৪
“আপনি কি নীল তারাটা এখন দেখতে পাচ্ছেন?”
আশুবাবু উত্তেজনায় কাঁপছেন, স্খলিত গলায় বললেন, “পাচ্ছি মশাই, পাচ্ছি! কিন্তু কী করে সম্ভব হচ্ছে বলুন তো! পঞ্চাশ হাজার আলো-বছর দূরের নক্ষত্রকে আজকের চেহারায় দেখা কী করে সম্ভব?”
“আপনারা আলোর গতিকেই সর্বোচ্চ গতি মানেন। আসলে আলোর গতি অত্যন্ত ধীর, তা দিয়ে মহাকাশের তত্ত্বতালাশ সম্ভবই নয়। আমাদের ইউনিট আলাদা, আমরা আলোর গতির উপর নির্ভর করি না।”
আশুবাবু বলেন, “তা হলে কিসের উপর নির্ভর করেন?”
“ইউনিভার্সে সবচেয়ে দ্রুতগতি হল মন। আমরা মনের গতিবেগকে কাজে লাগানোর প্রযুক্তিবিদ্যা জানি।”
আশুবাবু টেলিস্কোপটা থেকে চোখ সরিয়ে রামবাবুর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলেন “আপনারা মানে কারা?”
রামবাবু একটু হাসলেন, উদাস হয়ে বললেন, “এই আমার মতো কিছু লোক, অনেক দূরদেশের মানুষ।”
“আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, আপনার ভিতরে একটা রহস্য আছে মশাই। আপনি সাদা চোখে যা দেখা যাচ্ছে তা নন!”
রামবাবু আনমনে দূরের একটি অদৃশ্যপ্রায় নক্ষত্রের দিকে চেয়ে বলেন, “আপনার কখনও ইচ্ছে করে, ওই যে নীল নক্ষত্রটা দেখলেন, তার এক সুন্দর গ্রহে গিয়ে বাস করতে?”
মাথা নেড়ে আশুবাবু বলেন, “না মশাই, যত সুন্দরই হোক, নিজের
চেনা জগৎ ছেড়ে অচেনা জায়গায় গিয়ে মন টিকবে না।”
কথাটার সমর্থনে মাথা নেড়ে রামবাবু বলেন, “ঠিক তাই। আমারও মন মাঝে-মাঝে বড় অস্থির হয়।”
“কেন মশাই, আপনি তো পৃথিবীতেই আছেন! আপনার। চিন্তা কিসের?”
কিছুক্ষণ জবাব দিলেন না রামবাবু। তারপর খুব আনমনে বলতে লাগলেন, “ওই নীল তারার নাম হল শিয়ারা, মানে নতুন আলো। সূর্যের চেয়ে সাতাত্তর গুণ বড়। ওর গ্রহের সংখ্যা চারশো তেরো। এর মধ্যে ভারী মিষ্টি একটি গ্রহ আছে, তার নাম মিক।”
“এত কী করে জানলেন মশাই? নক্ষত্রটাকে তো সাধারণ টেলিস্কোপে দেখাই যায় না! আপনি কী সব যন্ত্রপাতি লাগালেন, তাই দেখা গেল। মিক গ্রহটাকে কি দেখা সম্ভব?”
“সম্ভব। তবে তার জন্য সুপারস্কোপ লাগবে। তবে তা চোখে সরাসরি দেখা যাবে না, ইমেজ দেখতে হবে। এখন যন্ত্রটা আমার কাছে নেই।”
“আপনি সাংঘাতিক লোক মশাই! এসব আবিষ্কারের জন্য তো আপনি। নোবেল প্রাইজ পেতে পারেন!”
