১
আশ্বিন মাস। ফকিরগঞ্জে এখনও তেমন শীত পড়েনি। মাঝে-মাঝে সকাল। আর সন্ধের দিকটায় একটু শিরশিরে উত্তুরে হাওয়া বইতে শুরু করেছে সবে। কিন্তু আশুবাবু বড়ই শীতকাতুরে মানুষ। সকালে বাজারে যাবেন বলে তিনি প্রস্তুত হচ্ছিলেন। পরনে গরম প্যান্টালুন, গায়ে পুলওভার, মাথায় বাঁদুরে টুপি, পায়ে মোজা। এবং নিউকাট জুতো। ঠান্ডা লাগার জো নেই।
তাঁর স্ত্রী শৈলবালা স্বামীকে হাড়ে-হাড়ে চেনেন, পিছন থেকে বললেন, “গায়ে যে গন্ধমাদন চাপিয়ে যাচ্ছ, একটু বাদে রোদ উঠলে যে গলগল করে ঘামবে! তখন ঘাম বসে গিয়ে সর্দি লাগবে যে!”
আশুবাবু তটস্থ হয়ে বললেন, “ঘাম হবে কী গো, আমার যে শীতে ঠকঠকানি হচ্ছে। হাত মোজাটাও গলিয়ে নেব কিনা ভাবছি।”
শৈলবালা দাঁত কড়মড় করে বললেন, “মরণ। তোমাকে দেখে লোকে হাসাহাসি করে না?”
লোকে হাসাহাসি করে কিনা তা লক্ষ করেন না আশুবাবু। আশপাশের লোকজনকে লক্ষ বার অভ্যেসই তাঁর নেই। সারাক্ষণ নানা ক্যালকুলেশন নিয়ে তিনি মনে-মনে এতই মগ্ন হয়ে থাকেন যে, চারপাশটাকে নিরপরখ করার ফুরসত তাঁর কমই হয়। তিনি খুবই নিরাসক্ত গলায় বললেন, “তা তারা হাসাহাসি করে তো করুক না। বেশির ভাগ লোকই তো আহাম্মক।এই তো এই ঠান্ডাতেও কাল সকালে দেখলাম সুবলবাবু একটা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে আবার হাঁক দিয়ে বললেন, এস্কিমোর মতো সেজে কোথায় চললেন আশুবাবু?’ কথা শুনে পিত্তি জ্বলে যায়। না হয় আমার শীতটা একটু বেশিই লাগে, তা বলে এই ঠান্ডায় স্যান্ডো গেঞ্জি পরে বীরত্ব দেখানো কি উচিত?”
“সুবলবাবুর কাছে তোমার শেখা উচিত।”
আশুবাবু ভারী অবাক হয়ে বললেন, “সুবলের কাছে শিখব। বলো কী? ওর কাছে শেখার কী আছে আমার? ও তো ইশকুলে বাংলা কবিতা পড়ায়! আমার মতো সায়েন্স জানে?”
“সায়েন্স না-জানুক, সুবলবাবুর কাণ্ডজ্ঞান আছে।”
আশুবাবু হাঁ হয়ে গেলেন। যে লোকটা বিজ্ঞানই জানে না তার আবার কাণ্ড জ্ঞান থাকে কী করে? তবে তিনি আর কথা বাড়ালেন না। আসলে কথা তাঁর বেশি আসেও না। তিনি একটা ভাষাই বোঝেন, আর সেটা হল বিজ্ঞানের ভাষা। বিজ্ঞানের সঙ্গেই তাঁর যত কথাবার্তা। আর তিনি হলেন অ্যাস্ট্রোনমির একনিষ্ঠ এক সেবক। আকাশের আঁকিবুকি, নক্ষত্রদের তিনি যত বোঝেন তত আর কিছু নয়।
পকেটে ফর্দ এবং হাতে থলি নিয়ে আশুবাবু বেরিয়ে পড়লেন। এই সবে রোদ উঠেছে, গাছে-গাছে পাখি ডাকছে, পরেশের মা গোবর কুড়োতে বেরিয়েছেন, নিতাই মণ্ডলের ছোট ছেলে গুল্টু তারস্বরে নামতা মুখস্থ করছে, তারক হোমিওপ্যাথ তার চেম্বারে বসে মস্ত একটা হাই তুলল। এইসব দৃশ্য প্রায় রোজই তাঁর চোখে পড়ে এবং রোজই মনে হয় পৃথিবীটা দিন-দিন অধঃপাতে যাচ্ছে। কেন মনে হয় কে জানে। তবে তিনি খুব বেশিক্ষণ মর্ত্যধামে থাকেন না, হুশ করে আকাশে উঠে যান। মাথাভর্তি গ্রহনক্ষত্র আর তাদের নানা বৈচিত্র ভাবতে-ভাবতে হাঁটতে থাকেন। এই আকাশের নেশা তাঁকে ধরিয়েছিলেন মন্মথনাথ রায়চৌধুরী। খুবই রহস্যময় মানুষ।
আশুবাবু যখন বারো-চোদ্দো বছরের ছেলে, তখন কোথা থেকে এসে এই গাঁয়ে থানা গাড়লেন মন্মথনাথ। পড়তি জমিদার বীরেনবাবুদের পেল্লায় পুরনো বাড়িখানা কিনে নিয়ে ফকিরগঞ্জে শিকড় গেড়ে বসলেন। একা মানুষ, সঙ্গে পরান নামে একজন কাজের লোক ছাড়া আর কেউ নেই। সারাদিন ঘরে বসে নানারকম লেখাপড়া করতেন, আর সন্ধের পর মস্ত ছাদে উঠে একটা জোরালো টেলিস্কোপ দিয়ে স্টারগেজিং বা নক্ষত্রাবলোকন করতেন। ফিসফাস শোনা যেত, তিনি নাকি একজন মহাকাশবিজ্ঞানী। একা থাকতেন বটে তবে গম্ভীর বা অমিশুক ছিলেন না, গাঁয়ের লোকজনের সঙ্গে তাঁর বেশ সদ্ভাব ছিল। নানা বিষয়ে কথা কইতেন বটে, তবে তাঁর নিজের সম্পর্কে কেউ কিছু জানতে চাইলে হেসে এড়িয়ে যেতেন। বলতেন, “আরে আমি অতি তুচ্ছ মানুষ। সংসারধর্ম করিনি, লেখাপড়া নিয়েই থাকতে ভালবাসি।”
