আরও দাও প্রাণ – ৬

ভোরবেলায় হঠাৎ লোকজনের সন্ত্রস্ত কোলাহলে ঘুম ভেঙে গেল গহনের! তার সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সের হুটারের আর্তস্বর!

আজকাল সকালে ঘুম ভাঙতে চায় না তাঁর৷ রোজ রাতে জেগে থাকাটাই রুটিন হয়ে গেছে৷ যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, ল্যাম্পপোস্টের বাতিগুলোও জ্বলে জ্বলে ক্লান্ত পিঙ্গল আভা ছড়াতে শুরু করে, তখন তিনি চুপিসারে ছাতে উঠে যান৷ নির্বাক তাকিয়ে থাকেন উলটোদিকের বাড়ির দিকে৷ ও বাড়ির জানালায় এক নারীমূর্তি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ তার মুখোমুখি দাঁড়ান এক কবি৷ আর প্রতিরাতে নিজেকে চাবুক মারেন৷ অসহায়ভাবে ক্ষমা চেয়ে যান সারারাত ধরে৷ উলটোদিকে বস্তি থেকে কালো ধোঁয়া ক্রমাগতই আচ্ছন্ন করে দেয় চাঁদের ঔজ্জ্বল্য৷ ঘুরতে ঘুরতে ছড়িয়ে পড়ে আকাশে৷

মেয়েটির নাম জানেন না গহন৷ কণার কাছে জানতে চাইতে পারতেন৷ কিন্তু প্রয়োজন বোধ করেননি৷ ওর নাম, বয়েস, যোগ্যতা কোনোটাই জানার দরকার নেই—শুধু আসল কথাটা প্রতি রাতেই অমোঘভাবে জানতে পারেন তিনি৷ যখন সে ক্ষতবিক্ষত শরীরটাকে টেনে এনে জানলার সামনে দাঁড়ায়, কী এক ব্যাকুল প্রার্থনায় চেয়ে থাকে অনির্দিষ্টের উদ্দেশে—তখন তার ইতিহাস সম্পূর্ণ জানা হয়ে যায়৷

মেয়েটি কখনও গহনকে লক্ষ করেনি৷ সে জানেও না যে এক মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি রোজ তাকে দেখার জন্য ছাতে এসে দাঁড়ান৷ তবু গহন অপেক্ষা করেন, যদি সে একবারও তার দিকে তাকায়! যেমন একটা ছ-বছরের ছেলে আকুলভাবে তাকিয়েছিল তাঁর দিদির নিথর দেহের দিকে৷ মনে ক্ষীণ আশা নিয়ে অপেক্ষা করছিল, যদি দিদির দৃষ্টি একবার তার দিকে ফেরে…!

সে আশা অধরাই থেকে গিয়েছিল৷ দিদি আর কখনও তাকায়নি তার দিকে৷ এই মেয়েটিও তাকায় না৷ গহন মরিয়া হয়ে শুধু কাতর প্রার্থনা করে গেছেন৷ কিন্তু সে প্রার্থনা সফল হয়নি৷

গতকালও দেখা হয়েছিল দুজনের৷ কাল মেয়েটির হাবভাব অন্যরকম ছিল৷ অন্যদিনের মতো উদাস, ব্যথিত দৃষ্টিতে শূন্যে তাকিয়ে থাকেনি৷ বরং তার চোখে আগুন জ্বলছিল৷ কাল সে কাঁদেনি৷ বরং ল্যাম্পপোস্টের আলো তার চোখে পড়ে ধিকি ধিকি স্ফুলিঙ্গ জাগিয়ে তুলেছিল৷ একটা হাত তলপেটে রেখে কী যেন অনুভব করার চেষ্টা করে সে৷ তার মুখ অদ্ভুত এক সংকল্পে দৃঢ় হয়ে উঠেছে৷

গহন ভয় পেয়েছিলেন৷ ও কাঁদছে না কেন? তবে কি চোখের জলও বুকের আগুনে বাষ্প হয়ে গেছে! তলপেটে হাত দিয়ে কী অনুভব করতে চায়! তবে কী…!

প্রায় তিনটে অবধি ওভাবেই দাঁড়িয়েছিল সে৷ তারপর জানলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল৷ জানলার পাল্লা বন্ধ হওয়ার আগে একঝলক তার মুখ দেখতে পেয়েছিলেন৷ বিস্মিত হয়ে দেখেছিলেন, কান্না নয় এই প্রথম সে হাসছে! অদ্ভুত একটা বঙ্কিম হাসি! হাসিটা যেন তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ নিয়ে এসে বিঁধল! এমন হাসি লোকে চরম প্রতিশোধ নেওয়ার আগে হাসে৷

গহনের বুক দুরু দুরু করে উঠেছিল৷ সেই হাসিটা কিছুতেই ভুলতে পারছিলেন না৷ বিছানায় শুয়ে ক্রমাগতই এপাশ-ওপাশ করতে করতে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন৷ তবু অবচেতনে একটা আশঙ্কা ছিলই৷

সেই নিরাকার আশঙ্কাই আজ সকালে রূপ নিল লোকজনের কোলাহলে আর অ্যাম্বুলেন্সের হুটারে!

ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলেন তিনি৷ হুটার বাইরে নয়, যেন তাঁর বুকের ভেতরে বাজছে৷ সাইরেনের বিপদসংকেত!

দ্রুত পায়ে বিধ্বস্ত অবস্থায়, উশকোখুশকো চুলে উদভ্রান্তের মতো ছুটে গেলেন বারান্দার দিকে৷ কণা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়েছিলেন৷ উদবিগ্ন কণ্ঠে তাঁকেই প্রশ্নটা করলেন—‘কণা, কী হয়েছে?’

কণা স্বামীর দিকে তাকিয়েছিলেন৷ তাঁর চোখে উদবেগের ছাপ পড়ল—

—‘তুমি এত সকালে উঠে পড়েছ যে! চা দেব?’

—‘কথা ঘুরিও না৷ কী হয়েছে?’

কণা চোখ নামিয়ে নিয়েছেন—‘তেমন কিছু নয়৷ বোধহয় কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছে৷ যাই, তোমার চা…!’

তাঁর পথ আটকে দাঁড়ালেন গহন৷ দৃঢ় স্বরে বললেন—‘কী হয়েছে?’

কণা মুখ নীচু করেছিলেন৷ যখন মুখ তুললেন তখন তাঁর ঠোঁট কাঁপছে৷ চোখে রক্তিমাভা৷ কোনোমতে বললেন—‘ওই মেয়েটা আজ ভোর রাতে সুইসাইড করেছে…গলায় দড়ি দিয়ে…মেয়েটা প্রেগন্যান্ট ছিল…!’

শেষ কথাটা যেন তিরের মতো বিঁধল বুকে৷ কণার দু-চোখ বেয়ে জল পড়ছে৷ উদগ্র কান্নাকে দমন করার চেষ্টা করছেন৷

গহন কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখলেন৷ অ্যাম্বুলেন্সে মৃতদেহ তোলা হচ্ছে৷ ক্ষিপ্ত জনতা মারমুখী হয়ে উঠেছে! মেয়েটির স্বামীকে পেড়ে ফেলে এলোপাথাড়ি মারছে৷ লোকটা মার খেয়েই মরে যেত৷ কিন্তু তার আগেই পুলিশ এসে তাকে কোনোমতে বাঁচাল৷

সমস্ত ঘটনাই চুপচাপ দেখলেন গহন৷ তারপর নিত্যনৈমিত্তিক অভ্যাসমতো প্রাতরাশও সারলেন৷ কিন্তু সবটাই নিশ্চুপে৷ আজ শব্দেরা হারিয়ে গেছে৷ বলার কিছু নেই৷ শব্দ তিনি বড়ো ভালোবাসতেন৷ নরম লিরিক্যাল শব্দে কতবার সাজিয়ে দিয়েছেন পঙক্তির-পর-পঙক্তি৷

কিন্তু আজ মনে হল, সেসব শব্দের মানে কি! কতগুলো মূঢ় ফ্যান্টাসি! যে লাশটা ঘাড় মুচড়ে সাদা চাদরের তলায় পড়েছিল—তার কাছে শব্দের কোনো অর্থই নেই৷ যে ছোট্ট প্রাণটাকে আর জীবনের দায়ভার বইতে হল না, মাতৃগর্ভের নৈঃশব্দ্যকে সম্বল করেই ফিরে গেল অনন্ত অন্ধকারে—সে শব্দের কী বোঝে! তাঁর মধ্যেও কোথাও যেন একটা অন্ধ রাগ জন্ম নিচ্ছিল৷ কেন রাগ, কীসের রাগ তা নিজেও জানেন না৷ একটা অন্ধকার সমুদ্র পাঁজরের ওপর প্রচণ্ড রোষে ঝাঁপিয়ে পড়ছে! ভেতরে ভেতরে পাড় ভাঙার শব্দ পাচ্ছিলেন গহন৷

—‘কোথায় যাচ্ছ?’

প্রাতরাশ শেষ করে বেরোনোর জন্য তৈরি হচ্ছিলেন তিনি৷ কণা সভয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে বলেন—‘কোনো জরুরি কাজ…?’

—‘শুঁটকির কাছে যাচ্ছি৷ ফিরতে রাত হবে৷ দুপুরে ওর বাড়িতেই খেয়ে নেব৷ চিন্তা কোরো না৷’

তিনি স্বামীর দিকে তখনও একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন৷ যেন আরও কিছু বলার আছে৷ কিন্তু ইতস্তত করছেন৷

—‘কিছু বলবে?’

—‘না…৷’ কণা ইতস্তত করতে করতেই জবাব দেন—‘মানে…‘স্বদেশ’-এর সম্পাদক ফোন করেছেন৷ তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন৷ ওঁদের এবার একটা স্পেশাল সংখ্যা বেরোবে৷ তোমার লেখা চাইছিলেন…৷’ কথাটা বলে ফেলেই আস্তে আস্তে বাকি শব্দগুলো উচ্চারণ করলেন তিনি—

—‘তুমি কি কথা বলবে?’

