকে এগোল সে।
.
কনসোল থেকে বেজে উঠল একটি আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর।
‘সেন্ট্রাল স্টোরেজ ব্যাঙ্ক ওভারলোডিং। রিসেপ্টর প্যানেলগুলো বন্ধ করে দেব?’
‘না,’ খেঁকিয়ে উঠলেন হ্যান্সি। ‘এখনই না। রি-রুট সারপ্লাস টু সেকশন ফাইভ, ওদের বাড়তি ক্যাপাসিটি আছে।’
গ্রেবা কন্ট্রোলে ফিরে এলেন।
‘ইসাস! শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শেষ হয়েছে।’
মুখ তুলে চাইলেন হ্যান্সি
‘কী? আপনারা ওঁকে ওই হাস্যকর শপথটা নেয়াবেন? এটা স্রেফ পাগলামি, ইসাস।’
‘এটার দরকার আছে, হ্যান্সি।’
এসময় দোরগোড়ায় ক্যারি উদয় হলো।
‘ডক্টর হিরন পাশা এসে গেছেন।’ এক পাশে সরে দাঁড়াল ও, এবং হিরু চাচার বেশধারী ডিলাক কামরায় প্রবেশ করল।
ইসাস সাগ্রহে বললেন, ‘ডক্টর, আবার আপনার দেখা পেয়ে খুব ভাল লাগছে।’
নবাগত শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।
‘আবার?’
খানিকটা আহত হলেন ইসাস। বললেন, ‘বহু বছর আগে আমাদের একবার দেখা হয়েছিল। আমি এখন নিশ্চয়ই অনেক বদলে গেছি। আমি ইসাস, এখন এডেনের নেতা।’
‘অবশ্যই। আপনাকে আমার স্পষ্ট মনে আছে।’
‘আপনি প্রায় আগের মতই আছেন, ডক্টর। বয়স আর অভিজ্ঞতা আরও খানিক বেড়েছে শুধু।’
‘অভিজ্ঞতা অনেক বেড়েছে।’ ইসাসকে প্রায় উড়িয়ে দিয়ে হ্যান্সির দিকে ঘুরে চাইল ডিলাক। ‘যদ্দূর জেনেছি, আপনাদের এনার্জি সোর্স কিছুটা খামখেয়ালি আচরণ করছে?’
‘খামখেয়ালি? বলুন একেবারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে।’
‘তাই? আচ্ছা, দেখছি।’
হ্যান্সি ঝট করে একপাশে সরে গেলেন, এবং অতিথি কনসোলে তার জায়গা নিল, যন্ত্রপাতিগুলো নিরীখ করছে। ‘আপনারা এক ধরনের এনার্জি অ্যাবজর্পশন সিস্টেম ব্যবহার করেন, তাই না?’
‘এক গাদা রিসেপ্টর প্যানেল, ডোডেকাহেড্রনের উপরে বসানো। রেডিয়েটেড এনার্জি শুষে নিয়ে মজুদ করে,’ আঙুল নির্দেশ করলেন। ‘এখানে মাপ দেয়া হচ্ছে।’
‘প্যানেলগুলো বন্ধ করে দেয়া যায়?’
‘সেন্ট্রাল স্টোরেজ ব্যাঙ্ক এক ঘণ্টার জন্যে এনার্জি অ্যাবজর্ব করতে পারবে। তবে এটা খুবই বিপজ্জনক, এবং এই পাওয়ার ওঠা-নামার মধ্যে…’
‘আমার এক ঘণ্টাই দরকার। বন্ধ করে দিন।’
হ্যান্সি ইসাসের দিকে চাইলে, তিনি মাথা ঝাঁকালেন।
হ্যান্সি একটা সুইচ টিপে কনসোলে কথা বললেন।
‘পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত রিসেপ্টর প্যানেলগুলো বন্ধ করে দাও।’
‘চমৎকার! আমাকে এখন ডোডেকাহেড্রনের কাছে নিয়ে চলুন।’
ইসাস হাতছানি দিয়ে সম্মানিত অতিথিকে আগে-আগে যেতে বললেন।
‘আপনি আগে যান, ডক্টর। পথ মনে আছে নিশ্চয়ই?’
