আরও দাও প্রাণ – ২

ঝুলস্য ঝুল!

গহন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না৷ তাঁর কবিতাকে ‘ঝুলস্য ঝুল’ বলেছে কেউ! গহন দত্তগুপ্ত-র কবিতাকে….৷

হঠাৎ করে রক্তচাপ বেড়ে গেল৷ মাথাটা দপ করে গরম হয়ে গেছে৷ এ যাবৎ জীবন অনেক কঠিন সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন৷ অনেক কঠোর বাক্যবাণ সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে৷ কিন্তু তাঁর কাব্যপ্রতিভাকে কেউ এভাবে নস্যাৎ করে দেয়নি৷ অথচ কোথাকার কে এই ‘রামহনু’ ছদ্মনামধারী ব্যক্তি, একেবারে সপাটে বলে দিল—‘কবিতা না অ্যাটম বোমা ঠিক বুঝলাম না৷ উড়ে যাক…উড়ে যাক…বলতে বলতে শেষ পর্যন্ত মাথার ওপর দিয়ে উড়েই গেল৷ উড়িয়েও দিল৷ এসব কী বিটকেল ফ্যান্টাসি৷ ঝুলস্য ঝুল৷’

অক্ষরগুলো যেন তাঁর চোখে লংকার গুঁড়ো ছিটিয়ে দিয়েছে৷ সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না এমন দুর্নাম তাঁর অতিবড়ো শত্রুও দেবে না৷ কিন্তু এই ভাষায় সমালোচনা রীতিমতো অপমানজনক! একজন প্রবীণ, প্রতিষ্ঠিত কবির পক্ষে হজম করা কঠিন৷ এর চেয়েও অপমানজনক পরের কমেন্টটা৷ জনৈক ‘কুবলাশ্ব’ লিখেছে—‘দাদা, এমন কবিতা লেখার চেয়ে তেলেভাজা খেয়ে অ্যাসিড বাঁধিয়ে বসে থাকুন না! তাতে অন্তত আমরা রক্ষা পাই৷’

গহন উইন্ডোটা ক্লোজ করে রীতিমতো সশব্দেই মাউসটাকে সরিয়ে রেখেছেন৷ বজ্রাহতের মতো চেয়ারেই বসে থাকলেন কিছুক্ষণ৷ কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না৷ ইচ্ছে করছিল শোকেসে সাজানো স্মারকগুলোকে ডাস্টবিনে ফেলে দিতে৷ যত বই আজ পর্যন্ত লিখেছেন সব আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে পারলেই হয়তো স্বস্তি পান তিনি৷

আরও কতক্ষণ ওভাবেই বসে থাকতেন কে জানে৷ কিন্তু পিছন থেকে সুললিত কণ্ঠে ডাক এল—‘কবিবর’…..৷

গহনের রাগ তখনও পড়েনি৷ বিষবাক্যের জ্বালায় তখনও চিড়বিড় করে জ্বলছিলেন৷ জ্বলন্ত দৃষ্টিতে কণার দিকে তাকালেন৷

—‘এ কী!’ কণার মায়াবী চোখদুটোয় চাপা কৌতুক—‘এখনও বসন্তকাল আসেনি৷ আমিও তপোভঙ্গ করতে আসেনি৷ তাহলে এই তেজোদীপ্ত অগ্নিদৃষ্টির কারণ?’

মৃদু অথচ রাগতস্বরে বললেন তিনি—‘ওই নামে আমায় ডাকবে না৷’

—‘কেন?’ কণার শীর্ণমুখ হাসিতে ঝলমল করে ওঠে—‘তুমি কবিও বটে৷ এবং আমার বরও নিঃসন্দেহে৷ তাহলে ‘কবিবর’ শব্দটা কি দোষ করেছে?’

একটু থেমে আবার দুষ্টু দুষ্টু হেসে যোগ করলেন—‘নাকি একা আমারই বর কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে!’

—‘সে বিষয়ে সন্দেহ নেই৷’ গহনের মেজাজও খানিকটা ঠান্ডা হয়ে আসে৷ অপেক্ষাকৃত শান্তস্বরে বলেন—‘তবে কবি কিনা তাতে সন্দেহ আছে৷’

—‘যাক, তবে তোমার ওপর আমার অনন্ত মৌরসি৷’ তিনি কণ্ঠস্বরে ছদ্ম অভিমান মাখিয়েছেন—‘তাহলে এই অসময়ে বিছানা ছেড়ে তোমায় কষ্ট করে ডাকতে এলাম কেন, সে কথা জানতে চাইছ না যে!’

এতক্ষণে খেয়াল হল তাঁর৷ এখন কণার বিশ্রামের সময়৷ খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে ঘণ্টাখানেকের জন্য একটু গড়িয়ে নেন তিনি৷ খুব প্রয়োজন না পড়লে বিছানা ছেড়ে এ সময়ে সচরাচর ওঠেন না৷ অথচ আজ নিয়মভঙ্গ হয়েছে৷

গহনের চোখে সপ্রশ্ন কৌতূহল৷ কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই কণা জবাব দিয়ে দিলেন—‘ঘুঁটু এসেছে৷ তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়৷ অসিতদা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন৷’

শেষ বাক্যটা বলার সময় তাঁর মুখে আন্তরিক উদবেগের ছাপ পড়ল৷ গহন তাঁর দিকে অপলকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন৷ তারপর চিন্তিত, মন্থর স্বরে বললেন—‘তুমি যাও, আমি দু-মিনিটের মধ্যেই আসছি৷’

কণা আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেন৷ গহন চেয়ারে বসে কী যেন চিন্তা করছেন৷ অসিতদার কথা মনে পড়তেই চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে৷ বুকে স্মৃতির উঁকিঝুঁকি৷ অসিতদা, তথা অসিতবরণ চৌধুরী একসময়ে তাঁদের হিরো ছিলেন৷ চেহারাটা এখনও স্পষ্ট মনে আছে৷ তপ্ত কাঞ্চনবর্ণ বলতে যা বোঝায় তাঁর গায়ের রংটা ঠিক তাই৷ লম্বা একহারা চেহারা৷ সাদা ধবধবে পাটভাঙা ধুতি-পাঞ্জাবি, ব্যাকব্রাশ করে আঁচড়ানো চুল, ক্লিন শেভ করা নীলচে গাল, সবসময়ই পান খেয়ে ঠোঁট দুটো লাল করে বসে থাকতেন৷ শিরায় জমিদারি রক্ত ছিল৷ তার ওপর কট্টর কমিউনিস্ট৷ অসম্ভব আদর্শবাদী তাই হয়তো চিরকালই অদ্ভুত, খামখেয়ালি সাহিত্যের ওপর প্রতিষ্ঠানের প্রভাব মানতেই চাইতেন না৷ রীতিমতো ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা করে বসেছিলেন, যে বড়ো বড়ো নামকরা পত্রিকায় কিছুতেই লিখবেন না৷ এ প্রসঙ্গে অনুযোগ করলেই বলতেন—‘কেন, ওরা ছাড়া দেশে কোনো পত্রিকা নেই নাকি? আমি বুর্জোয়াদের জন্য কবিতা লিখি না৷ সাহিত্য করলেই কয়েকটা মুষ্টিমেয় প্রতিষ্ঠানের বশ্যতা স্বীকার করতে হবে? অসম্ভব! পারব না….৷’

গহন দীর্ঘশ্বাস ফেলেন৷ তেজ আর জেদ—দুটোই ছিল অসিতদার৷ নিজের সর্বস্ব দিয়ে জন্ম দিলেন এক নতুন পত্রিকার৷ জন্ম নিল ‘নকশীকথা’৷ সমস্ত তরুণ উদীয়মান কবি সেখানে লিখতে শুরু করল৷ তাদের মধ্যে গহন ছিলেন অন্যতম৷ অসিতদা তাঁকে একটু বেশিই ভালোবাসতেন৷ বলতেন, ‘আমার অর্জুন’৷ বেশি ভালোবাসতেন বলেই বোধহয় বেশি ঘৃণাও করতে পেরেছিলেন৷ পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড়ো সাহিত্য পত্রিকা—‘স্বদেশে’-র শারদীয়া সংখ্যায় যখন গহনের দীর্ঘ কবিতা ছাপা হল তখন অসিতদার ফরসা মুখ রাগে লাল হয়ে গিয়েছিল৷ প্রচণ্ড রাগে চিৎকার করতে করতে বলেছিলেন—‘শেষ পর্যন্ত তুইও প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছিস! তোর মধ্যে লোভ আছে! লোভী! বিশ্বাসঘাতক! বেরিয়ে যা…এই মুহূর্তে বেরিয়ে যা৷ তোর মুখ আর কোনোদিন দেখতে চাই না৷ বেরিয়ে যা…৷’ তাঁর তর্জনী নিষ্ঠুরভাবে দেখিয়ে দিয়েছিল দরজাটা৷ মাথা নীচু করে সেই দরজা দিয়েই বেরিয়ে এসেছিলেন গহন৷

‘নকশীকথা’র দরজা তাঁর জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল৷ অসিতদার ওপর নিবিড় অভিমানে তাঁকে আর কোনোদিন মুখ দেখাননি তিনি৷ অথচ এই অসিতদাই গহনের বিয়ের সময় বাবার জায়গা নিয়েছিলেন৷ কণাকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন—‘কবির বউ হয়েছ মা, স্বামীর ভালোবাসা ছাড়া আর সবকিছুই ঘরে বাড়ন্ত থাকবে৷ শাঁখা, সিঁদুর আর জলজ্যান্ত পতিদেব ছাড়া অন্য কোনো অলংকার পাওয়ার সম্ভাবনাও কম৷ কষ্ট করতে পারবে তো?’

ভাবতেই বুক খাঁ খাঁ করে উঠল৷ সেই মানুষই কী নির্মমভাবে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁকে৷ ‘নকশীকথায়’ আর ফিরে যাননি গহন৷ কিন্তু খবর রেখেছিলেন৷ প্রায় দশ বছর ধরে উদয়াস্ত খেটে, ম্যাগাজিনটাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন অসিতদা৷ তারপর আচমকাই ‘নকশীকথা’ থেকে সরে দাঁড়ালেন৷ প্রথম প্রথম ছোটোখাটো কয়েকটা লিটল ম্যাগাজিনে তাঁর কবিতা নিয়মিত ভাবেই ছাপা হত৷ তারপর আস্তে আস্তে কবে যে বিস্মৃতির আড়ালে চাপা পড়ে গেলেন তার খবর আর কেউ রাখে না৷

চোখে বাষ্প জমে এসেছিল৷ আলগোছে চোখ মুছে নিলেন৷ তারপর উঠে গেলেন বসার ঘরের দিকে৷ ঘুঁটু ওরফে অধীর তরফদার তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে বসেছিল৷ নকশীকথার আমল থেকেই দুজনের আলাপ৷ দুজনেই প্রথমে অসিতদার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে চলতে শুরু করেছিল৷ ঘুঁটু ডাকনামটা অসিতদারই দেওয়া৷ গহনকে তাড়িয়েছিলেন অসিতদা৷ আর ঘুঁটু নিজেই সরে গিয়েছিল৷

বর্তমানে সে একটা বিরাট সাহিত্য প্রতিষ্ঠানের সম্পাদকীয় বিভাগে চাকরি করে৷ কবিতা বিভাগটা দেখে৷ মোটা টাকা মাইনে পায়৷ সেই গ্রামের গোবেচারা ঘুঁটুকে এখন আর চেনাই যায় না! এখন সে দস্তুরমতো সম্মানীয় শ্রীযুক্ত অধীর তরফদার৷

ঘুঁটু এই ক-বছরে বহরে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে৷ অতিরিক্ত মেদবাহুল্য আর উত্তেজনার যুগপৎ আক্রমণে সে ঘামছিল৷ গহনকে দেখে রুমালে মুখ মুছতে মুছতে হাঁসফাঁস করে বলল—‘শুনেছিস?’

