আরও দাও প্রাণ – ৪

কবিতা ডট কমের পেজগুলো খুলে খুলে সবার কবিতা পড়ছিলেন গহন৷ এমনকি কমেন্টগুলোও বাদ দিচ্ছিলেন না৷

এতদিন যেন বুকের ওপর একটা পাথর চেপে ছিল৷ গহন দত্তগুপ্ত নামটার অহংবোধ তাঁকে অন্যদের কবিতা পড়া থেকে সবসময়ই বিরত রেখেছে৷ ভাবটা এমন ছিল, যেন এই সাইবার জগতের একটা গুরুত্বহীন সাইটে কবিতা পোস্ট করে সবাইকে ধন্য করেছেন৷ কিন্তু যে মুহূর্তেই সাইটটার গুরুত্ব বুঝতে পারলেন সেই মুহূর্তেই নতুন লড়াই শুরু হল৷ গহন দত্তগুপ্ত-র নয়৷ ‘একা মেঘের’৷ যাকে কেউ চেনে না, জানে না৷ নাম শোনেনি কখনও৷ নিতান্তই ভাগ্যান্বেষী এক কবি৷ তার ইগো নেই৷ সে যেখানে খুশি যেতে পারে, যা খুশি বলতে পারে, সবার কথা শুনতেও পারে৷ তার কোনো অহংবোধ নেই৷

কবিদের মধ্যে ‘জোনাকি’, ‘আকাশনীল’-এর কবিতা বেশ ভালো লাগল তাঁর৷ কিন্তু আশ্চর্য কিছু লাগল না৷ লিখেছে ভালোই৷ অথচ মনে তেমন দাগ কাটছে না৷ অন্যদিকে মনে মনে অবাকও হচ্ছিলেন৷ কবিতাগুলো কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে৷ মনে হচ্ছে এ ধরনের কবিতা আগেও পড়েছেন৷

এমন মনে হওয়ার কারণটা খুঁজছিলেন গহন৷ উত্তর পেতেও অবশ্য দেরি হল না৷ কমেন্টগুলো পড়তে পড়তেই রামহনুর বক্তব্যে পেয়ে গেলেন ইপ্সিত উত্তর৷ রামহনু স্পষ্ট লিখেছে—‘কবিতা ভালো লাগল৷ তবে নতুনত্ব কিছু পেলাম না৷ বরং শব্দ চয়ন, স্টাইল, রোমান্টিসিজমে প্রখ্যাত কবি গহন দত্তগুপ্ত-র ক্ষুদ্র সংস্করণ বলা যেতে পারে৷ কিন্তু মৌলিকতা নেই৷’

কমেন্টটা পড়ে চমকে উঠলেন তিনি৷ বিস্মিতভাবে কবিতাগুলো আবার পড়ে দেখলেন৷ রামহনুর কথা সম্পূর্ণ সঠিক! কবিতাগুলোর নীচে অনায়াসেই গহনের নাম লিখে চালিয়ে দেওয়া যায়! কেউ কোনো পার্থক্য বুঝতেও পারবে না৷ শুধু উক্ত দুজনেরই নয়, আর অনেকের কবিতাই পড়ে দেখলেন৷ প্রত্যেকের রচনাশৈলীই প্রায় একরকম৷ একইরকম বিরহ, একইরকম প্রেম, একইরকম সুন্দর সুন্দর শব্দচয়ন৷ শুধু কুবলাশ্ব-র কবিতাটা এর থেকে কিছুটা আলাদা৷ সে কিছু আঞ্চলিক আটপৌরে শব্দ ব্যবহার করেছে বলেই বোধহয় বেশি ভালো লাগল কবিতাটা৷

তু হমার মরদ বটিস-লয়?

…মেয়েটা ভাবে৷

‘আপন করম ভায়েক ধরম’ গানে
তাল মিলিয়েই গোটা পরব যাবে৷
‘কেনি রে তু চাস না হামার পানে?’
সোহাগ রঙের অভিমানী মেয়ে,
আকুল ব্যথায় ঈষৎ এলোমেলো
চাঁদকে ভেবে সওদাগরের আলো
বলছে কেঁদে—‘দেখলি না তু চেয়ে!’
নীলচে আভা নীল পাহাড়ের গায়ে,
চাঁদ চলে যায় তেপান্তরের পারে৷
আকুল ব্যথা ফিরল দখিন বায়ে
‘টুকুনখানিও দেখলি না তু হা রে!’
শালের বনে জ্যোৎস্না ঝরে পড়ে
মহুল মাতাল—ধূপ জ্বলেছে বুঝি!
চাঁদ জানে না, করছে খোঁজাখুঁজি
এক মেয়ে, তার প্রেমিক সদাগরে৷
জ্যোৎস্না বুকে পাথর হল মেয়ে
টুকুনখানিও দেখল না চাঁদ চেয়ে৷

তিনি ‘একা মেঘ’ কবিতার নীচে মন্তব্য লিখে দিলেন—‘কবিতায় আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ সত্যিই প্রশংসনীয়৷ শব্দের চালাকি নেই৷ সোজাসাপটা সরল ভাষায় একটি রূপকথার মতো কবিতা৷ আদ্যন্ত সুন্দর৷’

তাঁর মন্তব্যের একমিনিট পরেই রামহনু মন্তব্য করল—‘ঠিক বলেছেন৷ আপনাকে দ্বিত্ব দিলাম৷’

গহন অবাক হয়ে পালটা মন্তব্য করেন—‘দ্বিত্ব! মানে?’

রামহনু একটা স্মাইলি দিয়েছে—‘এ পাড়ায় নতুন তো! তাই সব কথার মানে বুঝতে একটু সময় লাগবে৷ আপাতত এইটুকু বলতে পারি—দ্বিত্ব মানে, সেকেন্ড করা৷’

—‘ও৷’

—‘বাই দ্য ওয়ে, আপনাকে কী বলে ডাকব? ‘একাদা’ বা ‘একাদি’ বলে ডাকা যাবে? না মেঘ না মেঘদি বলব?’

গহন হেসে ফেলেন৷ এই রামহনুর বিরূপ মন্তব্যেই রাগ হয়েছিলেন তিনি৷ কিন্তু এখন আর রাগ নেই৷

—‘মেঘদাটাই বেটার৷ আমি কোনোভাবেই দিদি নই৷’

—‘বেশ, ‘মেঘদা’ই বলব তবে৷’ রামহনু লিখল—‘রাতে কতক্ষণ অনলাইন থাকবেন? একটু আড্ডা মারা যাবে?’

—‘নিশ্চয়ই৷’

—‘তাহলে আড্ডার থ্রেডে আসুন৷’ সে আবার স্মাইলি দিয়েছে—‘নয়তো কুবলাশ্ব কাল সকালে কুরুক্ষেত্র করবে৷ কবিতার থ্রেডে পাব্লিক গপ্পো করলে ওর একদম পছন্দ হয় না৷ ব্যাটাকে আমি বড্ড ভয় পাই৷ বড়ো কড়া লোক৷

গহনের বেশ মজা লাগছিল৷ তিনি উত্তরে টাইপ করলেন—‘সে কী! কুবলাশ্ব ব্যাটা নাকি? আমি তো ভেবেছিলাম বেটি!’

—‘বেটি! বলেন কী! কুবলাশ্ব বেটি হতে যাবে কোন দুঃখে!’

—‘কবিতা পড়ে তো বেটিই মনে হল৷ তা ছাড়া ছদ্মনাম তো মুখোশের মতো৷ তার পিছনের আসল লোকটাকে দেখা যায় না৷ অবশ্য আমার ধারণা ভুলও হতে পারে৷’

রামহনু উত্তরে আরও কিছু টাইপ করার আগেই এই সাইটের মডারেটর ‘ব্যাসদেব’ স্ক্রিনে আবির্ভূত হলেন—‘মেঘবাবু ও হনু, কুবলাশ্বর জেন্ডার নির্ণয় ও ওই বিষয়ক আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা থাকলে আড্ডাঘরে গিয়ে বলুন৷ আমি অদরকারি পোস্টগুলো ডিলিট করব৷’

—‘আহা দাদা, এমন জব্বর পোস্টগুলো ডিলিয়ে দেবে৷ কুবলাশ্ব-র দেখা উচিত যে ওকে কেউ মেয়ে বলেছে৷ তারপর ঘোড়াটা কি কুকথা বলে সেটাই দেখার!’