মাঝে-মাঝে গাঁয়ের ছোট ছেলেমেয়েদের ডেকে মহাকাশ চেনাতেন কোনটা কোন নক্ষত্র, কোনটা কোন তিথিতে আকাশের কোথায় অবস্থান করবে, এইসব। তা তিনিই আশুবাবুর মহাকাশের নেশাটা ধরিয়েছিলেন। মন্মথবাবুর টেলিস্কোপ দিয়ে মহাকাশ দেখতে-দেখতে আশুবাবুর এমন নেশা ধরে গিয়েছিল যে মহাকাশ বিজ্ঞানী হওয়া ছাড়া জীবনে আর কিছু হওয়ার কথা তিনি ভাবতেনই না। সেইজন্যই অনেক মেহনত করে খেটেখুটে তিনি অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে এম এস সি অবধি পাশ করে ফেললেন। কিন্তু তেমন ভাল ফল করতে পারলেন না। সংসারের দায়িত্ব নিতে গাঁয়ে ফিরে আসতে হল। কাছে তায়েবগঞ্জ কলেজে অধ্যাপনা জুটে গিয়েছিল বলে রক্ষে। মন্মথবাবুর যখন বেশ বয়স হয়েছে তখন আশুবাবুকে ডেকে একদিন সস্নেহে বললেন, “বড় অ্যাস্ট্রোনমার হতে পারিসনি বলে দুঃখ করিস না বাবা, আকাশকে ভালবাসলেই হবে। আকাশকে বুঝবার আনন্দটাই আসল।আমার টেলিস্কোপটা তুই নিয়ে যা। তুই ওটার মর্ম বুঝবি।”
মন্মথনাথ টেলিস্কোপের দাম নিলেন না। সেই থেকে টেলিস্কোপটা আশুবাবুর দখলে আছে। তবে মন্মথনাথ তাঁকে এ-ও বলেছিলেন, “শোন, টেলিস্কোপটা কিন্তু আমার নয়। ওর আসল মালিক ছিল ডেভিড, খুব খারাপ লোক। তবে যতদূর জানি সে বেঁচে নেই।”
এসব বছর উনিশ-কুড়ি আগেকার কথা। আজ আর মন্মথনাথ নেই, পরানও কবেই দেশে চলে গিয়েছে। ফাঁকা বাড়িটা জঙ্গল আর আগাছায় ডুবে আছে, সাপখোপের আড্ডা।
আকাশ পরিষ্কার থাকলে প্রায় রোজই ছাদে গিয়ে আকাশে মগ্ন হয়ে থাকেন আশুবাবু। পথিবীতে যত ধুলো বালির কণা আছে তার চেয়েও ঢের বেশি সংখ্যক নক্ষত্র রয়েছে আকাশে। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপের পাল্লার বাইরেও রয়েছে কোটি-কোটি গ্যালাক্সি। আর প্রতি গ্যালাক্সিতে কোটি-কোটি নক্ষত্র। যেহেতু আকাশের কোনও শেষ নেই, সেইজন্যই নক্ষত্রমণ্ডলেরও সীমাসংখ্যা নেই। মানুষ এখনও মহাকাশ সম্পর্কে সামান্যই জানে। সীমাহীনতার পাল্লা তো কোনও পরিমাপ বা সংখ্যা বা বোধের মধ্যে আসে না। তাই যারা মহাকাশের রহস্য নিয়ে মগ্ন হয়ে থাকে তারা কেউ-কেউ একটু পাগলাটে গোছের হয়। এই যেমন আমাদের আশুবাবু। প্রায় সময়েই তিনি তুমুল অন্যমনস্ক, মাঝে-মাঝে আপনমনে বিড়বিড় করেন, আঙুল নেড়ে নেড়ে কোনও অদৃশ্য মানুষের সঙ্গে কথা বলেন, মাথা নাড়তে নাড়তে হাঁটেন। লোকে তাঁকে দেখলে লুকিয়ে হাসে। ভাল অঙ্ক জানা না-থাকলে নাকি মহাকাশ সম্পর্কে জ্ঞানই হয় না। তাই আশুবাবুকে প্রায়ই দেখা যায় একটা ল্যাপটপে ঘণ্টার পর-ঘণ্টা অঙ্ক কষেই যাচ্ছেন।
একটা লোক কোত্থেকে হঠাৎ এসে বড্ড গা ঘেঁষে হাটতে-হাটতে বলল, “আচ্ছা আপনি কি আশুবাবু?”
গায়েপড়া লোকদের আশুবাবু মোটেই পছন্দ করেন না। তিনি গম্ভীর হয়ে বললেন, “আমি আশুবাবু হলে কি আপনার কিছু সুবিধে হয়?”
লোকটা ভারী নির্বিকার গলায় বলে, “তা একটু হয় বই কী।”
“কীরকম সুবিধে বলুন দিকি।”
“আপনি যদি আশুতোষ সরকার হয়ে থাকেন, তা হলে আপনাকে একটা খবর জানানোর আছে।”
“বটে! তা সেটা কীরকম খবর মশাই?”
“উতলা হবেন না। আশুবাবু ছাড়া আর কাউকেই খবরটা দেওয়ার হুকুম নেই! তাই আগে জানা দরকার আপনিই আসল আশুবাবু কিনা।”
“আমি যতদূর জানি, আমিই আশুতোষ সরকার।”
“এই গাঁয়ে আরও তিন-চারজন আশুবাবু আছেন বলে আমার কাছে খবর আছে। আমি যে আশুবাবুকে খুজছি তিনি আপনি কিনা তা বোঝা যাবে কী করে?”
আশুবাবু একটু মিইয়ে গিয়ে বলেন, “তাই বুঝি! ফকিরগঞ্জে যে এত আশুর আস্তানা, তা আমার জানা ছিল না মশাই! কুমোর পাড়ায় এক আশু আছে বলে শুনেছিলাম যেন, অবশ্য তার পদবি জানি না।”
“আজ্ঞে, তাঁর পদবিও সরকার। ফকিরগঞ্জে আশুতোষের অভাব নেই। আর সেই কারণেই আমি মুশকিলে পড়ে গেছি। কোন আশু যে আসল আশু সেটা এখন বুঝে ওঠাই কঠিন।”
আশুবাবু ভারী বিরক্ত হয়ে বললেন, “আপনি যে আশুবাবুকে খুঁজছেন। সেই আশুবাবু হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। কস্মিনকালেও আমি আপনার আশুবাবু ছিলাম না। আপনি বরং ঘুরে-ঘুরে আপনার আশুবাবুকে খুঁজুনগে, আমার বাজার করতে দেরি হয়ে যাচ্ছে, আমি চললুম।”
এই বলে আশুবাবু হনহন করে হাঁটা দিলেন।
পিছন থেকে লোকটা একটু মোলায়েম গলাতেই বলল, “আহা, চটে গেলেন নাকি মশাই! বলছিলাম কি, আপনার কপালের বাঁ দিকে কি একটা আব আছে?”
