আশুবাবুর টেলিস্কোপ – ২

বঙ্কুবাবুর বীরত্বের বেশ খ্যাতি আছে। অনেকেই জানে বঙ্কুবাবু একজন অসমসাহসী এবং বেপরোয়া লোক, আর তাই নানা মহলে তাঁর বেশ খাতির। কিছু কিছু অনুষ্ঠানে তাঁকে সভাপতি করা হয়ে থাকে, বসে আঁকো বা আবৃত্তি প্রতিযোগিতা বা বিতর্কসভায় তাঁকে বিচারপতিও করা হয়েছে কখনওসখনও। মোটকথা বঙ্কুবাবু ফকিরগঞ্জের একজন নামকরা মানুষ। মুশকিল হল, কেউ-কেউ আবার বঙ্কুবাবুকে জালি লোক বলেও তাচ্ছিল্য করে থাকে। এই দলে বঙ্কুবাবুর স্ত্রীও আছেন।

হয়েছিল কী, বছরপাঁচেক আগে এক রাত্তিরে বঙ্কুবাবুর বাড়িতে চোর এসেছিল। অসমসাহসী বঙ্কুবাবু চোরের আগমন টের পেয়ে দোতলা থেকে নীচে নেমে একতলার বৈঠকখানায় চোরটাকে ঘাপটি মেরে থাকতে দেখে সোজা গিয়ে তাকে জাপটে ধরেন। তারপর হুলস্থুল কাণ্ড। চেয়ার-টেবিল উলটে, ফুলদানি পড়ে গিয়ে, চোর এবং বঙ্কুবাবুর ঝটাপটির শব্দে তুলকালাম। বাড়িসুদ্ধু লোক জেগে নীচে গিয়ে দেখে, বঙ্কুবাবু মুশকো মতো একটা সাংঘাতিক চেহারার লোককে মেঝের উপর পেড়ে ফেলে ঠেসে ধরে আছেন, আর চোরটা হ্যাঁদাচ্ছে। বঙ্কুবাবুর এই বীরত্ব দেখে সবাই অবাক। বাড়িতেই যে একজন এমন বলবান ও সাহসী লোক রয়েছে এটা কেউ এতকাল বুঝতেই পারেনি। পাড়ার লোকও চেঁচামেচি শুনে এসে, কাণ্ড দেখে ধন্য-ধন্য করতে লাগল। চোরটার কোমরে একটা ছোরাও গোঁজা ছিল বটে। তা দেখে সবাই বলাবলি করতে লাগল, এরকম বিপজ্জনক কাজ করা বঙ্কুবাবুর মোটেই উচিত হয়নি। সাহস থাকা ভাল, কিন্তু দুঃসাহস থাকা কোনও কাজের কথা নয়। চোরটাকে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেল। এই ঘটনার পরই বঙ্কুবাবুর বেশ একটু খ্যাতি হয়ে পড়ে। যারা আগে পাত্তা দিত না, তারাও তাঁকে সমীহ করতে শুরু করে। এবং যে সুমতিদেবী এতকাল বঙ্কুবাবুকে মানুষ বলেই মনে করতেন না তিনিও হঠাৎ বেশ আদর-যত্ন শুরু করলেন। তাঁর পাতে মাছের বড় টুকরোটা পড়তে লাগল, দুধ ঘন করে দেওয়া হতে লাগল, সকালে মাঝে-মাঝেই শুকনো রুটির বদলে লুচি পাতে পড়তে লাগল, কথায়-কথায় মুখনাড়া আর শুনতে হচ্ছিল না। সে বড় সুখের সময় এসেছিল বঙ্কুবাবুর।

কিন্তু চিরদিন কি আর সমান যায়! এই ঘটনার বছরখানেকের মাথায় বাড়ির টিউবওয়েল সারাতে এক মিস্ত্রি এল। সঙ্গে কয়েকজন হেল্পার। তাদের মধ্যে একজনকে দেখে সুমতিদেবীর কেমন যেন চেনা-চেনা ঠেকায়। তাকে ঘরে ডাকিয়ে এনে জিজ্ঞেস করলেন, “অ্যাই, তোমার নাম পবন। কাহার না?”

লোকটা ভারী লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, “আজ্ঞে।”

সুমতিদেবী তখন আরও চেপে ধরলেন, “তুমিই সেই চোরটা না?”

