আরও দাও প্রাণ – ৩

—‘বুঝলেন কিনা, অ্যাঁ? মানুষের এমন শুষ্ক চোখ…৷’

গহন বোতল থেকে জল খাচ্ছিলেন৷ ‘শুষ্ক চোখ’ শব্দটা শুনেই একটা মোক্ষম বিষম খেয়েছেন৷

কণারও প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছিল৷ স্বামীর করুণ অবস্থা দেখে মুচকি হেসে ‘শুষ্ক চোখে’-র সঠিক সংস্করণটি উচ্চারণ করলেন—‘সূক্ষ্ম চোখ’৷

—‘হ্যাঁ…ওই তো শুষ্ক চোখ! সবকিছুই খুঁচি খুঁচি করে দ্যাখে৷’

পতিদেব এবারও হাঁ করে তাকিয়ে আছেন দেখে কৃপা হল তাঁর৷ পরিমলবাবু বাংলাটা এরকমই বলেন৷ তাঁর উরুশ্চারণের একটু দোষ আছে৷ কোনোমতে ফিসফিস করে স্বামীর কানে কানে বললেন—‘খুঁচি খুঁচি মানে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে৷’

গহন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন৷ কণা দো-ভাষীর কাজটা চমৎকার করছেন৷ তিনি না থাকলে যে কী অবস্থা হত তাঁর! বোধহয় হাড়ি চণ্ডালের দশা হত! কৃতজ্ঞতাপূর্ণ চোখে কণার দিকে তাকালেন তিনি৷ কণাও কৌতুকমিশ্রিত সপ্রেম দৃষ্টিতে স্বামীর সাধুবাদ গ্রহণ করলেন৷

—‘বুঝলেন কিনা, অ্যাঁ? মেয়ের জন্য কয়েক সেট জরায়ু কিনেছি৷ বড়ো- ঘরে যাচ্ছে তো! যেমনি-তেমনি ভাবে মেয়ে তো পাঠাতে পারি না৷’ পরিমলবাবু হাসলেন—‘তার সঙ্গে পাত্রপক্ষের দাবি, দশ ভরি সোনা দিতে হবে…৷’

কবিবর ফের স্তম্ভিত! দশ ভরি সোনার ব্যাপারটা তবু বোঝা গেল, কিন্তু কয়েক সেট জরায়ু!

কণাই ফের উদ্ধারকর্তা হয়ে এগিয়ে এলেন—‘দশ ভরি সোনাই তো যথেষ্ট ছিল৷ তার সাথে আবার জড়োয়ার সেট কিনলেন কেন? এত খরচ করছেন পরিমলবাবু! ছোটো মেয়ের বিয়েও দিতে হবে৷’

ওঃ! জরায়ু মানে জড়োয়া! হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন গহন৷ ভাগ্যিস এই ভদ্রলোকের সঙ্গে নিয়মিত দেখা হয় না! দেখা হলে বোধহয় মাতৃভাষাটুকু ভুলে যেতেন!

পরিমলবাবুর মুখে বিষণ্ণতার ছাপ পড়ে—‘কী করি বলুন দিদি! ভগবান আমাদের ঘরে পয়সা দেয় না৷ কিন্তু উৎপাত হাজারো! বউ-এর অম্ল, আমাদের ডাইবেটিস! আরও কত কী! অসুখের পিছনেই অর্ধেক ব্যাতন যায়৷’

—‘তবে?’

ভদ্রলোকের চোখ ছলছল করে ওঠে—‘মেয়েটা আমার বড় লক্ষ্মী দিদি৷ দেখতে শুনতে ভালো না ঠিকই৷ তবু বড়ো লক্ষ্মীমন্তর৷ কালো মেয়ের বাপ হওয়ার বড়ো যন্তনা৷ কিন্তুক এবারে সম্মন্ধটা খুব ভালো৷ ছেলে এঞ্জিনিয়ার— বাপের এট্টু দাবি-দাওয়া আছে, তবে ছেলে হিরের টুকরো৷ এমন সম্মন্ধ আমাদের ঘরে ভগবান দেয় না৷ তবে ললিতা মায়ের গান শুনেই ছেলে কাত৷ তাই ভাবি৷ ভগবান যুদি না—ও যদি লেখে—তবু ললিতার কপালে এ ছেলের নাম আমিই লিখব৷ তার জন্য ভিটেমাটি তো দূর, নিজের রক্ত, কিডনি বিক্কিরি করতে হয় তাই সই৷ কিন্তুক মেয়ের বিয়ে এই ছেলের সঙ্গেই দেব নিচ্চই৷’

বলতে বলতেই তাঁর চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে—‘আর ছোটো মেয়েটা ফরসা-টরসা সোন্দর৷ আমি বেঁচে থাকলে ওরও গতি হবে৷’

গহন অবাক হয়ে পরিমলবাবুর দিকে তাকিয়ে ছিলেন৷ একজন মধ্যবিত্ত মানুষের কী অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস! ভাগ্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস একজন ছাপোষা কেরানিও রাখে!

—‘ললিতা ভারী সুন্দর গান গায়৷’ কণা হাসলেন—‘ওর গলাটাই একটা অ্যাসেট! যে গুণের কদর বোঝে তার কাছে রূপ তুচ্ছ জিনিস মাত্র৷’

—‘হ্যাঁ৷’ পরিমলবাবুর মুখ গর্বে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে—‘মা আমার রবীন্দসংগীত বড়ো ভালো গায়৷ আর উশ্চারণও খুব ভালো৷ রবীন্দসংগীতে উশ্চারণটাই আসল বেপার৷ বুঝলেন কিনা, অ্যাঁ?’

আরও কিছুক্ষণ পাড়ার সমস্ত খবরাখবর দিয়ে উঠলেন তিনি৷ কার মেয়ে কার সঙ্গে ‘পেম’ করছে, বাজারের ‘দর’ ভয়াবহ৷ কিছুই কেনার উপায় নেই! পাশের বাড়ির ‘নন্দীবাবুর’ চরিত্তির খারাপ—এইসব আর কী!

কণা গালে হাত দিয়ে অত্যন্ত মনোযোগী শ্রোতার মতো শুনছিলেন৷ গহনের বিরক্ত লাগছিল৷ এ তো মানুষ নয়—আস্ত ডেইলি গেজেট! পাড়ার কোথায় কি হচ্ছে—সব ঠোঁটস্থ! তিনি পরনিন্দা-পরচর্চা য় বিশেষ অভ্যস্ত নন৷ তাই ভাবছিলেন, কী অজুহাতে এখান থেকে পালানো যায়!

কিন্তু অত কষ্ট করতে হল না৷ একটু বাদেই গাত্রোত্থান করলেন পরিমলবাবু৷ বিয়ের কার্ড গহনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন—‘আসবেন দাদা৷ আপনারা এলে খুব খুশি হব৷ ললিতাও খুশি হবে৷ আপনারা হলেন মন্যিমান লোক! আপনাদের আশীববাদের দামই আলাদা—বুঝলেন কিনা, অ্যাঁ?’

বলতে বলতেই বিদায় নিলেন ভদ্রলোক৷ গহন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন৷ যাক অবশেষে ‘ডেইলি গেজেট’ বন্ধ হল! কণা তাঁর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন—‘কী ভাবছ? বিয়েবাড়িতে যাবে না?’

—‘পাগল!’

—‘কেন? পাগলের কী আছে?’ তিনি বলেন—‘বাড়ি বয়ে এসে নেমন্তন্ন করে গেলেন ভদ্রলোক৷ না গেলে অভদ্রতা হবে৷ আমি তো যাবই৷ আমার সঙ্গে তুমিও যাবে কিনা সেটাই জানার বিষয়৷’

গহন বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকালেন—‘তুমি যাবে?’