আশুবাবু বেজায় চটে গিয়ে বললেন, “আব! আব থাকবে কেন মশাই? আবের কথা উঠছে কেন?”
“আহা, উত্তেজিত হবেন না, আবের কথা উঠছে এই কারণে যে, আমি যে আশুবাবুকে খুঁজছি তার কপালের বাঁদিকে মটরদানার সাইজের আব থাকার কথা। আপনি বাঁদুরে টুপি পরে থাকায় কপালটা ঢাকা পড়ে। গেছে। আব আছে কিনা তা বোঝার জো নেই।”
আশুবাবু অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, “না মশাই, আমার কপালে আবটাব নেই। আর অত বায়নাক্কাই বা কিসের মশাই? একজন আশুবাবুকেই চাই, অন্য কোনও বাবু হলে চলবে না, সেই আশুকে আবার সরকার হতে হবে, আবার তার কপালের বাঁদিকে আব থাকতে হবে, সেই আবের সাইজ মটরদানার মতো হতে হবে! মামারবাড়ির আবদার আর কী! অত খুঁতখুঁতুনি থাকলে কুমোরপাড়ায় গিয়ে আশুবাবুর মূর্তি গড়িয়ে নিলেই তো হয়।”
ছোটখাটো চেহারার লোকটা মোটেই ঘাবড়াল না, গলাটা মোলায়েম রেখেই বলল, “তা অবিশ্যি আপনি ঠিকই বলেছেন। এত লক্ষণ মিলিয়ে আশুবাবুর নাগাল পাওয়া বেশ কঠিন কাজ। কিন্তু কথা কী জানেন, আশুবাবু হিসেবে আপনাকে আমার বেশ পছন্দই হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু বয়সটাতেই আটকাচ্ছে। আমাকে বলা হয়েছে আশুবাবুর বয়স নাকি বিয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ বছর, কিন্তু আপনি তো দেখছি পচিশ-ছাব্বিশ বছরের ছোকরা! এরকম কচি আশুবাবু তো চলবে না মশাই!”
এ কথাটা শুনে আশুবাবু ভারী খুশি হয়ে পড়লেন। তাঁকে নাকি পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের ছোকরা বলে মনে হয়! তাজ্জব ব্যাপার তো! গত অগ্রহায়ণ মাসে তাঁর বিয়াল্লিশ পুরে এই তেতাল্লিশ চলছে, তাঁকে যে এখনও এত অল্পবয়সি বলে মনে হয় এটা তাঁর জানা ছিল না। বেশ খুশি-খুশি মুখ তিনি চোয়াড়ে চেহারার লোকটির দিকে এবার বেশ স্নেহের দৃষ্টিতে চাইলেন এবং কী আশ্চর্য, এবার লোকটাকে তাঁর একটুও অপছন্দ হল না। গলাটাও আপনা থেকেই মোলায়েম হয়ে এল, মিষ্টি একটু হেসে বললেন, “আহা, আমাকে দেখতে ছোকরা হলেও ততটা ছোকরা নই মশাই। আপনি যে আশুবাবুকে খুঁজছেন সেই আশুবাবু হতে আমার তেমন আপত্তিও নেই। আর ভাল কথা, সেদিন সকালবেলায় আমার বউও বলছিল বটে, ‘ওগো, তোমার কপালের বাঁদিকে যে একটা মটরদানার সাইজের আব আছে সেটা এতকাল আমার চোখেই পড়েনি!”
চালাক চেহারার লোকটা হঠাৎ হুশ করে একটা নিশ্চিন্দির শ্বাস ফেলে বলে, “ওহ, বাঁচালেন মশাই! নইলে আরও কত হয়রানিই যে কপালে ছিল। সেই কাকভোরে বেরিয়েছি, এতটা পথের ধকল, তার উপর পেটে এখনও দানাপানি পড়েনি, কী মুশকিলে যে পড়া গিয়েছিল!”
আশুবাবু এবার দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, “কোনও চিন্তা নেই, নিশ্চিন্তে কথাটা কইতে পারেন। আমিই আপনার আশুবাবু। এই যে টুপিটা সরাচ্ছি, কপালের আবটা দেখে নিন বরং।”
আশুবাবু বাঁদুরে টুপিটা একটু সরিয়ে আবটা দেখালেন, লোকটাও খুব দিয়ে দেখল। ভারী আহ্লাদের গলায় বলল, “বাহ, দিব্যি আবটা মশাই আপনার, একেবারে নিখুঁত। এরকম একখানা আবের জন্য আরও কয়েক কিলোমিটার ঠ্যাঙানো যায়।”
“তা হলে এবার যে খবরটা দিতে এসেছিলেন সেটা দিয়ে ফেলুন।”
“ঠিক আছে, কিন্তু তার আগে গলাটা যে একটু ভেজানো দরকার, মানুষের খিদে-তেষ্টা বলেও তো একটা ব্যাপার আছে, নাকি!”
আশুবাবু একটু তটস্থ হয়ে বলেন, “নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, ওই তো সামনেই নিতাই ময়রার দক্ষিণাকালী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার! কচুরি, জিলিপি, রাজভোগ সব পাবেন, যান না মশাই, ইচ্ছেমতো সাঁটিয়ে নিন।”।
লোকটা ভারী সঙ্কুচিত হয়ে বলে, “যে আজ্ঞে, তবে অসুবিধে কী জানেন, মনিব বারো টাকার বেশি রাহাখরচ দেয়নি কিনা। এখন কী দিয়ে যে পিত্তদমন করি!”
