আরও দাও প্রাণ – ৫

‘যে পিতা সন্তানের লাশ শনাক্ত করতে ভয় পায়
আমি তাকে ঘৃণা করি
যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক হয়ে আছে
আমি তাকে ঘৃণা করি
যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানি
প্রকাশ্য পথে হত্যার প্রতিশোধ চান না
আমি তাকে ঘৃণা করি’…

সকাল থেকেই দিনটা থমথমে৷ বাবা সাত দিন হল বাড়ি ফেরেননি৷ বাড়িতে একা মা, যুবতী মেয়ে আছে আর ছ-বছরের ছেলে৷ বাচ্চাটা জানে না বাইরে ঠিক কী হচ্ছে! বাবা কেন বাড়ি ফেরেন না তা-ও তার জানার কথা নয়! মাঝেমধ্যেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে মা আর দিদি কেন চমকে ওঠে, সে সম্পর্কেও তার কোনো ধারণা নেই৷ সে শুধু জানে, কিছুদিন যাবৎ একটা বন্দিজীবন তাকে ঘিরে ধরেছে৷ স্কুলে যাওয়া বন্ধ৷ বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে খেলতে যাওয়া বারণ৷ শুধু স্যাঁতস্যাঁতে দেয়ালের চৌহদ্দির মধ্যেই তার দিন কাটছে৷

এ বাড়ির ভেতরে রোদ ভুলেও উঁকি মারে না৷ সবসময়ই একটা স্থির শীতলতা৷ কেন যেন তার মনে হয়—শীত শীত ভাবটা এ ক’দিনে আরও বেড়েছে৷ আগে এই চত্বরটা সরগরম থাকত৷ ফুচকাওয়ালার দোকানের ভিড়ে, পানের দোকানে, চায়ের ঠেকের জমজমাট আড্ডায় গমগম করত চতুর্দিক৷

কিন্তু বেশ কিছুদিন হল দৃশ্যপটের পরিবর্তন হয়েছে৷ কার অদৃশ্য ইশারায় যেন সন্ধে সাতটার পরই চুড়িসারে পড়ে যায় দোকানের ঝাঁপ৷ শুনশান হয়ে যায় রাস্তা৷ দু-একটা বেওয়ারিশ কুকুরের ‘ভৌ ভৌ’ নিস্তব্ধতাকে আরও বেশি প্রকট করে তোলে৷

কখনো-কখনো অবশ্য গভীর রাতে কিছু বিজাতীয় শব্দ শুনতে পায় ছেলেটা৷ হঠাৎ করেই রাতের থমথমে নৈঃশব্দ্যকে চিরে বেজে ওঠে তীক্ষ্ণ বাঁশি৷ দুমদাম করে কান ফাটানো আওয়াজ! বারুদের উৎকট গন্ধ! দুপদাপ করে কয়েক জোড়া ভারী বুট শব্দ তুলে ছুটে যায়৷ তারপরই ‘দুড়ুম’ করে আরও একটা শব্দ!

ছেলেটা চমকে ওঠে৷ জানলা দিয়ে উঁকি মারতে চায়৷ কিন্তু মা তাকে বাধা দেন৷

—‘ওটা কীসের শব্দ মা?’

ছেলের উৎসুক প্রশ্নের উত্তরে মা তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেন—

—‘কিছু না বাবা৷ ছেলেরা বাজি ফাটাচ্ছে৷’

—‘বাজি ফাটাচ্ছে! আজ কি পুজো?’

—‘হ্যাঁ৷’

—‘আমি পুজো দেখব মা…৷’

মা অদ্ভুত আতঙ্কে ছেলেকে জড়িয়ে ধরেছেন—‘না খোকা৷ এ পুজো দেখতে নেই!’

পুজো কেন দেখতে নেই এ প্রশ্নটা খোকার মাথায় বারবার ধাক্কা মারতে থাকে৷ মা তাকে বুঝিয়ে বললেন যে, এটা বড়োদের পুজো৷ ছোটোদের দেখতে নেই৷ ছোটোরা দেখলে ঠাকুর পাপ দেয়৷ ছেলেটা মায়ের বুকে মাথা রেখে মশারির দিকে তাকিয়ে কতকিছুই না ভাবে৷…বড়ো হয়ে সে বাবার সঙ্গে বড়োদের পুজো দেখতে যাবে৷ বাবা ফিরে এলে বলবে রাত্রে মাঝে মাঝে যে বাঁশি বাজে, সেইরকম বাঁশি কিনে দিতে…দিদিকে মেলা থেকে লাল কাচের চুড়ি কিনে দেবে৷ লাল রং পরলে দিদিকে খুব সুন্দর লাগে…৷

ঘুমে দু-চোখ বুজে আসার আগে ক্ষীণভাবে কানে আসে জানলার বাইরে কাদের যেন ফিসফাস৷ কিছু একটা ঘষটে টেনে নিয়ে যাওয়ার শব্দ! তার ঘুমে অসাড় হয়ে আসা মস্তিষ্ক তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে না৷

এমন করেই কেটে যাচ্ছিল দিন৷ ছেলেটার জীবনে তেমন কিছু পরিবর্তন হয়নি৷ তবে তার কৈশোরের স্বভাবজাত কৌতূহলে মনে কিছু প্রশ্ন এসে ভিড় জমাচ্ছিল৷ বাবা কোথায়? কবে বাড়ি ফিরবে? মধ্যরাত্রে কারা যেন এ বাড়ির চতুর্দিকে লঘু পায়ে হেঁটে বেড়ায়৷ ফিসফিস করে কথা বলে৷ ওরা কারা? মা আর দিদি হাসে না কেন? বাইরে বেরোনো বারণ কেন?

অনেক জিজ্ঞাসা করেও প্রশ্নের জবাব কখনও পায়নি সে৷ তার পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না যে, এ আসন্ন প্রলয়ের ইঙ্গিত! কখনও অনুভব করতে পারেনি আজকাল হাওয়াও বড়ো সাবধানে বয়৷ গাছের পাতাও খুব সন্তর্পণে নিঃশব্দে ঝরে পড়ে৷ চতুর্দিক গুমোট হয়ে এসেছে৷ অবধারিতভাবে ঝড়ও আসবেই৷

আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনবহিত ছেলেটা তখন সূর্যোদয়ের ছবি আঁকছিল! কমলা রঙের সূর্য পাহাড়ের মাথায় উঁকি মারছে৷ সাদা বরফে ঢাকা পাহাড় সোনালি হয়ে উঠেছে৷ তার পায়ের কাছে একটা রুপোলি নীল রঙের নদী৷ নদীর জলে সোনা রঙের আভা!

সে রাতেও সে বড়ো যত্ন নিয়ে ছবিটা আঁকছিল৷ কমলা, গোলাপি আকাশে হালকা কালো রং দিয়ে একঝাঁক পাখির উড়ে যাওয়া চিহ্নিত করছিল ছেলেটা৷

হঠাৎ নিঝুম রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দিয়ে প্রচণ্ড বোমার শব্দ! বন্ধ দরজার বাইরে কয়েকজোড়া ভারী বুটের কর্কশ আওয়াজ! পরক্ষণেই কড়া নাড়ার পুরুষ শব্দ!

মা আর দিদি চমকে উঠে পরস্পরের দিয়ে ভয়ার্ত দৃষ্টিপাত করছে৷ ছেলেটা ভাবে, ওরা এত ভয় পাচ্ছে কেন? বাবা হয়তো ফিরে এসেছে৷ সে উল্লসিত হয়ে ওঠে৷ বাবা এলে তাকে এই নতুন ছবিটা দেখাবে৷ জানতে চাইবে—কেমন হয়েছে?

দরজায় ফের প্রবল কড়া নাড়ার শব্দ৷ মা কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ‘কে’?

—‘পুলিশ৷ দরজা খুলুন৷’

মা উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই বাড়িতে যেন ঝড় বয়ে গেল! একদল উর্দিপরা লোক ভেতরে ঢুকে পড়ে গোটা বাড়ি তছনছ করতে লাগল৷ জলের কলশি ভেঙে, বাবার বইয়ের টেবিল উলটে ফেলে, তক্তপোশের চাদর ছিঁড়ে, বালিশ ছুড়ে ফেলে দিয়ে অসম্ভব প্রতিশোধস্পৃহায় কী যেন খুঁজছে৷

মুহূর্তের মধ্যে বাড়িটাকে লন্ডভন্ড করে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত করল তারা৷ কিন্তু যা খুঁজছিল তা হয়তো পেল না৷ ভীষণ আক্রোশে মুখ লাল করে এসে মাকে বলল—‘মাস্টার কোথায়?’

ছেলেটা দেখল মায়ের মুখ শক্ত৷ কঠিন দৃষ্টি অন্যদিকে নিবদ্ধ৷ জোরালো গলায় বললেন—‘জানি না৷’

প্রচণ্ড একটা শব্দ! সে বিস্ফারিত চোখে দেখে যে, উর্দিপরা একটা লম্বা-চওড়া লোক মাকে চড় মারল৷ দাঁতে দাঁত পিষে বলল—‘হারামজাদি! ছেনালিপনা হচ্ছে! মাস্টার কোথায়? কোথায় লুকিয়ে আছে?’

মায়ের গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ৷ ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে৷ ব্যথায় চোখে জল এসে গেছে৷ তবু সেই জলেই যেন আগুন জ্বলল৷ রুদ্রাণীর মতো অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়েছেন তিনি৷

—‘জানি না৷ জানলেও বলব না৷’

—‘খানকি মাগী!’

আবার একটা জোরালো থাপ্পড়! লোকটা মায়ের চুলের মুঠি চেপে ধরেছে৷ হিড় হিড় করে টানতে বলল—‘চল থানায় চল৷ বেশি চর্বি হয়েছে না? সব চর্বি নামিয়ে দেব শা-লি!’

মা কঁকিয়ে উঠলেন৷ অসহায়ভাবে চুলের গোছা ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছেন৷ কিন্তু পাষণ্ড লোকটার হাত থেকে নিষ্কৃতি নেই৷

আর-একটা লোক চেপে ধরল দিদিকে৷ সে ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে কাঁপছিল৷ তাকেও মেঝেতে ঘষটাতে ঘষটাতে টেনে নিয়ে চলল ওরা৷ অমানুষিক প্রতিশোধস্পৃহায় অশ্লীল সব গালিগালাজ দিচ্ছিল লোকগুলো৷

—‘ডবকা রান্ডি বাড়িতে পুষেছে শালা! গতরে এত গরম! তোর সব গরম আজ ঠান্ডা করব মাগী৷ নাঙ কোথায় জানো না! মুখ না খুললে চামড়া খুলে নেব! থানায় চল৷ মাস্টার পুলিশ খুন করে লুকিয়ে বেড়ায়৷ আর মাগীরা ছেনালিপনা দেখাচ্ছে!’

ছেলেটা এতক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে দেখছিল৷ ঠিক যেন একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে! এমন বাস্তবে হয় না! হতে পারে না! সে তো আজ সকালেও দেখেছে পায়রারা ঝাঁক বেঁধে আকাশে মনের সুখে উড়ে বেড়াচ্ছে৷ আজও কৃষ্ণচূড়া গাছটা ফুলে ফুলে লাল হয়ে আগুন ছড়াচ্ছিল! বিকেলেও তুলসীতলায় প্রদীপ স্নিগ্ধ নীল শিখায় জ্বলে উঠেছে, শাঁখ বেজেছে, ধূপের শান্ত সৌরভে চতুর্দিক ‘ম’ ‘ম’ করেছে৷ তার মধ্যে এই লোকগুলোর আসুরিক অস্তিত্ব কোথায়!

