আরও দাও প্রাণ – ১

জলের সাথে আমার ছায়া বলছে আমার কথা
জল বোঝে না কোনটা কথা, কোনটা প্রগলভতা!
ছপছপিয়ে আতুর বিরাম আসল এখন কাছে,
ছলছলিয়ে ভাসিয়ে নিল খাতার শেষের পাতা৷
জল জানে না কোনটা কথা, কোনটা প্রগলভতা!

.

বাইরে তখন অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে৷ বন্ধ কাচের জানলার ও প্রান্তে ঝাপসা প্রেক্ষাপট৷ বর্ষাস্নাত প্রকৃতি আস্তে আস্তে যুবতি হচ্ছে৷ জলের স্বচ্ছ ফোঁটা পাতায় পাতায় দ্যুতি ছড়িয়ে হাসছিল৷ প্রচণ্ড গরমের ক্লান্তিকর ঘামের দাগ নিশ্চিহ্ন করতেই এই ধারাস্নানের উদ্যোগ! যেন সারাদিনের কাজকর্ম সেরে গৃহিণী সান্ধ্যস্নান করছেন৷ তাঁর অনিন্দ্যসুন্দর মুখ চুঁইয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে ঝরে জলবিন্দু৷

গহন ক্লান্ত দৃষ্টিতে বন্ধ জানলার দিকে তাকিয়েছিলেন৷ বৃষ্টি নয়৷ দ্রষ্টব্য বিষয় নিজের মুখের প্রতিচ্ছবি৷ কাচের জানলায় তাঁর নিজের মুখেরই প্রতিবিম্ব পড়ছিল৷ সেই প্রতিবিম্বের ওপর দিয়ে বৃষ্টির জল সরলরেখা টেনে টেনে চলে যাচ্ছে৷ তিনি আপনমনেই গুনছিলেন, কটা সরলরেখা দাগ ফেলে গেল তাঁর মুখে!

তার মধ্যেই কানের কাছে কে যেন উচ্ছ্বাসিত হয়ে কবিতার কয়েকটা লাইন আউড়ে গেল৷ সে বেচারারও দোষ নেই৷ ছোকরা উঠতি কবি৷ বেশ কয়েকটা লিটল ম্যাগাজিনে তার লেখা বেরিয়েছে৷ একেই অত্যুৎসাহী তরুণ কবি, তার ওপরে এমন সুন্দর বর্ষণমুখর পরিবেশ৷ সবমিলিয়ে রোমান্টিসিজমের চূড়ান্ত৷ ধাক্কাটা সামলাতে পারেনি৷ উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলে গেল কবিতার কয়েকটা লাইন—‘জলের সঙ্গে আমার ছায়া বলছে আমার কথা৷ জল বোঝে না কোনটা কথা কোনটা প্রগলভতা…!’

পনেরো…ষোলো…সতেরো…আঠারো…৷ গহন তখনও একমনে জলের সরলরেখার সংখ্যা গুনে যাচ্ছিলেন৷ হঠাৎই অঙ্কের মধ্যে দ্রাম করে আছড়ে পড়ল কাব্য! কবিতার গুঁতোয় খেই হারিয়ে ফেলেন তিনি৷ গভীর চোখদুটো জানালার দিক থেকে ফিরল আবৃত্তিকারের দিকে৷ অবিমিশ্র বিরক্তি ভেসে উঠছে চোখদুটোয়৷

আবৃত্তিকার সেই চাউনি দেখেই থতোমতো খেয়ে চুপ করে গেল৷ গহন মুখে কিছু বলেননি৷ কিন্তু তাঁর চোখদুটো আদ্যন্ত ভাষাময়! সেই চোখই যেন বিরক্তিমিশ্রিত কণ্ঠস্বরে বলে উঠল—‘চুপ করো৷’

উঠতি কবি কাব্যে ক্ষান্ত দিল৷ তার পিছনে একটা ছোটোখাটো ভিড়ও বসেছিল৷ সদ্য গোঁফ-দাড়ি গজানো কবি, কিংবা পোড় খাওয়া, জুতোর শুকতলা খইয়ে ফেলা কবি, অথবা লিটল ম্যাগাজিনে দুর্বোধ্য প্রেমের দুর্বোধ্যতর কবিতা লেখা কবি—সব নমুনাই পাওয়া যাবে সেই ভিড়ে৷ সপ্তাহান্তে ছুটির দিনে ওরা এসে আড্ডা জমায় গহনের বাড়িতে৷ গহন ওদের আসতে বলেন না৷ তবু ওরা আসে৷ ওদের সবাইকে চেনেনও না৷ কিন্তু ওরা সবাই তাঁকে চেনে৷ নিজেদের চেনাতেও চায়৷ এককথায় ওরা ‘ভক্তবৃন্দ’৷

অথচ গহনের কাছে ওরা ‘ভিড়’৷ যখন দল বেঁধে আসে তখন মনে হয় ‘কী জ্বালাতন!’ যখন কলকণ্ঠে তাঁর কবিতার প্রশংসা করে আর ক্ষণজন্মা কলমটা এখন থেমে গেছে বলে আক্ষেপে মাথা নাড়ায়, কেন লিখছেন না সে বিষয়ে বারবার প্রশ্ন করে, তখন ভাবেন—কতক্ষণে ‘যাবে!’ আর যখন বেশ কিছুটা সময় নষ্ট করে সদলবলে তাঁকে প্রণাম করে বিদায় নেয় তখনই তাঁর আত্মা কানে কানে বলে ওঠে ‘বাঁচা গেল৷’

তবে এই সবকটা বাক্যই থাকে মনের ভেতরে৷ মনের গণ্ডি পেরিয়ে কখনও মুখে আসে না৷ ভক্তবৃন্দরা ভিড় জমিয়ে প্রশংসাবাক্যে ভরিয়ে দিতে শুরু করলেও তাঁর মুখ নির্লিপ্তই থাকে৷ যেন ওরা গহনের কথা নয়, কোনো থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বারের কথা বলছে! আস্তে আস্তে সেই প্রশংসা যখন ‘অতিশয়োক্তির’ রাস্তা ধরে ‘স্তুতি’ হয়ে ‘চাটুকারিতায়’ পৌঁছায় তখনও গহন মুখে কিছু বলেন না৷ বরং নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে মাথার ওপরে ঘুরন্ত পাখাটার দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন৷ যেন এ যাবৎ যত নারীদের নিয়ে তুমুল প্রেমের কবিতা লিখেছেন—সেই নিশিগন্ধা, শ্রেয়সী, প্রিয়ম্বদাদের কেউ মাথার চুল ধরে ফ্যানের ব্লেডের সঙ্গে বেঁধে দিয়েছে! অনুরাগীরাও অগত্যা সেই ফ্যানের দিকেই তাকিয়ে থাকে৷ তাদের অনুমান যখন এই ‘প্রাজ্ঞ’, ‘আদ্যোপান্ত ইনটেলেকচুয়াল’ বিখ্যাত কবিটি মাথার ওপরের তিন ব্লেডওয়ালা পাখাটার প্রতি এত মনোযোগ দিয়েছেন, তখন নিশ্চয়ই ওটার মধ্যেও কোনো বিশেষ কাব্যিক অনুপ্রেরণা আছে৷ বলা যায় না—কোনোদিন হয়তো আবার তাঁর থেমে যাওয়া কলম থেকে বেরিয়ে আসবে যুগান্তকারী কোনো কবিতা, যার নাম ‘প্রাত্যহিক পাখার গুজরান!’

মোদ্দা কথা হল, কাব্যিক রূপকের বাইরের বাস্তব ঘটনা—যাকে ফ্যাক্ট বলে, সেটাই কেউ বুঝে উঠতে পারে না৷ কবি গহন দত্তগুপ্ত যে ওদের তাড়াতে পারলে বাঁচেন এই সত্যিটা কাব্যময় কল্পনায় ধরা পড়ে না৷ অগত্যা প্রায় মিনিট পঁয়তাল্লিশ কবি ও তাঁর ভক্ত—উভয়পক্ষই ফ্যানের দিকে তাকিয়ে নীরব হয়ে থাকে৷ অবশেষে একসময় তারা নিজেরাই অস্বস্তি বোধ করে৷ কবির ভাবতন্ময়তাকে ভেঙে দেওয়া উচিত নয়—একথা বিবেচনা করে সদলবলে গাত্রোত্থান করে৷ গহন শান্তভাবে ওদের বিদায়পর্ব দেখেন, এবং বলাই বাহুল্য হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন৷

এই গোটা ঘটনায় কিন্তু কবির নিজস্ব সংলাপ বিশেষ থাকে না৷ এমনিতেই তিনি অন্তর্মুখীন মানুষ! ‘হ্যাঁ’, ‘হুঁ’, ‘না’, ‘উহুঁ’র বেশি কিছু বলতে চান না৷ যা বলার তা তাঁর অনুরাগীরাই বলেন৷

কিন্তু আজ নিয়মের ব্যতিক্রম হল৷ তাঁর প্রতিচ্ছবির ওপরে জলের সরলরেখার সংখ্যা গোনায় ব্যাঘাত ঘটায়, আক্ষরিক অর্থেই রেগে গেলেন গহন৷ তাঁর চোখে বিরক্তির পাশাপাশি এবার রাগও ফুটে উঠেছে৷ যে বেচারা উচ্ছ্বাসিত হয়ে কবিতাটা আবৃত্তি করছিল, সমস্ত ক্ষোভ গিয়ে পড়ল তার ওপরেই৷

শান্ত অথচ বিরক্ত কণ্ঠে বললেন—‘কে লিখেছে এ কবিতাটা? তুমি?’

আবৃত্তিকার ঢোঁক গেলে৷ আশপাশের ভিড়টাও স্তম্ভিত হয়ে পরস্পরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করছে৷ কী বলবে যেন ভেবে পাচ্ছে না৷

গহন অবশ্য বলার অপেক্ষাও করেননি৷ সংযত অথচ উষ্মামিশ্রিত গলায় বলেন—‘অর্থহীন যত প্রলাপ৷ কেন যে এসব লেখো!’

কথাগুলো ঠিক কাব্যিক শোনাল না! ভিড়টা সচকিত হয়ে ওঠে৷ এতক্ষণের ভাবজগৎ থেকে একধাক্কায় তাদের বাস্তবে ফিরিয়ে এনেছেন কবি স্বয়ং৷ এবার বুঝতে অসুবিধা হল না যে গহন বিরক্ত হয়েছেন৷

—‘কবিতা ছাড়া তোমাদের কি আর কোনো বক্তব্য নেই?’ অশান্ত কণ্ঠস্বরে চাপা রাগ ঝরে পড়ল৷ বোধহয় সেই রূঢ়তার আঁচ তিনি স্বয়ংই উপলব্ধি করেন৷ আস্তে আস্তে পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে নিয়ন্ত্রণে আনেন৷ মানুষের কাছে কবি গহন দত্তগুপ্ত ‘জেন্টলম্যান’৷ বহুদিনের ইমেজটাকে একদিনেই ভেঙে ফেলার ইচ্ছে নেই৷

তিনি এবার অপেক্ষাকৃত শান্ত গলায় বললেন—‘আমি দুঃখিত, কিছু মনে কোরো না৷ আজ আমায় একটু বেরোতে হবে৷ ইফ ইউ প্লিজ অ্যালাউ মি…৷’

—‘নিশ্চয়ই…দাদা…নিশ্চয়ই…৷’

মুহূর্তের মধ্যে ঘর ফাঁকা হয়ে গেল৷ তিনি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন৷ কাচের জানালার দিকে দৃকপাতও না করে উঠে গেলেন বেডরুমের দিকে৷ এই মুহূর্তেই বিরক্তিটা ঝেড়ে ফেলা দরকার৷ নয়তো সারাদিন আপনমনেই খুঁতখুঁত করে বেড়াবেন৷ যাকে-তাকে খিঁচিয়ে উঠবেন৷ সেটা কাম্য নয়৷

বেডরুমে তখন গহনের সহধর্মিণী স্মৃতিকণা বালিশে ভর দিয়ে শুয়ে বাইরের বৃষ্টি দেখছিলেন৷ এই মহিলা অতীতে রীতিমতো সুন্দরী ছিলেন৷ এখন সেই সৌন্দর্যের সিংহভাগই কেড়ে নিয়েছে দুরারোগ্য ক্যানসার! গত দু-বছর ধরেই রোগটার সঙ্গে লড়তে লড়তে একে একে বিসর্জন দিয়েছেন যাবতীয় সৌন্দর্য৷ শুধু কাঠামোটাই বাকি আছে৷

নারীর সবচেয়ে বড়ো সৌন্দর্য তার মাথার ঘন চুল৷ কেমোথেরাপির সৌজন্যে এখন তা-ও নেই৷ তবু কণার মুখখানা ভারী মায়াবী! যৌবন, সৌন্দর্য, সুস্থতা—সব গেছে৷ কিন্তু অন্তরের মায়া, মমতা, স্নেহ কেড়ে নিতে পারেনি দুর্দান্ত রোগটা৷ সেই মায়াবী চোখদুটোই বৃষ্টির দৃশ্যপট থেকে সরে গিয়ে ন্যস্ত হল স্বামীর ওপর৷ তাঁর প্রেমিক পুরুষ! চিরকালই বড়ো মুখচোরা, লাজুক প্রকৃতির৷ এখনও এমন লাজুক লাজুক ভঙ্গিতে বেডরুমে ঢুকছেন, যেন সদ্যপরিণীতা স্ত্রীর কাছে সবাইকে লুকিয়ে-চুরিয়ে আসছেন৷ কেউ দেখে ফেললেই কেলেঙ্কারির একশেষ!