রামহনুর কথার উত্তরে ব্যাসদেব বললেন—‘হনু, কবি ছেলে কি মেয়ে সেটা বড়ো কথা নয়৷ শেষ পর্যন্ত সে কবিই৷ আমি পোস্টগুলো ডিলিয়ে দিচ্ছি৷ আড্ডাঘরে এসো৷’

গহন চমৎকৃত হচ্ছিলেন৷ দু-তিনটে লোক কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে চোখ রেখে বসে আছে৷ তারা ছেলে না মেয়ে, সুন্দর কী অসুন্দর, লম্বা না বেঁটে, বুড়ো না জোয়ান—তা কেউ জানে না৷ কেউ কাউকে চেনে না৷ অথচ কেমন সুন্দর আন্তরিকভাবে আড্ডা মারছে৷ সাইবার ওয়ার্ল্ডের কী অসীম ক্ষমতা!

কয়েক মিনিটের মধ্যে তিনজনের আড্ডা জমে গেল৷ ব্যাসদেব দুঃখ করে বলছিলেন—‘আজকাল কবিতার আর সেই দিন নেই৷ এই কবিতা ডট কমেই একসময় কীসব অসাধারণ কবিতা পোস্ট হত! এখন সব কপিক্যাট আর চোরদের জায়গা হয়েছে৷’

গহন বিস্মিত—‘কপিক্যাট আর চোর মানে?’

রামহনু ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেয়—‘বেশির ভাগ কবিতাগুলোই কোনো না কোনো বিখ্যাত কবির স্টাইলে লেখা৷ নিজস্ব স্টাইল এখানকার খুব কম লোকেরই আছে৷ যেমন আজকাল ট্রেন্ড চলছে গহন দত্তগুপ্ত-র৷ ভদ্রলোক বহুদিন কবিতা লিখছেন না৷ কিন্তু তাঁর অভাব আমরা টেরই পাচ্ছি না৷ কারণ ‘জোনাকি’, ‘আকাশনীল’ বা আরও কিছু কবি হুবহু গহন দত্তগুপ্ত’র স্টাইলেই লেখে৷ ওদের কবিতা পড়লেই মনে হয় বকলমে গহন দত্তগুপ্তই লিখে দিয়ে গেছেন কবিতাগুলো৷ সেই সাবজেক্ট! একই ভঙ্গি৷ নতুনত্ব কিছু নেই৷ বুঝলাম, যে ওরা কবির অন্ধভক্ত৷ তাই বলে তাঁকেই সবসময় কপি পেস্ট মারতে হবে!’

রামহনুর কথার রেশ টেনেই ব্যাসদেব জানালেন—‘সত্যিই তাই, মৌলিকতা কিছু নেই৷ ইনফ্যাক্ট ওদের কবিতাগুলো যদি পরপর কবির নাম ছাড়া পোস্ট করে দেওয়া হয়—তাহলে কোনটা কার কবিতা আলাদা করে আইডেন্টিফাই করা যাবে না৷ সবই একরকম৷ কবির সিগনেচারের অভাব যাকে বলে আর কী!’

গহন আস্তে আস্তে টাইপ করেন—‘ও৷’

—‘কিছু পাব্লিক তো তার চেয়েও আরও উচ্চস্তরের ঝাড়ু৷’

—‘ঝাড়ু! মানে ঝাঁটা?’

—‘না…না…৷’ রামহনু একটা চোখ টেপার স্মাইলি দেয়—‘ঝাড়ু মানে ঝাড়া বিদ্যায় এক্সপার্ট৷’

ব্যাসদেব একটা কাঁদো কাঁদো মুখের ইমোটিকন দিয়েছেন—‘সেই চিরাচরিত সমস্যা৷ প্লেগিয়ারিজম৷ আজকাল তো ব্লগে ব্লগে শখের কবিরা কবিতা পোস্টাচ্ছে৷ কথা নেই বার্তা নেই—একজন তার মধ্যেই একটা কবিতা বেমালুম ঝেঁপে দিয়ে এখানে নিজের নামে পোস্ট করে দিল৷ ব্যস, সেই নিয়ে চলল মারপিট৷ দুই কবিই একটা কবিতাকে নিজের বলে দাবি করছে! সে প্রায় প্রাণান্তকর পরিস্থিতি!’

যত জানতে পারছিলেন গহন, ততই তাঁর চোখ ব্রহ্মতালুতে গিয়ে ঠেকছিল৷ এরকমও হয়!

—‘তোমরা কেউ জানো না৷’ রামহনুর মন্তব্যে এবার ভুরু কোঁচকানো রাগি মুখের স্মাইলি—‘ভানুসিংহের পদাবলির গোটাটা আমি আগের জন্মে লিখেছিনু৷ দাদু ঝেঁপে দিয়েছে! উঃ, কী দুঃখু৷’

তার মন্তব্যের ভঙ্গিতে তিনি হেসে ফেলেছেন৷ তাঁর মাথায় তখন অন্য একটা চিন্তাও ঘুরঘুর করছিল—

—‘আচ্ছা, এদের কেউ কিছু বলে না?’

ব্যাসদেব উত্তর দিলেন—‘প্লেগিয়ারিজম হলে চোরের আই. পি. অ্যাড্রেসটাকে ব্যান করে দেওয়া হয়৷ তার অ্যাকাউন্টও ব্লক করা হয়৷ কিন্তু কপিক্যাটদের নিয়ে কী করবেন? এরা প্রত্যেক বইমেলাতেই কবিতার বই বের করে৷ কোন প্রকাশনী যে বের করে, আর কারা যে পড়ে তা ভগবানই জানেন! কিন্তু অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না৷ কার কটা বই হয়েছে তা নিয়েও কম্পিটিশন! এদের কারুর পঁয়ত্রিশটা বই, কারুর-বা আবার চল্লিশটা৷ সব স্বঘোষিত ‘মহান কবি’৷ কালেভদ্রে যদি একটা বা দুটো কবিতা কপালগুণে ‘স্বদেশ’-এ ছাপা হয়ে যায় তবে তো কথাই নেই! বাবফট্টাইয়ের চোটে টেকাই যায় না৷ আর যদি না হয় তাহলে আঙুরফল টক৷ বলে বেড়াবে—‘আমি প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে৷’

গহন নিজের মনেই সজোরে হেসে উঠলেন৷ এমন প্রজাতির বিশেষ অভাব নেই৷ সকলেই অসিতবরণ চৌধুরীর মতো নিঃস্বার্থ নয়৷ এমনকি সেই স্বেচ্ছা-নির্বাসিত কবিও হাসপাতালের বেডে শুয়ে আক্ষেপ করেছেন, আর এরা তো নিতান্তই ভেকধারী! আর বইয়ের সংখ্যাও প্রচুর! তিনি আপনমনেই গুনতে শুরু করেন—আদৌ তাঁর নিজের অতগুলো বই আছে কি?

রামহনু যোগ করে—‘এদের প্রচুর পোষা ভাই-বোনও আছে৷ দাদাদের অন্ধ ভক্ত৷ দু-লাইন লিখলেই একেবারে ‘বাঃ বাঃ’ করে পিঠ চুলকোতে শুরু করে৷ আর কি বলব৷ এসে যখন পড়েছেন তখন সবই স্বচক্ষে দেখতে পাবেন৷ চিন্তা নেই৷’

আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে গহন লগ আউট করেন৷ কম্পিউটার শাট ডাউনও করেছেন৷ কিন্তু তখনই শুতে গেলেন না৷ বরং অশান্ত মনে পায়চারি করছেন৷

তাঁর মাথায় একটা চিন্তাই ঘুরেফিরে আসছিল৷ বারবার ভাবছিলেন এই জোনাকি, আকাশনীলদের সঙ্গে তাঁর তফাতটা কোথায়? ওদের বইয়ের সংখ্যা তাঁর থেকেও বেশি৷ ওদেরও ‘বাঃ, বাঃ’ করার জন্য ভক্তবৃন্দ আছে! এমনকি তিনি ঠিক যেমন কবিতা লেখেন, এরাও অবিকল তেমনই লেখে৷ পার্থক্য কোথায়? তবে আকাশনীল কেন ‘আকাশনীল’? আর তিনিই বা কেন তিনি?

রাতের ছায়ায় নিভৃত আসনে বসে বারবার নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকেন কবি—‘আমি কে? আমি কোথায় আলাদা?…আমি কেন আমি?…’

হঠাৎ মনে পড়ে গেল পরিমলবাবুর কথা৷ কণা বলেছিলেন—‘ওঁর কথা কখনও লেখোনি তুমি…’

তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ল৷ কী ভেবে যেন খাতা-কলম নিয়ে বসে গেলেন৷ কয়েকটা মিনিট স্তব্ধতা৷ তারপরেই সাদা পাতার ওপর কলম খসখস করে চলতে শুরু করল৷

.