—‘অফকোর্স৷ কতদিন বিয়ের নেমন্তন্ন খাওয়া হয়নি৷’ তাঁর মুখের হাসিটা তখনও মিলিয়ে যায়নি—‘তার ওপর শুনলাম স্টার্টারে তন্দুরি চিকেন থাকছে৷… সঙ্গে মাটন বিরিয়ানি৷ এরকম সুযোগ কেউ ছাড়ে!’

—‘ভদ্রলোক কি তোমাকে মেনুটাও বলে গেছেন?’

—‘সে কী!’ কণা চোখ কপালে তুলেছেন—‘একটু আগেই তো বললেন, শোনোনি? অবশ্য শুনবে কী করে? তুমি তখন ফ্যানের দিকে তাকিয়ে তোমার নতুন প্রেমিকার কথা ভাবছিলে৷’

কবি রাগত চোখে সহধর্মিণীর দিকে তাকিয়েছেন—‘আমার কোনো প্রেমিকা নেই৷’

—‘তাই বুঝি?’ কৌতুকে ভুরু নেচে উঠল কণার—‘তাহলে আজকাল অত কম্পিউটারে নাক গুঁজে কীসব করা হচ্ছে শুনি? সবসময়ই দেখছি মহাউৎসাহে কম্পিউটার অন করে খুটখাট টাইপ করা হচ্ছে৷ কী উৎসাহ কবিমশাইয়ের! দিন নেই, রাত নেই—সবসময় কম্পিউটারের সামনে আসীন৷ বুড়ো বয়সে অরকুট বা ফেসবুকে কোনো অষ্টাদশী প্রেমিকা জুটিয়েছ৷ তার সঙ্গেই চ্যাটপর্ব চলছে৷’ তাঁর মুখে দুষ্টু হাসি—‘হুঁ হুঁ বাবা…যতই লুকাও, ঠিক ধরে ফেলেছি!’

—‘কি ধরেছি দেখবে?’ গহন কণাকে হাত ধরে টেনে বিছানা থেকে নামিয়ে এনেছেন৷—‘চলো দেখাচ্ছি তোমায়৷ আমার প্রেমিকা কে, আর তার সঙ্গে কি চ্যাট করছি—সব দেখাব৷’

—‘অবশ্যই আমার দেখা উচিত৷’ কণা বিনা প্রতিবাদে পিছু পিছু চললেন— ‘আমার স্বামীর গার্লফ্রেন্ড বলে কথা৷ আমারও তো পছন্দ-অপছন্দ আছে৷ যার-তার হাতে তো তোমায় তুলে দিতে পারি না৷’

গহন ভ্রূকুটি করেছেন৷ কণা হাসতে হাসতেই ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললেন—‘শশশশ…৷’

কম্পিউটারটা খোলাই ছিল৷ কবিতা ডট কমের থ্রেডটাও স্ক্রিনে ভাসছে৷ ‘একা মেঘ’ বলে জনৈক কবি লিখেছেন—‘ভাঙা চাঁদ৷’

কার্নিশে চড়ুইয়ের লাফালাফি
বিস্রস্তবসনার ঘামের বিন্দু ফোঁটায় ফোঁটায়…৷
নির্জনে নির্বাসিত একা লাইট হাউস৷
মেঘেরা মিজোরামে আজও কাঁদে৷
শূন্য কলশিতে ধরা বালিয়াড়ি
পুঁইমাচাটা অবিন্যস্ত৷
তার মধ্যেই ভেঙে গিয়েছিল আস্ত একাট চাঁদ…৷
খুঁজে পেয়েছি তার দু-এক টুকরো কোনখানে…৷

—‘একা মেঘটা কে? তোমার প্রেমিকা?’ কণা উৎসুক৷

গহন বিষণ্ণ মুখে বলেন—‘নাঃ৷ আমিই৷’

—‘তুমি!’ তিনি হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন স্বামীর দিকে—‘তুমি আবার কবিতা লিখছ! তাও ছদ্মনামে!’

তাঁর কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট উচ্ছ্বাস! সে উচ্ছ্বাসিত সুরের রেশ কেটে গেল গহনের বেসুরো জবাবে—‘লিখছি৷ কিন্তু আর লিখব বলে মনে হয় না৷’

—‘কেন?’

—‘কমেন্টগুলো পড়ে দেখো৷’

সর্বমোট পঁচিশটা কমেন্ট পড়েছে৷ কেউ লিখেছে—‘ধুত্তোর! ফের মাথার ওপর দিয়ে গেল!’ কেউ বলেছে—‘ঝুলস্য ঝুল৷’ কেউ বা আবার মন্তব্য করেছে—‘একই দিনে দুটো ঘেঁটে ঘ করার মতো কবিতা৷ কী চাপ!’

কণার সবচেয়ে মজাদার লাগল বিশেষ দুটো কমেন্ট৷ প্রথমটা রামহনুর৷ সে লিখেছে—‘ঠিক ব্যাপারটা বুঝলাম না৷ আমার মনে হল কবি কি কি সাবজেক্ট নিয়ে কবিতা লিখবেন তার লিস্টটাই আগে পোস্ট করেছেন৷ কবিতাগুলো বোধহয় পরে আসবে৷ কবিতার অপেক্ষায় রইলাম৷’ তার পাশেই দাঁত বের করে হাসার স্মাইলি৷

আর একটা জব্বর মন্তব্য দিয়েছে কুবলাশ্ব৷ তার বক্তব্য—‘একটু আগেই মগনলালের কবিতার থ্রেডে কুরুক্ষেত্র হয়ে গেছে৷ তাই বিশেষ কথা বাড়াতে চাই না৷ সম্ভবত এলিয়ট বলেছিলেন, যে কবিতার অর্ধেক বোঝা যায়, অর্ধেক যায় না—সেটাই আসল কবিতা৷ যেটা পুরোটাই বোঝা যায় না, সেটা বোধহয় কবিতার চেয়েও উচ্চমার্গের জিনিস৷ তুরীয় দশায় উত্তীর্ণ হওয়া ছাড়া বোঝার উপায় নেই দেখছি৷’

মুমতাজ নাম্নী একটি মেয়ে মৃদু প্রতিবাদ করেছে—‘অমন বোলো না৷ কবিতার শেষ দুটো লাইন আমার বেশ ভালো লেগেছে৷’

উত্তরে কুবলাশ্ব বলেছে—‘ভাই মুমতাজ, তোমার যদি শেষ দুটো লাইন ছাড়া বাকিটাও কবিতা মনে হয় তাহলে কিছু বলার নেই৷’

‘কেবিসিতে অমিতাভের নাচানাচি
ক্যাটরিনার আমসূত্রর ফোঁটায় ফোঁটায়
ফিলম থেকে নির্বাসিত একা রানি মুখার্জি
নিরূপা রায়েরা সিনেমায় আজও কাঁদে৷
শূন্য বাংলা ফিলমের ভাঁড়ে ধরা তামিলের মিক্সচার
ইমরান হাসমির দাড়ি অবিন্যস্ত…
আগেরটা যদি কবিতা হয়, তবে এটাও কবিতা৷’

কণা আর থাকতে পারলেন না, খিলখিল করে হেসে উঠলেন৷ গহন সবিস্ময়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে ব্যথিত কণ্ঠে বলেন, ‘তুমি হাসছ!’

‘হাসব না!’ তিনি হাসি থামাতেই পারছেন না—‘কুবলাশ্বর সেন্স অব হিউমারটা কী মারাত্মক দ্যাখো কী সুন্দর তোমার কবিতার প্যারোডি বানিয়েছে! হিঃ…হিঃ…হিঃ…!’