লোকটা কাঁচিকলে পড়ে শেষে স্বীকার করতে বাধ্য হল যে, বঙ্কুবাবুর সঙ্গে হাজার টাকার করে সে চোর সাজতে রাজি হয়ে গিয়েছিল। সে সত্যিকারের চোরটোর নয়। বঙ্কুবাবু যেমন শিখিয়ে দিয়েছিলেন তেমনি করেছে মাত্র। “তার কোই কসুর নেহি।”

এর পর বঙ্কুবাবুর যা অবস্থা হল তা কহতব্য নয়। কোথায় গেল আদর যত্ন আর কোথায় গেল সেই খাতির! উঠতে-বসতে বঙ্কুবাবুকে ঝেড়ে কাপড় পরাতে লাগলেন সুমতিদেবী। বঙ্কুবাবু দু’-একবার আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করেছিলেন বটে, তবে তা সুমতিদেবীর মুখের সামনে খড়কুটোর মতো উড়ে গিয়েছে।

তবে ভাগ্য ভাল যে সেসব গুহ্যকথা পাঁচজনে জানে না। লোকে তাকে এখনও একজন তেজি মানুষ বলেই মনে করে।

আপাতত বঙ্কুবাবু সকালবেলায় তাঁর দোতলার ঘর থেকে পুবের জানালা দিয়ে মুখোমুখি আম গাছে একটা হনুমানের দিকে চেয়ে সেটাকে ক্ষমা করে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ফকিরগঞ্জের হনুমানদের মোটেই পছন্দ করেন না বঙ্কুবাবু। গাছের পেয়ারা, আম, জাম, কলা এমনকী, হত্তুকি অবধি আজ পর্যন্ত দাঁতে কেটে দেখতে পারেননি তিনি, এই হনুমানদের উৎপাতে। তা গাছের ফল খাবি তো খা, কিন্তু অসভ্যতার একটা সীমা থাকবে তো! রোজ এই সকালের দিকে এসে বঙ্কুবাবুকে তারা নিয়মিত মুখ ভ্যাঙচায়। তিনি অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করেছেন, বাড়ির আর কাউকে কিন্তু হনুমানেরা অপমান করার চেষ্টা করে না। তাঁর স্ত্রী সুমতিদেবীর সঙ্গে তো ওদের রীতিমতো ভাবসাব। শুধু বঙ্কুবাবুর উপরেই ওদের যত খার। এমনকী, বাড়ির বাইরে বেরোলে তাড়াও করে। অপরাধের মধ্যে বঙ্কুবাবু একসময় ওদের লাঠি নিয়ে খেদানোর চেষ্টা করতেন, কয়েকবার বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজও করেছিলেন, ফাঁদ পেতে ধরার জন্য লোকও ভাড়া করে এনেছিলেন। কোনও কাজই হয়নি। উলটে হনুমানগুলো দিন-দিন আরও বাঁদর হয়ে উঠছে! তাই আজকাল তিনি ক্ষমাধর্মের পন্থা অবলম্বন করেছেন। কিন্তু কখনও-কখনও যে ক্ষমা করা অতিশয় কঠিন হয়ে দাঁড়ায় সেটাও তিনি হাড়ে-হাড়ে টের পান। আর শুধু হনুমানই কেন, রোজ যে পদে প্রচলন মানুষকে ক্ষমা করতে হয় তার হিসেব কে রাখে!

আজও ধাড়ি হনুমানটা তাঁকে দাঁত খিচোচ্ছে, বক দেখাচ্ছে, খ্যাখ্যা করে নিজস্ব ভাষায় বকাঝকা করছে। একসময় বঙ্কুবাবুও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র ছিলেন না। তিনিও ইংরেজিতে ইডিয়ট, রাসকেল, ভ্যাগাবন্ড স্টুপিড এবং বাংলায় জাম্বুবান, ঘটোৎকচ, বদমাশ, বাঁদর ইত্যাদি গালাগাল দিতেন। উলটে মুখ ভ্যাংচাতে এবং বক দেখাতেও ছাড়তেন না। তবে আজকাল তিনি হনুমানদের করুণা করারই চেষ্টা করেন, যেমন এখন করছেন। তাঁর কাজের লোক দশরথ এসে বলল, “আপনার কাছে লোক এসেছে।”

লোক এলে খুশিই হন বঙ্কুবাবু। লোক আসা মানে, লোকে তাঁকে খোজে, লোকে তাঁকে মনে রাখে, লোকে তাঁকে গুরুত্ব দেয়, এবং এভাবেই সমাজে একজন মানুষ মান্যগণ্য বা কেষ্টবিস্টু হয়ে ওঠে। এই হয়ে ওঠার জন্য তিনি চেষ্টা করছেন বহুদিন। তারই ফল এখন একটু আধটু ফলছে। প্রসন্ন মুখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কে আবার এল রে এই সাতসকালে!”