—‘ওঃ ঈশ্বর! তুই এখনও টয়লেটে!’

প্রায় রোজই বাবার এই ডায়লগটা শুনে শুনে বোর হয়ে গেছে মন্দার৷ ভদ্রলোক তো মানুষ নন, ‘মার্ফিজ ল’-এর (Murphys law) চলতা ফিরতা উদাহরণ৷ যেদিন তিনি ছাতা নিয়ে বেরোবেন না, সেদিনই বৃষ্টি নামবে! যেদিন গুরুত্বপূর্ণ মিটিং থাকবে, সেদিনই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র খুঁজে না পেয়ে ‘লেট হচ্ছে…লেট হচ্ছে…’ বলে নাচতে শুরু করবেন৷ এবং অবধারিত ভাবেই সেদিন তাঁর গাড়ির টায়ার পাংচার হবে ও স্টেপনি থাকবে না!

সেইসব অমোঘ নিয়মগুলোর অন্যতম হল, যেদিন মন্দারকে তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে, এবং সে বাথরুমে ঢুকে বসে থাকবে, ঠিক তখনই বাবার নিম্নচাপ ও গ্র্যাভিটেশনের চূড়ান্ত হবে৷

মন্দারের এমনিতেই আজ মেজাজ খিঁচড়ে ছিল৷ ভোররাতে আবার একটা দুঃস্বপ্ন-র গুঁতো খেয়েছে৷ আজ অবশ্য লোকটা তাকে মারেনি৷ শুধু যখন উশ্রীকে ‘ভালোবাসি’ বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই টপকে পড়ে উশ্রীর মাথার একঢাল চুল ধরে টান মেরে বলল—‘এইবার!’

মন্দার হতভম্ব হয়ে দেখে যে কালো মুষকো লোকটার হাতে উশ্রীর পুরো চুলটাই উঠে এসেছে! তার মাথায় টাক! উশ্রীকে এমন কুশ্রী আগে কখনও লাগেনি! চুল ছাড়া একটা মেয়েকে যে এত খারাপ লাগতে পারে তা তার ধারণাতেই ছিল না৷ সে বোধহয় হার্টফেলই করত! ভাগ্যক্রমে ঘুমটা তার আগেই ভেঙে গেল৷

এই শনিপুজোই তার কাল হয়েছে৷ ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে খুচুর-খুচুর করে দাঁত মাজতে মাজতে দুঃস্বপ্নগুলোর কথাই ভাবছিল সে৷ কালো পালোয়ানটা তাকে কিছুতেই ‘ভালোবাসি’ শব্দটা বলতে দেয় না কেন? বাস্তবে প্রপোজ করার মতো সাহস এখনও জুটিয়ে উঠতে পারেনি৷ কিন্তু স্বপ্নে তো ‘ভালোবাসি’ বলে ফেলতেই পারে! অথচ প্রত্যেকবার বলার আগেই ওই কেলে মোষটা এসে কিছু-না-কিছু কাণ্ড ঘটবেই৷

আসলে দোষ লোকটারও নয়৷ সব দোষ ওই কুবলাশ্বের৷ কাল একটা চমৎকার কবিতা লিখেছিল সে৷ যথারীতি সে কবিতার নায়িকা উশ্রী৷ তার রেশমি চুলের বর্ণনাও দিয়েছিল চমৎকার৷ কিন্তু সব মাটি করল ওই হতভাগা৷ কবিতাটা পড়েই দ্রাম করে মন্তব্য করল—

—‘আপনারা কবিরা এত প্রেমিকার চুল ধরে টানাটানি করেন কেন বলুন তো! মেয়েদের মাথায় চুল থাকলে সুন্দর দেখায় নিঃসন্দেহে৷ কিন্তু তা নিয়ে এত আদিখ্যেতা করার কি আছে?’

সে বিশেষজ্ঞের মতো বলে—‘কবির প্রেমিকার মাথায় ঘন চুল থাকাটা মাস্ট৷’ জীবনানন্দও তো বলেছেন—‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা৷’

—‘সে জীবনানন্দ বলেছেন…বলেছেন৷ উনি তো এ-ও বলেছেন…‘মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য’৷ ‘শ্রাবস্তীর কারুকার্য’ মুখে তখনই থাকতে পারে যখন প্রেমিকার মুখময় ব্রণ থাকে৷ তাই বলে কি সব কবির প্রেমিকার মুখই ‘শ্রাবস্তীর কারুকার্য’ হতে হবে! এবার বলুন, ওটাও মাস্ট৷’

মন্দার বুঝতে পারছিল না, সে সামান্য একটা বিষয়কে নিয়ে এত টানাহ্যাঁচড়া করছে কেন? কোনোমতে জানায়—

—‘না…আসলে প্রেমিকার ঘন লম্বা চুল কাব্যিক!’

—‘এ আবার কী কথা! কোনো কবির প্রেমিকা কি ববকাট কাটতে পারে না? মাশরুম ছাঁট বা ভেজ ছাঁট যে মেয়েরা মারে, তারা কি সুন্দরী নয়? অথবা যে মেয়ের মাথায় টাক আছে সে কি কবির প্রেমের যোগ্য নয়?’

টাকলু মেয়ে! তার প্রায় বিষম খাওয়ার দশা৷ এসব কী উদ্ভট উদ্ভট কথা বলছে লোকটা!

সে কথা বলতেই ‘কুবলাশ্ব’র কড়া জবাব—‘উদ্ভট নয়, আসলে আপনারা চিরকালই বাহ্যিক সৌন্দর্যের পূজারি৷ আপনাদের কাছে প্রেমের যোগ্য মেয়ে মাত্রেই সুন্দরী হতে হবে৷ আর তার সৌন্দর্যের একমাত্র মাপকাঠি ঘন, কালো, লম্বা চুল৷ ডাবর আমলা কেশ তেলের মডেল৷’

মন্দারের মনে সন্দেহ ঘনীভূত হয়৷ ‘একা মেঘ’ বোধ হয় ঠিক কথাই বলেছিল৷ কুবলাশ্ব নামের পিছনে নির্ঘাৎ কোনো ববছাঁট চুলের মেয়ে আছে৷ সেইজন্যই এমন সদ্য তেলে ফেলা বেগুনের টুকরোর মতো ছ্যাঁক ছ্যাঁক করছে৷

সে আর কথা বাড়ায়নি৷ চেপে গিয়েছিল৷ আর তারপরই এই দুঃস্বপ্নটা৷ উশ্রীর মাথায় টাক!

—‘কী হল? আর কতক্ষণ?’ বাইরে থেকে বাবার প্রাণান্তকর হাঁক—‘ওরে, এটা কি অর্ডিনারি না ফেভিকল?’

এরপর আর বেশিক্ষণ বাথরুম আটকে রাখা যায় না৷ অগত্যা মন্দার বেরিয়ে এল৷ মানে বেরোতেই হল তাকে৷

বাবা তখন যথারীতি মেঝের ওপর গড়াগড়ি খাচ্ছিলেন৷ তাঁর দিকে তাকিয়ে বলল সে—‘এমন জব্বর টাইমিং ফিক্স করো কি করে একটু বলবে? যখনই আমি টয়লেটে ঢুকি ঠিক তখনই তোমার ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়৷ পাঁচ মিনিট আগে বা পরে এই ঘটনাটা ঘটে না কেন?’

বাবা কুঁই কুঁই করে উত্তর দেন—‘টাইমিং ফিক্স করার আমি কে! আমার কোলনকে জিজ্ঞেস কর৷’

—‘মানতেই হবে যে তোমার কোলনের টাইমিং শচীন তেন্ডুলকরের চেয়েও ভালো৷ যাও’৷

বাবা দৌড়োলেন৷ সে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে রান্নাঘরের দিকে চলল৷ আজ নাকি টিকলি একটা এক্সপেরিমেন্টাল ডিশ তৈরি করবে৷ এই এক্সপেরিমেন্ট-এর গিনিপিগ অবধারিতভাবেই সে আর বাবা! এর আগের সপ্তাহে টিকলি ‘মাশরুম চিচিঙ্গা’ নামের একটা ডিশ তৈরি করেছিল৷ সেটা খেতে কেমন হয়েছিল তা টের পাওয়া গিয়েছিল পরদিন সকালে৷ মন্দার আর বাবা দুজনেই সেই ডিশের ধাক্কায় টয়লেটে প্রায় ইট পেতে রেখেছিল৷

রবিঠাকুর বোধহয় টিকলির ডিশের কথা ভেবেই লিখেছিলেন—‘শুধু যাওয়া-আসা…শুধু স্রোতে ভাসা…৷’

আজও ডিশের নামে আর-একখানা মূর্তিমান জোলাপ তৈরি হচ্ছে! সে ভয়ে ভয়ে রান্নাঘরে ঢুকে দেখল টিকলি মুখখানা হাঁড়ি-পানা করে ভাজা মাছের দিকে তাকিয়ে আছে৷ সে মুখে সদ্য সদ্যই দই মেখে সাদা ভূত সেজেছে৷ আজকাল বেশ রূপচর্চা র দিকে ঝোঁক গেছে বেটির! মুলতানি মাটি, বেসন, চন্দন—কিছুই বাদ যাচ্ছে না!