রামবাবু টেলিস্কোপের লেন্স থেকে চোঙের মতো দেখতে ভারী একটা যন্ত্র খুলে নিলেন। একটা ডাফেল ব্যাগে ভরে বললেন, “রাত আড়াইটে বাজে। এবার ঘরে গিয়ে ঘুমোন।”
আশুবাবু গদগদ হয়ে বলেন, “আর ঘুম! যে জিনিস দেখালেন তাতে আমার ঘুম উড়ে গেছে। এখন রাতের পর রাত জেগে থাকতে পারি। কিন্তু আপনি এত রাতে কোথায় যাবেন? আমার বাড়িতে অনেক এক্সট্রা রুম আছে, এখানেই থেকে যান।”
রাম মাথা নেড়ে বলেন, “আমার জীবনটা অত সুখের নয় মশাই। আমাকে অনেক দিক সামলে চলতে হয়।আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যান, আমাকে নিয়ে ভাববেন না।”
“অন্তত সদর দরজাটা তো খুলে দিয়ে আসি।”
রাম বলেন, “আরে না, সদর দরজা দিয়ে আমি আসিওনি যাবও না। আমি ঠিক চলে যাব, আপনি গিয়ে ঘুমোন তো!”
আশুবাবু দোনোমনা হয়ে ছাদের সিঁড়ি ধরে নামতে-নামতে হঠাৎ একটু উঁকি মেরে দেখলেন, তিনতলার ছাদ থেকে রামবাবু রেলিং টপকে লাফ দিয়ে নীচে পড়ে গেলেন। “হায়-হায়!” করতে-করতে আশুবাব ছুটে রেলিংয়ের কাছে গিয়ে দেখেন, লোকটা দিব্যি হনহন করে হেঁটে পিছনের আট ফুট উচু দেয়ালটার কাছ বরাবর গিয়ে আশ্চর্য মসৃণ একটা হাই জাম্প মেরে দেয়ালের ওপাশে গিয়ে পড়ল। তারপর আর দেখা গেল না। একটু হতভম্ব হয়ে পড়লেন আশুবাবু। ভূতপ্রেত তিনি বিশ্বাস করেন না ঠিকই, কিন্তু এসবেরই বা ব্যাখ্যা কী? তিনতলা থেকে লাফ! আট ফুট হাইজাম্প! হাইজাম্পের বিশ্বরেকর্ড যেন কত!
রাতে ভাল করে ঘুমই হল না আশুবাবুর। সকালে যথারীতি জম্পেশ গরমজামা পরে বাজারে বেরিয়েছেন, মোড়ের মাথায় সরু হয়ে একটা লোক সামনে উদয় হল, “আজ্ঞে, ভাল আছেন তো আশুবাবু? সব কুশল তো? রাতে ভাল ঘুম হয়েছে নিশ্চয়ই! হাসি-হাসি মুখ দেখে মনে হচ্ছে কোষ্ঠও পরিষ্কার, কী বলেন?”
লোকটাকে দেখে মোটেই খুশি হলেন না আশুবাবু। তবে মুখে জোর করে হাসি ফুটিয়ে বললেন, “পটলবাবু যে! তা শরীরগতিক ভাল তো!করালীবাবু ভাল আছেন তো! ওদিককার সব কুশল নিশ্চয়ই।”
“যে আজ্ঞে, বড়মানুষরা সব ভালই আছেন, আর তাদের ভাল রাখতে গিয়েই তো আমাদের যত মাথার ঘাম পায়ে ফেলা। কী বলেন?”
“আহা, তা তো বটেই। বড়মানুষরা ভাল না-থাকলে দুনিয়াটা চলবে কী করে বলুন! তাঁরা চালাচ্ছেন বলেই না দুনিয়াটা চলছে!”
“আজ্ঞে, লাখ কথার এক কথা! সেইজন্যই বড়মানুষদের আমি বড্ড পছন্দ করি মশাই! দুনিয়াটা তাঁরা বড়ই ভাল চালাচ্ছেন! আমাদের কোনও দুশ্চিন্তাই করতে হচ্ছে না। কাকে টাইট দিতে হবে আর কাকে তোল্লাই, কাকে সরিয়ে দিয়ে কাকে বহাল করা দরকার, কাকে ভিটেছাড়া করতে হবে আর কাকে খাল্লাস, এসব গুরুতর কাজ আর কে করবে বলুন! শুধু কি তাই! এই যে নানা খাতে লাখো-লাখো টাকার আমদানি হচ্ছে তার হিসেবনিকেশ রাখা, বিলিব্যবস্থা করা, কত দিকে মাথা ঘামাতে হচ্ছে ভেবে দেখুন তো! আমাদের মতো পেটসর্বস্ব মানুষ তো আর নন যে, সময়মতো দানাপানিটুকু পেলেই হয়ে গেল! এইসব মহাপুরুষদের হাওয়াটুকু গায়ে লাগলেও আমাদের উপকার হয়।”
“হ্যাঁ, সে তো বটেই!”
