বারো
হিরু চাচা ল্যাবোরেটরি থেকে সরে যাচ্ছে, এসময় নিজেকে দেখতে পেল-ছদ্মবেশী ডিলাক-এদিকেই আসছে। মুহূর্তে হিরু চাচা গা ঢাকা দিল, ল্যাবোরেটরির কোনা ঘুরে দেয়ালের সঙ্গে শরীর মিশিয়ে দিল।
পটোম্যাক যে দু’জন গ্যাটাককে হিরু চাচার পিছনে পাঠিয়েছিল তারা হিরু চাচাকে দেখেনি, কিন্তু তারা আগুয়ান ডিলাককে দেখতে পেল। ওরা কাছিয়ে আসতেই ডিলাক উদ্ধত চোখে ওদের দিকে চাইল।
‘তোমরা টহল দিচ্ছ না কেন?’
এক গ্যাটাক ডিলাকের সোলার প্লেক্সাসে প্রচণ্ড ঘুষি মারল। ও নুয়ে পড়তেই দু’জন মিলে ওর দু’বাহু চেপে ধরে গ্যাটাক স্পেসশিপের দিকে দৌড়তে-দৌড়তে নিয়ে চলল।
মুখ বেঁকে গেল হিরু চাচার।
‘বিশ্রী ব্যাপার, এটা আমার সাথেও ঘটতে পারত,’ মনে-মনে বলল।
ক’মুহূর্ত পরে ঘটলও। গুপ্ত স্থান থেকে হিরু চাচা বেরিয়ে আসতেই, পটোম্যাকের সামনে পড়ে গেল। সে ল্যাবোরেটরি থেকে বেরিয়ে এসেছে গার্ড দু’জন কী করছে দেখতে।
ডিলাককে মুক্ত দেখে, এবং গার্ডদেরকে দৃষ্টি সীমার মধ্যে দেখতে না পেয়ে, পটোম্যাক সিদ্ধান্ত নিল, কিছু করতে হলে নিজেকেই করতে হয়। এবং হিরু চাচার সোলার প্লেক্সাসে সজোরে ঘুষি মারল।
এক টহলরত গ্যাটাক গার্ডকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল পটোম্যাক।
‘জলদি এদিকে এসো।’
লোকটা দৌড়ে এল।
হিরু চাচার ভাঁজ-হওয়া দেহটা দেখাল পটোম্যাক।
‘একে শিপে নিয়ে চলো!’
দু’জন মিলে হিরু চাচাকে হিঁচড়ে নিয়ে চলল।
.
গ্যাটাক স্পেস শিপের সবচাইতে কাছের পর্দাটার পিছনে পৌঁছল কিশোর, ক্যারি, হ্যান্সি আর রোকু এবং গা ঢাকা দিল। ওরা লক্ষ করল ডিলাককে ধরে আনা গার্ড দু’জন শিপ ত্যাগ করে টহল শুরু করছে।
মিনিট কয়েক বাদে, ওরা পটোম্যাক এবং আরেকজন গ্যাটাককে দেখতে পেল, স্পেস শিপের দরজা দিয়ে টেনে-হিঁচড়ে ঢোকাচ্ছে হিরু চাচাকে।
‘জানতাম ধরা পড়ে যাবে,’ বলল কিশোর, ‘আয়, রোকু, হিরু চাচাকে উদ্ধার করতে হবে।’
‘হ্যাঁ, মাস্টার।’
পা টিপে-টিপে শিপটার দিকে এগোল ওরা।
.