—‘না৷’

এত রূঢ় ও স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন তিনি, যে কণাও চমকে ওঠেন৷ গহন একবারে সপাটে ‘না’ বলার লোক নন৷ গত পাঁচ বছর ধরে তিনি কোনো ম্যাগাজিনেই লিখছেন না৷ আক্ষরিক অর্থেই লেখা ছেড়ে দিয়েছেন৷ অথচ সবসময়ই সম্পাদকদের সঙ্গে কথা বলেছেন৷ সবিনয়ে নিজের অক্ষমতার কথা জানিয়ে নিরস্ত করেছেন তাঁদের৷ কিন্তু ‘না’ শব্দটা এত তীক্ষ্ণভাবে কোনোদিন বলেননি৷

কণা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাঁকে একবার দেখে নিলেন৷ তারপর আরও নম্র সুরে বললেন—‘তাহলে কি ওঁকে বারণ করে দেব? বলব যে, তুমি লিখতে পারছ না…৷’

—‘না৷’ দ্বিতীয়বার আবার সেই শব্দটাই উচ্চারণ করলেন তিনি৷ শার্টের বোতাম আটকাতে আটকাতে বললেন—‘জেনে নাও কবে দিতে হবে৷ কবিতা দেব আমি৷’

কণাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি৷ এক্ষুনি শুঁটকির কাছে পৌঁছোতে হবে৷ তাকে এই মুহূর্তে ভীষণ দরকার৷

শুঁটকি তখন বাড়িতেই ছিল৷ আজ সে দোকানে যাবে না৷ তার কবিতার কোটা প্রায় পূর্ণ হয়ে এসেছে৷ আর একটা লিখলেই ছাপ্পান্নটা হয়ে যাবে৷ তাহলেই একটা চার ফর্মার বইয়ের মালিক হবে সে৷ কবি হবে৷ শুঁটকি তার পাণ্ডুলিপির পাতাগুলো সযত্নে গুছিয়ে নিচ্ছিল৷ আর তার পায়ের কাছে বসে গোপাল গড়গড় করে ‘বীরপুরুষ’ কবিতাটা আবৃত্তি করছে৷

কিন্তু আবৃত্তিতে বাধা পড়ল৷ গহন দ্রুত পায়ে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকেছেন৷ শুঁটকি বিস্মিত দৃষ্টিতে তাঁকে দেখে নেয়৷ তিনি একটা কথাও না বলে সোজা সোফার ওপরে বসে পড়েন৷ কোনোদিকে খেয়াল নেই৷ চোখে-মুখে কাঠিন্য৷ নিশ্বাস দ্রুত৷ চোয়াল শক্ত করে কী যেন ভাবছেন৷

শুঁটকি একবার শুঁটকির মুখের দিকে তাকাল৷ একবার গহনের দিকে৷ বুঝতে পেরেছে এই মুহূর্তে তার এখানে থাকা উচিত নয়৷ সে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷

গোপাল একবার কিছুক্ষণ বন্ধুর দিকে তাকিয়ে থাকে৷ তারপর ফের কাগজ-পত্র গুছোতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে৷ পঞ্চান্নটা কবিতা একের-পর-এক ক্রমানুযায়ী সাজাচ্ছে৷ একটা আস্ত লোক যে সামনে ‘থ’ হয়ে বসে আছে— সেদিকে কোনো খেয়াল নেই!

নিজের বন্ধুকে সে খুব ভালোভাবেই চেনে৷ গহন এইমুহূর্তে কিছুক্ষণ একা থাকতে চান৷ কিছু একটার সঙ্গে মনে মনে মোকাবিলা করছেন৷ যখন তাঁর ইচ্ছে হবে তখন নিজেই কথা বলবেন৷

প্রায় আধঘণ্টা এভাবেই কাটার পর অবশেষে গহনই মুখ খুললেন৷ এখন তিনি অনেকটা শান্ত৷

—‘কী করছিস?’

শুঁটকি হেসে আবৃত্তি করার ভঙ্গিতে বলল—‘শূন্যের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে ফিরছিলাম আমি/আমার কৈশোর ছিল অর্থহীন/আমার যৌবন ছিল বেমানান—ফাঁকা৷/কীভাবে এত যে বিষ আমি চেয়েছিলাম জীবনে/আছে কি জীবন বলে আজও কিছু?—/ছাই৷ শুধু ছাই৷’

গহন বিস্ময়বিস্ফারিত দৃষ্টিতে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে থাকেন৷ শুঁটকি কি ম্যাজিক জানে? অথবা সে অন্তর্যামী!

—‘জল খাবি?’

তিনি প্রশ্নটার উত্তর না দিয়ে আত্মমগ্নভাবে বললেন—‘ভাস্কর চক্রবর্তী৷ তাই না?’

—‘হ্যাঁ, জিরাফের ভাষা৷ ‘ছয় নম্বর কবিতা’৷’

গহন ফের অন্যমনস্ক! একটা ঝড় এতক্ষণ বুকের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল৷ এখন যেন অঝোরে বৃষ্টি নামল৷ শুঁটকি বেছে বেছে এই কবিতাটাই আবৃত্তি করল কেন?

—‘জল খাবি কিনা বললি না তো!’

প্রসঙ্গ পালটে ফেললেন গহন—‘অতগুলো কাগজপত্র নিয়ে কী করছিস?’

সে রহস্যময় হাসি হাসছে—‘কবিতার বই ছাপাব৷ তারই প্রস্তুতি নিচ্ছি৷’

—‘তুই! কবিতার বই ছাপাবি!’ বিস্ময়ে প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন তিনি— ‘আগে বলিসনি তো!’

—‘বলে কী হবে?’ শুঁটকি হাতের কাগজপত্র সরিয়ে রেখেছে—‘তোকে তো বইয়ের কপি দিতে পারব না৷ কবিতা পড়াতেও পারব না৷ জানতে পারলে খিস্তি দিবি৷ তাই বেমালুম চেপে গিয়েছিলাম৷’

—‘কপি দিতে পারবি না মানে! বই ছাপাবি মানে মিনিমাম দুশো-তিনশো কপি বেরোবে৷ তার মধ্যে একটা কপি আমাকে দিবি না! ফাজলামি হচ্ছে!’

—‘ওই দেখ৷ তুই কিছু না জেনেই ফের সেন্টু খেতে লেগেছিস!’ সে বলে—! ‘আসল ব্যাপারটা একটু আলাদা৷ এ বইয়ের দুশো, তিনশো কপি আদৌ হবে না! হবে মাত্র এক কপি৷’

—‘এক কপি!’ পুরো ব্যাপারটাই মাথার ওপর দিয়ে গেল গহনের— ‘এতগুলো টাকা খরচ করে তুই শুধু এক কপি বই ছাপাবি! তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে!’

—‘মাথা আর কবে ঠিক ছিল? আমি হচ্ছি লগনচাঁদা ছেলে৷’ সে হো হো করে হেসে উঠেছে—‘এক কপিই আমার পক্ষে যথেষ্ট৷’

গহনের মনে হল গোটা ব্যাপারটাই তাঁর মাথায় তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে৷ শুঁটকির কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছেন না৷

শুঁটকিও বোধহয় বুঝতে পারে যে গহন কিছুই বোঝেননি৷ তাঁর পক্ষে বোঝা সম্ভবও নয়৷ একজন প্রখ্যাত কবি কি করে বুঝবেন যে সে কেন পয়সা খরচ করে মাত্র এক কপি বই ছাপাবে? এই বইটা সবার জন্য নয়৷ শুধু রুমার কাছেই শুঁটকি কবি হতে চায়৷ রুমাকে না-বলা কথাগুলো সে কবিতায় সাজিয়েছে৷ তা বারোয়ারি হবে কেন? এ শুধু তার আর রুমার নিভৃত সংলাপ! অন্য লোকের পড়ার অধিকার নেই৷ এমনকি গহনেরও নেই!

শুঁটকি মনে মনে চিন্তা করে, বইটাকে সে বাঁধিয়ে রাখবে৷ সামনে লাল ভেলভেটের মলাটের ওপর সোনার জলে নাম লেখা থাকবে তার৷ প্রতিটি পাতা ল্যামিনেট্রেড হবে৷ যেদিন জানালা দিয়ে জ্যোৎস্নার ফটফটে রুপোলি আলো এসে পড়বে বিছানার ওপর, হুহু করে দখিনা বাতাস আছড়ে পড়ে তৈরি করবে অদ্ভুত মূর্ছনা, হাস্নুহানার মদির গন্ধ ছড়িয়ে রুমা চুপি চুপি এসে বসবে রকিং চেয়ারে, সেদিন তার খোঁপায় জুঁইফুলের মালা পরিয়ে দেবে শুঁটকি৷ জুঁইফুল বড়ো ভালোবাসে রুমা৷ আর সারারাত ধরে একের-পর-এক কবিতা শুনিয়ে যাবে৷ এ কবিতাগুলো শুধু তার আর রুমার৷ আর কারুর নয়৷

—‘আমার কথা ছাড়৷ নিজের কথা বল৷ নতুন কোনো কবিতা লিখলি?’

গহন মাথা নাড়ালেন৷ তাঁর চোখ যেন জ্বলে ওঠে—‘এখনও লিখিনি৷ তবে এবার লিখব৷’

—‘এই তো চাই! সা-বা-শ!’ শুঁটকি খুশি হয়ে চেয়ারের হাতলে চাপড় মারে—‘এবার তবে অন্ধকারে যা গহন৷ অন্ধকারে যা৷ অন্ধকার তোকে ঠিক পথ চিনিয়ে দেবে৷ সঠিক পথ!’

পূর্ণদৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন গহন—‘সেইজন্যই তোর কাছে এসেছি৷ একটু অন্ধকার দিতে পারিস আমায়? নিস্তরঙ্গ অন্ধকার?’

সে তাঁর দিকে তাকিয়ে সম্মতিসূচক হাসি হাসে৷

—‘একটু বোস৷’

.

‘মিথ্যে দিয়ে ঘেরা এই পৃথিবীর শেষ সত্য দেখতে চাই আমি

যে হিংস্রতা আমাকে পোড়ায় প্রতিদিন

যে নিষ্ঠুরতার কাছে প্রতিদিন হেরে যাই আমি—

স্নায়ুহীন আলোর সমাজে

একটি ওঙ্কার ধ্বনি টের পেতে চাই আমি৷

এই শুধু, শুধু মাত্র এই৷’

সামনে নিঃসীম অন্ধকার৷ ঘরের সব জানলা বন্ধ৷ কোনোদিক দিয়ে সামান্য আলোর ক্ষীণ রশ্মিও আসছে না৷ চতুর্দিকে স্থির নিস্তব্ধতা৷ মাতৃজঠরের মতো শব্দহীন, আলোহীন শান্তি৷

কবি অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না৷ অবশ্য দেখতেও চাইছিলেন না৷ অস্থিরভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন অন্ধকারে৷ হোঁচট খাচ্ছেন৷ ঠোক্কর খাচ্ছেন৷ মাঝেমধ্যেই অপ্রয়োজনীয় কিছু কঠিন বস্তু ধাক্কাও মেরে যাচ্ছে৷ তবু সামলে নিচ্ছিলেন৷

কবির ঠিক সামনে একটি কাচের আয়না ছিল৷ আর কিছু টের না পেলেও আয়নাটার মসৃণ অস্তিত্ব টের পেয়েছেন৷ দেখতে না পেলেও আন্দাজ করতে পারেন, সেই আয়নাটায় এখন এক নগ্ন অন্ধকারের প্রতিবিম্ব পড়েছে৷

হাত দিয়ে সেই অন্ধকারের প্রতিবিম্বকে স্পর্শ করতে চাইলেন গহন৷ অন্ধকার মানুষ চেনে৷ চেহারা নয়, কণ্ঠস্বর নয়, তাঁর অন্দরের উলঙ্গ সত্তাকে চিনে নিতে অসুবিধে হয় না৷ গহনের মনে হল তার আঙুলগুলো সেই স্থির আঁধারে আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে৷ আঙুলগুলো স্পর্শ করছে এক অনাবিল বাস্তবকে৷ স্পর্শ করছে সেই শব্দগুলোকে যা আজ সকালেই শুনেছেন৷

মেয়েটা প্রেগন্যান্ট ছিল!
এক ফিনিক্স পাখি জন্ম নিতে চেয়েছিল৷
প্যান্ডোরার বাক্সে বন্দি অনুভূতির রাজ্যে
দু-ফোঁটা চোখের জল ফেলতে চেয়েছিল সে৷
রোজ চেতনার সতীচ্ছদ ছিন্নভিন্ন করে নপুংসকের দল—
বিষাক্ত ঔরস রক্তাক্ত যোনিবর্ত্মে অনুপ্রবেশ করে
জন্ম দিতে চায় আর একদল মেফিস্টোর!
 