দশরথ গম্ভীর গলায় বলে, “চেনা লোক নয়। ভাবগতিকও সুবিধের ঠেকল না। বুঝেসুঝে কথা কইবেন।”

আঁতকে উঠে বঙ্কুবাবু বলেন, “বলিস কী! ষণ্ডাগুন্ডা নাকি?”

“হতেও পারে। যা দিনকাল পড়েছে, কিছু বলা যায় না। অমন পাথুরে চোখের লোক কি আর ভাল লোক হয়! খুনে-বদমাশ হলেও আশ্চর্যির নেই!”

বঙ্কুবাবু ফাঁপরে পড়ে বললেন, “এ তো বড় জ্বালা হল! না বুঝেসুঝে কাকে ঘরে এনে বসালি বাপ!”

“ঘাবড়ে গেলেন নাকি? তা আপনি না বাহাদুর লোক! চিমসে চেহারার একটা লোক এল বলে আঁত শুকিয়ে গেল!”

বঙ্কুবাবু এবার গা ঝাড়া দিয়ে সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, “চিমসেচেহারা? তা সেটা আগে বলবি তো!”

“চিমসে চেহারার লোক কি আর খারাপ লোক হতে পারে না নাকি?”

বঙ্কুবাবুর সন্দেহ, দশরথ আসলে সুমতিদেবীর দলে, মাঝে-মাঝেই উলটোপালটা বলে বঙ্কুবাবুকে ভড়কে দেওয়ার চেষ্টা করে মজা পায়।

নীচের বৈঠকখানায় সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা যে লোকটা একটা সোফার কোণ ঘেঁষে বসে ছিল, তার চেহারাটা রোগার দিকেই, আর তেমন ভয়ঙ্করও নয়। বঙ্কুবাবু নিশ্চিন্ত হয়ে মুখোমুখি সোফায় বসে হাসি-হাসি মুখেই বললেন, “কোথা থেকে আসছেন?”

লোকটা এ প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে গম্ভীর মুখে বলে, “আপনি কি বঙ্কুবাবু?”

বঙ্কুবাবু আজকাল সকলের সঙ্গেই বিনীতভাবে কথা বলে থাকেন। বিনয়টা বজায় রেখেই বললেন, “আজ্ঞে হ্যাঁ, আমিই বঙ্কু আঢ্য।”

লোকটা তাঁকে আপাদমস্তক দেখে তেমন যেন খুশি হল না। আঁশটে মুখ করে বলল, “আপনার হাইট কত?”

“হাইট! আমার হাইট! কেন বলুন তো?”

লোকটা বেশ দাপুটে গলায় বলে, “দরকার আছে বলেই জানতে চাইছি।কত?”

বঙ্কুবাবু থতমত খেয়ে বলেন, “অনেকদিন মাপজোখ করা হয়নি, তবে বোধ হয় পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি।”

“আর ছাতির মাপ?”

লোকটা তাঁর জন্য পাঞ্জাবির অর্ডার দিতে চায় কিনা তা বুঝতে পারছিলেন না বঙ্কুবাবু। আমতা-আমতা করে বললেন, “তা আটত্রিশ ইঞ্চি হবে বোধ হয়।”

লোকটা অত্যন্ত ক্রুর চোখে তাঁকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে তেতো গলায় বলে, “কিন্তু ভুঁড়ির মাপ তো মনে হচ্ছে পঞ্চাশ ইঞ্চির কম নয়! আপনার কি আর একটু হাট্টাগাট্টা হাড়েমাসে চেহারা হওয়া উচিত ছিল না! এই চেহারা নিয়ে আপনি ওসব কাজ করেন কী করে?”

বঙ্কুবাবু কিছুই বুঝতে না-পেরে বললেন, “কী কাজের কথা বলছেন? একটু খোলসা করে বললে ভাল হয় না!”

লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “ঠিক আছে, চেহারা নিয়ে মাথা না-ঘামিয়ে বরং কাজের কথায় আসি। আপনার রেট কত?”

বঙ্কুবাবু ফের অগাধ জলে পড়লেন। তবে তিনি এটা বুঝলেন যে, এখানে একটু টাকা পয়সার গন্ধ আছে। সুতরাং একট বিজ্ঞ হাসি হেসে, বুদ্ধি খাটিয়ে বললেন, “রেট! রেট কি আর একরকম থাকে? নানা রকম রেট আছে। কাজ বুঝে রেট।”

এ লোকটা এবার একটু বিরক্তির গলায় বলে, “তা হলে সংক্ষেপে বলি, এই গাঁয়ে আমার পৈতৃক বাড়িটা একজন দখল করে বসে আছে। আমি বহুকাল প্রবাসী, তাই কিছু করা যায়নি। এখন বাড়িটা উদ্ধার করতে হবে। মামলা-মোকদ্দমায় সময় নষ্ট করতে চাই না। আমি চাই আপনি লোকটাকে তুলে দিন। তার জন্য কত টাকা দিতে হবে বলুন!”

বঙ্কুবাবু ভাল করেই জানেন যে, তিনি নিজে থেকে হাঁ করেননি, কিন্তু তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধেই থুতনিটা পট করে ঝুলে পড়ল এবং তিনি বেবাক হাঁ হয়ে লোকটার দিকে চেয়ে রইলেন। থুতনিটা যে আবার কোনওদিন জায়গামতো ফেরত যাবে এটা তাঁর মনে হচ্ছিল না। থুতনিটাকে হাত দিয়ে ঠেলে জায়গামতো তোলা যায় বটে, কিন্তু লোকটার সামনেই কাজটা করা ঠিক হবে কি? আর তুললেও থুতনিটা যে আবার পড়ে যাবে না তার গ্যারান্টি কী?

লোকটা অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে, “শুনলাম আপনিই নাকি এখানকার মস্তান, এসব কাজ নাকি আপনিই করে থাকেন। আপনাকে দেখে অবশ্য ঠিক বিশ্বাস হয় না। তবে কাজটা হলেই হল। আমি বরং আপনাকে এই হাজার পাঁচেক টাকা অ্যাডভান্স দিয়ে যাচ্ছি। আপনি বোধ হয় রসিদ টশিদ দেন না! তাই না? দেবেনই বা কী করে, এসব কাজের কি আর রেকর্ড রাখতে হয়?”

অবাধ্য থুতনিটা কিছুতেই উপরে উঠতে চাইছে না বলে ভারী মুশকিলেই পড়ে গেলেন বঙ্কুবাবু। অথচ লোকটা এখন তাঁর দিকেই চেয়ে আছে, লজ্জারই ব্যাপার!

লোকটা একটু অবাক হয়ে হঠাৎ বলে বসল, “আচ্ছা, আপনি কি হাঁ করে আছেন? কিছু বলবেন?”

বঙ্কুবাবু অভিনয়ও যে বেশ ভালই পারেন সেটা এতকাল জানাই ছিল না তাঁর। পট করে নিজের থুতনিতে একটা ঘুসি মেরে সেটাকে জায়গামতো ফেরত পাঠিয়ে তিনি হেসে বললেন, “আরে না,  একটা হাই তুলেছিলাম।”

“তাই বলুন! তা হলে এই যে টাকাটা রাখুন, আজ তা হলে আমি আসি। আর হ্যাঁ, ভাল কথা, আমার নাম সুধীর গিরি, রথতলা মোড়ের কাছে পরেশ গিরির বাড়ির ছেলে। ওই বাড়িটাই দখল করে আছে রতন চোঙদার। খুব ঠ্যাঁটা লোক মশাই! একটু তাড়াতাড়ি বাড়িটা খালাস করে দিন তো! যত টাকা লাগে!”