অতিথি ইতস্তত করে মসৃণ গলায় বলল, ‘আপনি নেতা, ইসাস। আমি আপনাকে অনুসরণ করব।’
গ্রেবা সামনে এগিয়ে এসে, পথরোধ করে দাঁড়ালেন।
‘পৃথিবীবাসী! পাওয়ার রূমে ঢোকার আগে আপনাকে এডের কাছে আনুগত্যের শপথ নিতে হবে। আপনি ডিয়ন শপথ নেবেন।’
অতিথির দিকে উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে চাইলেন ইসাস।
‘স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা, ডক্টর, তবে ব্যাপারটা জরুরি।
‘আপনি কি এডের কাছে আনুগত্যের শপথ নেবেন?’ জানতে চাইলেন গ্রেবা।
তিনি কী জবাব চান তা পরিষ্কার। কিন্তু তাঁকে হয়তো হতাশ করা হতে পারে।
‘খুশি মনে। আমাকে শপথ নেয়ার যোগ্য মনে করেছেন বলে আমি গর্বিত বোধ করছি। আমি আনন্দিত। দয়া করে পথ দেখাবেন?’
কন্ট্রোল রূম থেকে নেতৃত্ব দিয়ে বেরিয়ে এলেন হতভম্ব গ্রেবা।
ইসাস ডক্টরের দিকে সাবধানী চাউনি হানলেন। ডক্টর কূটনীতির আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু কেন যেন তাঁর মন বলল, অতিথি পাওয়ার রূমে ঢোকার জন্য যে কোন কিছু বলতে বা করতে রাজি।
.
‘ঠিক আছে। আমরা অন্য সবকিছু ট্রাই করেছি,’ বলল কিশোর। রোকুর লেজ ধরে নেড়ে দিল।
রোকুর চোখজোড়া জ্বলে উঠল এবং অ্যান্টেনাটা দুলে উঠল।
‘ধন্যবাদ, মাস্টার, মেরামতের কাজ কমপ্লিট।’
এবং আবারও চাচা-ভাতিজা অল্প ক’মিনিটের স্বাধীনতা পেল।
‘আমরা এখান থেকে বেরোতে পারব না,’ হতাশায় চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। ‘সব কিছু ট্রাই করা হয়েছে।’
‘রোকুকে মেরামত করার ব্যাপারেও তুই একথাই বলেছিলি-’ থেমে গেল হিরু চাচা। ‘এটাই, ‘আমরা অন্য সব কিছু ট্রাই করেছি।’ অফ কোর্স!’
‘কী?’
‘কিশোর, মনে করতে পারবি তুই আর কী কী বলেছিলি?’
‘পারব, অনেকবার এরমধ্যে দিয়ে গেছি তো।’
‘আমরা এভাবেই এর থেকে বেরিয়ে আসব!’
‘আমরা আবার সিকোয়েন্সটার মধ্যে দিয়ে যাব?’
‘ঠিক তাই। ওটা আবার ফিরে আসার আগেই।’ কিশোর টেবিলের কাছে দৌড়ে গেল।
‘জলদি, হিরু চাচা, তুমি হ্যাট-স্ট্যাণ্ডের কাছে ছিলে।’
‘হ্যাঁ, ঠিক আছে। তুই শুরু কর!’
‘ওহ, আবার শুরু করতে হবে!’ উজ্জ্বল কণ্ঠে বলল কিশোর।
একটু দেরি করে, হ্যাট-স্ট্যাণ্ডে হোঁচট খেল হিরু চাচা, মেঝেতে পড়ে গেল তার কোট।
‘কী ব্যাপার?’
‘ওর প্রোব-সার্কিট এখন জ্যাম হয়ে গেছে।
হিরুচাচা কোটটা তুলে নিয়ে স্ট্যাণ্ডে ছুঁড়ে দিল-এবং হাঁ করে চেয়ে রইল কিশোরের দিকে। তার লাইনগুলো ভুলে গেছে!
কিশোর মরিয়ার মতন রোকুর লেজটা দেখাল এবং হিরু চাচা ঝটপট বলল, ‘সোজা-কাজ-ওর-লেজটা নেড়ে দে!’