গহন কিছুক্ষণ বাচ্চা ছেলের মতো গোঁজ হয়ে থাকলেন৷ তারপর দ্রুত পায়ে সেখান থেকে চলে গেলেন৷

কণা বুঝলেন কবিবরের আঁতে ঘা লেগেছে! অমন মুখের ওপর হেসে ওঠাটা ঠিক হয়নি৷ ভুলটা বুঝতে পেরে সামান্য অনুতপ্তও হলেন৷ পরক্ষণেই অভদ্র হাসিটা ফের ‘অধিকার’ করে নিয়েছে তাঁকে৷ বেশ কিছুক্ষণ ফিক ফিক করে হাসার পর ক্রমশ শান্ত হলেন৷ এবার রঙ্গ-রসিকতাকে দূরে সরিয়ে রেখে কর্তব্যপালনের পালা! কবির অর্ধাঙ্গিনী হওয়া সহজ কথা নয়৷

আজও স্নিগ্ধ বৃষ্টি হচ্ছে৷ খুব জোরে নয়, বরং মাখনের মতো ঝিরঝিরে মোলায়েম বৃষ্টি৷ তার সঙ্গে মিঠে সোনালি রোদ্দুর কখনও লাজুক বউয়ের মতো মুখ দেখায়৷ আবার পরক্ষণেই পাতলা মেঘের ঘোমটা টেনে দেয়৷ যখনই রোদ্দুরের আভা বৃষ্টির ফোঁটার ওপর পড়ছে, তখনই বিন্দুগুলো সোনালি হয়ে উঠছে৷ ঠিক যেন গলন্ত সোনা৷

কণা ধীর পায়ে বেডরুমের দিকে গেলেন৷ মেজাজ খারাপ হলে গহন সচরাচর বিছানায় চুপ করে শুয়ে থাকেন৷ অথবা মিউজিক সিস্টেমে গান শোনেন৷

এখন অবশ্য তিনি গান শুনছিলেন না৷ বরং জানলাগুলো বন্ধ করে, অন্ধকার ঘরে শুয়েছিলেন৷ বৃষ্টি তার পছন্দ হচ্ছে না৷ ইদানীং বর্ষাকালের ওপরেও খাপ্পা হয়ে আছেন৷

কণা মনে মনে স্বীকার করলেন যে কবিদের মেজাজ-মর্জি বোঝা ভগবানেরও অসাধ্য৷

তিনি আস্তে অস্তে স্বামীর পাশে শুয়ে পড়েন৷ ঘন হয়ে আদুরে ভঙ্গিতে তাঁর বুকে মুখ গুঁজেছেন৷ অন্যান্য দিন গহন আলগোছে তাঁর মাথাটা জড়িয়ে ধরে, কপালে আলতো একটা চুমু এঁকে দেন৷ আজ একদম স্থির! নড়াচড়া নেই৷

—‘কী হল? রাগ নাকি?’ দু-হাতে তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলেন কণা—‘কার ওপর এত গোঁসা কবিবর!’

রাগ নয়, হতাশা চুঁইয়ে পড়ল গহনের কণ্ঠস্বরে—‘আমি আর কবি নই৷ আমি আর কবিতা লিখতে পারছি না কণা৷’

—‘কে বলল লিখতে পারছ না?’ তিনি সস্নেহে তাঁর মাথার চুলে বিলি কাটছেন—‘কবিতা যে লিখছ তা তো নিজের চোখেই দেখে এলাম৷’

—‘ধুস!’ অধৈর্য হয়ে মাথা ঝাঁকালেন গহন—‘কমেন্টগুলো তো নিজের চোখেই দেখলে৷ ত্রিশ বছর ধরে কবিতা লিখছি৷ কিন্তু শুঁটকির ভাষায় এমন ‘ঝাড়’ আগে কখনও খাইনি৷’

—‘হ্যাঁ৷ নিজের চোখে দেখেছি৷ তাতে কী?’ তাঁর শান্ত উত্তর৷

—‘তাতেই সব৷’

—‘সব নয় গহন৷ তুমি শুধু ঝাড়টাই দেখছ৷ কিন্তু ওরা যা বলেছে তা অবান্তর কিছু নয়৷’

—‘তার মানে?’ গহন উত্তেজিত—‘তার মানে তুমিও বলতে চাইছ আমি যা লিখেছি তার সবটাই ‘ঝুলস্য ঝুল’!’ কণা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে৷

—‘কি দেখছ?’

—‘একটা সত্যি কথা বলবে?’

—‘কী?’

—‘কবিতাটা লেখার আগে ঠিক কি ভেবেছিলে? মানে কি ভেবে লিখেছিলে?’

কণার কথায় থতোমতো খেয়ে গেলেন তিনি৷ এতক্ষণ কথাটা ভেবে দেখেননি৷ কবিতার সমালোচনার ঝালেই গা জ্বলছিল৷ কিন্তু কবিতার উৎপত্তি নিয়ে বিন্দুমাত্রও ভাবেননি৷

—‘কিছুই ভাবোনি৷ তাই না?’ কণা নিজেই উত্তর দিয়ে দিয়েছেন—‘যা মাথায় এসেছে, সুন্দর সুন্দর শব্দ দিয়ে সাজিয়ে তাই বসিয়ে দিয়েছ৷’

গহন আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন—‘আই মাস্ট কনফেস৷ ঠিক তাই৷’

‘—এটাই তোমার প্রবলেম৷ না ভেবে, শুধু শব্দের জোরে, যা খুশি তাই লিখে পার পাওয়ার ক্ষমতা গহন দত্তগুপ্তর আছে৷ কিন্তু ‘একা মেঘের’ নেই৷ পাঠক অত বোকা নয়৷ তারা একটা বিরাট নামের সামনে বোকা সাজে বটে৷ কিন্তু আদতে অত নির্বোধও নয়৷ পঙক্তিগুলো সুন্দর হচ্ছে অথচ স্পর্শ করছে না৷ সেইজন্যই এই রি-অ্যাকশন৷’

—‘শুধু রি-অ্যাকশন নয়, রুড রি-অ্যাকশন!’

—‘স্বাভাবিক৷’ কণার হাতদুটো গহনের মুখ তাঁর বুকে চেপে ধরেছে৷ যেন মা সন্তানকে বুকে নিয়ে ভোলাচ্ছে৷

—‘তোমার মনে আছে গহন? একদিন তুমি পার্কস্ট্রিট থেকে আমার মোবাইলে ফোন করেছিলে৷ আমি স্নানে গিয়েছিলাম৷ কলারটিউনে ‘সখী ভাবনা কাহারে বলে, সখী যাতনা কাহারে বলে’ গানটা বাজছিল৷ টয়লেট থেকে বেরিয়ে যখন ফোনটা রিসিভ করলাম, তখন তোমার রি-অ্যাকশন কি ছিল মনে আছে?’ কণা ফিক করে হেসে ফেললেন৷ তারপর গহনের বাচনভঙ্গি নকল করে বলেন—‘তুমি বলেছিলে কি সব গান লাগিয়েছ! আমি এদিকে চাঁদিফাটা রোদে দাঁড়িয়ে গলগল করে ঘামছি—আর তোমার ফোনে বাজছে ‘সখী ভাবনা কাহারে বলে, সখী যাতনা কাহারে বলে, সখী ভালোবাসা কারে কয়?’ এই পরিস্থিতিতে এইসব দার্শনিক প্রশ্ন শুনতে ভালো লাগে?’