রতন চোঙদারের নাম শুনে বঙ্কুবাবুর থুতনি আবার নিম্নগামী হতে যাচ্ছিল আর শিথিল হাত থেকে টাকাগুলো পড়েই যাচ্ছিল প্রায়, কোনওরকমে ধরে ফেললেন। থুতনিটাকেও শাসন করলেন। একবার তাঁর মনে হল, অপারগতা জানিয়ে টাকাগুলো হাতে-পায়ে ধরে সুধীর গিরিকে ফেরত দিয়ে দেন। কিন্তু মস্তান হিসেবে এই যে তাঁর নতুন খ্যাতি, এটাকে এত সহজে তো মাঠে মারা যেতে দেওয়া যায় না!

সুধীর গিরি বিদায় নেওয়ার পর বঙ্কু আঢ্য ভাবতে বসলেন। হাতের মুঠোয় কড়কড়ে পাঁচ হাজার টাকার গুন্ডামানি। মস্তান হিসেবে তাঁর প্রথম রোজগার। ভাবতেই বুক ফুলে ওঠে বটে, কিন্তু রতন চোঙদারের কথা মনে পড়লেই বুকটা যেন ‘বাপ রে’ বলে ককিয়ে উঠে পাখা ঝাপটায়।

দোতলায় উঠে তিনি দশরথকে গজফিতেটা আনতে বললেন। তারপর বললেন, “আমার ছাতি আর পেটের মাপটা নে তো।”

দশরথ হাঁ হয়ে বলে, “কেন গো দাদাবাবু, মাপজোখ কেন? আপনার মূর্তিটুর্তি হবে নাকি?”

“ইয়ার্কি মারিস না। যা বলছি তাই কর।”

মাপ নিয়ে দশরথ বলে, “ছাতি সাঁইত্রিশ, আর পেট একান্ন ইঞ্চি।”

“দূর! পেটটা আরও চেপে মাপটা ভাল করে নে।”

দশরথ যথাসাধ্য চেষ্টা করে বলে, “পেট তো সাড়ে পঞ্চাশের নীচে নামতে চাইছে না! আর অনেক ঢিলে করে মেপেও বুক ওই সাড়ে সাঁইত্রিশ।”

গম্ভীর হয়ে বঙ্কুবাবু বললেন, “হুঁ।”

দশরথ যে সুমতিদেবীর লোক তাতে তাঁর সন্দেহ নেই। তিনি লক্ষ করেছেন, তাঁকে হ্যাটা করার কোনও সুযোগ পেলে দশরথ ছাড়ে না। তাঁর নিজের ধারণা, তাঁর পেটের মাপটা দশরথ অনেকটা বাড়িয়ে বলেছে, আর তাঁর ছাতির মাপটা একটু ফুলিয়ে নিলে একচল্লিশ হওয়ার কথা।

‘হেক্কোর’ কথাটার মানে আসলে কী তা বঙ্কবাব জানেন না বটে, তবে হেক্কোরের মানে যে ভাল কিছু নয় এটা ভালই জানেন। চোয়াড়ে চেহারার পাকানো শক্তপোক্ত বডির রতন চোঙদারকে লোকে আদর করে হেক্কোর বলে উল্লেখ করে থাকে। তিনি যতদুর জানেন চোঙদারকে কেউ ঘাঁটায় না। বদরাগী বলে বদনাম আছে চোঙদারের। চোখদুটোয় একটা রক্ত জল করা চাউনি আছে, বেশি কথার মানুষও নয়, হাস্যহীন কঠিন মুখ। বঙ্কুবাবুর কপালটাই খারাপ, জীবনে প্রথম যে কেসটা পেলেন সেটাই বেশ কঠিন।

ফকিরগঞ্জের বিজ্ঞ মানুষ বাবুরাম বঙ্কুবাবুর বন্ধুমানুষ। খুব মন দিয়ে সব শুনে বলল, “বাপুরে, ছাতি বাড়াতে চাস, ভাল কথা। কিন্তু তার জন্য যে বিস্তর মেহনত করতে হবে! ডনবৈঠক, ওজন তোলা, কুর্মাসন, ধনুরাসন, প্রাণায়াম করে ধর ছাতি না হয় ফোলালি, কিন্তু তারপর পেটের চর্বি নামাতে যে আরও ডবল মেহনত! হবে না যে তা নয়, তবে হতে-হতে যে বুড়ো হয়ে যাবি বাপ! তার উপর হাইটটার কথাও তো ভাবতে হবে! রতন চোঙদার নাহোক হাতচারেক লম্বা। তুই তার কাঁধ অবধিও নোস। টেনেহিচড়ে তোকে আরও খানিকটা লম্বা করতে গেলেও তো বিস্তর সময় লাগবে। ততদিনে যে তুই আরও বুড়ো হয়ে যাবি বাপু! সুধীর গিরি কি ততদিন হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে? আগামের টাকা ফেরত চাইতে যদি এসে চড়াও হয়, তখন?”