হঠাৎই যেন সময় ধীর হয়ে এল, পুনরাভিনয় পর্ব লড়াই করছে ক্রনিক হিস্টেরেসিসের শক্তির বিরুদ্ধে।
হিরু চাচা আর কিশোর ধীর, গোঙানো কণ্ঠে কথা বলছে, এবং নড়াচড়া করছে অত্যন্ত ধীরে, ভাবখানা এমন যেন আঠাল গুড়ের মধ্য দিয়ে হাঁটছে।
‘ঠিক…আছে…আমরা… অন্য… সব… কিছু… ট্রাই….করেছি…’
কষ্টেসৃষ্টে বলল কিশোর। খুব ধীরে-ধীরে রোকুর লেজ নেড়ে দিল।
আরও ধীরে সাড়া দিল রোকু।
‘ধন্যবাদ…মাস্টার…’
হঠাৎই সময় ফিরে এল স্বাভাবিক গতিতে এবং রোকু চনমনে গলায় বলে উঠল, ‘মেরামতের কাজ কমপ্লিট।’
‘ফেজ ক্যান্সেলেশন!’ চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। ‘আমরা পেরেছি।’
‘ওয়েল ডান,’ খোশমেজাজে বলল হিরু চাচা। ‘এক মুহূর্তের জন্যে মনে হয়েছিল তুই তোর ডায়ালগ ভুলে গেছিস বুঝি!’
.
ওদিকে, পাওয়ার রূম অ্যানেক্সের মাঝখানে, তিনকোনা বিশাল পাথরটার উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে নকল হিরু চাচা। পাথরটার ভিত্তিমূল ঘিরে মরচে ধরা বাদামি দাগ, যদিও কেউ এগুলোর কথা কখনও উল্লেখ করেনি।
গ্রেবা তার পাশে পাথরের উপর দাঁড়িয়ে, সন্ন্যাসিনীরা জ্বলন্ত মশাল হাতে তাঁদের ঘিরে রেখেছে।
‘ডোডেকাহেড্রনের আইন কখনও অমান্য করব না,’ আওড়ালেন গ্ৰেবা।
‘ডোডেকাহেড্রনের আইন কখনও অমান্য করব না,’ পুনরাবৃত্তি করল ডিলাক।
‘সকল ধন্যবাদ এডের প্রাপ্য,’ বললেন গ্ৰেবা।
‘সকল ধন্যবাদ এডের প্রাপ্য,’ সমবেত ডিয়নরা উচ্চারণ করল। ইসাস, গ্রেবা আর হ্যান্সি অনুষ্ঠানটা দেখছিলেন, এবার সবাই একসঙ্গে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন।
ডিলাক আর গ্রেবা নেমে এল পাথর থেকে, এবং গ্রেবা রাজকীয় ভঙ্গিতে বললেন, ‘আপনি এখন পাওয়ার রূমে ঢুকতে পারেন, ডক্টর।’
‘সকল ধন্যবাদ এডের প্রাপ্য,’ শ্বাসের নীচে আওড়ালেন হ্যান্সি।
পাওয়ার রূমের খিলানাকৃতি দরজাটার দিকে চাইল ডিলাক। ওটা থেকে বেরিয়ে-আসা আলোটা কেঁপে-কেঁপে জ্বলছে। গলার স্বর তুলল সে।
‘এডেনবাসী! আমি এখন যে কাজটা করব সেটা অত্যন্ত বিপজ্জনক। এনার্জির আউটপুট কন্ট্রোল করতে হলে নিক্ষেপ আরও বাড়াতে হতে পারে।
হ্যান্সিকে উদ্বিগ্ন দেখাল।
‘সেক্ষেত্রে আপনি নিজেই ঝুঁকির মধ্যে পড়বেন।’
‘না, আমার মধ্যে টাইম লর্ডের বৈশিষ্ট্য আছে। আমি ভবিষ্যতে
বাস করি, বর্তমানে আমি মারা যাব না।’
‘এটা হতে পারে না, এটা একটা দার্শনিক প্যারাডক্স।’
‘না, স্রেফ আপনার বোঝার ক্ষমতার বাইরে।’ ডিলাক গলা চড়াল আবারও। ‘যাকগে, আপনাদের জীবন ভয়ানক বিপদের মধ্যে পড়বে। আপনারা সবাই চলে যান!’ ডিলাকের কণ্ঠে আনন্দ ফুটে উঠল। ‘আমি একা—আমি একা পাওয়ার রূমে ঢুকব!’