সে ছুটে গিয়ে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে৷ যে লোকটা মাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে৷ মায়ের হাত টেনে ধরে কাতর গলায় বলে—‘তোমরা আমার মাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ! ছেড়ে দাও…ছেড়ে দাও৷’

কিন্তু ব্যর্থ প্রচেষ্টা! উদভ্রান্তের মতো সে একবার দৌড়ে যাচ্ছে মায়ের দিকে, আর-একবার দিদির দিকে৷ লোকগুলোর হাত ধরে টেনেও ছাড়াতে পারল না কাউকে৷ নিস্তব্ধ রাত্রির বুক চিরে কতগুলো পাশবিক লোকের উন্মত্ত গালিগালাজ, দুই অসহায় নারীর আর্তচিৎকার আর একটি বাচ্চা ছেলের কান্না ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হল চতুর্দিকে৷

ছেলেটা তখন একজনের পা চেপে ধরেছে৷ হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল—‘আমার মাকে, দিদিকে নিয়ে যেয়ো না…ওদের ছেড়ে দাও…ছেড়ে দাও…৷’

লোকটা এক লাথি মেরে সরিয়ে দিয়েছে তাকে৷ শক্ত বুটের লাথিটা তলপেটে পড়েছে৷ একটা কাতর শব্দ করে ছিটকে পড়ল সে৷ ভীষণ ব্যথা লেগেছিল৷ মনে হচ্ছিল, এক্ষুনি মরে যাবে৷ তবু সামনের পৈশাচিক দৃশ্য অমন শান্ত ছেলেটাকেও হিংসা শিখিয়ে দিল৷ সে উন্মত্ত বনবিড়ালের মতো লোকগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আঁচড়ে-কামড়ে দিচ্ছে৷ যেন পারলে নখ-দাঁত দিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে তাদের!

—‘ছেড়ে দাও…ছেড়ে দাও…আমার মাকে…দিদিকে…ছেড়ে দাও৷’

—‘শুয়োরের বাচ্চা!’

কানের তলায় একটা মোক্ষম ঘুসি৷ চোখে আচমকা অন্ধকার দেখল ছেলেটা! কান বেয়ে তরল, উষ্ণ কী যেন একটা চুঁইয়ে পড়ছে!

সম্পূর্ণ অচেতন হওয়ার আগে টের পেল কতগুলো শক্ত ভারী বুট তাকে নেড়ে-চেড়ে দেখছে৷ কেউ যেন ফিসফিস করে বলে—

—‘মরে গেল নাকি স্যার!’

‘থুঃ’ করে তার মুখে একদলা থুতু ছিটিয়ে দিয়ে বলল আর-একজন— ‘হারামের পিল্লা! বেঁচে থাকলে তো বাপের মতো হারামি হত! মরাই ভালো৷’

তারপর আর কিছু মনে নেই ছেলেটার! কতক্ষণ অজ্ঞান হয়েছিল জানে না৷

শুধু মনে আছে, ভোর রাতে একটা জিপ বাড়ির সামনে ছুড়ে দিয়ে গিয়েছিল দুটো ছিন্নভিন্ন দেহকে! দেহ দুটো তখনও জ্যান্ত ছিল৷ কিন্তু প্রাণহীন৷

মা তারপর থেকে আর কোনো কথা বলেননি৷ চোখের সামনে যে বীভৎস দৃশ্য দেখতে হয়েছিল তা বর্ণনা করার জ্বালা সহ্য করতে হয়নি তাঁকে৷ সে রাতের পর থেকে তিনি মূক, স্থবির পাথরে পরিণত হয়েছিলেন৷

ছেলেটা ঝাপসা চোখে দেখেছিল, দিদি দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে৷ তার শাড়ি ছিন্নভিন্ন, কপালে কালশিটে৷ গলায় জমাট রক্ত৷ কামড়ের দাগ! ঠোঁটের কোণ বেয়ে জমাট রক্তের ধারা শুকিয়ে আছে৷ চুল অবিন্যস্ত৷ ব্লাউজটা ছেঁড়া! শাড়ির নিম্নদেশ রক্তে ভিজে গেছে৷

—‘দিদি!’

কান্নাজড়ানো আর্তসুরে ডেকেছিল সে৷ তার সর্বাঙ্গে ব্যথা৷ তবু কোনোমতে দেহটাকে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে টেনে নিয়ে গেল দিদির কাছে৷ দু-হাতে দিদির ক্ষতবিক্ষত মুখ ধরে ব্যাকুল স্বরে ডেকেছিল—‘দিদি…দিদি…দিদি…৷’

দিদি কোনো উত্তর দেয়নি৷ কেমন যেন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল অন্যদিকে৷ ভাই তাকে ছেড়ে দিতেই কাত হয়ে পড়ে গেল!

ঠিক তার পাশেই সেই সূর্যোদয়ের ছবিটা পড়ে আছে! সে অসহায় জলভরা চোখে দেখল, কমলা রঙের সূর্য, সাদা সোনালি পাহাড়, রুপোলি নীল রঙের নদী, গোলাপি আকাশ—সব লাল হয়ে গেছে! সব লাল!…

দিদিকে লাল রঙে ভারি সুন্দর লাগত! সেই দিদিই দেহের লাল তরল অংশকে ভীষণ ঘেন্নায় ত্যাগ করেছিল৷ যে দিদিকে লাল চেলি পরলে ঊর্বশী মনে হত, সেদিন সে সাদা হয়ে গিয়েছিল!

‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না
এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না
এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না৷

বাবা, দরজাটা খুলে দাও—
চাবুকগুলো অনেকদিন বাইরে দাঁড়িয়ে আছে—
আমি এখনও অন্ধকার ঘরে অরণ্যদেব…অরণ্যদেব খেলি
সাদা ধুলোর আস্তরণে ঢাকা পায়াভাঙা চেয়ারটাকে
সাদা ঘোড়া ভাবি৷
দরজাটা খুলে দাও, ওরা ভিতরে আসুক
কশাঘাতে কশাঘাতে ফিরিয়ে দিক রক্তাক্ত সন্ধ্যা!

বাবা, আমাদের দেশ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চলে৷
‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে ভারত ভাগ্যবিধাতা’—
যারা তোমার লাশ হয়ে যাওয়া মাংসের পিণ্ডটাকে
জুতোর তলায় চেপটে দিয়েছিল
তারা কি জানত ‘জনগণমন’ কাকে বলে?
যে মাছিগুলো ভনভন করে মুখের রক্ত চেটে খাচ্ছিল,
শুকিয়ে যাওয়া মৃত্যুকালীন রক্তবমি, আর তিন দিনের
পচা-বাসি লাশের দুর্গন্ধে
স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিল তারা!

বাবা, তুমি জানো না, স্বাধীনতা মানে রোজ সকালে বমি করে
অম্ল-পিত্ত উগরে দেওয়া!
স্বাধীনতা মানে—রোজকার হাগু—মুতু,
এক নারীকে মন্থন অথবা ধর্ষণ করে বীর্যপতনের অধিকার৷
অথবা নীলছবি দেখে উত্থিত শিশ্নসবল শীৎকারে হস্তমৈথুন!
ভডকা থেকে রাম, চুমু থেকে সিগারেট,—সব স্বাধীনতা!

শুধু যে বাঞ্চোত বলে ‘আমি আমার মতন দেশে বাঁচতে চাই’
গুলি করে মারো তাকে৷
যে লোকটা শেখায় স্বাধীনতার মানে সবার সমানাধিকার
ঠুঁসে দাও তার পোঁদে পয়েন্ট আটত্রিশ বা বাইশ!
যে হতভাগা তার সন্তানকে একটা
সুস্থ দেশে জন্ম দেওয়ার স্বপ্ন দেখে, তার
লিঙ্গ কেটে দাও—সন্তানের স্বপ্ন যেন সে না দেখতে পারে!
বেচুবাবুদের বলো, ঘর, আসবাবপত্র, এমনকি
নিজেদের মা-বোনকেও বিক্রি করতে;
তবু ভুলেও যেন স্বপ্ন বিক্রি না করে!
ধর্মশিক্ষা, যৌনশিক্ষা সব চলবে৷
সবাই জানুক কীভাবে, ঈশ্বর বানাতে হয়
কীভাবে আর-একটা মূঢ় মানুষের বাচ্চা বানাতে হয়,
সাবান থেকে ন্যাপথলিন—সব বানাতে শেখাও৷
কিন্তু যে হারামজাদা দেশ বানাতে শেখায়
তার গিলোটিনে চড়া নিশ্চিত!
বাবা, দরজাটা খুলে দাও—
তোমার দলামোচা শরীরটা ওরা আজও টেনে আনছে!
ওই পচা-গলা দুর্গন্ধময় লাশ
মাসের পর মাস, বছরের পর বছর…
গাধার মতো টেনেই চলে!
গলে গলে খসে পড়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো
কেটে দেখে বারবার৷
পচা হূদয়, গলিত বৃক্ক, পাকস্থলীর পুতি দুর্গন্ধে গা গুলোয়,
তবু নষ্ট দেহটাকে হাতড়ে হাতড়ে তন্নতন্ন করে খোঁজে
—‘আদর্শটা কোথায়! ফরেনসিক রিপোর্টে তার
কথা তো কেউ লেখেনি!’
বাবা, ওই দরজাটা খুলে দ্যাখো—
এক কিশোর ধানের খেতের দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন দেখছে৷
কিংবা ওর চোখ দিয়ে তুমি দেখছ—
দু’চোখে তাচ্ছিল্য, গ্রীবায় ঔদ্ধত্য৷
বুকের ভিতরে তাজা হাওয়া নিয়ে
অঙ্কুরে অঙ্কুরে ছড়িয়ে দিচ্ছে সাম্যবাদের ঘ্রাণ
একদিন তোমাদের মতো করেই সূর্যকে মুঠোয় ধরবে সে
ছুড়ে দেবে জ্বলন্ত প্রতিবাদ
স্টেনগানের তিলক মাথায় নেওয়ার জন্য জন্ম হয়েছে তার৷
প্রতিটা বুলেট বুকে নিয়ে মৃত্যুর পরও প্রশ্ন রেখে যাবে—‘আদর্শ কোথায়?’
শকুনগুলো ওর নিথর দেহ ঠুকরে ঠুকরে খুঁজবে আদর্শ!
আর মাটি ছুঁয়ে জেগে উঠবে আরও একটা স্বপ্নের চারাগাছ৷
 
বাবা, দরজাটা খুলে দাও৷
চারাগাছটা আমার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছে৷’

.

ছ-বছরের ছেলেটার ব্যথিত চোখ আস্তে আস্তে পূর্ণবয়স্ক হয়ে ওঠে৷ গহন তখনও যেন একচল্লিশ বছর আগেকার দিনটাতে পড়ে আছেন৷ যে দিনগুলোর কথা বারবার ভুলে যেতে চেয়েছেন, যে কষ্টকর গ্লানিময় অভিজ্ঞতার কথা অস্বীকার করার চেষ্টা করেছেন—এক টুকরো কাগজ তাঁকে আবার সেই দিনগুলোতেই ফিরিয়ে নিয়ে গেল৷

তিনি হলুদ কাগজটার দিকে তাকালেন৷ কবিতাটা লিখে নিজেই ফেলে দিয়েছিলেন৷ শুঁটকি কুড়িয়ে নিয়েছে৷ পঁচিশ বছর ধরে নিজের কাছেই আগলে রেখেছিল৷ আজ ফেরত দিল৷

—‘দেখ গহন৷’ শুঁটকি বলেছিল—‘যতই ক্যামোফ্লেজ করিস না কেন, এই হচ্ছিস আসল তুই৷ আমি এতদিন ধরে এটাকে সামলে রেখেছি একটাই কারণে৷ জানতাম, মুখোশ পরে থাকতে থাকতে একসময়ে নিজেই বিরক্ত হয়ে যাবি৷ তখন তোকে এটা দেখাব৷’ তার মুখে একচিলতে হাসি মিঠে রোদ্দুরের মতো ভেসে ওঠে—‘আজ তোকে তোর সঙ্গেই দেখা করিয়ে দিলাম৷ এবার ঠিক কর—কী লিখবি৷ স্লোগান না কবিতা!’

