দুই
ইসাস মুহূর্তের জন্য উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে হ্যান্সির দিকে চাইলেন। যুবক চীফ সাভান্টটি তাঁর গিল্ডের অন্যতম মেধাবী সদস্য-এবং ঠাণ্ডা মস্তিষ্কের। সঙ্কট এলে বাড়িয়ে বলার অভ্যাস নেই তাঁর…
ইসাস আলোকিত কন্ট্রোল রুমটির চারধারে নজর বুলালেন। বহু বর্ণের কন্ট্রোল প্যানেল রয়েছে এখানে, তাদের বাতিগুলো নিয়মিত বিরতিতে মিট-মিট করে জ্বলছে।
‘এত কিছু আছে, তারপরও আপনি অসহায়? বিজ্ঞানের এই জয়যাত্রার যুগে…’ ইসাস নিজেও জানেন সমালোচনা করাটা ঠিক হচ্ছে না।
যেমনটা অনুমান করা হয়েছিল, হ্যান্সি তাঁর গিল্ডের পক্ষে সাফাই গাইলেন।
‘ডোডেকাহেড্রনের ব্যাপারে খুঁটিনাটি তদন্ত ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারব না। এবং ডিয়নরা সেটা করতে দেবে না!’
‘তা ঠিক,’ ব্যথিত কণ্ঠে, খানিকটা অসহায়ের মত সায় জানালেন ইসাস।
ইসাস এডেনের নেতা হলেও, তিনি একটি বিভক্ত জাতিকে শাসন করেন। এডেনের সবাই দুটি গ্রুপের যে কোনও একটির অংশ অথবা সমর্থক-সাভাণ্ট আর ডিয়ন। শক্তি, জনবল আর প্রভাবে সমকক্ষ দুটি দল মহাগুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে পরস্পর মুখোমুখি—সেটি হচ্ছে ক্রিস্টাল ডোডেকাহেড্রন। দুই দলের কাছেই ক্রিস্টাল খণ্ডটি অলৌকিক, রহস্যময় এবং সর্বশক্তিসম্পন্ন। এমনকী এ গ্রহে ওটার আবির্ভাবও রহস্যের চাদরে মোড়া। কিংবদন্তী বলে ওটা আকাশ থেকে নেমে এসেছে।
সাভাণ্টদের কাছে অবশ্য ডোডেকাহেড্রন হচ্ছে বিজ্ঞানের জাদু, যেটিকে পরীক্ষা করে, পর্যবেক্ষণ করে এডেনবাসীর উন্নতির জন্য কাজে লাগানো প্রয়োজন। বেশিরভাগ গণ্যমান্য সাভাণ্টের ধারণা, গোটা গ্রহে পাওয়ার সাপ্লাইয়ের জন্য ক্রিস্টালটি যথেষ্ট হলেও, ওটার যা দেয়ার ক্ষমতা তার সামান্য অংশই তারা ব্যবহার করতে পারছে। এবং মতভেদটা এখানেই। সাভাণ্টদের কাছে ডোডেকাহেড্রন একটি যন্ত্র। ডিয়নদের কাছে দেবতা।
ডোডেকাহেড্রন এখন যেহেতু ব্যর্থ হচ্ছে, দুই দলের প্রতিক্রিয়া আরও বেশি বিপরীতমুখী হয়ে উঠেছে। সাভাণ্টদের ধারণা, পাওয়ার ফেইলিয়র যান্ত্রিক ত্রুটি। এটি পরখ করে সারিয়ে তুলতে হবে। ডিয়নদের বিশ্বাস, এডেনবাসীর পাপের জন্য শাস্তি দেয়া হচ্ছে। ধৈর্যের সঙ্গে প্রার্থনা আর ধ্যান করে এর মোকাবেলা করতে হবে।
এই দুই পক্ষের মধ্যে একমাত্র যোগসূত্র ইসাস-যাঁর কোনও সত্যিকারের ক্ষমতা দেখানোর সুযোগ নেই, যেহেতু তাঁকে দু’দলের মধ্যে ভারসাম্য রেখে চলতে হয়। একই সঙ্গে ইসাস হচ্ছেন অবিসংবাদিত নেতা। একমাত্র তাঁর পক্ষেই রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ থেকে এডেনকে বাঁচানো সম্ভব। তাঁর অবস্থানটা সহজ নয়।
ক্রুদ্ধ যুবক সাভাণ্টটির দিকে সহানুভূতির চোখে চাইলেন ইসাস।
‘আমি বুঝতে পারছি, হ্যান্সি। বিশ্বাস করুন, বুঝতে পারছি।’
‘আমি সব সময় তর্ক করে এসেছি’ শুরু করলেন হ্যান্সি।
খলখল করে হাসলেন ইসাস।
‘কথাটা একদম সত্যি!’