আশুবাবু অতিশয় হিসেবি মানুষ। মন আকাশে থাকলেও টাকাপয়সার ব্যাপারে খুব সেয়ানা। তাই মুখে বৈরাগ্য মেখে বললেন, “বারো টাকাই কী কম হল মশাই! দিব্যি দুটো লেড়ো বিস্কুট আর চা হয়ে যাবে।”
লোকটা একটু যেন দমে গিয়ে অভিমানের গলায় বলে, “অতিথি সৎকার বলেও তো একটা কথা আছে, নাকি!”।
আশুবাবু অম্লানবদনে বললেন, “তা আছে বই কী। ডিকশনারি খুললে কত ভাল-ভাল কথা পাবেন। কিন্তু কথাটা লাগসই হওয়া চাই তো! আপনি কোন সুবাদে আমার অতিথি মশাই? অজ্ঞাতকুলশীল হাড়হাভাতে মতলববাজ যে কেউ এসে গ্যালগ্যালে হেসে অতিথি কপচালেই তো হবে না! চারদিকে গন্ডায়-গন্ডায় জোচ্চোর ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
লোকটা একটু দমে গেলেও সঙ্গে-সঙ্গেই আশুবাবুর সঙ্গে একমত বলে, “তা অবিশ্যি ঠিক। আজকাল কাউকেই বিশ্বাস নেই। আপনি ভারী বিচক্ষণ মানুষ বলেই শুনেছিলাম, এখন দেখছি কথাটা একবিন্দু মিথ্যে নয়। নক্ষত্রবিদ্যার এত বড় স্কলার হয়েও আপনার দেখছি চারদিকে চোখ! না মশাই, আপনাকে যত দেখছি ততই আপনার উপর শ্রদ্ধা বেড়ে যাচ্ছে।”
আশুবাবু ফের একটু নরম আর রসস্থ হয়ে পড়লেন। মাখন মাখানো গলায় বললেন, “তা বটে, লোকে আমাকে বিচক্ষণ মানুষ বলে বেশ খাতিরও করে দেখেছি। হরিধন পোদ্দার তো প্রশংসায় পঞ্চমুখ, বলে, ‘গাঁয়ে চারচোখো লোক বলতে ওই একজনই আছে, আশুতোষ সরকার।”
“হরিধনবাবুকে আমার নমস্কার, তাঁর মানুষ চেনার ক্ষমতা আছে বটে! তা আশুবাবু, আপনার কাছে কি কুড়িটা টাকা খুচরো হবে? তা হলে চায়ের সঙ্গে দুটো গরম শিঙাড়াও হয়ে যায় আর কী! চাপাচাপি নেই, দেখুন যদি বাড়তি কুড়িটা টাকা পকেটে পড়েটড়ে থেকে থাকে।”
আশুবাবু মাথা নাড়া দিয়ে বললেন, “না মশাই, ওদিক দিয়ে আপনার তেমন সুবিধে হবে না। আমার গিন্নি ভারী হিসেবি লোক, বাজারদর তাঁর নখদর্পণে। ফর্দের সঙ্গে মিলিয়ে আঁক কষে টাকা বুঝিয়ে দিয়েছেন। এক পয়সা এদিক ওদিক হওয়ার জো নেই! বুঝলেন? আপনি তো কোন ছাড়, আমি স্বয়ং সংসারের কর্তা, আজ অবধি সাহস করে একটা অমতি বা দরবেশ খেয়ে উঠতে পারলাম না!”
লোকটা শশব্যস্ত বলে, “তা গিন্নিমার একটু পায়ের ধুলো পাওয়া যায় না! আহা, এমন লক্ষ্মীপ্রতিমা যে-ঘরে আছেন সেই ঘর কিন্তু তো অমরাবতী!”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আশুবাবু বলেন, “তা পাওয়া যাবে না কেন? পয়সা ফেললে কী না পাওয়া যায় বলুন! পায়ের ধুলো পাঁচটাকা করে। পুরিয়া, আপনার তাতে পোষাবে তো!”
লোকটা একটু থতমত খেয়ে মাথাটাথা চুলকে বলল, “আপনি সত্যিই ভারী বিচক্ষণ লোক দেখছি!”
আশুবাবু একটু মিচকি হেসে বললেন, “যা দিনকাল পড়েছে মশাই, বিচক্ষণ না হলে কি টিকে থাকার উপায় আছে! চারদিকটা চোর, জোচ্চোর, ঠগবাজ, গাঁটকাটায় গিজগিজ করছে! একটু আনমনা হয়েছেন কী সর্বনাশ! আগে আমি বেশ ভোলাভালা আনমনা কাছাখোলা মানুষই ছিলাম, বুঝলেন। কিনা! কিন্তু চারদিকটা ছ্যাঁচড়ামিতে এমন ভরে গেছে যে, ভালমানুষ হয়ে থাকার আর উপায় নেই। এই তো সেদিন সক্কালবেলায় এক ছোকরা একটা রসগোল্লার হাঁড়ি নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে আমাদের বাড়িতে এসে বলল, ‘এই রসগোল্লার হাঁড়িটা রাখুন, আপনার শ্বশুরমশাই এসেছেন, তাঁর গাড়িটা, ওই বটতলার কাছে ফেঁসে গেছে বলে মালপত্র নিয়ে আসতে দেরি হচ্ছে। আর গাড়িভাড়া তিন হাজার টাকাও দিতে বলে দিয়েছেন, কারণ তাঁর কাছে। হুন্ডি আছে বটে কিন্তু নগদ টাকা নেই, টাকা না-পেলে গাড়িওয়ালা ছাড়বে না কিনা।‘ শুনে আমি শশব্যস্ত হয়ে টাকা বের করে দিলাম। বাস্তবিকই আমার শ্বশুরমশাইয়ের দু’-চার দিনের মধ্যে আসার কথাও ছিল বটে। কিন্তু। ছোকরা টাকা নিয়ে সেই যে হাওয়া হল আর তার টিকির নাগালও পাওয়া গেল না। শ্বশুরমশাইও নাপাত্তা। আর রসগোল্লার হাঁড়ির মুখের ঢাকনা খুলে দেখি, তাতে এক হাঁড়ি জল। শুধু কি তাই? গত ভাদ্রমাসে পুজোর কেনাকাটা করতে গঞ্জের বাজারে গিয়েছিলাম। তা হাজারদশেক টাকার মালপত্র হবে। দোকান থেকে মালপত্র নিয়ে বেরোব, এমন সময়ে এক ছোকরা এসে পেন্নাম করে বলল, “স্যার, চিনতে পারছেন? আমি আপনার। ছাত্র অমল মিত্র, পাঁচ বছর আগে পাশ করে বেরিয়েছিলাম। মুখটা কেমন চেনা-চেনা লাগল, তাই বললাম, “বেশ-বেশ, তা ভাল তো! সে নানা কথা ফেঁদে বসল, পুনেয় নাকি পেল্লায় চাকরি করে, দেড় লাখ টাকা বেতন, এই সব। তারপর বলল, “স্যার, এত মালপত্র নিয়ে যাবেন কী করে? সঙ্গে গাড়ি আছে কি? আমি কাঁচুমাচু হয়ে বললাম, না বাপ, আমার গাড়িটাড়ি নেই। আমি বাসে যাব। সে অবাক হয়ে বলে, সে কী কথা? এত মালপত্র নিয়ে। বাসে যাবেন কী? আমার গাড়ি আছে, চলুন পৌঁছে দিচ্ছি। গুরুদক্ষিণা বলেও তো একটা ব্যাপার আছে নাকি! দিন, মালপত্রগুলো আমাকে দিন, হয়ে আর আপনি পিছু-পিছু আসুন। ওই মোড়েই আমার গাড়ি পার্ক করা আছে, নীল রঙের এস ইউ ভি।তা তার পিছু পিছু গেলাম বটে, কিন্তু ভিড়ের মধ্যে সে যে কোথায় হাওয়া হল কে জানে! নীল রঙের এস ইউ ভি-ও গায়েব। বুঝলেন তো, অভিজ্ঞতা থেকেই শিক্ষা নিতে হয়।”
লোকটা একথাতেও দ্বিমত হল না, মাথা নেড়ে বলল, “বড় জব্বর কথা বলেছেন। চারদিকে বড়ই অনাচার। দেখে-দেখে আমারও ঘেন্না ধরে গেল। তবে কিনা এই আপনার মতো দু’-চারজন সাচ্চা লোক আছেন বলেই আজও চাঁদসুয্যি ওঠে। নইলে দুনিয়াটার তো কবেই রসাতলে যাওয়ার কথা! তা আশুবাবু, আপনার বাড়িতে সকালের জলখাবার হয় না! গোটাচারেক লুচি আর আলুর হেঁচকি হলে মন্দ হত না কিন্তু!”