তবু জন্মাতে চেয়েছিল ফিনিক্স পাখিটা
তখন কালীঘাটের বস্তিতে তাড়ি সহযোগে বিষ পান করেছে
ক্লান্ত অর্ফিয়ুস৷
পার্কস্ট্রিটের আলোঝলমলে চোখে কখন যেন আচমকা
ভেসে উঠেছিল একলা হ্যামলিন!
তার জন্মক্ষণে কেউ বাঁশি বাজায়নি৷
জলভরা থলিতে শুয়ে সে শুনেছিল মাতালের চিৎকার৷
 
আর কতদিন রাংতা মোড়া আলেয়ায়
নিষ্ফল পদচারণা করে যাব!
আর কতদিন নেঁচে, কুঁদে মৈথুনিয়ে—ব্যর্থ শুক্রকীটের
মতো ভেসে বেড়াব নীল গহ্বরে!
স্বপ্নের সমাধিতে প্রস্রাব করে বলব—‘আমি
পৃথিবীর শেষদিন পর্যন্ত বাঁচতে চাই!’
রমানাথ মিস্তিরি, ছেদীলাল পিয়োনের ধর্ষকামী রিরংসার জ্বালায়
সিতিমার অশ্রু দেখে লাফিয়ে উঠব নিজের আবিষ্কারে—‘আহা চাঁদে জল আছে!’
ফিনিক্স পাখিটা জন্ম নিতে পারত৷
ঝলমলে ডানায় রোদের টুকরো নিয়ে
সাজিয়ে দিতে পারত পাতায় পাতায়৷
অথচ জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেল নির্নিমেষে!
স্বপ্ন পুড়ে যাওয়ার আগে
নিজেকেই ভস্মীভূত করে গেল নীরব প্রতিবাদে৷
 
এই দ্যাখো, সেই ভস্মে হাত রেখেছি আমি—
ভস্মাচ্ছাদিত হয়ে দাঁড়িয়েছি প্রশ্নের মুখোমুখি!
যে আঁধার অকুতোভয়ে সহ্য করেছে বীভৎস পাশবিকতা
আজ সেই অনঙ্গ অন্ধকার প্রশ্ন হয়ে ছাত থেকে ঝুলছিল
একা!
আমি দেখেছি তার গর্ভে ফিনিক্সের পচাগলা শব৷
আমি মেখেছি তার ছাইভস্ম৷
প্রশ্নটা মৃত মাছের দৃষ্টিতে দেখছিল আমায়
দেখো না—ভয় পাই!

গহন থামলেন৷ তাঁর হাত কাঁপছিল৷ একটা কান্না গলা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠছিল বারবার৷ আর থাকতে পারলেন না৷ একটা ভাষাহীন কাঁপুনি তাঁকে ভেঙে দিচ্ছিল৷ টুকরো টুকরো করে দিচ্ছিল৷…

.

পুরো ছাপ্পান্নটা!

শুঁটকির আজ বড়ো আনন্দের দিন৷ গতকাল রাতেই শেষ কবিতাটা লিখে ফেলেছে৷ আজই পাবলিশারের কাছে যাবে৷ তার মনের ভেতরে অস্থিরতা! যতদিন লেখা সম্পূর্ণ হয়নি ততদিন ধৈর্য ছিল৷ কিন্তু এখন ধৈর্য জবাব দিয়ে দিয়েছে৷ সে মনে মনে ভাবছিল, কতদিনে বইটা হাতে পাবে৷ কেমন দেখতে হবে! বুবাইয়ের ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিনে ঠিক যেমন একটা ভয়—উৎকণ্ঠা মেশানো আনন্দ তিরতির করে কাঁপছিল, তেমনই একটা উত্তেজনা খেলে বেড়াচ্ছিল তার রক্তে৷

—‘গোপাল, বল তো আজ কোন দিন?’

গোপাল মাথা চুলকে জবাব দেয়—‘বিষ্যুদবার৷’

—‘ধুর পাগল, আজ যে বৃহস্পতিবার তা আমিও জানি৷’ সে হেসে বলে—‘আর কি বল তো?’

গোপাল বিমূঢ় হয়ে মাথা নাড়ে৷ আজ স্বাধীনতা দিবস নয়৷ হলে পাড়ার ছেলেরা মোড়ের মাথায় তিনরঙা পতাকা টাঙাত৷ আজ ভ্যালেন্টাইন ডেও নয়৷ তাহলে হোর্ডিঙে—ছেলেমেয়েরা মাথা, মুখ ঠোকাঠুকি করত৷ তবে আজ কী দিন?

সে আমতা আমতা করে বলে—‘তালে?’

—‘আজ আমার জন্মদিন৷’ শুঁটকি হাসল—‘বল বিকেলে কী খাবি?’

গোপালের সপাট উত্তর—‘মাছ-ভাত৷’

—‘বোঝো!’ তার হাসি পেয়ে যায়—‘মাছ-ভাত তো রোজই খাস৷ আজ কী খাবি? যা বলবি তাই খাওয়াব৷’

গোপাল অনেক ভেবেচিন্তে উত্তর দিল—‘মাছ-ভাত৷’

শুঁটকি হাল ছেড়ে দেয়৷ গোপালের দোষ নেই৷ জীবন ওর গ্রামাফোনের পিন-টা মাছভাতের ওপরই আটকে রেখেছে৷ যতই জিজ্ঞাসা করা হোক রেকর্ডে ‘মাছ-ভাত’-ই বাজবে৷

সে মনে মনে ঠিক করে বিকেলে দোকান থেকে ফেরার পথে বিরিয়ানি কিনে আনবে৷ গোপাল কখনও বিরিয়ানির স্বাদ পায়নি৷ আজ একবার চোখই দেখুক৷

—‘ঠিক আছে৷ বিকেলে ভেবে দেখব’খন৷’

কোনোমতে স্নান করার নামে কয়েক মগ জল গায়ে ঢেলে, নাকে-মুখে দুটো গুঁজে সে তৈরি হয়ে নিল৷ প্রথমে কিছুক্ষণের জন্য চশমার দোকানে হাজিরা দেবে৷ তারপর সিধে কলেজ স্ট্রিট৷

আজ রাস্তাতে ট্র্যাফিকের করুণ দশা! অন্যান্য দিনও যে খুব ভালো পরিস্থিতি থাকে তা নয়৷ কিন্তু আজকের চাপটা একটু অস্বাভাবিক৷ স্কুল-অফিসের তাড়া, সবই ঠিকঠাক আছে৷ তবু সবকিছুর মধ্যে অদ্ভুত একটা সন্ত্রস্ত ভাব!

কোনোমতে দোকানে পৌঁছোতেই থমথমে পরিবেশের কারণটা বোঝা গেল৷ তার এক কর্মচারী বিশু জানাল—‘দাদা, আইজ আমি তাড়াতাড়ি ঘর ফিরুম৷ দুইটার আগে আমারে ছুটি দেন৷’

শুঁটকি তখনও ভালোভাবে নিজের চেয়ারটাতে বসতে পারেনি৷ তার আগেই এ-হেন আবদার শুনে তার ভুরু কুঁচকে গেছে৷ আজ কি সকলেরই বিশেষ দিন নাকি!

—‘কেন?’

—‘টি.ভি.-তে দ্যাখেন নাই?’ বিশু অম্লানবদনে জানায়—‘সরকারি পাট্টির লোকেরা বিরোধীর তিনটারে মারসে৷ দুফর দুইটায় প্রতিবাদ মিছিল বাইরইবে৷ ম্যালা ঝকমারি৷ তায় আবার পায়ে বাত৷ যাইতে সময় লাগবেনে৷ আমি চান্স নিমু না৷ দুইটার আগেই শ্যালদা পারাইয়া যামু৷’

সে ভুরু কুঁচকে কি যেন ভাবছিল৷ তিনটের সময় তার কলেজ স্ট্রিট পৌঁছোনোর কথা৷ পাণ্ডুলিপি জমা দিতে হবে৷ ‘শিয়ালদা’ নামটা শুনে তার মাথায় তিনজন মানুষের খুন হওয়ার কথা মনে পড়ল না৷ মনে পড়ল না প্রতিবাদ মিছিল ও তার আনুষঙ্গিক সমস্যার কথা৷ শুধু মনে হল কতক্ষণে পৌঁছোতে পারবে! রাস্তায় যদি ট্রাফিকের চাপ থাকে তবে সময়মতো অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখতে পারবে তো!

শুঁটকির কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে৷ অন্যমনস্কভাবে বিশুকে বলল—‘ঠিক আছে, তুই আগেই বেরিয়ে যাস৷’

—‘আইচ্ছা৷’ সে খুশি হয়ে মাথা নেড়ে কাউন্টারে ফিরে যায়৷ সহকর্মীদের সঙ্গে দেশের হাল নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করে৷

বেলা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই দোকানে ক্রেতাদের ভিড় বাড়ছিল৷ সেদিকে মন নেই শুঁটকির৷ আজ কাউকে ধরে কবিতা শেখানোর ইচ্ছেও দেখা গেল না তার৷ অস্থির হাতটা মাঝেমধ্যেই ব্যাগের ভিতরের কাগজের তাড়াটাকে স্পর্শ করছে৷ ওদিকে ঘড়িটাও আজকে বড়ো আস্তে চলছে৷ সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টার কাঁটা যেন আর নড়তেই চায় না৷

—‘হ্যাঁ রে৷’ অনেকক্ষণ উশখুশ করে শেষ পর্যন্ত আর থাকতে না পেরে, পাশে দাঁড়িয়ে আরেক কর্মচারীকেই জিজ্ঞাসা করে বসল সে—‘ক-টা বাজে? আমার ঘড়িটা বোধহয় স্লো যাচ্ছে৷’

কর্মচারীটি বিস্মিত দৃষ্টিতে তার হাতের ঘড়িটার দিকে তাকায়৷ তারপর আস্তে আস্তে বলে—‘বারোটা কুড়ি দাদা৷’

—‘এখনও সাড়ে বারোটা বাজেনি!’

