আর্টের মূল্য

আর্টের মূল্য

আমি আমার আপনাকে দিচ্ছি। যার ভিতর দিয়ে দিচ্ছি, যে ছলে দিচ্ছি, যে উপলক্ষে দিচ্ছি তার নাম আর্ট। আর্টের মূল্য কী? আর্টের মূল্য কতক তার নিজের, কতক আমার।

যেমন একখানা চিঠির মূল্য। প্রিয়ার চিঠি প্রিয়ার মূল্যে মূল্যবান। কিন্তু যদি প্রিয়ার চিঠি না হয়ে অপ্রিয়ার চিঠি হত তা হলেও তার একটা মূল্য থাকত। চিঠি হিসাবে। সেটা তার নিজের মূল্য।

আর্টের মূল্য কতক তার নিজের। যেহেতু সেআর্ট কতক আর্টিস্টের। যেহেতু তিনি আপনাকে দিচ্ছেন। এ ছাড়া আরও এক মূল্য আছে। বিষয়ের। বিষয়বস্তুর। চিঠি এলে প্রথমেই মনে জাগে, কে লিখেছে? তারপরে কথা ওঠে, কী লিখেছে? প্রিয়জনের চিঠিতে যদি কিছু নাও থাকে তবু তা মূল্যবান, কিন্তু কিছু থাকলে আরও মূল্যবান। জানতে ইচ্ছা করে কেমন আছে, কী করছে, কবে দেখা হবে। তেমনি প্রিয় লেখকের নতুন বই দেখলে পড়ে দেখতে ইচ্ছা করে কী বিষয়ে লেখা, বিষয়ের দিক থেকে মূল্যবান কি না। সাধারণত আমরা ধরে নিই নিশ্চয়ই মূল্যবান। কিন্তু শেষ করবার পর নিরাশ হয়ে বলি, কই, কী এমন ভালো! কিংবা নিশ্চিন্ত হয়ে বলি, ভালোই হয়েছে। কিংবা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলি, আগেরখানার চেয়েও ভালো।

আর্টের মূল্য তাহলে তিন দফা। এক, তার নিজের। দুই, তার রচয়িতার। তিন, তার বিষয়ের। লাইব্রেরিতে যখন একরাশ বই হাতের কাছে পাই তখন আমরা একখানা টেনে নিই তার লেখকের নাম দেখে, যেমন রবীন্দ্রনাথের। একখানা পেড়ে নিই বিষয়ের আকর্ষণে, যেমন স্বপ্নের ফলাফল। এবং যদি সুরসিক হয়ে থাকি তো একখানা বইয়ের খোঁজ করি নিছক আর্টের খাতিরে। যেমন বীরবলের হালখাতা। সংস্কৃত সাহিত্যে এমন অনেক রচনা আছে যার আদি-অন্ত সুভাষিত। আমরা তাদের স্বাদ নিই লেখকের খাতিরে নয়, কারণ লেখক অনামা। বিষয়ের খাতিরে নয়, কারণ বিষয় মরচে-ধরা। আর্টের খাতিরে। অর্থাৎ কে বলেছে তার জন্যে নয়, কী বলেছে তার জন্যে নয়, কেমন করে বলেছে তারই জন্যে।

সোনায় সোহাগা হয় যদি ‘কেমন করে বলেছে’র সঙ্গে ‘কী বলেছে’র সঙ্গম হয়। তার সঙ্গে যদি ‘কে বলেছে’ যোগ দেয় তো ত্রিবেণীসঙ্গম। কিন্তু এরকম সার্থক রচনা জগতে খুব বেশি নেই। সেইজন্যে শেক্সপিয়রের এত দর। আমাদের দেশে কালিদাসের ও রবীন্দ্রনাথের। অবশ্য এঁদের সব রচনা সমান সার্থক বা সমান অমূল্য নয়। কিন্তু কোন কোন রচনা সার্থক বা অমূল্য তা বিচার করা সহজ হয় যদি মনে রাখি কেমন করে বলেছেন, কী বলেছেন, কে বলেছেন।

কে বলেছেন, এর মধ্যে একটু কথা আছে। মলাটের উপর যদি লেখা না থাকে তো লেখকের নাম উদ্ধার করা শক্ত। ছেলেবেলায় এমন অনেক বই আমার চোখে পড়েছে যেগুলির মলাট ছেঁড়া ও ভিতরের কয়েক পৃষ্ঠা নেই। প্রাচীন পুথির যেখানে ভণিতা আছে সেখানে নাম পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু যেখানে ভণিতার অভাব সেখানে লেখকের নাম অজ্ঞাত। ছবিতে স্বাক্ষর করার প্রথা সেকালে ছিল না, একালে সকলে মানেন না। মন্দির মসজিদের গায়ে রাজারাজড়ার নাম খোদাই থাকতে পারে, কারিগরের নাম থাকে না। ভাস্কর্যের কোনো কোনো স্থলে উৎকীর্ণ লিপি লক্ষিত হয়, কিন্তু ভাস্করের নাম নয়।