“তা আশুবাবু, আজ যেন আপনার বাড়িতে কি জলখাবার হয়েছে? সেদিন দু’খানা পরোটা কম খেয়েছিলাম বলে মা লক্ষ্মী একটু মুখভার করেছিলেন বটে!”
আশুবাবু দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলেন, “আজ আমাদের মঙ্গলচণ্ডীর উপোস।”
“বলেন কী! বৃহস্পতিবার মঙ্গলচণ্ডী!”
আশুবাবু অম্লানবদনে বলেন, “হয়, দৃকসিদ্ধান্ত পঞ্জিকার মতে বৃহস্পতিবারও মঙ্গলচণ্ডী হয়।”
পটল দাস হেঁ হেঁ করে হেসে বলে, “তা হলে চলুন আপনার সঙ্গে বরং বাজারের দিকেই যাই, ঘানিঘরের সামনে গদাই বৈরাগী ফুলুরি ভাজছে দেখে এলুম।”
“দেখে এসেছেন। বাহ, তা হলে তো ল্যাটা চুকেই গেছে। আমরাও মাঝে-মাঝে গদাই বৈরাগীর ফুলরি ভাজা দেখতে যাই। আহা, দেখেও সুখ! পাকা হাতে কি ফুলরিটাই না ভাজে গদাই! দেখার মতোই ব্যাপার! তা হলে তো কাজের কথা হয়েই গেল, এবার তা হলে আপনি আসুন!”
পটল একটু হাত কচলে বলে, “আজ্ঞে, আপনার কাছে কিন্তু অনেক কিছু শেখার আছে, আশুবাবু!”
“আহা, আপনার কাছেও কি আমার শেখার নেই! ধৈর্য, অধ্যবসায়, হার না-মানা মনোভাব, ছিনে জোঁকের মতো লেগে থাকা, এসব কি শিক্ষণীয় নয়?”
লজ্জায় অধোবদন হয়ে পটল দাস বলে, “কী যে বলেন আশুবাবু, আমি আর এমন কী। তবে কিনা করালী কুন্ডুমশাই বড্ড রেগে আছেন মশাই! কোথা থেকে খবর পেয়েছেন যে, আপনার বাড়িতে রাতবিরেতে উটকো লোক হাজির হয়, আর ওই দূরবিন না কী নিয়ে যেন নাড়াচাড়া করে! এটা তাঁর মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। ডেভিডসাহেব আসার আগে ওই দূরবিনে যেন কেউ হাত না-দেয় তা দেখার জন্য আজ রাত থেকে আপনার বাড়ির ছাদে হারু আর নবকে মোতায়েন রাখা হবে।”
আশুবাবু তটস্থ হয়ে বলেন, “তারা কারা?”
“আজ্ঞে, খুব সুবিধের লোক নয়। নব সাড়ে ছ’ফুটের কাছাকাছি লম্বা, গোরিলাকে লজ্জায় ফেলে দেওয়ার মতোই মজবুত শরীর। আর হারুর বড় কথা যত কম বলা যায় ততই ভাল, চাকু, ব্লেড, ক্ষুর চালাতে পাকা হাত মশাই, তার উপর তাইকোন্ডো আর যুযুৎসু জানে। দু’জনের মধ্যে বড্ড মিল। মশাই, এদের কারও মায়াদয়া বলে কোনও শব্দ জানা নেই। আজ থেকে আপনার আর ছাদে গিয়ে দরকার নেই। সারাদিন মঙ্গলচণ্ডীর উপোসের পর রাতে একটু দুধ-সাগু-কলা খেয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমোলেই হবে। কাজ কী আপনার ওসব হুড়যুদ্ধর মধ্যে গিয়ে?”
