আসল-নকল – ৪

চার

অস্বস্তিকর নীরবতা।

গলা খাঁকরে নিল গ্যাগারিন।

‘আমি পুরো ব্যাপারটা ভুলে যেতে রাজি আছি!’

‘না ভুললেই খুশি হব, জেনারেল গ্যাগারিন!’

গোপন হুমকিটা বুঝতে পারল পটোম্যাক।

‘আমরা মনে রাখব! মনে রাখব!’

‘ভাল। দ্বিতীয় বাটনটা, প্লিজ।’

গ্যাগারিন দ্বিতীয় বাটন টিপল এবং দুটো সিলিণ্ডারই আলোকিত হয়ে উঠল। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইল গ্যাগারিন আর পটোম্যাক।

ক্রমান্বয়ে ডিলাক নামের বিশাল ক্যাকটাসটা কুঁকড়ে যেতে শুরু করল। ছোট হতে-হতে শেষমেশ কন্টেইনারের মেঝেতে পড়ে রইল সবুজ, কাঁটাযুক্ত এক বিন্দু।

একই সময়ে, পৃথিবীবাসীটির দেহ আড়ষ্ট হয়ে গেল, এবং ক্যাকটাসের সবুজ রং ধারণ করল। হাতে-মুখে খুদে খুদে কাঁটা উদয় হলো। ধীরে-ধীরে ডিলাকের ব্যক্তিত্ব দখল করল পৃথিবীবাসীটির দেহ।

‘কী দেখছি এটা?’ আওড়াল পটোম্যাক।

গ্যাগারিন তৃতীয় বাটনটা টিপতেই পৃথিবীবাসীর কাঁটাযুক্ত সবুজ দেহ বেরিয়ে এল-ডিলাকের কণ্ঠে কথা বলছে!

‘আমাদের জলদি কাজ করা দরকার। আমি এডেনের একটা মেসেজ ইন্টারসেপ্ট করেছি।’ ডিলাক তড়িঘড়ি এক কমিউনিকেশন কনসোলের কাছে গেল, কন্ট্রোল অ্যাডজাস্ট করতেই হীরকাকৃতি এক ভিশন স্ক্রীন আলোকিত হয়ে উঠল। একটা মুখ উদয় হলো-লম্বা, কোঁকড়াচুলো এক লোকের।

স্ক্রীনের নীচ দিয়ে ওটা যেতে শুরু করল।

গ্যাগারিন ওটার দিকে চাইল…ডক্টর হিরন পাশা। প্ল্যানেট অভ অরিজিন: পৃথিবী। বয়স…

সে কিছুই বুঝতে না পেরে ঘুরে দাঁড়াল।

‘কে লোকটা?’

‘একজন ভ্রমণ বিলাসী পৃথিবীবাসী, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতে ঘুরে বেড়ায়-যার ভ্রমণে আমি এখন বাধা দেব!’

ডিলাক আরেকটি কনসোলের কাছে গেল, এবং দুটোর মাঝখানে হেঁটে বেড়িয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অ্যাডজাস্টমেন্ট করল।

‘ঠিক কোথায় এখন সে?’ বিড়বিড় করে বলল। ‘এবং কখন?’

.

হিরু চাচা অ্যাপ্রন খুলে ফেলেছে। টাইম মেশিনের কন্ট্রোল রূমে পায়চারী করছে। রোকুর মেরামতের বাদবাকি কাজ ছেড়ে দিয়েছে কিশোরের উপর। এডেন ভ্রমণের জন্য পোশাক পাল্টে কিশোর এখন লাল মখমলের ট্রাউজার পরেছে।

হিরু চাচা গভীর চিন্তায় মগ্ন, কিশোর যখন তার সঙ্গে কথা বলল, ঠিকমত শুনল না।

‘হিরু চাচা, ইলেকট্রো-প্লায়ার্সটা কোথায় রেখেছ?’

‘গুহার মধ্যে…এক ধরনের শ্রাইন,’ হিরু চাচা নিজের ভাবনার জবাব দিল।

‘ইলেকট্রো-প্লায়ার্সটা?’

‘না, ডোডেকাহেড্রন, এডেনে।’ কিশোরের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল। ‘কী বললি?’

‘ইলেকট্রো-প্লায়ার্সটা কোথায়?’