কিন্তু আজ কী হল! এমন ‘কলহান্তরিতা’ নায়িকার মতো মাছের দিকে তাকিয়ে আছে কেন? মন্দারের সন্দেহ হয়৷ তবে কি দইটা মাছের গায়ে পড়ার কথা ছিল? ভুল করে নিজের মুখে মেখে ফেলেছে!

—‘কী হয়েছে?’ থাকতে না পেরে প্রশ্নটা করেই ফেলে সে—‘মুখে অমন হসন্ত দিয়ে রেখেছিস কেন?’

টিকলি কোনো কথা না বলে ভাজা মাছের দিকে আঙুল তুলে দেখায়৷

মন্দার সবিস্ময়ে দেখে, মাছগুলোকে কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে৷ কোন বাজারে এ ধরনের মাছ পাওয়া যায়! এ কী জিনিস বাজার থেকে এনেছে বাবা! কুচকুচে কালো! মাছ না অন্যকিছু!

—‘সব পুড়ে গেছে!’ টিকলি প্রায় কেঁদে ফেলেছে—‘আমি কড়ায় বসিয়ে মুখে দই মাখতে গিয়েছিলাম…সেই ফাঁকে!’

এতক্ষণে গোটা ব্যাপারটা মাথায় ঢুকল৷ এগুলো মাছই৷ অন্তত কড়ায় বসানোর আগে তাই-ই ছিল৷ কিন্তু এখন পুড়ে ঝামা!

টিকলি ঠিকমতো কাঁদতেও পারছে না৷ চোখ থেকে জল পড়লেই মুখের দই ধুয়ে যাবে৷ কোনোমতে বলল—‘কি করব দাদাভাই? ভিনিগার ঢেলে দিলে পোড়া পোড়া ভাবটা কি যাবে?’

পোড়া মাছ উইথ ভিনিগার! ভাবতেই হূৎকম্প হতে শুরু করল৷ সে আমতা-আমতা করে বলে—‘ইয়ে…মানে…টিকলি, আজ আমার এক বন্ধুর বাড়িতে নেমন্তন্ন আছে৷ সকালে…মানে এখন তার বাড়িতেই খাওয়ার কথা৷ তুই বরং বাবাকে নতুন ডিশটা টেস্ট করা…৷’

টিকলি আর কিছু বলার আগেই সে রাজধানী এক্সপ্রেসের স্পিডে সেখান থেকে কেটে পড়ল৷ এখন কোনোমতে বাড়ি থেকে বেরোতে পারলে সে বাঁচে৷

কিন্তু পেটকে তো বেশিক্ষণ পোড়া মাছ আর ভিনিগারের ভয় দেখিয়ে রাখা যায় না! তার ওপর এখন আবার বাইরে খেয়ে পয়সা নষ্ট করছে না মন্দার৷ উশ্রীর জন্মদিনে তাকে চমকে দেবে সে৷ সেই লক্ষ্যেই একটু-একটু করে টাকা জমাচ্ছিল৷ বাইরে খাচ্ছে না, যাতায়াতের জন্য ট্যাক্সি ভাড়া করছে না, এমনকি নিজের জন্য একটা সুতোও কেনেনি৷ নামকরা জুয়েলারির দোকানে একটা দারুণ হিরের আংটি দেখেছে৷ ওই আংটিটাই উশ্রীকে দেবে এবারের জন্মদিনে৷ এই লক্ষ্যেই গোটা বছর সে তার মাইনের টাকা বাঁচিয়ে এসেছে৷

আজ সেইদিন! আজ উশ্রীর জন্মদিন! দোকানে গিয়ে তার যথাসর্বস্বের বিনিময়ে আংটিটা কিনে নিল মন্দার৷ পেটে তখন ছুঁচো ডন মারতে শুরু করেছে৷ কিন্তু বুকভরা আনন্দের কাছে খালি পেটের চিনাচিনানি আর কতটুকু!

হিরের আংটিটা ব্যাগে পুরে সে হাওয়ায় উড়তে উড়তে স্টুডিয়োতে পৌঁছোল৷ আজ এই আংটিটা উশ্রীকে দেবে৷ আজই তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে নিজের হূদয়ের কথা জানাবে সে৷ উশ্রী কি হাসবে? চোখের ঘন পল্লব ঝুঁকিয়ে লাজুক মুখে সম্মতি দেবে কি? ওর আপেলের মতো গালে আরও-একটু রক্তিমাভা কল্পনা করে মন্দার নিজেই বিহ্বল হয়ে পড়ে৷ ভয় হয় দৃশ্যটা দেখার আগেই না তার হূদপিণ্ড থেমে যায়৷

স্টুডিয়োতে এসে কিন্তু উশ্রীকে দেখতে পেল না সে৷ হয়তো সে কোনো শটে ব্যস্ত৷ তবে বাইরে ঊর্মির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল৷ সে তখন যথারীতি ল্যাপটপে ওয়্যারলেস কানেকশন গুঁজে নিবিষ্ট মনে কি যেন করছে৷ মন্দারের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই হাসল—‘গুড মর্নিং৷’

—‘গুডমর্নিং ঊর্মি৷’ মন্দার তার পাশের চেয়ারটাতে বসে পড়ে—‘কেমন আছ?’

তাদের মুখোমুখি পরিচয়ের পর আপনি থেকে তুমি-তে নামতে বেশি সময় লাগেনি৷ ঊর্মি খুব মজার মেয়ে৷ গভীরমনস্কও বটে৷ তার সঙ্গে বন্ধুত্ব জমে উঠেছে কয়েকদিনেই৷ মন্দারের তার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে৷ ঊর্মির সঙ্গে কথা বলে, তার কথা শুনে সে আরাম পায়৷ তার শ্যালিকা ভাগ্য ভালো বলতে হবে!

মন্দারের চোখের দিকে তাকিয়েই সে যেন তার অনুচ্চারিত প্রশ্নটা ধরে ফেলে—‘আমি দিব্যি আছি৷ উশ্রীও ভালো আছে৷ শট দিচ্ছে, একটু পরেই আসবে৷’

—‘ও৷’ মন্দার আরও কিছু বলার আগেই তার পেট রীতিমতো সশব্দ বিপ্লব করে ওঠে—গরররর ঘুঁ উ উ…৷

আর গররররঘুঁ! জ্বলন্ত ইজ্জতের মুখে ফুঁ! প্রেস্টিজে গ্যমাক্সিন! ঊর্মি পর্যন্ত আওয়াজটা শুনতে পেয়েছে৷ তার মুখে স্মিত হাসি৷

—‘মধ্যপ্রদেশে এমন কোলাহল কেন? ব্রেকফাস্ট হয়নি?’

—‘না…না…!’ মন্দার অপ্রস্তুত৷ মাথা চুলকে বলে—‘হয়েছে…মানে…৷’

পেটটা বোধহয় ঠিক করেছে যে করেই হোক তার মুখে চুন-কালি মাখিয়ে ছাড়বে৷ সে এবার আরও তীব্র প্রতিবাদ জানাল—‘ঘুর র র র…ঘুট…ঘুট… ঘুট…৷’ অর্থাৎ ‘মিথ্যেবাদী! ব্রেকফাস্টে কী খেয়েছিস? হরিমটর!’

মন্দার পারলে এক্ষুনি অভদ্র পেটটাকে কেটে বাদ দেয়! ঊর্মি আড়চোখে তার পেটের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে৷ মাথায় জড়ানো ওড়নাটা বারবার মুখের ওপর এসে পড়ছিল৷ একহাতে সেটাকে সরিয়ে বলল—‘কেমন হয়েছে তা ঘুঁ ঘুঁ…ঘুঁট ঘুঁট শুনেই বুঝতে পারছি৷’

মন্দার লক্ষ করেছে যে ঊর্মির সঙ্গে সবসময়ই একটা ঢাউস ব্যাগ থাকে৷ উশ্রীর মেকআপ বক্স, এক্সটা আউটফিট, পারফিউম, জলের বোতল ইত্যাদি ক্যারি করার জন্যই ব্যাগটা ব্যবহূত হয়৷

সেই ব্যাগ থেকে একটা টিফিন বক্স বের করে এগিয়ে দিল ঊর্মি৷

—‘এই নাও৷’

—‘কী এটা?’ মন্দার বিস্মিত!