আশুবাবুর বুকটা একটু কেঁপে উঠল। রামবাবু বলে গিয়েছেন, বিপদ বুঝলে যেন নতুন পুলিশ অফিসার সৌরভ বোসকে একটা খবর দিয়ে রাখা হয়। তাতে কোনও কাজ হবে কিনা বুঝতে পারছেন না আশুবাবু। তবে তিনি আর কী-ই বা করতে পারেন!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বাজারের দিকে হাঁটতে লাগলেন।
ইমপস্টারটা আর পরদিন এল না। এলে সৌরভ তাকে পাকড়াও করত। কিন্তু লোকটা কে হতে পারে তা কিছুতেই আন্দাজ করতে পারছিল না সে। একজন পাক্কা পুলিশ অফিসারকে ধোঁকা দেওয়ার মতো এত সাহস কার?
উত্তরটার জন্য দিনতিনেক অপেক্ষা করতে হল সৌরভকে। তারপর একদিন যখন একা-একা প্র্যাকটিস সেরে পরিত্যক্ত বাড়ির লনে বসে জিরোচ্ছে সে, তখন হঠাৎ অবাক হয়ে দেখল, লনের শেষপ্রান্তে একটা কেয়াঝোপের আড়ালে খুব দীর্ঘকায় একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে।পরনে ট্র্যাকসুট এবং সবুজ হুড দিয়ে মুখটা ঢাকা।
সৌরভ লাফিয়ে উঠে চেঁচিয়ে বলল, “কে ওখানে?”
লোকটা ধীর পায়ে এগিয়ে এল। তার মুখোমুখি হয়ে মুখের হুডটা তুলে পিছনে কাঁধের উপর ফেলে দিয়ে মৃদুস্বরে বলল, “আমিই সেই ইমপস্টার।”
সৌরভ অবাক হয়ে দেখে, তার সামনে অন্তত ছয় ফুট ছয় ইঞ্চি লম্বা অতি সুপুরুষ এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দার মতো চওড়া কাঁধ, রাজবাড়ির স্তম্ভের মতো মজবুত গর্দান, দু’খানা হাত ইঞ্জিনের পিস্টনের মতো নিরেট। সৌরভ নিজে পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি লম্বা। সে যতদূর লক্ষ করেছে, বাঁকেলাল তার মতোই লম্বা, পাঁচ ফুট দশ বা এগারো। এ লোকটা তারও উপর অন্তত সাত ইঞ্চি। তা ছাড়া এর ফিটনেস অনেক বেশি। কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থেকে সে বলে, “আপনি কে?”
ছেলেটা ভদ্রস্বরে বলে, “আমার নাম রাম। পুরো নাম রামরাহা। মানে নির্মল বাতাস।”
সৌরভ একটু চিন্তায় পড়ে বলে “কিন্ত বাংলা ভাষায় রামরাহা মানে তো নির্মল বাতাস নয়!”
ছেলেটি মাথা নেড়ে বলে, “না, আমি বাঙালি নই।”
“তা হলে কোথাকার?”
“সেটা বললে আপনার বিশ্বাস হবে না। কারওই হয় না।”
“আমি জানতে চাইছি, আসলেই আপনি কে! আপনি বাঁকেলালের বন্ধু নন তো!”
“না, আমি বাঁকেলালের বন্ধু নই।”
“তা হলে?”
“যদি বলি, আমি একজন এলিয়েন?”
সৌরভ ম্লান হেসে বলে, “দেখুন মিস্টার রামরাহা, আমি এখন ঠিক সায়েন্স ফিকশন শোনার মতো মুডে নেই। কিছুদিন যাবৎ আপনি বাঁকেলালকে রিপ্লেস করে আমার সঙ্গে প্র্যাকটিস করছেন! কেন, আপনার উদ্দেশ্য কী?”
“উদ্দেশ্য খারাপ কিছু নয়। আপনার ফিটনেস ঠিক রাখার জন্য। যাতে আপনি দুষ্টু লোকদের মোকাবিলা করতে পারেন।”
“তাতে আপনার লাভ কী? আমি একজন পুলিশ অফিসার, দুস্টু লোকদের মোকাবিলা করাই আমার কাজ। পিকচারে আপনি কী করে আসছেন? মিস্টার এলিয়েন, আপনি আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন।”
রামরাহা একথার জবাব চট করে দিল না। একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ বলল, “ওই যে বাউন্ডারি ওয়ালটা দেখা যাচ্ছে ওর হাইট কত হবে বলে আপনার অনুমান?”