চিন্তিত বঙ্কুবাবু বললেন, “তাই তো! তা হলে কী করা যায়। বল তো!”

বাবুরাম বিজ্ঞোচিত হেসে বলে, “আহা, তার জন্য চিন্তা কিসের? এসব কাজের জন্য আজকাল খামোখা কেউ নিজে দাঙ্গাহাঙ্গামা করতে যায় নাকি? সুস্থ শরীরকে কি ব্যস্ত করতে আছে রে? এ লাইনের লোকই আলাদা, একেবারে বাঁধা রেটে কাজ নামিয়ে দেবে। লাখখানেক টাকা ফেললেই কাজ উদ্ধার। বাড়ি খালাস করার রেট এখন বেশ চড়া। সুধীর গিরিকে তুই দুই লাখ দর হেঁকে গোঁফে তা দিয়ে আয়েশ করগে যা।”

উদ্বিগ্ন বঙ্কুবাবু বলেন, “তা সেই লাইনের লোক কোথায় পাওয়া যাবে বল তো!”

“তার জন্য চিন্তা কিসের? আমার হাতে ফার্স্টক্লাস, ফাইভ স্টার গুন্ডা আছে। বড় পাথুরিয়ার করালী কুন্ডু। জাহাজ বাঁধার দড়ি অবধি দু’হাতে টেনে ছিড়ে ফেলতে পারে। ছ’ফুট দু’ইঞ্চি লম্বা, ছাতি এত চওড়া যে ফুটবল খেলা যায়, আর গর্দানখানা যেন হাতির পা। কটমট করে যার দিকে তাকায়। সে-ইশীতল হয়ে যায়।”

বঙ্কুবাবু ভারী আহ্লাদিত হয়ে বলেন, “বলিস কী? এ তো সোনার টুকরো ছেলে রে!”

“ওরে, এসব সোনার টুকরো ছেলে আছে বলেই দেশটা এখনও রসাতলে যায়নি, বুঝলি! এই এরা আছে বলেই এখনও মানুষ সুবিচার পাচ্ছে, অন্যায়ের প্রতিবিধান হচ্ছে, দুর্বলের উপর অত্যাচার হতে পারছে না। বুঝলি! ফ্যালো কড়ি মাখো তেল। শঠে শাঠ্যং যাকে বলে!”

“নাহ, দেশে এখনও তা হলে প্রতিভাবান জন্মায়! খুঁজে দেখলে এখনও মানুষের মতো মানুষ এ দেশেই পাওয়া যায়, কী বলিস!”

“তবে আর বলছি কী?”

বাবুরামের উপর অগাধ বিশ্বাস বঙ্কুবাবুর। পবন কাহারকে চোর সাজানোর বুদ্ধি বাবুরামই দিয়েছিল তাঁকে, আর খুঁজেপেতে কলের মিস্ত্রি পবন কাহারকে জুটিয়েও এনেছিল সে। বুরবক পবনটা সুমতিদেবীর কাছে ধরা খেয়ে কাজটা বিলা করে না-দিলে বঙ্কুবাবু আজও বাড়িতে জামাইআদর ভোগ করতেন। এসব ভাবতে গেলেই তিনি আর দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখতে পারেন না।

সুধীর গিরির যে বাড়িখানা রতন চোঙদার দখল করে আছে সেখানা বেশ পেল্লায় দোতলা বাড়ি। চারদিকে অন্তত দেড়-দু’বিঘে ঘেরাও জমিতে ফলাও বাগান। সবুজে সবুজ। আনাজপাতি, ফুল, ফল আর শাকপাতায় ঢেউ খেলছে। চোখ জুড়িয়ে যায়। বাড়িখানাও দেখনসই। বাইরে থেকে আন্দাজে মনে হয়, একতলা-দোতলা মিলিয়ে অন্তত দশ-বারোখানা ঘর তো আছেই! দু’-চারখানা বেশিও হতে পারে। এ বাড়ির দাম এ বাজারে হেসেখেলে আশি-নব্বই লাখ তো হবেই! একটা বাবলা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে বঙ্কুবাবু একটা নোটবইয়ে বাড়িটার খুঁটিনাটি নোট করে নিচ্ছিলেন। সুধীর গিরির সঙ্গে দরাদরি করতে গেলে বাড়িটার ভ্যালুয়েশন নিয়ে কথা উঠতে পারে, আর তাই এই সতর্কতা।