—‘খাবার৷’ সে মৃদু হেসেই উত্তর দেয়—‘আমার স্পাইসি ফুড খাওয়ার একদম অভ্যেস নেই৷ এখানে লাঞ্চে রীতিমতো লংকার গুঁড়ো দেওয়া খাবার দেয়৷ তাই নিজের লাঞ্চ আমি সবসময়ই ক্যারি করি৷’

মন্দারের দ্বিধা তবু কাটে না—‘এটা তো তোমার খাবার!’

—‘হ্যাঁ, আমার কথা ভেবেই বানিয়েছিলাম৷’ সে আবার হাসল—‘কিন্তু আজ না হয় তুমিই টেস্ট করে দ্যাখো৷’

—‘কিন্তু তুমি…?’

—‘আমি আজ তোমার লাঞ্চে ভাগ বসাব৷’ ওড়নাটা ফের তার চোখের ওপর এসে পড়েছে৷ সেটাকে বাঁ হাতে সরিয়ে হাসে ঊর্মি, ‘আশা করি অসুবিধে হবে না৷’

একটু কিন্তু কিন্তু করতে করতেই টিফিন বাক্সটা খুলল মন্দার৷ ভেতরে জ্বলজ্বল করছে সাদা ফকফকে পাতলা রুটি, বেগুনভাজা আর আলুর তরকারি৷ রুটির এককোনা ছিঁড়ে আলুর তরকারি সুদ্ধু মুখে দিতেই মনে হল—অমৃত! সাধারণ একটা খাবারও যে এত সুস্বাদু হতে পারে তা জীবনে এই প্রথম জানল সে!

—‘তরকারিটা তুমি করেছ!’ মন্দার বিস্ময় আর প্রশংসা মাখা দৃষ্টি ঊর্মির দিকে ছুড়ে দিয়েছে—‘ডেলিশিয়াস!’

ঊর্মি দু-চোখে স্নেহ মাখিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে৷ অদ্ভুত একটা বাৎসল্য তার হাসির মধ্যে ফুটে ওঠে৷ মন্দারের মনে হল—এমনভাবে বোধহয় একমাত্র মেয়েরাই হাসতে পারে! অভুক্ত সন্তানের সামনে নিজের খাবারটুকু তুলে দিয়ে এমন তৃপ্তিমাখা হাসি হাসার ক্ষমতা শুধু গর্ভধারিণীরই আছে৷

সে মুগ্ধ হয়ে ঊর্মির মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিল৷ এমন হাসি উশ্রীর মুখে কখনও দেখেনি৷ তার হাসিতে আকর্ষণী শক্তি আছে, মদিরতা আছে, কুহক আছে—কিন্তু স্নেহ, মমতা নেই!

কেন কে জানে, এই প্রথম তার বুকে অব্যক্ত একটা কষ্ট হচ্ছিল৷ মনে হচ্ছিল, এমন হাসি কেন উশ্রী হাসে না!

—‘কী হল? খাও!’

ঊর্মির কণ্ঠস্বরে সংবিৎ ফিরল মন্দারের৷ খিদেও পেয়েছিল খুব৷ প্রায় চেটেপুটেই রুটি, বেগুনভাজা, আলুর তরকারি শেষ করে ফেলেছে৷ খাওয়া শেষ করে খালি টিফিন-বক্সটা এগিয়ে দিয়ে বলল—

—‘থ্যাঙ্কস ঊর্মি৷’

—‘ওয়েলকাম৷’

—‘দাঁড়াও…তোমাকে একটা জিনিস দেখাই৷’ মন্দার হাত-মুখ ধুয়ে এসে ব্যাগ খুলতে খুলতে বলল—‘দ্যাখো তো জিনিসটা কেমন? উশ্রীর পছন্দ হবে? আমি আবার মেয়েদের পছন্দ-অপছন্দ ঠিক বুঝি না৷’

সে বাক্স খুলে হিরের আংটিটা দেখায়৷ এবার অবাক হওয়ার পালা ঊর্মির৷ হিরেটা আগুনের ছোট্ট কণার মতো দ্যুতি ছড়িয়ে জ্বলছিল৷ সেদিকে তাকিয়েই বিস্মিত গলায় বলল—‘কী সর্বনাশ! এ তো খাঁটি ডায়মন্ড! কার জন্য কিনেছ? এত দামি জিনিস…!’

মন্দার সমস্ত কথা ঊর্মিকে খুলে বলে৷ কার জন্য কিনেছে, কেন কিনেছে, কীভাবে কিনেছে—সব৷ ঊর্মি তার সব কথা শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে৷ সব কথা যেন ঠিক মাথায় ঢুকছে না৷

মন্দারের কথা শোনার পর সে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে৷ অদ্ভুত বিষণ্ণতা তাকে ছেয়ে আছে৷

—‘কী হল? উশ্রীর কি পছন্দ হবে না গিফটটা?’

মন্দারের শঙ্কিত কণ্ঠস্বর শুনে একটু যেন বিষণ্ণ হাসি হাসে ঊর্মি—‘অপছন্দ হওয়ার মতো জিনিস তো নয়৷ কিন্তু মন্দার, তুমি কী কখনও উশ্রীকে তোমার ফিলিংসের কথা বলেছ?’

—‘না৷’ মন্দার একটু চিন্তা করে জবাব দেয়—‘সেভাবে কখনও বলিনি৷ কিন্তু ভ্যালেন্টাইনস ডে, রোজ ডে বা নিউ ইয়ারে সবসময় দামি দামি গিফট দিয়েছি৷ ও রিফিউজ করেনি কখনও৷’

ঊর্মি চুপ করে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল৷ তারপর আস্তে আস্তে বলল—‘অন্য দামি গিফটের কথা বলছি না৷ তবে হিরের আংটির ব্যাপার আলাদা৷ হিরেটার নিশ্চয়ই অনেক দাম৷ কিন্তু তার দামের চেয়েও বেশি দামি তোমার ফিলিংস৷ এটার পিছনে তোমার রক্ত, ঘাম, কৃচ্ছ্রসাধন জড়িয়ে আছে৷ এটা হিরের আংটি নয়, আসলে তোমার সমস্ত জীবন, সমস্ত অনুভব৷ কার হাতে যাবে সেটা বড়ো কথা নয়৷ বড় কথা, সেই হাতের এই আংটি পরার যোগ্যতা আছে কি না৷’

মন্দার ঊর্মির কথা শুনছিল৷ তার বিরক্ত লাগছে৷ হঠাৎ করে ঊর্মি এমন ভাষণ দিতে শুরু করেছে কেন? বিরক্তিটা সম্ভবত তার মুখেও ছাপ ফেলেছিল৷ ঊর্মি সেটা লক্ষ করেই ফের বিষণ্ণ হাসিটা হাসে—‘আমি তোমায় জ্ঞান দিতে চাই না মন্দার৷ শুধু এইটুকু বলতে চাই তোমার ফিলিংস যেন কারুর কাছে ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ হয়ে না দাঁড়ায়৷ দ্যাটস অল৷’

বলতে-বলতেই তার কণ্ঠস্বরের গাম্ভীর্যটা সরে গেছে৷ তার বদলে এখন একটা ছেলেমানুষি ভাব—‘আর শুধু উশ্রীর জন্য গিফট আনলেই হবে? আমার জন্য কী এনেছ?’

সে আশ্চর্য হয়ে বলে—‘তোমার জন্য?’

—‘হ্যাঁ, আমার জন্য৷’ ঊর্মি মিটিমিটি হাসে—‘জানো না? উশ্রী আর আমি টুইনস৷ আমাদের জন্ম একই দিনে৷ উশ্রী আমার থেকে দু-মিনিটের বড়ো৷ অর্থাৎ আজ আমারও জন্মদিন৷’

মন্দার অপ্রস্তুত৷ এমন সম্ভাবনার কথা তার মাথায় আসেনি৷ উশ্রী আর ঊর্মি পরস্পরকে নাম ধরে ডাকে, ‘তুইতোকারি’ করে৷ কিন্তু উশ্রী সর্বত্র ঊর্মিকে ‘বোন’ হিসেবে পরিচয় দেয়৷ সে পরিচয়টাই জানত মন্দার! ওদের দুজনের চেহারা, স্বভাব, ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণ আলাদা! তাই কখনও মনে হয়নি ওরা যমজ বোনও হতে পারে৷

—‘ওঃ…আই অ্যাম সরি…৷’ সে আমতা আমতা করে বলে—‘আমি জানতাম না…আই মিন…বুঝতে পারিনি৷ তোমাদের দেখতে তো…৷’

—‘একদম একরকম৷’ ঊর্মি মুখ টিপে হাসল…‘শুধু বাইরের লোক সেটা দেখতে পায় না৷’ সে একটু থেমে ফের বলে—‘কই, আমার গিফট তো দিলে না?’

