আর্ট কী ও কী নয়
লেখার ভিতর দিয়ে আমি আমার আপনাকে দিচ্ছি, যিনি পড়ছেন তিনি আমাকে পাচ্ছেন। গানের ভিতর দিয়ে আমি আমার আপনাকে দিচ্ছি, যিনি শুনছেন তিনি আমাকে পাচ্ছেন। ছবির ভিতর দিয়ে আমি আমার আপনাকে দিচ্ছি, যিনি দেখছেন তিনি আমাকে পাচ্ছেন।
আরও আছে। কিন্তু যে-কথাটা বোঝাতে চাই সেটা এই যে, একটা-না-একটা ছলে আমি আমার আপনাকে দিচ্ছি আর তিনি আমাকে পাচ্ছেন। আমার পক্ষে এই দেওয়াটা আনন্দের, তাঁর পক্ষে ওই পাওয়াটা আনন্দের। দেওয়া ও পাওয়ার এই যে ছল বা উপলক্ষ্য বা মাধ্যম এরই নাম আর্ট। এও আনন্দের।
আমরা অনেক সময় বলে থাকি রান্না একটা আর্ট। অযথা নয়। রান্নার ভিতর দিয়ে একজন তার আপনাকে দিতে পারে, যে খায় সেতাকে পেতে পারে। দেওয়া ও পাওয়ার এটাও একটা ছল বা উপলক্ষ্য বা মাধ্যম। স্যাকরা যে গয়না গড়ে, ধোপা যে কাপড় কাচে, গাড়োয়ান যে গাড়ি হাঁকায়, পসারিনি যে পসরা হাঁকে, এদের এক-একটি ছলে আপনাকে দেওয়া, আপনার পরিচয় দেওয়া, এক-একটি আর্ট বলে গণ্য হতে পারে। যদিও হয় না।
বস্তুত মানুষের আপনাকে দেওয়ার অন্ত নেই, পরকে পাওয়ার অন্ত নেই, দেওয়া ও পাওয়ার ছল বা উপলক্ষ্য বা মাধ্যম অনন্ত অজস্র। আমার এক কালে দুরভিলাষ ছিল যে আমার প্রতিদিনের প্রত্যেকটি কাজ ও অকাজ, প্রত্যেকটি হাসি ও কান্না, প্রত্যেকটি চিন্তা ও বাক্য আর্ট হবে। আমি যখন মরব তখন লোকে বলবে, অমন করে মরাটাও একটা আর্ট। এখন ততবড়ো দুরভিলাষ নেই, তবু এখনও আমি বিশ্বাস করি যে মোটের উপর জীবনটা একটা আর্ট। ঠিকমতো বঁাচতে পারাটা একটা আর্ট। তা যদি হয় তবে জীবনের ছোটো-বড়ো অনেক ব্যাপার আর্ট হতে পারে। তাস খেলাও একটা আর্ট, চুকলি করাও তাই। ঢিল মেরে আম পাড়াও একটা আর্ট, ফাঁদ পেতে প্রজাপতি ধরাও তাই। গম্ভীরভাবে যোগাসনে বসে মেয়েদের দিকে আড়চোখে চাওয়াও একটা আর্ট, পাগলা ষাঁড়ের তাড়া খেয়ে দিব্যি সরে পড়াও তাই। এসব উপলক্ষ্যেও মানুষ তার আপনাকে দিচ্ছে, আপনার পরিচয় দিচ্ছে। হয়তো কেউ লক্ষ করছে না, কিন্তু করতে তো পারত। লক্ষ করলেই পরিচয় পেত। সবসময় কল্পনা করতে হয় যে কেউ একজন লক্ষ করছেন। আর কেউ না করলেও, অন্তর্যামী ভগবান।
আর্ট কথাটা আমাদের ভাষার নয়। এর ঠিকঠিক প্রতিশব্দ নেই। তবে কলা কথাটা যদি হাস্যকর না হত, তা দিয়ে আর্টের কাজ চলত। হাস্যকর হয়েই মাটি করেছে। ধরুন আমি যদি নিরীহভাবে বলি, আপনার লেখায় কলা আছে, হনুমানেরা আপনাকে খেপিয়ে তুলবে। জীবনটা একটা কলা শুনলে হনুমানেরা ঠাওরাবে আমিও তাদের একজন। সেই ভয়ে আমি ইংরেজি আর্ট কথাটাকে আসরে নামালুম। শিল্প এক্ষেত্রে অচল, কেননা ছলার সঙ্গে কলার নিকট সম্পর্ক শিল্পের মধ্যে একটা আয়াসের ভাব। আর্টিস্টকে আমরা শিল্পী বলে অনুবাদ করে থাকি, কিন্তু ওর চেয়ে খাঁটি অনুবাদ কলাবৎ বা কলাবতী।