ঘটনাটা গহনেরও মনে পড়ে গেল৷ অবিকল এই কথাগুলোই বলেছিলেন তিনি৷ ভাবতেই হাসি পেয়ে গেছে তাঁর৷

—‘তোমার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হচ্ছে৷ চতুর্দিকে মানুষের এত সমস্যা, এত যন্ত্রণা, এত কষ্ট—অথচ কবিতায় তার কোনো ছাপই নেই! তোমার কবিতা নরম, আতুর, সুন্দর৷ কখনও ভাবের গভীরে ডুবে যাচ্ছে, কখনও দার্শনিকতার আকাশে উড়ছে৷ কিন্তু মাটিতে নেমে আসছে না৷’ কণা স্নিগ্ধস্বরে বলেন—‘যে লোকটা সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে, বসের খিঁচুনি খেয়ে, ট্রামে-বাসে ঝুলতে ঝুলতে বাড়ি ফিরছে, কিংবা যে ছেলেটি বা মেয়েটি বেকারত্বের জ্বালায় মরছে—তাদের কাছে ভাব, দার্শনিকতা বা সুন্দর শব্দ কোনোটাই আবেদন রাখে না৷ কারণ তুমি তো তাদের কথা কখনও বলোনি, তাদের যন্ত্রণাকে স্পর্শ করোনি৷’

গহন কণার বুকে মুখ ডুবিয়ে খুব মন দিয়ে কথাগুলো শুনছিলেন৷ তিনি জানেন কণা একদম ঠিক কথা বলছেন৷ এর চেয়ে চরম সত্য আর কিছু হতেই পারে না৷ তবু মনের কোথাও একটা যন্ত্রণা কাঁটার মতো বিঁধছিল৷

—‘কিন্তু কণা, আমি যে কঠিন শব্দ, কষ্টের কথা, যন্ত্রণার কথা বলতে পারি না৷’

—‘সে আবার কী কথা!’ কণা যেন শাসনের সুরে বলেন—‘কেন পারো না! তোমার কলম আছে, শব্দ আছে, অনুভূতি আছে, ক্ষমতাও আছে৷ তবে পারবে না কেন?

—‘হুঁ’৷

—‘হুঁ নয় হ্যাঁ৷’ তিনি বললেন—‘আজকে যে মানুষটি আমাদের নেমন্তন্ন করে গেলেন, সেই মানুষটি তোমাকে জ্ঞানীগুণী মানুষ বলে জানেন৷ কিন্তু তোমার কোনো কবিতা কখনও পড়েছেন কি? পড়েননি৷ তার কারণ এই নয় যে তুমি ইন্টেলেকচুয়ালদের জন্য লেখো৷ না পড়ার একমাত্র কারণ, কখনও তাঁর কথা লেখোনি তুমি৷ কবিতা মানেই তো দুর্বোধ্য জিনিস নয়৷ যা মানুষকে ভাবায়, অনুভূতিকে ধাক্কা মারে—তাই কবিতা৷ যার অনুভূতি আছে, আবেগ আছে সে-ই কবিতা পড়বার যোগ্য৷ সেই অনুভব থেকে ওকে বঞ্চিত করবে কেন? ওনার অপরাধ কী? উনি আঁতেল নন, সাংঘাতিক ডিগ্রি নেই এটাই কি অপরাধ?’

গহন চুপ করে থাকলেন৷ এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া যায় না৷ সত্যি বলতে কি এর উত্তর তাঁর কাছে নেই৷ সবসময়ই ভেবে এসেছেন কবিতা শুধু শিক্ষিত পাঠকদের জন্য৷ যাদের কাব্যচর্চা করার অভ্যাস আছে তারাই একমাত্র পাঠক হওয়ার উপযুক্ত৷ কিন্তু আজ মগনলালের থ্রেডে, স্বর্ণাভ গুপ্তর এই একই কথার উত্তরে কুবলাশ্বর একটি পোস্ট তাঁকে ভাবাচ্ছে৷ কুবলাশ্ব লিখেছিল—‘কবিতা চর্চা করার অভ্যাস পুরো ভাঁটের কথা৷ মায়ের পেট থেকে পড়ে কেউই কাব্যচর্চা করতে শুরু করে না৷ আমাদের সকলের কবিতা চর্চা শুরু হয় ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ থেকে৷ তারপর একটু একটু করে বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সাথেই পরিচয় হয় মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, মোহিতলাল মজুমদারের সঙ্গে৷ তারপর জীবনানন্দ, সুকান্ত ভট্টাচার্যরাও এসে পড়েন৷ এই অবধি সব মানুষই অল্পবিস্তর পড়ে থাকেন৷ কারণ এরা আমাদের সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত৷ তার মধ্যে যারা একেবারে মাথামোটা, তাদের কথা বাদই দিলাম—কিন্তু যাদের অল্পবিস্তর সূক্ষ্ম অনুভূতি আছে, তারা এর রস্বাস্বাদনও করতে পারে৷ সুতরাং যাকে বেস বলে তা তাদের তৈরি হয়ে যায়৷ অতএব অল্পবিস্তর সব মানুষেরই কবিতা পড়ার অভ্যাস থাকে৷ তারা হয়তো কবিতার ল্যাজা মুড়ো, ছন্দ অলংকার নিয়ে মাথা ঘামায় না৷ কিন্তু অনুভব করার ক্ষমতা রাখে৷’

এর উত্তরে স্বর্ণাভ গুপ্তর তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গোক্তি—‘সেই অনুভব করার ক্ষমতা কি ইন্টেলেকচুয়াল কবিদের কবিতা বোঝার পক্ষে যথেষ্ট?’

কুবলাশ্বর ফের ঝাঁঝালো উত্তর—‘ইন্টেলেকচুয়াল কবি বলতে আপনি যদি নিজেকে ও মগনলালকে বোঝান—তবে অনুভব তো দূর, কোনোকিছুই যথেষ্ট নয়৷ কিন্তু যখন শঙ্খ ঘোষ বলেন, ‘আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক’ কিংবা শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলে ওঠেন—‘ভালোবাসা পেলে সব লন্ডভন্ড করে চলে যাবো’ অথবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হাহাকার করে বলেন—‘কেউ কথা রাখেনি’—তখন আমরা অনুভব করতে পারি৷ কবিতা তখন আমাদের বুকে ধাক্কা দেয়৷ কাঁদায় হাসায়! যখন উচ্চারিত হয় ‘কাল ছিল ডাল খালি/আজ ফুলে যায় ভরে/বল দেখি তুই মালি/হয় সে কেমন করে’ তখন বিস্মিত হই৷ আপনি কি বলেন? এগুলো কি কবিতা নয়? না কবিরা আপনার মতে যথেষ্ট ইন্টেলেকচুয়াল নন৷’

স্বর্ণাভ গুপ্ত এখানেই ক্ষান্ত দিয়েছিলেন৷ মডারেটর ব্যাসদেবও বিপদ বুঝে থ্রেডটাই ক্লোজ করে দিয়েছেন৷ কিন্তু গহনের মাথায় কথাগুলো তখন থেকেই ঘুরছিল৷ আর এই মুহূর্তেই কণা ঠিক ওই ভাষাতে না হলেও, মোটামুটি কাছাকাছি বক্তব্যই পেশ করেছেন৷

—‘কী ভাবছ?’

গহন কণার দিকে তাকিয়ে হাসলেন—‘ভাবছি এত কথা শিখলে কোথায়!’

—‘বা-রে!’ তিনি ঠোঁট ফুলিয়েছেন—‘আফটারঅল আমি কবিপত্নী৷ গহন দত্তগুপ্ত’র বউ বলে কথা! বুঝলেন কিনা, অ্যাঁ?’

গহন হেসে ওঠেন৷ আদর করে স্ত্রীয়ের স্ফুরিত অধরে চুমু এঁকে দিলেন—‘এটা তার পুরস্কার৷’

—‘পুরস্কার তো বুঝলাম! কিন্তু মাথায় কিছু ঢোকাতে পেরেছি কি?’