পটোম্যাক আর গ্যাটাকটা এক করিডর ধরে সিকিউরিটি হোল্ডের দিকে হিঁচড়ে নিয়ে গেল হিরু চাচাকে। ওখানে পৌঁছে দরজার তালা খুলল পটোম্যাক। ভিতরে না তাকিয়ে, ঠেলে ঢুকিয়ে দিল হিরু চাচাকে, দড়াম করে দরজা লাগিয়ে, তালা মেরে, গ্যাটাকটাকে পিছনে নিয়ে শিপ ত্যাগ করল।
ধাতব সেলটার ভিতরে সটান সিধে হয়ে দাঁড়াল হিরু চাচা, পেটে হাত বুলোল, এবং আবিষ্কার করল সে নিজের দিকে চেয়ে রয়েছে।
‘আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো?’ নম্র কণ্ঠে প্রশ্ন করল।
ডিলাক এতটাই বিস্মিত, জবাব দিতে পারল না।
.
স্পেসশিপের কোনায় আড়াল নিল কিশোর এবং অন্যরা, পটোম্যাক এবং অপর গ্যাটাকটিকে উদয় হতে দেখে।
‘এখানে থাকো,’ আদেশ করল পটোম্যাক। ‘ও কিছু করার চেষ্টা করলে খুন করে ফেলো।’ এবং দ্রুত পায়ে চলে গেল সে।
সশস্ত্র, সতর্ক, সন্দিহান, গ্যাযটাকটা পাহারায় রইল।
‘আমরা কখনওই সামনে দিয়ে ঢুকতে পারব না,’ ফিসফিস করে বলল ক্যারি। ‘এখন কী করা?’
.
বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠতে সময় লাগল না ডিলাকের। কী ঘটেছে বুঝে ফেলল ও। ছোট্ট সেলটায় ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে পায়চারী করতে লাগল সে।
‘দশ হাজার বছরের অপেক্ষা, প্ল্যানিং, অথচ এখন এই গ্যাটাকরা সব ভণ্ডুল করে দিল। নির্বোধ! মূর্খ! গর্দভ! আহাম্মক!’
শক্ত ধাতব বাঙ্কে সহজ ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে বসে ছিল হিরু চাচা।
‘হ্যাঁ, ওদের বুদ্ধির ঘাটতি আছে। আমাদের মত নয়!’
‘ওরা এডেনে সম্ভবত হিটও করতে পারবে না,’ ফোঁস-ফোঁস করে বলল ডিলাক।
‘আমার ক্যালকুলেশন ঠিক হলে অবশ্যই পারবে না!’
‘আপনার ক্যালকুলেশন?’
‘আমি আপনার ল্যাবোরেটরিতে ঢুকেছিলাম।’ ক্ষমা প্রার্থনার সুরে বলল হিরু চাচা। ‘ওরা আমাকে আপনি ভেবেছিল। আমি আপনার কন্ট্রোল সেটিংগুলো পাল্টে দিয়েছি। আপনার গ্যাটাক বন্ধু কাউন্টডাউন শুরু করলে নিজেকেই ধ্বংস করে দেবে-সে সঙ্গে আমি, আপনি আর গোটা গ্রহটাও ধ্বংস হয়ে যাবে!’
.
গ্যাগারিন মেইন কন্ট্রোল কনসোলে দাঁড়িয়ে, তার আঙুলগুলো অধৈর্যের সঙ্গে তবলা বাজাচ্ছে। পটোম্যাক ঢুকলে মুখ তুলে চাইল ও।
‘কী খবর?’
‘ওকে সিকিউরিটি সেলে বন্দি করে রেখেছি। আর কোন সমস্যা নেই। আমরা কি এখন রেডি?’
‘হ্যাঁ!’
ডিলাকের হুবহু অনুকরণে বলল গ্যাগারিন। ‘কাউণ্টডাউনের জন্যে তৈরি হও।’
.
সতর্কতার সঙ্গে পায়চারী-করা গ্যাটাক গার্ডটিকে জরিপ করল কিশোর। লোকটা চারধারে সন্দেহের দৃষ্টি বুলাচ্ছে। একে চমকে দিয়ে কাবু করা সহজ হবে না।
রোকুর উদ্দেশে ঝুঁকে বসল কিশোর।
‘তোকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। যা!’