কণা গহনের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হেসে বলতে শুরু করলেন, ‘জলের সাথে আমার ছায়া, বলছে আমার কথা/জল বোঝে না কোনটা কথা, কোনটা প্রগলভতা…৷’

গহন এগিয়ে এসে বিছানার ওপর বসতে যাচ্ছিলেন৷ কিন্তু তার আগেই থমকে গেছেন৷ স্ত্রী আরও কিছু বলার আগেই অ্যাবাউট টার্ন মেরে বাইরের দিকে পা বাড়ালেন৷

কণা এমন পরিস্থিতির জন্য আগেভাগেই প্রস্তুত ছিলেন৷ শীর্ণ হাতটা বাড়িয়ে খপ করে চেপে ধরেন স্বামীর হাত—‘পালাচ্ছ কোথায়?’

রাগতস্বরে উত্তর এল—‘যেখানে প্যানপ্যানে বৃষ্টি আর এই অপদার্থ কবির অপদার্থতর কবিতাটা নেই৷’

কণা মনে মনে হাসছেন৷ যদিও মুখে নিপাট গাম্ভীর্য—‘কবি অপদার্থ— এইটুকু তথ্যেই খুশি? বাকি তথ্যগুলো জেনে যাবে না?’

গহন ঘুরে দাঁড়িয়ে ভাসা ভাসা চোখজোড়া স্ত্রীর চোখের ওপরে রেখেছেন৷ তাঁর দৃষ্টি সপ্রশ্ন৷

—‘কবিতার নাম ‘জলসই’৷ কাব্যগ্রন্থের নাম ‘শিশিরের শব্দ’৷ প্রকাশিত হয়েছে ২ জুন ২০০৬-এ৷ প্রায় হট কেকের মতোই বিক্রি হয়েছে৷ এখনও মাঝেমধ্যে বেস্ট সেলারের লিস্টে দেখতে পাই৷ লিখেছিলেন এক সুদর্শন রোমান্টিক কবি৷ ঘটনাচক্রে তাঁর নামও গহন দত্তগুপ্ত৷ এবং আরও কাকতালীয় ব্যাপার যে তিনিও আমারই স্বামী৷’ কণা ফিক করে হেসে ফেলেছেন— ‘আবৃত্তিকার বেচারা খামোকাই ধমক খেল৷’

গহন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন৷ তারপর অনুতপ্তভঙ্গিতে স্ত্রীর হাতদুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নিলেন৷

—‘আই অ্যাডমিট কণা৷’ বিছানায় বসে পড়ে বললেন তিনি—‘অন্যায় হয়েছে৷ আগেই বোঝা উচিত ছিল, এই জাতীয় অর্থহীন, অপদার্থ, কবিতা একমাত্র আমি ছাড়া আর কেউই লিখতে পারে না৷’

কণা বড়ো সস্নেহে সগর্বে তাকান স্বামীর দিকে৷ গহন সদ্য সদ্যই সাতচল্লিশ পেরিয়েছেন৷ কিন্তু এখনও মানুষটাকে চল্লিশ বলে অনায়াসেই চালিয়ে দেওয়া যায়৷ গায়ের রং এতটাই কালো যে বাবা-মা আদর করে নাম রেখেছিলেন ‘গহন’৷ কালো হলেও মুখখানা ভারী লাবণ্যময়৷ সবচেয়ে সুন্দর তাঁর চোখদুটো৷

দৃষ্টির গভীরতাতেও ‘গহন’ সার্থকনামা৷

তাঁদের কোনো সন্তান-সন্ততি নেই৷ গোড়ার দিকে তা নিয়ে আপসোস থাকলেও এখন আর দুঃখ করেন না কণা৷ স্বামী আর সন্তান এই দুই সত্তাই একসঙ্গে গহনের মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন৷ তাই যখন স্বামীর দিকে তাকান তখন সেই চাউনিতে স্ত্রীর প্রেম আর মায়ের বাৎসল্য—দুই-ই মিশে যায়৷

বেডরুমের খোলা জানালা দিয়ে উত্তাল হাওয়ার ঝাপটায় বৃষ্টির ছাঁট এসে পড়ছিল কণার চোখে৷ বিন্দু বিন্দু জল মহা আহ্লাদে গড়াগড়ি দিচ্ছে তাঁর কপালে, গলায়, গালে৷ তিনি বৃষ্টির খামখেয়ালিপনাকে প্রশ্রয় দিচ্ছিলেন৷ তাঁর ভালোই লাগছিল৷ কিন্তু গহনের ভালো লাগল না৷ তিনি সপাটে জানলা বন্ধ করে দিয়েছেন৷

কণা ব্যথিত হলেন—‘এ কী! জানলা বন্ধ করলে যে!’ সশব্দে জানালা বন্ধ করতে করতে বললেন গহন—‘আই হেট রেন…আই জাস্ট হেট ইট…৷’

‘সে কী! কবির বৃষ্টি পছন্দ নয়!’ তিনি বিস্মিত—‘বরং কবিরাই তো বৃষ্টি বেশি পছন্দ করেন৷ কবিগুরুও করতেন…৷’

—‘কবিগুরু পছন্দ করতেন বলে আমাকেও করতে হবে?’ গহনের কণ্ঠস্বর এখনও মোলায়েম৷ এটাই তাঁর টোন৷ এর বেশি রূঢ় বা উঁচুস্বরে তিনি কথা বলেন না৷ কিন্তু তার মধ্যেই ফুটে উঠেছে প্রবল বিরক্তি—‘কবিগুরু তো একহাত লম্বা দাড়িও রাখতেন, জোববাও পরতেন৷ তাই বলে কি আমিও ওইরকম দাড়ি রেখে জোববাধারী হয়ে বসে থাকব? তা ছাড়া গুরুপত্নীর সর্দি-কাশি-জ্বর হলে তিনি দাদুরি, ময়ূর, ঝিল্লিকে ছেড়ে—প্যারাসিটামল, থার্মোমিটার, আর ভিক্স ভেপোরাব নিয়ে চর্চা করতেন কিনা জানা নেই৷ কিন্তু আমাকে করতে হয়৷’

—‘হুঁ’, কণা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন—‘ভুলেই গিয়েছিলাম যে আধখানা ফুসফুস নিয়ে বেঁচে আছি৷’

গহন তাঁর দিকে তাকিয়েছেন৷ এবার তাঁর দৃষ্টিতেও অপরিসীম বেদনা— ‘আমি কি তাই বলেছি?’

—‘না তুমি বলোনি!’ তিনি ম্লান হাসলেন—‘আ ফ্যাক্ট, কান্ট বি ডিনায়েড৷ আমার থিম সং হওয়া উচিত ‘সমুখে শান্তি পারাবার, ভাসাও তরণী’…৷’

—‘চোপ!’ কবির চোখে-মুখে রাগ ফুটে উঠেছে—তুমি ক্যানসার পেশেন্ট নও৷ ক্যানসার কিয়োরড৷ এ নিয়ে আর-একটাও বাজে কথা বলবে না৷ যতসব ডেইলি সোপের নায়িকা মার্কা ডায়লগ৷’

‘হুম৷’ কণা গহনকে আরও রাগিয়ে দিতে চাইছিলেন৷ রেগে গেলে কবিবরকে ভারী চমৎকার লাগে৷ তিনিও মজা পান৷

—‘দিস ইজ নট দ্য হোল ট্রুথ৷’ গোবেচারার মতো স্বরে বললেন—‘আমার রোগের ঠ্যালায়—তোমার নিশিগন্ধা, শ্রেয়সীরা সবাই পালিয়ে গেছে৷ দিনরাত বউয়ের সেবা করছ৷ তাই সরস্বতী অবহেলিত৷’

—‘ডোন্ট বি সিলি৷’ তিনি সত্যিই রেগে গেছেন—‘কে বলেছে তোমার জন্য আমি লেখা ছেড়েছি? আমার লাস্ট বই—২০০৬-এ প্রকাশিত৷ তারপর থেকে আর-একটি কবিতাও লিখিনি৷ তোমার রোগ ধরা পড়েছে ২০০৯-এ৷ আমার লেখা ছেড়ে দেওয়ার তিন বছর পর! একটা বাচ্চা ছেলেও বুঝতে পারবে যে, তোমার অসুস্থতার সঙ্গে আমার লেখা ছাড়ার কোনো সম্পর্ক নেই৷’

—‘তাহলে কীসের সঙ্গে সম্পর্ক আছে? কোনো উদ্ভিন্নযৌবনার সঙ্গে পরকীয়ায় ব্যর্থ হয়েছ?’

রাগতে গিয়েও এবার ফিক করে হেসে ফেলেছেন গহন৷ হাসতে হাসতেই বললেন—‘ইউ আর সিম্পলি ইম্পসিবল কণা৷ গান শুনবে? বলো কী চালাব?’

—‘শীলা কি জওয়ানি! আছে?’

প্রখ্যাত কবি তির্যক দৃষ্টিতে সহধর্মিণীর দিকে তাকিয়েছেন৷

কণা নির্লিপ্ত মুখে জানালেন—‘তোমার কথামতো আমি ক্যানসার কিয়োরড৷ তাই এখন ডেইলি সোপের নায়িকার মতো ডায়লগ দেওয়া অ্যালাউড নয়৷ অন্তত আইটেম নাম্বারের সঙ্গে নাচতে তো পারিই৷’

—‘না৷ তাও পারো না৷’ তিনি হাসছেন—‘তাতে হাড় ভাঙার প্রবল সম্ভাবনা৷ বরং আমার পছন্দের গান শোনো৷’

—‘বেশ৷’

ডি. ভি. ডি প্লেয়ারে বেজে উঠল রবীন্দ্রসংগীত৷ কণা চোখ বুজলেন৷ তাঁর প্রিয় গানটা চালিয়েছেন গহন৷ বর্ষার প্রগলভ মুখরতাকে ছাপিয়ে গমগম করে উঠল কবিগুরুর গান৷

তিনি স্বামীর বুকে মাথা রেখেছেন৷ যে প্রশ্নটা দিনরাত আজকাল তাঁকে তাড়া করে বেড়ায়, যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে নিজেকেই বারবার কাঠগড়ায় তুলেছেন, সেটাই ক্রমাগত মনের মধ্যে ফিরে আসছিল৷ গহনের বুকে মুখ গুঁজে প্রশ্নটা স্তিমিত কণ্ঠে করে ফেলেন কণা—

—‘একটা কথা বলবে? উঁ?’

গহন অন্যমনস্কভাবে বলেন—‘কী?’