গহন চোখ বুজলেন৷ দীর্ঘদিন ধরে নিজেকে লুকিয়ে রাখা বড়ো ক্লান্তিকর৷ যতই পালাতে চাও, কোনো-না-কোনোসময় অতীত সামনে এসে দাঁড়াবেই৷ এতদিন তিনি চোখ বুজে সূর্যটাকে অস্বীকার করার চেষ্টা করেছিলেন৷ এবার সে তার গনগনে উত্তাপ নিয়ে একেবারে মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে৷

হাতের কাগজটাকে টেবিলের ওপর রেখে তিনি উঠে দাঁড়ালেন৷ আস্তে আস্তে বাথরুমে গিয়ে চোখে-মুখে জলের ঝাপটা দিচ্ছেন৷ জলের বিন্দু তাঁর মুখ চুঁইয়ে ঝরে পড়ে৷ সেই জলের ফোঁটাগুলোর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বিন্দু বিন্দু রক্তের ঘ্রাণ পেলেন! এমন ফোঁটা ফোঁটা রক্ত দিদির ঠোঁট বেয়ে পড়ছিল!

বুকের ভেতরে একটা অশান্ত উচ্ছ্বাস! ছ-বছরের ছেলেটার অনুভূতিগুলো আবার ফিরে এল গহনের মধ্যে৷ অনুভব করলেন, হাত-পা কাঁপছে৷ একটা তীব্র অসহায়তা, রাগ, কান্না গলার কাছে জমে উঠেছে৷ চোখটা কড়কড় করছিল৷ গহন চোখে জলের ঝাপটা দিলেন৷ তবু জ্বলুনি কমল না৷ ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা জলের বোতল বের করে মাথায়, মুখে ঢেলে দিয়েছেন৷ তা সত্ত্বেও অনির্বাণ জ্বালা ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক করে দিতে চায়—প্রশমিত হয় না৷ অশান্তভাবে হলঘরে পায়চারি করে বেড়াচ্ছিলেন তিনি৷ কণা যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন৷ তাই যথাসম্ভব নিঃশব্দেই হেঁটে বেড়াচ্ছেন৷

বুকের ভেতরে ভূমিকম্প হচ্ছিল৷ একাত্তর সালের সেই অভিশপ্ত দিনটা পুরোনো ক্ষতকে খুঁড়ে বের করেছে৷ বারবার মনে পড়েছে শুঁটকির কথাগুলো—

—‘আজও তেমন একটা সময় আসছে গহন৷ আবার একটা অস্থির সময়! তার মধ্যে দাঁড়িয়েও চাঁদ-তারা-ফুল-পাখির সৌন্দর্যে নিজেকে জোর করে ডুবিয়ে রাখবি!…’

পাশের বাড়ির নিত্যনৈমিত্তিক চিলচিৎকারে চিন্তাসূত্র ছিঁড়ে গেল গহনের৷ ফের শুরু হয়েছে মারধর! এরপর কী হবে তা জানেন৷ কয়েকদিন আগে স্বচক্ষেই দেখেছেন৷ প্রথমে মার খাবে মেয়েটি, তারপর ধর্ষিত হবে একটা মদ্যপ পশুর হাতে!

দৃশ্যটা কোনোদিন দেখতে চাইতেন না গহন৷ চিরদিন এইসব কুৎসিত ছবিগুলো থেকে চোখ সরিয়ে নিয়েছেন৷ আজও তাই হওয়াই স্বাভাবিক ছিল৷ কিন্তু হল না!

গহন দ্রুত পায়ে চলে গেলেন ছাতে৷ সেখানে দাঁড়িয়েই গোটা দৃশ্যটা দেখলেন৷ অসম্ভব কষ্ট হচ্ছিল৷ অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করছিলেন৷ তবু আগের দিনের মতো চোখ সরিয়ে নেননি৷ স্তম্ভিত, নির্বাক, যন্ত্রণাকাতর দৃষ্টিতে সোজা তাকিয়ে রয়েছেন জানলার দিকে৷

অনেক রাতে, ঘরের আলো নিভে যাওয়ার পর মেয়েটি ফের এসে দাঁড়াল জানলার সামনে৷ ল্যাম্পপোস্টের আলো তার ফুলে ওঠা কপালের কালশিটে, রক্তাক্ত ঠোঁট ছুঁয়ে গেল৷ প্রাণহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে৷

গহন এই প্রথম তার চোখে চোখ রাখেন৷ মনে মনে যেন স্পর্শ করতে চাইছেন তার ক্ষতবিক্ষত মুখকে৷ যেমনভাবে কচি কচি হাত দুটো ছুঁয়েছিল তার দিদির মুখ! মেয়েটির চোখে অবিকল দিদির দৃষ্টি! জাগতিক সবকিছু ছাড়িয়ে কোন অসীমের দিকে যেন অজ্ঞান বেদনায় তাকিয়ে আছে৷

ও-প্রান্তে এক নির্বাক বিস্রস্তবসনা! এ-প্রান্তের মানুষটি কখন যেন পৌঁছে গেলেন একচল্লিশ বছর আগের দিনটায়৷ জলে ভরল তাঁর চোখ! সমস্ত প্রতিরোধ ছাপিয়ে বেরিয়ে এল অসহায় কান্না! দু-চোখে জল নিয়ে, চোয়াল শক্ত করে, দৃঢ় হাতের মুঠোয় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে সেই ছ’বছরের ছেলে! নিজের দেহে অনুভব করছে দিদির ক্ষতগুলোর যন্ত্রণা! মনে মনে বারবার স্পর্শ করছে সেই নারীকে! আর ডাকছে—‘দিদি…দিদি…দিদি…৷’

.

‘আ-বে শালা!’

সর্বশক্তি দিয়ে গাড়িতে ব্রেক কষল শুঁটকি৷ বরাতজোরে অল্পের জন্য গাড়ির তলায় চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে ছেলেটা৷ আর-একটু হলেই ওর আজকে ‘রাম নাম সত্য’ হত!

রোজকার মতোই চশমার দোকান থেকে রাতে ফিরছিল সে৷ গোপালের জন্য একবাক্স আইসক্রিম, চকোলেট, আপেল, আর চিপস কিনেছে৷ মহা ত্যাঁদড় ছেলে৷ কিছু খেতে ইচ্ছে করলেই চালের ড্রাম খুলে একমুঠো কাঁচা চাল মুখে চালান করে দেয়৷ অথবা ভাতের ফ্যান গিলে নেয়৷ যেন মহাসুস্বাদু জিনিস! শত বকেঝকেও তার এই অভ্যাস ছাড়াতে পারছে না৷ তাই এখন কূটনৈতিক রাস্তা ধরেছে শুঁটকি৷ বিকেলে প্রায়ই তাকে পিৎজা, এগরোল, চাউমিন ঘুষ দিচ্ছে৷ ভালো ভালো খাবার খেয়ে যদি তার এই বদভ্যাসটা পালটায়!

আগে শুঁটকির ফ্রিজে মদের বোতল, চানাচুর ছাড়া আর কিছুই থাকত না৷ এখন সেখানে শোভা পাচ্ছে কোল্ডড্রিংকস, ফ্রুট জুস, দুধের বোতল, কেক এবং অন্য রকমারি খাওয়ার জিনিস৷ গোপালের সৌজন্যে মদের বোতল বাড়িতে ঢুকছে না৷ বাচ্চাটা তাকে মদ খেতে দেখলে বাজে শিক্ষা পাবে, এই কথা ভেবেই একদিন সকালবেলায় উঠে সিদ্ধান্ত নিল—‘ধুত্তোর, আর মদ খাবই না৷’ সেদিন থেকে আর মদ স্পর্শও করেনি সে৷ এমনকি সিগারেট খেলেও বাথরুমে লুকিয়ে বা দরজা বন্ধ করে খায়৷ গোপালকে বিশ্বাস নেই৷ বাপ-মা মরা ছেলে৷ এতদিন মাথার ওপরে কেউ ছিল না৷ রাস্তার ছেলেদের সঙ্গেই মিশত৷ কে বলতে পারে, শুঁটকিকে দেখে হয়তো তারও শখ হল সিগারেটে টান মারার! অতএব ‘সাধু সাবধান’৷ ছেলের বাপ হওয়ার ঝক্কি নেহাত কম নয়!

আজও নিয়মমতো মার্কেটিং করে ফিরছিল সে৷ গোপালের দেখাশোনা করার জন্য এক মধ্যবয়স্কা গভর্নেসকেও রেখেছে৷ শুঁটকির দোকানে থাকার সময়টুকু সেই ওকে স্নান করায়, খাওয়ায় দাওয়ায়, পড়ায়৷ শুঁটকি ফিরলে তার ছুটি৷

আজ বেরোতে বেরোতে একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল৷ তার ওপর রাস্তায় জ্যাম৷ কোনোমতে জ্যামটা কাটিয়েই গাড়ি ফুলস্পিডে চালাচ্ছিল৷ ন-টার মধ্যে তাকে বাড়িতে পৌঁছোতেই হবে৷ নয়তো গোপাল না খেয়ে বসে থাকবে৷ বাচ্চা হলে কি হবে, জেদ আছে ছেলের৷

হয়তো সময়মতো বাড়ি পৌঁছোতে বিশেষ অসুবিধেও হত না৷ কিন্তু সব বিগড়ে দিল এই উটকো ছেলেটা৷ কোথা থেকে যেন হুড়মুড় করে এসে টপকে পড়ল গাড়ির ঠিক সামনে!

গাড়িটা কোনোমতে সাইড করেই সে একেবারে তেড়েফুঁড়ে ছুটে গেল ছেলেটার দিকে৷

—‘হারামজাদা! মরার জন্য আমার গাড়িটাই পেয়েছিলি তুই!’ শুঁটকি তাকে এই মারে তো সেই মারে! ছেলেটা চোখ কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে৷ অল্প অল্প টলছেও!

—‘অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেলে কী হত? তুই তো যমরাজের কোলে বসে হাওয়া খেতিস—আর আমি জেলখানায়!’

ছেলেটার বয়েস বেশি না৷ তাকে বেশ অপ্রকৃতিস্থও লাগছে৷ কোনোমতে বলল—‘আই অ্যাম সররররি! দেখতে পাইনি৷’

তার মুখ থেকে একটা পরিচিত গন্ধ পেল শুঁটকি৷ সে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ছেলেটাকে মাপছে৷ ব্যাটার শরীর কাঁপছিল৷ ‘দেখতে পাইনি’ বলেই রাস্তার ওপর হড়হড় করে বমিও করে ফেলে৷

শুঁটকি আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে৷ ঠিকই ধরেছে৷ মাতাল! কিন্তু একেবারে নবিশ! সদ্য সদ্যই মদ ধরেছে৷ পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের যুবক৷ ছেলেটার মুখটা মিষ্টি৷ ভারি কচি কচি নিষ্পাপ৷ এ ছেলের মদ খাওয়ার কথা নয়!

সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷ মাতালরা জাতে রক্তবীজের বংশধর৷ একটা মরলে, আর-একটা জন্মাবে! শুঁটকি নিজে মদ ছেড়ে দিয়ে ভেবেছিল—হয়তো দুনিয়ায় একটা মাতালের সংখ্যা কমাতে পেরেছে! কিন্তু কোথায় কী? সে ছেড়েছে, আর এই ব্যাটা ধরেছে৷

—‘নাম কী?’ শুঁটকি এবার খানিকটা নরম সুরে জানতে চায়৷

—‘উশ্রী!’

সে ছেলেটার নামই জানতে চেয়েছিল৷ কিন্তু উদ্ভট উত্তর পেয়ে হিস্ট্রিটা বুঝতে অসুবিধে হল না তার৷ ছেলেটার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল—‘টাইটেল?’

—‘জানি না’৷

—‘থাকে কোথায়?’

—‘জানি না৷’

—‘দিনে ক-বার খায়, কী দিয়ে ভাত মাখে, ক-বার পটি করে, কী সাবান ইউজ করে, ক-বার পার্লারে যায়, কি পেস্ট দিয়ে দাঁত মাজে, চোখে পিচুটি হয় কি না, মাথায় কতটা খুশকি আছে, সর্দির ধাত, পাইরিয়া বা আমাশা আছে কিনা জানিস?’

ছেলেটা কেমন বিস্মিত দৃষ্টিতে তার দিকে দেখছে! যেন শুঁটকি এইমাত্র মঙ্গলগ্রহ থেকে খসে পড়ল! শুঁটকি কিছুক্ষণ চুপ করে তাকে দেখল৷ মনে মনে কিছু স্থির করছে! পরক্ষণেই সপাটে এক থাপ্পড়!

—‘ফা-জ-লা-মি হচ্ছে! যার সম্বন্ধে আর কিছু তো দূর, টাইটেলটাও ঠিকমতো জানিস না তার জন্য মাল খেয়ে বাওয়ালি করছিস৷ গর্দভ৷ ইডিয়ট!’

চড়টা খেয়ে হকচকিয়ে গেল ছেলেটা৷ বিড়বিড় করে বলল—‘ফের শনিদেব!’

—‘কী!’

সে সামলে নেয়! চড় খেয়ে নেশাটা চটে গেছে৷ জেদি উত্তেজিত গলায় বলল—‘আমি শুধু এইটুকু জানি যে আমি ওকে সত্যিই ভালোবাসতাম৷’

—‘বাল ভালোবাসতি!’ শুঁটকি প্রায় তাকে তেড়ে মারতেই যায়—‘সত্যিই ভালোবাসলে ‘ভালোবাসতাম’ বলতি না! বলতি ‘ভালোবাসি’৷ ভালোবাসার কোনো অতীত-ভবিষ্যৎ হয় না৷ এ কি জুতো পেয়েছিস যে পুরোনো হলেই ‘এককালে সত্যিই পরতাম’ বলে অতীত করে দিবি!’

সে একটু থামল৷ কয়েক মুহূর্ত পর ফের নীচু স্বরে বলে—‘বাবা জানে?’

—‘কী?’

—‘তুই মদ খাস৷’

ছেলেটা প্রতিবাদ করে—‘আমি মদ খাই না৷ খাইনি কখনও৷’

—‘তাহলে তোর মুখ থেকে কীসের গন্ধ আসছে? দুধের? আমায় ছাগল পেয়েছিস?’

—‘না৷’ কচি কচি মুখটা দৃঢ় হল—‘আজ খেয়েছি৷’

—‘কেন খেয়েছিস?’

—‘আমি উশ্রীকে ভুলতে চাই…ওকে মন থেকে মুছে ফেলতে চাই…৷’

—‘গা-ড়ো-ল কোথাকার!’ শুঁটকি ধমকে ওঠে—‘কোথাকার অশিক্ষিত রে! মদ খেলে লোকে ভোলে? ছাতা ভোলে! মদ খেলে আরও বেশি মনে পড়ে! যত নেশা করবি, স্মৃতিগুলো বাস্তবকে ছাপিয়ে আরও কাছে আসবে৷ যা ভুলতে চাস, সেগুলোই যখন চোখের সামনে নাচবে—তখন ভালো থাকবি তুই? আর যখন তোর বাপ-মা দেখবে, ছেলে মাতাল হয়ে গড়াগড়ি দিচ্ছে, তখন তারা খুব খুশি হবে—তাই না?’

ছেলেটা তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে৷ তারপরই কথা নেই বার্তা নেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে৷ কান্নার চোটে তার নাকের জল, চোখের জল, মুখের লালা সব মিলেমিশে শার্টে পড়ছে৷

—‘যা বাব্বা! এ তো টোটাল ইমোশনাল!’ শুঁটকি রাগ ভুলে গিয়ে ছেলেটাকে বুকে টেনে নেয়৷ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে—‘কাঁদছিস কেন বাবা! এইটুকুতেই ভেঙে পড়লে চলবে! অ্যাঁ?’

তার আলিঙ্গনের আন্তরিকতায় ছেলেটার বোধহয় আরও কান্না পেয়ে গেল৷ বুকে যখন ব্যথার পাহাড় জমে তখনই একটু উষ্ণ স্পর্শের প্রয়োজন হয়! তার কান্না আরও উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠেছে৷ শুঁটকি তাকে কাঁদতে দিল৷ কাঁদুক৷ কান্না দুঃখকে অনেকটাই তরল করে দেয়৷ প্রাণ ভরে কেঁদে নিক৷

বেশ কিছুক্ষণ কান্নার পর আস্তে আস্তে শান্ত হল সে৷

—‘হয়েছে? এবার মুখ মুছে নে৷ চোখ-মুখের কী অবস্থা করেছিস! জল খাবি একটু?’ মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় ছেলেটা৷

গাড়ি থেকে জলের বোতল বের করে এনে তার চোখে-মুখে জল ছিটিয়ে দিল শুঁটকি৷ কয়েক ঢোঁক জল খেয়ে সে একটু ধাতস্থ হয়৷

—‘নাম কী তোর?’

ক্ষীণস্বরে উত্তর এল—‘মন্দার৷’

—‘মন্দার৷ বেশ নাম৷ বোস৷ তোর সঙ্গে একটু কথা বলি৷’

বলতে বলতেই শুঁটকি রাস্তার ওপরে বসে পড়েছে৷ মন্দারও একদম বাধ্য ছেলের মতো তার পাশে বসল৷ পিচের মসৃণ রাস্তার একদিক আটকে রেখেছে দুটো লোক৷ পিছন থেকে একরাশ গাড়ির অধৈর্য ভোঁ ভোঁ-পোঁ পোঁ-পিঁপ পিঁপ ভেসে এল৷ হেডলাইটের তীব্র আলো চোখে এসে পড়ায় শুঁটকি বিরক্ত হয়—‘ধুর মশাই, ভেঁপু বাজাচ্ছেন কেন? অতখানি রাস্তা ফাঁকা আছে দেখতে পাচ্ছেন না! ওদিক দিয়ে যান!’

একটি অল্পবয়সি মেয়ে ত্রস্তব্যস্ত হয়ে গাড়ি থেকে নেমে আসে৷ আতঙ্কিত স্বরে বলে—‘দাদা, এ রাস্তা দিয়ে কি যাওয়া যাবে না? কিছু হয়েছে নাকি?’

—‘না মামণি কিছু হয়নি৷ এটা রাস্তা রোকো নয়৷ ছোট্ট একটা মিটিং…আইমিন গজল্লা৷’ সে কান এঁটো করা হাসি হাসে—‘আসলে এখানে তো আর কোথাও বসার জায়গা নেই৷ সাইডে গাড়ি থামিয়ে গপ্পো মারলে পুলিশ প্রথমে টর্চ মেরে ভেতরের সিন দেখার চেষ্টা করবে৷ দুজন পুরুষ মিলে আর কী সিন করব! জড়াজড়ি-চুম্মাচাটি কিছুই দেখতে পাবে না৷ অতএব ব্যর্থ হয়ে খেপে গিয়ে ফাইন করবে৷ তাই রাস্তাতেই বসে পড়েছি৷’

মেয়েটির মুখে একটা কিম্ভূতকিমাকার এক্সপ্রেশন ফুটে ওঠে৷ যেন শুঁটকি নয়, এক্সহর্স্টিসের ভূত তার সঙ্গে কথা বলছে৷

দুজন মানুষকে সাইডে রেখে হুশহুশ করে বিনাপ্রতিবাদে গাড়িগুলো চলে গেল৷ সবারই এখন বাড়ি ফেরার তাড়া৷ তাই ঝামেলা করতে চায়নি৷ শুঁটকি মন্দারের দিকে তাকিয়ে চোখ টেপে—‘মেয়েটা রাপচিক ছিল—তাই না? বয়েসটা অল্প হলে ওর সঙ্গে একটু ফস্টিনস্টি করতাম৷’

মন্দার বিষণ্ণ—‘জানি না৷ দেখিনি৷’

—‘সে কী! তুই কী রে!’ সে চোখ কপালে তুলে ফেলেছে—‘রাস্তায় চলন্ত গাড়ি দেখতে পাস না! সামনে সুন্দরী মেয়ে দেখতে পাস না৷ পাগল না কবি!’

—‘কবিদের সম্পর্কে এরকম মন্তব্য করবেন না৷’ মন্দার ফোঁস করে ওঠে—‘আমার ভালো লাগে না৷’

শুঁটকি কুলকুল করে হেসে ফেলল—‘শালা, জাতে মাতাল তালে ঠিক! বুঝেছি, তুই কবি৷ এবার বল ঘোঁটালাটা কী?’

মন্দার লোকটাকে চেনে না৷ জীবনে কখনও দেখেনি৷ আর কখনও দেখবে কিনা ঠিক নেই! তবু মনে হল ওর কাছে সব কথা বলা যায়৷ যা এখনও পর্যন্ত কাউকে মুখ ফুটে বলেনি, সেই আন্তরিক ব্যথার কথাও বলে ফেলা যায় এই মানুষটির কাছে৷ এই রাতের বেলায়, মেইন রোডের ওপর বাবু হয়ে বসে কী করছে সে জানে না! কেন বলছে, কীজন্য বলছে তাও জানা নেই৷ শুধু এইটুকুই জানে, এই লোকটির সঙ্গ তার এই মুহূর্তে খুব প্রয়োজন৷

সব ঘটনাই ধৈর্য ধরে শুনল শুঁটকি৷ তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল—‘বোঝো! যাকে জানলি না, চিনলি না, ভালোবাসলি না—তার জন্য মাল খেয়ে শহরের রাস্তার ল্যাদ খাচ্ছিস৷’

—‘ভালোবাসিনি৷ কে বলল আপনাকে?’

—‘ভালোবাসার মানে জানিস তুই?’ সে বলল—‘ইন্টারনেটে একজন হরিদাস পাল নামের কবি দু-লাইনের একটা কবিতা পোস্ট করেছিলেন— ‘ভালোবাসা স্বপ্নের মতো, জেগে গেলে মাপা যায় না/ভালোবাসা পটির মতো, বেগে এলে চাপা যায় না৷’ প্রেমের নিয়মই হচ্ছে নিজেকে প্রকাশ করা৷ সে সবসময়ই চিৎকার করে বলতে চায়—‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’৷ সেখানে তুই মেয়েটার কাছেই বেমালুম চেপে গিয়েছিস৷ তাহলে ভালোবাসলি কবে?’