—‘মাথায় কি ঢুকিয়েছ তা একমাত্র গহন দত্তগুপ্তর বউয়ের স্বামী ছাড়া কেউ বুঝবে না৷’ তিনি কণার কোমর ধরে টেনে তুলে এনেছেন বুকের ওপর৷

—‘এসো৷ দেখি, আমার নদীটা কেমন আছে৷’

কণা গহনের বুকে আলতো করে কিল মারলেন৷ লাজুক হেসে বললেন, ‘অসভ্য!’

—‘থ্যাঙ্কস ফর দ্য কমপ্লিমেন্ট৷’

—‘আচ্ছা, একটা কথা বলবে?’

কণার চুল আদরে এলোমেলো করে দিতে দিতে বললেন গহন—‘বলো৷’

—‘তুমি রোমান্টিক কবিতা ছাড়া অন্য কিছু লেখো না কেন? বাস্তবকে এত ভয় কীসের?’

তিনি কণাকে ঘনভাবে জড়িয়ে ধরেছেন৷ তাঁর মনে অদ্ভুত একটা ক্ষোভ গুমরে মরছিল৷ তবু একটা মৃদু হাসি দিয়ে ক্ষোভ ঢাকলেন৷ বললেন—‘এসো৷ একটু ভালোবাসি৷’

কণা বুঝলেন যে প্রসঙ্গটা গহন এড়িয়ে গেলেন৷ গহনও বুঝলেন যে কণা বুঝেছেন৷ তবু যে কথাটা স্পষ্ট করে বলতে পারলেন না সেটাই যেন উচ্চারিত হল তাঁর দীর্ঘশ্বাসে৷

—‘বাস্তবকে ভয় পাই না কণা৷ বাস্তব যে আঘাত ছাড়া আর কিছু দেয় না, তা তোমায় কী করে বোঝাই৷’

ঘড়িতে বারোটার ঘণ্টা পড়ল!

সারাদিন ধরে নম্র হওয়ার দরুন এখন পরিবেশ ঠান্ডা৷ এই মুহূর্তে বৃষ্টি নেই৷ তবে একটা জোলো হাওয়া থেকে থেকেই হুহু করে এসে আছড়ে পড়ছে৷ আকাশে একটা-দুটো পাতলা মেঘের স্তর খামখেয়ালিভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল৷ তার মধ্যে দিয়েই শলমাজরির মতো নক্ষত্ররা কৌতুকে চোখ টিপছে৷

রাতের অন্ধকার মেখে ছাতে পায়চারি করে বেড়াচ্ছিলেন গহন৷ ছায়া ছায়া জ্যোৎস্না মাখা প্রেক্ষাপটে তাঁকে অতৃপ্ত আত্মার মতো মনে হয়৷ গন্ধরাজের মিষ্টি গন্ধ মাঝেমধ্যেই নাকে আসছে৷ কণা ছাতের টবে গন্ধরাজ লাগিয়েছেন৷ তার পাশে লংকা গাছের সহাবস্থান৷ গন্ধরাজের সঙ্গে লংকা গাছের বুনো গন্ধও পাচ্ছেন গহন৷

তিনি অন্যমনস্ক ভাবে হাত বাড়িয়ে দেন গাছটার দিকে৷ ঠান্ডা ভিজে, ঈষৎ স্যাঁতস্যাঁতে পাতাগুলো তাঁর স্পর্শে খসখস করে উঠল৷ যেন সামান্য উষ্ণতা পেয়ে উল্লসিত হয়ে উঠেছে৷

গহন পরম স্নেহে হাত বাড়িয়ে দেন গাছগুলোর গায়ে৷ নিজেদের কোনো সন্তান তো আর হল না৷ এরাই কণার সন্তান৷ কণা এদের স্নেহে, যত্নে বড়ো করে তুলেছেন৷ যখন প্রথম এ বাড়িতে এসেছিল তখন ছোট্ট ছোট্ট চারা ছিল৷ এখন বড়ো হয়েছে৷

গাছগুলোও যেন বুঝতে পারে তাদের ভীষণ আপন কেউ এসেছে৷ স্পর্শে ঝুঁকে পড়ে অভিবাদন জানায়৷ লংকা গাছটা লংকার ভারে বিধ্বস্ত৷ তবু গহনের হাত স্পর্শ করে যেন বলছে—‘দ্যাখো…আমি তোমাদের উপহার দেওয়ার জন্য প্রস্তুত৷ এই নাও আমার ফুল…এই নাও ফল…৷ স্পর্শ করো…অনুভব করো…৷’

স্পর্শে যে কী আনন্দ তা আজ টের পেলেন গহন৷ অন্ধকারে ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না৷ তবু গাছটার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সব বুঝতে পারছেন! কোনটা পাতা! কোনটা ফুল! কোনটা ফল—সব অনুভব করছেন৷

তাঁর আনন্দ যেন প্রকৃতির গায়েও ছড়িয়ে পড়ল৷ টুপ টুপ করে নিঃশব্দেই কয়েক ফোঁটা জল পড়ল তাঁর গায়ে৷ স্বাতী নক্ষত্রের জল নাকি! হাওয়া হুহু করে বয়ে গেল তাঁকে ছুঁয়ে৷ বাড়ির সামনের বড়ো আমগাছটার ডালপালা এসে পড়েছে ছাতে৷ হাওয়ার দমকে তার পাতায় পাতায় মর্মরধ্বনি৷ বাড়ির পিছনে অন্ধ গলিতে জোনাকির ভিড়৷ স্পষ্ট ও জোরালো আলোয় গ্রিন সিগন্যাল দিচ্ছে৷ রাস্তায় ভিখিরি আর কুকুরের দ্বন্দ্বযুদ্ধের আওয়াজ! তার মাঝখানেই রাতজাগা প্রহরীর লাঠির ঠুকঠুক, হুইসেল এবং চিৎকার—‘জাগতে রহো— ও-ও-ও-ও!’

সব মিলিয়ে আজ যেন পৃথিবী জীবন্ত হয়ে উঠে বলছে, ‘দ্যাখো…চোখ মেলে দ্যাখ্যো…কান্না দ্যাখ্যো…বেদনা-যন্ত্রণা-লজ্জা সব দ্যাখো৷ স্পর্শ করো… অন্ধের মতো নয়, দার্শনিকের মতো নয়, মরমি মানুষের মতো স্পর্শ করো…৷’

গহন দু-চোখ ভরে দেখলেন রাতের পৃথিবীকে৷ ছাত থেকে গোটা পাড়ার দৃশ্যই স্পষ্ট দেখা যায়৷ এতদিন আকাশের সৌন্দর্য দেখেছেন৷ এবার মাটির দিকে তাকালেন৷

গহনের পাশের বাড়িতে তখনও আলো জ্বলছে৷ জানলা খোলা৷ কণার কাছে শুনেছেন, এ বাড়ির ছেলেটা রোজ রাতে মদ খেয়ে বাড়ি ফেরে৷ কাউকে হাতের কাছে না পেয়ে অসহায় বউটাকেই বেদম পেটায়৷ মাঝেমধ্যেই প্রবল চিৎকারও কানে আসে৷ নিতান্তই পি.এন.পি.সি. ভেবে পাত্তা দেননি৷ তা ছাড়া বিষয়টা তাঁর কাছে বিরক্তিকর ঠেকেছে৷

কিন্তু আজ স্বচক্ষেই দেখতে হল দৃশ্যটা৷ তিনি শিউরে উঠেছেন৷ এ কী মানুষ! না না জানোয়ার! বেদম মারতে মারতেই ছেলেটা ঝাঁপিয়ে পড়েছে মেয়েটির ওপর৷ জোর করে ছিঁড়ে ফেলেছে তার ব্লাউজটা! শাড়ি অবিন্যস্ত৷ খাটটা যেন ভয় পেয়ে প্রবল নড়ে উঠল! পৈশাচিক দৃ,শ্য দেখে সে-ও নিজে কেঁপে কেঁপে উঠছে৷ মানবিক নয়, জান্তব রিরংসা৷ পাশবিক মৈথুন!