গহন শান্তভাবেই তার মুখোমুখি চেয়ারটাতে বসে পড়েন—‘কী হয়েছে?’

—‘সেরিব্রাল’, ঘুঁটুর ডাবল চিন নড়ে ওঠে—‘গত বৃহস্পতিবার রাত্রে বাথরুমে যেতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন৷ সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালে আই.সি.ইউ-তে অ্যাডমিট করতে হয়েছিল৷ শরীরের ডানদিকটা একদম পড়ে গেছে বুঝলি! তবে ডাক্তাররা বলেছে প্যারালিসিস হওয়া একদিক দিয়ে ভালোই৷ প্রাণের আশঙ্কা নেই৷ এখন অবশ্য জেনারেল বেডে দিয়েছে…৷’

ঘুঁটু আরও কত কি বকবক করে বলে গেল কে জানে৷ গহন কিছুই শুনেছিলেন না৷ তিনি ভাবছিলেন অসিতদার ডানহাতটা অসাড় হয়ে গেছে৷ আর কবিতা লেখা হবে না তাঁর৷

—‘দাজি কাল তোর কথা খুব বলছিলেন৷’ সে একটু কুণ্ঠিত স্বরে বলে—‘একবার দেখতে যাবি?’

তার কথা শুনে ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে গেলেন গহন৷ এতদিন বাদে অসিতদার মুখোমুখি হতে পারবেন কি! যে পথ দিয়ে তিনি হেঁটে গিয়েছিলেন, গহন সে পথে কোথায়? আজ তিনি অসিতদার চেয়ে অনেক উঁচুতে উঠে গেছেন৷ সে উচ্চতা থেকে মানুষটাকে দেখাও যায় না৷

অথচ সেই মানুষটার মুখোমুখি দাঁড়াতে ভয় পাচ্ছেন আজকের প্রতিষ্ঠিত কবি! এ কি ভয়, না লজ্জা! আদর্শচ্যুত হওয়ার লজ্জা কি প্রতিষ্ঠার চেয়েও বড়ো!

—‘দ্যাখ’, ঘুঁটু তাঁর কাঁধে হাত রেখেছে—‘আমিও জানি দাজি তোর সঙ্গে অন্যায় করেছেন৷ একটা সামান্য ব্যাপারে তোকে অপমান করেছিলেন৷ কিন্তু এখন ওসব মনে রাখার সময় নয়…৷’

সত্যিই কি অসিতদা অন্যায় করেছিলেন! ন্যায়-অন্যায়, মান-অপমান মনে পুষে রাখার লোক নন গহন৷ তবু কোথায় যেন একটা কুণ্ঠা, একটা আত্মগ্লানি তাঁকে চেপে ধরে৷

তাঁর আত্মনিমগ্ন চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে যেন হতাশ হয়ে পড়ল ঘুঁটু৷ কাতরস্বরে বলে—‘একবার যাবি না গহন?’

বুকের ভেতরে কুচ করে কী যেন একটা বিঁধল৷ একটা সূক্ষ্ম অথচ তীক্ষ্ণ ব্যথা টের পেলেন৷ ঘুঁটুর দিকে তাকাতে গিয়েই চোখ পড়ল আয়নায়৷ দামি কাচে কণার প্রতিচ্ছবি৷ দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছেন তিনি৷ দু-চোখে জলভরা মেঘ নিয়ে তাকিয়ে আছেন স্বামীর দিকেই৷ যেন জানতে চাইছেন, ‘আর কত পালাবে?’

গহন একমুহূর্তের জন্য চোখ বুজলেন৷ জোরালো একটা শ্বাস টেনে বললেন—‘চল৷’

‘এখন চারদিকটা কেমন যেন কালো কালো ঠেকে!
যেদিকেই হাতড়াই, খালি অশরীরী ছায়া টেনে ধরে নির্বাক,
একটা কালো নদী খোলস পালটেছে—
কালোকে মাঝেমধ্যে লাল দেখি৷
নদীটা হাত ফসকে মিলিয়ে গিয়েছিল
ডালিম গাছের পাতার ফাঁকে—পাখির ঠোঁটে টুপ করে
ঝরে পড়ে দুটো—একটা দানা চুনি চুনি৷
এখন চতুর্দিকে শুধু ভাঙাভাঙির শব্দ,
কাচ ভাঙছে৷ তার পিছনে ঝাপসা ঝাপসা মুখ
বেঁকেচুরে ভেঙে যাচ্ছে৷ প্লেট টেকটনিক
তত্ত্বই আসলে সত্যি৷ আমাদের পায়ের তলায়,
মাটি ভেঙে টুকরো টুকরো প্লেট হয়ে যায়৷
তারপর ধাক্কাধাক্কি ভাঙাভাঙি৷
ভেঙে যায়…ভেঙে যায়
ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে৷
তারপরও আমাদের বুড়ো বটগাছটা
কালো ভূতের মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে৷
শিমশিম করে দুলে ওঠে প্রাচীন শিরা৷
ব্রহ্মদত্যির ভয় দেখাতে চাওয়া
লাল-লাল চোখ নিরস্ত হয়ে মিশে যায়
মাটিতে৷ গভীর শিকড়ে গুঁড়ো গুঁড়ো ঘামের মতো মাটি আঁকড়ে,
গ্রাম আঁকড়ে, দেশ আঁকড়ে, বিশ্ব আঁকড়ে
দাঁড়িয়ে থাকা চারকোল ছবি দেখতে চাই৷
অন্ধকার কি নেমেছে বসুন্ধরা?’

হাসপাতালের বেডে একটা কঙ্কাল শুয়েছিল৷

অসিতদা নয়, অসিতদার কঙ্কাল৷ অত লম্বা মানুষটা যেন কুঁকড়ে ছোটো হয়ে গেছেন৷ এখন দেখলে আর কেউ বলবে না, যে-কোনোদিন তাঁর নায়কের মতো চেহারাও ছিল৷ কোথায় সেই পুরুষালি সৌন্দর্য! তার বদলে যেন কেউ একটা প্রাচীন ঐতিহাসিক ফসিলকে শুইয়ে রেখেছে৷ ডান হাতটা নিঃসাড় হয়ে আছে বুক ঘেঁষে৷ মুখের একদিক বেঁকে গেছে৷ বাঁ হাতটা বেডের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা! অক্সিজেনের নল, স্যালাইনের বোতল, ক্যাথিটার,—আরও কত উপসর্গ ছুঁচ ফুটিয়ে রয়েছে গোটা শরীরে!

গহন স্তম্ভিতের মতো একদৃষ্টে তাকিয়েছিলেন অসিতদার মুখের দিকে৷ সদাব্যস্ত নার্স এদিক-ওদিক ঘুরে তদারকি করছিল৷ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন— ‘ওঁর হাত বেঁধে রেখেছেন কেন?’

নার্স বিরক্ত হয়ে উত্তর দেয়—‘কী করব? সুযোগ পেলেই অক্সিজেন, স্যালাইন, চ্যানেলগুলো ধরে টেনে খুলে ফেলার চেষ্টা করছেন৷ তাই বাধ্য হয়েই হাত বেঁধে রেখেছি৷’

অসিতদার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল৷ শব্দগুলো স্পষ্ট নয়—ক্রমাগতই জড়িয়ে যাচ্ছে—তার মধ্যেই কোনোমতে বললেন—‘গহন, আমি শিউলির গন্ধ নিতে চাই৷ এখানে শুধু মেডিসিনের উৎকট গন্ধ!’

শিউলি! এই গরমের মরশুমে শিউলি কোথায়! গহনের স্পষ্ট মনে পড়ে, অসিতদার বাড়ির সামনে একটা শিউলি গাছ ছিল৷ শরৎকাল এলেই বাড়ির সামনের পথ, উঠোন অবধি সাদা হয়ে থাকত৷ রোজ ভোরে অসিতদা ফুল কুড়িয়ে নিয়ে একটা বাটির মধ্যে জলে ভিজিয়ে রাখতেন৷ সেই মিষ্টি গন্ধটা আজও যেন টের পান তিনি৷ গলার কাছে অদ্ভুত ব্যথাবোধ জমাট বেঁধেছিল৷ অসিতদার দিকে চোখ তুলে তাকাতেও পারছিলেন না৷ অপরাধবোধ তাঁকে একটু একটু করে গ্রাস করছিল৷

—‘আমি আপনাকে শিউলি ফুল এনে দেব দাজি৷’

শীর্ণ মুখটায় শিথিল হাসি ফুটল৷ একটু চুপ করে থেকে যেন দম নিয়ে নিলেন৷ তারপর ফের অস্পষ্ট জড়ানো কণ্ঠস্বরে বলেন—‘তোর কাছে কাগজ- কলম আছে?’

গহনের কাছে সবসময়ই একটা রাইটিং প্যাড থাকে, তিনি ব্যাগ থেকে সেটাকে বের করে এনেছেন৷ নার্সটি তীক্ষ্ণচোখে গোটা ব্যাপারটাই দেখছিল৷ এবার খনখনে গলায় বলে—‘বেশি কথা বলবেন না৷ ডাক্তারবাবুর বারণ আছে৷’

অসিতদা হাসলেন৷ মুখটা বেঁকে যাওয়ায় হাসিটাও বাঁকা ঠেকল৷ গহন কাগজ-কলম নিয়ে তৈরি৷ অসিতদা চোখ বুজে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবেন৷ তারপর আস্তে আস্তে স্খলিত উচ্চারণে একের-পর-এক লাইন বলে গেলেন৷ গহন যেন বাধ্য ছাত্রের মতো ক্লাস নোট নিচ্ছেন৷ মাথা নীচু করে লিখে গেলেন, পঙক্তির পর পঙক্তি৷

—‘অন্ধকার কি নেমেছে বসুন্ধরা!’ শেষ লাইনটা অতিকষ্টে বলে চুপ করে গেলেন তিনি৷ পাঁজর-সর্বস্ব বুকটা হাপরের মতো উঠছে নামছে৷ মানুষটাকে ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল৷ শরীরটা হাসপাতালের ময়লা চাদরের সঙ্গে একবারে মিশে গেছে৷

গহন চুপ করে তাকিয়েছিলেন তাঁর দিকে৷ অসিতদা একসময়ে লিটল ম্যাগাজিনে দাপিয়ে বেড়াতেন৷ কবিতা-অন্ত-প্রাণ এই প্রচারবিমুখ কবি অনেক প্রতিষ্ঠিত নামী কবির চেয়েও ভালো লিখতেন৷ আত্মাভিমানী মানুষটার আজ আর কবিতা লেখার উপায় নেই! লিখতে চাইলেও অন্য কারুর শরণাপন্ন হতে হবে৷

—‘কবিতাটা তুই বড়ো ভালো লিখতিস গহন৷’ শ্বাস টানতে টানতে বললেন তিনি—‘তবে আমি তোর থেকেও ভালো লিখতাম৷’

সেই অহংকার! এ অহমিকা গহনের পরিচিত৷ তিনি অসিতদার চোখে এই প্রথম চোখ রেখেছেন৷ গর্তে ঢুকে যাওয়া চোখদুটোয় এক অমানুষিক দীপ্তি!

—‘কিন্তু তুই ঠিক রাস্তাটা ধরেছিলি৷ আই ওয়াজ রং!’