—‘তুমি আর কবিতা লেখো না কেন?’ অদ্ভুত স্বচ্ছ চোখজোড়া তুলে অতিপ্রিয় মানুষটার দিকে তাকিয়েছেন তিনি৷ কণ্ঠস্বরে ব্যাকুল বেদনা—‘গহন, তোমার তো ক্যানসার হয়নি! তবে?’

গহন দীর্ঘশ্বাস ফেলেন৷ আলগোছে স্ত্রীর মাথাটা বুকে চেপে ধরেছেন৷ এ কথার কোনো জবাব হয় না৷ ক্যানসারের চেয়েও যে গভীর অসুখে আক্রান্ত তিনি, সে কথা কণাকে কী করে বোঝাবেন!

তাঁর বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বৈপরীত্য সৃষ্টি করে, মিউজিক সিস্টেমে তখনও বাজছে উচ্ছ্বাসিত সুর—

—‘প্রাণ ভরিয়ে, তৃষা হরিয়ে, মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ…৷’

‘আবার জীবন পেলে দেখাতাম কাশ ভাঙা ঢেউ
বেরং দেয়ালে চাপা পড়ে গেছে জীবনের সোঁতা
আবার কখনও যদি হয়ে আসি আমি আর কেউ
তোমায় দেখাব ফের পরিশেষে বড় হয়ে ওঠা৷’

চশমার শোরুমের মালিক তন্ময় হয়ে কবিতার লাইন আওড়াচ্ছিল৷ তার সামনের ক্রেতাটির তখন করুণ দশা৷ চোখের ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনের আধখানা তার হাতের মুঠোয়, বাকি আধখানা লোকটার উপুড় করা তালুতে আটকে আছে৷ একান্ত ইচ্ছে গোটা প্রেসক্রিপশনটাই হাতিয়ে নিয়ে এখান থেকে চম্পট দেওয়ার৷ কিন্তু কাগজটা ছিঁড়ে যাওয়ার ভয়ে বেশি টানাটানিও করা যাচ্ছে না৷ অগত্যা ক্রেতাটি বাধ্য হয়েই মিউমিউ করে বলে—‘দাদা…আপনি বুঝতে পারছেন না৷ আমার চশমাটা ভীষণ দরকার৷ আ-র্জে-ন্ট৷’

‘আর্জেন্ট’ শব্দটার দীর্ঘায়িত উচ্চারণও শোরুমের মালিকের ভাবান্তর ঘটায় না৷ বরং উলটে সে ক্রেতাটিকে এক ধমক দিয়ে বলে—‘ধুর মশাই, চশমা পরে হবে, আগে কবিতা শুনুন৷ গহন দত্তগুপ্তের কবিতা পড়েছেন কখনও?’

—‘কিন্তু আমার চশমা…..৷’

—‘চশমার নিকুচি করেছে৷’ লোকটি ভয়াবহ রেগে গিয়েছে—‘কবিতা পড়েন না, শোনাতে চাইলে শোনেন না৷ জানেন, এই কবিতাটা কোন ছন্দে লেখা? মিশ্রকলাবৃত্ত৷ সবচেয়ে সুরেলা আর মিষ্টি ছন্দ৷ জীবনানন্দ এই ছন্দে গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতা লিখে গেছেন৷ জানেন এসব? জানেন না৷ জানার ইচ্ছেও নেই৷ খালি তখন থেকে ‘চশমা…চশমা’ করে লাফাচ্ছেন৷ কী হবে মশাই চশমা দিয়ে, যদি কবিতাই না পড়লেন!’

কবিতার সঙ্গে চশমার যে কী সম্পর্ক, বলাই বাহুল্য ক্রেতাটির মাথায় ঢুকল না৷ সে অসহায় দৃষ্টিতে শোরুমের অন্যান্য কর্মচারীদের দিকে তাকায়৷ হয়তো করুণ সাহায্য প্রার্থনাও ছিল সে দৃষ্টিতে৷ কিন্তু আবেদন রাখবে কোথায়? কর্মচারীরাও তস্য অসহায়ভাবে তারই দিকে তাকিয়ে আছে৷

ক্রেতাটির জানার কথা নয় যে, এই নাটক এখানে প্রথমবার অভিনীত হচ্ছে না৷ শোরুমের মালিক এখানে নিজে উপস্থিত না থাকলে সবকিছুই শান্তিপূর্ণভাবে হয়ে যেতে পারত৷ এমনকি তার চশমাটাও সঠিক পাওয়ারের লেন্সে সেজেগুজে দৃষ্টিশক্তিকে আরও সবল করে তুলত নিঃসন্দেহে৷ কিন্তু মালিক উপস্থিত থাকলেই বিপদ৷ কবি হওয়ার স্বপ্ন বুকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত যে লোকটা সাধারণ চশমার দোকানি হয়েই থেকে গেল, তার বেদনা বোঝার জন্য ব্যস্ত মহানগরীতে বিশেষ কেউ নেই৷ আর সেটাই হয়েছে যত নষ্টের গোড়া৷ সুযোগ পেলেই সে চশমার বদলে কবিতা বিতরণ করতে বসে৷ ক্রেতারা আজকাল তাকে দেখলেই পালিয়ে যায়৷ কারণ এ চত্বরের সবাই জেনে ফেলেছে যে এ শোরুমে চশমার অর্ডার দিতে গেলেই প্রথমে শুনতে হবে সাগ্রহ প্রশ্ন—‘চশমার কথা পরে বলছি, আগে বলুন কবিতা-টবিতা পড়া হয়? কার কার কবিতা পড়েছেন?’

সদ্য আগত ক্রেতাটি এতসব জানত না৷ বাধ্য হয়েই সে প্রায় কাঁদো কাঁদো মুখে বলে—‘স্যার, চশমা লাগবে না৷ প্লিজ আমায় ছেড়ে দিন৷’

—‘বেশ, চশমা থাক৷’ বিক্রেতা তাকে প্রেসক্রিপশনটা ফেরত না দিয়েই বলে—‘কিন্তু কবিতা না শুনিয়ে আপনাকে ছাড়ছি না৷’

অগত্যা বেচারাকে নিমের পাঁচন গেলার মতো মুখ করে কবিতা শুনতে হল৷ শুধু কবিতাই নয়, তার পিছন পিছন এল মিশ্রবৃত্ত, কলাবৃত্ত, দলবৃত্তের থিসিস৷ নানারকম বৃত্তের ঠ্যালায় যখন সে প্রায় চারকোনা হতে চলছে, ঠিক তখনই ঈশ্বর দয়াপরবশ হয়ে দেবদূত পাঠিয়ে দিলেন৷ শোরুমের কাচের দরজা ঠেলে এক দারুণ সুদর্শন পুরুষ ঢুকলেন৷ তাকে দেখেই কাব্যবিশারদ হইহই করে উঠেছে—‘কী কাণ্ড! একশো বছর বাঁচবি দেখছি৷ এই মাত্রই তোর কথা হচ্ছিল৷’

ক্রেতাটি একঝলক তার রক্ষাকর্তার দিকে দেখল৷ পরক্ষণেই তার নজর গেল প্রেসক্রিপশনটার দিকে৷ এতক্ষণ ওটা বিক্রেতার হাতের তলায় চাপা পড়েছিল৷ এখন অসতর্কভাবেই লোকটা হাত তুলে নিয়েছে৷ এই সুযোগ৷ এবং সে সম্পূর্ণ সদব্যবহার করল৷ ক্ষিপ্রগতিতে প্রেসক্রিপশনটা তুলে নিয়ে এমন দৌড় মারল যে-অলিম্পিকের দৌড়বীরও লজ্জা পাবে৷

গহন সকৌতুকে লোকটির ড্রামাটিক টেম্পোয় প্রস্থানপর্ব দেখলেন৷ তারপর মুচকি হেসে বললেন—‘এ মাসে এই নিয়ে কটাকে ভাগালি?’

—‘যাঃ, পালিয়ে গেল!’ কাব্যবিশারদ আমসির মতো মুখ করেছে—‘এই নিয়ে সাড়ে পাঁচ’৷

—‘সাড়ে পাঁচ!’

—‘এদের মধ্যে একটা হাফও ছিল তো! আই মিন বাচ্চা৷’

গহন সবিস্ময়ে বন্ধুর দিকে তাকিয়েছেন—‘শুঁটকি, তুই আজকাল—বাচ্চাদেরও ছাড়ছিস না!’

—‘বাচ্চা আবার কী!’ শুঁটকির চেহারাটা সত্যিই শুঁটকি মাছের মতো৷ শুকিয়ে প্রায় নারকেলের দড়ি হয়ে গেছে৷ শিরা বের করা শীর্ণ হাত নাড়িয়ে সে বলে—‘ওটা বাচ্চা নয়, চৌবাচ্চা৷ চোখের পাওয়ার কত জানিস? মাইনাস ফাইভ! দুনিয়ার সবকিছু জানে৷ ইংরেজি কবিতা গড়গড় করে বলে৷ রা-ওয়ানের হিরোইনের নাম থেকে শুরু করে ফেসবুক, টুইটার অবধি হেন জিনিস নেই যা জানে না৷

—‘তাতে কী!’ তিনি আস্তে আস্তে বলেন—‘আজকালকার বাচ্চারা অনেক অ্যাডভান্স৷ ওরা অনেক কিছুই জানে৷ তাতে অন্যায়টা কী হয়েছে?’

—‘অন্যায় কিছু হয়নি’, শুঁটকি এবার ভেটকি মাছের মতো ভাবলেশহীন মুখ করেছে—‘সব জানে বলেই জানতে চেয়েছিলাম ‘প্রশ্ন’ কবিতাটা কার লেখা? আমার ধারণা ছিল সেটাও জানবে৷’

গহনের ঠোঁটে একটা স্মিত হাসি ভেসে উঠল—‘উত্তর কি পেলি?’

সে কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে গহনের দিকে তাকিয়ে থাকে৷ তারপর শুকনো মুখে উত্তর দেয়—‘চেতন ভগৎ৷’

তিনি হো হো করে হেসে উঠেছেন৷ দোকানের কর্মচারীরাও মুচকি মুচকি হাসছে৷

—‘তুই হাসছিস!’ শুঁটকি উত্তেজিত—‘বাঙালির বাচ্চা হয়ে রবি ঠাকুরের নাম জানে না৷ এটা তোর খুব মজার জিনিস মনে হচ্ছে?’

তিনি হাসতে হাসতেই বলেন—‘না, মজার কেন হবে? তারপর নিশ্চয়ই তুই রবি ঠাকুরের নাম জানাতে বসলি৷’

—‘হ্যাঁ বসলাম৷’ তার মুখে বিরক্তির ছাপ—‘জানিয়েও দিতে পারতাম, যদি না ওর মা এসে ওকে টেনে নিয়ে চলে যেত৷’

গহন আর-একবার উচ্চস্বরে হেসে উঠতে যাচ্ছিলেন৷ কিন্তু শুঁটকির করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে চেপে গেলেন৷

—‘এরা জীবনে কখনও শঙ্খ, শক্তি, সুনীল পড়বে? কখনও জানবে যে জীবনানন্দ বলে একটা লোক নিঃসঙ্গতার তাড়নায় কী সব কবিতা লিখে গেছে!’ তার কণ্ঠস্বরে হতাশার প্রাবল্য—‘শুধু একটা জিনিসই জানতে পারে৷ যখন কলকাতায় ট্রাম আর থাকবে না, জাদুঘরে ট্রামের মডেল দেখিয়ে ইতিহাস বলা হবে, তখন এক লাইনে জীবনানন্দের সম্পর্কে একটাই তথ্য জানবে এরা৷ ওই নামে একটা বিশ্বট্যালা কবি ছিল৷ লোকটা চাপা পড়ার জন্য ট্রেন, বাস, ট্যাক্সি, মেট্রো—কিছুই খুঁজে পায়নি৷ অগত্যা ওই ঢিকঢিকে ট্রামের তলাতেই তাকে চাপা পড়তে হল! বাঙালির পরবর্তী প্রজন্মের এই অবস্থাই হবে গহন, আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি৷’

শুঁটকির দু-চোখে অপরিসীম বিষণ্ণতা৷ গহন দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে থাকেন৷ শুঁটকি বোধহয় খুব একটা ভুল বলেনি৷ বিশ্বায়নের দাপট আর ইংরেজি মিডিয়ামের দৌলতে হয়তো এমনই একটা ভয়াবহ ভবিষ্যৎ আসতে চলেছে৷ এখনই তরুণ প্রজন্ম বাংলা সাহিত্য এড়িয়ে চলতে শুরু করেছে৷ সাহিত্য বলতে রাউলিং, চেতন ভগৎ, বা ঝুম্পা লাহিড়ি অবধিই বোঝে৷ তারপর আর কিছু নেই৷

—‘ছাড় ওসব কথা৷’ শুঁটকি বলল—‘যত ভাবব ততই ভয় করবে৷ তোর খবর বল৷ এবার কিছু লেখার কথা ভাবছিস?’