আশুবাবু অবাক হয়ে বলেন, “জলখাবার! জলখাবার বলেও যে একটা কথা আছে তাও তো বিস্মরণ হতে বসেছি মশাই! ওসব জলখাবার টাবারের পাটই আমাদের বাড়িতে নেই। আধমুঠো চাল গালে ফেলে ঢকঢক করে এক গেলাস জল খেয়ে নিলেই হেউঢেউ হয়ে যায়। পিত্তদমন নিয়ে কথা, ওসব লুচিটুচি আমার কাছে রূপকথা বই নয়। আর আলুর হেঁচকি! শেষ কবে খেয়েছিলাম তাই মনে পড়ে না।”
লোকটা মোটেই ঘাবড়াল না। অমায়িক মুখে বলে, “আত্মসংযম কাকে বলে তা আপনাকে দেখে শিখতে হয়। এ হল ব্রহ্মচারীর লক্ষণ। সংসারী সন্ন্যাসী। তা বাড়িতে মুড়িটুড়ি নেই? গোটা চারপাঁচ বাতাসা হলে তাই দিয়ে একটু মুড়ি চিবোতে চিবোতে না হয় দুটো কথা হতে পারত! কী বলেন?”
আশুবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, “তার আগে জানা দরকার, কথাটা কী! কথার ওজন বুঝে তবে আপ্যায়নের ব্যবস্থা। বুঝলেন! মুড়ি আর বাতাসাই কি এখন আর আগের মতো তুচ্ছ জিনিস আছে? তারাও এখন জাতে উঠে গেছে মশাই।”
“যথার্থই বলেছেন আশুবাবু। আপনার দূরদৃষ্টির ভূয়সী প্রশংসা না-করলে অন্যায় হবে। তবে বলছিলাম কী, মুড়ির অসুবিধে থাকলে বরং এক-আধখানা বাসি রুটিটুটি থাকলেও চলে যাবে, সঙ্গে একটু গুড় হলে তো কথাই নেই।”
“যাদের বাড়িতে খাবার বাড়তি হয় তাদের বাড়িতেই বাসি রুটি থাকে। ওটা অপব্যয়ের লক্ষণ। আমার গিন্নির হিসেবের মাথা এমন পরিষ্কার যে, কারও পাতে লবণটুকুও বাড়তি হয় না। তাই ঝড়তিপড়তি কিছুই থাকে না আমাদের।”
“বুঝেছি। একেই বলে লক্ষ্মীশ্রী। এমন না হলে কি আর আর গিন্নিমাকে মানায়!”
আশুবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “একটা কাজের কথা বলতে এসে গুচ্ছের এলেবেলে কথা ফেঁদে বসা কি ভাল? কথার মধ্যে রাজ্যের কচুরি, শিঙাড়া, লুচি, রুটি এনে ফেললে যে ভজঘট্ট লেগে যায় মশাই!”
“তা অবিশ্যি ঠিক। তবে আমার আবার পেটেরই সমস্যা কিনা। পেটেই যত গড়বড়। গোবিন্দ কোবরেজের পাঁচন খেয়েও কোনও কাজ হয়নি। যখন তখন খিদে পায় মশাই, আর খিদে পেলে মাথাটা মোটেই কাজ করতে চায় না। কী বলতে গিয়ে কী বলে ফেলি তারও ঠিক থাকে না।”
আশুবাবু একটু উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বললেন, “পেটের ওই সমস্যাতেই তো গোটা দুনিয়ার লাখো লোক ভুগছে, নতুন কী বলুন! সমস্যাটা আমারও আছে। খিদে-তেষ্টা আছে বলেই তো লোকে টের পায় যে সে বেঁচে আছে। সব জিনিসেরই ভাল দিকটা দেখতে চেষ্টা করুন।”
“লাখ কথার এক কথা! আজ সক্কালবেলাটায় যেন ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হল। কথাগুলো স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো। তা কথাটা হল, গতকাল রাত্তিরবেলায় করালীবাবু আমাকে ডেকে বললেন, “ওরে পটল, ফকিরগঞ্জের আশুতোষ সরকারকে যে একটা জরুরি খবর দিতে হবে বাপু। ডেভিডসাহেব বোম্বাই থেকে গাড়িতে চেপেছেন, দু-একদিনের মধ্যেই তাঁর জিনিসটা নিতে এসে পড়বেন। আশুবাবু যেন তৈরি থাকেন।”
আশুবাবু অবাক হয়ে বললেন, “করালীবাবু কে? ডেভিডই বা কে? জিনিসটাই বা কী?”
লোকটা হাঁ করে কিছুক্ষণ আশুবাবুর দিকে অবাক চোখে চেয়ে থেকে বিস্ময়ের গলায় বলে, “করালী কুন্ডুকে চেনে না, এমন মানুষও যে ভূ-ভারতে আছে তা জানতুম না মশাই! বড় পাথুরিয়ার করালী কুন্ডুর নাম শুনলে যে রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যায়, কুকুর-বিড়ালটাও পথে বেরোতে সাহস পায়না! যাদের কলিজার তেমন জোর নেই তাদের অনেকে হার্টফেল অবধি করেছে!”
আশুবাবু অবাক হয়ে বলেন, “ষণ্ডা গুন্ডা নাকি?”
“ছিঃ, করালীবাবুকে ওভাবে ছোট করা আপনার উচিত হচ্ছে না। ষণ্ডাগুন্ডারা তো তাঁর ফাইফরমাশ খাটে মশাই! লুঙি কেচে দেয়, পিকদানি ধরে, জুতো পালিশ করে, কারও মাথা কেটে আনতে বললে হাসিমুখে মাথা কেটে প্লেটে সাজিয়ে সামনে এনে রাখে!”