তিনি বিস্মিত হলেন! এ কী কথা বলছেন অসিতদা! এমন কথা কখনও তাঁর মুখ দিয়ে উচ্চারিত হবে তা দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি৷ নির্বাক, বিহ্বল দৃষ্টিতে দেখছেন তাঁকে৷

—‘অনেকক্ষণ কথা বলছেন দাজি৷ এবার একটু রেস্ট…৷’

—‘ভাবছিস বুড়োকে ভীমরতিতে ধরেছে!’ খুব কষ্ট করে বাঁকা হাসিটা হাসলেন অসিতদা৷ একটু দম নিয়ে ফের বলেন—‘সারাজীবন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে স্লোগান তুলে জেহাদ করে এলাম৷ প্রতিষ্ঠানের পোষা কবি বলে তোকে তাড়ালাম, নকশীকথার পিছনে সবকিছু ব্যয় করেছি আমি৷ অথচ…৷’

—‘দাজি, এখন ওসব কথা থাক…৷’

—‘নাঃ, বলতে দে৷’ হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন তিনি—‘কনফেশনের দরকার আছে৷ হয়তো সময় পাব না…৷’

কী বলবেন গহন! অসহায় দৃষ্টিতে শীর্ণকায় মানুষটির দিকে তাকিয়ে আছেন৷ সেরিব্রাল অ্যাটাকে আক্রান্ত রোগীর এত কথা বলা উচিত নয়৷ কিন্তু অসিতদাকে সে কথা কে বোঝাবে!

—‘নকশীকথা আমার সন্তানের মতো ছিল৷ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হাতিয়ার৷ ভেবেছিলাম খুব প্রতিবাদ করছি৷ বুর্জোয়াগুলোকে দেখিয়ে দেব সাহিত্যের ক্ষেত্রে গোষ্ঠীই শেষ কথা নয়৷ কিন্তু…৷’ রুগণ মানুষটার চোখদুটো জলে ভরে এসেছে—‘কয়েকবছর পরে বুঝলাম আসলে আমিও আর-একটা ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন তৈরি করেছি! প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যেতে গিয়ে নিজের অজান্তেই কখন যেন আর-একটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে ফেলেছি৷ আমারই হাতে তৈরি হয়েছে আরও একটা বুর্জোয়া গোষ্ঠী—সেই লবি-অ্যান্টিলবির ঘৃণিত গল্প! যা আন্তরিক ভাবে চিরকাল ঘৃণা করে এসেছি—আমিও সেই গোষ্ঠীবাদেরই জনক৷’

গহন নির্বাক শ্রোতা৷ এত যন্ত্রণা অসিতদার মধ্যে ছিল! যে লোকটা কোনোদিন কোনো পরিস্থিতিতেই হার মানেনি, আজ সে কী বলছে! তার একান্ত পরাজয়ের গ্লানিময় ইতিহাস এতদিন নৈঃশব্দ্যের পিছনেই লুকিয়ে ছিল৷ আজ বুকফাটা হাহাকার হয়ে বেরিয়ে এসেছে৷

—‘আজ তুই কোথায়, আর আমি…৷’ অসিতদা যেন ভেতরে ভেতরে কাঁদছেন—‘আমাকে কেউ চিনল না গহন…কেউ জানল না আমার কথা…আমি হারিয়ে গেলাম…হারিয়েই গেলাম…৷’

অসিতদার দিকে তাকিয়ে হঠাৎই পিতামহ ভীষ্মের কথা মনে পড়ে গেল গহনের৷ নিজেরই প্রতিজ্ঞার ফাঁদে জড়িয়ে পড়া পৌরাণিক বীরটিও কি গোপনে গোপনে এমনই কেঁদেছিলেন? অন্তিম মুহূর্তে তাঁর মনেও কি আপসোস কামড় বসায়নি?

বাদবাকি সময়টা নীরবেই কাটল৷ অসিতদা অবসন্নের মতো বিছানায় পড়ে রইলেন৷ এরপর আর একটা কথাও বলেননি৷ গহনও ভারাক্রান্ত মনে, সজল চোখে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন৷ অপরাধবোধটা দ্বিগুণ বেড়েছে৷ সবচেয়ে বিড়ম্বনা, এ বেদনার কোনো নিদান নেই৷ সান্ত্বনা, ভরসা, স্তোকবাক্য—কোনোটাতেই এ যন্ত্রণা কমানো সম্ভব নয়৷

ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হতেই তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন করিডোরে৷ একরকম পালিয়েই এলেন৷ তাঁর দেহও যেন অবসন্ন হয়ে আসছে৷ কোনোমতে সামনের একটা কাঠের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়েন৷ মনে কোনো অনুভূতিই আর দাগ কাটছে না৷ দুঃখ, কষ্ট, রাগ, অভিমান—কিছুই না! শুধু খাঁ খাঁ শূন্যতা৷

ঘুঁটু এতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলছিল৷ এবার গহনকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসে৷ তার কণ্ঠস্বরে নিশ্চিন্ততার প্রলেপ৷

—‘দাজি এখন আউট অফ ডেঞ্জার৷ ডাক্তাররা বলছে—আপাতত কয়েকটা দিন খুব সাবধানে…৷’ বলতে বলতেই থেমে গেল সে৷ গহনের ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে আশঙ্কিত গলায় বলল—‘গহন! কী হয়েছে!’

গহন তখন ভাবছিলেন, অসিতদাও ইচ্ছামৃত্যুর বর পেলেন না কেন!

.

‘আমরা কেউ মাস্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল৷
 অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায়নি৷
 সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!
 ক্ষান্ত বর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর,
 জাম আর জামরুলের পাতায়৷
 যা নাকি অল্প-একটু হাসির মতন লেগে থাকে৷’

—‘অমলদা…৷’

শুঁটকি আপনমনেই এককোণে বসে মদের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিল৷ এমনিতে সে বারে আসতে চায় না৷ কিন্তু আজ দায়ে পড়ে আসতে হয়েছে৷ জিনিসটা স্টকে রাখতে ভুলে গিয়েছিল সে৷ আজকাল প্রায়ই গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা মনে থাকছে না৷ কে জানে অ্যালঝাইমার হল কিনা!

অ্যালঝাইমারকে ভয় পায় না শুঁটকি৷ বরং যে মানুষ সবকিছু ভুলে যেতে পারে তার চেয়ে সুখী আর কেউ নেই৷ স্মৃতি মানেই শুধু মৃত্যু, বেদনা, আঘাত! আজ পর্যন্ত স্মৃতির অন্য মানে জানতে পারল না সে!

শুধু একটাই দুঃখ৷ অ্যালঝাইমার হলে রুমার জন্য কবি হওয়ার স্বপ্নটাও ভুলে যাবে৷ সারাজীবন ধরে ওই একটা স্বপ্নই তো দেখছে৷ একদিন সে-ও কবি হবে৷ অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি৷ কিন্তু শুঁটকি কবি হয়েই ছাড়বে৷

—‘ও অমলদা৷’

পিছনের ডাকটা এবার জোরালো হয়েছে৷ শুঁটকির হঠাৎ মনে পড়ে গেল যে তার পিতৃপ্রদত্ত নামটাও অমলকান্তি৷ শীর্ণ, কাঁকলাসের মতো চেহারার জন্য শুঁটকি নামটা এমনই বহুল প্রচলিত, যে নিজের খানদানি নামটাই ভুলে গিয়েছিল৷ আজ মনে পড়তেই বেদম হাসি পেয়ে গেল তার৷ জীবনে ব্যর্থ হওয়ার জন্য বেছে বেছে এই নামটাই রাখতে হয়েছিল বাবা-মাকে!

—‘কোন শালা রে?’

ঘাড় ঘুড়িয়ে পিছনের লোকটাকে দেখার চেষ্টা করে শুঁটকি৷ লোকটা এবার তার মুখোমুখি চেয়ারটাতে এসে বসেছে৷

—‘খামোখা মুখ খারাপ করছ কেন? আমি স্বর্ণাভ৷’

বিরক্তিতে নিজের অজান্তেই মুখ বিকৃত হয়ে আসে তার—‘তুই এখানে কি করছিস? এখনও নোবেল দেওয়ার জন্য তোকে ডাকেনি?’

স্বর্ণাভ গুপ্ত এখনকার উঠতি তরুণ কবিদের অন্যতম৷ কী যে মাথামুন্ডু কবিতা লেখে তা শুধু ও-ই জানে৷ অথচ হাম্বাগ দি গ্রেট৷ কথায় কথায় বোদলেয়ঁ, চমস্কি, এলিয়ট ভ্যালেরি আওড়ায়৷ বাংলা কবিতার নাম শুনলেই নাক সিঁটকানো এদের স্বভাব৷ শুঁটকির ভীষণ বিরক্ত লাগে৷ যদি এত বড়ো সাহেবই হয়েছিস তো চানা-মটর চিবিয়ে ফরাসি বা ইংরেজিতে কবিতা লিখিস না কেন? কলম ধরলেই তো সেই ‘দীনা হীনা পিঁচুটি নয়না’ বঙ্গভাষার কথাই মনে পড়ে! যতসব হারামজাদার দল!

শুঁটকির বক্রোক্তিকে পাত্তা না দিয়েই স্বর্ণাভ বলে—‘তুমি এখানে যে! এ পাড়ায় তো তোমাকে দেখাই যায় না৷ ভুল করে চলে এসেছ বুঝি?’

—‘ঠিকই বলেছিস৷’ সে উঠে দাঁড়ায়—‘সত্যিই খুব ভুল হয়ে গেছে৷ চলি৷’

—‘আরে…৷’ স্বর্ণাভ তার হাত টেনে ধরেছে—‘এখনই কোথায় যাচ্ছ? সবে তো কলির সন্ধে৷ বোসো, আরও পাঁচ-ছ পেগ মেরে যাও৷ আমার ট্রিট৷’

—‘পাঁচ-ছ পেগ!’ শুঁটকি হেসে ফেলল—‘ধুস, ওতে কি হবে? পাঁচ-ছ পেগে আমার ব্রেকফাস্টও কমপ্লিট হয় না!’

—‘ঠিক আছে, যত খেতে চাও, খাও৷’ সে হাসছে—‘বিল আমি দেব৷’

শুঁটকি ভুরু কুঁচকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকে দেখে—‘কেসটা কী বল তো! কখনও তো একটা বরফের গোলাও খাওয়াসনি! আজ একেবারে মাল! সত্যি সত্যিই নোবেল পেয়েছিস নাকি!’

স্বর্ণাভ কোলগেট হাসি হাসল—‘নোবেল পাইনি বটে, তবে বেলতলায় যাচ্ছি, আই মিন, ছাঁদনাতলায় দাঁড়াচ্ছি’৷

সে সরুচোখ করে ছেলেটাকে দেখছে৷ জগতে এমন মেয়েও আছে যে এই ফ্রেঞ্চলিশ গাধাটাকে বিয়ে করবে! এমনিতেই তো আঁতেলের শিরোমণি৷ তার ওপর চেহারারও কী বাহার! মেয়েদের মতো পনিটেল রেখেছে৷ মুখ ভরতি উলুবনে চোখ-নাক সবই ঢেকে গেছে৷ তার ওপর যা দশাসই একখানা পেটমোটা বপু! মেয়ের বাপ জগতে আর মানুষ খুঁজে পায়নি! শেষ পর্যন্ত এই গোরিলাটাকেই পেল!

—‘কী ভাবছ?’

