আশুবাবুর টেলিস্কোপ – ৩

খুব ভোরবেলা, যখন বেশ অন্ধকার থাকে তখন ফকিরগঞ্জের নিরিবিলি রাসমেলার মাঠের ধারে শিমুল গাছটার তলায় দু’জন রহস্যময় মানুষের দেখা হয়। দু’জনেই দুটো মোটরবাইকে চেপে আসে। গাছতলায় মোটরবাইক দাঁড় করায়। দু’জনেরই পায়ে রানিং বুট, পরনে ট্র্যাকসুট, মুখমণ্ডল হুড দিয়ে ঢাকা। একজনের হুডের রং লাল, অন্যজনেরটা সবুজ। বিশেষ বাক্যালাপ হয় না তাদের মধ্যে। একটু গা ঘামিয়ে নেওয়ার পর সবুজ হুড পরা মানুষটি বলে, “হুঁ!”

লাল হুড পরা অন্যজনও বলে, “হুঁ!”

তারপরই দু’জনে পাশাপাশি ছুটতে শুরু করে। ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায় যে দু’জনেই বেশ পাকা এবং দক্ষ দৌড়বাজ। প্রথমে একটু ধীরে, তারপর তাদের গতি বাড়তে থাকে, এবং শেষে গতি প্রায় তিরের মতোই হয়ে ওঠে। একবার এ ওকে টপকে যায়, আবার ও একে মেরে বেরিয়ে যায়। কেউ যে কারও চেয়ে কম নয় এটা তারা নিজেরাও ভালই জানে।

ঠিক তিন মাইল তীব্র গতিতে দৌড়ে তারা একটা পরিত্যক্ত বাড়ির পিছনের উচু দেয়াল টপকে ভিতরের লনে নামে। কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে তারা কুংফু, ক্যারাটে আর বক্সিং প্র্যাকটিস করে। দু’জনেই জানে তারা কেউ কারও চেয়ে কম নয়। প্র্যাকটিস শেষ করে দু’জনেই আবার দৌড়ে রাসমেলার মাঠে আসে এবং সকাল সাতটা বাজার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে যে যার মোটরবাইকে চেপে দু’দিকে চলে যায়।

এ থেকে কেউ যদি ভাবে যে, এরা দু’জনে অন্তরঙ্গ বন্ধু, তা হলে মস্ত ভুল হবে। তা তো নয়ই, বরং এরা পরস্পরের চরমতম শত্রু। এদের একজন হল পুলিশের সাব ইনস্পেক্টর সৌরভ বোস, আর অন্যজন এলাকার ত্রাস ডাকাত বাঁকেলাল। বাঁকেলালকে ধরা বা খতম করার দায়িত্ব দিয়েই সৌরভ বোসকে স্পেশ্যাল পোস্টিং দিয়ে ফকিরগঞ্জে পাঠানো হয়েছে।

মুশকিল হল সৌরভ একজন ভাল অ্যাথলিট এবং ফাইটার। কিন্তু এখানে তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো দৌড়বাজ বা কুংফু ক্যারাটে বা বক্সিং জানা লোক নেই। পাল্লা দেওয়ার মতো লোক না-থাকলে একা-একা প্র্যাকটিস করে তেমন লাভ হয় না। তার সমস্যাটা বুঝতে পেরে একদিন হেড কনস্টেবল জগন সিং চুপিচুপি বলল, “স্যার, আপনার সঙ্গে পাঙ্গা নেওয়ার মতো একজনই আছে এখানে। বাঁকেলাল। তার সঙ্গে যদি একটা বন্দোবস্ত করে নিতে পারেন তবে প্রবলেম সলভ হয়ে যায়। কারণ বাঁকেও খুব ভাল অ্যাথলিট, তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো কেউ নেই বলে তারও খুব আফসোস। এই প্রস্তাবে প্রথমে অবাক হল, তারপর রেগেও গেল সৌরভ। কিন্তু পরে ভেবে দেখল, এতে শত্রুপক্ষকে মেপে নেওয়ার একটা সুযোগ আছে। তাই খানিকটা গাঁইগুই করে অবশেষে ব্যবস্থাটা মেনে নিল সৌরভ। বাঁকেলালের দুর্বলতা-সবলতা জেনে রাখলে তার সুবিধেই। মন্দ কী!