আশুবাবু একটু চিন্তিত মুখে বলেন, “তা হলে কি ডন নাকি মশাই?”
লোকটা অনিচ্ছুক গলায় বললে, “সেটা বললেও প্রায় কিছুই বলা হয় না। তবু আপাতত কাজ চালানোর জন্য ডন-ই সই।”
আশুবাবু একটু উত্তেজিত হয়ে বলেন, তা তিনি ডনই হোন বা বৈঠকই হোন, তাতে আমার কী? আমার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কিসের? আমি তো ভদ্রলোককে চিনিই না।”
“আহা, উত্তেজিত হবেন না আর গলাটা একটু নামিয়ে কথা বলুন। কে কোথায় শুনে ফেলবে, বিপদে পড়বেন যে মশাই! মান্যগণ্য মানুষদের হ্যাটা করা কি ভাল? এই তো জষ্টিমাসের তেরো তারিখে যোগেশ্বর গয়লা তার রাখালকে সকালবেলায় হাঁক দিয়ে বলেছিল, ওরে, যা তো, করালীর বাড়িতে এক বালতি দুধ দিয়ে আয়।” কথাটা পাঁচকান হতে দেরি হয়নি। বেফাঁস বলা মশাই, আর যায় কোথা, যোগেশ্বরকে চার ঘণ্টা বাবলা গাছে হেঁটমুন্ড করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। কত বড় বুকের পাটা, করালীবাবুর মতো মহা মান্যগণ্য মানুষকে করালী’ বলাটা কত বড় অপমান ভাবুন! শুধু কি তাই! করালী কুন্ডুর বাড়ির সামনে দিয়ে যাতায়াত করতে গেলে নিয়ম আছে, জুতো খুলে হাতে নিয়ে, মাথা নিচু করে যেতে হয়। সেদিন হরেন ঢোল ভুল করে জুতো খোলেনি। তার কী হল জানেন! গনগনে জ্বলন্ত কয়লার উপর দিয়ে খালিপায়ে পনেরো মিনিট হাঁটতে হল। আরও শুনতে চান? শুনতে চাইলে কিন্তু মহাভারত!”
একথায় হঠাৎ করে আশুবাবুর গলাটা ফেঁসে গেল। ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বললেন, “আজ আমাদের সকালের জলখাবার হয়েছে পরোটা বেগুনভাজা আপনার চলবে কি?”
লোকটা ভারী লজ্জা পেয়ে বলে, “ওসব আবার কেন? আমার তো একটু মুড়ি-বাতাসা হলেই হয়ে যেত! অবশ্য পরোটাও চলতে পারে, তবে ওই পাঁচ-ছয়খানার বেশি নয় কিন্তু! পিত্তদমন দিয়ে কথা, বুঝলেন কিনা!”
মোট দশখানা পরোটার পর পটল ক্ষান্ত দিয়ে বলল, “নাহ, আরও ঘণ্টাখানেক এতেই দিব্যি চলে যাবে। আমার দাদু বলতেন, “সবসময় পেটে খিদে রেখে খাবি, অতিভোজন মোটেই ভাল নয়। তা হলে আজকের মতো আসি আশুবাবু!”
আশুবাবু তেমনি ফ্যাঁসফেঁসে গলাতেই বললেন, “ডেভিডসাহেবের কথা কী যেন বলছিলেন পটলবাবু! তিনিও কি করালী কুন্ডুর মতোই। মান্যগণ্য লোক নাকি?”
পটল মাথা নেড়ে বলে, “তা জানি না মশাই। তবে কেষ্টবিষ্টই হবেন বোধ হয়। করালী কুন্ডু তো আর যার-তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন না! কী একটা দূরবিন না কী যেন একটা জিনিসের কথা শুনছিলাম বটে। সেটা নাকি আপনি অন্যায্যভাবে দখল করে রেখেছেন!”
আশুবাবুর মাথায় হঠাৎ যেন বজ্রাঘাত হল! তাই তো! মন্মথবাবু তো কে একজন ডেভিডের কথা বলেছিলেন বটে! টেলিস্কোপটা নাকি কোন এক ডেভিডের। এবং এ-ও বলেছিলেন যে, তিনি যতদুর জানেন ডেভিড বেঁচে নেই। তা হলে আবার এ কোন ডেভিডের উদয় হল! মন্মথবাবু মারা গিয়েছেন প্রায় বিশ বছর, তখন তাঁর বয়স হয়েছিল নব্বইয়ের উপর। ডেভিড যদি তাঁর কাছাকাছি বয়সের হয়ে থাকে তা হলে কালের নিয়মে তারও এতদিন বেঁচে থাকার কথা নয়। থাকলেও সে এখন বেশ বুড়ো, অথর্ব। অঙ্কটা তো মিলছে না!
পটল দাস বিদেয় হওয়ার পর সারাদিনটা আশুবাবুর একটা ঘোরের মধ্যে কাটছিল। এমনিতেই সারাদিন তিনি নানা কথা বিড়বিড় করেন, আজ বিড়বিড়ানিটা আরও একটু বেশি। বিশেষ করে ডেভিডের নামটা। তার উপর আবার করালী কুন্ডু নামে এক ভয়ঙ্কর গুন্ডার ভয়ও বড্ড চেপে ধরেছে তাঁকে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে বড্ড। টেলিস্কোপটা তাঁর বড় আদরের আর সাধের জিনিস। এর যে কোনও দাবিদার থাকতে পারে, এ তিনি স্বপ্নেও কখনও ভাবেননি। টেলিস্কোপটা ছাড়া তিনি বাঁচবেন কী করে? একটা এরকম টেলিস্কোপ কিনতে গেলে এখন সাত-আট লাখ টাকার ধাক্কা। তাও এমন সরেস জিনিস পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। আর অত টাকা তিনি পাবেনই বা কোথায়!
ভারী আনমনা ছিলেন বলে আজ তিনি একটু বেলার দিকে বাজারে গিয়ে তেমন দরাদরি না-করেই বুড়ো ঝিঙে, পাকা তেঁড়স, শুকনো পালং আর আধপচা মাছ কিনে বাড়ি ফিরছিলেন। তেঁতুলতলার মোড়ের কাছ বরাবর কে যেন তাঁর কানের কাছে মুখটা এনে বলল, “না মশাই, আজ তেমন জমল না!”
হতচকিত আশুবাবু অবাক হয়ে দেখলেন, তাঁর পাশে-পাশে একজন লম্বা-চওড়া চেহারার লোক হাঁটছে, মুখে যেন একটু বিদ্রুপের হাসি। লোকটাকে ভারী চেনা-চেনা লাগলেও অন্যমনস্কতার দরুন ঠিকঠাক মনে করতে পারলেন না। আশুবাবু কাহিল গলায় বললেন, “অ্যাঁ! কী জমল না?”