—‘এই মুহূর্তে একটা কবিতা মাথায় সুড়সুড় করছে৷’ শুঁটকি খলখল করে হেসে উঠেছে—‘হি প্রিয়তম,/যদি হাতে দিলে তোমার ছবি/হূদয়ে দিলে প্রেম/তোমার ওই হতকুচ্ছিত দাড়ি কেন/ছাড়িয়ে গেল ফ্রেম!’

—‘এটা কার কবিতা?’

—‘তোর বউয়ের!’ হাসতে হাসতে তার চোখে জল এসে পড়ে—‘এখনও লেখেনি৷ তবে তোকে বিয়ে করার পর শিয়োর লিখবে৷’

—‘ধুস৷’ স্বর্ণাভ বলে—‘তোমাকে বলাটাই ভুল হয়েছে৷ ফ্রাস্টু লোকদের সুখবর শোনাতেই নেই৷’

—‘ঠিক বলেছিস৷ ফ্রাস্টু লোকদের ফরাসি আর ইংরেজি কবিতা শোনাতে হয়৷’ শুঁটকি চোখ টিপল—‘আছে নাকি স্টকে?’

ব্যস! স্বর্ণাভকে আর পায় কে! সে প্রথমে ফরাসি সাহিত্য নিয়ে একচোট বক্তৃতা দিতে শুরু করল৷ শুঁটকি খুব বাধ্য ছাত্রের মতো তাকিয়ে আছে ঠিকই৷ কিন্তু আদৌ লেকচার শুনছে না৷ তার লক্ষ্য বিনা পয়সায় আরও কয়েক পেগ মদ খাওয়া৷ এমন সুযোগ পেলে কেউ ছাড়ে?

ও প্রান্তে শিক্ষক তখন ফরাসি ছেড়ে বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে ইংরেজি সাহিত্যের তুলনামূলক আলোচনা চালাচ্ছেন৷ যথারীতি ঝুম্পা লাহিড়ি, ভি. এস. নৈপল, অরুন্ধতী রায়, অরবিন্দ আদিগা—সমস্ত ঝলমলে নামগুলো উঠে আসতে শুরু করেছে৷ সে চিরকালই প্রমাণ করতে চায় যে তার মতো পণ্ডিত ব্যক্তি খুব কমই আছে৷ দুনিয়ার সব লেখক ও তাঁদের সমস্ত সৃষ্টি তার ঠোঁটস্থ৷

—‘আচ্ছা, তুই ভর্না শ-এর লেখা পড়েছিস?’ আচমকা প্রশ্ন করল শুঁটকি—‘শুনেছি ভদ্রমহিলা দারুণ লেখেন৷ একটুর জন্য বেচারির বুকারটা ফসকে গেল৷’

—‘ঠিকই শুনেছ৷ অসাধারণ লেখিকা৷ আমি ওঁর অনেকগুলো লেখা পড়েছি’, স্বর্ণাভ আবার বক্তৃতা দিতে শুরু করেছে৷ সব পুরস্কারই যে যোগ্যতম ব্যক্তিকে দেওয়া হয় না, বরং এর পিছনে অন্য কোনো কেমিস্ট্রি কাজ করে, তার রীতিমতো ইতিহাস, স্ট্যাটিসটিক্স, রাজনীতি সহ যুক্তিনিষ্ঠ প্রমাণ দিয়েও ফেলল৷

শুঁটকি ভাবলেশহীনভাবে গ্লাস শেষ করল৷ এটাই তার শেষ পেগ৷ আর এই কচকচি ভালো লাগছে না৷ কী কুক্ষণে যে বারে এসেছিল! এই লোকটার পাল্লায় পড়তে হবে জানলে বোধ হয় কষ্ট করেও নির্জলা থাকতে পারত!

গ্লাসটা ঠক করে টেবিলের ওপর রেখে দাঁড়াল সে৷ স্বর্ণাভর কাঁধে হাত রেখে নেশাজড়িত আন্তরিক গলায় বলে—‘থ্যাঙ্কস ভাই৷ তোর কাছ থেকে অনেক তথ্য পেলাম৷ বলতে পারিস ঋদ্ধ হলাম৷ অনেস্টলি, স্পিকিং, ভর্না শ নামে কোনো মহিলা লেখালেখি করেন তা দশ মিনিট আগেও জানতাম না, বুকারের গপ্পো তো দূর! এটা জাস্ট আমার বানানো একটা নাম৷ স্বর্ণাভ-র উলটো সংস্করণ৷ স্বর্ণাভ থেকে ভর্না শ৷ ভেবেছিলাম বোধহয় ওখানেই থামবি৷ কিন্তু তুই তো দেখছি মহিলার অনেকগুলো লেখাও পড়ে ফেলেছিস! কি আর বলব৷ ইউ আর রিয়েলি জিনিয়াস! এ ছেলে বাঁচলে হয়৷’

কথাগুলো বলেই স্তম্ভিত স্বর্ণাভকে পিছনে ফেলে হনহন করে করে এগিয়ে গেল শুঁটকি৷ দরজার দিকে এগোতে এগোতেই শুনতে পেল স্বর্ণাভ বিড়বিড় করে বলছে—‘শালা ঢ্যামনা৷’

ফিচ করে হেসে ফেলল সে৷ লোকে রেগে গেলে তাকে ‘ঢ্যামনা’ই কেন বলে কে জানে৷ নেশা নেশাও হয়েছিল তার৷ সেইজন্যই বোধহয় হাসিটা থামতেই চাইছে না৷ আপনমনেই ফিচফিচ করে হাসতে হাসতে শুঁটকি বারের বাইরে এসে দাঁড়ায়৷

—‘স্যার৷’ দারোয়ান তাকে স্যালুট ঠুকতে সে পকেট থেকে একটা নোট বের করে তাকে দেয়৷ তার সন্ধানী চোখ তখন নিজের গাড়িটা খুঁজছে৷ সারি সারি গাড়ির মধ্যে স্টিল কালারের জেনটা কোথায়! এখানেই পার্ক করেছিল? না অন্য কোথাও? নাকি বেশি নেশা হয়ে গেছে, তাই নিজের গাড়িটাকেই খুঁজে পাচ্ছে না!

তার রকমসকম দেখে দারোয়ানের সন্দেহ হয়৷ সে একটু কুণ্ঠিত স্বরে বলে—‘স্যার, স্টিল কালারের জেনটা কি আপনার ছিল?’

—‘হ্যাঁ আমারই৷’ কথাটা অন্যমনস্কভাবে বলেই চমকে ওঠে শুঁটকি—‘ছিল মানে!’

—‘আপনাকেই একটু আগে আমি খুঁজছিলাম স্যার৷ কিন্তু খুঁজে পাইনি৷’ দারোয়ান মাথা হেঁট করেছে—‘আপনি নো পার্কিং জোনে গাড়ি পার্ক করেছিলেন৷ তাই পুলিশের গাড়ি ওটাকে তুলে নিয়ে গেছে!’

কেউ যেন ধড়াম করে একটা মস্ত গদা তার মাথায় বসিয়ে দিল৷ কথাটা বুঝতে কিছুক্ষণ সময় লাগল৷ কোনোমতে হতবিহ্বলভাবে বলে সে—‘তুলে নিয়ে গেছে!’

—‘হ্যাঁ…স্যার৷’

—‘হা-রা-ম-জা-দা!’ শুঁটকি অদ্ভুত আক্রোশে ছুটে গেল বাইরের দিকে৷ মেইন রোডের ওপর দাঁড়িয়ে চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে পুলিশের উদ্দেশে অশ্রাব্য গালিগালাজ দিতে শুরু করল৷

—‘শালা, বাঞ্চোত…বোকাচোদা…তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য তোরা আমার গাড়িটাই পেয়েছিলি!…যতসব ভুঁড়িওয়ালা ঘুষখোরের দল…’

আরও কিছুক্ষণ শ-কার, ব-কার, ম-কারের বন্যা বইয়ে শেষ পর্যন্ত শান্ত হল শুঁটকি৷ গালাগালি দেওয়ার চোটে তার মুখে ফেনা জমে গেছে৷ আস্তে আস্তে উত্তেজনা প্রশমিত হয়৷ রাস্তায় দাঁড়িয়ে লম্ফঝম্প করে যে বিশেষ লাভ নেই, দেরিতে হলেও একথা মাথায় ঢুকেছে৷ এখন সমস্যা একটাই৷ বাড়ি ফিরবে কী করে!

বাড়ির কথা মনে পড়তেই শুঁটকি নিজেকেই নিজে ভেংচি কাটে৷ বাড়ি কাকে বলে? ইট কাঠ পাথরের একটা নির্বোধ আশ্রয়৷ মাথার ওপর একটা ছাত আর চারদিকে মজবুত দেয়াল থাকলেই বাড়ি হল! আহা! বাড়ির কী ছিরি! অমন বাড়িতে ফেরার কী দরকার!

সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, আজ আর বাড়ি ফিরবে না৷ এখন রাত প্রায় পৌনে বারোটা৷ যানবাহন পাওয়া যাবে না৷ ট্যাক্সিগুলোও বসে থাকে রিফিউজ করার জন্যই৷

অতএব আজ আর ঘরে ফেরা নয়৷ কলকাতার রাস্তাতেই ঘুরে বেড়ানো যাক৷

ভাবতেই মনে বেশ রোমাঞ্চ হল তার৷ রহস্যে ডুবে থাকা কলকাতার পথঘাট৷ কল্লোলিনীর একদিকে হয়তো এত রাতেও আলোর উৎসব৷ এ শহর কখনও ঘুমোয় না৷ বরং শুঁটকির মনে হয় মটকা মেরে পড়ে থাকে৷ যখন মধ্যবিত্তের ঘরের আলো নেভে, তখনই অন্য কোথাও রহস্যময় আলো জ্বলে ওঠে৷ অপ্সরা-কিন্নরীর জমায়েত হয়,—স্বাভাবিক ভাবেই ‘দেবতা ঘুমালে তাহাদের দিন, দেবতা জাগিলে তাহাদের রাতি’৷

ইচ্ছে করলে গভীর রাতে রহস্যময় দিনটার খোঁজে যেতে পারত৷ কিন্তু ‘অমলকান্তি’দের সবই উলটো৷ তাই পথের দিকেই পা বাড়াল সে৷

মেইন রোড প্রায় শুনশান হয়ে এসেছে৷ দু-পাশের সারসার ল্যাম্পপোস্টের আলোর ঔজ্জ্বল্যও যেন খানিকটা ম্লান৷ পিচের রাস্তার ওপর পিছলে পড়ে ক্ষীণ আভা তৈরি করছে৷ একটা-দুটো ল্যাম্পপোস্ট আবার অন্ধ! আলোর সারির মধ্যে ফোকলা দাঁতের মতো তাদের ব্যঙ্গাত্মক উপস্থিতি৷

ফুটপাথের ওপর চাদর বিছিয়ে ভিখিরিরা গভীর ঘুমে কাদা৷ হলুদ আলোর পিঙ্গল আভায় শায়িত যেন তামাটে মূর্তি৷ কেউ একা, কেউ বা সপরিবারে৷ একপাশে দুটো ছোটো ছোটো বাচ্চাকে নিয়ে বাচ্চাদের বাপ ঘুমন্ত৷ তুলনামূলক বড়োটা পাশে৷ একেবারে চুন্নুমুন্নুটা বুকে৷ পাশের শিশুটিকে বড়ো সযত্নে, সতর্কতার সঙ্গে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গায় শুইয়েছে তার বাবা৷ যদি কোনো মদ্যপের বেসামাল গাড়ি কোনোভাবে ফুটপাথে উঠে পড়ে, তখন তার গাড়ির চাকা বাবার বুকেই আটকে যাবে৷

শুঁটকি কখন যেন অজান্তেই থমকে দাঁড়িয়ে গেছে৷ নিদ্রিত পরিবারটির দিকে তাকিয়ে কেমন যেন কান্না পেয়ে গেল৷ মাথার উপরে ছাত নেই৷ নেই নরম বিছানার ওম৷ তবু ঘুম আছে! ছাতওয়ালা, দেওয়াল যুক্ত চৌকানো বাক্সটা নেই৷ তবু বাড়ি আছে৷

সে আরও অনেক কিছুই ভাবতে যাচ্ছিল৷ তার আগেই বুকপকেটের মোবাইল বেজে উঠেছে৷ শুঁটকি তাড়াতাড়ি খানিকটা এগিয়ে গেল৷ মোবাইলের শব্দে বাচ্চাদের ঘুম ভেঙে যেতে পারে৷ প্রযুক্তির চিৎকারে সহূদয় ঘুমের সর্বনাশ হোক, তা চায় না৷

সেলফোনের ডিসপ্লেতে গহনের নাম!