ঊর্মির কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল মন্দার৷ দুজন একরকম দেখতে! বলে কী! ওদের দুজনের চেহারায় আকাশ-পাতাল তফাত!

বিস্ময়টা কোনোমতে গিলে ফেলে সে বলল—‘তোমার জন্য তো কিছু আনিনি৷ সরি ঊর্মি৷’

—‘সরি বললে তো শুনছি না৷’ ঊর্মি ঢাউস ব্যাগটা খুলে একটা বিরাট ডায়ারি বের করে এনেছে৷ ডায়ারির একটা পাতা খুলে এগিয়ে দেয়—‘দাও৷’

মন্দার বিহ্বল—‘কী?’

—‘গিফট৷ উদীয়মান কবির সই সহ একটি তাৎক্ষণিক কবিতা৷’ সে বলল—‘বলা যায় না, কোনোদিন হয়তো তুমি বিশাল নামী কবি হবে৷ আমাদের চিনতেই পারবে না৷ তখন এই গিফটটাই সবাইকে সগর্বে দেখিয়ে বলব—‘মন্দার ভট্টাচার্য একসময় আমাকে চিনতেন৷’

—‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল!’ মন্দার ফিক করে হেসে ফেলেছে৷ হাসতে হাসতেই তার ডায়ারিতে জন্মদিন উপলক্ষ্যে কয়েক লাইনের একটা ছড়া লিখে দিল—

এই মরেছে, এই মরেছে, এই হয়েছে কেলো!

হেড্ডিমণির জন্মদিনে কেকটা কোথায় গেল?

ফেট্টিবাঁধা দুষ্টুবুড়ি

মিষ্টি কথায় মিছরি ছুরি

রূপের ঠ্যালায় কোথায় লাগে অ্যাঞ্জেলিনা, জেলো!

কেক আনিনি, গিফট আনিনি, তাই তো বাজাই বাজা,

ট্যাঁকের কৃপায় আমি সদাই বোম্বাগড়ের রাজা৷

এমন সাধের জন্মদিনে

নাই বা দিলুম কিছুই কিনে

দিদিমণি, তুমিই সত্য, বাদবাকি সব গাঁজা!

—‘ও-মা! লিমেরিক!’ ঊর্মির মুখ খুশির হাসিতে ঝলমল করে উঠেছে—‘কী সুন্দর হয়েছে!’

—‘পছন্দ হয়েছে তোমার?’

—‘ভীষণ…ভীষণ…ভীষণ’, সে ছেলেমানুষের মতো উচ্ছ্বাসিত—‘তুমি আজকের পার্টিতে আসবে তো? আমার সব বন্ধুদের আমি কবিতাটা পড়ে শোনাব…৷’

—‘পার্টি!’

—‘হ্যাঁ, পার্টি৷’ ঊর্মি একটু যেন অবাক হয়—‘কেন? উশ্রী তোমায় ইনভাইট করেনি?’

মন্দার কিছু বলার আগেই উশ্রী এসে পড়ল৷ তার মুখে তখনও মেক-আপ৷ শট দিয়ে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে৷ মন্দারের দিকে তাকিয়ে অল্প হেসে বলল—‘হাই মন্দার৷’

—‘হাই উশ্রী৷’ সে হিরের আংটির বাক্সটা তার দিকে এগিয়ে দিয়েছে—‘হ্যাপি বার্থ ডে৷ ভেরি ভেরি রিটার্নস অফ দ্য…’

—‘কী এটা?’ উশ্রী নিরুৎসুকভাবে বাক্সটা খুলল৷ বাক্সের ভেতর হিরেটা ঝলমলিয়ে উঠেছে৷

অথচ সেই ঝলমলানির কণামাত্রও উশ্রীর মুখে দেখতে পেল না মন্দার৷ ভেবেছিল আংটিটা তাকে পরিয়ে দেবে৷ কিন্তু সে নিজেই আংটিটা পরে ফেলেছে৷ বেশ কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখে তার ভুরু কুঁচকে গেল৷ ঊর্মির দিকে তাকিয়ে বলল—‘কী মনে হয়? এটা এক ক্যারাট হবে?’

ঊর্মির হাসি ঝলমলে মুখ যেন ফ্যাকাশে হয়ে যায়৷ মন্দারের মনে হল শনিদেব নয়, এবার চড়টা তাকে উশ্রীই মেরেছে৷

—‘না৷’ তার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছিল না৷ তবু কোনোমতে বলল—‘ফরটি ফাইভ সেন্ট৷’

অদ্ভুত তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে উশ্রী বলে—‘এক ক্যারাটের নীচে হিরে হিরেই নয়৷’

—‘উশ্রী,…৷’ ঊর্মির মুখ রাগে থমথম করছে—‘এটা কী জাতীয় ভদ্রতা? তুই জানিস কত কষ্ট করে এই আংটিটা ও কিনেছে?’

—‘দ্যাটস নট মাই প্রবলেম৷’ উশ্রীর মুখে সেই কুহকমাখা হাসি৷ মন্দারের হঠাৎ মনে হল এমন কুৎসিত নির্বোধ হাসি আগে কখনও দেখেনি৷

—‘একটা মিডলক্লাস ঘরের সাধারণ স্ক্রিপ্টরাইটারকে আমি হিরে গিফট দিতে বলিনি৷’ সে তার ঘন চুলে হাত বোলায়—‘এনিওয়ে আই অ্যাম টায়ার্ড৷’

মন্দারের মুখ কালো হয়ে গিয়েছিল৷ এমন অপমানিত সে কখনও হয়নি৷ সকাল থেকে কত কিছুই না কল্পনা করেছে৷ কেউ যেন সেই কল্পনাকে এক হাতুড়ির বাড়ি মেরে খানখান করে দিল৷

তার চোখ বাষ্পাচ্ছন্ন৷ নাক-কান দিয়ে আগুনের হলকা বেরোচ্ছে৷ তবু দাঁতে-দাঁত চেপে বলল—‘আমি জানতাম না উশ্রী, তুমি আমার সম্পর্কে এরকম ভাবো!’

—‘কাম অন…গ্রো আপ মন্দার!’ উশ্রী খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে—‘এরকম, ওরকম তো দূর৷ আমি তোমার সম্পর্কে কিছুই ভাবি না! তোমাকে নিয়ে ভাবার সময় আমার নেই৷’

বলতে-বলতে সে উঠে দাঁড়িয়েছে—‘আমার কাজ আছে৷ অ্যান্ড মন্দার, থ্যাঙ্কস ফর দ্য গিফট৷’

মন্দার দেখল ঊর্মি তার দিকে ব্যথিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷ হঠাৎ করে মনে পড়ে গেল একটু আগেই তার বলা কথাগুলো৷

—‘এটা হিরের আংটি নয়, আসলে তোমার সমস্ত জীবন, সমস্ত অনুভব! কার হাতে যাবে সেটা বড়ো কথা নয়৷ বড়ো কথা, সেই হাতের এই আংটি পরার যোগ্যতা আছে কিনা৷…’

তখন ভীষণ ভেবে বিরক্ত হয়েছিল সে৷ কিন্তু…৷

—‘দাঁড়াও উশ্রী৷’ কোথা থেকে তার মধ্যে এত জোর এল, মন্দার জানে না৷ কিন্তু সে বিদ্যুৎগতিতে উঠে গিয়ে উশ্রীর সামনে দাঁড়িয়েছে৷ তার চোখে চোখ রেখে বলল—‘আংটিটা ফেরত দাও৷’

ঊশ্রী যেন তার কথাটা বুঝতে পারেনি৷ থতোমতো খেয়ে বলে—‘সরি…!’

—‘আই অ্যাম সরি উশ্রী৷’ তার কণ্ঠস্বরে জেদ, রাগ, ক্ষোভের মিলিত প্রকাশ—‘এই আংটিটা তোমার জন্য নয়৷ ফেরত দাও৷’

উশ্রীর ফরসা মুখ লাল হয়ে ওঠে৷ সে বিনাবাক্যব্যয়ে সঙ্গে সঙ্গেই হাত থেকে খুলে আংটিটা ছুড়ে দিয়েছে তার মুখের ওপর৷ খপ করে সেটাকে লুফে নিল মন্দার৷ শান্ত স্বরে বলল—‘থ্যাঙ্ক ইউ৷’

.