আর্ট কথাটার মস্ত দোষ এই যে, আর্ট বলতে যার যা খুশি সেতাই বোঝে। ইদানীং সাহিত্য শব্দটাও পিতৃমাতৃহীন হয়েছে। সাহিত্য সম্মেলনে বিজ্ঞান শাখা ইতিহাস শাখা দেখে ভ্রম হয় বিজ্ঞান দর্শন ইতিহাস বুঝি সাহিত্যের শাখা। যাদের মাথা এত পরিষ্কার তাদের কেউ যদি ধর্মকেও আর্টের আমলে আনে কিংবা আর্টকেও ধর্মের আমলে তবে নালিশ করতে পারিনে। শুধু চতুরাননকে স্মরণ করে নিবেদন করতে পারি, শিরসি মা লিখ। অধুনা চন্ডীমন্ডপের সমাজপতিরা যদি-বা চুপ করেছেন, তাঁদের চাদর পড়েছে মস্কো মন্ডলের সমাজতন্ত্রীদের কাঁধে। আর্ট এবং মার্কস কথিত সুসমাচার যে এক এবং অভিন্ন হওয়া উচিত, না হলে বুর্জোয়া বলে বর্জনীয় হওয়া বিধেয়, আধুনিক ভাটপাড়া থেকে এই জাতীয় পাঁতি দেওয়া হচ্ছে। আর্ট যে একপ্রকার প্রোপাগাণ্ডা, প্রোপাগাণ্ডা যে একপ্রকার আর্ট, অপোগন্ডরা সহজেই তা মেনে নিচ্ছে। না নেবেই-বা কেন? তাদের পূর্বপুরুষেরা যে আবহমানকাল দেবদেবীর মাহাত্ম্য-প্রচারকে মঙ্গলকাব্য বলে মেনে এসেছে।
আর্ট কী তার একটা আভাস দিয়েছি, সংজ্ঞা দেওয়া আমার সাধ্যাতীত। আর্ট কী নয় তার এবার একটা ইঙ্গিত দিই।
আমার অনেক লেখা আছে, সব লেখার ভিতর দিয়ে আমি আমার আপনাকে দিইনি। বৈষয়িক চিঠিপত্র, মামলার রায়, পরিদর্শনের মন্তব্য, তদন্তের রিপোর্ট এসব লেখা আর্ট নয়। যদিও তাদের কোথাও কোথাও হয়তো আমার সাহিত্যিক রুচির ছাপ আছে।
যেমন সব প্রেম প্রেম নয়, তেমনি সব লেখা আর্ট নয়। প্রতিদিন রাশি রাশি লেখা প্রকাশিত হচ্ছে, আরও কত অপ্রকাশিত থাকছে। সব যদি আর্ট হত তবে আনন্দের বিষয় হত, কিন্তু বিষয়কর্ম চলত না। কোম্পানি আমাকে চিঠি লিখে জানিয়েছে বারো ভোল্ট ব্যাটারি দিতে পারবে না। আমি যদি এর উত্তরে একটা কবিতা কি প্রবন্ধ লিখে পাঠাই তাহলে কোম্পানি আমাকে পাগলাগারদে পাঠাবে। সব লেখা আর্ট নয়, তাই বঁাচোয়া। নইলে কোম্পানি আমাকে একটা ছোটোগল্প পাঠিয়ে বলত এই তার পালটা জবাব। তখন আমি মনের ঘেন্নায় লেখা ছেড়ে দিতুম।
পৃথিবীতে তিন ভাগ জল যেমন সত্য, জীবনে বারো আনা বিষয়কাজ তেমনি। বিষয়কাজের সঙ্গে আর্টের সম্বন্ধ সদরের সঙ্গে অন্দরের। আমার বিহার উভয়ত্র। আমি নভেলও লিখি, রিপোর্টও লিখি। কিন্তু অন্দরকে যেমন সদর বলে ভ্রম করিনে তেমনি নভেলকে রিপোর্ট বলে; কিংবা রিপোর্টকে নভেল বলে। সব লেখা আর্ট নয়। কারণ সব লেখায় আমি আমার আপনাকে দিতে পারিনে, দেবার ছল পাইনে। ঘর কৈনু বাহির, বাহির কৈনু ঘর, জীবনে এরকম নিত্য ঘটে না। ঘটে হয়তো ক্বচিৎ। যদি কেউ ঘরে-বাইরের ভেদ তুলে দেন তবে তাঁর জীবনটা হাট হয়ে উঠবে। লেখার থেকে আর্ট উঠে যাবে।
যেমন সব লেখা আর্ট নয় তেমনি সব গান আর্ট নয়, সব ছবি আর্ট নয়, সব রান্না আর্ট নয়, সব কান্না আর্ট নয়, সব চুলছাঁটা আর্ট নয়, সব হাতসাফাই আর্ট নয়। দেখতে হবে কীসে মানুষ তার আপনাকে দিয়েছে, দেবার ছল পেয়েছে। কীসে দেয়নি, দেবার ছল পায়নি। সেই অনুসারে স্থির করতে হবে কোনটা আর্ট, কোনটা আর্ট নয়।