—‘বল৷’

কলটা রিসিভ করতেই ও প্রান্তে বিষণ্ণ স্বর—‘বিরক্ত করলাম না তো!’

—‘ফ্যাট শালা!’ শুঁটকি ঝাঁপিয়ে ওঠে—‘প্রেমিকাকে ফোন করছিস নাকি! ওসব কার্টসি মেয়েদের দেখাস৷’

গহন হেসে ফেলেন—‘আর পালটালি না বাচ্চা’!

—‘আমি পলিটিশিয়ান না গিরগিটি!’ শুঁটকির পায়ের কাছে একটা কোল্ডড্রিংকের খালি বোতল পড়েছিল৷ সেটাতে একটা শট মেরে বলল সে—‘তা ছাড়া তুই বা পালটেছিস কই? শালা যথারীতি এসকেপিস্ট৷ কঠিন বাস্তবের সামনে পড়লেই ন্যাজ তুলে চোঁ চা দৌড়! একদিকে লম্বা লম্বা দার্শনিক ডায়লগ ঝাড়ছিস ‘সমালোচনা নাই, হ্যানো চাই, ত্যানো চাই, নইলে লিখতে পারছি না…৷’ অথচ উদমা ঝাড় খেলেই কুঁইকুঁই করতে করতে ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন৷

টেলিফোনের ও প্রান্তে গহন কতটা চমকে উঠলেন তা বোঝা গেল না৷ কিন্তু তাঁর কণ্ঠস্বরে নিখাদ বিস্ময়—‘তুই জানলি কী করে?’

—‘মধ্যরাত্রে এমন ‘বা-জে করুণ সুরে’ মার্কা ভলিউম শুনলে জানার বাকি কি থাকে?’ সে ভারী মজার খেলা পেয়েছে৷ গহনের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই বোতলটা নিয়ে ফুটবল খেলছে৷ ফাঁকা বোতল কিক খেয়ে গড়গড় করে এগিয়ে গেল৷ পিছন পিছন এলোমেলো পায়ে শুঁটকি৷

—‘কুঁই কুঁই করছি না৷’ একটু চুপ করে থেকে বললেন গহন—‘কিন্তু এটা তো ঠিক, যে আমি কবিতা লিখতে পারছি না৷’

—‘কে বলল?’ সে একটা লম্বা কিক মেরে বোতলটাকে সাইড করে— ‘কেউ তো বলেনি যে ওটা কবিতা হয়নি৷ যদি বলতও তাহলেই বা কী হত? কোনটা কোনটা কবিতা নয়—তা ডিসাইড করার ধক সুপ্রিম কোর্টেরও নেই৷’

—‘তবু…৷’

—‘দ্যাখ গহন৷ তবু, যদির এখানে কোনো সিন নেই৷’ শুঁটকি বলল… ‘কবিতা তুই লিখিস কি লিখিস না—সেটা এখানে বড়ো কোনো ইস্যু নয়৷ আসলে তোর কবিতাটা কাউকে স্পর্শ করতে পারেনি৷ ইনফ্যাক্ট কারুর ভালো লাগেনি৷ সেটাই তারা অনেস্টলি বলেছে৷ তোর যদি খারাপ লাগে, তবে ওটার পাশে ‘গহন দত্তগুপ্ত’ ট্যাগ লাগিয়ে মাঠে নামিয়ে দে৷ ঝুড়ি ঝুড়ি ভূরি ভূরি প্রশংসা পাবি৷’ সে হাসে—‘তবে সেটা কবির নামের মাহাত্ম্য৷ কবিতার নয়৷’

—‘যারা আমার কবিতার সমালোচনা করছে তাদের কি আদৌ সে যোগ্যতা আছে শুঁটকি?’ গহন উত্তেজিত—‘এককথায় যে একটা কবিতাকে ‘ঝুলস্য ঝুল’ বলে দেয়—সে কতটা পড়াশোনা করেছে, আদৌ করেছে কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে৷ সে কি কবিতার সমালোচনা করার যোগ্য?’

—‘হয়তো যোগ্য, হয়তো নয়৷ তাতে কি এল গেল?’ বলতে বলতেই সে খিলখিল করে হেসে উঠেছে৷

—‘হাসছিস কেন?’

—‘তোর ইগো দেখে৷’ হাসতে হাসতেই বলল শুঁটকি—‘এত ইগো থাকলে ইগো ধুয়ে খা৷ ‘সমালোচনা চাই—সমালোচনা চাই’ বলে দেয়ালা করছিস কেন?’

—‘শুঁটকি!’

—‘শুনতে যতই খারাপ লাগুক, কথাটা সত্যি৷’ বোতলটাকে ট্যাকল করতে করতে সে বলে—‘যাঁরা বিজ্ঞ, বিশেষজ্ঞ এবং যোগ্যতম মানুষ—তাঁরা আদৌ কবিতার বই কিনে পড়েন না৷ এইসব অযোগ্য, নির্বোধ লোকগুলোই কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে ভিড় করে তোর কবিতার বই কেনে৷ এই লোকগুলোর জন্যই তোর ঘরে মোটা রয়্যালটি আসে৷ বই বেস্ট সেলার্সের লিস্টে জায়গা পায়৷ যাদের তুই সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় ভাবিস, সেই লোকগুলোই আসলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয়৷ কবিতার টেকনিক্যাল চুলচেরা বিশ্লেষণ করে হাড়, মাংস, কঙ্কাল ঘেঁটে ঘেঁটে আঁতলেমি করার ক্ষমতা হয়তো তাদের নেই৷ কিন্তু অনুভব তারাই বেশি করে৷ টেকনিক্যাল নয়, কবিতার নিটোল সার্বিক আবেদনটাই তাদের কাছে বড়ো কথা৷’

ও প্রান্তে গহন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন৷ তাঁর নীরবতার কারণ বুঝতে পারল শুঁটকি৷ মুচকি হেসে বলে—‘তোর ধারণা ঠিক৷ আমিও আছি ওই আকাট মুখ্যু লোকগুলোর দলে৷ তোর কবিতাটাও পড়েছি৷ মাইরি বলছি, ‘ঝুলস্য ঝুল’ একদম পারফেক্ট বিশ্লেষণ৷’

কবির কণ্ঠস্বর সন্দিগ্ধ—‘কী নামে আছিস?’

—‘সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য৷’

তিনি বিরক্তিতিক্ত কণ্ঠস্বরে বলেন—‘আর এখানে কবিতা দিতে ইচ্ছে করছে না৷ কে—কোথাকার একটা ‘রামহনু’ ফের এসে লিখে দিয়ে যাবে ‘ঝুলস্য ঝুল কবিতা’৷

—‘কেন লিখবে? ’রামহনু’র তোর সঙ্গে কোনো পার্সোনাল ক্ষার নেই৷ তাহলে সে খামোখা কথায় কথায় বাজে মন্তব্য করবে কেন? ভালো লিখলে ভালো কমেন্টই দেবে৷ অবশ্য সত্যিই যদি তুই ‘ঝুলস্য ঝুল’ লিখিস তাহলে আর কী করা!’

বোতলটাকে একটু দূরপাল্লার শট মারতেই সেটা ড্রেনে গিয়ে পড়ল৷ হতাশ হল শুঁটকি৷ যাঃ…এমন মজাদার খেলাটা ভেস্তে গেল!

—‘তুই কচি খোকাটি নোস৷ সমালোচনা, চ্যালেঞ্জ চেয়েছিলি, পেয়েছিস৷ যদি চ্যালেঞ্জটা নেওয়ার সাহস না থাকে তাহলে বৃথা কান্নাকাটি কেন?’

—‘কীসের চ্যালেঞ্জ?’

—‘‘নো ওয়ান’ থেকে ‘বেস্ট ওয়ান’ হওয়ার চ্যালেঞ্জ৷ ‘ঝুলস্য ঝুল’ থেকে ‘কুলস্য কুল’ হওয়ার চ্যালেঞ্জ৷ যেটা বৃহত্তর ক্ষেত্রে করেছিস, সেই লড়াইটাই একটা ছোটো জায়গায় করতে হবে৷’ সে হাসল—‘মাস্টার্সে ফার্স্ট-ক্লাস-ফার্স্ট পাওয়ার পর যদি মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে ভয় করে, তবে তুই কোথাকার ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট? আর কেনই-বা তুই গহন দত্তগুপ্ত? গঙ্গু তেলি আর তোর মধ্যে পার্থক্য কোথায়?’

বলতে বলতে এবার হঠাৎই বিরক্ত হয়ে বলল সে—‘শোন, আমি এখন রাস্তায় হাঁটছি৷ জব্বর হিসি পেয়েছে৷ আর চাপতে পারছি না৷ ছাড়ছি৷’

লাইনটা কেটে গেল৷ শুঁটকি একটু এদিক-ওদিক দেখে নেয়৷ আশপাশে কেউ নেই৷ রাস্তার পাশে একটা গাছের তলায় হালকা হওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ল সে৷ লোকে দেখলে খিস্তি দেবে৷ পুলিশ দেখলে রুল উঁচিয়ে তাড়া করবে৷ কিন্তু অন্যায় কি করছে? গাছের গোড়ায় সামান্য ইউরিয়াই তো ঢালছে৷ তেমন হলে কালকে না হয় এখানে আরও একটা গাছের চারা লাগিয়ে যাবে৷

—‘অ্যাই শালা!’

পিছনে একটা বাইকের শব্দ৷ আর পরক্ষণেই একটা চাপা অথচ রূঢ় স্বর শুনে ঘাবড়ে গেল শুঁটকি৷ পুলিশে ধরল নাকি! এত রাত্রেও ব্যাটারা চরে বেড়াচ্ছে!

সে পিছনে তাকায়৷ পুলিশ নয়, দুটো ছেলে৷ মুখ কালোকাপড়ে বাঁধা৷ একটার হাতে উদ্যত ভোজালি৷ বিদ্যুতের মতো সামনে এসে তার গলায় ঠেকিয়ে বলল—‘একদম চিল্লামিল্লি নয়৷ লোচা করলেই এই চিকনি তোর গলা কাটবে! দামি জিনিস সঙ্গে যা যা আছে সব দে৷’

ও! পুলিশ নয়! বরং উলটোটাই৷ যাক তাহলে ভয়ের কিছু নেই৷ শুঁটকি বিনাবাক্যব্যয়ে ওয়ালেটটা এগিয়ে দিল৷ দ্বিতীয় ছেলেটা এবার এগিয়ে এসে সেটা কেড়ে নিয়েছে৷ আস্তে আস্তে হাতের ঘড়ি, সোনার আংটি, সোনার চেন, দামি মোবাইল সবই শান্তভাবে দুর্বৃত্তদের হাতে তুলে দিল সে৷ ছেলেদুটো বোধহয় এরকম ঝামেলাহীন শান্তিময় সহযোগিতা অপর পক্ষের কাছ থেকে আশা করেনি৷ যে ভোজালি ধরেছিল সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অস্ত্রটা নামিয়ে নিয়েছে৷ দ্বিতীয় ছেলেটাও অবাক!