মন্দারের মনে পড়ল স্বপ্নেও কখনও ‘ভালোবাসি’ শব্দটা বলতে পারেনি সে৷ যখনই বলতে চেয়েছে, তখনই কালো, মুষকো লোকটা থাপ্পড় মেরে ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে৷ তবু নাছোড়বান্দা হয়ে বলে—‘কিন্তু আমি তো সবসময়ই ওকে ভালো ভালো গিফট দিয়েছি, ওকে নিয়ে কবিতা লিখেছি…’

—‘কবিতা যে বোঝে না, তাকে নিয়ে কবিতা লেখা, আর শুয়োরকে বিরিয়ানি খেতে দেওয়া—দুইই সমান৷’ শুঁটকি হাসল—‘তা ছাড়া যতদূর শুনলাম, তাতে মনে হল মেয়েটার মাথায় গিফটের দামটা যত ভালোভাবে ঢুকেছে, কারণটা ততটাই মাথার ওপর দিয়ে গেছে৷ তুই তো কবি৷ যে এত সহজ ব্যাপারটাই বোঝে না,—এমন মাথামোটা মেয়েকে বিয়ে করতে যাবি কোন দুঃখে৷’

মন্দার থমকে যায়৷ ব্যাপারটা এভাবে সে ভেবে দেখেনি৷

—‘কবি আর তার বউ হবে টেনিস প্লেয়ারের মতো৷’ সে হাসতে হাসতে বলে—‘কবি এদিক থেকে ‘ঠুক’ করলে সে-ও ওদিক থেকে সমান তালে ‘ঠাক’ করবে৷ বিজনেসম্যান, কর্পোরেট কর্তারা ‘শো-পিস’ নিয়ে ঘর করতে পারে৷ কিন্তু তোর তো বাবা রক্তমাংসের মেয়ে দরকার৷ কাচের সুন্দর মূর্তি নিয়ে কাব্যি করতে পারিস, ঘর করবি কীভাবে?’

বলতে বলতেই সে সিগারেট ধরায়—‘নিজের ওজনটা আগে বোঝ বাচ্চা৷ যে-কোনো শিক্ষিত বা অশিক্ষিত পয়সাওয়ালা লোকের পায়ে তেল মাখাতে অনেকেই চায়৷ পা টিপে দিতে পারে, এমনকি পা চাটতেও পারে৷ তবে সবের পিছনেই কিছু-না-কিছু স্বার্থ থাকে৷ কিন্তু কবি, সাহিত্যিক প্রজাতিটা একটু আলাদা! লোকে তাদের পায়ের কাছে মাথা ঝোঁকায়৷ প্রণাম করে৷ এবং বিনা স্বার্থেই করে৷ এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য বুঝিস?’

মন্দার চুপ করে শুনছিল৷ এতদিন কেউ তাকে এসব বলেনি৷ বাড়িতে বা শুটিংয়ের সেটে ঝাড় খেতে খেতে কখনও মনে হয়নি যে সে আলাদা! কেউ কখনও বলে দেয়নি—‘মন্দার, তুমি স্পেশাল!’

সে কথা বলতেই শুঁটকি মুখ টিপে হাসে—‘এখানেই কবি কেঁদেছেন! একজন বলেছে৷ কিন্তু তুই এমনই বুদ্ধু যে বুঝতেই পারিসনি৷ অথবা গুরুত্ব দিসনি৷’

কার কথা বলছে লোকটা! মন্দারের মাথায় সব তালগোল পাকিয়ে যায়৷

—‘ভালোবাসা নয়, তুই একটা ধাক্কা খেয়েছিস৷ কচি বয়েসে একটা ব্যথা পেয়েছিস৷ সেই ব্যথাকে ব্যবহার কর৷ কবিতা লেখ৷’ সে হেসে ওঠে—‘যন্ত্রণা ছাড়া কি সৃষ্টি হয়? মদ নয়, কবিতা ধর৷ মদ তোকে কষ্ট দেবে! আর কবিতা শক্তি৷ যাকগে, অনেক কথা বলেছি—এবার বল—! তোর বাড়ি কোথায়?’

—‘কেন?’

—‘সারারাত এখানে বসে আড্ডা তো মারতে পারি না৷ নিজে বাড়ি যেতে পারবি? না ড্রপ করে দেব?’

মন্দারের নেশা প্রায় কেটেই গিয়েছিল৷ সে মাথা নাড়ে—‘না, আমি যেতে পারব৷’

—‘গুড৷ বিন্দাস বাড়ি যা! ভালো করে একটা ঘুম দে৷ তারপর কাল সকালে উঠে কথাগুলো মন দিয়ে ভেবে দেখবি৷’

—‘আচ্ছা৷’

সে উঠে দাঁড়ায়৷ শুঁটকিও দাঁড়িয়ে পড়ে জামা-প্যান্ট ঝাড়ছে৷

—‘থ্যাঙ্কস দাদা৷’ মন্দার তার দিকে কৃতজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টিপাত করে চলে যাচ্ছিল৷ পিছন থেকে ডাক এল—‘এই শোন৷’

সে সচকিত হয়ে ওঠে—‘কিছু বলবেন?’

—‘মেয়েটার বোনটার নাম কি যেন?’

—‘ঊর্মি৷’ মন্দার বিস্মিত—‘কেন?’

শুঁটকি রহস্যময় হাসি হাসল—‘ওর টাইটেল আর ঠিকানা জেনে নিস৷ পারলে বাকি ডিটেলসগুলোও৷ কাজে লাগবে৷ চল বাই৷’

স্তম্ভিত মন্দারকে সেখানেই রেখে হনহন করে চলে গেল সে৷

তার গাড়িটা এক সাইডেই দাঁড় করানো ছিল৷ ড্রাইভিং সিটে বসতেই আচমকা একটা মৃদু মিষ্টি গন্ধ তাকে ছুঁয়ে গেল৷ হাস্নুহানার গন্ধ!

—‘রুমা!’ যুগপৎ বিস্ময় ও আনন্দ মেশানো কণ্ঠে ডেকে উঠেছে শুঁটকি! পাশের সিটে এক নারীর ছায়া ছায়া অবয়ব!

—‘কখন এসেছ?’ সে একটু অনুতপ্ত হয়ে বলে—‘অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছ তাই না? সরি, আসলে ওই ছেলেটা…কি নাম যেন, তাকে জ্ঞান দিতে গিয়েই দেরি হয়ে গেল৷ আজকের ছেলেপুলেগুলোও পারে! শুধু অ্যাট্রাকশনকেই প্রেম ভেবে বসে থাকে৷ তারপর ল্যাং খেয়ে কুপোকাত! আসল প্রেম যে কী জিনিস, তা বোঝার আগেই লাইফ বরবাদ করে ফেলে৷’

বলতে বলতেই হাসল শুঁটকি—‘আসলে কি জানো? আমার কাছে বুবাই, গোপাল—এইসব ছেলেগুলো, সবাই একরকম৷ যদি বুবাই কখনও এরকম কাণ্ড ঘটাত—তোমার, আমার ভালো লাগত? ওই ছেলেটার মা-বাবাও তো আমাদেরই মতো৷ তাই একটু বোঝাচ্ছিলাম৷’

বলতে বলতেই তার চোখে স্বপ্নিল আচ্ছন্নতা ভেসে উঠেছে৷ দু-চোখে ঝলমলে আকাশ নিয়ে সে বলল—‘দেখো রুমা, যেদিন ও সত্যিই প্রেমে পড়বে, সেদিন চতুর্দিক হাস্নুহানার গন্ধে ভেসে যাবে৷ সেদিন ওর রক্তে রক্তে মল্লার বাজবে৷ সেই মুহূর্তটা জীবনে ও কখনও ভুলতে পারবে না…কোনদিনও ভুলতে পারবে না…আমার মতো…যেমন আমি পারিনি…৷’

শুঁটকির মনে হল নারীমূর্তিটা হেসে উঠেছে৷ তার ঠোঁটে ঝলমল করছে খুশির হাসি৷ একটা ছায়া ছায়া হাত শুঁটকির হাত জড়িয়ে ধরেছে৷ যেন বলতে চাইছে—‘আমি আছি৷’

—‘এসো, তোমায় সিটবেল্ট পরিয়ে দিই৷’ সে ছায়ামূর্তিকে বেল্ট পরাতে পরাতে বলে—‘তারপর চলো, বাড়ি যাই৷ আমাদের বাড়ি৷ যেখানে তুমি আছ, আমি আছি, বুবাই আছে আর গোপাল আছে৷’

ছায়ামূর্তি আবার হাসল৷ হাস্নুহানার গন্ধে ভরে উঠল মুহূর্তটা!

.

দেখতে দেখতে একমাস কেটে গেল৷ আবহাওয়া বদলাল৷ বদলাল রাজনৈতিক পরিস্থিতি৷ বাজারদর আরও কয়েক ধাপ চড়ল৷ প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে সম্পর্কের দিশা বদলাল৷ জীবন নানা মোড় নিল৷

বদলাল না শুধু কবিতা ডট কম৷ আর তার নিত্যনৈমিত্তিক কাদা ছোড়াছুড়ি৷

—‘কবিতায় অশ্লীল শব্দ ব্যবহারের আমি বিরোধী নই৷ কলোকিয়াল শব্দ, খিস্তি ব্যবহার করেও দারুণ সব কবিতা লেখা যায়৷ কিন্তু এ আবার কী! কবি যেভাবে চ-কার শব্দটি অকারণে ব্যবহার করেছেন তাতে একটা ট্যাক্সিওয়ালারও উত্তেজনা হবে না!’

—‘চ-কার শব্দটিকে কুবলাশ্ব অশ্লীল কেন বলতে চাইলেন বুঝতে পারলাম না৷ এটি যথেষ্ট ভালো শব্দ৷ বাংলা অভিধানে এর অর্থ, শারীরিক মিলন বা সঙ্গম৷’

—‘স্বর্ণাভদা, তাহলে ‘মিলিত হত’ লিখলেই তো ল্যাঠা চুকত৷ ওই শব্দটি ব্যবহার করার দরকার পড়ল কেন? সমস্ত কবিতাটির ভাষা প্রায় রাবীন্দ্রিক৷ হঠাৎ করে তার মধ্যে ফা;নী রায়, মলয় রায়চৌধুরীদের ঢুকে পড়ার কারণ কী! তা-ও আবার একটি শব্দের জন্য! একবারের জন্য ভেবেছিলাম, হয়তো ভুল করে শব্দটি লিখে ফেলেছেন৷ কিন্তু ষষ্ঠ লাইনটি পড়ে চক্ষু চড়কগাছ৷ ওই একই শব্দ ডেলিবারেটলি ফের ষষ্ঠ লাইনে লিখেছেন তিনি৷ এমনকি পরের লাইনেও! নগ্ন নারীর ছবি আঁকা দোষের নয়৷ শুধু পায়ে মোজা পরানোটা মেনে নিতে পারলাম না৷’

কবিতা ডট কমে-এ আজ আবার খামচাখামচি শুরু হয়েছে৷ কবি ‘অন্য কেউ’ একটা কবিতা পোস্ট করেছেন৷ সে কবিতাটা আপাতদৃষ্টিতে বেশ নিরীহ৷ বেশ সুন্দর রাবীন্দ্রিক ছিমছাম রোমান্টিসিজম নিয়ে শুরু হয়েছিল৷ কিন্তু পঞ্চম লাইনে এসেই পিলে চমকে গেল৷

রবীন্দ্রনাথ যদি হঠাৎ জোববা-টোববা ছেড়ে, মাইকেল জ্যাকসনের পোশাকে মুন ওয়াক করতে শুরু করেন তাহলে যা হয় আর কী! রোমান্টিসিজম ও আতুর শব্দাবলি ছেড়ে কবি একেবারে সোজাসুজি চ-কার ব্যবহার করেছেন! আর সেটা নিয়েই স্বর্ণাভ গুপ্ত অ্যান্ড কোং-এর সঙ্গে কুবলাশ্বর অবধারিত ঠোকাঠুকি৷

মন্দার নিজেও কবিতাটা পড়ে আঁতকে উঠেছিল৷ খিস্তি দেওয়া, গালিগালাজ দেওয়া বুদ্ধিদীপ্ত কবিতা সে অনেক পড়েছে৷ দেখেছে সে কীভাবে কলোকিয়াল, তথাকথিত ‘অশ্লীল’ শব্দকেও শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়৷ কিন্তু এমন গোদা পদ্ধতিতে সুড়সুড়ি দেওয়ার প্রচেষ্টা দেখে, সে হাসবে না কাঁদবে ভেবে পাচ্ছিল না৷

—‘কুবলাশ্ব কি আগে কখনও কবিতায় অশ্লীল শব্দের প্রয়োগ দেখেননি? তাঁকে হাংরি জেনারেশনের কবি মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা পড়ে দেখার অনুরোধ করছি৷ কবি ব্রাত্য রাইসুর একটি কবিতার লাইন যদি—‘ঘরের ভিতর ভাউয়া ব্যাঙে করছে চোদাচুদি’ হতে পারে, তবে ‘অন্য কেউ’ কি দোষ করেছেন?’