ধীরে-সুস্থে দৃশ্যপটে উদয় হলো রোকু। গার্ডটিকে আপাতদৃষ্টিতে উপেক্ষা করে, এদিক-সেদিক অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরতে লাগল। গ্যাযটাকটা আমুদে বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইল, ধীরে-ধীরে ঘুরছে যাতে রোকুকে নজরে রাখতে পারে।
রোকু অন্যদিকে ঘুরল এবং গার্ডটা ওর সঙ্গে ঘুরে গেল, পিঠ ফেরাল কিশোর এবং অন্যদের দিকে।
হ্যান্সি সন্তর্পণে সামনে এগোলেন। গার্ডটার কাছে পৌঁছে ওর কাঁধে টোকা দিলেন। পাঁই করে ঘুরল লোকটা, এবং হ্যান্সি সর্বশক্তিতে ওর চোয়ালে বিরাশি সিক্কার একটা ঘুষি ঝাড়লেন। গ্যাটাকটা চোখ পিটপিট করল, মাথা ঝাঁকাল, যেন মশার কামড় খেয়েছে, তারপর রাগে গর্জে উঠে ব্লাস্টার তুলল। তখুনি উল্টোদিক থেকে ওকে ফায়ার করল রোকু। হ্যান্সি মুঠোয় হাত ঘষলেন!
‘ধন্যবাদ, রোকু।’
কিশোর আর ক্যারি দৌড়ে এল।
‘জলদি,’ বলল কিশোর, এবং ওরা ত্বরিত শিপের ভিতরে ঢুকে পড়ল।
ফাঁকা শিপটায় দ্রুত এবং দক্ষতার সঙ্গে তল্লাশী চালাল ওরা। তালাবন্ধ সিকিউরিটি সেলটা খুঁজে পেতে দেরি হলো না।
‘হিরু চাচা নিশ্চয়ই ওখানে আছে,’ বলল কিশোর। ‘তুই খুলতে পারবি, রোকু?’
রোকু সামনের দিকে গড়িয়ে চলল, এবার নাকের লেসার বের করে তীব্র রশ্মি ছুঁড়ল। ধীরে-ধীরে একটা চিড় দেখা গেল ধাতব দরজায়…
.
ডিলাক তখনও পায়চারী করছে।
‘তিন মিটার বাই পাঁচ মিটার-এবং আমি ছায়াপথ দখল করে নিতে পারতাম, পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড।’
‘আমি এব্যাপারে প্রায়ই ভেবেছি,’ গল্পচ্ছলে বলল হিরু চাচা।
‘কোন্ ব্যাপারে?’
‘কেন আপনার মত সুদর্শন এক লোক বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতে চায়?’
‘কেন?’ আর্তনাদ ছাড়ল ডিলাক। ‘কেন?’
‘এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা দেখে থ বনে গেছি আমি…’ হিরু চাচা থেমে গেল। ডিলাক তার স্বভাবসিদ্ধ উদ্ধত অভিব্যক্তিতে ফিরে গেল।
‘এটা আপনার বোঝার ক্ষমতার বাইরে!’
‘তা ঠিক বলেছেন,’ সায় জানাল হিরু চাচা। ‘কথা হচ্ছে…’ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে দরজার দিকে চাইল। ইতোমধ্যে বড় এক অংশ সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। হঠাৎই ওটা ভিতর দিকে ধসে পড়ল। এবার কিশোরকে দেখা গেল।
‘হিরু চাচা!’ আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল ও। এবার দু’জন হিরু চাচাকে দেখে আঁতকে উঠল। ‘হায় আল্লাহ!’
‘সরে যাও!’ খেঁকিয়ে উঠল ডিলাক, ওকে একপাশে সরিয়ে দিতে চাইল। কিন্তু হ্যান্সি আর ক্যারি ছিল ওর পিছনে, তারা পথরোধ করল।
‘ধরো ওকে!’ চিৎকার করে বলল হিরু চাচা। ‘ওটা ডিলাক!’