সমস্ত দামি দামি জিনিস হস্তান্তরিত করে এবার হঠাৎই শার্ট খুলতে শুরু করেছে সে৷

—‘আবে-শালা…কী করছিস…?’

ছেলেদুটো হতভম্ব! শুঁটকি শান্তভাবেই বলে—‘কেন? তোমরাই তো বললে দামি জিনিস সঙ্গে যা যা আছে সব দিতে৷’

বলতে বলতেই প্যান্টও খুলে ফেলেছে—‘সব দামি জিনিস তো দিতে পারব না৷ যেটুকু দিতে পারি দিলাম৷ নাও৷’

ছেলেদুটো তখনও স্তম্ভিত৷ তাদের অবস্থা দেখে করুণা হল তার৷ সে আকাশের দিকে তাকিয়েছে—‘যে স্বপ্নটা আমি একদিন রেখে যাব ভাবছি সেটাই সবচেয়ে দামি…সেটা তো দিতে পারব না ভাই৷ তার চেয়ে বরং আমার জুতোদুটো, গেঞ্জি আর আন্ডারওয়্যারটাও…৷’

—‘সানকি মাল!…পুরো সানকি!’

বলতে বলতেই প্রায় ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় মেরেছে ছেলেদুটো৷ বাইকে স্টার্ট দিতে দিতেই দেখল, পাগল লোকটা ইতিমধ্যেই জুতো আর গেঞ্জিও খুলে ফেলেছে!

—‘…শালা ফুলটু স্ক্রু ঢিলা…৷’

বাইকটা হুশ করে বেরিয়ে গেল৷ এমন করে তাড়াতাড়ি পালিয়ে গেল যেন একটা ভয়াবহ ডাইনোসর তাদের তাড়া করেছে৷

ফুটপাথবাসী দুটি বাচ্চার বাপ সেদিন মধ্যরাত্রে আচমকা ঠ্যালা খেয়ে ঘুম ভেঙে উঠে বসল৷ বিস্ময়মাখা দৃষ্টিতে দেখল একটা কালো সিড়িঙ্গে চেহারার লোক শুধু একটা আন্ডারওয়্যার পরে সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷ গায়ে বিলিতি মদের গন্ধ৷ সদ্য ঘুমভাঙা অবস্থায় এটা স্বপ্ন না বাস্তব বোঝার আগেই সে শুনতে পেল একটা কুণ্ঠিত স্বর৷ লোকটা সংকুচিতভাবে বলছে—

—‘তোমাদের পাশে একটু শোওয়ার জায়গা হবে ভাই?’

.

‘কবিতা ডট কম’ আজ সকাল থেকেই সরগরম! এককথায় বলতে গেলে রীতিমতো বাওয়াল শুরু হয়েছে এখানে! ঘটনাটা আর কিছুই নয়৷ মগনলাল নামের এক কবি ভয়াবহ একটা কবিতা পোস্ট করেছেন৷ আর সেটা—নিয়েই শুরু হয়েছে টানাহ্যাঁচড়া৷

কবিতাটা অনেকটা এইরকম—

পাহাড়ের মাথা থেকে
জংলি বাইসনের নিতম্ব বারান্দায়—মস্তিষ্কে বরফ প্রলেপ!
জরায়ু যখন হেঁটে বেড়ায়, তখন
নগ্নতার একশো কুড়ি ডেসিবেলকে ঘৃণা করি৷
যে যৌনরমণী ঘুমন্ত পুরুষের দণ্ডটি নেড়েচেড়ে
দেখেছিল, শান্তিনিকেতনে তার ভিতরের উষ্ণতারস পাইনি৷
এখন শুধুই আঙুলে টিপে মারি অসহ্য উকুন!
আর দিনগত পাপক্ষয়৷

এখানেই বিতর্ক ও চাপানউতোরের শুরু৷

থ্রেডের প্রথম কমেন্টটাই ‘ফ্রাস্টু কবি’র৷ সে লিখেছে—‘দাদা, আপনি মগনলাল না নগনলাল? কবিতাটা যে বুঝেছি তা বলতে পারছি না৷ কিন্তু কবিতা কাকে বলে তাও বেমালুম ভুলে গেছি৷’

ঠিক তারপরেই ‘আকাশনীলের’ ফোড়ন—‘হায় কবিতা কাহারে কয়?/সে কি শুধুই যৌনতাময়?’

‘মুমতাজ’ বেশ সরল সাদাসিধে মিষ্টি পাঠিকা৷ সে বেচারি বলেই ফেলেছিল—‘কবিতাটা ঠিক বুঝতে পারিনি৷ কেউ বুঝিয়ে দেবেন?’

তার উত্তরেই ‘কুবলাশ্ব’র বিস্ফোরক ভাবসম্প্রসারণ৷ সে বিশেষ অন্যায় কিছু করেনি৷ শুধু ‘মুমতাজ’কে কবিতাটা বুঝিয়ে বলেছে৷

অনেক ভেবেচিন্তে নিজের মতো করে যা মানে বের করেছে তা অনেকটা এইরকম—

কবি পাহাড়ের মাথায় থাকা একটি সমকামী বাইসনকে নিজের প্রেমিকারূপে কল্পনা করেছেন৷ সেই সমকামী বাইসনের নিতম্বকে বারান্দা ভেবে তিনি বোধহয় পায়চারি করতে গিয়েছিলেন৷ সেইজন্য বাইসনটা খেপে গেছে৷ তাই পাহাড়ি লোকেরা তার মাথায় বরফের প্রলেপ দিয়ে রেখেছে, যাতে মাথা ঠান্ডা থাকে এবং কাউকে গুঁতিয়েও না দিতে পারে৷

যেহেতু বাইসনটা সমকামী, সেহেতু তার জরায়ু থাকা-না-থাকা দুই-ই সমান৷ অগত্যা বিরক্ত হয়ে জরায়ুটা একা-একাই ইভনিং ওয়াকে বেরিয়েছে৷ বাইসনটা নগ্ন ছিল৷ স্বাভাবিক! তাকে জামাকাপড় বা মোজা কে পরাবে? সে নগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে একশো কুড়ি ডেসিবেলে গাঁ গাঁ করে জরায়ুকে ডাকছে৷ সেই ডাক কবির অসহ্য ঠেকছে৷

সেই চিৎকার শুনতে শুনতেই তিনি বাইসনটিকে প্রেমিকার মতো করে কল্পনা করেছেন৷ যে মেয়েটি কবি ঘুমিয়ে পড়লে তার দাদুর লাঠিটা নেড়েচেড়ে দেখত এবং ভাবত, সেটা দিয়ে বাড়ি মারলে কবির মাথার ভিতরের জিনিসপত্তর বাইরে আসবে কিনা! আর এইরকম গাঁক গাঁক করে চেঁচিয়ে বলত—‘আমি পেপসি খাব…পেপসি খাব৷’ একেই কোল্ডড্রিংক তার ওপর বরফের প্রলেপ! তাই তার ভেতরে উষ্ণতারস পাননি কবি৷ অগত্যা তিনি মাথার উকুন বেছে বেছে মারছেন৷ অর্থাৎ টাইম পাস করছেন, যার এক্সপ্রেশন শেষ লাইনটা—‘আর দিনগত পাপক্ষয়’৷

কবিতাটা ভয়ংকর নিঃসন্দেহে৷ কিন্তু তার ভাবসম্প্রসারণটা আরও ভয়াবহ৷ মন্দার অনুভব করল ‘কুবলাশ্ব’-কে সে মনে মনে পছন্দ করতে শুরু করেছে৷ লোকটার এলেম আছে৷ এই কবিতাটার এমন ভয়ংকর ব্যাখ্যা বোধহয় একমাত্র তার পক্ষেই সম্ভব!

বলাই বাহুল্য মগনলালের সেটা বিশেষ পছন্দ হয়নি৷ সে এতক্ষণ অন্যান্য পাঠক ও কবিদের মন্তব্য কোনোরকমে দাঁতে দাঁত চেপে হজম করছিল৷ কিন্তু এবার আর সহ্য হল না৷ সে চটে গিয়ে দশটা বেজে তিন মিনিটে মন্তব্য করল—‘আপনি আমাকে অপমান করছেন৷’

কুবলাশ্ব’র উত্তর দশটা বেজে চার মিনিটেই কম্পিউটার স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে—‘আপনি কবিতার অপমান করেছেন৷’

—‘মানে?’

—‘এরকম আপাদমস্তক হিজিবিজিকে আপনি কবিতা বলেন?’

—‘আমি যা-ই বলি৷ আমার কবিতার এরকম বিকৃত অর্থ করার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে? এ তো কবির স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ! কবির অপমান!’

কুবলাশ্ব একটা বত্রিশপাটি বার করা স্মাইলি দিল৷

—‘আমি যদি বিকৃত অর্থ করে থাকি তবে আন্তরিক ক্ষমাপ্রার্থী৷ মুমতাজ কবিতার অর্থ জানতে চেয়েছেন৷ আপনি যদি স্বয়ং কবিতাটির অর্থ জানিয়ে দেন তবে বাধিত হই৷’

‘মগনলাল একটু থতোমতো খেয়ে গিয়ে উত্তর দেয়—‘কবিতার কোনো মানে হয় না৷ কবিতা বোঝার জিনিস নয়, বাজার জিনিস৷’

—‘সে আবার কী! কবিতা কি হারমোনিয়াম না—পাখোয়াজ, যে বাজবে! তা ছাড়া যখন লিখেছিলেন তখন নিশ্চয়ই কিছু ভেবে লিখেছেন৷ কী ভেবে লিখেছেন সেটাই অন্তত শুনি৷ ছাত্রবন্ধু লিখতে বলছি না৷ শুধু একটু ক্লু হলেই চলবে৷’

দিব্যি ‘ওয়ান-টু-ওয়ান’ তর্ক চলছিল৷ কিন্তু এর মধ্যে আবার স্বর্ণাভ গুপ্ত এসে টপকে পড়লেন৷ ইনি স্বনামেই লেখেন৷

বুকনির চোটে টেকাই যায় না৷ সামনা-সামনি কখনও না-দেখলেও স্বভাব- চরিত্র বুঝতে বাকি নেই মন্দারের৷ কথায় কথায় বাতেলা দেওয়াই তার স্বভাব৷ কিছু মানুষ আছে যারা ‘দেখ আমি কত জানি’ গোছের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে বেড়ায়৷ স্বর্ণাভ গুপ্ত তাদের মধ্যে অন্যতম৷

তিনি বোধহয় এতক্ষণ গোটা ব্যাপারটাই দেখছিলেন৷ এবার উড়ে এসে জুড়ে বসে গ্রাম্ভারি মন্তব্য করলেন—‘তার আগে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যাক৷ কবিতা আসলে কার? কবির না পাঠকের?’

