আশুবাবুর টেলিস্কোপ – ৬

পুবের আকাশের দিকে তাক করে টেলিস্কোপটা স্ট্যান্ডের উপর রাখা। পাশেই একটা প্লাস্টিক চেয়ারে বিরস মুখে বসে আছেন আশুবাবু। ছাদের বাঁ কোনে তাল গাছের মতো ঢ্যাঙা নব, আর ডান কোনে হিলহিলে চেহারার হারু নজর রাখছে। আজ বিকেলেই বাবুরাম এসে আশুবাবুকে চুপিচুপি বলে গেছে, “সর্বনাশ করেছিস! এ কাদের তোর বাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়ে গেল করালী! হারুকে লোকে বলে কাটাহারু। আঙুলের ফাঁকে ব্লেড রেখে। যখন কারও উপর চড়াও হয় তখন ঝড়ের গতিতে ব্লেড চালিয়ে মানুষের মুখ-চোখ-শরীর ফালাফালা করে দেয়। আর নব তো তো মানুষের মুন্ড ধরে মুচড়েই ঘাড় ভেঙে দিতে পারে, অস্ত্রের দরকার হয় না। এইসব ভয়ঙ্কর এলিমেন্ট নিয়ে বাস করবি কী করে?”

“কিন্তু আশুবাবুরই বা কী করার আছে? চুপ করে কম্পিত বুকে অপেক্ষা করা ছাড়া! তাঁর সবচেয়ে বড় ভয়, যদি রামরাহা সত্যিই আসে তা হলে সন্দেহের বশে এরা না তাকে মেরেই ফেলে! এদের হাবভাব মোটেই ভাল নয়। একটু আগেই নব তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “কী মশাই, আপনার পুষ্যিপুত্তুরটি কখন আসবে?”

আর হারু মাঝে-মাঝে শুনিয়ে বলছে, “আজ রামরাহা ভেড়ুয়াটা এলে তার মুখের উপর খাজুরাহোর আর্ট দেগে দেব, জীবনে আর ভুলবে না।”

এখন রাত এগারোটা বাজে। কী হবে কে জানে!

একটু দূরে শান্ত বনভূমি। আজ আকাশে চাঁদ নেই। আকাশে ঝেঁপে রয়েছে অনন্ত নক্ষত্রবীথি। জোনাকিরা উড়ে বেড়াচ্ছে নিশ্চিন্তে, একটু ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। কী শান্ত, কী সমাহিত, কী ধ্যানমগ্ন পরিবেশ। মন ভাল হয়ে যায়।

কিন্তু রামরাহাই জানে, এই পরিপাটি পরিমণ্ডলটি কী বিস্ফোরক উপাদানে ভরা! চতুর এক জাল অতি দক্ষতার সঙ্গে কেউ বিছিয়ে রেখেছে চারদিকে। তার অনুমান, খ্রাচ তার অনেকগুলো চোখ বিভিন্ন রূপমায়ায় ছড়িয়ে রেখে গিয়েছে এই পটভূমিতে। তার অভিজ্ঞ ও অভ্যস্ত চোখে অন্তত পনেরোটি জোনাকি চিহ্নিত হয়েছে, যারা প্রকৃত জোনাকি নয়, ট্রেসার বা সন্ধানী গুড়ুল। আশুবাবুর বাড়ির চিলেকোঠার ছাদে একটি প্যাঁচার অস্তিত্বও টের পেয়েছে সে। প্যাঁচাটি গোটা পটভূমির নির্ভুল গ্রাফ খ্রাচকে জানিয়ে দিচ্ছে। রামরাহার শরীরে অশ্রত একটা ধুনের আবরণ থাকায় খ্রাচের চোখগুলো এখনও রামরাহার অবস্থান বুঝতে পারছে না। এ ছাড়াও আছে বিভিন্ন অবস্থানে কয়েকটা মাকড়সার জাল, প্রয়োজনে চোখের পলকে তাদের সুতোগুলো খুলে হাওয়ায় বিস্তারলাভ করে পথ আটকে দেবে। তাদের আঠা মারাত্মক শক্তিশালী। খুব নিবিড় নিরীক্ষণে মনে-মনে সব টুকে নিল সে। এগুলো খুব দুশ্চিন্তার কারণ নয়। দুশ্চিন্তার বিষয় হল, রামরাহার অবস্থান বা অস্তিত্ব টের পেলেই খ্রাচ তার অস্ত্র প্রয়োগ করবে। খ্রাচ ভালই জানে যে দুটো বন্দুকধারী গুন্ডার সাধ্যই নেই রামরাহার কেশাগ্র স্পর্শ করে। তাই খ্রাচ অন্য পন্থা নেবে। এই যে মদমন্দ বাতাস বইছে, হঠাৎ এই বাতাসের গতিবেগ বাড়তে থাকবে। ঘণ্টায় সত্তর-আশি থেকে একশো, দুশো, পাঁচশো, হাজার বা পাঁচ হাজার মাইল, যাতে পুরো ভূখণ্ডটা একদম ন্যাড়া হয়ে যায়। গাছপালা, ঘরদোর, পাখি, পতঙ্গ, মানষ সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিংবা আকাশ থেকে নেমে আসবে ঘনীভুত বাতাসের অজস্র গোলা, যা ভীমবেগে আছড়ে পড়ে প্রবল ভূমিকম্প আর জলোচ্ছাসে তছনছ করে দেবে সবকিছু। মাটির মধ্যে তলিয়ে যাবে জনপদ। খ্রাচ কী করবে তা অনুমানের বিষয়, কিন্তু অনুমান করতে চায় না রামরাহা৷ সে চায় না তার অবস্থান খ্রাচের গোচরে আসুক।