এখন এই বিকেলের দিকে রতন চোঙদার একটা লম্বা রবারের পাইপ দিয়ে তার বাগানে জল দিচ্ছিল। বঙ্কুবাবু রতন চোঙদারেরও মাপজোখ নিতে লাগলেন। না, লোকটা সত্যিই বেশ লম্বা, আর চেহারাটাও হাড়েমাসে। মুখটা যেন পাথর কুঁদে গড়া, কোনও রসকষের বালাই নেই। এরকম চোঁয়ার লোক ফকিরগঞ্জে কমই আছে। দূর থেকে মেপেজুপে মনে হয় কাঁধদুটো বেশ চওড়াই, আর হাতের হাড়ও বেশ মজবুত। তবে করালী কুন্ডুর যে বিবরণ বঙ্কুবাবু শুনেছেন তাতে রতন চোঙদারের কোনও আশাই নেই। করালী যদি কাজটা উদ্ধার করে দিতে পারে তা হলে গুণ্ডা বা মস্তান হিসেবে বঙ্কুবাবুর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগবেনা। সেই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবেই মনে ভারী আহ্লাদ হচ্ছিল বঙ্কু আঢ্যর। নামডাকটা একবার হয়ে গেলে সুমতিদেবীর মনোভাব পালটাতেও দেরি হবে না। আবার হয়তো সকালের জলখাবারে লুচি, দুপুরে মাছের মুড়ো, রাতে ঘন দুধের বাটি। ওহ, সে কী সুখের দিনই গেছে! তবে সেই সুখের দিন এবার। আবারও ফিরে আসি-আসি করতে লেগেছে কিন্তু!

হঠাৎ তাঁর কানের কাছে মুখ এনে কে যেন ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি কোনও ক্যালকুলেশন করছেন?”

বঙ্কুবাবু এমন আঁতকে উঠলেন যে, হাত থেকে নোটবই খসে পড়ে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন, একজন লম্বা-চওড়া ছোকরা তাঁর দিকে অবাক চোখে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্পাইয়িং করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছেন মনে করে ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়ে তিনি বললেন, “না না, ক্যালকুলেশন নয় তো! আমি তো কবিতা লিখছিলাম।”

ছোকরাটা বেশ অবাক হয়ে বলে, “আপনি কবিতা লেখেন নাকি?”

দেঁতোহাসি হেসে বঙ্কুবাবু বললেন, “হ্যাঁ, ওই মাঝে-মাঝে একটুআধটু এসে যায় আর কী!”

ছোকরাটা চিন্তিত মুখে তার দিকে চেয়ে বলে, “কিন্তু আমার মনে হল, আপনি মন দিয়ে কোনও একটা কঠিন ক্যালকুলেশন করছেন!”

আতঙ্কিত বঙ্কুবাবু আর্তস্বরে বলে উঠলেন, “না-না, মাইরি না! ক্যালকুলেশন খুব খারাপ জিনিস, ওসব আমি কস্মিনকালেও করি না! বিশ্বাস করুন!”

ছোকরা আরও অবাক হয়ে বলে, “ক্যালকুলেশন খারাপ হবে কেন?ক্যালকুলেশনের উপরেই তো জগৎসংসার চলছে! গ্রহ-নক্ষত্র চাঁদ সূর্য অ্যাস্টেরয়েড, গোটা ইউনিভার্স ক্যালকুলেশন মেনেই তো চলে। এমনকী, কবিতা লিখতেও ক্যালকুলেশনের দরকার হয় কিন্তু ছন্দ, মাত্রা, পঙক্তি, কোনওটাই ক্যালকুলেশন ছাড়া সম্ভব নয়, তাই না!”

বঙ্কুবাবু থতমত খেয়ে হেঁ হেঁ করে বললেন, “তা বটে, তা বটে! আপনি বিজ্ঞ মানুষ।”

ছোকরা গম্ভীর মুখে বলে, “আমি বিজ্ঞ মানুষ বুঝি? আপনি কি আমাকে চেনেন?”