—‘নাঃ৷’

—‘কেন?’

এ প্রশ্নের উত্তরে কী বলবেন গহন ভেবে পেলেন না৷ এই প্রশ্নটা শুনতে শুনতে তিনি ক্লান্ত৷ কেন লিখছেন না, কবে আবার লিখবেন, আদৌ আর লিখবেন কিনা—এসব প্রশ্ন রোজই চতুর্দিক থেকে ফণা তোলে৷ কোনোমতে ভুজুং ভাজুং দিয়ে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান৷

কিন্তু শুঁটকির সামনে সেসব যুক্তি ধোপে টিঁকবে না৷ সে তাঁর অনেকদিনের বন্ধু৷ দুজনে একসঙ্গে স্কুলে, কলেজে পড়েছেন৷ একসঙ্গে গাঁজা খেয়েছেন৷ এবং মধ্যরাত্রের কলকাতাকে নেশাজড়িত উচ্চকণ্ঠে কবিতা শোনাতে শোনাতে বাড়ি ফিরেছেন৷ শুঁটকি তাঁকে হয়তো তাঁর নিজের থেকেও ভালো চেনে৷ ওর কাছে মিথ্যে বলার উপায় নেই৷ তবু একটু ইতস্তত করে বললেন—‘আসলে বয়েস হচ্ছে তো৷ এখন আর শিং ভেঙে বাছুর হয়ে গদগদ প্রেমের কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে না৷’

শুঁটকি তাঁর দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায়—‘তুই শালা চিরকেলে এসকেপিস্ট৷ সমস্যার সামনে পড়লে পিঠ দেখিয়ে পালাস৷ আমায় ওসব গপ্প দিস না৷ এমন কিছু বয়েস হয়নি তোর৷ এই তো সুবিমল বিশ্বাসকে দেখ৷ প্রায় আশি বছর হতে চলল বুড়োর৷ এখনও প্রেমিকার কাঁচুলিতে জমা ঘাম নিয়ে চর্চা করছে৷ বয়স দেখাস না আমায়৷ তা ছাড়া প্রেমের কবিতাই লিখতে হবে—এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে? অন্য কিছু নিয়ে লেখ৷’

গহন চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে আছেন৷ শুঁটকিও তাঁর চোখের দিকে নিষ্পলকে দেখছে৷ একমিনিট সে চুপ করে গহনকে জরিপ করল৷ তারপর বলল—‘অ, তুই তো আবার রোম্যান্টিক কবিতা ছাড়া লিখবি না, টিপিক্যাল এসকেপিস্ট! চল৷’

—‘কোথায়?’

—‘পেটে দু-পাত্তর না পড়লে তোর মুখ খোলাতে পারব না৷ আর আমিও সহজে ছাড়ছি না৷’

—‘শুঁটকি….’ গহন নিরুপায় ভাবেই বলেন—‘আজ থাক…….৷’

—‘কিচ্ছু থাকবে না৷’ শুঁটকি প্রায় গর্জন করে উঠেছে,—‘ভালোয় ভালোয় যাবি? না সবার সামনে নর্মদা থেকে নর্দমা হব৷’

এই কথাটার অর্থ খুব ভালোই বোঝেন গহন৷ অর্থাৎ শুঁটকি এবার ভালো ভালো শব্দ ছেড়ে শ-কার, ব-কার, ম-কারের প্যাঁটরা খুলবে৷ ও একবার মুখ খুললে ম্যানহোলও লজ্জা পায়৷ তিনি ঝুঁকি নিলেন না৷ লক্ষ্মী ছেলের মতো শুঁটকির পিছন পিছন পা বাড়ালেন৷

—‘আয়৷’ শোরুমের বাইরে একটু দূরত্বেই শুঁটকির স্টিল কালারের জেন দাঁড়িয়ে আছে৷ গহনের চোখে পড়ল একটি বছর বারো-তেরোর বাচ্চা ছেলে গাড়িটার পাশেই অপেক্ষারত৷ ছেলেটাকে দেখলে ভিখিরি বলেই মনে হয়৷ পরনে একটা শতচ্ছিন্ন নোংরা শার্ট, এবং তার চেয়েও নোংরা একটা হাফপ্যান্ট৷ মাথার চুল রাস্তার ধুলোয় প্রায় সাদা, চোখে একগাদা পিঁচুটি নিয়ে পরম আগ্রহে তাকিয়ে আছে শুঁটকির দিকেই৷

গহন বুঝতে পারলেন না যে বাচ্চাটা এত আগ্রহভরে এদিকেই দেখছে কেন৷ শুঁটকি বুড়ো বা অথর্ব লোক ছাড়া আর কাউকে ভিক্ষে দেয় না৷ বাচ্চাদের তো একেবারেই নয়৷ অথচ ছেলেটার দৃষ্টি স্পষ্ট জানান দিচ্ছে যে শুঁটকিকে সে চেনে৷ এবং তার আগ্রহ নিতান্তই অযৌক্তিক নয়৷

ব্যাপারটা অবশ্য একটু পরেই স্পষ্ট হল৷ শুঁটকি ড্রাইভিং সিটে বসতেই সে জানলার কাছে ঘনিয়ে এসেছে৷ গহন কৌতূহলী হয়ে ব্যাপারটা দেখছিলেন৷ ছেলেটা জানলার কাছে এসে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে—‘বাবু, হয়ে গেছে৷’

শুঁটকি তার দিকে তাকিয়েছে—‘পুরোটা?’

—‘হ্যাঁ৷’

—‘বল দেখি৷’

ছেলেটা একটু যেন থমকাল৷ তারপরই যেন মঞ্চে উঠে আবৃত্তি করছে, এমন ভঙ্গিতে হাতজোড় করে বলল—‘নমস্কার, কবিগুরু রবীন্দোনাথ ঠাকুরের ‘জুতা আবিষ্কার’—কহিলা হবু, শুনগো গবুরায়,/কালিকে আমি ভেবেছি সারারাত্র/মলিন ধুলা লাগিবে কেন পায়/ধরণী মাঝে চরণ ফেলা মাত্র৷’

গহন সবিস্ময়ে দেখছিলেন তাকে৷ যাকে ভিখিরি ভেবেছিলেন সে রীতিমতো গড়গড়িয়ে ‘জুতা আবিষ্কার’ মুখস্থ বলে যাচ্ছে৷ কিছু অমার্জিত উচ্চারণ ছাড়া বাদবাকিটা একদম ঠিকঠাক৷ কোথাও কোনো ভুলচুক নেই৷ এমনকি যেখানে যেখানে যতির ব্যবহার প্রয়োজন, সেখানে সেখানেই থামছে৷ এ কী কাণ্ড!

‘সেদিন হতে চলিল জুতাপরা/বাঁচিল গবু রক্ষা পেল ধরা……৷’ ছেলেটা একনিশ্বাসে কবিতাটা শেষ করে ফেলল৷ শেষ লাইনটা বলে সে সাগ্রহে শুঁটকির দিকে তাকায়৷

—‘ভেরি গুড!’ শুঁটকি তার মাথায় হাত রেখে আদর করে—‘খুব ভালো হয়েছে৷ শুধু উচ্চারণটা আর-একটু ঠিক করতে হবে৷ রবীন্দোনাথ ঠাকুর নয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ বল র-বী-ন্দ্র-না-থ….৷

বেশ কিছুক্ষণ উচ্চারণের তালিম চলল৷ গহন অবাক হয়ে ব্যাপারটা দেখছিলেন৷ একটা ভিখিরি ছেলে রবীন্দ্রনাথ আওড়াচ্ছে! গোটা ব্যাপারটাই তাঁর অবিশ্বাস্য ঠেকছিল! মনে হচ্ছিল স্বপ্ন দেখছেন৷

—‘ঠিক আছে’, তালিম শেষ করে শুঁটকি পকেট থেকে নোট বের করে এগিয়ে দেয় ছেলেটার দিকে৷ গহন আড়চোখে দেখলেন—সেটা পঞ্চাশ টাকার নোট!

—‘নে’, সে স্মিত হেসে বলে—‘এটা দিয়ে মাংস-ভাত খাবি৷ খবরদার, ফেভিকল, ডেনড্রাইটের চক্করে পড়বি না৷ যদি বুঝতে পারি যে ওসব কিনে খাচ্ছিস….৷’

—‘না বাবু৷’ ছেলেটি একশো আশি ডিগ্রি মাথা নাড়ল—‘ওসব খাইনে কো৷’

—‘ভালো৷ এখন যা৷’ শুঁটকি গাড়িতে স্টার্ট দিয়েছে—‘আবার কাল-পরশু নাগাদ আসিস৷ নতুন কবিতা দেব৷’ ছেলেটা মাথা নেড়ে চলে গেল৷ গহন স্তম্ভিত হয়ে ব্যাপারটা দেখছিলেন৷ এবার মৃদু অথচ বিস্মিত স্বরে বলেন—‘শুঁটকি! এসব কী হচ্ছে!’

শুঁটকি অ্যাক্সিলেটরে চাপ দিয়েছে—‘আমার নবতম আবিষ্কার৷ ছেলেটার নাম গোপাল৷ বাপ-মা আদর করে ওই নামই দিয়েছিল৷ আমার শোরুমের উলটোদিকের ফুটপাথে থাকে৷ আয়লা ঝড়ে গাছ ভেঙে পড়ে বাপ-মা দুটোই ফৌত হয়ে গেছে৷ এখন ছেলেটা ফুটপাথে ভিক্ষা করে৷’

—‘সে তো বুঝলাম৷ কিন্তু ‘জুতা আবিষ্কার’…….!’

—‘ওটা আমিই ওকে শিখিয়েছি৷’ সে নির্লিপ্ত গলায় বলে—‘ছেলেটার মেমোরিটা খুব শার্প৷ যাকে বলে শ্রুতিধর৷ বুঝলি, একবার আমার শোরুমে ভিক্ষে চাইতে ঢুকেছিল৷ তখন আমি এক ব্যাটাকে ‘রূপসী বাংলা’ আবৃত্তি করে শোনাচ্ছিলাম৷ লোকটা দু-মিনিট পরেই অবশ্য পালিয়ে বাঁচল৷ আর এ ছোঁড়া আমাকে একবারে চেপে ধরল৷ তিন দিন ধরে নাকি খায়নি৷ টাকা দিতেই হবে৷ জানিসই তো, বাচ্চাদের আমি ভিক্ষে দিই না৷’ শুঁটকির মুখে মুচকি হাসি—‘কিন্তু হতভাগা একবারে নাছোড়বান্দা৷ তাই ভাগানোর জন্য বলেছিলাম, একটু আগেই বলা কবিতার একটা লাইনও যদি ঠিকঠাক বলতে পারে, তবে দশটাকা দেব৷’

‘তারপর?’ রুদ্ধশ্বাসে শুনছিলেন গহন৷

—‘তারপর আর কী?’ সে হাসতে হাসতে বলে—‘সবাইকে অবাক করে দিয়ে ব্যাটা একেবারে চারটে লাইন ঠিকঠাক বলে দিল৷ একবার শুনেই মোটামুটি মাথায় তুলে নিয়েছে৷ খুশি হয়ে চল্লিশ টাকা দিয়ে দিলাম৷ তারপর থেকেই চলেছে এই ট্রেনিং৷ রোজ সকালে এসে একটা করে কবিতা শোনে৷ পরদিন মনে করে আমাকে শোনায়৷ কবিতা ছোটো হলে একবার শুনেই মনে রাখতে পারে৷ বড়ো হলে তিন-চারবার শোনাতে হয়৷’

গহন গোটা বৃত্তান্ত শুনে কী বলবেন ভেবে পেলেন না৷ শুধু অবাক হয়ে বড়ো বড়ো চোখে শুঁটকিকে দেখছিলেন৷ লোকটাকে তাঁর মাঝে মাঝে দুর্বোধ্য ঠেকে৷ একি তার খামখেয়ালিপনা, না অদ্ভুত শখ!