সৌরভ একটু থতমত খেয়ে সামলে নিয়ে বলে, “অনুমানের কিছু নেই যেহেতু রোজ আমাকে ওটা টপকে ভিতরে ঢুকতে হয়, তাই আমি নিজে গজফিতে দিয়ে মেপে দেখেছি, দেওয়ালটা ঠিক নয় ফুট সাত ইঞ্চি খাড়াই। কিন্তু দেয়ালের হাইট জেনে কী হবে বলুন তো!”
“আমি জানতে চাই আপনি দেওয়ালটা লাফিয়ে ডিঙোতে পারেন কি না।”
“আপনি কি উন্মাদ? সাড়ে নয় ফুট হাই জাম্প কোনও মানুষের পক্ষেই দেওয়া সম্ভব নয়।”
ছেলেটি খুব নির্লিপ্ত মুখে বলল, “আমি যে আপনাদের মতো নই সেটা বোঝানোর জন্য, যদি আপনি অনুমতি করেন, তা হলে আমি দেওয়ালটা ডিঙিয়ে আপনাকে দেখাতে চাই!”
সৌরভ একটু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলে, “দেখবেন, হাতে-পায়ে চোট হলে কিন্তু আমাকে দোষ দেবেন না!”
ছেলেটিও হাসল, বলল, “না, দোষ দেব না।”
ছেলেটা নিঃশব্দে দেওয়ালটার কাছে গেল, তারপর একটুও না-ছুটে, শুধু একটু ঝল খেয়ে স্পট জাম্প দিয়ে শুন্যে উঠে প্রায় দশ ফুট দেওয়ালটা এত অনায়াসে ডিঙিয়ে গেল যে, নিজের চোখকে বিশ্বাস হল না সৌরভের। ছেলেটা আবার উলটোপিঠ থেকে লাফ দিয়ে অনায়াসে এপাশে চলে এল।
স্তম্ভিত সৌরভ কিছুক্ষণ বাক্যহারা হয়ে রইল, তারপর মাথা নেড়ে বলল, “অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য! আমি হয় স্বপ্ন দেখছি, না হয় তো এটা কালো জাদু!”
“আমি কাতরভাবে চাইছি, আপনি আমাকে বিশ্বাস করুন।”
সৌরভ ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বলে, “কী বিশ্বাস করব বলুন তো! আপনি রামরাহা! আপনি একজন এলিয়েন! আপনি দশফুট উচু লাফ দিতে পারেন! কে জানে হয়তো ঘণ্টায় দেড়শো মাইল গতিতে দৌড়তে পারেন! হয়তো শুনব আপনি একশো ফুট লম্বা লাফও দিতে পারেন! হয়তো বিশ মন লোহাও তুলতে পারেন! আর কী পারেন আপনি? মিস্টার রামরাহা, আপনি কি নিজেকে সুপারম্যান বলে প্রমাণ করতে চান? কিন্তু আমার আপনাকে একজন ম্যাজিশিয়ান বলেই সন্দেহ হচ্ছে। সবচেয়ে স্ট্রেঞ্জ হচ্ছে একজন এলিয়েন পরিষ্কার বাংলা ভাষায় কথা বলছে!”