—‘স্বর্ণাভদা, কবি মলয় রায়চৌধুরীর যে বিশেষ কাব্যগ্রন্থের দিকে ইঙ্গিত করছেন, সেই ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’, আমিও পড়েছি৷ সমস্যাটা মলয় রায়চৌধুরী বা ব্রাত্য রাইসুর কবিতা নিয়ে নয়৷ যে কবি লেখেন—‘কেন আমি পিতার আত্মমৈথুনের পরে তার পেচ্ছাপে বয়ে যাইনি/কেন আমি রজস্রাবে মিশে যাইনি শ্লেষ্মায়’ সেই কবি কখনোই দাবি করেননি যে তিনি মাইকেল মধুসূদনের বংশধর৷ কবি ব্রাত্য রাইসুর যে কবিতাটির কথা আপনি বলেছেন, সেই কবিতার কাব্যগ্রন্থটির নাম থেকেই কবি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে তিনি স্বভাব ফিচেল৷ যাঁর কাব্যগ্রন্থের নাম ‘আকাশে কালিদাসের লগে ম্যাঘ দেখতাসি’, তিনি এমন কবিতা লিখবেন তাতে আর আশ্চর্য কী! যাঁর কবিতার লাইন এরকম—‘কাউয়া বলে কা-কা/কলা বলে কলা খা’ কিংবা ‘চেয়ার বহনকারী দুইজন নারী/চেয়ারের চেয়ে তারা ভারী…’ তিনি যতই কালিদাসের সঙ্গে মেঘ দেখুন, নিজেকে কালিদাসের রি-ইনকারনেশন বলেননি৷ তাই তাঁর ফিচেল মুড বা রাইটিং স্টাইলে ‘ভাউয়া ব্যাঙের চোদাচুদি’ চলে যায়৷ কিন্তু কবি ‘অন্য কেউ’ যেভাবে পাইরেটেড রবীন্দ্রনাথ হওয়ার ভণ্ডামি দেখান সেখানে হঠাৎ চ-কারের অনুপ্রবেশ সহ্য হয় না!’

মন্দার হাঁ! ‘কুবলাশ্ব’-কে ভালো লাগত বটে৷ কিন্তু সে যে স্বর্ণাভ গুপ্ত’র মতো আঁতেলকেও শুইয়ে দেওয়র ক্ষমতা রাখে তা জানা ছিল না৷ এতদিন লোকটার প্রতি তার একটা অদ্ভুত ভালো লাগার অনুভূতি ছিল৷ এবার যুক্ত হল শ্রদ্ধা! লোকটা রীতিমতো শিক্ষিত৷ হয়তো মন্দারের চেয়েও বেশি পড়াশোনা করা মানুষ!

এবার উলটে পড়া গুরুদেবকে টেনেটুনে তোলার জন্য মগনলাল এসে হাজির হয়েছে—‘কুবলাশ্ব আসলে কী বলতে চান? তাঁর কোনটায় আপত্তি? কবিতাটায় না শব্দটায়?’

কুবলাশ্ব নিশ্চয়ই উত্তর দিত৷ কিন্তু তার আগেই তাকে কভার করল ‘একা মেঘ’৷

—‘মগনলাল, আপনি কি এতক্ষণ ঘুমোচ্ছিলেন? না কুবলাশ্ব হিব্রুভাষায় কথা বলছেন? যে-কোনো রচনার একটা নিজস্ব ভাষা থাকে৷ এখানে প্রথম কয়েকলাইন এতটাই মসৃণ যে আচমকা বিশেষ পাঠক হোঁচট খাচ্ছে৷’

মন্দারও আর থাকতে পারল না৷ সে ‘রামহনু’ হয়ে নেমে পড়ল যুদ্ধক্ষেত্রে—‘মেঘদা আপনি শুধু হোঁচট খেলেন! আমি যে চেয়ার থেকে পড়েই গেনু!’

প্রতিপক্ষ ক্রমশই শক্তিশালী হয়ে উঠছে দেখে স্বর্ণাভ-র দলবলও তেড়ে আসে৷ স্বর্ণাভ-র অতিপ্রিয় ই-ভগিনী ‘তুর্কি’ এমনিতে মহা নাকউঁচু মহিলা! নিজের কবিতা দিয়ে আপামর জনগণকে ধন্য করাই তার স্বভাব৷ আর বেছে বেছে নিজেদের দাদাদের কবিতাতেই মন্তব্য করে৷ তথা পিঠ চুলকায়৷ অন্য কারুর কবিতা পড়েও দেখে না!

এই সাইবার কবিতা জগতে মেয়েদের বড়োই সুবিধা৷ মেয়ে কবির সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম বলে মেয়েরা কবিতা লিখলেই ছেলেরা প্রশংসা করার জন্য লাফিয়ে পড়ে৷ যতই ‘ঝুলস্য ঝুল’ লিখুক না কেন, সবাই মিলে ‘বাঃ বাঃ’ বলে হাওয়া দিতে থাকে৷

তুর্কি তেমনই গরম হাওয়ায় ভরা ফানুস! মাঝেমধ্যে ওর ওই ফোলানো পশ্চাদ্দেশে পিন ফুটিয়ে দেওয়ার লোভ হয় তার৷ আজকে আচমকা সে সুযোগ জুটেও গেল৷

—‘কবির কি শব্দচয়নের স্বাধীনতা নেই! তিনি হয়তো মোলায়েম শব্দগুচ্ছ ছেড়ে এক্সপেরিমেন্টাল কিছু করতে চেয়েছেন৷ আমার মনে হয় এই প্রচেষ্টা যথেষ্টই গঠনমূলক৷’

তুর্কি যে স্বর্ণাভদেরই সাপোর্ট করবে তা জানাই ছিল৷ মন্দার ‘রামহনু’ হয়ে লিখল—‘তুর্কিদেবী, এক্সপেরিমেন্ট করতে হলে শুরু থেকেই সেটা করা উচিত৷ কবিতার মাঝখানের শুধু একটি শব্দের ওপরই তাকে এক্সপেরিমেন্ট করতে হল? এ কেমন এক্সপেরিমেন্ট! বঙ্কিমচন্দ্র যদি এমন এক্সপেরিমেন্ট করে কখনও লিখতেন—প্রাতঃকালে মুখপ্রক্ষালনাদি সমাপন করিয়া, ভোজন পর্ব সমাধা করিয়া, অশ্বারোহণ পূর্বক অবন্তীনগরে প্রত্যাবর্তন মাত্রই ক্লান্তদেহে বৃক্ষতলে ধপ্পৎ কইরা হুইয়া পড়লাম,—তাহলে সেটা কি জাতীয় ইতিবাচক এক্সপেরিমেন্ট হত?’

তার কথাকে সমর্থন করেই কুবলাশ্ব দাঁত বের করা একটা স্মাইলি দিয়েছে৷ মন্দার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে হাসল৷ মনে মনে বলে—‘চলো গুরু একসঙ্গে লড়ি৷’

এই নিয়েই বেশ কিছুক্ষণ আকচাআকচি চলল৷ কুবলাশ্ব চিরকালই ভালো লড়িয়ে৷ কিন্তু একা মেঘ আর রামহনুও যেন আজ রুদ্রমূর্তি ধরেছে৷ স্বর্ণাভ’র দল তখন পালানোর পথ পাচ্ছে না!

অবশেষে কবি ‘অন্য কেউ’ স্বয়ং আবির্ভূত হলেন৷ বললেন—‘আসলে আমি বাংলা ভাষায় ঠিক সড়গড় নই৷ ইনফ্যাক্ট দীর্ঘ তিন বছর ধরে একটা বাংলা কবিতাও লিখিনি৷ ইংলিশ ইজ মোর কমফর্টেবল৷ ইংরেজির শব্দভাণ্ডার অনেক সমৃদ্ধ৷ আমি কবিতাটায় রাফ রাস্টিক টাচ আনতে চেয়েছিলাম৷ কিন্তু বাংলা ভাষায় তেমন শব্দ খুঁজে পেলাম না’৷

ন্যাকামি দেখে মন্দারের মাথা গরম হয়ে গেছে৷ সে খটখট করে টাইপ করে—‘এটা কি জাতীয় ঢ্যামনামি? বাংলায় রাফ অ্যান্ড রাস্টিক শব্দ নেই! স্বর্ণাভদা একটু আগেই মলয় রায়চৌধুরীর রেফারেন্স দিচ্ছিলেন কুবলাশ্বকে৷ আপনাকে দেননি? আর বাংলা ভাষার প্রতি যদি এতই অনীহা তবে বাংলা কবিতা লিখতে আসেন কেন?’

এবার বোধহয় ‘অন্য কেউ’ কেঁদেই ফেলেছেন৷ লিখলেন—‘ও খুড়ো, কেন আমায় বারবার লিখতে বলো! দেখছই তো আর কবিতা লিখতে পারি না৷ এ গালাগালি আর সহ্য হয় না!’