অনিচ্ছাসত্ত্বেও মুচকি হাসলেন হ্যান্সি। ইসাস পরিবেশটাকে হালকা করলেও প্রসঙ্গ থেকে সরে গেলেন না তিনি।
‘হাজার বছর ধরে আমাদের জীবন একটা রহস্য দিয়ে মোড়া। ডোডেকাহেড্রন আমাদের সবার, শুধু ডিয়নদের একার নয়।’
‘আপনি ওদের মতামত সম্বন্ধে যা-ই ভাবুন না কেন, ওদের ধর্মটাকে কিন্তু শ্রদ্ধা করতে হবে।’
‘ধর্ম,’ খোঁত করে শব্দ করলেন হ্যান্সি। ‘তারচেয়ে এই কন্ট্রোল কনসোলটাকে পূজা করা ভাল।’
‘একভাবে না একভাবে তা-ই হয়তো করছেন,’ বিনীতভাবে বললেন ইসাস।
হ্যান্সি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তর্ক বাদ দিলেন। একটা কন্ট্রোল স্পর্শ করলেন তিনি।
‘কন্ট্রোল টু ওয়াকওয়ে নাইন। বার্ন-আউটের আপডেট জানান, প্লিজ।’
.
ওয়াকওয়েতে, ক্যারি কাজ থেকে সটান সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে, কপাল মুছল। দগ্ধ টেকনিশিয়ানটির মুখে ড্রেসিং করে, মেডিকেল টিম স্ট্রেচারে তুলে নিয়ে গেছে। ক্যারি ও আর এক টেকনিশিয়ান পোর্টেবল পাওয়ার প্যাকের ইর্মাজেন্সি লাইটিঙের নীচে কাজ করছে, নতুন এক ট্রান্সফর্মার জায়গা মত ওয়েল্ডিং করে বসাচ্ছে।
কম-ইউনিটে কথা বলল ক্যারি।
‘আমি এখন ট্রান্সফর্মারটা পাল্টাচ্ছি, হ্যান্সি। তিন ঘণ্টার জন্য কারেন্ট থাকবে না।’ তারপর তিক্তকণ্ঠে যোগ করল, ‘এবার আমার কথা বিশ্বাস হলো?’
হ্যান্সি স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন, ‘ধন্যবাদ, ক্যারি, স্বীকার করলাম এবং বুঝলাম।’ ইসাসের দিকে চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে চাইলেন। ‘ইদানীংকার ঘটনাগুলোর ফলে ক্যারির যুক্তি আরও জোরাল হয়েছে।’
‘মাটির ওপরে আবার বাস করার হাস্যকর পরিকল্পনা, এবং গাছ- পালার আক্রমণ মোকাবিলা করা?’ শিউরে উঠলেন ইসাস। ‘প্রস্তুতি নিতেই বহু বছর লেগে যাবে।’
‘কয়েক দশক খুব সম্ভব।’
‘তো আমরা একবারের জন্যে হলেও একমত হলাম?’
‘আমার নিজেরও আইডিয়াটা পছন্দ নয়,’ স্বীকার করলেন হ্যান্সি। ‘আমার মাথায় বেটার চিন্তা আছে-যেমন ডোডেকাহেড্রনের পুরো ক্ষমতা ব্যবহার করার কায়দা শেখা।’ সামনে জরুরি ভঙ্গিতে ঝুঁকে পড়লেন। ‘তবে ক্যারি আর তার বন্ধুদের অন্তত একটা প্ল্যান তো আছে-যৌক্তিক, বিজ্ঞানসম্মত প্ল্যান।’
‘যেটাকে ডিয়নরা ব্লাসফেমি ঘোষণা করেছে।’
‘আপনি চাইলেই ওদেরকে উপেক্ষা করতে পারেন, ইসাস!’