—‘এ ছেলে ভালো ঘরে জন্মালে জজ-ম্যাজিস্ট্রেট হত’৷ শুঁটকি বিমর্ষ মুখে মাথা নাড়ে—‘ভাগ্যের দোষ! যাক গে৷ তুই তোর কথা বল৷ কবিতা লেখাটা ছাড়লি কেন?’

আবার সেই এক প্রসঙ্গ৷ ভবি ভোলবার নয়৷ গহন বিব্রত বোধ করেন৷ এই প্রশ্নটা সামনে এলেই কেমন যেন অসহায় মনে হয়৷ ভেতরে ভেতরে একটা অস্থিরতা টের পান৷ একটা ক্ষোভের মেঘ জমাট বাঁধে বুকে৷

—‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি৷’ সে স্টিয়ারিঙে আলতো করে একটা চাপ মারে—‘তুই সেই কেউ কেউ-এর একজন৷ অথচ এমন কেঁউ কেঁউ করছিস কেন বুঝতে পারছি না৷’

—‘কী হবে কবিতা লিখে?’

—‘কবিতা লিখে কিছু হয় নাকি?’ শুঁটকি জোরে হেসে উঠেছে—‘হয় শুধু হয়ের অণ্ড, আই মিন—ঘোড়ার ডিম! কিছু হওয়ার জন্য তুই কবিতা লিখিস বুঝি! বাজে কথা ছেড়ে সত্যি কথাটা বল৷ আজ আর পালাস না প্লিজ৷’

—‘ঠিক তা নয়৷’ গহন আস্তে আস্তে বলেন—‘আসলে ঠিক বুঝতে পারি না….৷’

—‘কী?’

তিনি ব্যথিত ক্লান্ত দৃষ্টিতে বন্ধুর দিকে তাকিয়েছেন—‘আমি কি আদৌ কবিতা লিখি শুঁটকি?’

—‘হো-য়া-ট!’

শুঁটকি বিস্ময়ের ধাক্কাটা সামলাতে না পেরে সজোরে ব্রেক কষল৷ ড্যাশবোর্ডের ওপর থেকে সিগারেটের প্যাকেট ছিটকে পড়েছে গহনের কোলে৷ ঝাঁকুনির চোটে লকারটাও খুলে গেছে৷ তার ভেতরে পানীয়ের বোতলও চোখে পড়ে৷ শুঁটকি সবসময়ই এ জিনিসটা স্টকে রাখে৷ মদ খাওয়ার জন্য বারে যাওয়া সে পছন্দ করে না৷ তা ছাড়া বিকেলের পর থেকে তার যতটা মদ লাগে, তা সাপ্লাই দিতে কলকাতার যে-কোনো বার ফেল পড়বে৷ মিছরির পানা খাওয়ার মতো সে মদ খায়৷ এই নিয়ে অনেক অশান্তি হয়েছে দুই বন্ধুর মধ্যে৷ শুঁটকির লিভারে আজকাল ব্যথা হয়৷ তবু সে ডাক্তার দেখাবে না৷ মদ খাওয়াও ছাড়বে না৷ গহন কিছু বললেই বলে—‘ডাক্তার আর সুরা দুটোকে একসঙ্গে রাখা যায় না৷ তাই ডাক্তারকেই স্যাক্রিফাইস করতে হল৷’

আজ অবশ্য বিকেল অবধি অপেক্ষা করতে হল না৷ গাড়ি থামিয়েই উত্তেজিত ভঙ্গিতে পানীয়ের বোতল খুলে গলায় ঢেলে দিয়েছে৷ উগ্র ঝাঁঝালো একটা গন্ধ গহনের নাকে ঝাপটা মারল৷ বেশ খানিকটা তরল গলায় ঢেলে যেন একটু শান্ত হল সে৷

—‘তুই কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছিস! প্রায় ত্রিশ বছর ধরে কবিতা লিখে, প্রতিষ্ঠা—খ্যাতির এভারেস্টে উঠে, হাফ-ডজন পুরস্কার পেয়ে—আজ জিজ্ঞাসা করছিস যে তুই আদৌ কবিতা লিখিস কি না! এটা কি নতুন ধরনের কোনো রসিকতা! লেটেস্ট আমদানি করেছিস?’

গহন ক্লান্তভাবে গাড়ির সিটে শরীর এলিয়ে দিয়েছেন৷ এই জন্যই অন্তরের গোপনতম কথাটা কাউকে বলতে চান না৷ কারণ গোটা ঘটনাটাই সবার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকবে৷ কী করে বলবেন যে সত্যিই এই আত্ম-জিজ্ঞাসা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে৷ অদ্ভুত লাগলেও এ কথাটা আদ্যোপান্ত সত্যি৷ তিন দশক ধরে কবিতা লেখার পর আজ গহন দত্তগুপ্ত ভাবছেন—তিনি কি আদৌ কবিতা লিখেছেন? সত্যিই কি তাঁর কবিতারা, কবিতা হয়ে উঠেছে!

—‘তুই বিশ্বাস না করলে আমার কিছু করার নেই৷’ গহন আস্তে আস্তে বলেন—‘কিন্তু এটাই ফ্যাক্ট৷ সত্যিই বুঝতে পারছি না যে, আদৌ আমি কবিতা লিখি কি না!’

—‘বাঃ!’ শুঁটকি বোতলে আরও কয়েকটা চুমুক দেয়—‘আশ্চর্য আবিষ্কার! এই আবিষ্কারের জন্য তোকে একজোড়া নোবেল দেওয়া উচিত৷ এনকোর… এনকোর!’

—‘ইয়ার্কি নয়৷ আমি সিরিয়াসলি বলছি৷ তুই যদি শুনতে না চাস, তাহলে বলতে ইন্টারেস্টেড নই৷’

সে তখনই কথাটার কোনো প্রত্যুত্তর না দিয়ে অনিমেষে তাকিয়ে আছে গহনের দিকে৷ মুখ গম্ভীর৷ শান্ত ভঙ্গিতে দু-এক মিনিট দেখল গহনকে৷ যেন বুঝতে চাইছে যে, তিনি কতটা সিরিয়াস৷ তারপর আস্তে আস্তে বলল— ‘বল, শুনছি৷’

গহনের বোধহয় সত্যিই কোনো মনোযোগী শ্রোতার প্রয়োজন ছিল৷ তিনি মনে মনেই অনুভব করেছিলেন ক্রমাগতই মনের খোলা জানালাগুলো বন্ধ হয়ে আসছে৷ বুকের ভেতরে এই অসহ্য চাপ যে একা একা বেশিদিন বওয়া যাবে না তাও বুঝতে পেরেছিলেন৷ বহুদিনের বন্ধুত্ব আজ তাঁকে হালকা হওয়ার সুযোগ এনে দিল৷

তাঁর চোখ দুটো বিষণ্ণতায় ছেয়ে আছে৷ আস্তে আস্তে বললেন—‘জানি না, প্রবলেমটা তুই কতদূর বুঝবি৷ কিন্তু আমি ক্রমাগত বিভ্রান্ত হচ্ছি৷’

—‘কেন?’

তিনি অন্যমনস্ক—‘তুই তো জানিস, একসময় রীতিমতো লড়াই করেই আমাকে আজকের জায়গায় পৌঁছোতে হয়েছে৷ প্রতিভাবান কবি সে সময়ে কম ছিল না৷ তার ওপর সমালোচনার লাল চোখ! অনেক প্রতিকূলতা ঠেলে আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছি৷ কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এ সবের মানে কী!’

—‘যাচ্চলে! মানে?’

—‘মানে, আজ আমি যেখানে এসেছি সেখানে কোনো লড়াই নেই৷ কোনো সমালোচনা নেই৷ সর্বোপরি কোনো চ্যালেঞ্জ নেই৷’ গহন বলতে বলতেই উত্তেজিত হয়ে ওঠেন—‘অষ্টপ্রহর কানের কাছে একদল ভক্ত আমার গুণকীর্তন করছে৷ যা-ই লিখি সেটাই নাকি মাস্টারপিস! একই লাইন পাঁচবার লিখে, শেষে ‘এখানেই শেষ হোক’ লিখে তিনটে ডট মেরে দিলাম৷ সেটাই নাকি শতাব্দীর সেরা কবিতা! ওই তিনটে ফুটকির ব্যঞ্জনা নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠল৷ অথচ কেউ বুঝলই না যে ওই ডটগুলো আর কিছুই নয়৷ কবি আর কী লিখবেন ভেবে পাননি, তাই ডট বসিয়ে দিয়েছেন৷ রাবিশ!’

এতদিনের পুষে রাখা রাগটা এবার বিস্ফোরণ হয়ে বেরিয়ে এল৷ শুঁটকির মুখে একটা স্মিত অথচ হাসি ফুটে ওঠে৷ সেদিকে না তাকিয়েই গহন বলতে থাকেন—‘‘বড়ো’ ‘বড়ো’ পত্রিকারা লেখা পাওয়ার জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকে৷ আমার ওঁচা লেখাগুলো পর্যন্ত ধরে ধরে ছাপে৷ মিডিয়া, স্তাবক, সমালোচক—সকলে মিলে আমার কবিতাগুলোকে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম কবিতা আর আমাকে প্রায় ভগবান বানিয়ে ছেড়েছে৷ যখন আমার কবিতাই শ্রেষ্ঠ, আমি ঈশ্বরত্ব পেয়েই গিয়েছি তখন লিখব কেন? নতুন করে কিছু তো প্রমাণ করার নেই! কোথাও যাওয়ার নেই! নিজের লেখাকেই অতিক্রম করার চ্যালেঞ্জ নেই৷ কারণ সবই তো মাস্টারপিস, তাকে কি টপকানো যায়?’

শুঁটকি মন দিয়ে গহনের কথা শুনছিল৷ তিনি নেহাত মিথ্যে বলছেন না৷ বাংলা সাহিত্যের বাজারটাই আজকাল এরকম হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ বড়ো বড়ো পত্রিকা, মিডিয়ার প্রচার, ভক্তবৃন্দ কবি-লেখকদের গায়ে গ্রেডেশনের ট্যাগ লাগিয়ে দিয়েছে৷ উনি ‘এ’ গ্রেডের লেখক বা কবি৷ তাই ওঁর সব লেখা চমৎকার হতেই হবে! ইনি ‘বি’ গ্রেডের৷ এঁর ফিফটি পার্সেন্ট লেখা ভালো, ফিফটি পার্সেন্ট মোটামুটি৷ ভক্তবৃন্দ তৈরি হয়েই থাকে ‘বাঃ…বাঃ’ বলার জন্য৷ এই বাহবার পিছনে কতটা যে আন্তরিক প্রশংসা, আর কতটা চাটুকারিতা তা বোঝা মুশকিল৷ পুরস্কারের তালিকায়, মিডিয়ার ফ্ল্যাশের ঝলকানিতে, প্রচারে, বিজ্ঞাপনে, বড়ো বড়ো পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতার চটকদারিতে স্রষ্টা যত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন, তাঁর সৃষ্টি ততই গুরুত্ব হারায়৷ এ যেন হলমার্কের স্ট্যাম্প! যে সোনার গায়ে লাগানো আছে সেটাই খাঁটি! স্ট্যাম্পটাই শেষ কথা—সোনা নয়!