রামরাহা ফের একটু বিরতি নিয়ে বলল, “বুঝতে পারছি, ব্যাপারটা হজম কঠিন। কিন্তু আপনি যা-যা বললেন সবই কিন্তু সত্যি। আমি বাস্তবিকই দেড়শো মাইল গতিতে দৌড়তে পারি, বিশ মন লোহা অনায়াসে তুলতে পারি, একশো ফুটের বেশি লম্বা লাফও দিতে পারি। কিন্তু এটা আমার পক্ষে কোনও বাহাদুরির কাজ নয়। আমি যেখানকার মানুষ সেখানে সবাই এসব পারে। সেইদিক দিয়ে দেখলে আমরা আপনাদের তুলনায় সুপারম্যান। কিন্তু এটা আমাদের সাধারণ গুণ। আর আমি যে বাংলা জানি তার কারণ আমি এখানে বাহান্ন বছরেরও বেশি আটকে আছি।”
সৌরভ ফের বিদ্রুপের হাসি হেসে বলে “চমৎকার মিস্টার রামরাহা, আপনি বাহান্ন বছর এখানে রয়েছেন, অথচ আপনার বয়স কিন্তু সাতাশ-আটাশের বেশি নয়! সেটা কোন জাদুবলে সম্ভব বলুন তো!”
রামরাহা ঠান্ডা গলাতেই বলে, “আমাদের বয়সের গতি আপনাদের বয়সের গতির চেয়ে অনেক কম। অন্তত কুড়ি গুণ কম গতিতে আমাদের বয়স হয়।”
বিভ্রান্ত সৌরভ কিছুক্ষণ ঘন-ঘন শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টা করল। বেশ কিছুটা সময় নিয়ে সে নিজেকে সামাল দিল। তারপর একটু খসখসে গলায় বলল, “আপনি আমাকে আজ খুব চমকে দিয়েছেন! আপনার ওই হাই জাম্প আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। তবে যা চোখে দেখেছি তা অস্বীকার করি কী করে! বাই এনি চান্স, আপনি আমাকে হিপনোটাইজ করেননি তো!”
রামরাহা একটা বড় শ্বাস ফেলে বলে, “সম্মোহন একটা মনোক্রীড়া, ওসব আমরা অনায়াসেই পারি। যারা আমাদের সমকক্ষ নয় তাদের উপর। আমরা অযথা ওসব প্রয়োগ করি না। মন আমাদের সব শক্তির উৎস, মনের শক্তি এবং গতিকে কাজে লাগাতে পারি বলেই মহাকাশ বিচরণ আমাদের কাছে কঠিন কাজ নয়। না, আপনাকে সম্মোহিত করার কোনও প্রয়োজন আমার পড়েনি। আমি শুধু আপনাকে বোঝানোর চেষ্টা করছি আমরা ঠিক কেমন এবং কী!”
“কিন্তু আমি এখনও সেটা বুঝতে পারছি না যে! শুধু আপনার সামনে নিজেকে একটা নেংটি ইদুর বলে মনে হচ্ছে।”
“না, ওটা নির্ভুল চিন্তা নয়। ঈশ্বরের সব সৃষ্টিই আলাদা এবং অতুলনীয়। আমি যেমন আমার মতো, আপনিও তেমনি আপনার মতো সৃজনবৈচিত্রকে আমাদের সম্মান জানানো উচিত।”
“আপনি বা আপনারা কি ঈশ্বর বলে কাউকে মানেন?”
“আমরা ঈশ্বরকে জানি এবং মানি।”
“আমি কিন্তু একজন নাস্তিক।”
“তাতে কিছু আসে যায় না। আপনাদের বিজ্ঞানের জড়জগৎকে ছাড়িয়ে উঠতে আরও অনেক সময় লাগবে। আর জড়জগৎকে ছাড়িয়ে মনের বিপুল উৎসে পৌঁছতে না-পারলে ঈশ্বরধারণাই সম্ভব নয়।”
“ঠিক আছে, আমি বিশ্বাস করলাম যে আপনি একজন এলিয়েন। এবার বলুন আমি আপনার জন্য কী করতে পারি!”
“আমি আপনার সাহায্য চাই।”
“ঠাট্টা করছেন? আপনার অতিমানবীয় ক্ষমতা থাকা সত্তেও আমার সাহায্যের কী দরকার?