‘তোমরা আমাকে আটকাতে পারবে না,’ গর্জে উঠল ডিলাক। দুই এডেনবাসীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে এসময় ক্ষীণ এক কণ্ঠস্বর ফিসফিসিয়ে বলল, ‘এবার তোমাকে বাগে পেয়েছি, ডিলাক! ‘
ডিলাক আড়ষ্ট হয়ে গেল, জায়গায় জমে গেল। চামড়া ক্যাকটাস সবুজ হয়ে উঠল এবং কাঁটা গজাল। হিরু চাচার রূপ ঝাপসা হয়ে এল, এবং আরেকটি মুখ স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। সেই বহু ব্যবহৃত গ্রেগ চ্যাপেল মুক্তির জন্য আরেকবার চেষ্টা চালাচ্ছেন, এবং এবার সঠিক সময় বেছে নিয়েছেন তিনি।
‘পেয়েছি তোমাকে!’ আনন্দে আত্মহারা কণ্ঠে বলে উঠলেন কণ্ঠস্বরটা চড়া, জোরাল এখন।
ডিলাকের কণ্ঠ বলল, ‘ওরা তোমাকে পেয়েছে, আর্থলিং।’
সবুজ রং আর ক্যাকটাস সদৃশ বৈশিষ্ট্য যেন ওর দেহ থেকে গড়িয়ে নেমে, পায়ের কাছে পরিণত হচ্ছে উজ্জ্বল সবুজ অ্যামিবার মত এক পিণ্ডে। মেঝের উপর দিয়ে এঁকেবেঁকে, দরজার কাটা অংশ গলে বেরিয়ে গেল ওটা।
ডিলাকের জায়গায় দাঁড়িয়ে লম্বা, কালো চুলো এক লোক। মুখের চেহারায় ক্লান্তি আর হতবিহ্বল ভাব। বাঙ্কে ধপ করে বসে পড়লেন তিনি। দু’হাতে মুখ ঢাকলেন।
‘কী হয়েছিল?’ গুঙিয়ে উঠলেন তিনি। ‘কী হচ্ছে এসব?’
কারও কথা বলার সময় নেই।
‘পিণ্ডটা-ওটাই কি ডিলাক?’ প্রশ্ন করল কিশোর।
মাথা ঝাঁকাল হিরু চাচা।
‘রঙিন ব্যক্তিত্ব বলতে পারিস!’
‘ও নিশ্চয়ই নিজেকে আলোর বিশেষ এক ওয়েভলেংথে মডিউলেট করেছে,’ বলল কিশোর। ওর বৈজ্ঞানিক কৌতূহল জেগে উঠল। ‘এই শক্তি নিয়ে ডিলাক এক কথায় অপরাজেয়!’
‘ও অপরাজেয় হতে পারে, কিন্তু আমরা নই,’ চট করে বলল হিরু চাচা। ‘আমাদের সবার টাইম মেশিনে ফিরে যাওয়া উচিত… বেশি দেরি হওয়ার আগেই। তোর বন্ধু গ্যাগারিন ভুল করে গ্রহটা উড়িয়ে দিতে চলেছে।’
দরজার দিকে এগোল ওরা, পৃথিবীবাসীটি বাঙ্কেই বসে রইলেন। হিরু চাচা তাঁকে ধরে ওঠাল।
‘আপনিও চলুন, নইলে বিস্ফোরণে উড়ে যাবেন।’
‘উড়ে যাব?’
‘হ্যাঁ,’ বলল হিরু চাচা।
‘না!’ বলে উঠলেন পৃথিবীবাসী, এবং হিরু চাচাকে অনুসরণ করে সেল ত্যাগ করলেন।
.