তার পিছনে সৌরভ নিঃশব্দে এসে দাঁড়াতেই রামরাহা মৃদুস্বরে বলল, “আপনার চারদিকে যে ট্র্যাপটা পাতা রয়েছে সেটা বোধ হয় আপনি টের পাচ্ছেন না!”

“ট্র্যাপ! তাই নাকি?”

রামরাহা একটু বিষাদময় গলায় বলে, “খ্রাচ আমার জন্য অনেক আয়োজন করে রেখেছে।”

“আমি তো কিছুই টের পাচ্ছি না!”

“ওই যে বেগুনি রঙা বড় জোনাকিটা উড়ছে ওটাকে ধরতে পারবেন?”

“ইজি!” বলে সৌরভ পট করে হাতের থাবায় জোনাকিটা ধরে ফেলল।

“কী মনে হচ্ছে? জোনাকি তো! এবার জোনাকিটাকে আঙুল দিয়ে পিষে দেখুন তো, মরে কিনা!”

সৌরভ সেই চেষ্টা করে বলে, “না তো! যেমনকে তেমনই আছে! কী এটা?”

“ওটা সন্ধানী গুড়ুল। কিন্তু ভয় নেই, আপনার কোনও ক্ষতি করবে না। ওকে এমনভাবে মোটিভেট করা আছে যাতে আমার স্পন্দন টের পেলেই ও ক্রিয়াশীল আর মারক হয়ে উঠবে।”

“আপনার ভাইব্রেশন কি এ পায়নি?”

“না, আমাকে ঘিরে আছে নীরব এক ধুন। নইলে এতক্ষণে পনেরোটি জোনাকি আমাকে পনেরোটি ছিদ্রে ঝাঁঝরা করে দিত।”

“বাপ রে!”

“ভয় পাবেন না। আমি তো বলেইছি আপনাকে, খ্রাচ যে-কোনও মূল্যে আমাকে শিকার করতে চায়। আর কাউকে সে বিরক্ত করবে না। আপনাকে যে নীরব ধুনের কথা বললাম, যেটা এখন আমার আবরণ, সেই মন্ত্রটাই আমি চুরি করেছিলাম খ্রাচের কাছ থেকে।”

“আমার মাথা এসব ফিউচারিস্টিক সায়েন্স নিতে পারছে না রামবাবু।”

“তার দরকারও নেই। এত সায়েন্স ছাড়াও লোকে বেঁচে থাকতে পারে। একটু বেশি জেনে ফেলেছিলাম বলেই তো আমাকে আজ পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে! আমার মিষ্টি গ্রহ মিক থেকে অনেক দূরে নির্বাসনে আছি।”

“আপনাদেরও কি আমাদের মতো মাঝে-মাঝে মন খারাপ হয় বা একা লাগে?