আমি চুল ছাঁটাকেও আর্টের মধ্যে ধরেছি, পকেট কাটাকেও। কিন্তু বিজ্ঞান দর্শন বা ইতিহাসকে ধরতে রাজি নই। এর কারণ আমি সাম্রাজ্যবাদী নই, স্বরাজ্যবাদী। বিজ্ঞান দর্শন ইতিহাস সমাজতত্ত্ব এরা একটা স্বতন্ত্র রাজ্য। আর্টও স্বতন্ত্র। পরস্পরের সঙ্গে সম্বন্ধ নিশ্চয় আছে, না থাকলে অস্বাভাবিক হত। কিন্তু যা আর্ট নয় তাকে আর্টের সীমানার ভিতর পুরলে আর্ট বেচারি কোণঠাসা হয়, তার পা ছড়াবার ঠাঁই থাকে না। আবার উলটো বিপত্তি ঘটে যখন আর্টের উপর ফরমাশ পড়ে বৈজ্ঞানিক বা আধ্যাত্মিক হবার। বিজ্ঞানকে বা ধর্মকে আত্মসাৎ করতে গিয়ে আর্ট তাদেরই উদরসাৎ হয়। আজকাল সমাজকে নিয়ে আর্টের এই বিপত্তি।
তবে আর্ট ও আর্ট-নয়ের মাঝখানে কোনো সুনির্দিষ্ট সীমান্তরেখা নেই। যে রেখা নেই তাকে গায়ের জোরে টানতে গেলে দ্বন্দ্ব বঁাধে। ‘উপনিষদ’ পড়তে পড়তে অনেক সময় মনে হয়েছে যা পড়ছি তা কাব্য। প্লেটোর রচনা পড়ে বুঝতে পারিনি কেন আর্ট নয়। বাইবেলের যেখানে-সেখানে কবিতার কণা ছড়ানো। এসব উড়িয়ে দেবার যো নেই। অথচ একথা কখনো মানতে পারিনে যে ধর্মগ্রন্থের বাইরে দর্শনগ্রন্থের বাইরে আর্ট নেই বা থাকলেও নীচু দরের আর্ট। আসল কথা, কোথায় আর্ট শেষ হয়ে দর্শন আরম্ভ হয়েছে, কোথায় ধর্ম শেষ হয়ে আর্ট আরম্ভ হয়েছে তা কেউ জানে না, জানতে পারে না। কেউ কি বলতে পারে কোনখানে হেমন্তের সারা, শীতের শুরু? কোনখানে বসন্তের শুরু, শীতের সারা?
সীমানার গোলমাল চিরদিন থাকবে, জোর করে বেড়া দিলে বেড়া টিকবে না। তা বলে যদি কেউ মনে করেন যার নাম বিজ্ঞান তারই নাম ধর্ম, যার নাম ধর্ম তারই নাম দর্শন, যার নাম দর্শন তারই নাম ইতিহাস, যার নাম ইতিহাস তারই নাম সমাজতত্ত্ব, যার নাম সমাজতত্ত্ব তারই নাম আর্ট, তবে সেই অদ্বৈতবাদীকে ব্রহ্মজিজ্ঞাসার জন্যে বানপ্রস্থ অবলম্বন করতে বলব। সীমানার বিবাদ হাজার বার সইব, কিন্তু এই হবুচন্দ্রের বিচার এক বারও না। কোনখানে ব্যবধান তা যদিও স্পষ্ট নয় তবু ব্যবধান তো সত্য। ব্যবধানের সত্যতা অস্বীকার করলে সত্যের অপলাপ হয়।
যা আর্ট তা আছে। যা আর্ট নয় তাও আছে। উভয়ের মধ্যে প্রভেদ, তাও আছে। প্রভেদের অস্পষ্টতা, তাও আছে। সুতরাং তর্কের অবকাশ চিরকাল। তাতে আমার ক্ষোভ নেই। আমার লেখা যদি আর্ট হয়, আমার আর্ট যদি সত্য হয়, তবে সত্যের জোরে নিজের স্থান করে নেবে, তর্কের জোরে নয়, তত্ত্বের জোরে নয়। কিন্তু সম্প্রতি একটা ধারণা আর্টিস্টদের নিজেদেরই মাথা ঘুলিয়ে দিচ্ছে। তাঁরা ভাবছেন যে আপনাকে দেওয়াটা কোনো কাজের নয়, যে ছলে দেওয়া যায় সেটাও বাজে, দিতে হবে এমন কিছু যাতে সমাজের প্রত্যক্ষ প্রগতি হয়, তা দিলেই আর্ট হবে, না দিলে আর্ট হবে না। এই ধারণা যে একটা কুসংস্কার—একটা নতুন কুসংস্কার—এ জ্ঞান একদিন ফিরবে তাঁদের, যাঁদের ভিতরে কিছু আছে। অন্তরের মূল্যই আর্টের পরম মূল্য, বাইরের মূল্য তাকে মূল্য দিতে পারে না। আর্ট একটা ছল, একটা উপলক্ষ্য, একটা মাধ্যম। সমাজ-প্রগতির হেতু বা নিমিত্ত নয়। সেকাজ অন্য লেখার, অন্য ছবির, অন্য গানের।