জেনারেল গ্যাগারিন তার সদ্যলব্ধ বৈজ্ঞানিক জ্ঞান নিয়ে ডিলাকের ল্যাবোরেটরিতে কনসোলে ব্যস্ত। কাজ করছে আর সহজ বিজয়ের স্বপ্ন দেখছে। ব্যক্তিগত প্রতিশোধ হিসেবে এডেনকে ধ্বংস করা হবে একটা উদাহরণ। কাজটা হয়ে গেলে সবচাইতে কাছের ধনী গ্রহটির দিকে রশ্মি তাক করে আল্টিমেটাম দেবে সে।
‘যা কিছু আছে দিয়ে দাও নইলে এডেনের দশা হবে।’
খুব সোজা হবে কাজটা। প্রথমটায় অবশ্য ওর কথা বিশ্বাস করবে না, সেজন্য আরও গোটা কয় গ্রহ উড়িয়ে দিতে হবে। তাতে অবশ্য কোন সমস্যা হবে না, ক্ষমতা এখন তার মুঠোয়।
গ্যাগারিন বলল, ‘ত্রিশ সেকেণ্ড, রশ্মিগুলো এক বিন্দুতে মিলছে!’
পটোম্যাক মেইন কনসোলের অংশ এক ডিজিটাল ঘড়ি দেখে কাউণ্টডাউন শুরু করল।
‘ঊনত্রিশ…আটাশ… সাতাশ… ছাব্বিশ….’
.
হিরু চাচা তার ছোট্ট দলটিকে টাইম মেশিনে তাড়া দিয়ে তুলে দিল, এবং তারপর কিশোরের মত ওটার গায়ে আলতো চাপড় দিল।
‘আমি জানি তুই আমাদের ডোবাবি না, ঠিক না?’
টাইম মেশিনের টেক-অফ ইদানীং একটু ধীরে হচ্ছে…
.
ওদিকে ল্যাবোরেটরিতে পটোম্যাক গুণে চলেছে।
পঁচিশ… চব্বিশ… তেইশ… বাইশ… একুশ… বিশ… উনিশ… আঠারো… সতেরো…’
ওর কণ্ঠস্বরে শিশুর সরলতা, স্কিপিং খেলছে যেন।
‘ষোলো…পনেরো…চোদ্দ…’ উজ্জ্বল সবুজ এক পিণ্ড দরজা দিয়ে ছিটকে ঢুকে পড়ল, ল্যাবোরেটরির মেঝের উপর দিয়ে গড়িয়ে স্ট্যাণ্ডের শুকিয়ে-যাওয়া ক্যাকটাসটার সঙ্গে মিশে গেল…
‘তেরো…বারো…এগারো…’
.
টাইম মেশিনের উপরে বাতি ঝলসাচ্ছে, মৃদু, শোঁ-শোঁ গোঙানির শব্দ উঠছে, কিন্তু টাইম মেশিন যেখানে ছিল সেখানেই আছে…
ভিতরে হিরু চাচা আর কিশোর সেন্ট্রাল কনসোলে পাগলের মত কাজ করছে। তাদেরকে বিস্ময়মাখা চোখে দেখছে সহযাত্রীরা।
‘মেশিনটার থরো ওভারহল দরকার!’ কিশোরের উদ্দেশে বলল হিরু চাচা।
.
ল্যাবোরেটরিতে, গ্যাগারিন আর পটোম্যাকের অলক্ষে গাছটা ওটার স্ট্যাণ্ডে স্ফীত হয়ে, সতেজ, পূর্ণ জীবন পেয়েছে। ডিলাক এখন তার ক্যাকটাস আকৃতি ধারণ করেছে।
‘ছয়, পাঁচ, চার…. খোশমেজাজে বলল পটোম্যাক। ভাবছে বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাবে কিনা।
‘আমরা নড়ছি!’ আতঙ্কিত গ্যাগারিন চেঁচিয়ে উঠল।
‘কী?’ পটোম্যাক স্বয়ংক্রিয়ভাবে গুণে চলল। ‘কোথায় ছিলাম যেন? পাঁচ…চার…’
‘ল্যাবোরেটরিটা,’ আর্তনাদ ছাড়ল গ্যাগারিন। ‘আবার দেবে যাচ্ছে!’