—‘লিখতে হলে খিদে চাই৷ প্রেরণা চাই৷’ গহন হতাশভাবে মাথা নাড়লেন— ‘আমি দুটোই হারিয়ে ফেলেছি৷ আমার পক্ষে আর লেখা সম্ভব নয়৷’

শুঁটকি অর্ধনিমীলিত দৃষ্টিতে কী যেন ভাবছে৷ তার চোখে কী যেন একটা ভাবনার ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছিল৷ অস্থির আঙুলগুলো স্টিয়ারিঙে তবলা বাজাচ্ছে৷

—‘তোর বাড়িতে নেট আছে গহন?’

গহন নির্জীবের মতো চোখ বুজে ছিলেন৷ এই অপ্রাসঙ্গিক কথার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে গেলেন—‘নেট!’

—‘হ্যাঁ৷ ইনটারনেট৷ আছে?’

—‘ইনটারনেট!’ তিনি অবাক হয়ে কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন শুঁটকির দিকে৷ যেন প্রশ্নটার অর্থ বুঝতে পারছেন না—‘হ্যাঁ…আছে৷ মানে… আমার তেমন দরকার পড়ে না৷ কিন্তু কণা বাড়িতে বসে বসে বোর হচ্ছিল বলে……৷’

তাঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সে বলে—‘ইনটারনেট এনেছিস৷ বেশ করেছিস৷ কণা ইউজ করছে, এবার তুইও করবি৷’

গহন তার কথার মাথা-মুন্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না৷ এমনিতেই তিনি কম্পিউটার, ইনটারনেট—এসব এড়িয়েই চলেন৷ উন্নততর প্রযুক্তির প্রতি বিতৃষ্ণায় নয়৷ আসলে ওই জিনিসটার সঙ্গে ঠিক সড়গড় হয়ে উঠতে পারেননি৷

শুঁটকি তাঁর হতভম্ব ভাব লক্ষই করেনি৷ সে তখন সিগারেটের প্যাকেটের ভেতর থেকে রাংতা বের করে এনে কী যেন খসখস করে লিখছে৷

—‘ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বলবি?’ বাধ্য হয়ে তিনি প্রশ্নটা করেই ফেলেন৷

লিখতে লিখতেই সে উত্তর দেয়—‘খোলসা করার কিছু নেই৷ তুই নিজেই একটু আগে বললি যে, মাথায় কিছু আসছে না বলে যেখানে-সেখানে একগুচ্ছ ডট বসাচ্ছিস৷ তোর ডট বেশি হয়েছে৷ তাই ডট কম করার চেষ্টা করছি৷’

—‘মানে?’

—‘মানে এই৷’ কাগজটা এগিয়ে দিয়েছে সে৷ তিনি দেখলেন রাংতার পিছনের দিকে লেখা আছে—‘ডব্ল্যু ডব্লু ডব্লুডট কবিতা ডট কম৷’

—‘কবিতা ডট কম!’ তাঁর চোখ প্রায় ব্রহ্মতালুতে উঠেছে—‘আজকাল কবিতারও ডট কম বেরিয়েছে!’

শুঁটকি এবার মৌজসে সিগারেট ধরায়—‘তুই এখনও সত্যযুগে পড়ে আছিস! পুথিতে কাব্যি করার দিন আর নেই বাচ্চা! এখন লোকে ইন্টারনেটে কাব্যচর্চা করছে৷ ওয়েবজিন, ব্লগ, কম্যুনিটি, গ্রুপ—এমনকি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোতে গেলে দেখবি লোকে নিজের অ্যালবামে কবিতা সেঁটে রেখেছে৷’

গহন চোখ গোল গোল করে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করেন, যদিও পুরো ব্যাপারটাই তাঁর মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে৷ তবু কোনোমতে বললেন—

—‘এটাও কি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট?’

—‘নাঃ’, সে সিগারেটের ছাই ঝেড়ে বলে—‘এটা শুধু কবিতার একটা ওয়েবসাইট৷ ভারত-বাংলাদেশের অনেক কবি—অকবি, অ্যামেচার কবি এখানে কবিতা পোস্ট করে৷ কোনো সেন্সর-টেন্সর নেই৷ বাছাবাছির বালাই নেই৷ যে কেউ এখানে কবিতা দিতে পারে৷ এর অনেকগুলো সুবিধাও আছে৷’

—‘যেমন?’

—‘যেহেতু এটা অনলাইন কবিতার সাইট সেহেতু রেসপন্স অনেক তাড়াতাড়ি পাবি৷’ সে একমুখ ধোঁয়া ছাড়ল—‘প্রিন্টেড ম্যাগাজিনে তুই একটা কবিতা লিখবি, দু-মাস পরে সেটা পাবলিশড হবে৷ তারও একমাস পরে পাঠকের চিঠি আসবে—তবে তুই জানতে পারবি কবিতাটা কেমন লেগেছে৷ এখানে সে-সব ঝামেলা নেই৷ যে মুহূর্তে কবিতাটা পোস্ট করছিস, ঠিক সেই মুহূর্তেই হয়তো দশ-পনেরোটা লোক—অনলাইন হয়ে বসে আছে৷ কম্পিউটারের পর্দায় এক মিনিটের মধ্যেই কবিতাটা পড়ে ফেলবে৷ দু-মিনিটের মধ্যেই রি-অ্যাকশন পেয়ে যাবি৷ একদম ইনস্ট্যান্ট রি-অ্যাকশন৷’

গহন এক মুহূর্ত ভাবলেন—‘হুঁ৷’

—‘দ্বিতীয়ত এখানে তোর পরিচয় কেউ জানতে চাইবে না৷ যে-কোনো ছদ্মনামে তুই কবিতা পোস্ট করতে পারিস৷ মানেটা বুঝতে পারছিস?’ শুঁটকি রহস্যমাখা হাসি হাসে—‘এখানে তোর কবিতার পাশে গহন দত্তগুপ্ত—এ ওয়ান কবির নেমপ্লেটটা থাকবে না৷ বড়ো বড়ো পত্রিকার রেফারেন্সও থাকবে না৷ তোর আইডেন্টিটি ক্যারি করবে শুধু তোর কবিতা৷ কবিতাটা কেমন হল সে সম্পর্কে একদম খাঁটি আর আনবায়াসড রেসপন্স পাবি৷’

তিনি শুঁটকির কথা শুনে সংশয়ান্বিত হয়ে পড়েছিলেন৷ এরকম আবার হয় নাকি! এমন কথা আগে কখনও শোনেননি৷

—‘অত ভুরু কোঁচকানোর কিছু হয়নি৷ তোকে ঠিকানা দিয়ে দিলাম৷ অ্যাপ্লাই করে দ্যাখ৷ কয়েক মিনিটেই জবাব পেয়ে যাবি—যে সত্যিই তোর কবিতা, কবিতা হচ্ছে কিনা৷’

গহন তখনও সংশয় কাটিয়ে উঠতে পারেননি৷ তাঁর মনে একটা অদ্ভুত সন্দেহও ঘনিয়ে আসছিল৷

—‘শুঁটকি, তুই এই সাইটটার খোঁজ পেলি কী করে?’

সে হাসল৷ মাঝেমধ্যেই সে এরকম অদ্ভুত একটা হাসি হাসে৷ হাসিটাকে গহনের, হাসি কম, কান্না বেশি বলে মনে হয়৷

—‘সে প্রসঙ্গ থাক৷’ শুঁটকি হাসতে হাসতে বলে—‘অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি৷ আমি শেষমেশ চশমার দোকানি হয়েছি৷ কিন্তু স্বপ্নটা মরেনি, জানিস৷ বেশিদিন বাঁচব না জানি৷ কিন্তু মরার আগে একবার কবি হতে চাই আমি…শুধু একবারের জন্য কবি হতে…৷’ গহনের বুক ভেঙে দীর্ঘশ্বাস পড়ল৷

.

তোমার খোঁপা এলো হলেই বাদলা নামে
মেললে দু-চোখ লজ্জাহত সূর্য পালায়,
মনের কথা লিখছি রোজই মেঘের খামে
বদ্ধ আখর গুমরে মরে বন্দিশালায়৷
বুকের ভিতর আঁকছি নদী কল্পজালে,
তোমার মতোই অলীক বুঝি আমার চাওয়া
যতই ভাবি পৌঁছে যাব পা বাড়ালে
অনেক চলার শেষেও তোমায় যায় না পাওয়া!

উশ্রী অবিকল বনলতা সেনের মতো চোখ তুলে তাকিয়ে বলল—‘এটা আমাকে নিয়ে লিখেছ?’

—‘হ্যাঁ…তোমাকে নিয়ে৷ শুধু তোমাকেই নিয়ে উশ্রী৷’

উশ্রীর চুল আজ খোলা৷ রেশমের মতো একঢাল ঘন চুল ফুরফুরে হাওয়ায় উড়ছে৷ মন্দারের খুব ইচ্ছে করছিল ওই ঝাঁপিয়ে পড়া মেঘের প্রপাতের নীচে শুয়ে থাকতে৷ নরম, মসৃণ, সুগন্ধি কালো ছায়ায় মুখ ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিতে৷ এমন চুল নিয়ে খেলা করতে না জানি কেমন লাগবে!

কালো কুচকুচে ধনুকের মতো ভুরু বাঁকিয়ে বলল উশ্রী—‘কেন? আমাকে নিয়ে কেন?’

মন্দার উশ্রীর মুখোমুখি ঘন হয়ে দাঁড়াল৷ দু-হাতে তার মোম রঙের সুডৌল মুখ স্পর্শ করে৷ গাঢ় স্বরে বলে—‘আমি তোমায় খুব ভালো…’

‘ভালোবাসি’ শব্দটাই বোধহয় বলতে চেয়েছিল সে৷ হয়তো বলতেও পারত৷ কিন্তু তার আগেই গালে সপাটে একটা বিরাশি সিক্কার চড়! পেল্লায় হাতের এক মোক্ষম চড়ে তার মাথা ঝিমঝিম করে উঠল৷ চোখের সামনে সরষেফুলের দিগন্তবিস্তৃত খেত! সে তখনও ভেবে পায়নি যে উশ্রী তাকে এমন প্রলয়ংকর থাপ্পড় মারল কী করে! অমন নরম-সরম পুতুলের মতো মেয়ের এমন বাঘের থাবার মতো হাত! উশ্রী কি রোজ ডাম্বেল ভাঁজে!

সে কোনোমতে মাথা ঝাঁকিয়ে ধাতস্থ হওয়ায় চেষ্টা করে৷ কানের ভেতর ঢুকে যেন এক ডজন চড়ুই পাখি ঝগড়া লাগিয়ে দিয়েছে৷ চোখ ঝাপসা! তার মধ্যেই কোনোমতে উশ্রীর দিকে সবিস্ময়ে তাকায় মন্দার৷ কিন্তু উশ্রী কোথায়! তার জায়গায় লম্বা-চওড়া কালো একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে! কয়লা লোকটার চেয়ে কালো, না লোকটা কয়লার চেয়ে কালো—তা নিয়ে ডিবেট হতে পারে৷ ভুরু দুটো ঠিক যেন একজোড়া শুঁয়োপোকা৷ সবচেয়ে ভয়ংকর চোখদুটো! মহাভারতের কংসের বোধহয় এমন চোখ ছিল৷ সাজপোশাকও পৌরাণিক সিরিয়ালের ভিলেনের মতো! মাথায় মুকুট, কানে দুল, কবচ, গলায় নীল পাথরের হার!—যেন এইমাত্র রামানন্দ সাগরের সিরিয়াল থেকে নেমে এল!

—‘হা-রা-ম-জা-দা!’ লোকটা দাঁত খিঁচিয়ে বলে—‘বামুনের ছেলে হয়ে উলটো-পালটা মন্ত্র পড়ে! সংস্কৃতের ‘স’-ও জানে না৷ ভুল-ভাল উচ্চারণ করে জীবন অতিষ্ঠ করে ছেড়েছে! আর প্রেম করার সময়ে একেবারে মদন! মাথায় একশো কুড়ি ডাঙস না মেরেছি…..!’

বলতে-না-বলতেই আর এক পেল্লায় থাপ্পড়! মন্দারের মাথা তিনশো ষাট ডিগ্রিতে ঘুরে গেল৷

সে চেঁচিয়ে ওঠে—‘বাঁচাও…বাঁচাও…’

‘কী হল! অমন ষাঁড়ের মতন চ্যাঁচাচ্ছিস কেন?’