গহন চোখ সরিয়ে নিলেন সেদিক থেকে৷ বুকের ভেতরে অসহ্য একটা অন্ধ রাগ, ক্ষোভ দানা বাঁধছিল৷ দাঁতে দাঁত চেপে বললেন—‘স্কাউনড্রেল৷’

ছাতের উলটোদিকে বস্তির দৃশ্য! এখান থেকে খানিকটা দূরেই বস্তি অঞ্চল৷ দু-একটা ঘরে তখনও আলোর আভা৷ বেশ খানিকটা কালো ধোঁয়া উড়ে উড়ে ছড়িয়ে পড়ছে আকাশে৷ এত রাতে কারুর বাড়িতে হাঁড়ি চড়েছে৷ যখন সমস্ত মানুষ পেট ঠেসে খেয়ে স্বপ্নের দেশে পাড়ি দিচ্ছে, তখন হয়তো দুটো ভাতের জন্য লালায়িত হয়ে বসে আছে কেউ!

বস্তির কালো ধোঁয়া যেন উজ্জ্বল চাঁদকে ম্লান করে দেয়৷ গহন আকাশের দিকে তাকালেন না৷ আর ভালো লাগল না৷ বুকের ভেতরে একটা অব্যক্ত কষ্ট৷ ভীষণ অসহায় লাগছে নিজেকে৷ তিনি ফের চোখ ফিরিয়েছেন পাশের বাড়ির জানলায়৷ আলো নিভে গেছে৷ কিন্তু ল্যাম্পপোস্টের আলো নিষ্প্রভ বেদনার মতো পিছলে পড়েছে জানালার ওপরে৷ সেই ক্ষীণ আলোয় দেখতে পেলেন মেয়েটি জানলার গরাদে মুখ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ তার দু-চোখে নিষ্প্রাণ শূন্য দৃষ্টি! পাথরের মূর্তির মতো নিষ্প্রাণ৷ ভঙ্গি দেখে মনে হয়, বোধ হয় সে বেঁচে নেই!

অত ক্ষীণ আলোতেও বুঝতে অসুবিধে হল না, তার কপালে, গালে কালশিটে! চুলের ফাঁকে, ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ রক্তরেখা, গলায় সিগারেটের ছ্যাঁকার দাগ!

গহন দেখলেন মেয়েটির স্থির চোখ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে৷ ল্যাম্পপোস্টের আলো পড়ে ঝিকিয়ে উঠল অশ্রুবিন্দুরা! মনে হল যেন বলছে—‘দ্যাখো আমায়…স্পর্শ করো…চোখের জল স্পর্শ করো…অনুভব করো কালশিটের ব্যথা…স্পর্শ করো…৷’

গহনের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে৷ কিন্তু মেয়েটির দিকে তাকাতে অস্বস্তি বোধ করছেন৷ তার চোখে চোখ রাখার সাহস পাচ্ছেন না৷ দৃ,শ্যটা সহ্য হচ্ছে না৷ তাই আস্তে আস্তে তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে, ছাত থেকে চুপিসারে নেমে গেলেন গহন৷ একরকম পালিয়েই গেলেন৷ সাধে কি শুঁটকি তাঁকে বলে—এসকেপিস্ট!

‘চালচুলো নেই তার, নেই তার চেনা বা অচেনা
আদমসুমারি হলে তার মাথা কেউ গুনবে না৷
তার ভোট চাইবে না গণতান্ত্রিক কোনো প্রার্থী৷
সরকারের দরকার নেই, তাই নিজের সুড়ঙ্গে—
পাগল,…পাগল, সাপলুডো খেলছে বিধাতার সঙ্গে৷’

ফ্ল্যাটের ঘরটা অন্ধকার! অদ্ভুত আলোহীন বিবরের মতো৷ হঠাৎ করে দেখলে মনে হয় এ ঘরে বোধ হয় আলো ঢোকে না৷ ঢোকেনি কখনও! প্রাচীন সুড়ঙ্গের অন্দরে যেমন নির্নিমেষ রাত্রি ছড়িয়ে থাকে, ঠিক তেমনই অন্ধকার তার স্থায়িত্ব কায়েম রেখেছে এখানে৷

ঘরে প্রধান শব্দ বলতে শুধু কবীর সুমনের গান৷ এ ছাড়াও খুঁটিনাটি দু-একটা ক্ষীণ শব্দ মাঝমধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে৷ কখনও-বা সেটা ঘড়ির কাঁটার টিকটিক৷ কখনও বাথরুমের কলে জলের টুপটাপ৷ আবার কখনও বা দেশলাই জ্বালানোর আওয়াজ৷ ঘন অন্ধকারের মধ্যেও সিগারেটের আগুনে মুখটা তীব্র ধকধকে আলো নিয়ে জ্বলছিল;

—‘জগতে যা কিছু আছে, কিছু নেই তার অনুষঙ্গে
পাগল…পাগল…সাপলুডো খেলছে বিধাতার সঙ্গে…৷’

গানটা শেষ হয়ে যেতেই আরেকটা নতুন শব্দ যোগ হল৷ তরলে বরফ পড়ার ছলাৎ আওয়াজ৷ তার পেছন পেছন একটা কণ্ঠস্বর—

কোনো উত্তর নেই৷

—‘কথা বলবে না? রাগ করেছ?’

এবারও কোনো উত্তর এল না৷ শুধু রকিং চেয়ারটা যেন একটু দুলে উঠল৷

রকিং চেয়ারটার ঠিক সামনের ডিভানটাতে বসেছিল শুঁটকি৷ বিকেল থেকেই প্রচুর মদ খেয়েছে সে৷ কথা বেশ অস্পষ্ট৷ জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে৷

—‘আজ একটু বেশি খেয়ে ফেলেছি৷ মাফ করে দাও৷’

চেয়ারটা আর একটু নড়ল৷ শুঁটকির মনে হল চেয়ারে বসা নারীমূর্তির মুখ বিষণ্ণ৷

—‘সরি রুমা৷’ সে অপরাধীর মতো মাথা নীচু করেছে—‘জানি আমি ভীষণ খারাপ৷ মদ খাওয়ার অভ্যেসটা ছাড়তেই পারি৷ কিন্তু ছেড়ে দিলে তুমি তো আর বারণ করতে আসবে না৷’

এবারও অন্যপক্ষ নিশ্চুপ! তার এই মৌনতার পিছনে রাগ লুকিয়ে না দুঃখ—তা বোঝা মুশকিল৷

‘বুবাই কেমন আছে? বড়ো হয়েছে?’ শুঁটকি উৎসাহভরে জানতে চায়—‘এখন কি বাবা বলে ডাকতে পারি? ওকে তুমি আমার কথা বলেছ?’