‘তারপরে আর কতক্ষণ নেতা থাকতে পারব?’
পুরানো সেই উভয় সঙ্কট। যদি কোনও পক্ষ মনে করে ইসাস পক্ষপাতিত্ব করছেন, তবে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হবে, বসানো হবে হয়তো তাঁর চাইতে অনেক খারাপ কাউকে।
‘আপনার সমস্যার কথা আমি জানি, ইসাস। কিন্তু আমি একজন সাভাণ্ট হিসেবে বলছি, যে সারাজীবন এসব জিনিস বোঝার কাজে ব্যয় করেছে। শীঘ্রিই যদি কিছু করা না হয় তা হলে আমাদের প্রিয় শহরটার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। আপনি নেতা, ইসাস, তাই দায়-দায়িত্ব আপনার।’
ইসাস দু’মুহূর্ত গভীর চিন্তা করে মাথা নোয়ালেন।
‘ঠিক আছে। আমি গ্রেবার কাছে খবর পাঠাব।’
.
পাওয়ার রুমের অ্যানেক্স। এখানে ক্যাথেড্রালের মতন নীরবতা। ডিয়নদের প্রধান সন্ন্যাসিনী গ্রেবা গভীর ধ্যানে মগ্ন। অধীনস্ত সহকারী উপাসিকারা তাঁকে ঘিরে আছে। সবার পরনে বেগুনী আলখিল্লা। কামরার মাঝখানে স্বমহিমায় স্থাপন করা তিনকোনা প্রকাণ্ড পাথরটিকে ঘিরে দলবদ্ধ হয়েছে তারা।
গ্রেবা লম্বা, সুন্দরী এক নারী। ডিয়ন পুরোহিতের পোশাক পরিহিতা। ধর্মীয় মুকুট সদৃশ হেডড্রেসের তলা থেকে দীর্ঘ চুল নেমে এসেছে তাঁর।
বিশাল গোলাকার কামরাটিতে প্রায়ান্ধকার আর নীরবতা বিরাজ করছে। দেয়ালের ব্র্যাকেটে মশাল জ্বলছে। তার শিখায় যেটুকু আলোকিত হয়েছে চারপাশ। মাঝে-মধ্যে অবশ্য পাওয়ার রূমের খিলানাকৃতি দরজা গলে চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল আলো এসে পড়ছে।
সহকারী উপাসিকারা গ্রেবার মতই আলখিল্লা আর হেডড্রেস পরে থাকলেও তাদেরগুলো তেমন জমকাল নয়। তারা অর্ধবৃত্তাকারে গ্রেবাকে ঘিরে বসেছে। পাওয়ার রূম থেকে ভেসে আসা নিচু শক্তির গুঞ্জন তাদেরকে আধো সম্মোহিত করে রেখেছে। এটি ঐকমত্যের অনুষ্ঠান, ডিয়ন ধর্মের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় রীতি।
অ্যানেক্সের দরজায় কালো উর্দি আর কালো শিরস্ত্রাণ পরা প্রহরী উদয় হল, বিরক্তিতে মুখ তুলে চাইলেন গ্রেবা।
‘কী ব্যাপার?’ প্রশ্ন করলেন।
প্রহরী এগিয়ে এসে, বাউ করে তাঁর হাতে ইসাসের সিলমোহর দেয়া একটি স্ক্রল তুলে দিল।
তিনি ওটা খুললেন। দীর্ঘ চিঠিটি পড়ে উত্তেজিত ভঙ্গিতে সটান উঠে দাঁড়ালেন।
‘না!’
উপাসিকারা তাঁকে ঘিরে ধরল, কিন্তু কথা বলার সাহস পেল না।
‘না!’ গ্রেবা আবারও বললেন। ‘ইসাস আমাদের নেতা, কিন্তু তাঁর কোনও অধিকার নেই আমাদেরকে পাপের পথে ঠেলে দেয়ার!’
সহকারীদেরকে হাত নেড়ে যার যার জায়গায় ফিরে যেতে ইশারা করলেন।
‘অনুষ্ঠান শুরু করো। আমি এ ব্যাপারটা আরও একবার ইসাস এবং সাভাণ্টদের বুঝিয়ে বলব!’