পকেট হাতড়াল হিরু চাচা।

‘এই যে, এখানে।’

‘ধন্যবাদ,’ ফাইনাল অ্যাডজাস্টমেন্ট করল কিশোর, এবং রোকুর চোখের পর্দা জ্বলে উঠল, কানজোড়া ঘুরে গেল, লেজ অ্যান্টেনা নড়ে উঠল। ‘মনে হচ্ছে প্রায় শেষ করে এনেছি।’

‘পরিষ্কার বোঝা যায় ওরা জিনিসটাকে ভয় পাবে,’ আপনমনে কথোপকথন করে যাচ্ছে হিরু চাচা। ‘ওদের জীবনযাত্রা নির্ভর করে ওটার ওপর।’

রোকুর চোখ ম্লান হয়ে এল, এবং অ্যান্টেনা ঝুলে পড়ল।

‘ওহ!’ বলে উঠল কিশোর, ‘আবার শুরু করতে হবে!’

মনোযোগ টুটে গেছে, হিরু চাচা হ্যাট-স্ট্যাণ্ডে হোঁচট খেল, তার কোটটা ফেলে দিল মেঝেতে।

‘কী ব্যাপার?’

‘ওর প্রোব-সার্কিট এখন জ্যাম হয়ে গেছে।’

‘সোজা কাজ, ওর লেজটা নেড়ে দে।’ হিরু চাচা কোটটা তুলে নিয়ে অযত্নে ছুঁড়ে দিল স্ট্যাণ্ডের উপর।

‘ঠিক আছে। আমরা অন্য সব কিছু ট্রাই করেছি।’ রোকুর লেজ ধরে নেড়ে দিল কিশোর।

ওর চোখজোড়া জ্বলে উঠল এবং অ্যান্টেনাটা সতর্ক ভঙ্গিতে দুলে উঠল।

‘ধন্যবাদ, মাস্টার, মেরামতের কাজ কমপ্লিট।’

ইলেক্ট্রো-প্লায়ার্সটা পকেটে ঢুকিয়ে সটান সিধে হলো কিশোর, আড়মোড়া ভাঙল, এবং হেঁটে গেল কনসোলটা পরীক্ষা করতে।

‘ওয়েল ডান, কিশোর,’ বলল হিরু চাচা। ‘তুই দিনকে দিন নিজেকে এধরনের হাই টেকনোলজির জন্যে তৈরি করে নিচ্ছিস।’

‘ধন্যবাদ, হিরু চাচা।’

হিরু চাচা টেবিলের কাছে গেল।

‘রোকু, তুই প্রিয়ন প্ল্যানেটারি সিস্টেম সম্পর্কে কী জানিস?’

রোকু ধাতব কণ্ঠে আওড়ে গেল, ‘আলফা-তুরায় একসময় উন্নত হাই-টেক সমাজ ছিল। এডেনের সমাজ ছিল আদিম। এক বৈশ্বিক যুদ্ধে নিজেকে ধ্বংস করে ফেলে আলফা-তুরা। গ্রহটা এখন ধু-ধু মরুভূমি।

‘এখন বাকি থাকল শুধু এডেন,’ চিন্তামগ্ন শোনাল হিরু চাচার কণ্ঠ। ‘ডোডেকাহেড্রন নিয়ে…’

‘হ্যাঁ বাচক।’

কিশোর চট করে টেবিলের কাছে চলে গেল, মেরামত করতে লাগল রোকুকে। রোবট কুকুরটার চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে এল।

‘ওহ, আবার শুরু করতে হবে!’

হিরু চাচা হ্যাট-স্ট্যাণ্ডে হোঁচট খেল, তার কোটটা ফেলে দিল মাটিতে।

‘কী ব্যাপার?’

‘ওর প্রোব-সার্কিট এখন জ্যাম হয়ে গেছে।’

‘সোজা কাজ, ওর লেজটা নেড়ে দে। কোটটা তুলে নিয়ে স্ট্যাণ্ডের উপর ছুঁড়ে দিল হিরু চাচা।

‘ঠিক আছে। আমরা অন্য সব কিছু ট্রাই করেছি।’ রোকুর লেজ ধরে নেড়ে দিল কিশোর।

ওর চোখজোড়া জ্বলে উঠল এবং অ্যান্টেনাটা সতর্ক ভঙ্গিতে দুলে উঠল।

‘ধন্যবাদ, মাস্টার, মেরামতের কাজ কমপ্লিট।’

হিরু চাচা আর কিশোর অস্বস্তিভরা চোখে পরস্পরের দিকে চেয়ে রইল। কোথাও বড় ধরনের কোনও গড়বড় হয়েছে।

.