তা হলে কে বলেছেন বা এঁকেছেন বা গড়েছেন কেমন করে জানব? জানব মন দিয়ে পড়ে, অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখে, সত্তা দিয়ে অনুভব করে। নাম হয়তো জানব না। তাতে কিছু যায়-আসে না, কারণ নামটা একটা লেবেল ছাড়া আর কী? উঠে গেলেও যে যার জিনিস চিনে নিতে পারে। তেমনি অজন্তার গুহাচিত্র দেখে চিনতে পারি, যদি যত্ন করি, কে কোনখানা এঁকেছেন। নাম জানিনে, কিন্তু যেকোনো নাম কল্পনা করতে পারি। উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে না চাপালেই হল। নীচে স্বাক্ষর না থাকলেও যেকোনো অর্বাচীন দর্শক যামিনী রায়ের ছবির সঙ্গে নন্দলাল বসুর ছবির তফাত ধরতে পারবে। নাম যদি না জানে তো কল্পনা করবে, এখানা পাঁচকড়িবাবুর ওখানা তিনকড়িবাবুর। আমার নাম ও বুদ্ধদেববাবুর নাম যদি বিলুপ্ত হয়ে যায় তা হলেও আমাদের লেখায় এমন কোনো গভীর পার্থক্য থাকবেই যার থেকে আন্দাজ হবে আমার নাম উদো, ওঁর নাম বুধো।

অত কথায় কাজ কী, শেক্সপিয়র যে বেকনের ছদ্মনাম, নাটকগুলি যে বেকনের কীর্তি, এখনও এ ধারণা খাস ইংল্যাণ্ড থেকে যায়নি। সুতরাং নিজ নামে লিখলেও নিস্তার নেই। বৌদ্ধরা হয়তো একদিন দাবি করবেন যে অন্নদাশঙ্কর হচ্ছে বুদ্ধদেবেরই অষ্টোত্তর শত নামের এক নাম। ভরসা এই যে বোদ্ধারা সে-দাবি নাকচ করবেন।

কিন্তু যে-কথা পরিষ্কার করে বলতে চাই সেটা এই যে, আর্টের ভিতরেই আর্টিস্টের সত্যিকার পরিচয় অদৃশ্য থাকে, যার অন্তর্দৃষ্টি আছে সেআবিষ্কার করতে পারে। প্রিয়জন যদি টাইপরাইটারে চিঠি লেখেন ও নীচে নাম সই করতে ভুলে যান তাহলে কি আমরা ও-চিঠি আর কারও চিঠি বলে ভুল করি? সেক্ষেত্রে আমরা অভ্রান্ত। প্রত্যেকটি বাক্যের ও শব্দের যোজনায় প্রিয়জনের পরিচিত মুখ নতুন করে দেখতে পাই। তেমনি আর্টের বেলা। রবীন্দ্রনাথের অপ্রকাশিত রচনা যদি অন্য কোনো নামে প্রচারিত হয় তা হলেও আমার চিনতে ভুল হবে না কে লিখেছেন। কবি তাঁর অদৃশ্য পরিচয় চিরকালের মতো রেখে গেছেন তাঁর প্রকাশিত অপ্রকাশিত যাবতীয় লেখায়। হয়তো তাঁর নামটা লোকে ভুলে যাবে, বা ভুল করবে। বলবে ভানুসিংহ বা নিবারণ চক্রবর্তী। কিন্তু তাঁর পরিচয় নিয়ে ভুল করতে পারে না। ভোলবার নয়।