এলাহাবাদ থেকে শুরু করে অক্ষরেখা-দ্রাঘিমারেখা সবার ওপরই বিরক্ত হল শুঁটকি৷ এ কী জাতীয় চক্রান্ত! আজ কি সময়টা একটু তাড়াতাড়ি এগোতে পারে না! না তারও পায়ে বাত ধরেছে!

সে অন্যমনস্কভাবে বলে—‘তোরা দোকানটা দেখ, আমি একটু বেরোচ্ছি৷’

প্রত্যুত্তরের অপেক্ষায় না থেকে দোকান থেকে বেরিয়েই পড়ল শুঁটকি৷ বাইরে তখন কাঠফাটা রোদ্দুর৷ শোরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল তার৷ তপ্ত কাঞ্চনবর্ণ রোদ নির্বিচারে উষ্ণতা ঢেলে যাচ্ছে শহরের ওপর৷ পিচের গরম রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়ে ভুঁড়িওয়ালা ট্রাফিক পুলিশ নিরন্তর মূকাভিনয়ে ব্যস্ত৷ তার মধ্য দিয়েই কখনও রুপোলি, কখনও সোনালি, কখনো-বা চেরি রঙের ঝিলিক মেরে বিদ্যুৎগতিতে বেরিয়ে যাচ্ছে গাড়ি৷

—‘বাবা, শ্যালদা যাবে?’

সে তখন ফুটপাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ভাবছিল কোথায় যাবে! শোরুমের এ.সি.র নিষ্প্রাণ শীতলতা ভালো লাগছিল না৷ চশমার কেনা-বেচা ফ্রেমের ডিজাইন, লেন্সের পাওয়ার, ক্যাশবাক্স, পাঁচশো, হাজার টাকার নোট—কোনোটাই এই মুহূর্তে অভিপ্রেত নয়৷ জাগতিক বস্তুর মোহ থেকে সে যে আজ বহুদূরে দাঁড়িয়ে, সে কথা কে বুঝবে!

তাই ভাবছিল যে এখন থেকে তিনটে অবধি কোথায় যাবে, কী করবে৷ কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে আসার আগেই ভাবনায় ছেদ পড়ল৷

এক বুড়ি পরনে জন্মের নোংরা কাপড়চোপড়! হাতে দগদগে একটা ভীষণদর্শন ঘা৷ হাতের পুঁটুলিটা তার জামাকাপড়ের চেয়েও নোংরা৷ চামড়া ওঠা বলিরেখাময় মুখে অসহায়তার ছাপ৷ কুঁকড়ে যাওয়া মুখটাকে কুণ্ঠায় আরও কুঁকড়ে বলল—‘দশটা ট্যাকা নয় বেশি দেব! শ্যালদা যাবে বাবা?’

শুঁটকি প্রথমে অবাক হল৷ কথাটা বলেই পিচুটিমাখা পিটপিটে চোখে তার দিকে দেখছে বুড়ি৷ সর্বনাশ! ট্যাক্সি ড্রাইভার ভেবেছে নাকি! হঠাৎ মনে পড়ল যে, আজ সে অ্যাশ কালারের সাফারিস্যুট পড়েছে৷ আর চেহারাটাও ট্যাক্সি ড্রাইভারেরই অনুকূলে!

সে হেসে ফেলে৷ বুড়ির ভুলটা ভাঙিয়ে দিতেই যাচ্ছিল! তার আগেই সে খুনখুন করে বলল—‘না হয় পনেরো ট্যাকাই বেশি নিয়ো৷ কিন্তু পৌঁচে দাও৷ আল্লা তোমার ভালো করবেন৷ আমি দোয়া করব৷’

শেষ দুটো কথা শুঁটকির বড়ো ভালো লাগল৷ সে ঈশ্বরবিশ্বাসী নয়৷ কিন্তু পনেরো টাকা বেশি দেওয়ার মধ্যে যে দুনিয়াদারির ছোঁয়া ছিল, শেষ দুটো বাক্যের আন্তরিকতা তাকে আদ্যন্ত মুছে দিল৷ আপাতদৃষ্টিতে দোয়ার চেয়ে টাকাটা অনেক বেশি লোভনীয়৷ কিন্তু পরের জিনিসটার জন্য বড়ো লোভ হল শুঁটকির৷ প্রার্থনা কার কাছে করা হচ্ছে সেটা বড়ো নয়৷ কিন্তু তার জীবনেও প্রার্থনা করার কেউ আছে, তার জন্যও ‘দোয়া’ করতে একজোড়া হাত অসীমের দিকে উঠবে—এটা ভেবেই খুশি হল৷

—‘বেশ৷’ সে এক মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে৷ নিজের গাড়ির পিছনের দরজা খুলে দিয়েছে—‘এসো বুড়োমা৷’

বুড়োমা গাড়ি দেখে হকচকিয়ে গেছে৷ সে একটা কালো-হলুদ রঙের ট্যাক্সি আশা করেছিল৷ তার জায়গায় একটা স্টিল কালারের জেন!

শুঁটকি তার মনোভাব বুঝল৷ শান্তস্বরে বলে—‘আমার ট্যাক্সিটা গ্যারাজে গেছে৷ এটা মালিকের গাড়ি৷ তুমি উঠে এসো৷’

বুড়ি ভয়ে ভয়ে পিছনের সিটে বসেছে৷ তার ছোট্ট শরীরটা আরও গুটিয়ে আছে৷ যেন সে অচ্ছুৎ! গাড়ির গায়ে তার হাত লাগলেই পুরো গাড়িটা অপবিত্র হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা৷

—‘আরাম করে বসো৷ অত ভয় পাচ্ছ কেন?’

শুঁটকি তাকে আশ্বস্ত করে৷ একটু একটু করে বুড়োমার জড়তা কাটে৷ তারপর আস্তে আস্তে জানায় তার ইতিহাস৷

সে ট্রাফিক সিগন্যালের সামনে বসে ভিক্ষে করে৷ আগে তার এত দুরবস্থা ছিল না৷ তার বুড়ো শিয়ালদায় রিকশা টানত৷ একবার সেই যে মুখ থুবড়ে পড়ল, আর উঠল না৷ তারপর থেকেই এই দুর্দশা! আজ ঠা ঠা রোদে শরীর খুব খারাপ লাগছে৷ সকাল থেকে যে টাকা জমেছে তা সম্বল করেই ট্যাক্সি ধরার দুঃসাহস দেখাতে হয়েছে৷ কিন্তু কোনো ড্রাইভারই ঘেন্নায় তাকে গাড়িতে তুলতে চায় না৷ আল্লার অনেক মেহেরবানি যে শুঁটকির মতো মানুষও পৃথিবীতে আছে!

শুঁটকি তার ইপ্সিত জায়গায় তাকে নামিয়ে দিল৷ বুড়ি পুঁটুলি থেকে কয়েকটা নোট বের করে এনেছে৷

—‘বুড়োমা, টাকা তোমার কাছেই থাক৷’ সে হেসে বলল—‘আমার দোয়াই যথেষ্ট৷’

বুড়ির শুকনো চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে৷ কী বলবে যেন ভেবে পায় না৷ কোনোমতে ধরা গলায় বলে—‘তোমার সব খোয়াব সাচ্চা হোক বাবা৷ তোমার মধ্যে খোদা আছে৷ তোমায় খোদা ভালোবাসেন৷ তার প্যায়ার সবসময় সঙ্গে থাকুক৷’

শুঁটকি তার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতেই ফের টের পেল পরিচিত মিষ্টি গন্ধটা৷ সামনের আয়নায় দেখল বুড়োমা যেখানে বসেছিল, ঠিক সেখানেই বসে হাসছে রুমা৷ এখন আর সে ছায়া হয়ে নেই৷ বরং ঝাপসা ঝাপসা অবয়ব নিয়ে বসে৷ যেন ঘষা কাচের ওপ্রান্তে বসে আছে৷

সে-ও তার দিকে তাকিয়ে হাসল৷ দিনটা আজ বড়ো সুন্দর৷ আজ রুমাকে সবচেয়ে বড়ো উপহার দেবে৷ রুমা আর রাগ করে থাকতে পারবে না৷ ফিরে আসতেই হবে তাকে৷ ফিরে আসতেই হবে…৷

‘ফুরায় না তার যাওয়া, এবং ফুরোয় না তার আসা,
ফুরোয় না সেই একগুঁয়েটার দুরন্ত পিপাসা৷
সারাটা দিন আপনমনে ঘাসের গন্ধ মাখে
সারাটা রাত তারায় তারায় স্বপ্ন এঁকে রাখে৷
ফুরোয় না তার, কিছুই ফুরোয় না,
নটেগাছটা বুড়িয়ে ওঠে, কিন্তু মুড়োয় না৷
ভালোবেসে মেঘলা আকাশ দেবে,
কিংবা চোখে অনন্ত মৌসুমী?
ভালোবাসা কান্না ভালোবাসে
এ কথা কি জানতে আগে তুমি?’

.