ঈষৎ স্বচ্ছ নীলাভ এবং গভীর দুটি চোখ দিয়ে সৌরভকে একট মেপে নিয়ে রামরাহা বলল, “আমার আকাশগাড়িটি শত্রুপক্ষের আক্রমণে বাহান্ন বছর আগেই খারাপ হয়ে যায়। আমি কোনওক্রমে বঙ্গোপ সাগরের তলায় পালিয়ে যাই। উপযুক্ত যন্ত্রাংশ না-থাকায় সেই থেকে আমার ঠিকানা একটা সমুদ্রের তলা। শত্রুরা আমার পালানোর পথ ব্যারিকেড করে রেখেছে তাই আমার গ্রহটি থেকেও কোনও সাহায্য আসতে পারে না। ওরা আমাকে হয়তো আর কোনওদিনই বেরোতে দেবে না। মাঝে-মাঝে ওরা আমাকে খুঁজতে আসে, যেমন এখন এসেছে। পঞ্চাশ হাজার আলোবছর দূরে শিয়ারা নক্ষত্রের মণ্ডলে মিক নামে এক মিষ্টি গ্রহে আমার বাড়ি। শিয়ারা নক্ষত্রের চারশো তেরোটা গ্রহ। তার মধ্যে বিয়াল্লিশটা বাসযোগ্য গ্রহে আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকি। আপনার চোখ দেখে মনে হচ্ছে খুব অবাক হচ্ছেন না আর!”
“না, বিস্তর সায়েন্স ফিকশন পড়া থাকায় এখন ততটা অবাক লাগছে না।”
“ভাল, খুব ভাল। আপনার কাছে আমার বিশ্বাসযোগ্যতা খুব জরুরি।”
“কিন্তু একটা কথা, আপনার শত্রুতা কার সঙ্গে এবং কেন?”
রামরাহা একটু চুপ থেকে বলে, “ওরা মহাকাশবাসী। আপনার হয়তো বিশ্বাস হবে না যে মহাকাশের ঠান্ডা এবং শূন্যতায় কেউ থাকতে পারে। কিন্তু ঘটনাটা সত্যি। মনুষ্যবাসের সম্পূর্ণ অযোগ্য কিছু গ্রহে এদের ঘাঁটি আছে বটে, কিন্তু এরা বেশির ভাগ সময়ে মহাকাশেই ঘুরে বেড়ায়। যানবাহনেরও দরকার হয় না। সীমাহীন এদের সহনশীলতা। আমি ওদের কাছ থেকে কিছু মন্ত্র চুরি করেছিলাম।”
“মন্ত্র! মাই গড!”
রামরাহা একটু হাসল, “মন্ত্র আসলে একটা তরঙ্গের নকশা, আপনি ঠিক বুঝবেন না, কারণ এই বিদ্যা আপনাদের অধিগত বিষয়গুলোর মধ্যে পড়ে না। আমি যাদের কথা বলছি তারা ইচ্ছেমতো শরীর পালটে ফেলতে পারে, শরীরকে ইচ্ছেমতো কঠিন, তরল, বায়বীয় বা পারমাণবিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে এবং সেভাবেই বেঁচেও থাকে।”
“এ তো ভূতের গল্প!”
“অনেকটা তাই। তবে ভতেরা কঠিন শরীর ধারণ করতে পারে না, এরা পারে।”
বিস্মিত সৌরভ বলে, “আপনি কি ভুতেও বিশ্বাস করেন নাকি?”
“তা হলে আমার ইনফর্মার কারা? এমনকী, সৌরভ বসু নামে যে একজন যোগ্য পলিশ অফিসার আছেন সে খবরটাও আমাকে দিয়েছিল হরেন সরকার নামে একজন, যার সলিড কোনও শরীর নেই।”
“আমার সব পরনো ধ্যানধারণা কি আপনি পালটে দেবেন নাকি মশাই?”
“না তবে সংশোধন করতে তো দোষ নেই। আর পুলিশ হিসেবে আপনার জেনে রাখা ভাল যে ভূতেরা খুব ভাল ইনফর্মার।”
“রক্ষে করুন মশাই, আর আমার কনফিউশন বাড়াবেন না! আমি এমনিতেই ভীষণ কনফিউজড।”
“জানি আপনার বিভ্রান্তি স্বাভাবিক। তাই আমি আমাদের বিষয়ে আর কিছু বলতে চাই না। শুধু জানাতে চাই যে, আজ রাতে আশুবাবুর টেলিস্কোপটা চুরি হয়ে যাবে। আর তারপর আশুবাবুর উপর প্রাণঘাতী আক্রমণ করবে কিছু লোক। তারা খুব ভয়ঙ্কর লোক। আপনি কি তাঁকে রক্ষা করার দায়িত্ব নেবেন? তিনি নিরীহ একজন স্টারগেজার মাত্র।”
“এ কাজটা তো আপনিও করতে পারতেন। কয়েকজন গুন্ডাকে এলিমিনেট করা তো আপনার কাছে জলভাত!”