লোকটা গা-জ্বালানো হাসিটা হেসেই যাচ্ছিল, বলল, “আরে মশাই, বাজার করাটা যে একটা আট সেটা তো আমি আপনাকে দেখেই রোজ শিখি! আপনি গগনবিহারী মানুষ বটে, কিন্তু বাজার করার সময়ে আপনি একেবারে শক্ত জমিতে নেমে পড়েন। কীভাবে কুড়ি টাকার পটল বারো টাকায় কিনতে হয়, কোন কায়দায় তিরিশ টাকার বেগুনকে বাইশ টাকায় নামিয়ে আনতে হয়, কোন কৌশলে একশো চল্লিশ টাকার মাছ নব্বুই টাকায় গস্ত করা যায়, এসব আর কে শেখাবে বলুন আপনি ছাড়া। তা আজ দেখলাম, আপনি ঝিঙেওয়ালার কাছে ল্যাজেগোবরে হয়ে গেলেন, ঢেঁড়স ওয়ালার কাছে দাড়াতেই পারলেন না, পালংওয়ালা তো আপনাকে গুনে-গুনে তিন গোল দিয়ে দিল, আর মাছওয়ালা রঘু তো আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে যে মাছটার পেট নরম হয়ে এসেছিল সেই আড় মাছটাই গছিয়ে ছাড়ল। না মশাই, আজ আপনার খেলটা কিন্তু মোটেই জমেনি৷ যাই বলুন।”
আশুবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “রোজ কি কারও সমান যায় মশাই? আজ আমার মনটা ভাল নেই কিনা!”
লোকটা একটু উদাস মুখে বলে, “তাই বুঝি। তা মনের ভাল-খারাপ তো আছেই। এই মেঘ তো এই রোদ, বুঝলেন কিনা। তা বলে নিজের এত বড় প্রতিভাটার অপমান করা কি ঠিক হল আপনার? আমার মতো আরও অনেকেই যে রোজ আপনাকে দেখে বাজার করা শিখতে আসে।”
এই কথা শুনে আশুবাবু আবার একটু চাঙ্গা হয়ে উঠে হেঁ হেঁ করে হেসে বললেন, “তা অবিশ্যি ঠিক। আমাকে দেখে লোকে অনেক কিছুই শেখে বটে! তা আপনি কে বলুন তো! খুব চেনা-চেনা লাগছে, কিন্তু ঠিক চিনতে পারছিনা!”
“আজ্ঞে, আমি তেমন নামডাকওয়ালা লোক নই, সামান্য মানুষ। আপাতত এই গাঁয়েই থাকি। আমার নাম রাম। কিন্তু আজ আপনার মনটা কেন ভাল নেই তা তো বললেন না!”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আশুবাবু বলেন, “সে অনেক কথা। আমার বড় বিপদ যাচ্ছে মশাই!”
“সে আর বেশি কথা কী? মাঝে-মাঝে আমাদের সকলের জীবনেই বিপদ আপদ আসে! কোষ্ঠ পরিষ্কার না-হলে বিপদ, কাজের মাসি না-এলে বিপদ, গিন্নির বাতব্যাধির প্রকোপ বাড়লে বিপদ, পাওনাদার তাগাদায় এলে বিপদ, বিপদের ফর্দ তো বেজায় লম্বা! তা আপনার বিপদটা কোন ধরনের বলুন তো!”
ফের ফোঁত করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আশুবাবু বলেন, “সে লম্বা কাহিনি মশাই, রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলার মতো নয়।”
লোকটা ঘাড় কাত করে বলে, “বেশ-বেশ, আজ না হয় থাক। বাজার নিয়ে ফিরতে দেরি হলে আবার গিন্নির মুখনাড়া খেতে হবে, কী বলেন! আচ্ছা মশাই, আমি কানাঘুষো শুনেছি, আপনার নাকি একটা সেকেলে খেলনা টেলিস্কোপ আছে, আর আপনি নাকি তা দিয়ে রোজ আকাশের তারা দেখেন! সত্যি নাকি?”
আশুবাবু অতিশয় বিরক্ত আর অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “যা জানেন না তা নিয়ে ফুট কাটেন কেন মশাই? ওটা মোটেই সেকেলে জিনিস নয় আর খেলনাও নয়, রীতিমতো কাজের জিনিস। আর মনে রাখবেন, আমি একজন অ্যাস্ট্রোনমার।”
“ছিঃ ছিঃ, আমার খুব অপরাধ হয়ে গেছে আশুবাবু, মাপ করে দেবেন। কিন্তু জানতে খুব কৌতুহল হচ্ছে যে আপনি ওই টেলিস্কোপটা দিয়ে কী দেখেন।”
“কেন, টেলিস্কোপটা দিয়ে আমি গ্রহ, নক্ষত্র, ধুমকেতু, অ্যাস্টেরয়েড এবং আরও অনেক কিছুই স্টাডি করি। আকাশ তো আর ছোটখাটো জিনিস নয় মশাই, এ হল ইনফিনিটি, তাই দেখার কত কী আছে! সেসব আপনি ঠিক বুঝবেন না।”
“তা তো বটেই। তবে কিনা, একটা প্রশ্ন আছে।”
“কী প্রশ্ন?
“এই নক্ষত্রদের কথাই বলছিলাম সার কী। শুনতে পাই এক-একটা নক্ষত্র নাকি লক্ষ লক্ষ কোটি-কোটি লাইট ইয়ার দুরে। তাই যদি হয় তা হলে আপনি আজ যে নক্ষত্রটা দেখছেন সেটা কিন্তু মোটেই আজকের নক্ষত্র নয়, আপনি বহু লক্ষ বা বহু কোটি বছর পিছিয়ে গিয়ে সেটাকে দেখছেন। আসলে সেই নক্ষত্রটা এখন হয়তো বেঁচেও নেই, হাতে নিভে গেছে বা বামন নক্ষত্র হয়ে গেছে বা ব্ল্যাকহোল।”
আশুবাবু একটু অবাক হয়ে বললেন, “তা তো বটেই। নক্ষত্রদের আলো এসে না-পৌছলে আমরা তা দেখতে পাব কী করে?”
রাম ফের বিচ্ছুর মতো একটু হেসে বলে, “আমিও তো তাই বলতে চাইছি, আপনি যা দেখছেন তা হয় একটা ইলিউশন, বাসি বস্তা পচা অলীক জিনিস। রাতের আকাশে এখন যে তারাটা দেখা যাচ্ছে সেটা আসলে হয়তো এখন নেই বা অনেক দুরে সরে গিয়েছে বা বদলে গিয়ে অন্য কিছুতে রূপান্তরিত হয়েছে। আপনি ভুল জিনিস দেখছেন।”
আশুবাবু একটু উত্তেজিত হয়ে বলেন, “ভুল দেখছি মানে? ভুল দেখছি বললেই হবে। অ্যাস্ট্রোনমি কত এগিয়ে গেছে জানেন?”