কানের কাছে প্রায় কয়েকশো ডেসিবেলের একটা বাজখাঁই গলার আওয়াজ শুনে ধড়মড় করে উঠে বসল মন্দার৷ সদ্য ঘুমভাঙা চোখে কণ্ঠস্বরের মালিককে দেখে আঁতকে উঠেছে! এ কী! এ তো সেই লোকটা! কুচকুচে কালো! ভাঁটার মতো চোখ৷ শুঁয়োপোকা ভুরু! শুধু ‘জয় হনুমান’ মার্কা পোশাকটা ছেড়ে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে এসেছে৷

সে অস্ফুটে বিড়বিড় করে বলে—‘সর্বনাশ! শনিদেব!’

—‘কী বিড়বিড় করে বকছিস!’ লোকটা রেগে গিয়ে বলে—‘ন’টা বাজে৷ স্নানে যাবি না!’

মন্দার এতক্ষণে ধাতস্থ হয়৷ নাঃ, লোকটা স্বপ্ন থেকে নেমে আসেনি৷ বরং ভীষণ রকম বাস্তব৷ ভদ্রলোক অন্য কেউ নন—স্বয়ং তার বাবা! দশটা নয়, পাঁচটা নয়, একমাত্র পিতৃদেব!

ব্যাজার মুখে বিছানা ছাড়ল সে৷ মনমেজাজ খারাপ হয়ে গেছে৷ কেমন সুন্দর একটা রোমান্টিক স্বপ্ন দেখছিল৷ কিন্তু তার মধ্যেও টপকে পড়তে হল পালোয়ানটাকে! লোকটা কিছুতেই তার পিছন ছাড়বে না৷ স্বপ্নে মাধুরী দীক্ষিতের সঙ্গে প্রেম করুক কি উশ্রীর সঙ্গে—ঠিক কোনো-না-কোনো ভাবে এসে বাগড়া দেবেই! আগে তবু দাঁত খিঁচিয়েই ক্ষান্ত হত৷ এখন দুমদাম হাত চালাচ্ছে৷

টয়লেটের দিকে যেতে যেতেই রান্নাঘরের ফ্যাঁচফোঁচ শব্দ পেল সে৷ হাতা-খুন্তিগুলো আজ একটু বেশিই শব্দ করছে৷ বাটি-গ্লাসগুলোও ক্রমাগত ঝনঝন আওয়াজ দিচ্ছে৷ মন্দার বুঝতে পারে, পরিস্থিতি আজ গরম! রান্নাঘরে এত শব্দকল্পদ্রুমের অর্থ একটাই! মা বলতে চাইছেন—‘আমি রেগে আছি’৷

উশ্রী কিন্তু কখনও রাগ করে না৷ সে ভারী মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে৷ ডাইরেক্টর তাকে বকাবকি করলেও শান্ত হয়ে সব কথা শোনে৷ সবসময়ই প্রোডাকশনের লোকদের সঙ্গে খুনসুটি করছে৷ একটা মিষ্টি রহস্যময় হাসি তার ঠোঁটে সবসময়ই লেগে থাকে৷

ভাবতেই মন্দারের মুখেও মুচকি হাসি ভেসে উঠল৷ উশ্রী এ বাড়ির বউ হয়ে এলে রান্নাঘরের হুড়ুম-দুড়ুম কমবে৷

—‘কী ব্যাপার রে?’

তার ছোটো বোন টিকলি ডাইনিং টেবিলে বসে কর্নফ্লেক্স খাচ্ছিল৷ দাদাকে দেখে টিপ্পনী কাটল—‘কাল রাত্রে ইসবগুল খেয়েছিস নাকি!’

মন্দার তার দিকে চোখ গোলগোল করে তাকিয়েছে—‘ইসবগুল! মিন্স!’

—‘না! দিব্যি ‘মোনালিসা’-স্মাইল দিতে দিতে টয়লেটে যাচ্ছিস কিনা!’ টিকলি ফিচ ফিচ করে হাসল—‘রোজ সকালে তোর মুখে ‘উঃ কী চাপ!’ গোছের এক্সপ্রেশন থাকে৷ আজ ‘আঃ কী আরাম’ মার্কা হাসি দিচ্ছিস৷ তাই জিজ্ঞেস করছি—লুবরির বন্দোবস্ত করেছিস কি না৷’

সে কিছুক্ষণ বোনের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে৷ টিকলি হায়ার সেকেন্ডারিতে লজিক নেওয়ার পর থেকেই হঠাৎই যুক্তিপূর্ণ কথা বলতে শুরু করেছে! এমনকি দাদার ওপর ‘দিদিগিরি’ করতেও ছাড়ছে না৷

—‘শ্রীরামকৃষ্ণের সামনের দাঁতের পাটিতে ফাঁক ছিল, মায়েরও আছে৷ তাহলে মা, রামকৃষ্ণ নয় কেন?’ মন্দার হাসল—‘থিঙ্ক ইট……’

টিকলি ঠোঁট ফুলিয়েছে, কর্নফ্লেক্সের বাটি সরিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই ছুটে গেল রান্নাঘরের দিকে৷ বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতেই মন্দার শুনতে পেল সে মায়ের কাছে নাকি সুরে নালিশ জানাচ্ছে—‘দ্যাঁখো মাঁ, দাঁদাভাই কিঁ বলেছেঁ৷ বলেঁ কিনাঁ তোঁমার দাঁতেও ফাঁক আঁছে…রাঁমকৃষ্ণের দাঁতেও…..৷’

দড়াম করে টয়লেটের দরজাটা বন্ধ করে দিল মন্দার৷ টিকলির নালিশের প্রত্যুত্তর শুনতে চায় না৷ কমোডের ওপর চেপে বসে সে আজকের স্বপ্নটার কথাই ভাবছিল৷ উশ্রীকে আজ কী অপূর্ব লাগছিল! ওকে খুব চুমু খেতে ইচ্ছে করছিল তার৷ হয়তো একটা-দুটো চুমু খেয়েও ফেলতে পারত৷ কিন্তু ওই লোকটা সব ভেস্তে দিল!

ভাবতেই তার রাগ হয়ে গেল৷ কী কুক্ষণে গ্যাস খেয়ে পইতে নিতে গিয়েছিল! বামুনের ছেলে হওয়ার এই শাস্তি! সবার ধাক্কা-টাক্কা খেয়ে এই দামড়া বয়েসে যদিও-বা পইতে নিল, তাতেও শান্তি নেই৷ পইতে নিলে নাকি একটা পুজো করতেই হয়৷ অন্তত একবার পুরুতের আসনে বসে ‘অং বং চং’ করাটা মাস্ট! এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল৷ কোনোমতে ‘চাঁদ সদাগর’ হয়ে পুজোটাও নির্বিঘ্নে করে ফেলতে পারত সে৷ কিন্তু তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর মধ্যে আর কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না! শেষ পর্যন্ত শনিদেব! কেন? হাতের সামনেই তো দিব্যি ভোলেভালা মহাদেব ছিলেন! ঠাকুমার কাছে শুনেছে তিনি নাকি গাঁজা-ভাং খেয়ে ভোম হয়ে বসে থাকেন৷ একটা-দুটো ভুলভাল মন্ত্র পড়লেও বিশেষ পাত্তা-টাত্তা দিতেন না৷ আর যিনি আগেই বিষ খেয়ে নীলকণ্ঠ হয়ে বসে আছেন, সেখানে ‘মহেশ্বর’ ভুলক্রমে ‘মহাষাঁড়’ হয়ে গেলেও এমনকি ক্ষতি হত৷

কিন্তু না, মন্দারকে বিশেষ করে বাঁশ দেওয়ার জন্যই সবাই মিলে শনিদেবকেই খুঁজে পেল! পুজো দেওয়ার সময় কি আর জানত যে এই দেবতা কানখাড়া করে সব শুনছেন! আর তাকে কুম্ভীপাক দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন! যেদিন থেকে শনিপুজো করেছে, সেদিন থেকেই নিজের কপালে শনি নিয়ে ঘুরছে সে! যা-ই করতে যায় তাতেই ‘আছোলা বাঁশ!’ মনের আনন্দে একটা মেগা সিরিয়ালে স্ক্রিপ্ট লিখছিল৷ মেইন স্ক্রিপ্ট-রাইটার দেবুদা বেশ ভালো মানুষ ছিলেন৷ সামান্য ভুল-ত্রুটি হলেও মাথা ঘামাতেন না৷ কিন্তু কপালে সে সুখ সইল না! দুম করে স্ক্রিপ্ট-রাইটার চেঞ্জ হয়ে গেল! ভালোমানুষ দেবুদার জায়গায় এলেন অজয় পান্ডা ওরফে পান্ডাদা! সে আর একরকম মূর্তিমান শনি! যেন কালো ষাঁড়ের মতো চেহারা, তেমনি তার হাঁকডাক৷ পায়ে আর্থ্রাইটিস—তাই হাঁটার সময় ডানদিকে-বাঁদিকে সমান অ্যাঙ্গেলে বেঁকে হাঁটে৷ ডাইনে-বাঁয়ে ক্রমাগত হেলে হাঁটার জন্য অনেকেই তাকে পেছনে ‘পান্ডা’র বদলে ‘পেন্ডুলাম’ বলে৷ কিন্তু কী মেজাজ? পান থেকে চুন খসলেই রদ্দা বাগিয়ে তেড়ে আসে!

অ্যাসিস্ট্যান্ট স্ক্রিপ্ট-রাইটারের কাজ করলেও মন্দার আসলে মনেপ্রাণে কবি৷ নেহাত বাবার ঠ্যালা খেয়ে কাজটা নিয়েছে৷ আর ওই কবি কবি ভাবই হয়েছে যত নষ্টের গোড়া! মেগা সিরিয়ালের সংলাপও মাঝে মধ্যে কাব্যিক হয়ে পড়ে৷ পেন্ডুলাম খেপে গিয়ে খিস্তি দেয়—‘এসব কী ন্যাকা ন্যাকা সংলাপ! কবি হবি নাকি! কাব্যি করতে চাইলে—দাড়ি রেখে আগে আঁতেল হ৷ তারপর ঝোলা কাঁধে নিয়ে নন্দনে বসে থাক৷ সিরিয়াল মারাচ্ছিস কেন বে?’

মাথায় রক্ত চড়ে গেলেও কোনোমতে মেজাজ ধরে রাখে মন্দার৷ পান্ডা, তথা পেন্ডুলামের কথার যে কোনো মা-বাপ নেই তা ইন্ডাস্ট্রির সবাই জানে৷

—‘হুঁ, কবি হবে!’ পেন্ডুলাম একখানা বাংলা দৈনিকের পাতা টেনে এনেছিল৷ তার ওপর ভাল্লুকের মতো একখানা থাবা রেখে বলে—‘কবিতা লেখা কী এমন শক্ত! খবরের কাগজের একটা পেজ খোল৷ তারপর হাতের পাতা দিয়ে চাপা দে৷ আঙুলের ফাঁক দিয়ে যে সব অক্ষর উঁকিঝুঁকি মারবে, সেগুলোকে লিখে দিলেই হয়ে গেল কবিতা! যত দুর্বোধ্য তত অনবদ্য৷’ বলেই সে ভুঁড়ি কাঁপিয়ে অশ্লীলভাবে হেসে উঠল৷ মন্দার প্রথমে রেগে গেলেও পরে তাকে মনে মনে ক্ষমা করে দেয়! অশিক্ষিত লোকজন! কবিতার মাহাত্ম্য কে বুঝবে! কী করে বুঝবে যে মন্দার পাতি কবি নয়৷ তার কবিতা ‘সৌরভ’, ‘বিশ্ববঙ্গ’, ‘জলচ্ছবি’র মতো লিটল ম্যাগাজিনে ছাপা হয়৷ কবিতা ডট কমের লোকজনও তার কবিতা পড়ে উচ্ছ্বাসিত প্রশংসা করে!