এরকম আলটপকা দার্শনিক মন্তব্যে ব্যোমকে গেল মন্দার৷ সে এতক্ষণ এই বিতর্কে কোনোভাবেই যোগদান করেনি৷ শুধু চুপ করে তামাশা দেখছিল৷ কোথাকার জল কোথায় গড়ায় সেটাই দ্রষ্টব্য৷

কুবলাশ্বও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়৷ তার সপাট উত্তর—‘কবিতা ততক্ষণ কবির, যতক্ষণ না সেটা পাঠকের দরবারে আসছে৷ মগনলাল যদি তাঁর কবিতাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে চালাতে চান, তবে খাতায় ভরে রাখলেই পারেন৷ অনলাইনে পোস্ট করার দরকার কী? যে মুহূর্তে ওটা পোস্ট হয়েছে, সেই মুহূর্তেই পাঠকও কবিতাটার সঙ্গে ইনভলভড হয়ে গেছে৷ এখন তাদের বক্তব্যও কবিকে শুনতে হবে বই-কি!’

—‘কাদের বক্তব্য? কোন পাঠকের? কবিতা অনুভবী ও শিক্ষিত পাঠকের জন্য৷ যারা কবিতার মানে জানতে চায় এমন লে-ম্যানদের জন্য নয়৷’

পুরোপুরি ‘বিলো দ্য বেল্ট’ আক্রমণ৷ এতক্ষণ কবিতাটা নিয়েই কথা চলছিল৷ এবার স্বর্ণাভ গুপ্ত তর্কটাকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে গেছেন৷ এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই৷ উনি প্রায়শই এরকম করে থাকেন৷ আসলে ভদ্রলোক কবিতার চেয়ে লবিবাজিটাই বেশি পছন্দ করেন৷

নিজের অজান্তে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে৷ কবিতার অন-লাইন সাইট হলেও এমন ভাবার কোনো কারণ নেই যে এখানে লবিবাজি নামক বস্তুটি অনুপস্থিত! বরং প্রিন্টেড মিডিয়ার থেকে এখানে খামচাখামচি আরও বেশি৷ প্রকাশ্য জগতে মানুষগুলোকে চোখে দেখা যায়৷ তাই চক্ষুলজ্জাও থাকে৷ এখানে সেসব বালাই নেই৷ ছদ্মনামের আড়ালে তাই চামচাগিরি, লবিবাজি, লেঙ্গি মারামারির প্রবল সুযোগ৷ যাঁরা প্রিন্টেড মিডিয়ায় বিশেষ কলকে-টলকে পান না, তাঁরাই এখানে বাঘ সেজে বসে থাকেন৷ আর সেইসব মহান দাদাদের গুণধর ভাই-বোনেরা পদলেহন শিল্পে কামসূত্রকেও টেক্কা দেয়৷

আর লবিরও কী রকমফের! প্রবীণ কবি—নবিশ কবি, মহিলা কবি—পুরুষ কবি, শিক্ষিত কবি—অশিক্ষিত কবি৷ দাড়িওয়ালা কবি—দাড়ি ছাড়া কবি, প্রেমিক কবি—ব্যর্থপ্রেমিক কবি…উফফ! কবির থেকেও বোধহয় লবির সংখ্যা বেশি!

সেক্ষেত্রে মগনলালের হয়ে স্বর্ণাভ গুপ্ত মাঠে নামবেন—এতে আর আশ্চর্যের কী আছে৷ মগনলাল স্বর্ণাভ-র খাস চামচা৷ পরস্পরের পিঠ চুলকানো আর সাবাশি দেওয়াই ওদের কাজ৷ মন্দার জানে এবার খেলা জমে যাবে৷ স্বর্ণাভ-র অ্যান্টিলবি আকাশনীলও ঢাল-তরোয়াল নিয়ে মাঠে নামল বলে৷ থ্রেডে পোস্টের সংখ্যা কয়েকশো ছাড়িয়ে যাবে৷ দিন গড়িয়ে রাত হয়ে যাবে৷ তবু মারপিট থামবে না৷ ‘আমি তোর থেকে বড়ো কবি ঢিসুম’ ‘আমি তোর থেকে বেশি শিক্ষিত কবি গুদুম’…এই চলবে৷

মন্দার এতকিছু ভাবতে ভাবতেই দেখল কুবলাশ্ব উত্তর দিয়ে দিয়েছে৷ পেজটা রিফ্রেশ করতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠল তার জোরালো জবাব—‘তাই নাকি? কিন্তু দাদা, কয়েকদিন আগেও তো আপনি এইসব লে-ম্যানদের জন্যই লিখেছেন৷ প্রশংসাও পেয়েছেন৷ ইনফ্যাক্ট, শঙ্খ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাও আমরা অল্পবিস্তর বুঝতে পারি৷ তাহলে উক্ত কবিরাও লে-ম্যানদের জন্যই কবিতা লিখেছেন! সেক্ষেত্রে কী প্রমাণিত হয়? হয় মগনলাল তাঁদের থেকেও বড়ো কবি! নয় আস্ত একটি গাম্বাট অপদার্থ!’

পুরো বাউন্সার! কুবলাশ্ব মেয়ে হলে বোধহয় তার প্রেমে পড়ত মন্দার৷ এই মুহূর্তে তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে ইচ্ছে করছিল৷ একদম উপযুক্ত জবাব দিয়েছে ব্যাটা৷ কিন্তু একা কতক্ষণ যুদ্ধ করবে? কয়েক মিনিটের মধ্যে স্বর্ণাভ-র লবির লোকেরা হুড়মুড় করে এসে পড়ল বলে৷ কতজনের সঙ্গে তর্ক করবে কুবলাশ্ব!

সে ভাবছিল কুবলাশ্বকে ব্যাক-আপ দেওয়ার জন্য ‘রামহনু’ হয়ে মাঠে নেমে পড়বে কিনা৷ কিন্তু তার আগেই বাধা পড়ল৷

আর্ট ডাইরেক্টর শাশ্বত মুখখানা পুরো ট্রাকের তলায় চাপা পড়া প্লাস্টিকের ঠোঙার মতো করে এসে বলল—‘তুই এখানে বসে খুটখুট করে ল্যাপটপে কবিতা মারাচ্ছিস! ওদিকে হারামি পেন্ডুলাম ষাঁড়ের মতো চেল্লাচ্ছে৷’

মন্দারের চোখের সামনে সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত একটা দৃশ্য ভেসে উঠল৷ একটা কালো বাইসন একশো কুড়ি ডেসিবেলে গাঁক গাঁক করে ডাকছে!

সে ল্যাপটপ অফ করে ব্যাগের মধ্যে ভরে রাখল৷ ওয়্যারলেস কানেকশনের মোডেমটাও যথাস্থানে চলে গেছে৷ ধীরেসুস্থে ব্যাগ গুছিয়ে বলে—‘চ্যাঁচাচ্ছে কেন? পুরো সিন তো কমপ্লিট করে দিয়েছি৷’

—‘গাঁড় মারা গেছে সিনের!’ শাশ্বত বিরক্ত—‘গোটা সিন ফের পালটাতে হবে৷ এক্ষুনি চল৷ শুয়োরের বাচ্চা কানের মাথা খেয়ে ফেলেছে৷ ওই তো বালের গপ্পো লেখে! তার কী রোয়াব!’

মন্দার লক্ষ করে দেখেছে, এখানে কেউ খিস্তি না দিয়ে কথা বলতে পারে না৷ এত খিস্তি দেওয়ার কি আছে! শালীন ভঙ্গিতে কথা বললে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়! গালাগালি খেয়ে এখানকার লোকেদেরও এমন অভ্যাস হয়েছে যে ভালো কথা ওদের পোষায় না৷ একবার এক স্পটবয়কে বলেছিল—‘ভাই, একটু চা হবে?’

তার পরিপ্রেক্ষিতেই স্পটবয়টির উত্তর—‘শান্তিনিকেতনি মাল নাকি!’

—‘আমাদের কি লাইফ বল৷’ শাশ্বত আপশোশের সঙ্গে বলে—‘শালা সব ঝাড়খন্ডি মাল৷ দিনরাত ঝাড় খেয়ে খণ্ড খণ্ড হয়ে মরছি৷ বাপের বড়ো মিষ্টির দোকান আছে শ্যামবাজারে৷ মাঝেমধ্যে ভাবি সব ছেড়েছুড়ে মিষ্টির দোকানেই বসি৷ এই ঢ্যামনাগুলোর খিস্তি খাওয়ার চেয়ে বরং বাপের ঝাড় হজম করা সহজ৷’

মন্দার তার কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে৷ তার বাবা আবার ব্যাংকের ম্যানেজার৷ মিষ্টি দোকানও নেই যে সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে দোকানে বসবে! অগত্যা ঝাড় খাওয়াই তার কপালে আছে৷

সেটের ভেতরে পেন্ডুলাম সত্যিই একটা খ্যাপা বাইসনের মতো ভোঁস ভোঁস করে যথারীতি ডাইনে-বাঁয়ে বেঁকতে বেঁকতে পায়চারি করছিল৷ দেখে মনে হল ওর নিতম্বে ও মস্তিষ্কে বরফ ঘষা দরকার৷ তাকে দেখেই এমন লাফিয়ে উঠল যেন পাছায় পিন ফুটেছে৷

—‘এই যে ক্যালানে কার্তিক!’ স্ক্রিপ্ট-এর গোছাটা তার দিকে প্রায় ছুড়ে দিয়েছে পান্ডাদা—এটা কী লিখেছিস শুয়োরের বাচ্চা? মাত্র একটা চুমু খেয়েই সেকেন্ড ভিলেন মরে যাবে৷ এটা স্ক্রিপ্ট না আমার শ্রাদ্ধ?’

পেন্ডুলামের পাশেই বসেছিলেন সিরিয়ালের ডিরেক্টর আশুদা৷ তিনি অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা মাথার মানুষ৷ সামান্য মাথা নেড়ে বললেন—‘মরার আগে অন্তত দু-মিনিটের ফুটেজ লাগবে৷ একটা চুমুতে দশ সেকেন্ডও কাটবে না৷ স্ক্রিপ্টে আরও একটা-দুটো সেক্সি সিকোয়েন্স নামিয়ে দে৷ অন্তত অল্পস্বল্প আদর-টাদর, অল্প ফস্টিনস্টি৷’

মন্দার আড়চোখে দেখল, সেটে সুইমিং কস্টিউম পরে ভিজে গায়ে টাওয়েল জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার স্বপ্নসুন্দরী উশ্রী৷ সেকেন্ড ভিলেন শুভাশিস সুইমিং পুলের পাশে পায়চারি করছে৷ সিকোয়েন্সটা বেশ উত্তেজক৷ সেকেন্ড ভিলেন নায়িকাকে এক্সপ্লয়েট করার প্ল্যান করে তাকে নিজের বাগানবাড়িতে এনেছে৷ কিন্তু নায়িকা আগেই সে প্ল্যানের কথা জেনে যায়৷ তাই সুইমিংপুলে নামার আগে কায়দা করে ভিলেনের মদের গ্লাসে বিষ মিশিয়ে দিয়েছে৷ তারপর নায়িকাকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেয়ে সে মরে যাবে৷

এই তো সিন! একেবারে জলের মতো সহজ৷ কিন্তু সেখানেও ঝামেলা৷ মরার আগে দু-মিনিটের ফুটেজ চাই!

সে পেন্ডুলামের দিকে তাকায়—‘কিন্তু পান্ডাদা দু-মিনিট কোথা দিয়ে আসবে?’

পেন্ডুলাম খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠল—‘সেটাও আমি বলব পাগলা…৷’ ফের একটা গালাগালি৷ মন্দারের কান-মাথা ধ্বক করে গরম হয়ে ওঠে৷ তবু সে শান্ত গলায় বলে—‘আরে, কি বিষ দিয়েছ সেটা তো আগে দেখবে! পটাশিয়াম সায়ানাইডের একটা আস্ত অ্যাম্পুল! আমি তো তবু চুমু খাইয়েছি! লোকে তো পটাশিয়াম সায়ানাইড জিভে ঠেকিয়ে খাবি খাওয়ারও সময় পায় না! সেখানে দু-তিনটে চুমু! ইম্পসিবল!’