ডিলাক তার ভিউয়িং স্ক্রীনে ঘটনাটার পুনরাবৃত্তি দেখে নিঃশব্দে হাসল।

‘অম্বরে মাছি আটকেছে। ক্রনিক হিস্টেরেসিস থেকে হিরন পাশা পর্যন্ত বেরোতে পারছে না!’

‘কী বললেন?’ অস্বস্তি ফুটল গ্যাগারিনের কণ্ঠে।

‘টাইম লুপ। সময়ের ভাঁজে বন্দি করেছি ডক্টরকে। দরকার শুধু কণ্টিনামের সামান্য লোকাল রি-শেপিং।’

‘ভাল,’ বলল গ্যাগারিন। ‘খুব ভাল!’ ডিলাক কী বলছে মাথায় ঢোকেনি তার। সে শুধু এটুকু বুঝেছে, তার নতুন পার্টনারের বেশ কিছু অস্বাভাবিক আর বিপজ্জনক ক্ষমতা রয়েছে। আকার বদলানো, আত্মিক পরিবর্তন, এখন সময় নিয়ে খেলা করা। হুঁশিয়ার হয়ে ডিলাককে মোকাবেলা করতে হবে, সিদ্ধান্ত নিল গ্যাগারিন। সম্পূর্ণ নিরাপদ হওয়ার আগে ওর সাথে বেঈমানী নয়।

‘কিছুই বুঝলাম না,’ গজগজ করে বলল পটোম্যাক।

গভীর মনোযোগে পর্দায় হিরু চাচার মুখ দেখছে ডিলাক।

‘শুরুতে ফিরে যাওয়ার আগে যে সামান্য সময়টুকু পাবে সেটাই তার একমাত্র অবসর। যা-ই করুক না কেন বারবার ওই পয়েন্টে ফিরে যাবে।’

হেসে উঠল গ্যাগারিন।

‘ঘুরে ঘুরে একই জায়গায়, না? আজীবন!

‘হ্যাঁ।’ বলল ডিলাক। ওর চোখজোড়া হিরু চাচার মুখের চেহারায় স্থির।

.

‘ওহ,’ বলে উঠল কিশোর। ‘আবার শুরু করতে হবে!’

হিরু চাচা হ্যাট-স্ট্যাণ্ডে হোঁচট খেল, তার কোটটা ফেলে দিল মাটিতে।

‘কী ব্যাপার?’

‘ওর প্রোব-সার্কিট এখন জ্যাম হয়ে গেছে।’

তারপর আগের দু’বার চাচা-ভাতিজার মধ্যে যা যা কথা হয়েছিল এবং যা যা ঘটনা ঘটেছিল তার পুনরাবৃত্তি ঘটল।

‘এবার নিয়ে তিনবার,’ বিস্ফোরিত হলো হিরু চাচা। ‘কী হচ্ছে এসব?’

কিশোর কনসোলের কাছে গিয়ে ঝটপট পরীক্ষা করল। টাইম মেশিন তো স্বাভাবিকভাবেই কাজ করছে।’

‘তা হলে এটা কী হচ্ছে?’ বিড়বিড় করে বলল হিরু চাচা। ‘রিপিটেড টাইম সাইকল। ক্রনিক হিস্টেরেসিস হতে পারে?’

কিশোর রীতিমত আতঙ্কিত।

‘যেন না হয়, আল্লাহ। হলে আমরা এখানে চিরদিনের জন্যে আটকে যাব।’

টেবিলে ফিরে গেল ও, রোকুকে মেরামত করছে।

‘ওহ, আবার শুরু করতে হবে!’ এই পরিস্থিতিতে ওর কথাগুলোর নতুন আর পরিহাসপূর্ণ অর্থ প্রকাশ পেল।

হিরু চাচা হ্যাট-স্ট্যাণ্ডে হোঁচট খেল, তার কোটটা পড়ে গেল মাটিতে।

‘কী ব্যাপার?’

.

ডিলাক ভিউয়িং স্ক্রীনে ঝুঁকে পড়েছে, মুখে হাত বুলাচ্ছে।

ওদিকে গ্যাগারিন পটোম্যাককে কিছু ব্যাপার বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছে। কাজটা কঠিন, কেননা পটোম্যাকের বোধবুদ্ধি সীমিত, এবং গ্যাগারিন নিজেও জানে না কী বলছে। গ্যাগারিনের ব্যাখ্যা শেষ হলে, পটোম্যাক মাথা চুলকাল।

‘তো এই ডিলাক সময়কে বাঁকাতে পারে?’