কবিতা ডট কমের কথা মনে পড়তেই তার কপালে ভাঁজ পড়ল৷ সেখানেও আজকাল শনির দৃষ্টি পড়েছে৷ ‘কুবলাশ্ব’ ছদ্মনামের একটা লোক তাকে জ্বালিয়ে খাচ্ছে৷ যাই লেখে, লোকটা তার মধ্যে খুঁত ধরবেই৷ তার পোস্ট করা একটি কবিতার লাইন ছিল—‘প্লিহার বেদনাতেও তোমার প্রেমের ব্যথা কমে না৷’ কুবলাশ্ব সেটা পড়ে মতামত দিল—‘সবই তো বুঝলাম! কিন্তু প্লিহার ব্যথা উঠলে তো লোকে মা-বাপের নামই ভুলে যায়৷ অথচ আপনার দেখছি প্রেমিকার নামও মনে থাকে! আশ্চর্য!’

বিলো দ্য বেল্ট পাঞ্চ খেয়ে সে মনে মনে দাঁত কিড়মিড় করেছিল৷ কিন্তু বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব বজায় রেখেই টাইপ কবে—‘এসব রোমান্টিসিজিমের ব্যাপার৷ যে-কোনো ব্যথাই আদতে রোমান্টিক৷’

কুবলাশ্ব সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দেয়—‘প্লিহা, মানে পিলের ব্যথায় আবার রোমান্টিসিজম আছে নাকি! আমার এক পিসেমশাই তো প্রায়ই পিলের ব্যথায় ভোগেন৷ কই, তাঁকে তো বিন্দুমাত্রও রোমান্টিক বলে মনে হয় না৷ বরং সবসময়ই খিটমিট করেন৷ আপনার কাছে সব ব্যথাই রোমান্টিক বুঝি! দাঁতের ব্যথায় ভুগেছেন কখনও?’

সে আর বলতে! আক্কেল দাঁত ওঠার সময়ই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে ‘আক্কেল গুড়ুম’ হওয়া কাকে বলে৷

অগত্যা, কুবলাশ্বকে আর মুখের মতো জবাব দেওয়া যায়নি৷ নিষ্ফল আক্রোশে দাঁত কিড়মিড় করেছে মন্দার, আর মনে মনে ভেবেছে ‘এইসা দিন নেহি রহেঙ্গা’৷ তারও দিন আসবে৷

কমোডের ওপর চেপে বসে এই সবই ভাবছিল সে৷ হঠাৎ বাইরে থেকে বাবার উত্তেজিত চিৎকার—

—‘ওঃ ভগবান, তুই এখনও টয়লেটে!’

—‘বাবা……!’ সে বাবার উত্তেজনাকে বিশেষ পাত্তা দেয় না—‘ভগবান টয়লেটে নেই৷ আমি আছি৷’

—‘কতক্ষণ লাগবে তোর?’ বাবা আরও জোরে চেঁচিয়ে ওঠেন—‘একেই নিম্নচাপ, আর্জেন্ট কেস৷ তার ওপর গ্র্যাভিটেশনের দুরন্ত ডাক! পারছি না৷

—‘অন্য টয়লেটটায় যাও না৷’

—‘ওটাতে টিকলি ঢুকেছে৷’ বাবার গলা ফুল ভলিউমে—‘তাড়াতাড়ি কর৷’

বাধ্য হয়েই পরের কাজগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেরে ফেলল মন্দার৷ পাঁচ মিনিট পরে যখন সে তৈরি হয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এল, ততক্ষণে বাবা মেঝের ওপর চেপে বসে পড়েছেন৷ সম্ভবত মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে প্রবল লড়াই চলছে৷

—‘যাও৷’

বাবা তার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন সে ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’র অমিতাভ বচ্চন! এবং তিনি পাঁচ কোটি টাকা পেয়ে গেছেন৷

রান্নাঘরের ঢং ঢং-ঠং ঠং এখন অনেকটাই কম৷ তার মানে এখন মায়ের রাগ কমের দিকে৷ সম্ভবত সকালেই কর্তা-গিন্নির মধ্যে একচোট রোঁয়া ফোলানো হয়ে গেছে৷ ফলস্বরূপ এবেলা দুজনের বাক্যালাপ বন্ধ৷ বাবাকে দূরদর্শী লোক বলতে হবে৷ তিনি আগেভাগেই কিচেনের দেয়ালে নীরব একটা ব্ল্যাকবোর্ড সেঁটে রেখেছেন৷ রান্নাঘরে ঢুকতে ঢুকতেই মন্দার দেখল ব্ল্যাকবোর্ডের ওপরও খড়ির দাগে বাবা-মায়ের ঝগড়া চলেই যাচ্ছে৷

প্রশ্ন—কোন শার্টটা পরে যাব?

উত্তর—যেটা খুশি৷

প্রশ্ন—ব্লু রঙের টাইট খুঁজে পাচ্ছি না৷

উত্তর—বেডরুমের নীচের কাবার্ডে সাইডে ভাঁজ করে রাখা আছে৷

প্রশ্ন—আমার শর্টস কোথায়?

উত্তর—আমি পরে বসে আছি৷

শেষ উত্তরটা পড়ে কোনোমতে হাসি চাপল সে৷ মা তখনও একমনে হাতাখুন্তি নাড়িয়ে চলেছেন৷ মুখে-গলায় ফোঁটা ফোঁটা ঘাম৷ ব্লাউজের পিছনটা ঘামে ভিজে জবজবে৷ পিছনে না ফিরেই বললেন—‘পাঁচ মিনিট, ডিমের ঝোলটা নামিয়েই খেতে দিচ্ছি৷’

—‘ঠিক আছে৷’

আর কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরে চলে এল মন্দার৷ তাড়াতাড়ি ল্যাপটপটা অন করল৷ মা যতক্ষণে খেতে ডাকবেন, ততক্ষণে ‘কবিতা ডট কমের’ একটা চক্কর মেরে নেবে৷ রোজ সকালে, বিকেলে, সময় পেলেই অনলাইন হয়ে ‘কবিতা ডট কমের’ কবিতাগুলো পড়ে ফেলা তার নেশা৷ নতুন কে কী লিখল, তার নিজের কবিতায় কটা কমেন্ট পড়ল—সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে৷

ল্যাপটপটা অন হতেই স্ক্রিনে উশ্রীর ছবি ভেসে উঠেছে৷ দেখেই মন ভালো হয়ে গেল৷ একমাথা ঘন চুল এলিয়ে কেমন ছেলেমানুষের মতো হাসছে৷ উশ্রীর স্থির হাসির প্রত্যুত্তরে মন্দারও হাসল৷ তারপর অভ্যস্ত হাতে ব্রাউজার খুলে ‘কবিতা ডট কমে’ চলে গেল৷

কবিতা ডট কমে আজ সকাল থেকে কবিতার ভিড়৷ প্রথম পাতায় একের-পর-এক কবিতা৷ তার নিজের কবিতাটা সম্ভবত দ্বিতীয় বা তৃতীয় পাতায় চলে গেছে৷ ‘অগ্রদূত’, ‘যাযাবর’, ‘আকাশনীল’, ‘জোনাকি’ প্রত্যেকেই লিখেছে৷ একটাই শুধু নতুন নাম,—‘একা মেঘ’৷

কবিতাপাড়ায় নতুন কবির আমদানি হয়েছে! সে নিতান্তই কৌতূহলবশত কবিতার নামের ওপর ক্লিক করল৷ এটাই এখনও পর্যন্ত লাস্ট পোস্ট৷ কোনো কমেন্ট পড়েনি৷ মাত্র এক মিনিট আগেই কবিতাটা জমা পড়েছে৷

মন্দার পেজটা খুলে কবিতার থ্রেডে চোখ রাখল৷ ক্লিক সংখ্যা এক৷ অর্থাৎ সেই-এ কবিতার প্রথম পাঠক৷ কবিতার নাম—‘নোনা রোদ’৷

বালির রেতে দফন প্রাচীন শামুক
অন্ধকার ও সমুদ্র ডাক নিয়ে৷
ঢেউ চলে যায় একলা দ্বীপান্তরে—
পুরোনো স্মৃতির টিলায় মাখা রোদ
নোনা ধরা জলে আরশিটা মেলে ধরে
আর পিছু টানে জংলি হাঁসের ডাক৷
উড়ে যাক
উড়ে যাক
উড়ে যাক…..৷

কবিতাটা পড়ে তার ফের মাথা ঝিমঝিম করে উঠল৷ শনিদেবের থাপ্পড় খেয়েও এমন অনুভূতি হয়নি৷ সে প্রথমে লাইন-বাই-লাইন পড়ল৷ তারপর গোটা কবিতাটা! একেবারে অর্থহীন নয়৷ কিন্তু সব মিলিয়ে কি! ‘বালির রেত’ আবার কীরকম শব্দ! বালি মানেই তো রেত! না অন্য কিছু? শব্দের চাতুরী মানেই কি কবিতা! অত সহজ!

মন্দার নিজের ছদ্মনামে মন্তব্য পোস্ট করল—‘কবিতা না অ্যাটম বোমা ঠিক বুঝলাম না! ‘উড়ে যাক…উড়ে যাক… বলতে বলতে শেষ পর্যন্ত মাথার ওপর দিয়ে উড়েই গেল৷ উড়িয়েও দিল৷ এসব কী বিটকেল ফ্যান্টাসি৷ ঝুলস্য ঝুল!’

তার একটু রাগই হয়৷ এরা কী ভাবে! কতগুলো সুন্দর সুন্দর শব্দ পরপর বসিয়ে দিলেই কবিতা হয়ে গেল! এদের জন্যই পেন্ডুলামের মতো পাব্লিকগুলো কবিতার নামে হাসে৷ একবার এই কবিতা ডট কমেই ‘কালকেতু’ নামের এক কবি লিখেছিল—‘শূকরের মাথা যেন এক ঝুড়ি লুচি!’ কুবলাশ্ব তাকে এমন ঝেড়ে কাপড় পরিয়েছিল যে পালাবার পথ পায়নি৷ তারপর থেকে তাকে আর এ পাড়ার ত্রিসীমানায়ও দেখা যায় না৷

মন্দার নিজেই কুবলাশ্ব-র ওপর চটে থাকলেও মনে মনে স্বীকার করল যে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে তার মতো পাঠকেরও প্রয়োজন আছে! এরা খোঁচা না মারলে এইসব শূন্যকুম্ভরা নড়েচড়ে বসবে না৷ কবিতা লিখতে গেলে যে, কিছু পড়তেও হয় তা বোঝানোর জন্যই কুবলাশ্ব-র মতো তেএঁটে লোক দরকার৷ আস্ত থিসিস না থাকলেও কিছু কিছু কবির কবিতা তো পড়তেই হবে৷

মন্দারের ফেভারিট কবি অবশ্যই একমেবাদ্বিতীয়ম গহন দত্তগুপ্ত! কীসব অমানুষিক কবিতা লিখেছে লোকটা! পড়লেই গায়ে কাঁটা দেয়৷ বুকের ভেতরটা কেমন করে৷

ভাবতেই আবার মন খারাপ হয়ে গেল৷ গহন দত্তগুপ্তের কবিতাকে এত ভালোবাসে বলেই না স্বয়ং কবির বৈঠকে সটান হাজির হয়েছিল৷ এমনিতে ভদ্রলোক ভারী শান্তশিষ্ট৷ কথা বলার চেয়ে ফ্যানের দিকেই তাকিয়ে থাকেন বেশি৷ নীচুস্বরে ছাড়া কথা বলেন না, বকা তো দূর! অথচ সেই মানুষটিও মন্দারকে এক মোক্ষম দাবড়ানি দিয়ে বসলেন৷ দোষের মধ্যে সে বৃষ্টিস্নাত দিনে কবির লেখা ‘জলসই’ কবিতাটা উচ্ছ্বাসিত হয়ে আবৃত্তি করে ফেলেছিল৷ তাতেই ভদ্রলোক এমন খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠলেন, যেন মন্দার তাঁর লেখা কবিতা নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছে!

নাঃ, গহন দত্তগুপ্ত-র দোষ নয়৷ দোষ তার নিজের কপালের৷ কী কুক্ষণেই যে শনিপুজোটা করতে গিয়েছিল!

.