টুপ টুপ করে শুধু কোথায় যেন জল পড়ে যায়৷ আর কোনো শব্দ নেই৷

‘বলোনি তাই না?’ সে যেন একটু হতাশ হল—‘আচ্ছা, পরে বলে দিয়ো৷ বোলো ওর বাবা খুব দুষ্টু৷ মাকে খুব ব্যথা দিয়েছিল৷ তাই মা তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে৷ কিন্তু বাবার ওকে দেখতে ইচ্ছে করে৷ খুব আদর করতে ইচ্ছে করে৷ ওর জন্য বাবা একটা ঘর সাজিয়ে রেখেছে৷’ তার কণ্ঠস্বর ফের উৎসাহিত হয়ে ওঠে—‘গোলাপি রঙের দেয়াল, জানলায় মিকি মাউসের ছবিওয়ালা পর্দা৷ নরম গদির ছোট্ট একটা ধবধবে বিছানা৷…হ্যাঁ তার দু-দিকে রেলিংও লাগিয়ে দিয়েছি রুমা৷ বুবাই পড়ে যাবে না৷ একটা দোলনাও আছে৷ আর আছে অ-নে-ক পুতুল৷ টেডি বিয়ার, বাঘ, সিংহ, বেন-টেন না কি যেন—অনেক খেলনা৷’

বলতে বলতেই চুপ করে গেল শুঁটকি৷ কুণ্ঠাভরা কাতর গলায় বলে—‘ও কি একবার বাবার কাছে আসবে? আমি শুধু একবার ওকে দেখব৷ কথা দিচ্ছি, সেদিন একটুও মদ খাব না৷ বাজে খিস্তি দেব না৷ তুমি বলতে যে বাচ্চাদের সামনে খিস্তি দিতে নেই! বুবাই এলে শুধু ভালো ভালো কথাই বলব৷ অনেক বেলুন কিনে আনব ওর জন্য৷ আমরা দুজনে শুধু খেলব৷ তোমার কোনো ব্যাপারে আর কোনোদিন জোর করব না৷ একটুও জ্বালাব না রুমা…৷’ তার কথায় তীব্র আকুতি—‘ওকে শুধু একবার নিয়ে এসো…আনবে না?’

এমন প্রার্থনায় বোধহয় ঈশ্বরের মনও দ্রবীভূত হয়৷ কিন্তু ওপ্রান্তের মানুষটা এবারও কোনো কথা বলল না৷ শান্ত নীরবতায় ভরে আছে গোটা ঘর৷ হাস্নুহানার মিষ্টি গন্ধ আচ্ছন্ন করে রেখেছে আবেশে৷ রুমা এলেই এই গন্ধটা পায় শুঁটকি৷ সে জানে রুমার গা থেকেই গন্ধটা আসে৷

বেশ খানিকক্ষণ নীরবতা৷ সে চুপ করে উত্তরের প্রতীক্ষা করছে৷ ওপ্রান্তের মানুষটি এখনও নীরব৷ বুকের ভেতরে দীর্ঘশ্বাসটা কোনোমতে চাপল শুঁটকি৷ তার মধ্যে হতাশা ক্রমাগতই গুমরে মরছিল৷ এখনও কি ক্ষমা পাওয়া যাবে না? আজও কি ক্ষমা করবে না রুমা? সে তো কোনোদিন রুমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেনি! কোনোদিন গায়ে হাত তোলেনি! তুলবেই বা কেন! সে যে রুমাকে ভীষণ ভালোবাসত৷ আজও বাসে৷ শুধু একটা দিনের ভুল…মুহূর্তের ভুল৷ ক্ষণিকের মতিভ্রম…৷

হঠাৎই মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল৷ রিংটোনে একটা বাচ্চা খিলখিলিয়ে হাসছে৷ শুঁটকি একটু বিরক্ত হয়েই ফোনটা তুলে নেয়৷ গহনের ফোন! এই রাত দুটোর সময় তার আবার কী হল!

—‘সরি রুমা৷’ সে অনুতপ্ত স্বরে ক্ষমা প্রার্থনা করে—‘গহন ফোন করেছে৷ গহনকে তো চেনো তুমি৷ ফোন না তুললে হারামজাদা অভিমান করে বসে থাকবে৷ তুমি একটু বোসো,…আমি ওর সঙ্গে কথা বলেই আসছি৷’

ফোনটা হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে এল শুঁটকি৷ কলটা রিসিভ করেই বলল—‘রামছাগল কোথাকার…এত রাত্রে ফের নাকে কান্না জুড়েছিস! ঝাড় সহ্য না হলে লেখা বন্ধ করে দে৷ মগজমারি খতম৷ আমায় জ্বালাচ্ছিস কেন?’

গহনের কণ্ঠস্বরটা আজ অন্যরকম শোনাল—‘না শুঁটকি, আমি লিখব৷’

শুঁটকি হাসে—‘ঝাড় সহ্য করেও লিখবি! বাঃ৷ এবার আর পালাবি না! বাঘ! বাঘ! গহন দত্তগুপ্ত আর পালাবে না! গ্রেট!’

—‘না!’ গহন দত্তগুপ্ত নয়, গহন শান্তভাবে বলেন—‘গহন দত্তগুপ্ত-ই হচ্ছে সব নষ্টের গোড়া৷ আমি বুঝতে পারছিলাম যে সমালোচনা প্রয়োজন, অথচ সমালোচনা সহ্য করতে পারছিলাম না৷ এই দ্বিচারিতার কারণ ওই গহন দত্তগুপ্ত নামটাই৷ ওই নামটা তার ইগোর পাহাড় নিয়ে বারবার বাধা দিচ্ছিল৷ এখন আমি আর গহন দত্তগুপ্ত-ই নই৷ কল মি একা মেঘ৷’

‘বাঃ৷’ সে হেসে উঠল—‘তবে আজ তোর নবজন্ম হল৷’

—‘বলতে পারিস৷ অথবা নিউ জার্নিও বলা যায়৷’

—‘যাই হোক৷’ শুঁটকি আন্তরিক স্বরে বলে—‘শেষ পর্যন্ত তুই জিতবিই৷’

—‘তোর মুখে ফুল-চন্দন পড়ুক৷’

—‘ইয়ে…তার সঙ্গে একটু তুলসীপাতা, একটু এসেন্স, একটা খাটিয়া, আর এক-প্যাকেট ধূপও৷ বুঝতেই পারছিস, খরচ বেঁচে যায়৷’

গহন বিরক্ত হলেন—‘এই রাত দুটোর সময় ফের আজেবাজে কথা শুরু করেছিস!’

—‘কেন? রাত দুটোর সময় তুই জন্মাতে পারিস, আর আমি মরার কথা ভাবতে পারি না?’ সে বলে—‘এমনিতেও আমাদের মরাটা কোনো ইস্যু নয়৷ চোখ বুজলে চশমার দোকানের কাস্টমারগুলো হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে৷ বড়োজোর মদের দোকানের মালিকগুলো একফোঁটা-দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলতে পারে৷ একটা ভালো খদ্দের কমে গেল কিনা৷’

—‘আমাকে বাদ দিয়ে গেলি!’

—‘তুই!’ শুঁটকি হা হা করে হেসে ওঠে—‘শালা, তোকে আমি চিনি না! তুই মহা হারামি মাল! আমি মলে একটুও কাঁদবি না৷ বরং খাতাপেন নিয়ে কবিতা লিখতে বসবি৷’

গহন ব্যথিত কণ্ঠে বললেন—‘এতদিনে তুই আমায় এই চিনলি!’

—‘খামোখা সেন্টু দিস না খুড়ো৷ তোকে আমি ঠিক চিনেছি৷ এখন আর জ্বালাস না৷ রুমার সঙ্গে কথা বলছি৷ তোর জন্য প্রেমটা চটকে গেল শালা!’