গ্রেবা রাগত স্বরে বললেন, ‘কথা ছিল আমি আপনার সাথে থাকব, দেবতার তরফ থেকে।’
‘আমি ডিয়ন শপথ নিয়েছি,’ ডিলাক মনে করিয়ে দিল তাঁকে। ‘আমি এখন এডের কাছ থেকে নিরাপত্তা পাব। আপনি কি তাঁর আশীর্বাদে বিশ্বাস করেন না?’
নিজের অস্ত্রে নিজেই ঘায়েল হয়ে পিছিয়ে গেলেন গ্রেবা।
‘তবে তাই হোক।’ দু’হাত তুললেন। ‘যান! সবাই চলে যান। ডক্টরের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ এখানে আসবেন না।’
.
টাইম মেশিনের দরজা খুলে গেল এবং হিরন পাশা আসল হিরন পাশা—জঙ্গলের এক ফাঁকা জায়গায় বেরিয়ে এল, তাকে অনুসরণ করল কিশোর আর রোকু
সবুজ বনভূমির ঘন প্রাচীরের দিকে চাউনি বুলাল হিরু চাচা।
‘আমার ধারণা, আমরা সিটি গেটের কাছেই আছি।’
চারধারে চোখ বুলাল কিশোর।
‘এটা যদি শহরের কাছে হয়, তা হলে আমরা সম্ভবত কোন পার্ক কিংবা জুলজিক্যাল গার্ডেনে আছি।’
ঘন জঙ্গলের দিকে ঈষৎ বিস্মিত দৃষ্টিতে চাইল হিরু চাচা।
‘আমি শেষ যেবার এখানে আসি তারপর জঙ্গল অনেক বেড়ে গেছে…
‘তা হলে সিটি গেটটা কোথায়?’
হিরু চাচা একাগ্র হতে চেষ্টা করল।
‘দেখতে দে…আমার মনে হয়…এদিকে হবে?’ বনভূমি ভেদ করে পা চালাল সে।
ওদিকে রোকু উল্টোদিকে রওনা দিয়েছে।
‘বিয়ারিং অভ সিটি, ২২ ডিগ্রী উত্তর, ৩১.৪ ডিগ্রী দক্ষিণ।
‘হিরু চাচা!’ সতর্ক কণ্ঠে বলে উঠল কিশোর।
‘ও, হ্যাঁ, যে কেউই ভুল করতে পারে।’
এবার রোকুকে অনুসরণ করল চাচা-ভাতিজা।
.
ডিলাক একাকী পাওয়ার রূমে প্রবেশ করল, এবং ডোডেকাহেড্রনের দিকে এক মুহূর্ত নীরবে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
পাঁচকোনা প্রকাণ্ড ক্রিস্টালটা ফাঁকা পাথুরে দেয়ালঘেরা কামরার মাঝখানে বিশাল এক ভিত্তির উপর বসানো, তীব্র সোনালি আলোয় ঘরটা ভরিয়ে তুলেছে। রুপোলি রিসেপ্টর প্যানেলগুলো উপরে স্থাপন করা হয়েছে।
‘দশ হাজার বছর,’ মৃদু কণ্ঠে বলল ডিলাক। ‘দশ হাজার বছর!’ পকেট থেকে এল-আকৃতির রি-ডাইমেনশনারটা বের করল সে, এবং ওটার কন্ট্রোলগুলো ঠিকঠাক করে নিল। রি-ডাইমেনশনারটা আভা ছড়াল, এবং শক্তির মৃদু গুঞ্জন তুলল। ডোডেকাহেড্রনের নীচে, ভিত্তিমূলে ওটাকে রাখল ডিলাক। এবার পিছিয়ে এসে অপেক্ষা করতে লাগল।