সহকারীরা সবাই মাথা নোয়াল। গ্রেবা গটগট করে অ্যানেক্স ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। উপরের স্তরে যাওয়ার সিঁড়িটার দিকে যাওয়ার জন্য ওয়াকওয়ে ‘ধরে হাঁটা দিলেন। সিঁড়ির তলায় পৌঁছে দেখলেন ইসাস সিঁড়ির মাথায় অপেক্ষা করছেন। নেতা হিসেবে গ্রেবা তাঁর কাছে যাবেন, কিন্তু তিনি নিজেই গ্রেবাকে অভ্যর্থনা জানাতে চলে এসেছেন। এটিই ইসাসের বৈশিষ্ট্য।
সিঁড়ির মাথায় পৌঁছনোর পর ইসাস মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘আপনি রেগে আছেন, গ্রেবা।
‘আপনি আমাকে না, ক্রুদ্ধ করেছেন শক্তিকে,’ জবাব দিলেন গ্ৰেবা।
‘এমুহূর্তে মনে হচ্ছে ওটার ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে আছে। এবং আমাদেরও তাই থাকা উচিত।’
পাশাপাশি হাঁটতে লাগলেন তাঁরা।
‘সাভান্টরা কিছু প্রস্তাব দিয়েছে, বলে চললেন ইসাস। ‘আমাদের সমস্যার সমাধান আছে ওতে, অন্তত তাদের তা-ই বিশ্বাস আরকী।’
‘বিশ্বাস!’ তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠলেন গ্রেবা। ‘ওদের অভিধানে এ শব্দটি নেই। ওরা ছেলেমানুষের মত খামখেয়ালি, অজ্ঞ, এবং ওদের কোনও আশা নেই।
‘আমাদের কারোরই কোনও আশা থাকবে না, সাভাণ্ট বলুন আর ডিয়ন বলুন-পাওয়ার যদি ফেইল করে।
‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’ প্রশ্ন করলেন গ্ৰেবা।
‘ডিবেটিং চেম্বারে, সাভান্টদের প্রস্তাবগুলো শুনতে,’ শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন ইসাস।
‘আমি আপনাকে সাবধান করছি, ইসাস, এটা সমঝোতার বিষয় নয়।’
‘গ্রেবা, আমি একজন বুড়ো মানুষ। আপনার মত হয়তো অতখানি বিশ্বাস নেই আমার। তারপরও আমার ধারণা আপনি আমার মতামতের ওপর আস্থা রাখেন, ঠিক বলেছি না?’
মুহূর্তের বিরতির পর গ্রেবা গজগজ করে বললেন, ‘হ্যাঁ…’
‘তা হলে সাভান্টদের প্রস্তাবগুলো শুনুন। ওরা সামান্য কিছু পরিবর্তন করতে চায়। ওরা এমনকী ডোডেকাহেড্রনকে স্পর্শও করবে না।’
‘ওরা আমাদের পাওয়ার রূমে ঢুকতে পারবে না, গোমড়া স্বরে বললেন গ্রেবা। ‘কাউকে আমাদের প্রাচীন রীতি ভাঙতে দেয়া হবে না-এমনকী আপনাকেও না, ইসাস।’
গুরুত্বপূর্ণ এসময়টিতে যখন তাঁরা সেন্ট্রাল কন্ট্রোলের দরজার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, হ্যান্সি ডিবেটিং চেম্বারে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে এলেন। তিনিও আলোচনায় যোগ দিলেন।
গ্রেবা, আপনাদের ঐকমত্যের অনুষ্ঠানও বিজ্ঞানের সূত্রকে বাতিল করতে পারবে না।’
গ্রেবা ক্রুদ্ধভঙ্গিতে হ্যান্সির দিকে ঘুরে চাইলেন।
‘দেখুন, হ্যান্সি-’
ইসাস হস্তক্ষেপ করলেন।
‘হ্যান্সি, গ্রেবা, এসব তর্ক অনেক হয়েছে। আপনারা নেতার মতন আচরণ করতে চেষ্টা করুন।
‘তা হলে আপনি নেতা হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন, ইসাস। একটা কিছু সিদ্ধান্ত নিন!’ তাগিদ ঝরল হ্যান্সির কণ্ঠে।