রামরাহা বলে, “না, ঠিক সেরকম নয়। পরমাণুর গঠন জানেন তো। একটা নিউক্লিয়াসকে ঘিরে কিছু কণা আবর্তিত হয়, যেমন সৌরলোক, যেমন বিশ্বলোক। তেমনি নিজস্ব আবর্তনে ফেরার একটা টান থাকে। এটা ঠিক বোঝানো যাবে না। আপনি কি জানেন যে, অভিকর্ষের কোনও ব্যাখ্যা নেই অথচ সেটাই গোটা বিশ্বজগৎকে ধরে রেখেছে! এ এক আশ্চর্য টান। কিন্তু আর সময় নেই। ছাদের দিকে দেখুন। দু’জন গুন্ডা চঞ্চল হয়ে উঠেছে। সম্ভবত আমার অবস্থান জানা যাচ্ছে না বলে এবার ওরা বেচারা আশুবাবুর উপর চড়াও হবে। আমি একজন একনিষ্ঠ নক্ষত্রবিদের কোনও ক্ষতি চাই না। ওঁকে রক্ষা করুন।”

সৌরভ নিঃশব্দে উঠে চিতাবাঘের মতো এগিয়ে গেল। আগে থেকেই দেখে রাখা ছিল তার। একটা নির্দিষ্ট রেনপাইপ বেয়ে সে হনুমানের মতোই চোখের পলকে ছাদে উঠে গেল। বিভিন্ন দিক থেকে সংকেত আরও কয়েকজন হাট্টা-গাট্টা লোক উঠে আসছিল উপরে। ছাদের উপরে আশুবাবুর মাথায় একটা পিস্তল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে করালী কুন্ডু, ব্লেড চালাতে উদ্যত হারু আর আশুবাবুকে পিছন থেকে দুই হাতে ধরে রেখেছে নব। চতুর্থ আর-একজনকেও দেখা যাচ্ছিল, একটু তফাতে দাঁড়ানো। তার পরনে প্যান্ট কোট, মাথায় টুপি।

করালী টুপিওয়ালা লোকটার কাছেই হুকুম চাইছিল, “শেষ করে দেব স্যার?”

তারপরই ধুন্ধুমার শুরু হয়ে গেল।

নবর একটা ঘুসি চোয়ালে লাগল বটে কিন্তু সৌরভ জুডো থাম্বলকে নবর কব্জিটা আটকে নিয়ে মাটিতে ফেলে পিঠে চেপে বসল। নব নড়তে-চড়তে পারল না আর।

হারুর ব্লেড অন্তত জনা তিনেকের গাল আর হাত চিরে দিল বটে, কিন্তু সে তো আর সুপারম্যান নয়। করালী পিস্তল চালায়নি, তবে ঘুসি ভালই চালাল, দু’জনকে ভূপতিত করে অবশেষে জগনের ল্যাং খেয়ে পড়ল মাটিতে। সাদা পোশাক পরা পুলিশ তিনজনকেই পেড়ে ফেলার পর সৌরভ অবাক হয়ে দেখে, চতুর্থ লোকটা তখনও নির্বিকার মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সে সোজা গিয়ে লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কেহে?”

লোকটা বিরক্তির সঙ্গে চারদিকে চেয়ে বলল, “আসল লোক কোথায়?”

“কে আসল লোক?”

“রামরাহা!”

সৌরভ বোকার মতো মুখ করে বলে, “কে রামরাহা?”

লোকটা বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে-বলতে সৌরভকে হতবাক করে দিয়ে হঠাৎ ভুস করে বাতাসে ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে গেল।

সৌরভ বুঝতে পারল, আসলে লোক নয়, একটা ত্রিমাত্রিক প্রক্ষেপ এবং সেটা ডেভিডের। কিন্তু বহুরূপী ডেভিডের আসল রূপ কেমন তা কে জানে! হয়তো কোনও রূপই নেই।

-সমাপ্ত-