ফাঁপরে পড়ে বঙ্কুবাবু আমতা-আমতা করে বলেন, “একটু চেনা-চেনা লাগছে বটে, তবে ঠিক স্মরণ হচ্ছে না! একটু ধরতাই দিলে হয়।”

ছোকরা মাথা নেড়ে বলে, “আমি চেনা লোক নই। অনেক দূরের বাসিন্দা।”

বঙ্কুবাবু ছোকরাটার মতলব বুঝতে না-পেরে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিলেন! দিনকাল ভাল নয়। অজ্ঞাতকুলশীল ষণ্ডামার্কা এই দানবটিকে চটানো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। সাতপাঁচ ভেবে তিনি ভারী বিনয়ের হাসি হেসে বলেন, “তাই বলুন, এ গাঁয়ে নতুন এসেছেন! তা জায়গাটা আপনার ভাল লাগছে তো! কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো! কোনও অসুবিধে হলে বলবেন কিন্তু!”

ছোকরাটা বলে, “না, কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। বরং অনেক বন্ধু জুটে গেছে।”

বন্ধুর কথায় ফের দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়ে বঙ্কুবাবু বললেন, “তা বেশ তো, বন্ধু থাকা তো ভালই। তা কারা আপনার বন্ধু বলুন তো! তার মধ্যে কি রতন চোঙাদার আছে?”

ছোকরাটা মাথা নেড়ে বলে, “না তো! আমার বন্ধুরা হল শিবেশ নাগ, গোবিন্দ সাউ, সরেশ লস্কর, হরেন সরকার, নগেন হাজরা, পাচুগোপাল বৈদ্য, ধীরেন কপালি আরও অনেকে।”

বাক্যহারা হয়ে ছোকরার মুখের দিকে চেয়েছিলেন বন্ধু আঢ্য। এবার কাঁদো-কাঁদো হয়ে বললেন, “বলেন কী মশাই! এরা আপনার বন্ধু! কিন্তু তা কী করে হয়, এরা যে কেউ বেঁচে নেই! বহুকাল আগেই গত হয়েছেন। হরেন সরকার আমার সম্পর্কে দাদামশাই হতেন যে! কাঁধে করে আমি নিজেই যে তাঁকে দাহ করে এসেছি!”

কথাটা শুনেও ছোকরার কোনও হেলদোল হল না। নির্বিকার মুখে বলল, “বেঁচে থাকবেন না কেন? শরীরটা নেই বটে, কিন্তু তাতে বেঁচে থাকা আটকায় না। আপনি যখন কাউকে কল্পনা করেন তখন তো তাকে মনে-মনে দেখতেও পান, যাকে দেখতে পান তার কি শরীর আছে? হয়তো সে বেঁচেও নেই, তবু জ্যান্ত বলে মনে হয় না? স্বপ্নে যখন কোনও বিগত মানুষকে জ্যান্ত দেখতে পান তখন সে যে মারা গেছে এই লজিক কি কাজ করে? বেঁচে থাকা যে কত রকমের আছে তা কি আপনি জানেন?”

ভোম্বলের মতো মুখ করে বঙ্কুবাবু কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথা নেড়ে বললেন, “আজ্ঞে না।”

ছোকরা একটু মুচকি হেসে বলে, “আপনি কি একটু ঘাবড়ে গেলেন?”

বঙ্কুবাবু কাহিল গলায় বলেন, “ভূতের কথা কইছেন নাকি?”

“আপনি কি ভূতকে ভয় পান?”

“কে না পায় বলুন!”

“ভূত তো কাজের জিনিস, ইনফরমেটিভ। তাদের কাছ থেকে যে অনেক খবর পাওয়া যায়, যা এমনিতে পাওয়া সম্ভব নয়।”

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বঙ্কুবাবু বললেন, “আপনার দুর্জয় সাহস!”

সাহসের দরকার হয় না, লজিক্যাল হলেই হয়। ভূত একটা অ্যাটমস্ফেরিক ইমপ্রেশন উইথ লেটেন্ট মেমোরি। একটা এনটিটি। একধরনের ইমপ্রেশনিস্টিক এগজিস্টেন্স।”

বঙ্কুবাবুর হাঁ আর বন্ধ হতে চাইছিল না।