তুর্কি একেবারে বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনী—‘ঢ্যামনামি! একজন কবিকে এ কি জাতীয় বিশেষণ দেওয়া হচ্ছে! আমি অ্যাবিউস রিপোর্ট করছি৷’

স্বর্ণাভ লিখল—‘আমিও অ্যাবিউস রিপোর্ট করছি৷’

যা! নালিশ কর৷ নালিশ করে বালিশ পাবি! মন্দার কম্পিউটারকে টার্ন-অফ করে দেয়৷ সে জানে এরপর কী হবে৷ ‘অন্য কেউ’ নাকে কেঁদে বেড়াবেন, আর মডারেটর ব্যাসদেব তাঁর পিছনে পিছনে টিস্যুর দলা নিয়ে ঘুরবেন৷

বাইরে তখন ফটফটে রোদ আমগাছের পাতায় পাতায় লুকোচুরি খেলছিল৷ তার মধ্যে একটা লম্বা নারকেল গাছের শান্ত ছায়া ঝিরঝির করে এসে পড়েছে৷ সেদিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে গেল মন্দার৷ প্রায় একমাস হয়ে গেল সে স্ক্রিপ্ট-রাইটারের কাজ ছেড়ে দিয়েছে৷ সেদিন যে লোকটা মাঝপথে প্রায় দেবদূতের মতো এসে হাজির হয়েছিল, তার প্রতিটি কথা পরদিন মন দিয়ে ভেবে দেখেছে৷ ভাবতে ভাবতেই সে অদ্ভুতভাবে আবিষ্কার করেছিল নিজেকে৷ আবিষ্কার করেছিল এগারোশো স্কোয়্যার ফিটের ফ্ল্যাট, ব্যাংক ব্যালেন্স, গাড়ি—কোনোটাই তার নিজের স্বপ্ন ছিল না! এর কোনোটাই সে আসলে চায়নি৷ উশ্রীকেও ভালোবাসেনি৷ ভালোবাসার জন্য যতখানি চেনার প্রয়োজন, ততটা পরিচয় কখনোই উশ্রীর সঙ্গে তার হয়নি৷ সে শুধু একটা মোহ ছিল৷ যেমন ওয়ার্ল্ডকাপ জেতার উন্মাদনা৷ একটা সোনালি-রুপোলি কিংবা প্ল্যাটিনামের সুদৃশ্য কাপ! জেতার আগে মনে হয় কী দুর্মূল্য জিনিস! অথচ জেতার পর সেটার মূল্য শুধু শো-কেসই বোঝে৷

উশ্রী মন্দারের কাছেও তেমনই৷ একটা সুদৃশ্য অধরা কাপ! যাকে জয় করার জন্য এগারোশো স্কোয়্যার ফিট, গাড়ির স্বপ্ন দেখতে বাধ্য হয়েছিল সে৷

ওই সিড়িঙ্গে লোকটা তার জীবনে এসে পড়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেল, প্রেম আর উন্মাদনা দুটো সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস! জানিয়ে গেল যে কবির সবচেয়ে বড়ো মাহাত্ম্য এগারোশো স্কোয়্যার ফিটে নয়! তার ছোট্ট আসনে সে নিজেই মহান৷

যেদিন মন্দার চাকরি ছাড়ল, ছেড়ে দিল উশ্রীকে—সেদিন মনে হয়েছিল বুক থেকে একটা বিরাট পাথর নেমে গেল! টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোয় দাঁড়িয়ে বুক ভরে উন্মুক্ত জীবনের শ্বাস নিয়েছিল সে৷ আর পৌঁছানোর তাড়া নেই, পান্ডা তথা পেন্ডুলামের দাঁত খিঁচুনি নেই, বোকা বোকা ডায়লগ লিখে আর আত্মধিক্কারে ভুগতে হবে না৷ ‘কবি’ বলে কেউ তাকে অপমান করবে না৷ কাউকে পাওয়ার জন্য টাকার পিছনে র্যাটরেসে নামার আর দরকার নেই৷

তবে চাকরি ছেড়ে সে একেবারে হদ্দ বেকার হয়ে বসে নেই৷ চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার তিনদিন পরেই একটা অজানা নম্বর থেকে ফোন এল মন্দারের মোবাইলে৷

—‘হ্যালো৷’

ও প্রান্তে রহস্যময়ী নারীকণ্ঠ—‘বলো তো কে?’

মন্দার নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেল৷ এ গলা তার চেনার কথাই নয়! কারণ গলার মালিক কোনোদিন তাকে ফোন করেনি৷ কিন্তু এই দুষ্টু দুষ্টু হাসিমাখা গলাটাকে চিনতে তার কোনো অসুবিধেই হল না!

—‘ঊর্মি! তুমি!’

—‘ইয়েস স্যার৷’ ঊর্মি ওপ্রান্তে সজোরে হেসে উঠেছিল—‘আমার টিফিনবক্সটা তোমায় খুব মিস করছে৷ তাই ভাবলাম, খবর নিই৷ কেমন আছ?’

—‘চাকরি ছেড়ে একটা দামড়া ছেলে বাপের হোটেলে যেমন থাকে—তেমনই আছি৷’

ঊর্মি ফের হাসল—‘তার মানে তুমি খই ভাজছ!’

—‘হ্যাঁ, ভাজছি৷ খাবে তো চলে এসো৷’

সে যেন এই প্রস্তাবটার জন্য তৈরিই হয়েছিল৷ প্রায় তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলল—‘ঠিকানাটা বলো৷ এক্ষুনি আসছি৷’

মন্দারকে স্তম্ভিত করে সত্যি সত্যিই সেদিন তার বাড়ি চলে এসেছিল ঊর্মি৷ তাকে দেখে প্রথমেই ‘থ’ হয়ে গিয়েছিল সে৷ চিনতেই পারেনি! বরং প্রথমে উশ্রী ভেবেই ভুল করতে যাচ্ছিল৷ অবিকল একইরকম দেখতে৷ শুধু চুলের স্টাইলটা অন্যরকম, আর চেহারাটা একটু বাল্কি! এ ছাড়া দুজনের চেহারায় কোনো বাহ্যিক তফাত নেই! এ মেয়েটা এমন সুন্দরী! তবে ওরকম বিটকেল জামাকাপড় পরে থাকত কেন?

মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছিল মন্দার৷ তাকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে হেসে ফেলে ঊর্মি৷ মন্দার তখনই বুঝল—উশ্রীর পক্ষে এমন হাসি হাসাই সম্ভব নয়৷ চোখে সপ্রতিভ অথচ শান্ত গভীরতা, হাসিতে স্নেহ-মমতা ঝরে পড়ছে—ঊর্মিকে উশ্রীর চেয়ে অনেক বেশি সুন্দরী মনে হল তার!

অথচ এই মেয়েটা দিনের-পর-দিন মাথায় ওড়না বেঁধে, ভুরু ঢাকা মোটা ফ্রেমের চশমা পরে, ঢলঢলে আউটফিট পরে বসে থাকত! নিজের সৌন্দর্যকে একটা আবরণের পিছনে লুকিয়ে, সুন্দরী দিদির পাশে নিজেকে অসুন্দর প্রমাণ করার চেষ্টা করত৷

—‘তুমি তো একদম…৷’

—‘উশ্রীর মতো দেখতে৷ তাই না?’ খিলখিল করে হেসে ওঠে ঊর্মি— ‘আগেই তো বলেছিলাম, আমাদের দু-জনকেই একরকম দেখতে৷ শুধু বাইরের লোক বুঝতে পারে না৷’

—‘কী করে বুঝবে?’ সে বলল—‘মাথায় ফেট্টি বেঁধে, নাকে পাঁউরুটি ফ্রেমের চশমা চাপিয়ে, ভুরু ঢেকে, তাঁবুর মতো সালোয়ার কামিজ পরে বসে থাকলে বোঝাও সম্ভব নয়৷’

উত্তরে ঊর্মি মুখ টিপে হাসে—‘তাহলে দেখো, সৌন্দর্য ব্যাপারটা কতটা আপেক্ষিক৷ আউটফিটের সঙ্গে সঙ্গে রং বদলায়৷’

কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে দিব্যি মা, বাবা আর টিকলির সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলল৷ আধঘণ্টা পর মায়ের তৈরি ব্রেড রোলে কামড় দিতে দিতে মন্দারের বিছানায় দিব্যি ঠ্যাং তুলে ঠাকুরানির মতো বসে বলল—‘তারপর চাকরি-বাকরি ছেড়ে কী করবে ভেবেছ?’

—‘আপাতত ঘাস সাপ্লাই করা ছাড়া আর তো কোনো অপশন দেখছি না৷’

—‘হুমমম…ব্রেড রোলটা দারুণ৷’ মন্দারের চোখের সামনেই গোটা প্লেটটাই একা সাবাড় করে দিয়ে বলে ঊর্মি—‘ঘাস সাপ্লাইটা মেইন বিজনেস হিসাবে রাখতে পারো৷ তবে তার সঙ্গে একটা পার্ট-টাইম জব করলেও মন্দ হয় না৷ তোমারও খারাপ লাগবে না৷ আর-একজনেরও উপকার হয়৷’

—‘কীরকম?’

ঊর্মি তখনই তাকে অফারটা দিয়েছিল৷ তার এক কাকা নামকরা একটি পাক্ষিক পত্রিকার এডিটর৷ ওই পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে বাংলা সাহিত্যে পারদর্শী ছেলে-মেয়ে লাগবে৷ সপ্তাহে পাঁচদিন অফিস৷ সময়ের তেমন কড়াকড়ি নেই৷ শনি-রবিবার ছুটি৷

—‘কিন্তু হঠাৎ আমাকে নিয়ে পড়লে কেন…? তুমিও তো চাকরিটা করতে পারতে৷’ মন্দার বলে—‘নাকি সারাজীবনই উশ্রীর সেক্রেটারির চাকরি করে যাবে!’

—‘একদম না৷’ ঊর্মি হাসল—‘আমি কারুর সেক্রেটারি নই, বরং হোম মিনিস্টার হওয়ার তালে আছি৷ তা ছাড়া ওসব চাকরিবাকরি আমার পোষাবে না৷’

—‘তাহলে কী পোষাবে?’

—‘আপাতত আর-একটা ব্রেড রোল৷’ ঊর্মি ধনুকের মতো ভুরু নাচায়—‘হবে?’

ঊর্মির ধাক্কা খেয়েই কপাল ঠুকে কাজটার জন্য অ্যাপ্লাই করে দিয়েছিল মন্দার৷ ছোটোবেলা থেকে বাংলা-ইংরেজি দুটো ভাষাই তার সমান দখলে৷ চাকরিটা পেতেও বিশেষ অসুবিধে হয়নি৷ দারুণ ইনটারভিউ দিয়েছিল৷

আপাতত সেই কাজটাই করছে সে৷ স্যালারি খুব বেশি নয়৷ তবে ভদ্রস্থভাবে চলে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট৷ কিন্তু কাজটা করতে খুব ভালো লাগছে৷ বিশেষ করে কবিতার বইয়ের রিভিউ-এর দায়িত্বটা নিয়ে সে খুব খুশি৷ কত নামকরা কবি, সাহিত্যিকের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হচ্ছে৷ তাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হচ্ছে!

একমাস আগে যখন উশ্রীর প্রত্যাখ্যানে ব্যথিত হয়ে মদ খেয়ে মাতলামি করছিল, তখন কি জানত জীবন এভাবে সুন্দর একটা বাঁক নেবে! ওই লোকটা আচমকা এসে থাপ্পড় না মারলে সে হয়তো আজও মাতাল হয়ে কোনো নর্দমার পাশে পড়ে থাকত৷ জীবন এমন সুন্দর—তা জানা হত না৷ বন্ধুত্ব এত সুন্দর তাও অজানা থাকত৷ ঊর্মির বন্ধুত্ব, নিজের মনের মতো কাজ করার আনন্দ—কোনোটাই পেত না সে৷

আজকাল স্বপ্নে শনিদেব এসেও আর হামলা করছেন না৷ সব মিলিয়ে বড়ো শান্তিতে আছে মন্দার৷ সবকিছুই ভালো লাগছে৷ এমনকি টিকলির ভয়ংকর এক্সপেরিমেন্টাল ডিশগুলোও খুব সুস্বাদু মনে হয়৷ অফিস থেকে ছুটি হওয়ার পর ঊর্মির সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা বা কুলফি খেতে ভালো লাগে৷ ভালো লাগে তার সঙ্গে পার্কে বসে চিনেবাদাম চিবোতে৷ সে বীরপুঙ্গবের মতো জানায় আজকে কোন কোন কবিকে রিভিউতে একহাত নিয়েছে৷ ঊর্মি মুখে সস্নেহ হাসি নিয়ে সব শোনে৷ আবার মন্দারের কথা শুনে সে ‘কবিতা ডট কমের কবিতাও’ পড়তে শুরু করেছে৷ সে বিষয়ে আলোচনা হয়৷

সব মিলিয়ে সময়টা বড়ো সুন্দর৷ যে কন্ডাক্টারটা রোজ রেজগি নিয়ে ঝামেলা করে, কখনো কখনো তাকেও চুমু খেতে ইচ্ছে করে মন্দারের! নেহাত সেটা সম্ভব নয় বলে চেপে গেছে৷

নারকেল গাছের তিরতিরে ছায়াটার দিকে তাকিয়ে আপনমনেই নিজের কথা ভাবছিল সে৷ এত সুখ, এত আনন্দ হঠাৎ কোথা দিয়ে এল! একমাস আগেও যে জীবনটাকে ফ্যাকাশে মনে হচ্ছিল, সে কোথা থেকে এত রং নিয়ে এসে হাজির হল! জীবন কি এমনই! কোথায়, কোন বাঁকে কি লুকিয়ে রাখে—তা কেউ জানে না!