মুহূর্তের জন্য ইসাসকে প্রলুব্ধ মনে হলো, তারপর মাথা নাড়লেন তিনি।
‘আমি যে কোনও একটা পক্ষ বেছে নিতে পারি না।’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। ‘জানতাম ব্যাপারটা এতদূর গড়াবে। যাকগে, আমি অন্য ধরনের একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
হ্যান্সি আর গ্রেবা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে চাইলেন।
‘প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে,’ বললেন ইসাস, ‘আমি একজনকে চিনতাম, যিনি সমাধানের অযোগ্য বিষয়কে অদ্ভুত উপায়ে সমাধান করতে পারতেন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে বেঁধে রাখা সুতোটা দেখতে পেতেন তিনি। এবং সুতো ছিঁড়ে গেলে জুড়ে দিতে পারতেন।’
‘কোনও সাভাণ্ট?’ সন্দেহের সুরে জানতে চাইলেন হ্যান্সি। নাকি কোনও মিস্টিক, গ্রেবা কিংবা তাঁর সহকারীদের মতন।’
‘খানিকটা করে দুটোই, এবং তারচেয়েও বড় কথা একদম অন্যরকম একজন মানুষ। তিনি কাছেই আছেন, এবং আমাদের এখানে ভিজিট করতে চান। আমি তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি।’
সন্দেহে ভ্রূ কুঁচকে গেল হ্যান্সির।
‘আপনি একজন ভিনগ্রহীকে এখানে দাওয়াত করেছেন?’
মাথা ঝাঁকালেন ইসাস।
‘কেন?’ জবাব চাইলেন গ্রেবা।
‘আমার ধারণা এই মুহূর্তে আমাদের তাঁকেই প্রয়োজন।
.
সে মুহূর্তে, হিরু চাচা রোকুর সার্কিটরিতে কিছু অ্যাডজাস্টমেন্ট করছে।
‘রিফ্লেক্সগুলো মনে হচ্ছে এখন ঠিকই আছে…কিন্তু ওকে ভবিষ্যতে সাগর থেকে দূরে থাকতে হবে, নইলে গভীর পানিতে হাবুডুবু খাবে।’
‘কেউ ওকে সিপ্রফ করতে ভুলে গেলে ওর কী দোষ!’
‘ঠিক বলেছিস, অস্পষ্ট শোনাল হিরু চাচার কণ্ঠ। ‘তুই জানিস আমি ওর ম্যানুয়ালটা কোথায় রাখি?’
‘জানি, হিরু চাচা।’ কিশোর গেল ম্যানুয়ালটা উদ্ধার করতে। ওটা হ্যাট স্ট্যাণ্ডের খাট পায়ার নীচে গোঁজা ছিল। এটাকেও জরুরি ভিত্তিতে মেরামত করা দরকার। হিরু চাচার হাতে দিল ম্যানুয়ালটা।
‘রোকুর সেরে ওঠা দরকার। ওকে আমাদের এডেনে দরকার পড়তে পারে।’
‘এডেনবাসী শত্রুভাবাপন্ন নয়।’
‘গাছ-পালাগুলো, হিরু চাচা। আমার ইণ্টার গ্যালাকটিক গাইড এবং হিস্ট্রির মতে, এডেনের সার্ফেস সতেজ, আক্রমণাত্মক গাছ- পালায় ঠাসা।’
হিরু চাচা রোকুর ম্যানুয়ালটা উল্টাচ্ছে।
‘বইয়ের সব কথা বিশ্বাস করতে হয় না।’
‘ইতিহাস বইতে বলছে, আক্রমণাত্মক গাছ-পালার কারণে এডেনবাসীকে পাতালে বসতি গড়তে হয়েছে। তুমি যেবার ওখানে গেছিলে ব্যাপারটা খেয়াল করনি?’
‘আমার তো বন্ধুভাবাপন্নই মনে হয়েছিল। তবে সেটা অবশ্য অনেক বছর আগের এডেন।’ বইটা থেকে মুখ তুলে চাইল। ‘মেরামতের পর পরীক্ষামূলক প্রশ্ন। এক নম্বর: আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস?’ ছোট্ট রোবটটার দিকে ঝুঁকে পড়ল সে। ‘আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস, রোকু?’