কবিতা ডট কমের ‘আকাশনীল’ কবিতাটা আজ সকালেই পোস্ট করেছে৷ মন্দার একঝলক দেখেই চোখ সরিয়ে নেয়৷ তার আজ কিছুই ভালো লাগছে না৷ কবিতাও নয়৷

সামনে বেশ কয়েকটা বই পড়ে আছে৷ ওগুলো পড়ে রিভিউ লিখতে হবে৷ ল্যাপটপে জ্বলজ্বল করছিল ‘কবিতা ডট কম’৷ তবু কিছুতেই শান্তি নেই৷ আগে কখনও এমন হয়নি মন্দারের৷ শুধুমাত্র একটি মানুষের অনুপস্থিতি যে সমস্ত কিছুকেই ব্যর্থ করে দিতে পারে, এ ধারণা তার ছিল না৷ এমনকি—উশ্রী যখন তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল তখন একটা চিড়বিড়ে জ্বালা তাকে জ্বালিয়ে মারছিল৷ কিন্তু এখন কোনো জ্বালা নয়, কোনো যন্ত্রণা নয়, ব্যর্থতা আর হতাশা এসে জমেছে বুকে৷ অদ্ভুত একটা ব্যথা যার বর্ণনা করা সম্ভব নয়—তেমনই একটা ব্যথা বারবার চিনচিন করে উঠছে৷

এই নিয়ে সাতদিন হল ঊর্মি ফোন করেনি৷ তার ফোন তোলেনি৷ কথা বলেনি, দেখা করেনি৷ মেসেজের উত্তরও দেয়নি৷ এমনকি শুটিং-এও হানা দিয়েছিল সে৷ কিন্তু ঊর্মি সেখানেও নেই! মন্দারের মনে হচ্ছিল সারা দুনিয়ায় এখন আগুন লাগুক, সুনামিতে ভেসে যাক সমস্ত ভারতবর্ষ৷ ঊর্মির সাড়া না পেলে, সঙ্গ না পেলে সব অর্থহীন! ঊর্মি না থাকলে—সব ফাঁকা৷

কী অন্যায় মন্দার? ঊর্মির সঙ্গে মিশতে মিশতে হঠাৎই তার মনে হয়েছিল জীবন বড়ো সুন্দর! একদিন আবিষ্কার করল, ঊর্মিকে তার প্রয়োজন৷ ভীষণভাবে প্রয়োজন! শুধু একঘণ্টা-দু’ঘণ্টায় তার মাধুর্যটুকু যথেষ্টভাবে উপভোগ করা হচ্ছে না৷ সারাজীবন ধরে সে তাকে পাশে চায়৷ ওই নরম হাত তার হাত দুটো জড়িয়ে ধরুক৷ সারাজীবন পাশে পাশে হাঁটুক৷ ফুচকা, চিনেবাদাম খেয়ে টাইম পাস করুক—কিন্তু লাইফ টাইমের জন্য৷

এক সুন্দর বিকেলে সাহস করে মনের কথাটা বলে ফেলেছিল সে৷ ঊর্মির স্পর্শ যে তার দেহে বিদ্যুৎ সঞ্চার করে, সে হাসলে মনে হয় সব জ্বালা ভুলে গিয়ে ঊর্মির নরম কোলে মুখ গুঁজে দেয়—সব বলেছিল৷ ভীষণ আবেগে তার হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে বলেছিল—‘তুমি আমার জীবনে এসো ঊর্মি৷ আমি তোমাকে চাই৷’

ঊর্মি তড়িদাহতের মতো চমকে ওঠে৷ হাত দুটো সজোরে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে—‘কী বলছ? পাগল হয়ে গেলে নাকি?’

—‘এখনও হইনি৷’ মন্দার তার হাত দুটো ফের জড়িয়ে ধরেছে—‘কিন্তু একবার হ্যাঁ বলে দ্যাখো৷ আনন্দে সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে যাব৷ পার্কস্ট্রিটে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলব—‘আমি ঊর্মিকে ভালোবাসি৷’ দরকার পড়লে পেন্ডুলামকেও চুমু খেয়ে থ্যাঙ্কস জানাব৷ ঊর্মি, তুমি আমার জীবনে এলে আমি পাগল হতেও রাজি৷’

ঊর্মির চোখে জল জমেছিল৷ সে দৃঢ় গলায় বলে—‘তা হয় না৷’

—‘কেন?’

—‘তুমি আমার সম্বন্ধে কতটুকু জানো?’

এ প্রশ্নটার জন্য তৈরি ছিল মন্দার৷ সেই লোকটা আগেই তাকে বলে রেখেছিল৷

—‘তোমার সারনেম চ্যাটার্জি, সাউথ সিটিতে মা, বাবা, দিদির সঙ্গে থাকো, ঝাল সহ্য করতে পারো না, কিন্তু খাদ্যরসিক৷ হলুদ আর কমলা রং পছন্দ, তোমার রাশি কন্যা, কবিতা পড়তে ভালোবাসো—এসব তো আমি জানি৷’

—‘না সবটা জানো না৷’ রাগে ঊর্মির নাকের পাটা ফুলে ওঠে—‘আসল জিনিসটাই জানো না৷ তুমি জানো আমার অতীত কী?’

—‘দরকার নেই ঊর্মি৷ আমি শুধু জানি তোমাকে ছাড়া আমি এক পাও এগোতে পারব না৷’

ঊর্মি শুধু দৃঢ়স্বরে বলে—‘না৷’

মন্দার ব্যথা পেল৷ ব্যথিত স্বরে বলল—‘না কেন? তুমি আমায় পছন্দ করো না? ভালোবাসো না?’

—‘না, সে অধিকার আমার নেই৷’

—‘অধিকারের প্রশ্ন উঠছে কোথা থেকে?’

তার দিকে তর্জনী তুলে বলল ঊর্মি—‘তুমিই তুলেছিলে প্রশ্নটা৷’

—‘আমি!’

মন্দার কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি৷ ঊর্মি কি বলছে! ভালোবাসার অধিকার! প্রশ্ন!

—‘জানতে চাও তুমি কাকে ভালোবাসো?’ সে উত্তেজিত গলায় বলে— ‘দেখে নাও তবে…৷’

বলতে বলতেই নিজের মাথার চুল ধরে টানল! মন্দার স্তম্ভিত! গোটা চুলের গোছাটাই ঊর্মির হাতে! আসলে ওটা উইগ! ঊর্মির মাথায় একটা চুলও নেই! সম্পূর্ণ খাঁ খাঁ করছে৷

সে চমকে উঠেছিল৷ কিন্তু আরও চমক বাকি ছিল৷ নিজের হাতেই তার ধনুকের মতো ভুরু দুটোও খুলে ফেলল ঊর্মি৷ সে দুটোও নকল৷ তার ভুরুও নেই! মন্দারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক বিরলকেশ, ভুরুহীন নারী৷

মন্দারের মুখে কোনো কথা জোগায় না৷ সে বাকশক্তিরহিত৷ ভাষা হারিয়ে ফেলেছে৷

—‘ষোলো বছর বয়সে একটা রোগ হয়েছিল৷ ‘অ্যালোপেশিয়া ইউনিভার্সালি’ বলে রোগটাকে৷’ গলা কাঁপছে ঊর্মির—’খুব বড়ো ক্ষতি কিছু হয়নি৷ শুধু মাথার চুল, ভুরু, গায়ের লোম—সব ঝরে গিয়েছিল৷ আর কখনও গজায়নি৷’

বলতে বলতেই সে কান্নায় ভেঙে পড়ে—‘রোগটা না হলে লোকে আমায় উশ্রীর মতোই সুন্দরী বলত৷ কিন্তু আমি একটা কুৎসিত বাস্তব! এক অসম্পূর্ণ নারী৷ ঘর-সংসার, সন্তানের স্বপ্ন দেখার অধিকার নেই আমার৷ কাউকে ভালোবাসতে পারি না, কবির কল্পনা হওয়ার যোগ্যতাও নেই৷ কখনও মাথায় ফেট্টি বেঁধে, ভুরুঢাকা চশমা পরে, কখনও বা বিদেশি উইগ, নকল ভুরু পরে একটা নকল জীবনযাপন করি৷ এবার বলো, কবির প্রেমিকা হওয়ার যোগ্যতা আছে আমার?’

ঊর্মি একটু থামল, মন্দার তখনও তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে৷ সে তখন অন্যকথা ভাবছিল৷ স্বপ্নে একবার ঊশ্রীকে এমনই বিরলকেশ অবস্থায় দেখেছিল৷ চুল ছাড়া তাকে জঘন্য দেখাচ্ছিল৷

কিন্তু ঊর্মিকে তো অত খারাপ লাগছে না! বরং অভিমানাহত ভিজে চোখের দৃষ্টিতে, স্ফুরিত অধরে তাকে আরও সুন্দরী মনে হচ্ছিল! মন্দারকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফুঁসে উঠেছিল ঊর্মি৷—‘এবার কথা বেরোচ্ছে না কেন মুখ থেকে? তুমিই তো আমার প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলে যে ‘কবির প্রেমিকার মাথায় ঘন চুল থাকাটা মাস্ট’, প্রেমিকার মাথার ঘন চুলটাই কাব্যিক৷ মনে পড়ে?’ তার চোখ কান্নায় লাল হয়ে গেছে৷ কোনোমতে বলল— ‘আর কখনও আমার সঙ্গে যোগাযোগ কোরো না মন্দার৷ আমি কবির প্রেমিকা হওয়ার যোগ্য নই৷’

বলতে বলতেই সে ছুটে চলে গিয়েছিল৷ মন্দার নির্বাক হয়ে তার চলে যাওয়া দেখে৷ কী বলল ঊর্মি! এসব কথা মন্দার তাকে কবে বলেছে? সে তো এগুলো কবিতা ডট কমে কুবলাশ্বকে বলেছিল! তবে ঊর্মি…৷ তার মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়৷ বিস্মিত স্বরে আপনমনেই বলে—‘ঊর্মি কুবলাশ্ব!’

ঊর্মিই যে আসলে কুবলাশ্ব হতে পারে তা সে কখনও কল্পনা করতে পারেনি৷ যখন জানল তখন প্রথমে স্তম্ভিত হয়েছিল৷ পরে ঊর্মির ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকা, কবিতা সম্পর্কে গভীরতা, বিস্তারিত আলোচনা—সব একের-পর-এক মিলিয়ে দেখছিল৷ ঊর্মিকে সে ভালোবাসে, আর কুবলাশ্বকে শ্রদ্ধা এবং সমীহ—দুটোই করে৷ ঊর্মি কুবলাশ্ব না হলে তাতে ব্যথা পেত মন্দার৷ কিন্তু এখন হারানোর কথা ভাবতেই পারছে না!

সে আবার ডায়াল করল ঊর্মির নম্বর৷ ক্রমাগতই বেজে যাচ্ছে! তুলছে না কেউ৷ কেটে দিয়ে আবার ফোন করল৷ এবারও ফোন নিরুত্তর! মন্দারের মুখ শক্ত হয়ে ওঠে৷ আজই ব্যাপারটার এস্পার কি ওস্পার করে ছাড়বে সে৷ ঊর্মিকে তার সঙ্গে আজ কথা বলতেই হবে৷ সব সিদ্ধান্ত সে একা নিতে পারে না৷ মন্দারের কথাও তাকে শুনতেই হবে৷ শুনিয়েই ছাড়বে তাকে৷

সে ঘড়ির দিকে তাকায়৷ প্রায় তিনটে বাজতে যায়৷ স্টুডিয়োতে এখন উশ্রীর সঙ্গে যায় না ঊর্মি৷ অতএব তাকে বাড়িতেই পাওয়া যাবে৷

অসময়েই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল মন্দার৷ তার মনে তখন অটুট সংকল্প! আজ ঊর্মিকে ছাড়বে না সে৷ মুখোমুখি দাঁড়াতেই হবে৷ তার সব প্রশ্নের জবাব আজ সে পাবে৷ আজ মন্দার তাকে কোনো মূল্যেই ছাড়ছে না!