তা চুক্তিটা হল জগন সিংয়ের মাধ্যমেই। কারণ জগনের এক দেশওয়ালি ভাই বাঁকেলালের শাগরেদ। ব্যবস্থা এরকম, ভোর চারটে থেকে বেলা সাতটা অবধি কোনও শত্রুতা নেই, শুধু প্র্যাকটিস। কিন্তু ভোর চারটের আগে এবং সকাল সাতটার পর কেউ কাউকে ছেড়ে কথা কইবে না। হয় এ ওর টুটি টিপে ধরবে, নয়তো ও এর মাথার খুলি গুলি করে উড়িয়ে দেবে।

তা সেই ব্যবস্থাই চলে আসছে গত মাসতিনেক ধরে। হুড থাকায় কেউ তাকিয়ে বলেন, “আপনারা মানে কারা?” কারও মুখ দেখতে পায় না, কাজেই গত তিনমাস একসঙ্গে প্র্যাকটিস করেও কেউ কাউকে চেনে না।

এই বন্দোবস্তে সৌরভের নৈতিকতায় একটু বাধোবাধো লাগছিল। কিন্তু রামায়ণ আর মহাভারত গুলে খাওয়া জগন সিং বুঝিয়ে বলল, “রামায়ণ-মহাভারত দেখুন স্যার, দিনের বেলায় কী সাংঘাতিক যুদ্ধ আর শত্রুতা, কিন্তু রাতের বেলা সব ভাই-ভাই। যখন ব্যাটল গ্রাউন্ডে দেখা হবে তখন কি আর আপনি বাঁকেলালকে ছেড়ে দেবেন? আর ফিটনেসের কথাও তো ভাবতে হবে স্যার, ফিটনেস না-থাকলে বাঁকেলালের সঙ্গে টক্কর দেবেন কী করে?”

সৌরভ বিরক্ত হয়ে বলে, “কিন্তু এই ব্যবস্থায় বাঁকেলালের ফিটনেসও যে বেড়ে যাচ্ছে, জগন!”

জগন একগাল হেসে বলে, “লড়াইটা একতরফা হয়ে গেলে কি ভাল হবে স্যার? সেয়ানে-সেয়ানে না-হলে আর মজা কিসের বলুন!”

তা এতদিন সেয়ানে-সেয়ানেই হচ্ছিল। কেউ কারও থেকে পিছনে ছিল না। কিন্তু সেদিন সকালে দৌড় শুরু হওয়ার পর হঠাৎ সৌরভ দেখল, বাঁকেলাল রোজকারের চেয়ে যেন একটু বেশি স্পিড় তুলেছে! অন্তত একফুটের মতো লিড! সৌরভ খুশিই হল। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই না হলে উন্নতি হবে কী করে? সৌরভ একফুটের লিডকে টপকানোর জন্য জান লড়িয়ে দিতে লাগল। নিজেকে নিংড়ে দিয়ে অবশেষে একদম শেষপ্রান্তে সে বাঁকেলালের সমান্তরাল হতে পারল। কিন্তু দম একেবারে শেষ। ছেলেটা হঠাৎ ভাল দৌড়চ্ছে তো!

পরদিন কিন্তু শুরু থেকেই বাঁকেলাল সৌরভকে প্রায় পাঁচ ফুট পিছনে ফেলে দিল, যেটা প্রায় অবিশ্বাস্য! দু’জন সমান মাপের অ্যাথলিটের মধ্যে হঠাৎ এতটা তফাত হওয়ার কথা নয়! শুধু তাই নয়, সৌরভ প্রাণপণে চেষ্টা করা সত্ত্বেও লিড কমাতে পারল না। কিন্তু সে জানে যে, মোটেই খারাপ দৌড়য়নি সে। তা হলে বাঁকেলাল তাকে হারিয়ে দিচ্ছে কী করে?

পরদিন বাঁকের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্যে মনকে প্রস্তুত করেই নামল সে, এবং বাঁকেলালের সঙ্গে পার্থক্য বেশ কমিয়ে ফেলল। কিন্তু হারাতে পারল না। দমসম হয়েও পারল না। তাকে মেনে নিতেই হচ্ছে যে বাঁকেলাল তার চেয়ে অনেক ভাল একজন অ্যাথলিট। কিন্তু সেটা তার কাছে স্বস্তিদায়ক খবর নয় মোটেই।

থানায় জগনের সঙ্গে দেখা হতেই সৌরভ বলল, “না হে, বাঁকেলাল সত্যিই ভাল অ্যাথলিট। আজও আমাকে দেড়ফুটের ফারাকে হারিয়ে দিয়েছে।”

জগন হাঁ হয়ে তাকিয়ে থেকে বলে, “আপনি বাঁকেকে পেলেন কোথায়? সে তো পাঁচদিন আগে মায়ের অসুখের খবর পেয়ে বড় পাথুরিয়ায় গেছে!”

সৌরভ অবাক হয়ে বলে, “তবে আমার সঙ্গে রোজ দৌড়চ্ছে কে?”

কথাটা শুনে সবাই মুখ তাকাতাকি করতে থাকে।

সৌরভ গভীর চিন্তায় পড়ে গেল, বাঁকেলাল কি তার বদলি কাউকে দিয়ে গেছে তাকে না-জানিয়ে? সেটা কি সম্ভব? মনে হয় না। তা হলে তো এটা একটা গভীর ষড়যন্ত্র! ইমপস্টারটা তা হলে কে?