গহন চুপ করে গেলেন৷ কিছুক্ষণ নীরব থেকে আস্তে আস্তে বললেন—‘ঠিক আছে৷ তোরা কথা বল৷ আমি রাখছি৷’

লাইনটা কেটে দিয়ে ফোনটাকে সুইচ অফ করে দেয় শুঁটকি৷ রুমার সঙ্গে কথা বলার সময় কেউ তাকে জ্বালাতন করুক তা চায় না৷ এই সময়টুকু তার একান্ত নিজস্ব৷ শুধু তার আর রুমার! মাঝখানে আর কাউকে সে বরদাস্ত করবে না৷

শুঁটকি ফোনটাকে পকেটে পুরে রুমার কাছে ফিরে এল৷ গাঢ় স্বরে বলল—‘গহন আবার কবিতা লিখতে শুরু করেছে জানো? মালটার একটু ঝাড় খাওয়ার দরকার ছিল৷ এতদিন স্রেফ ফাঁকি দিয়ে ‘আম গাছ-জাম গাছ’ লিখে পাতা ভরিয়েছে৷ উদমা খিস্তি খাওয়ার পর এবার সত্যিকারের কবিতা আবার ওর হাত থেকে বেরোবে৷’ তার মুখে একটা স্মিত হাসি ভেসে ওঠে—‘আমিও অবশ্য লুকিয়ে-চুরিয়ে একটু-আধটু কবিতা লিখছি৷ সব কবিতাই তোমাকে নিয়ে৷ পাবলিশারের সঙ্গে কথাও বলেছি৷ চার ফর্মা, মানে চৌষট্টি পৃষ্ঠার বই না হলে সেটা বই বলে ধরাই হয় না৷ এখনও পর্যন্ত চল্লিশটা কবিতা লিখেছি৷ পাবলিশার বলেছে ছাপান্ন থেকে আটান্নটা কবিতা চাই৷ আর ষোলোটা৷ আমারও বই বেরোবে রুমা৷ আমিও কবি হয়ে যাব৷ শুঁটকি কবি হবে!’ কথাটা বলেই হা হা করে হেসে ফেলল সে৷ যেন খুব বড়ো একটা রসিকতা করেছে! হাসতে হাসতেই চোখে জল এসে গেছে৷ দু-হাতে চোখের জল মুছে বলল—‘আজও একটা লিখেছি৷ শুনবে?’

ওপারের জমাট নিস্তব্ধতা থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া এল না৷ তবু শুঁটকি মহা উৎসাহে আবৃত্তি করতে শুরু করল—

পুড়ব বলেই কাব্য লিখি সহজ মন,
তরাই ঘুরে, আদর করে আসল জল৷
তিস্তানদীর বুকের ভাষায় মাদল শোন
যে কথাটা বলবি ভাবিস, আজকে বল৷
 ভিড় পড়েছে জংশনে আর চৌমাথায়
কে জানে কোথায় যাচ্ছি ভেসে কে জানে!
 হিজবিজিয়ে ছন্দ ওঠে আজ মাথায়,
দেয়াললিখন কালের কাছে হার মানে৷
কলকাতাতে ট্রাফিক—আলোর রূপকথা৷
ফুটপাথে ঐ স্বপ্নপোড়ার জ্বলছে ঘুম!
গাত্রদাহ আজ শহরের চুপকথা
তাই বেপাড়ার নষ্ট মেয়ের সাজের ধুম
দিব্যি দিলেও তিস্তাপারে ডুবব না,
ভেসে বাঁচার, বেঁচে ভাসার মন্ত্র চাই৷
গীতার বাণী আর কিছুতেই শুনবো না৷
প্রেম বলে তাই কাম শরীরে আজ জাগাই!
তবুও কেন তিস্তাপারে রঙিন ফুল
ফুটছে মনে, স্বপ্নকোণে আজ বদল!
যে কথাটা বন্দি, ঠোঁটে তোর আঙুল,
চুপ করে সেই গোপন কথাই আজকে বল৷

শুঁটকির আবৃত্তি শেষ হল৷ আবার পিন পতনের স্তব্ধতা ফিরে ফিরে এসেছে৷ বেসামাল হাওয়ায় ঘরের সাদা পর্দাটা হু হু করে উড়ছিল৷ একটা টিকটিকি কোথা থেকে যেন মৃদু আওয়াজ দিয়ে ওঠে—‘ঠিক…ঠিক…ঠিক…৷’

—‘তোমার দিঘার রাতটার কথা মনে আছে রুমা?’ সে আপনমনেই বলে—‘তখন পূর্ণিমা ছিল৷ চাঁদের আলোয় সমুদ্রের সাদা ফণা চিকচিক করছিল৷ ভরা কোটালের জল ফুলে ফুলে উঠছিল৷ বড়ো বড়ো ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছিল তোমার পায়ের কাছে৷ চোখে-মুখে নোনতা জলের ছিটে…’ তার চোখ স্বপ্নিল৷ যেন সেই মুহূর্তটা আবার এসে দাঁড়িয়েছে চোখের সামনে৷ সমুদ্রের নোনা গন্ধ, উত্তাল হাওয়া সবই যেন তার অনুভবে ধরা দেয়—চ ‘তোমার কোলে ছ-মাসের বুবাই৷ চাঁদের আলোয় দুধসাদা শাড়ি হিমজুঁইয়ের মতো ঝলমল করছিল৷ হাওয়ায় এলোমেলোভাবে তোমার চুল উড়ছিল৷ শাড়ির আঁচল উড়ছিল৷ তুমি জানো না, সমুদ্রের সামনে দাঁড়ালে তোমাকে ভেনাসের মতো দেখায়৷ আমি বলেছিলাম—‘চলো সমুদ্রে নামি৷’ তুমি ভয় পেয়েছিলে৷ ভেনাসের সমুদ্রকে ভয় কী! জোর করে হাত ধরে টেনে জলে নামালাম৷ তোমার শাড়ি ভিজে গেল৷ ভয়ও খানিকটা কাটল৷ খুব মজা পেয়েছিলে৷ বুবাইকে শক্ত করে ধরে এক পা এক পা করে কোমর জলে নামলে৷ সমুদ্র কোমর ছুঁয়ে, শাড়ি ছুঁয়ে কলকল—ছলছল করে বয়ে যাচ্ছিল৷ আর আমি গান ধরেছিলাম৷ কোন গানটা বলো তো?’

শুঁটকি উদাত্ত গলায় গান গেয়ে ওঠে৷ ফ্ল্যাটের ঘরটায় অনুরণিত হতে লাগল তার কণ্ঠস্বর৷ চোখ বুজে, গলার শিরা ফুলিয়ে একমনে গেয়ে যাচ্ছে সে—‘সাগরসঙ্গমে সাঁতার কেটেছি কত, কখনও তো হই নাই ক্লান্ত/তথাপি মনে মোর প্রশান্ত সাগরে ঊর্মিমালা অশান্ত…৷’

একই লাইন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে গাইছিল শুঁটকি৷ তার গলায় বিশেষ সুর নেই৷ কথাও জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে৷ তা সত্ত্বেও কী অদ্ভুত জেদে, জোর করে গেয়ে যাচ্ছিল৷ কথাগুলো আস্তে আস্তে বিকৃত হয়ে আসে৷ গলাও কী যেন অজ্ঞাত কারণে ধরে এসেছে৷ ভেঙে যাচ্ছে বারবার, তবু বারবার ফিরে ফিরে গাইছিল— ‘তথাপি মনে মোর প্রশান্ত সাগরে ঊর্মিমালা অশান্ত/সাগরসঙ্গমে…৷’

আস্তে আস্তে গান সুরহীন হয়ে এল৷ একসময় হারিয়ে গেল কথাগুলোও৷ হা হা করে কেঁদে উঠল শুঁটকি৷ প্রবল আবেগে চেয়ারের পায়ের কাছে বসে পড়েছে সে৷ ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতে হাহাকার করে বলল—‘আমায় ক্ষমা করো রুমা…আমি জানতাম না, হঠাৎ একটা বিরাট ঢেউ বেসামাল হয়ে আচমকা এসে আছড়ে পড়বে…জানতাম না, যে বোল্ডারগুলো অত শক্ত! তোমার, বুবাইয়ের যে অত ব্যথা লাগবে আমি জানতাম না…জানতাম না…৷’

হাস্নুহানার গন্ধ মাখা একঝলক হাওয়া হুহু করে তাকে ছুঁয়ে যায়৷ রকিং চেয়ারটা দুলে উঠল কয়েক মুহূর্তের জন্য৷

.