লোকটা মুখের বিচ্ছু হাসিটা বজায় রেখেই বলে, “যা-ই বলুন আশুবাবু, আপনি আকাশ দেখছেন বটে কিন্তু দেখছেন টাইম ট্রাভেলারের মতো। যেটা দেখছেন সেটা মিথ্যে। আপনাদের বিজ্ঞান কিন্তু অনেক পিছিয়ে আছে। মশাই।”
আশুবাবু রেগে উঠতে গিয়েও হঠাৎ একটু থতমত খেয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “আপনার কি এসব চর্চা আছে নাকি?”
লোকটা মাথা নেড়ে বলে, “আরে না। আমি একজন মিস্তিরি মানুষ। তবে আপনার টেলিস্কোপটার কথা লোকের মুখে শুনে খুব ইচ্ছে হয় একদিন গিয়ে জিনিসটা দেখে আসি, যদি আপনার অনুমতি হয়।”
আশুবাবু আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “আর টেলিস্কোপ! টেলিস্কোপটা আর আমার দখলে থাকবে কিনা তাই তো বুঝতে পারছি না মশাই! যার জিনিস সে যদি এসে তুলে নিয়ে যায় তা হলে তো হয়েই গেল, কী করে আর দেখবেন।”
রাম হঠাৎ ভ্রু দুটো কুঁচকে বলে, “কেন, জিনিসটা আপনার নয় বুঝি!”
আশুবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “ন্যায্যত বলতে গেলে জিনিসটা আমার নয় বটে। মন্মথবাবু নামে একজন আমাকে দিয়ে গিয়েছেন। তবে তিনি বলেছিলেন বটে, জিনিসটা নাকি ডেভিড নামে একজনের এবং সে নাকি খুব সুবিধের লোক নয়। তিনি অবশ্য আমাকে অভয় দিয়ে এ-ও বলেছিলেন যে, ডেভিড বেঁচে নেই। এখন তো শুনছি ডেভিড তার জিনিস উদ্ধার করতে আসছে!”
“মন্মথবাবু কি বেঁচে আছেন? থাকলে তিনি কোথায়?”
“আরে না মশাই, মন্মথবাবু নব্বই বছর পার করে বিশ বছর আগেই গত হয়েছেন।”
“আর ডেভিড! সে কোথায়?”
“তা কে জানে মশাই! একটা উটকো লোক খবরটা দিয়ে গেল। ডেভিডসাহেব নাকি বোম্বে থেকে গাড়িতে চেপেছেন। এলেন বলে!”
“এই ডেভিড তো আসল ডেভিড না-ও হতে পারে! ভড়কি দিয়ে দামি জিনিসটা হাতানোর মতলব নয় তো!”
“তা শুধু হতে পারে নয় মশাই, আমার তো মনে হচ্ছে ঘটনা সেটাই। কিন্তু করালী কুন্ডুর সঙ্গে তো বিবাদে যেতে পারি না! সে যে বিরাট গুন্ডা!”
রাম একটু অবাক হয়ে বলে, “এর মধ্যে আবার করালী কুন্ডু এল কোথেকে মশাই? সে-ই বা কে?”
আশুবাবু বড়-বড় চোখ করে ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলেন, “চেনেন না? বড় পাথুরিয়ার করালী কুন্ডু নাকি বিশাল ডন! হাতে মাথা কাটে। তারই লোক এসে আজ আমাকে হুমকি দিয়ে গেছে যে! তার নাম পটল দাস।”
রাম এবার একটু হেসে বলে, “যে যা বলে তাই বিশ্বাস করা কি আপনার মতো বিচক্ষণ লোককে মানায়! কই, যখন মাছওয়ালা দুর্গাপদ রুই মাছের দাম আড়াইশো টাকা হাঁকে, তখন তো তাকে বিশ্বাস করেন না! আড়াইশোকে ঘাড় ধরে দেড়শোয় নামিয়ে ছাড়েন, তাই না!”
আশুবাবু টালুমালু করে চেয়ে বলেন, “তা হলে কি আপনি বলতে চান যে, করালী কুন্ডু তেমন গুন্ডা নয়!”
রাম মাথা নেড়ে বলে, “না, তা বলছি না। করালী কুণ্ড একজন গুন্ডা হতেই পারে। তবে যাচাই না করে কাউকে বিশ্বাস করা ঠিক নয়।”
আশুবাবু যেন একটু আশার আলো দেখতে পাচ্ছিলেন। রাম নামে এই লম্বা-চওড়া অল্পবয়সি লোকটার উপর তাঁর একটু ভরসাও হচ্ছিল। বললেন, “তা হলে এখন আমার কী করা উচিত বলুন তো রামবাবু!”
রাম মুচকি হেসে বলে, “আপনার এখন পা চালিয়ে বাড়ি যাওয়া উচিত নইলে মাছটা কিন্তু আর খাওয়ার যুগ্যি থাকবে না। তারপর ঠান্ডা মাথায় কয়েকটা কথা ভাবা উচিত। প্রথম কথা, টেলিস্কোপটা যে ডেভিডের তার কোনও প্রমাণ নেই, দ্বিতীয় কথা, কেউ এসে নিজেকে ডেভিড বলে দাবি করলেও সে যে আসল ডেভিড তা প্রমাণ করতে হবে, আর তৃতীয় কথা, গাঁয়ের সবাই জানে যে, টেলিস্কোপটা আপনার, কাজেই অন্য দাবিদারের প্রশ্নই ওঠে না। আরও একটা কথা হল, করালী কুন্ডু বড় পাথুরিয়ার গুন্ডা হতে পারে, কিন্তু ফকিরগঞ্জ তার এলাকা নয়, এলাকার বাইরে বেড়াল কিন্তু ইদুর হয়ে যায়। এসব ভাবলে মনে সাহস পাবেন।”
“সেই ভরসা দিই কী করে? তবে আমি শিগগিরই আপনার যন্ত্রটা দেখতে আসব। আশা করি ততদিন কিছু হবে না। এবার আপনি বাড়ি যান, ” বলেই লোকটা হঠাৎ উলটো দিকে ফিরে হনহন করে জোরে হাঁটা দিল। আশুবাবু অবাক হয়ে দেখলেন, চোখের পলকে লোকটা যেন হাওয়া হয়ে গেল। কেউ যে এত জোরে হাঁটতে পারে তা জানা ছিল না আশুবাবুর।