আরও কি কি ভাবত কে জানে, কিন্তু তার আগেই মোবাইল সশব্দে বেজে উঠেছে৷ মন্দার ডিসপ্লেতে চোখ রাখল৷ ঊর্মির ফোন৷

—‘হ্যাঁ, বলো৷’

ওপ্রান্ত থেকে ঊর্মির উচ্ছ্বাসিত স্বর ভেসে আসে—‘শিগগির হোটেল ব্লু স্টারে চলে এসো৷ দারুণ খবর আছে৷’

—‘কী খবর? তুমি বিয়ে করছ?’

—‘ধ্যাৎ!’ ঊর্মি ঝাঁঝিয়ে উঠেছে—‘তুমি একটা গাগোল৷ তাড়াতাড়ি এসো বলছি৷’

—‘গাগোল!’ মন্দার বিস্মত—‘সেটা কী!’

—‘গাড়োল আর ছাগলের মিক্সচার৷ তুমি আসছ কিনা! আমি আর আধঘণ্টা অপেক্ষা করব৷ তারপর স্ট্রেট তোমার বাড়ি চলে যাব৷’

—‘কী এমন সুখবর যে আর তর সইছে না!’ মন্দার ফিচেল হাসি হাসে— ‘কোনো হতভাগা তোমার প্রেমে পড়েছে নাকি!’

—‘ডোন্ট টক রাবিশ৷ আমি রাখছি৷ তোমার হাতে আর আধঘণ্টা সময় আছে৷ হারি আপ৷’

‘হারি আপ’ শুনে মন্দার প্রায় হ্যারি পটারের ঝাঁটার মতোই দ্রুতবেগে ‘ব্লু স্টারে’ পৌঁছোল৷ ঊর্মির সব ভালো৷ কিন্তু বড্ড জেদি! সময়মতো না পৌঁছালে হয়তো সত্যি সত্যিই বাড়ি এসে হামলা করবে৷ আজ দুপুরে মা কষিয়ে চিকেন রান্না করেছে৷ সে আবার ভয়ানক খেতে ভালোবাসে৷ মাকে ‘কাকিমা…কাকিমা’ করে পটিয়ে-পাটিয়ে ঠিক মুরগির ঠ্যাংটা বাগাবে! মন্দার তার জাঙিয়াও লোকের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে—কিন্তু মুরগির ঠ্যাং নয়৷

অগত্যা ‘ব্লু স্টারে’ গেল সে৷ মানে যেতেই হল তাকে৷ হোটেলের বাইরে পিংক কালারের কুর্তি আর ব্ল্যাক জিনস পরে দাঁড়িয়ে আছে ঊর্মি৷ আজকে সে বেশ সেজেছে৷ চোখে লাইনার৷ গালে গোলাপি আভা৷ ঠোঁটে মেরুন রঙের লিপস্টিক৷

—‘কী ব্যাপার! এমন মাঞ্জা মেরেছো যে!’

—‘বলছি…বলছি…’ ঊর্মি আঙুল নেড়ে বলল—‘তার আগে কাকিমাকে ফোন করে বলে দাও যে, তুমি আজ বাড়িতে লাঞ্চ করবে না৷’

যাত্তারা! মন্দার মনশ্চক্ষে দেখতে পেল রান্না করা মুরগিটা তার আস্ত ঠ্যাং নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে!

—‘কেন?’

—‘কারণ তুমি আর আমি আজ ব্লু স্টারে লাঞ্চ করব…৷’

—‘বাট…!’

—‘নো বাট…নো ইফ…জাস্ট সেলিব্রেশন…৷’

সেলিব্রেশন! কীসের সেলিব্রেশন! গোটাটাই মাথার ওপর দিয়ে গেল! মেয়েটা কি পাগল হয়ে গেছে!

—‘আর ইউ ও কে ঊর্মি?’ সে ভয়ে ভয়ে জানতে চায়৷

—‘নো৷ আই অ্যাম নট ওনলি ও কে৷’ ঊর্মি দু-চোখ বুজে বলল—‘আই অ্যাম ভেরি ভেরি মাচ ও কে৷’

‘ও কে’-র আগে এতগুলো ‘ভেরি…ভেরি…ভেরি’-র ভেরী বাজছে কেন কে জানে! মন্দার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারে না! মেয়েটা বোধহয় সত্যিই পাগল হয়ে গেছে!

—‘ব্যাপারটা কী একটু খোলসা করে বলবে?’

—‘ব্যাপার এই…৷’ নাটকীয় ভঙ্গিতে একটা চকচকে ম্যাগাজিন মন্দারের দিকে এগিয়ে দিয়েছে ঊর্মি৷ মন্দার দেখল সেটা ‘স্বদেশ’-এর তাজা সংখ্যা৷

—‘হ্যাঁ৷ স্বদেশের এবারের সংখ্যাটা এখনও আমি পাইনি৷’ সে অবাক হয়ে বলে—‘কিন্তু এটা দেওয়ার জন্য এমন তাড়া মেরে আমাকে টেনে আনলে৷ আমি তো কাল-পরশুই এটা পেয়ে যেতাম…৷’

বলতে বলতেই মন্দার বিরক্তিমাখা মুখে ‘স্বদেশের’ প্রথম পাতাটা খোলে৷ ঊর্মির এ কী জাতীয় রসিকতা! শুধু এই পত্রিকাটা দেওয়ার জন্য এমন হুড়ো মারল৷…পাগল না…

ভাবতে ভাবতেই সে থমকে গেছে! একি! পত্রিকাটার মাথায় লেখা ‘কমপ্লিমেন্টারি কপি!’ ভেতরে একটা খাম গোঁজা৷

—‘এটা কী?’

—‘খুলে দ্যাখো৷’

মন্দার তখনও বুঝতে পারেনি ঘটনাটা ঠিক কী ঘটছে৷ কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো খামটা খুলে দেখল তার ভেতর পাঁচশো টাকার একটা চেক! পাঠিয়েছে ‘স্বদেশ’ কর্তৃপক্ষ৷ প্রাপকের নাম মন্দার ভট্টাচার্য!

সে স্তম্ভিত! তার আঙুল কাঁপছে৷ ‘স্বদেশ’ তাকে চেক পাঠিয়েছে! কেন? কীজন্য?

দ্রুত হাতে কবিতার পাতা খুলে ফেলেছে ঊর্মি৷ কবিতার পাতার প্রথম কবিতাটার ওপর আঙুল রেখে বলল—‘দ্যাখো৷’

মন্দারের শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যায়! সে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না৷ পাতার প্রথমেই জ্বলজ্বল করছে কবিতার নাম—‘ছেঁড়া রামধনু’! তার নীচেই কবির নাম—‘মন্দার ভট্টাচার্য!’

যখন হিরের মতো জ্বলেছিল দ্যুতি
তোমার ও মুখে পানপাতা ধোয়া জল
কোথাও শিশির কেঁদেছিল সারারাতে
তাকেই দু-চোখে ধরেছি যে নিষ্ফল৷
এ পাকদণ্ডি ধোঁয়া দিয়ে আজও ঢাকা
পাকে পাকে শুধু তুমি গিয়েছিলে উঠে
সারে গা ডোরেমি ডুবে মরেছিল ঝিলে
যখন সে গান গেয়েছিলে অস্ফুটে৷
 
আজও ছেঁড়া তারে বাজাব কি রামধনু?
আজও কি বর্ষা নেমে আসে এলোচুলে?
তুমি কি এখনও মেঘ রঙে ডুবে থাকো,
অস্তরাগের অলকার উপকূলে?
 
তুমি কি জেনেছ কেউ রোজ মরে যায়—
ফের বেঁচে ওঠে স্মৃতির পদক্ষেপে!
লাল তিল আজ অন্য সোহাগমালা…
থির বিদ্যুতে তেমনই কি ওঠে কেঁপে?
যদিও অতীত ছাপিয়েছে সেই দ্যুতি
আমার এ বুকে বাঁধভাঙা নোনাজল
তবুও মেঘের ঠিকানাটা রাখি চোখে
বৃষ্টিহীনের এটুকুই সম্বল৷

—‘ঊর্মি!…ঊর্মি…এটা কে পাঠাল! এটা…!’ মন্দারের ভীষণ কান্না পেয়ে যায়৷ এই সেই কবিতা যেটা সেই কষ্টের রাতে লিখেছিল! লোকটা বলেছিল মদ শুধু কষ্ট দেয়, আর কবিতা শক্তি৷ তাই বুকের যন্ত্রণাকে মুক্তি দিয়েছিল শব্দে শব্দে৷

—‘সরি, তোমায় জানাতে পারিনি৷’ ঊর্মি হাসতে হাসতেই বলল—‘কবিতা ডট কম-এ কবিতাটা দেখে আর লোভ সামলাতে পারলাম না৷ কপি করে প্রিন্ট আউট নিয়ে স্ট্রেট পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ‘স্বদেশ’-এর ঠিকানায়৷ তখন তোমার ঠিকানা জানতাম না৷ তাই নিজের বাড়ির ঠিকানাই দিতে হল৷ আর আজই এটা এসে পৌঁছেছে৷ কেমন সারপ্রাইজ বলো?’

মন্দার ভেতরে ভেতরে কাঁদছিল৷ এ তার স্বপ্ন! এ তার বহুদিনের প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা! আজ সফল হল৷

—‘তুমি অনেক বড়ো কবি হবে মন্দার৷’ ঊর্মির দু-চোখে যেন মন্দারের স্বপ্ন ডানা মেলে দিয়েছে—‘একদিন সব বড়ো জায়গায় তোমার কবিতা ছাপা হবে৷ কিন্তু এই দিনটার কথাই সবাইকে গর্ব করে বলে বেড়াব৷ বলব যে মন্দার ভট্টাচার্যকে গড়ে উঠতে আমি দেখেছি৷’

মন্দার এবার কান্নামাখা হাসি হাসল৷ ভীষণ সুখে তার চোখে জল এসে গেছে৷ চোখ নীচু করে চোখের জল লুকোতে লুকোতে বলল—‘হোটেলে লাঞ্চ করবে ঊর্মি? কিন্তু হোটেলের কুক যে তোমার পছন্দ-অপছন্দ জানে না৷ তবে আমি জানি, আজকে আমাদের বাড়িতে চিকেন কষার একটা জব্বর লেগপিস আছে৷ আর তার সঙ্গে তুমি লুচি খেতে ভালোবাসো—তাই না?’

.