আলফা-তুরার বালির নীচে ল্যাবোরেটরিটা তলিয়ে যেতেই, টাইম মেশিন ধীরেসুস্থে রওনা হলো।
.
‘দেবে যাচ্ছে?’ বলে উঠল পটোম্যাক। হতভম্ব। ‘চার…তিন…’
হঠাৎই ডিলাকের কণ্ঠস্বর গমগম করে উঠল ল্যাবোরেটরিতে। ‘কাউন্টডাউন বন্ধ করুন, বেকুবের দল! হিরন পাশা আপনাদেরকে বোকা বানিয়েছে! কাউন্টডাউন থামান!’
গ্যাগারিন ঘুরে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে গাছটার দিকে চেয়ে রইল।
‘পারছি না। ঘড়ি সেট করা।’
‘তা হলে ঘড়ি বন্ধ করুন।’
পটোম্যাক কনসোলের উপর সাহায্য করার ভঙ্গিতে ঝুঁকে পড়ল।
‘ঠিক! মনে হয় এ বাটনটা।’
‘গাধা,’ চেঁচিয়ে উঠল ডিলাক। ‘থামান ওকে।’
গ্যাগারিন কনসোলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, কিন্ত ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। পটোম্যাকের হাড্ডিসার আঙুল একটা বাটন দাবিয়ে দিয়েছে-ভুল বাটন।
ডিলাক, গ্যাগারিন, পটোম্যাক, পর্দাগুলো, স্পেসশিপ, এবং গোটা আলফা-তুরা বিস্ফোরণের শব্দে অদৃশ্য হয়ে গেল।
.
হিরু চাচা জঙ্গলের মধ্যে এক ফাঁকা জায়গার মাঝখানে, টাইম মেশিনের খোলা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইতোমধ্যেই অনেকখানি জমি ফাঁকা করা হয়েছে, এবং ডিয়ন আর সাভান্টরা চারদিকে কাজে ব্যস্ত থেকে ওটাকে আরও বড় করছে।
এটি শহরের কাছে অন্যতম এক ফাঁকা জায়গা। এডেনবাসী কর্মঠ এবং লড়াকু, যখন তারা বুঝতে পেরেছে ডোডেকাহেড্রন আর ফিরে আসবে না তখন গ্রহের সার্ফেস পুনর্দখল করতে উঠে পড়ে লেগেছে।
গর্বিত ইসাস চারধারে চোখ বুলালেন।
‘কঠিন পরিশ্রম করতে হবে, কিন্তু আমরা অন্তত শুরু তো করলাম।’
ক্যারি আর হ্যান্সি কাজে বিরতি নিয়ে ওদের কাছে এল। ক্যারি চারধারে হাত নাড়ল।
‘অনেক আগেই এ কাজ করা দরকার ছিল।
‘জানি, জানি,’ গুঙিয়ে উঠলেন হ্যান্সি। ‘তুমি প্রথম থেকেই ঠিক বলে এসেছ। তোমার কথাই শেষে শুনতে হলো। কষ্ট হবে, ইসাস যেমনটা বললেন, কিন্তু টিকে যাব আমরা।’
‘অবশ্যই,’ বলল হিরু চাচা। ‘আমি থেকে আপনাদের সাহায্য করব। কিন্তু হর্টিকালচার আসলে আমার সাবজেক্ট নয়। বোটানিতে কিশোরের আগ্রহ আছে।’ টাইম মেশিনের ভিতরে হাঁক ছাড়ল। ‘কিশোর, জঙ্গল পরিষ্কারের ব্যাপারে তুই কী জানিস?