‘হ্যাঁ। বাঁকিয়ে ফাঁসের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়।’

‘এমন কথা আগে কখনও শুনিনি। কাজটা করে কীভাবে?’

‘জেনে কী হবে?’ পাল্টা প্রশ্ন করল গ্যাগারিন, যার নিজের জ্ঞানও খুব সামান্য। ‘আসল ব্যাপার হচ্ছে হিরন পাশা যাতে এডেনে যেতে না পারে।’

‘কিন্তু যাবে,’ মৃদু কণ্ঠে বলল ডিলাক। ‘যাবে!’ একটা কন্ট্রোল টিপতেই, মুহূর্তের জন্য উজ্জ্বল সাদা আলোর স্তম্ভে ম্লান হয়ে গেল তার গোটা দেহ। আলো মিলিয়ে গেল, এবং ডিলাক বোঁ করে ঘুরে দাঁড়াল ওদের মুখোমুখি হতে। ‘আমরা এডেনবাসীকে হতাশ করতে পারি না!’

গ্যাগারিন আর পটোম্যাক হাঁ হয়ে গেল।

ডিলাকের সবুজ রং আর কাঁটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। পৃথিবীবাসীটির চেহারা এখন আর নেই। ওরা চেয়ে রয়েছে হিরন পাশার মুখের চেহারার দিকে।

.

ওদিকে হিরু চাচা, আসল হিরু চাচা, টাইম মেশিনে পায়চারী করছে, মরিয়ার মত চেষ্টা করছে যদি কোনওভাবে এই ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসা যায়। হাতের তালুতে ঘুষি মারল সে।

‘কাজ হচ্ছে না! যতবারই আমরা চেষ্টা করছি-’

কিশোর টেবিলে ফিরে গেছে।

‘ওহ, আবার শুরু করতে হবে!’

এবং আবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।

‘ধন্যবাদ, মাস্টার, মেরামতের কাজ কমপ্লিট,’ রোকু কথাগুলো বলার পর হিরু চাচা আর কিশোর ধেয়ে গেল কনসোলটার কাছে।

‘হিরু চাচা, এখন কী করবে? আমরা এটা ভাঙব কীভাবে?’

‘আমি জানি না। রোকুকে জিজ্ঞেস কর।’

কিশোর টেবিলের কাছে দৌড়ে গেল।

‘রোকু, ক্রনিক হিস্টেরেসিস থেকে বেরিয়ে আসার কোনও পথ আছে?’

‘নেই, মাস্টার, কোনও প্রযুক্তিগত পদ্ধতি নেই।’

‘টাইম রোটর থামিয়ে দেয়া যায় না, হিরু চাচা? নিশ্চয়ই কোনও কায়দা আছে।’

‘কোনও প্রযুক্তিগত পদ্ধতি নেই,’ আওড়াল হিরু চাচা। ‘কোনও প্রযুক্তিগত পদ্ধতি নেই…’

কিশোর টেবিলে ফিরে গেল।

‘ওহ, আবার শুরু করতে হবে!’

.

গ্যাযটাকরা চরম বিস্ময়ে ডিলাকের রূপান্তর প্রক্রিয়া লক্ষ করল। উচ্চতা আর মুখের আদলে শেষবারের মতন সামান্য ছোঁয়া দিল ও। হিরু চাচার পোশাক-পরিচ্ছদ সতর্ক চোখে নিরীখ করল, এক মেশিনে কো-অর্ডিনেট পাঞ্চ করল, এক কিউবিকলের ভিতর উধাও হয়ে গেল, এবং শীঘ্রি ফিরে এল অবিকল হিরন পাশার মত পোশাক পরে। গ্যাটাকদের হতবিহ্বল মুখের চেহারার দিকে চেয়ে মৃদু হাসল সে।

‘আপনারা রেডি?’ প্রশ্ন করল।

কন্ট্রোলগুলো প্রি-সেট করে, সবাইকে পিছনে নিয়ে ল্যাবোরেটরি ত্যাগ করল ডিলাক। গনগনে বালি মাড়িয়ে পা বাড়াল গ্যাটাকদের মহাকাশযানের দিকে। ডিলাকের ল্যাবোরেটরি যখন ধীরে-ধীরে বালির বুকে দেবে যাচ্ছে, তখন মহাকাশযানটা অলস ভঙ্গিতে আকাশে উঠে গেল।

এডেনে আক্রমণ শুরু হলো।