—‘হোয়াট ইম্পসিবল!’ পেন্ডুলাম আরও জোরে চ্যাঁচাচ্ছে—‘তোকে কি ফরেনসিক সায়েন্সের ক্লাস নিতে বলা হয়েছে গান্ডু? আরও দু-মিনিটের ফুটেজ না হলে চলবে না, ব্যস!’

কী আশ্চর্য! পটাশিয়াম সায়ানাইডের একটা গোটা অ্যাম্পুল খাওয়ার পরও দু-মিনিট বাঁচতে হবে লোকটাকে! সেকেন্ড ভিলেন তো অগস্ত্য মুনি নয়, যে ইল্বল-বাতাপি-পটাশিয়াম সায়ানাইড, সব হজম করে মেরে দেবে!

কিন্তু সে কথা পেন্ডুলামকে কে বোঝাবে? সে প্রায় হিড়িম্বা নৃত্য করতে লেগেছে—‘বাস্তব-অবাস্তব বুঝি না! মেগা সিরিয়ালে বাস্তব বলে কিছু নেই৷ যদি বাস্তব কিছু থাকে তা হল ওই দু-মিনিটের ফুটেজ আর তিনটে চুমু৷ যদি পারিস তো করে দে৷ না পারিস তো কবি হয়ে পেছন মারা!’

শেষ কথাটা শুনে সেটের সকলেই কেমন তাচ্ছিল্যভরা হাসি হেসে উঠল৷ উশ্রীও কেমন গায়ে জ্বালা ধারানো হাসি হাসছে! রাগে-ক্ষোভে মন্দারের চোখে এই প্রথম জল এসে পড়ল৷ উশ্রী অমন ব্যঙ্গাত্মক হাসি হাসছে কেন? সে কি কবিতা পড়ে না? একজন কবি যে একজন স্ক্রিপ্ট-রাইটারের চেয়ে বেশি মর্যাদার পাত্র তা কি সে বোঝে না!

—‘আর শোন’, পান্ডা খরখরে গলায় যোগ করে—‘নায়িকার মাকে কিছুদিনের জন্য কাশী, গয়া বা হরিদ্বারে পাঠিয়ে দে৷ নেক্সট সিনে উশ্রীর মুখে ডায়লগ থাকবে—‘মা কয়েকদিনের জন্য হরিদ্বারে গেছে’—বুঝেছিস?’

মন্দার মাথা নীচু করে চোখের জল আড়াল করেছে৷ কোনোমতে মাথা নাড়ল৷

অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর জাভেদ একবার ক্ষীণ স্বরে প্রতিবাদ করে—‘তা কী করে হয় দাদা! তাহলে তো শুরুর এপিসোডগুলোর সঙ্গে কন্টিনিউইটি থাকছে না! শুরু থেকেই দেখানো হচ্ছে যে নায়িকার মা, আই মিন বৈজয়ন্তীদি দস্তুর মতো জাঁদরেল ও আধুনিকা৷ তিনি স্লিভলেস পিঠকাটা ব্লাউজ, শিফনের শাড়ি পরেন৷ বব কাট চুল৷ মদ, সিগারেট খান, পার্টিতে নাইট ক্লাবে যান৷ যিনি এমন আধুনিকা, তিনি কাশী, গয়া বা হরিদ্বারে মরতে যাবেন কেন?’

—‘কেন? মানুষের মনের কি পরিবর্তন হয় না?’ পেন্ডুলাম জাভেদকে এক রামধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছে—‘আর যদি পরিবর্তন না হয় তবে নায়িকার মায়ের রোলটা কি তুই করবি? বৈজয়ন্তীদির চিকুনগুনিয়া হয়েছে জানিস না? শুটিংয়ে আসবেন কী করে?’

পাশ থেকে কে একজন ফোড়ন কাটল—‘তবে অনির্দিষ্টকালের জন্য আন্দামানে পাঠিয়ে দাও না দাদা৷ এক্কেবারে দ্বীপান্তর৷’

সকলে আর-একবার গা জ্বালানো হাসি হেসে ওঠে৷ মন্দার মাথা নীচু করে ভাবছিল, কী নির্বোধ এরা! নির্বুদ্ধিতার কি শেষ নেই?

সে আস্তে আস্তে সেখান থেকে সরে এল৷ তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে৷ উশ্রী এমন বোকার মতো হাসছে কেন? ওদের সঙ্গে থাকতে থাকতে কি সে-ও অনুভূতিহীন নির্বোধে পরিণত হয়েছে!

আর থাকতে পারল না মন্দার৷ স্টুডিয়োর টয়লেটে ঢুকে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল৷ এখানে কী করছে সে? কতগুলো নিম্নমেধার লোকের ভিড়ে তার অবস্থান কোথায়? তার কাজ কি শুধু এই গালিগালাজগুলো খেয়ে, পাতার-পর-পাতা অর্থহীন মেলোড্রামা লিখে যাওয়া! এই জন্যই জন্মেছিল মন্দার! এই করেই মরবে!

হঠাৎ করে মনে পড়ে গেল বাবার বলা কঠিন শব্দগুলো—‘সাহিত্য পড়ে কোন রাজকার্যটা করবি? কবিতা লিখে কি পেট ভরবে! বাপের হোটেল চিরকাল খোলা থাকবে না চাঁদু! এটাই বাস্তব!’

সত্যিই কবি হয়ে পেট ভরানো যায় না৷ বিয়ে করা যায় না উশ্রীর মতন মেয়েকেও৷ সেইজন্যই তো এত কষ্ট সহ্য করেও এখানে টিকে আছে৷ আস্তে আস্তে পয়সা জমিয়ে দামি দামি গিফট দিয়েছে উশ্রীকে৷ কখনও জুয়েলারি, কখনও ফ্রেঞ্চ পারফিউম, কখনও বা দামি লেডিস হ্যান্ডব্যাগ৷ উশ্রী লাজুক মুখে সেগুলো নিয়ে ছুড়ে দিয়েছে মোহিনী হাসি৷ ওই হাসিটা দেখার জন্য বহুবার মরতে পারে সে!

আস্তে আস্তে মন্দার চোখের জল মুছে ফেলল৷ তার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে৷ নাঃ, টিকে থাকতেই হবে৷ এগারোশো স্কোয়্যার ফিটের একটা ঝকঝকে ফ্ল্যাট, একটা গাড়ি, কিছু ব্যাংক ব্যালেন্স—আর উশ্রী৷ সবকটা পেতে হলে লেগে থাকতেই হবে৷

সে চোখমুখে জল দিয়ে এসে বসল চেয়ারে৷ এখন মনটা অনেকটা শান্ত৷ স্ক্রিপ্টের গোছাটা নিয়ে দু-তিনটে চুমুর সিকোয়েন্স আর গোটা কয়েক ডায়লগ বসাতে যাবে, এমন সময় একটা মেয়েলি গোলগাল হাত সামনে এসে পড়ল৷ হাতে ধরা একটা রুমাল৷

—‘ছেলেদের কাঁদলে ভালো লাগে না৷’ একটা মিষ্টি রিনরিনে স্বর বলে ওঠে—‘আপনার চোখে এখনও জল লেগে আছে৷ মুছে নিন৷’

মন্দার অবাক হয়ে পিছনে তাকায়৷ উশ্রীর বোন ঊর্মি ঠিক তার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে৷ এই মেয়েটিকে রোজই দেখে৷ দিদির সঙ্গে শুটিংয়ে আসে৷ বোধহয় দিদিকে পাহারা দেয়৷ শুটিং চলাকালীন সবসময়ই গম্ভীর মুখে ল্যাপটপে খুটুর খুটুর করে কী যেন করে৷

কোনোদিন মেয়েটাকে ভালো করে দেখেনি৷ আজ দেখে মনে হল, ঊর্মি উশ্রীর বোন হতেই পারে না৷ দুই বোনের চেহারায় আকাশপাতাল তফাত৷ উশ্রী তন্বী, সুন্দরী৷ চোখে সবসময়ই দুষ্টুমি চিকমিক করছে৷ কালো কুচকুচে ঘন ভুরুর নানা বিভঙ্গে, লম্বা চুল ঝাপটে, ছেলেমানুষি হাবেভাবে পুরুষের বুকে ঝড় তোলে৷ নিজেকে কী করে মোহিনী সাজিয়ে তুলতে হয় তা সে জানে৷ সেইরকমই আউটফিট পরে৷

তুলনায় ঊর্মি বেশ খানিকটা মোটাসোটা৷ এমন ঢিলেঢালা একটা সালোয়ার সুট পরে আছে যে হাঁটলেই মনে হয় থলির ভেতরে বিড়াল লাফাচ্ছে৷ সম্পূর্ণ প্রসাধনহীন মুখ৷ শান্ত চোখ৷ একখানা দিদিমণি মার্কা চশমা নাকের ওপর৷ মোটা ফ্রেমের দৌলতে ভুরু দেখাই যায় না৷ আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার, সে সবসময়ই মাথায় একটা ওড়না পরে থাকে৷

—‘আমি কাঁদছি না৷’ মন্দার প্রতিবাদ করে—‘চোখে জলের ঝাপটা দিয়েছি৷’

উর্মি মুচকি হাসল৷ তারপর রুমালটা তার দিকে এগিয়ে দেয়৷ সে বুঝতে পারে এ মেয়ে একটু আলাদা৷ এর চোখে ধুলো দেওয়া মুশকিল৷

—‘কবিতা-টবিতা লেখা হয়?’

রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে থমকে গেল মন্দার৷

—‘আপনাকে কে বলল?’

—‘আমি একটু আগেই সেটের ভেতরে ছিলাম৷’

ওই একটা বাক্যেই সবকথা বলা হয়ে গেল৷ মন্দার মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়৷

—‘এখানে এসে একজন কবির দেখা পাব ভাবিনি৷’ ঊর্মির কণ্ঠস্বরে সম্ভ্রম ও সহানুভূতি৷

—‘কোথায় লেখেন?’

—‘বেশ কয়েকটা লিটল ম্যাগাজিনে৷’ ঊর্মির সঙ্গে কথা বলতে তার ভালো লাগছিল৷ এই মেয়েটা হয়তো কবিতার মর্ম বোঝে৷ অন্যদের মতো অনুভূতিহীন নয়৷ বরং বেশ সহূদয়৷ সে মৃদু স্বরে বলল—‘একটা ওয়েবসাইটেও লিখি৷’

—‘ওয়েবসাইট! ইন্টাররেস্টিং৷’ ঊর্মির চোখে কৌতূহল—‘কোন ওয়েবসাইট?’

—‘কবিতা ডট কম৷’ সে রুমালটা ফেরত দিয়ে বলল—‘ওখানে অবশ্য ছদ্মনামে কবিতা দিই৷’

—‘ছদ্মনাম৷ কীরকম?’

মন্দার এবার সামান্য হাসে—‘নামটা মোটেও শোনার মতো নয়৷’

—‘তবু শুনি৷’

সে ফিক করে হেসে ফেলেছে—‘রামহনু৷’

ঊর্মি কিছুক্ষণ তার দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে৷ বোধহয় ছদ্মনামটা শুনে হাঁ হয়ে গেছে৷ তারপর বিস্ময়ের ধাক্কাটা সামলে নিয়ে সে-ও হাসল৷ মুচকি হেসে বলল—‘মন্দ কি! বেশ তো৷’

.