—‘তুমি!’

দরজা খুলেই প্রায় ভূত দেখার মতো চমকে উঠল ঊর্মি৷ সে সপাটে মুখের উপর দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিল৷ তার আগেই দরজার ফাঁকে পা গলিয়ে দিয়েছে মন্দার৷

—‘দাঁড়াও৷’

ঊর্মির চোখে সেই পাঁউরুটি ফ্রেমের চশমা, মাথায় ফেট্টি৷ তার মুখ লাল হয়ে উঠেছে—‘কেন এসেছ? তোমার এত বড়ো সাহস!’

—‘সাহসের এখনও কিছুই দ্যাখোনি তুমি৷’ মন্দার অদ্ভুত রকমের বেপরোয়া! সে এক ঝটকায় দরজা খুলে ফেলে জোর করেই ভেতরে ঢুকল—‘কিন্তু আজ দেখবে৷’

উশ্রী এখন শুটিংয়ে৷ ঊর্মির মা-বাবা এই সময়ে অফিসে থাকেন৷ ঊর্মিকে বাড়িতে একা পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি ছিল৷ মন্দার দেখল, তার আন্দাজ সম্পূর্ণ সঠিক৷ বাড়ি একদম ফাঁকা৷ সে পিছন ফিরে দরজায় ছিটকিনি তুলে দেয়৷ ঊর্মি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকে লক্ষ করছে৷ কোনোমতে বলে—‘কী করছ?’

—‘যা অনেক আগেই করা উচিত ছিল৷’

—‘মন্দার, পাগলামি করো না৷’

—‘আমি বিন্দুমাত্রও ‘পাগলামি’ করছি না৷’ সে ঊর্মির দিকে এগোতে থাকে—‘আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো৷ সেখানে পাগলামি নেই৷’

মন্দারের চোখে অদ্ভুত জেদ! ঊর্মি ভয় পেয়ে পিছোতে থাকে৷

—‘আমি চ্যাঁচাব মন্দার…এগিয়ো না…৷’

—‘আজ স্বয়ং ঈশ্বর এলেও আমাকে ঠেকাতে পারবে না৷’ সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল—‘চ্যাঁচাও…কত চ্যাঁচাতে পারো৷’

বলতে বলতেই মন্দার জাপটে ধরেছে ঊর্মিকে৷ তার বাহুবন্ধনের মধ্যে বনবিড়ালের মতো খণ্ডযুদ্ধ করছে মেয়েটা৷ হাতের নখে ছড়ে গেল মন্দারের গাল৷ তবু সে তাকে বুকের ওপর আরও শক্ত করে চেপে ধরেছে৷

—‘ছেড়ে দাও…৷’ ছটফট করতে করতে বলল ঊর্মি…—‘আমার লাগছে৷’

—‘চোপ!’

প্রেম মানুষকে হয়তো বন্য করে তোলে৷ করে তোলে শক্তিশালী৷ যে মন্দার আগে উশ্রীর সামনেই দাঁড়াতে ভয় পেত, সে যে কখন ছেলে থেকে পুরুষ হয়ে গেল তা কেউ জানে না! প্রেম শেখায় যে তার নিজের, তাকে যে-কোনো মূল্যে পেতে হবে৷ তার জন্য অল্প বলপ্রয়োগও দোষের নয়!

শান্তশিষ্ট হিসাবে পরিচিত মন্দারের উগ্র ধমক খেয়ে ঊর্মি হতভম্ব! মন্দার তখন মাথার ফেট্টি টান মেরে খুলে ফেলেছে৷ চশমাটাও একটানে চোখ থেকে সরিয়ে নিয়েছে৷

—‘আর কতদিন নিজেকে লুকিয়ে রাখবে?’ সে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে—‘নিজের আসল সৌন্দর্য কোথায় সেটা নিজেই জানো না! স্টুপিড কোথাকার! তুমি অসম্পূর্ণ? তোমার ভালোবাসার অধিকার নেই? তোমাকে আমি শিক্ষিত, ইনটেলেকচুয়াল, অসাধারণ ভাবতাম৷ কিন্তু তুমি তো একটা অশিক্ষিত, মধ্যযুগীয় মেয়ে ছাড়া কিছুই নও!’

সে ঊর্মিকে ছেড়ে দিল৷ উত্তেজনায় তার নিশ্বাস জোরে জোরে পড়ছে৷ ঊর্মি দু-হাতে মুখ ঢেকে ফেলে৷ ভুরুহীন কেশবিরল কুৎসিত মুখ কাউকে দেখাতে চায় না৷

—‘মুখ ঢেকেছ কেন?’ মন্দার তার হাত দুটো জোর করে সরিয়ে দিয়েছে৷ নিজের দুই হাতে তার মুখ চেপে ধরে—‘ভুরু থাক বা না থাক, চুল থাক বা না থাক এ মুখ এখন আমার৷ দেখতে দাও আমায়৷’

দু-মিনিট সব চুপচাপ৷ মন্দারের চোখে অদ্ভুত মুগ্ধতা! ঊর্মির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেও যেন তার সাধ মেটে না৷ এমন গভীর নদীর মতো চোখ, স্নেহক্ষরা দৃষ্টিতে অদ্ভুত বিস্ময়, প্রেম আর কান্না! চোখের জলেও এত সুখের রং থাকে তা সে আগে কখনও দেখেনি৷ ঊর্মির ঠোঁটজোড়া প্রজাপতির মতো থিরথির করে কাঁপছে৷ এ নারী কুৎসিত নয়! এ নারী অন্য প্রজাতির! সম্পূর্ণ আলাদা৷

—‘কবির প্রেমিকারা কেউ নারী নয় ঊর্মি৷ আমি বুঝতে পেরেছি, আসলে তারা শুধু একটা আইডিয়া৷ তারা কারুর নয়৷ তারা আসলে কেউ নেই৷ কিন্তু তুমি আছ৷ তুমি আমার রক্তমাংসের নারী৷’ মন্দার চিবুক ধরে তার মুখ সামান্য তুলে দেয়—‘মন্দার ভট্টাচার্যকে গড়ে উঠতে দেখেই খুশি! গড়ে ওঠার পথে সঙ্গ দেবে না?’

ঊর্মি কেঁদে ফেলছিল৷ জীবনে এত সুখ কখনও সে পায়নি৷ আজ পর্যন্ত জেনে এসেছে কোনো পুরুষের ভালোবাসা পাওয়া তার ভাগ্যে নেই৷ সংসার, সন্তান, নিজের পুরুষ কোনোটাই তার জন্য নয়৷ কিন্তু আজ মন্দারের প্রেমসিক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনে হল—ও আমার!…ও শুধুই আমার! ওকে ঈশ্বর আমার জন্যই পাঠিয়েছেন৷

মন্দারের মুখ তার মুখের কাছে ঘন হয়ে এসেছে৷ ঠোঁটের ওপর ঠোঁট৷ বাধা দিল না৷ পরম সুখে তার চোখ বুজে এসেছে৷ ঠোঁট ঠোঁট ডুবিয়ে পাগলের মতো চুমু খাচ্ছে মন্দার৷ তার হাত দুটো বড়ো সযত্নে খুলে ফেলেছে নাইটি৷ আঙুলগুলো এমনভাবে স্পর্শ করছে যেন সে বড়ো দামি জিনিস৷ ঊর্মি বড়ো আনন্দে দুজনেই অধীর৷ দুটো হূদপিণ্ড বড়ো কাছাকাছি, একসঙ্গে স্পন্দিত হচ্ছে৷ যেন বলছে—

.

‘আমার কাছে আসতে বোলো
আমায় ভালোবাসতে বোলো
বাহিরে নয়, বাহিরে নয়
ভিতর জলে ভাসতে বোলো
আমায় ভালোবাসতে বোলো
ভীষণ ভালোবাসতে বোলো

বিছানায় মন্দারের বুকের ওপর মাথা রেখে শুয়েছিল ঊর্মি৷ আজ প্রমাণিত হয়েছে সে নারী৷ সেও ভালোবাসতে পারে৷ অন্য মেয়েদের মতো রতিক্রিয়াতেও পারদর্শী৷ জীবনের এই নতুন আবিষ্কারে বারবার রোমাঞ্চিত হচ্ছিল সে৷

—‘হাতটা দাও তো৷’

মন্দারের কথা শুনে মুখ তুলে তাকায় ঊর্মি—‘কেন?’

—‘যোগ্য হাত যখন পেয়েছি, তখন এটাও পরিয়ে দিই৷’

তার হাতে এককণা নীলাভ আগুন দ্যুতি ছড়িয়ে জ্বলে উঠল৷ এই সেই হিরের আংটি৷ তার অনামিকায় অতি যত্নে আংটিটা পরিয়ে চুমু খেল মন্দার—

—‘আমার সমস্ত জীবন, সমস্ত অনুভব তোমায় দিলাম৷ নিজের করে নেবে ঊর্মি৷’

ঊর্মি লাজুক হেসে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল৷

.

—‘ম্যায় করু তো শালা, ক্যারেক্টার ঢিলা হ্যায়৷’

কফি হাউসে বসে শুঁটকি কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে কবি অনুপম মিত্রের দিকে মন্তব্যটা ছুড়ে দিল৷ কথাটা বলেই সজোরে হেসে উঠেছে৷ অনুপম অপ্রস্তুত—‘কী বলতে চাইছ?’

—‘কী আর বলব?’ সে চিকেন স্যান্ডউইচে আলতো কামড় বসায়—‘তুই তো বাবা, দিব্যি দোকান খুলে বসেছিস৷ এখনও আঁতেলগুলো ছাড়া কবি হিসাবে আর কেউ তোর নাম জানে না! শিয়ালদা স্টেশনে গিয়ে দশটা লোককে ‘অনুপম মিত্র’র নাম বললে ভাববে—তল্লাটে নতুন কোনো টিকিট চেকার এসেছে৷’

অনুপমের মুখ রক্তাভ হয়ে ওঠে৷ কিন্তু রেগে গিয়েও কিছু বলার উপায় নেই৷ ইনফ্যাক্ট বলার ক্ষমতাই নেই৷ শুঁটকিকে সমস্ত কবিই অল্পবিস্তর চেনে৷ কথার ঝাঁঝের জন্যও কুখ্যাত৷ বেশি কথা বললে এমন ডোজ দেবে যে পালাবার পথ পাওয়া যাবে না৷

তাই সে মুখ বুজেই থাকল৷

—‘অথচ এখনই বগলে মামণিদের নিয়ে ঘুরছিস৷ পরশু রাখি৷ তরশু মল্লিকা৷ কাল মুন্নি, আজ…?’