আর্টকে মূল্যবান করে আর্টিস্টের প্রচ্ছন্ন পরিচয়। মহাশিল্পীরা সে-পরিচয় আরও প্রচ্ছন্ন করেন, তাঁদের কাছে তাঁদের নিজেদের দাম কানাকড়ি। তাঁরা যা দিতে চান তাকেই দাম দেন সবচেয়ে বেশি। কী দিচ্ছেন তারই উপর এতটা জোর দেন যে কেমন করে দিচ্ছেন তাও ভাবেন না। তাঁদের রচনায় আর্ট যদি থাকে তো অনিচ্ছাকৃত বা অযত্নসম্ভব। অথচ সে-আর্ট সজ্ঞান শিল্পীর অসাধ্য। যাঁরা দু-বেলা ‘আর্ট’ ‘আর্ট’ করেন তাঁরাই যে সেরা আর্টিস্ট তা নয়। সেরা আর্টিস্টদের মুখে কথা নেই, তাঁরা ইজম আওড়ান না, তাঁদের একাগ্র অভিনিবেশ বিষয়ের উপর। কিন্তু তাঁদের অজ্ঞাতসারে তাঁদের ভিতরে যে আর্টিস্ট থাকে সেআর্টের প্রতিও তীব্র দৃষ্টি রাখে। তাঁরা যেমন-তেমন করে লেখেন না, আঁকেন না, গড়েন না। কেমন করে লেখেন বা আঁকেন তা হয়তো তাঁদেরও অজ্ঞাত, কিন্তু আমরা যখন পড়ি বা দেখি তখন বুঝতে পারি সেটাও আছে এবং সেটাও দামি।

কেমন করে লিখব এটা অনেক সময় ‘কী লিখব’র থেকে অভিন্ন। বিষয় অনুসারে লেখার ধরনধারণ বদলায়। প্রত্যেক বারেই ভেবে নিতে হয় কেমন করে লিখব, কেমন করে লিখলে ঠিক লেখাটি ওতরাবে, ঠিক সুরটি বাজবে, ঠিক ছবিটি ফুটবে, ঠিক অর্থটি হৃদয়ঙ্গম হবে। যাঁরা ওস্তাদ লিখিয়ে তাঁদের অত ভাবতে হয় না, তাঁদের অজ্ঞাতসারে আর একজন ভাবে, সেতাঁদের ভিতরকার আর্টিস্ট। তাঁরা তাঁদের সবটা মনোযোগ দেন বিষয়ের উপরে। ‘কী লিখব’র উপরে। ‘কেমন করে লিখব’র দিকে নজর আর একজনের। কিন্তু আমার ভিতরকার মানুষ যদি না ভাবে তো আমাকেই ভাবতে হয়। তাতে আমার বিষয়বিভোরতা ব্যাহত হয়। ধ্যানীর পক্ষে ধ্যানহানি প্রায় প্রাণহানির মতোই দুঃখকর। সেইজন্যে আমি আঙ্গিকের কথা একেবারেই মনে আনতে চাইনে। অথচ ওর প্রয়োজন মানি।

একটু বয়স হলে, হাত পাকলে, আত্মবিশ্বাস জন্মালে অন্যান্য সাধকের মতো শিল্পীরও স্মরণীয় শরবৎ তন্ময়ো ভবেৎ। শর যেমন লক্ষ্যে মগ্ন সাধকও তেমনি বিষয়ে মগ্ন। বিষয় অবশ্য ধনসম্পদ নয়। বিষয় হচ্ছে যা দেবার। যা না দিয়ে আমার নিষ্কৃতি নেই, যা দিতে আমি এসেছি। কে কী দিতে এসেছে তা অপরের অজানা, হয়তো তার নিজেরই না-জানা। কিন্তু প্রত্যেক অভিনেতার যেমন নির্দিষ্ট পাঠ প্রত্যেক লেখকেরও তেমনি। জীবনদেবতার নির্দেশ। তিনিই প্রম্পট করেন। আমরা ইতস্তত পরীক্ষা করতে করতে যে যার বিষয় পেয়ে যাই। এ ক্ষেত্রে যার-তার ফরমাশ খাটে না। তবে পরের ফরমাশও অনেক সময় সোনার কাঠির কাজ করে। তার পরশ লেগে আমাদের ঘুম ভাঙে, আমরা আত্মস্থ হই, আপনাকে চিনি, আপনার পাঠ বুঝে নিই। পরের ফরমাশ খাটতে গিয়ে ঘরের কাজ করি। যা দেবার তা প্রথমে জানি, তার পরে দিই।

তিন দফা মূল্যের কথা হল। এবার কাঞ্চনমূল্য। কাঞ্চনমূল্য আর্টের নয়, কারণ আর্ট হচ্ছে বিশুদ্ধ দান। কাঞ্চনমূল্য ছাপা কাগজের, কাঞ্চনমূল্য বহুজনের শ্রমের। আর্টিস্ট তার পাওনা হিসাবে যেটুকু পায় সেটুকু যেকোনো শ্রমিকের পাওনা। কারও কম, কারও বেশি।