‘পাচ্ছি-মাস্টার কিশোর।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল হিরু চাচা।
‘শুরুটা সুবিধের হলো না। আমার সনিক স্ক্রু-ড্রাইভারটা দে তো, ভাতিজা।’
.
এডেনের ডিবেটিং চেম্বারে তুমুল তর্ক-বিতর্ক চলছে। কয়েক স্তর বিশিষ্ট আসনের একদিকে সাভাণ্ট আর অন্যদিকে ডিয়নরা দল বেঁধে বসেছে। খানিক পরেই তর্ক রূপ নিল চেঁচামেচিতে।
ইসাস সটান উঠে দাঁড়ালেন।
‘আপনারা সবাই শান্ত হোন!’ চেঁচিয়ে উঠলেন। ‘এজায়গার সম্মান ক্ষুণ্ণ করবেন না। আমরা কি এখানে ঝগড়া করতে এসেছি? একমত যদি আমরা না-ই হতে পারি, অন্তত শৃঙ্খলা তো বজায় রাখা দরকার!’
তিনি বসে পড়লেন, এবং মুহূর্তের জন্য নীরবতা নেমে এল।
এবার হ্যান্সি লাফিয়ে উঠলেন।
‘আমি আমার যা বলার বলেছি। খামোকা এখানে সময় নষ্ট করছি। আমার মেইন কন্ট্রোলে জরুরি কাজ আছে।’
তিনি চেম্বার ত্যাগ করতে পারার আগেই, গ্রেবা উঠে দাঁড়ালেন।
‘ওঁকে যেতে দেবেন না। ধর্মের বিরোধিতা করার জন্যে ওঁকে গ্রেপ্তার করুন।’
‘এবং মৃত্যুদণ্ড দিন,’ ব্যঙ্গ করে বললেন হ্যান্সি।
গ্রেবা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওঁর দিকে চাইলেন। কথাটা দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, ডিয়ন ধর্মের গোড়ার দিকে, বিরোধিতাকারীকে প্রকাণ্ড এক পাথরের নীচে চাপা দিয়ে মারা হত। গত বহু বছর কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় না, যদিও গোঁড়া ডিয়নদের কারও-কারও মতে এখন আবার মৃত্যুদণ্ডের বিধান চালু করার সময় এসেছে।
‘ডিয়নদের আইনকে আপনার শ্রদ্ধা করা উচিত, হ্যান্সি,’ কঠোর গলায় বললেন ইসাস।
‘মানুষ হত্যার আদিম আইনকে শ্রদ্ধা করি কীভাবে? গ্রেবা, আপনি কি মানুষ উৎসর্গ করে বর্তমান সমস্যার সমাধান করতে চাইছেন?’
‘আপনি কোথায় আছেন ভুলে যাবেন না, হ্যান্সি,’ সতর্ক করলেন ইসাস। ‘চুপ করুন!
‘না! এটা বলতেই হবে-এবং সবার সামনে। ডোডেকাহেড্রন দেবতা নয়। একটা আর্টিফ্যাক্ট। ওটা বানানো হয়েছিল!’
ভয়ঙ্কর এই ধর্মদ্রোহিতা ডিয়ন উপাসকদের মধ্যে প্রতিবাদ আর ক্রোধের গর্জন তুলল। ক্রুদ্ধ গ্রেবার কণ্ঠ শোনা গেল সবাইকে ছাপিয়ে।
‘ডোডেকাহেড্রন স্বর্গ থেকে নেমে এসেছিল। এটা আমাদের দেবতা!’
‘স্বর্গ থেকে নয়,’ মরিয়ার মতন চিৎকার ছাড়লেন হ্যান্সি। ‘অন্য কোনওখান থেকে-যে কোনওখান থেকে হতে পারে, কিন্তু স্বর্গ থেকে নয়।
বিজয়ীর ভঙ্গিতে তাঁর মোকাবিলা করলেন গ্রেবা।
‘কোত্থেকে, হ্যান্সি? কোত্থেকে?’
এ প্রশ্নের জবাব নেই। পরাজিত হ্যান্সি ঘুরে দাঁড়ালেন।