মাথা নেড়ে রামরাহা বলে, “না। আমাদের কঠোর অনুশাসন মেনে চলতে হয়। নিজেদের এলাকার বাইরে অন্য কোনও গ্রহের কাউকে আমরা আঘাত করি না, সে যেমন মানুষই হোক। বড়জোর নিরস্ত করার চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু এখন যাদের কথা বলছি তাদের পিছনে আছে খ্রাচ।”
“খ্রাচ! সে আবার কে?”
“গত বাহান্ন বছর ধরে সে অন্তত বাইশবার আমার সন্ধানে এসেছে, এবারও সে হাজির। তার উপস্থিতি আমার সেন্সরে ধরাও দিচ্ছে। এই গ্রহে সে নিজের পরিচয় দেয় ডেভিড নামে। আপনি যাকে বাঁকেলাল বলে জানেন সে ডেভিডের সুপারি কিলার। তবে তার নাম বাঁকেলাল নয়, অন্য কিছু। সম্ভবত করালী কুন্ডু, বড় পাথুরিয়ার ডন। শুধু মনে রাখবেন, ডেভিড বা খ্রাচ যাকে নিরাপত্তা দেয় তার সঙ্গে পাঙ্গা নেওয়া অসীম সাহসের কাজ। আশা করি আমি একজন ভেড়ুয়াকে এই কাজের ভার দিচ্ছি না!”
সৌরভ একটা শ্বাস মোচন করে বলে, “না, তা দিচ্ছেন না। কিন্ত….
“বুঝেছি, আপনি ভাবছেন এই লড়াইয়ে আমি নেই কেন? তা হলে সত্যি কথাটা শুনুন, আমাকে ওই টেলিস্কোপটা নিয়ে সমুদ্রের তলায় পালিয়ে যেতে হবে। ওটা কোনও সাধারণ যন্ত্র নয়, কয়েকটা জিনিস লাগিয়ে নিলেই ওটা সুপারস্কোপ। আমার শেষ ভরসা। আমাকে কাপুরুষ ভাববেন না। আমার সন্ধান পেলে মারার জন্য খ্রাচ এই গ্রহটাকে ধ্বংস করে দিতেও দু’বার ভাববেনা। আর আমাকে মারতে তা হলে পৃথিবীটা ধ্বংস না-করেও উপায় নেই। বুঝলেন? ভয় পাচ্ছেন কি?”
“একটু-একটু। খ্রাচের সমকক্ষ তো নই।”
“আমার সন্ধান না-পেলে খ্রাচ কোনও অ্যাকশন নেবে না, ভয় নেই! আপনি বাঁকেলালকে সামলালেই হবে। খ্রাচ শুধু আমাকে শিকার করতে আসে। আর ওই টেলিস্কোপটা হচ্ছে টোপ, যে টোপটা আমাকে গিলতেই হচ্ছে। খ্রাচ চল্লিশ বছর আগে টোপটা আমার জন্যই ফেলে রেখে গিয়েছিল। সে জানে আমি ঠিক একদিন ওটার সন্ধান পাব। এবং টোপটা গিলব।”
“আপনি তো বিপদের মধ্যেই আছেন মশাই!”
“এ লড়াইটা কয়েকশো বছরও চলতে পারে। ও নিয়ে ভাববেন না। আপনি শুধু বাঁকেলালকে সামলান।”
“ডান!” বলে হাত বাড়িয়ে দিল সৌরভ। তার হাতটা সাগ্রহে ধরে আন্তরিক একটা নাড়া দিল রামরাহা। আশ্চর্য যে, ঝাঁকুনিটা যেন সৌরভের ভিতরটাকে হঠাৎ জাগ্রত করে দিল।