আমার অ্যান্টাসিডের শিশি,
দাঁতে সকালবেলার মিশি,
বউয়ের বাসি মুখের কিসি
নিয়ে মধ্যবিত্ত আমি৷

হাতের বাবরি আমল ছাতায়,
প্রভুর চিত্রগুপ্ত খাতায়
ভুঁড়ি ইন্দ্রলুপ্ত মাথায়
নিয়ে নিটোল গৃহস্বামী৷

আবেগ নেয় না কোনো ঝুঁকি,
তোমায় ডিস্কো প্রণাম ঠুকি,
তবু দেয় না কপাল উঁকি
প্রভু আধকপালী ছেড়ে,—

মেশে রক্তে চিনি স্নেহ৷
তবু পাঁঠামৃতই দেহো!
যতই বাড়ুক মধুমেহ,
ডোবা কবজি তোলে কে রে!

বহর ছোট্ট লম্বোদরো৷
কাব্যে সখী আমায় ধরো!
ফিলিম মোগ্যাম্বো গব্বরও
আমার ডেইলি হাতিমতাই৷

ঘরে বৌ-মায়ে কারগিল
আমি বিষণ্ণ চার্চিল
ইস্যু তাল হয়ে যায় তিল
‘প্রভু নষ্ট হয়ে যাই৷’

আমি বাসে ট্রামে চড়ি
কনুই হিলের গুঁতোয় মরি
আজও স্বপ্নে দেখি পরি
পাঁচীর সঙ্গে খাটে শুয়ে…!

তোমার বৈকুণ্ঠে বাতি
আমার লোডশেডিংই সাথী৷
যতই হই না আমি পাতি
ঝড়ে পড়ছি না তো নুয়ে!
তোমার একটেরে চোখ খোলা
আশিস তাদের জন্য তোলা
যাদের ব্যাংকে টাকার গোলা
দেশের শুম্ভ-নিশুম্ভ৷

আমি সবার জন্য আছি
একা যুদ্ধ করেই বাঁচি৷
যতই দাও না পাছায় কাঁচি
জমি ছাড়ছে না কুম্ভ৷

যারা লক্ষহিরা ছড়ায়
তোমায় বুর্জোয়া-পাঠ পড়ায়
সোনা রুপোর মুকুট গড়ায়
তাদের বাড়ুক তসিল খান!
ধনে থাকি বা নাই থাকি
মনে ডাকছে অচিন পাখি
নিজের জীবন নিজেই আঁকি
আমিই মধ্য ভগবান!

—‘পথিক, তুমি কি পথ হারাইয়াছ?’

শুঁটকি অর্ধনিমীলিত দৃষ্টিতে গহনের দিকে তাকিয়েছে—‘কবিতাটা লিখেছিস ভালো৷ এটাও ঘটনা যে তোর পরিচিত রাইটিং স্টাইল ভেঙে বেরিয়েছিস৷ কিন্তু প্রশ্নটা সেই একই জায়গায়—‘পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ?’

গহন অসহিষ্ণু হয়ে বলেন—‘তুইও কপালকুণ্ডলা নোস, আমিও নবকুমার নই৷ তাহলে হঠাৎ করে বঙ্কিমবাবু এসে পড়লেন কেন?’

—‘বঙ্কিমবাবু আসেননি৷ প্রশ্নটা এসেছে৷’ শুঁটকি বলল—‘তুই ভাবছিস যে পরিচিত ছক ভেঙে বেরিয়েছিস৷ তা বেরিয়েছিস ঠিকই৷ কিন্তু নিজের পরিচিত ছক ভাঙতে গিয়ে অন্য একটা ছকে ঢুকে পড়েছিস৷ যেটা আমাদের কাছেও সমান পরিচিত৷’

—‘মানে?’

—‘কমেন্টগুলো দ্যাখ৷’

কবিতার নীচে বড়ো বড়ো ব্লকে ত্রিশটা কমেন্ট পড়েছে৷ ‘আকাশনীল’ লিখেছে—‘আরে, এ তো পুরো ঝিঙ্কু চিকু৷ মিঠুনের ফিলমে রম্ভার নৃত্য! একেবারে স্বপ্নিলীয় স্টাইল৷’

ব্যাসদেব বলেছেন—‘এতদিনে একটা অন্যরকম কবিতা পড়লাম৷ শব্দচয়ন দুর্ধর্ষ৷ ছন্দ জমে ক্ষীর! আপনি কি স্বপ্নিল আচার্যের ফ্যান?’

নিধিরাম সর্দারের মন্তব্য—‘পুরো চম্পা মাল মামা৷ স্বপ্নিল, স্বপ্নিল গন্ধ! পাগলা, ক্ষীর খা কুলস্য কুল৷’

গহন সবকটা কমেন্টেই চোখ বোলালেন৷ তারপর বিভ্রান্তভাবে বলেন—‘এতে দেখার কী আছে? এতদিন ‘ঝুলস্য ঝুল’ ছিলাম৷ এখন ‘কুলস্য কুল’ হয়েছি৷’

—‘এই!’ শুঁটকি চেয়ারের হাতলে আলতো চাপড় মারে—‘এই হচ্ছে তোর পলায়নপর মনোবৃত্তি৷ ভালো ভালো জিনিসগুলো দেখলি—অথচ আসল জিনিসটাই দেখলি না!’

—‘কি দেখিনি?’

—‘প্রত্যেকেরই কবিতাটা ভালো লেগেছে৷ কিন্তু…!’ সে পায়ের ওপর পা তুলে বসেছে—‘প্রত্যেকেই বলেছে যে কবিতাটায় ‘স্বপ্নিল’,…‘স্বপ্নিল’ গন্ধ আছে৷ নতুন প্রজন্মের ফেমাস কবি স্বপ্নিল আচার্য ঠিক এইরকম ভাষাতে, এইরকম স্টাইলেই কবিতা লেখেন৷ কবিতাটা ভালো হয়েছে নো ডাউট৷ তোর অন্যান্য লেখার থেকে আলাদা হয়েছে তা-ও ঠিক৷ কিন্তু স্বপ্নিলের কবিতার মতো হয়েছে৷ তুই নিজেকে ভাঙতে গিয়ে অন্য একজনের মতো করে গড়ে ফেলেছিস৷’

গহন কপালে হাত রেখে শুঁটকির কথা শুনছিলেন৷ সে বিন্দুমাত্রও বাড়িয়ে বলছে না৷ কবি স্বপ্নিল আচার্যের অনেক কবিতা পড়েছেন তিনি৷ লেখার সময়ে মনে হয়নি যে, সেই আদলেই কবিতাটা গড়ে উঠছে৷ কিন্তু এখন বুঝতে পারছেন সত্যিই ওটা স্বপ্নিলীয় স্টাইল হয়ে গেছে!

—‘নিজেকে ভাঙছিস ভাঙ৷’ শুঁটকি বলে—কিন্তু নিজের মতো করে ভাঙ৷ নিজের মতো করে শব্দ বেছে নে৷ অন্যের মতো নয়৷ একটা জিনিস দেখাই তোকে৷’

সে চেয়ার ছেড়ে উঠে গেল৷ গহন দেখলেন শুঁটকি তার লাইব্রেরির দিকে যাচ্ছে৷ নির্ঘাত এখনই কোনো বই এনে বলবে—‘তোর এটা পড়া উচিত৷’ কিংবা কোনো বইয়ের রেফারেন্স এনে সুদীর্ঘ ভাষণ দেবে৷ বলবে, কবিতা কাকে বলে, কবিতা কী জন্য কবিতা—এইসব!