শুঁটকি কিছু বলার আগেই অনুপমের পাশের মেয়েটি নিজের নাম বলে দিল—‘শীলা৷ শীলা ভাদুড়ি৷’

—‘বাঃ৷ শীলাও চলে এসেছে!’ কৌতুকে তার চোখ নেচে ওঠে—‘উইদ হার জওয়ানি!’ শুঁটকির দৃষ্টি মেয়েটির দিকে ফিরল—‘তা মামণি, এত লোক থাকতে এই ভামটার সঙ্গে ঘুরছ কেন? দেখে তো বাচ্চা মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে৷ নিশ্চয়ই কবিতা লেখো৷ আর এই মাকড়াটা বলেছে যে ওর সাথে ঘুরলে বড়ো বড়ো পত্রিকায় লেখার স্কোপ দেবে৷ তাই না?’

মেয়েটি অবাক হয়ে একবার শুঁটকির দিকে, আর একবার অনুপমের দিকে তাকায়৷ সে কী করে জানবে যে মার্কেটে সকলেই অনুপমকে হাড়ে হাড়ে চেনে! বয়েস চল্লিশ ছাড়িয়েছে৷ ঘরে স্ত্রী-ছেলে সবই আছে৷ তবু তার চুলকানি কমেনি৷ মহিলা কবি দেখলেই তাকে প্রোমোট করার প্রতিশ্রুতি দেয়৷ বলে— ‘আমার সঙ্গে লেগে থাকো৷ তোমার ব্যবস্থা করে দেব৷’ সে লেগে থাকার প্রসেস যে কেমন, আর শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থা কী হয় তা কারুর অজানা নেই৷

শুঁটকি মেয়েটির দিকে তাকায়৷ রীতিমতো সুন্দরী৷ সুন্দরীরা আবার কবি হলে নাক উঁচু হয়৷ এই মেয়েটির হাবভাবও তেমন৷ একটা অদ্ভুত ‘সবজান্তা…সবজান্তা’ ভাব!

তার মেয়েটিকে নিয়ে একটু মজা করার ইচ্ছে হল৷ সে আস্তে আস্তে বলে—‘তা মামণি, কতদূর পড়াশোনা করা হয়েছে?’

—‘ইংলিশে এম. এ. করেছি৷’ সপ্রতিভ উত্তর৷

—‘তারপর? ফিউচারে কী করার ইচ্ছে আছে?’

—‘লেখালেখিই করব৷ কবিতা আমার প্যাশন৷’

—‘কীরকম প্যাশন?’ শুঁটকি মুচকি হাসে৷

মেয়েটি কফি হাউসের ছাতের দিকে তাকিয়ে বলে—‘আই ইট পোয়েট্রি, ড্রিংক পোয়েট্রি, ড্রিম পোয়েট্রি,…৷’

—‘ওরে বাবা! তুমি তো দেখছি কবিতা গুলে খেয়ে ফেলেছ৷ বেশ, বেশ৷ তা বাংলা কবিতা লিখবে না ইংলিশ?’

—‘দুটোই৷’ মেয়েটা শুঁটকির সামনেই ফস করে একটা সিগারেট ধরাল৷ ‘আই ওয়ান্না বি আ বাইলিঙ্গুয়াল পোয়েট৷’

‘বাইলিঙ্গুয়াল! আ-হা৷’ সে কী যেন ভাবছে—‘তুমি নিশ্চয়ই প্রচুর পড়াশোনা করেছ৷ বাইলিঙ্গুয়াল পোয়েট হওয়া সহজ কথা নয়৷ তা বলো তো মা—এই লাইনগুলো কার?’

শুঁটকি আবৃত্তি করল—’I saw her as a sailor after the storm/rudderless in the sea, spies of a sudden/the grass green heart of the leacy island/where were you so long? she asked…’

মেয়েটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অনুপমের দিকে তাকায়৷ অনুপমেরও ‘সসেমিরা’ অবস্থা৷ কবিতাটা সে-ও চিনে উঠতে পারেনি৷ গুরু ও শিষ্যার দ্বৈত কনফিউশন দেখে শুঁটকির হাসি পাচ্ছিল৷ তবু সে হাসি চেপে গম্ভীর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে৷

—‘টেনিসন?’

টেনিসন! শুঁটকি এবার হেসে ফেলেছে৷ হাসতে হাসতেই বলল—‘নাঃ৷’

—‘তবে? শেলী? বা ওয়ার্ডসওয়ার্থ?’

পাশ থেকে অনুপমও জানতে চায়—‘কীটস?’

—‘বেচারা বায়রন বাদ গেল কেন?’ সে অনুপমের দিকে তাকিয়ে চোখ টেপে—‘আফটার অল লোকটা ‘ডন জুয়ান’ লিখেছিল৷ যাকে এককথায় তোর বায়োগ্রাফি বলা যায়!’

অনুপম অপমানিত বোধ করে৷ বিরক্ত গলায় বলে—‘রহস্য ছেড়ে বলবে এটা কার লেখা? আমি কস্মিনকালেও পড়িনি…৷’

—‘শিয়োর যে কস্মিনকালেও পড়িসনি?’ তার মুখে একটা রহস্যময় হাসি, চোখে কৌতুক—‘দাঁড়া, এটার বাংলা ভার্সানটা বলি৷ এবার দ্যাখ পড়েছিস কিনা!’

বলেই সে গড় গড় করে বলে গেল—….‘হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা/সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর/তেমনই দেখেছি তারে অন্ধকারে, বলেছে সে, এতদিন কোথায় ছিলেন?…’

অনুপম প্রায় লাফিয়ে ওঠে—‘পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন! জীবনানন্দ!’

—‘তাহলে দেখ কস্মিনকালেও পড়িসনি কথাটা ঠিক নয়!’ শুঁটকি বলল— ‘প্রথমটা চিদানন্দ দাশগুপ্তের অনুবাদ ছিল৷ ইংরেজি শব্দগুলোর মানে ভালো করে বুঝলেই বনলতা সেন’কে ধরতে তোর দু-মিনিটও লাগত না৷ কিন্তু তোরা তো কবিতা পড়িস না—মুখস্থ করিস৷ মুখস্থ বিদ্যা গাল ভরে আওড়াতে খুব ভালো লাগে৷ কিন্তু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেই ফুসসস৷’

বলতে বলতেই তার সহাস্য দৃষ্টি মেয়েটির দিকে ফেরে—‘বুঝেছ মামণি? কবি হতে গেলে সিগ্রেট, মদ, দাদা, মামা, কিস্যু ধরার দরকার নেই৷ স্রেফ কবিতাকে ধরো৷ তাকে জলে গুলে খাওয়ারও দরকার নেই৷ শুধু বোঝো, অনুভব করো৷ কবিতাই পারে তোমাকে কবি বানাতে, দাদারা নয়৷ বিনে পয়সায় জ্ঞান দিলুম৷ নিলে নাও, নয়তো ‘শীলা কি জওয়ানি’র চর্চা ই করো৷ আটকাচ্ছে কে?’

দুই বিমূঢ় নরনারীকে রেখে সে হাসতে হাসতে কফি হাউস থেকে বেরিয়ে গেল৷ এখন ঘড়ির কাঁটা পৌনে তিনটের ঘর ছুঁইছুঁই৷ আর পনেরো মিনিট এদিক-ওদিক ঘুরে কাটিয়ে দেবে৷ কফি হাউসে বসলেও হত৷ কিন্তু অনুপম আর ওই কচি মেয়েটার ঢলাঢলি দেখার ইচ্ছে তার বিন্দুমাত্রও নেই৷

কফি হাউসের সিঁড়ির ঠিক নীচে একটা সিগারেট-চুইংগাম-চকোলেটের ছোট্ট দোকান আছে৷ সেখান থেকেই এক প্যাকেট সিগারেট কিনল শুঁটকি৷ কী ভেবে যেন গোপালের জন্য একটা চকোলেট বারও নিয়ে নিয়েছে৷ ব্যাটাকে আজ রাতে বিরিয়ানি খাইয়েই ছাড়বে৷

আপাতত হাতে যখন সময় আছে তখন বিরিয়ানিটাও এই বেলাই কিনে নেওয়াই যাক৷ পরে মাইক্রোওয়েভে গরম করে নিলেই চলবে৷

ভাবতে ভাবতেই বেরিয়ে পড়েছে সে৷ কিন্তু এগোতে গিয়েই বাধা পেল৷ ভেড়ার পাল লাইন করে চলেছে আমহার্স্ট স্ট্রিটের দিকে৷ যেন ঠিক শেভিংক্রিমের ফেনা মেখে, গম্ভীর মুখে গুটগুটিয়ে যাচ্ছে৷ তার মধ্যে একটা শুঁটকির প্রায় গায়ের ওপরই উঠে পড়ছিল৷ কোনোমতে লাফ মেরে সরে গিয়ে এড়িয়েছে৷ তার বিরক্ত লাগে! এ কী রে বাবা! যাচ্ছে তো যাচ্ছেই৷ আর-একটু তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারে না!

বিরক্ত হয়ে সে আরও কিছু ভাবতে যাচ্ছিল—তার আগেই একটা কানফাটানো আওয়াজ; প্রচণ্ড কোলাহল৷ তীব্র তীক্ষ্ণ সমবেত ভয়ার্ত চিৎকার! যেন হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠল গোটা এলাকা৷ গাছে গাছে বসে থাকা কাকগুলো কর্কশস্বরে মহা শোরগোল ফেলে দিল৷ এবার ভেড়াগুলো দুড়দাড়িয়ে ছুটতে শুরু করেছে! তার পিছনেই মানুষের দল৷ ভেড়ার পালের মতোই দৌড়ে আসছে এদিকে৷ চোখে-মুখে আতঙ্ক৷ হল কী!

—‘কী হয়েছে দাদা?’

সে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসা একটি লোককে জিজ্ঞাসা করে৷ কিন্তু লোকটা উত্তর দেবে কি? সে শুঁটকিকে এক ধাক্কা মেরে বেরিয়ে গেছে সামনের দিকে৷ অসহায়ভাবে খুঁজছে একটা নিরাপদ আশ্রয়!

শুঁটকি দেখল ঝপঝপ করে সব দোকানের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে! একদল যুবক-যুবতি তার পাশে দিয়ে দৌড়ে গেল৷ তাদেরই একজনের ভীত কণ্ঠস্বর শুনল শুঁটকি—‘পুলিশ এসেছে…ফায়ারিং চলছে!’