কিশোর পৃথিবীবাসী গ্রেগ চ্যাপেলকে পিছনে নিয়ে বেরিয়ে এল।
‘টিগানা গ্রহ থেকে মেসেজ এসেছে, হিরু চাচা, ওরা শীঘ্রি আমাদের যেতে বলেছে।’
‘তাই?’ বলল হিরু চাচা। ‘যাব, তবে তার আগে আমাদের বন্ধুকে পৃথিবীতে নামিয়ে দিয়ে আসি।’ ত
গ্রেগের দিকে ঘুরে চাইল সে। মানুষটিকে আগের চাইতে সুস্থ দেখাচ্ছে, কিন্তু মুখের চেহারায় বিস্ময়ের অভিব্যক্তি। হিরু চাচা আর কিশোর তাঁর কী হয়েছিল সে সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করেছে। শেষে গ্রেগ এমন মনোভাব নিয়েছেন, এগুলো সব অসম্ভব, কিন্তু যখন ঘটেইছে, সব কিছু মেনে নিয়ে ভুলে যাওয়াই ভাল। গ্রেগ এখন শুধু চান বাড়ি ফিরে গিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন শুরু করতে। তিনি শপথ করেছেন আর কখনও ব্যাঙ্কের একঘেয়ে কাজ নিয়ে অভিযোগ করবেন না।
‘আপনি কি এখানে থেকে গার্ডেনিং করতে চান?’ গ্রেগ চ্যাপেলের দিকে ঘুরে তাকিয়ে জানতে চাইল হিরু চাচা।
‘করতে পারলে তো ভালই হত,’ বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন গ্রেগ। ‘বাড়ি ফিরে সমস্যায় পড়ব আমি। আমার ওয়াইফকে বলেছিলাম বিশ মিনিটের মধ্যে ফিরছি!’
দাঁত বের করে হাসল হিরু চাচা।
‘ঘাবড়াবেন না, সময় সব সময়ই রিলেটিভ, জানেনই তো! আমরা হয়তো আপনাকে চলে আসার আগের সময়ে পৌঁছে দিতে পারব।
‘হয়তো আপনি চলে আসার একশো বছর আগে,’ ভাবল কিশোর, কিন্তু গ্রেগ উদ্বেগ বোধ করবেন বলে বলল না। তার বদলে বলল, ‘চলো, হিরু চাচা, যাওয়ার সময় হলো!’
ইসাস, হ্যান্সি আর ক্যারির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে টাইম মেশিনে ঢুকল ওরা।
ক’মিনিট বাদে অদ্ভুত এক শোঁ-শোঁ গোঙানির শব্দে এডেনবাসী মুখ তুলে চাইল। বেশ ক’জন দেখল টাইম মেশিন শূন্যে মিলিয়ে গেল। শ্রাগ করে কাজে ফিরে গেল তারা। ইদানীং অনেক আজব ঘটনাই ঘটছে…
.
একবারের জন্য হলেও হিরু চাচার স্পেশিও/টেম্পোরাল নেভিগেশন সুনির্দিষ্ট হলো, এবং গ্রেগ চ্যাপেল স্ত্রীকে ফোন করার বিশ মিনিট বাদে বাগানের পথ ধরে হেঁটে চললেন। মিসেস চ্যাপেল স্বামীর হাতে তুলে দিলেন মিডিয়াম-ড্রাই শেরির গ্লাস এবং তাঁর গালে চুমো খেলেন।
‘আজকে একটু দেরি হলো যে?’
‘তাই নাকি? সরি!’ বললেন গ্রেগ চ্যাপেল।
‘আর তোমাকে খুব টায়ার্ড দেখাচ্ছে।’
‘খুব ব্যস্ত সময় কাটিয়েছি কিনা!’
মিসেস চ্যাপেলের জানা আছে কাজ-কর্মের বিষয়ে স্বামীর উদ্বেগের ভাগীদার হওয়া একজন আদর্শ স্ত্রীর কর্তব্য।
‘আমাকে বলা যায়?’
গ্রেগ চ্যাপেল দু’মুহূর্ত ভেবে বললেন, ‘না, থাক।’ তারপর হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙলেন। ‘সাপারের জন্য কী করেছ?’
***