ভেবেই মনে মনে আতঙ্কিত হয়ে উঠছিলেন গহন৷ শুঁটকির লেকচার হজম করা রীতিমতো কঠিন কাজ৷ সে শুরু করতে জানে, থামতে জানে না৷

বাস্তবে অবশ্য সেসব কিছুই ঘটল না৷ শুঁটকি দলামোচা পাকানো, হলদে হয়ে যাওয়া কাগজ নিয়ে এসেছে৷ গহনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল—‘পড় এটা৷’ গহন সবিস্ময়ে দেখলেন হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজে নীল অক্ষরে গোটা গোটা হরফে একটা কবিতা লেখা আছে—

—‘এ কী!’ তিনি বিস্মিত চোখজোড়া তুলে তাকালেন বন্ধুর দিকে— ‘এ তো…৷’

—‘হ্যাঁ, তোরই কবিতা৷’ শুঁটকি বলে—‘আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে, তুই নিজেই লিখে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিলি৷ কুড়িয়ে রেখেছিলাম৷ এটা অন্যদিক দিয়ে ইউনিক গহন৷ কারণ এমন কবিতা তুই আর কখনও লিখিসনি৷ যদিও তোরই লেখা উচিত ছিল৷’

গহন চোখ বুজলেন৷ তিনি জানেন এবার সে কী বলবে—

—‘তোকে আমি এসকেপিস্ট কেন বলি জানিস?’ শুঁটকি বলে—‘কারণ তুই চিরকাল জীবনের সেই দিকটার দিকে পিঠ ফিরিয়ে রেখেছিস, যে দিকটা তোর চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না৷’

সে চুপ করে গেল৷ গহনও স্তব্ধ৷ তিনি আন্দাজ করতে পারেন শুঁটকি কোন দিকের কথা বলছে৷ যে সময়ের কথা ভুলে যেতে চান, ঠিক সময়ের কথাই বলছে সে৷

মুখ নীচু করে গোঁজ হয়ে বসেছিলেন গহন৷ শুঁটকির দিকে না তাকিয়েও বেশ বুঝতে পারছেন যে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এদিকেই নিবদ্ধ৷ ভেতরে ভেতরে একটা তীব্র প্রতিবাদ জন্ম নিচ্ছিল৷ যে প্রতিবাদে একদিন সেই সময়টার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, ডুবে গিয়েছিলেন রোমান্টিসিজমে৷ মনে হয়েছিল—‘কেন লিখব? যে ক্ষত বুকে আছে তা থাক৷ ভিখিরির মতো দেখিয়ে বেড়াব কেন? যে অসুখের কথা ভুলে যেতে চাই, তাকে ফিরিয়ে আনব কোন যুক্তিতে?’

—‘তুই শুধু রোমান্টিক কবিতাই লিখিস কেন?’ সে তীব্র দৃষ্টিতে গহনকে দেখছে—‘খুব অল্প বয়সে একটা অশান্ত সময় দেখেছিস৷ যদিও সে সময়কে বোঝার মতো বয়েস তখন তোর বা আমার—কারুর ছিল না৷ কিন্তু সেই সময়টা তোকে একটা জোরদার ধাক্কা দিয়ে গেছে৷ ছাপ ফেলে গেছে৷ আজও তেমন একটা সময় আসছে গহন৷ আবার একটা অস্থির সময়৷ তার মধ্যে দাঁড়িয়েও চাঁদ-তারা-ফুল-পাখির সৌন্দর্যে নিজেকে জোর করে ডুবিয়ে রাখবি! কেন তাকাবি না সেই অস্থিরতার দিকে?’

—‘আমি কবিতা লিখতে চাই৷’ গহন যেন একটু উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলেন—‘স্লোগান লিখতে চাই না৷’

তিনি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন৷ তার আগেই বাধা পড়ল৷ একটি বারো-তেরো বছরের ছেলে ঘরে এসে ঢুকেছে৷ গহন দেখেই চিনতে পারলেন৷ এই সেই ছেলেটা৷ যে সেদিন ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতাটা আদ্যোপান্ত মুখস্থ বলেছিল৷ তিনি অবাক! ছেলেটা এখানে কী করছে? শুঁটকির সংসারে নতুন অতিথি!

—‘কহো গোপাল…৷’ শুঁটকির সস্নেহ চোখ ছেলেটার দিকে ফিরল—‘কী সমাচার?’

গোপালকে এখন আর চেনাই যায় না৷ পরনে ঝকঝকে তকতকে জামা৷ মাথায় শ্যাম্পু আর গায়ে সাবান পড়েছে৷ তবে মাথার উকুনগুলোর রাজত্ব বোধহয় এখনও কায়েম৷ সে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে—‘ভাত কি বসিয়ে দেব?’

শুঁটকির ভুরু কুঁচকে গেছে৷ ভ্রূকুটি করে বলল—‘তোকে কি আমি ভাত রাঁধতে বলেছি? যা করতে বলেছি সেটা কতদূর?’

মুখ কাঁচুমাচু করে বলল গোপাল—‘দীঘ্যইটা লিখতে পাচ্ছিনে কো৷’

‘দীর্ঘই’টা লিখতে পারছ না, তাই ভাত রাঁধার এত তাড়া৷’ সে ধমক দেয়—‘যা৷ লেখার চেষ্টা করগে৷ না পারলে দেব এক কানের গোড়ায়…৷’

ছেলেটা বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে চলে গেল৷ গহন গোটা ঘটনাটা সবিস্ময়ে দেখছিলেন৷ এবার মুখ খুললেন—

—‘তুই কি সাক্ষরতা অভিযানে নেমেছিস শুঁটকি!’

—‘আরে, নাঃ৷’ শুঁটকি মৃদু হাসে—‘ঠিক তা নয়৷ ব্যাটাকে পুষ্যি নিয়ে নিলাম, বুঝলি?’

—‘কিন্তু হঠাৎ…৷’

—‘হঠাৎ নয়৷ হিস্ট্রি আছে৷ গত বুধবার রাতে দোকান বন্ধ করে ফিরছি, চোখে পড়ল ব্যাটা রাস্তার ওপরে বস্তা পেতে ঘুমোচ্ছে৷’ সে আড়চোখে দেখে নেয় যে গোপাল ধারে-কাছে আছে কিনা৷ তারপর দরজা বন্ধ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল—‘হ্যাঁ, যা বলছিলাম৷ গোপাল রাস্তার ওপরে ঘুমোচ্ছিল৷ আর ওর ঠিক পাশেই কি যেন একটা চিকচিক করছে৷ রাস্তার আলোয় দেখি চকচকে জিনিসটা অল্প অল্প নড়ছেও৷’

—‘তারপর?’

—‘তারপরই তো কেলো! সন্দেহ হল! কাছে গিয়ে টর্চের আলো ফেলে যা দেখলাম, তুই জাস্ট ভাবতে পারবি না৷’ শুঁটকি চোখ বড়ো বড়ো করেছে—‘একটা আস্ত গোখরো সাপ! কলকাতার রাস্তার কোথা থেকে এল কে জানে৷ কিন্তু দিব্যি ফণা গুটিয়ে গুঁড়িসুড়ি মেরে গোল হয়ে শুয়ে আছে! একবার ভেবে দেখ, বাচ্চা ছেলেটা ঘুমিয়ে আছে৷ তার পাশে একটা গোখরো সাপ! একটু নড়াচড়া করলেই কামড়ে দিত৷’

কলকাতার যীশুদের হেঁতালের লাঠির দরকার পড়ে না!

ভাবতেই গা শিরশির করে ওঠে গহনের৷ দৃশ্যটা তিনি কল্পনাও করতে চান না!

—‘তাড়াতাড়ি গিয়ে সাবধানে গোপালকে ডেকে তুললাম৷ প্রথমে তো উঠতেই চায় না৷ তারপর ঘুম ভেঙে পাশের প্রাণীটিকে দেখেই ‘আই বাবা’ বলে চেঁচিয়ে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরল৷’ শুঁটকি বিষণ্ণ হাসল—‘‘বাবা’ শব্দটা এই প্রথম শুনলাম জানিস৷ বুবাই কখনও বলেনি৷ বড়ো ছোট্ট শব্দ৷ কিন্তু মায়াবী৷ মায়ায় জড়িয়ে গেলাম৷ ভাবলাম আমিও একা, ওরও জগতে কেউ নেই৷ দুই কপালপোড়া মিলেই না হয় একসঙ্গে থাকি৷ ভাতেভাত, ডাল-ভাত আমার যা জোটে, ওরও দুটো যা হোক করে জুটে যাবে৷ ব্যস, তারপর থেকেই গোপাল বাবাজির এখানে অধিষ্ঠান৷ সব ভালো, শুধু পড়তে বললেই হাই ওঠে—এই যা দোষ৷’

গহন আপন মনে কী যেন ভাবছিলেন৷ ঠিক গোপালের অর্ধেক বয়সেই গোখরো সাপের চেয়েও বিষাক্ত কিছুর ছোবল খেয়েছিলেন তিনি৷ শুঁটকির দিকে তাকিয়ে তাঁর চোখে রুধির জমছিল৷ যেন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে জানতে চাইছেন—‘আমাকেও তো সাপে কামড়েছিল! তখন তুই কোথায় ছিলি শুঁটকি!’

.