ওর মনে পড়ে আজ সকালেই বিশু বলেছিল একটা প্রতিবাদ মিছিলের কথা৷ সম্ভবত সেই মিছিল এখানে এসে পৌঁছেছে৷ কফি হাউসে থাকাকালীন কোনো শব্দ পায়নি সে৷ কিন্তু বেরিয়ে একটা হালকা স্লোগানের শব্দ পেয়েছিল৷ কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরা প্ল্যাকার্ড ফেস্টুন হাতে নিয়ে একটু আগেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেছে৷ সে তো কত কারণেই যায়৷ কলেজ স্ট্রিট এলাকায় প্রায়ই স্লোগান, ভাষণ, জমায়েত লেগে থাকে৷ নিতান্তই পরিচিত দৃশ্য৷ তাই বিশেষ পাত্তা দেয়নি শুঁটকি!

এখনও যে গোটা ব্যাপারটা পরিষ্কার বুঝল, তাও নয়৷ তবু আন্দাজ করতে পারল, হয়তো প্রতিবাদ মিছিল কোনো কারণে জনবিক্ষোভে পরিণত হয়েছিল৷ অথবা হত্যার বদলে হত্যার রাজনীতি৷ বোধ হয় দুই রাজনৈতিক দল হিংসাত্মক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে৷ ফলস্বরূপ পুলিশের এই পেশি প্রদর্শন!

পিলপিল করে লোক দৌড়োচ্ছে৷ শুঁটকি ধাক্কার পর ধাক্কা খেতে খেতে জনস্রোতের উলটো দিকে চলল৷ তারও পালানোই সমীচীন ছিল৷ কিন্তু অদ্ভুত কী এক কৌতূহলে সে অকুস্থলের দিকেই এগোল৷ একের-পর-এক ফায়ারিঙের শব্দ কানে আসছে! প্রবল চিৎকার-চ্যাঁচামেচি! তার মধ্যেই স্লোগানের আওয়াজ৷

একটু এগোতেই গোটা দৃশ্যটা চোখে পড়ে তার৷ কে কোন দলের তা এই মুহূর্তে বোঝা সম্ভব নয়! রাস্তায় লুটিয়ে পড়ছে ফেস্টুন! ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে৷ আতঙ্কিত মানুষের পায়ের তলায় পিষে যাচ্ছে প্ল্যাকার্ড৷ খাকি উর্দি পরা একদল মানুষ এলোপাথাড়ি লাঠি চালিয়ে যাচ্ছে৷ বাইশ-তেইশ বছরের এক যুবক রক্তাক্ত দেহে এলিয়ে পড়েছে রাস্তার ওপরে৷ তবু স্লোগান দিয়ে যাচ্ছে! তার হাতের দৃঢ় মুঠি তখনও আকাশের দিকে অভ্রান্ত লক্ষ্যে স্থির৷ পুলিশের নিষ্ঠুর লাঠিও তাকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে পারেনি৷

শুঁটকি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিল, এ কোথায় এসে পড়েছে! লাঠির বাড়ি খেয়ে কতগুলো তাজা মুখ রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে, ঢলে পড়ছে মাটিতে! কেউ নির্বিবাদে মার খাচ্ছে, কেউ পালাচ্ছে! মিছিল ছত্রভঙ্গ৷ তবু পিছন থেকে কয়েকজন এসে পুলিশকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল৷ দু-একটা ইট-পাটকেল উড়ে এল উর্দিধারীদের লক্ষ্য করে৷ লাগল হেলমেটে৷ প্রতিশোধস্পৃহায় যেন উন্মত্ত হয়ে উঠেছে লোকগুলো৷

মেয়েদের ওড়না, সালোয়ার কামিজ ছিঁড়ে গেছে৷ জমে আছে চাপ চাপ রক্ত৷ সেই অবস্থাতেই তাদের চুলের মুঠি ধরে রাস্তার ওপর দিয়েই ঘষটাতে ঘষটাতে নিয়ে চলল পুলিশ ভ্যানের দিকে৷ উদভ্রান্ত, আতঙ্কিত জনতা দিগবিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়োচ্ছে৷ চতুর্দিকে শুধু আর্তনাদ, রক্ত, মৃত্যুর বিভীষিকা!

হঠাৎ মনে হল সে কিছু শুনতে পাচ্ছে না! কিছু দেখতে পাচ্ছে না! মুহূর্তের জন্য যেন সময় থমকে দাঁড়াল৷

শুঁটকি বিস্ফারিত চোখে দেখল ওই আতঙ্কিত মানুষের ভিড়, ক্ষতবিক্ষত দেহগুলোর মধ্যেই রাস্তায় বসে আছে এক দু-তিন বছরের পথশিশু!! যে-কোনো মুহূর্তে তাকে পদপিষ্ট করে চলে যাবে বিভ্রান্ত মানুষের দল! সে কিছুই বুঝছে না! ভয়ার্ত দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকে খুঁজছে৷ আর চিৎকার করে অসহায়ের মতো কাঁদছে!

সে কান্নার ভাষা কী ছিল তা জানে না শুঁটকি৷ কিন্তু তার মনে হল ওই অসহায়, বিপন্ন বাচ্চাটা—‘বাবা…বাবা…’ বলে কাঁদছে৷ একদিকে জনতার রাশ৷ অন্যদিকে মারমুখী পুলিশের লাঠি! যে-কোনো মুহূর্তে ওর নরম খুলি দু-টুকরো হয়ে যাবে যেমন দিঘার বোল্ডারে বুবাইয়ের মাথাটা!

সে দেখল—বুবাই রাস্তায় বসে দু-হাত বাড়িয়ে তাকে ডাকছে৷ ও আর কেউ নয়! তার বুবাই! বুবাই কাঁদছে ‘বাবা…বাবা…’ করে, অসহায় ভাবে ডেকে চলেছে৷ তাকেই খুঁজছে৷

একমুহূর্তেই মাটিতে লুটোল এতদিনের পরিশ্রম! এতদিনের স্বপ্ন-কবিতার পাণ্ডুলিপি রাস্তাতেই গড়াগড়ি খাচ্ছে! শুঁটকি ছুড়ে ফেলে দিল সবকিছু৷ উন্মাদের মতো সবলে জনস্রোতের বুক চিরে ছুটতে লাগল বাচ্চাটার দিকে! বুবাইয়ের মাথা লক্ষ্য করে উদ্যত হয়েছে শক্ত লাঠি! আবার চলে যাবে ও! বাবাকে ছেড়ে চলে যাবে!

যেতে দেব না তোকে…আর যেতে দেব না বাবা!

সে চিৎকার করে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাচ্চাটাকে আড়াল করে৷ পুলিশ ক্ষিপ্ত হয়ে এলোপাথাড়ি লাঠি চালাচ্ছিল৷ এক বাড়িতেই ওইটুকু শিশুর মাথা চুরমার হয়ে যেত৷ হয়ে গেলেই বা কী হত! কত ভিখিরি মায়ের শিশু এভাবেই বছরের-পর-বছর মারা যায়৷ মৃতের সংখ্যা একটা বাড়ত বই তো কিছু নয়৷

অথচ তার আগেই কোথা থেকে এক খ্যাপা এসে লাফিয়ে পড়ল তার ওপরে৷ বুকে জড়িয়ে ধরেছে বাচ্চাটাকে৷ লাঠির মোক্ষম বাড়ি থেকে বাঁচল শিশু৷ কিন্তু লোকটা নিজেকে বাঁচাতে পারল না৷ জোরালো আঘাত পড়ল একেবারে মাথার পিছন দিকে৷ মস্তিষ্কের সবচেয়ে অরক্ষিত অংশে!

বাচ্চাটা দেখল তাকে যে মানুষটা বুকে জড়িয়ে ধরেছিল, তার মাথা দিয়ে গল গল করে রক্ত পড়ছে৷ নাক দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ল শিশুটির মুখের ওপর৷ তা সত্ত্বেও লোকটা তার দিকে তাকিয়ে কেমন অদ্ভুতভাবে হাসছে৷ দু-হাত শক্ত করে ধরে তাকে বুকের নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে, সে নিজে অবশভাবে কাত হয়ে পড়ল৷ ভয়ার্ত মানুষেরা তাকে মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে৷ কিন্তু তার কোনো সাড়া নেই! সে স্থির দৃষ্টিতে কী যেন দেখছে!

শুঁটকি কেমন যেন অসাড় হয়ে যাচ্ছিল! তার মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে৷ কত রক্ত…কত রক্ত! অথচ রক্তের গন্ধ নেই তো! বরং হাস্নুহানার গন্ধে ভরে যাচ্ছে চতুর্দিক!

শুঁটকি মুগ্ধ হল৷ তার রক্তে এত হাস্নুহানার গন্ধ মিশে ছিল! শিরায় শিরায় এতদিন ধরে বয়ে চলেছিল রুমার সৌরভ! আজ সেই সুগন্ধ শুঁটকির দেহ থেকে ছড়িয়ে পড়ল হাওয়ায় হাওয়ায়; সমস্ত কলেজ স্ট্রিট জুড়ে আজ রুমার গন্ধ!

সে জানে মৃত্যু আসছে৷ সবাই বলে মৃত্যু বড়ো কষ্টকর৷ কিন্তু মৃত্যু কি রুমার মতো? নয়তো সামনে এসে ও কে দাঁড়িয়েছে! সাদা শাড়ি হাওয়ায় উড়ছে৷ উড়ছে খোলা চুল৷ সমুদ্রের সামনে দাঁড়ালে এ নারীকে ভেনাসের মতো দেখায়৷ এই মুহূর্তে ছায়া ছায়া নয়৷ নয় ঘষা কাচের পিছনের আবছায়া—একেবারে স্পষ্ট রুমা৷ হাত বাড়িয়ে তাকে ডাকছে!

শুঁটকি হাসতে চাইল৷ বলতে চাইল—‘এসেছ?’

তার মুখটা হঠাৎ একটা হেঁচকি তুলেই শক্ত হয়ে গেছে৷ কিন্তু চোখ দুটো তখনও হাসছে, ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি৷ বুকের ভেতর শিশুটাও টের পেলে না মানুষটার বুকের ওঠাপড়া থেমে গেছে!

শুঁটকি দেখতে পেল না তার বড়ো সাধের কবিতার পাণ্ডুলিপিকে পিষে দিয়ে চলে গেল পুলিশের জিপ! সেই ভিখারিনি জানতে পারল না যে তার প্রার্থনা ঈশ্বর এত তাড়াতাড়ি কবুল করে নিয়েছেন৷ মন্দার জানল না, যে মানুষটি তাকে বাঁচতে শিখিয়েছিল, সে আজকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে৷ আর কবিতা ডট কমের সদস্যরা কোনোদিনই হয়তো জানবে না যে, সাইটের মডারেটর ব্যাসদেবের প্রোফাইলটা থেকেই গেল, কিন্তু লোকটা নেই!

.