আমের পরিণাম
ছেলেবেলায় শোনা একটি গল্প বলছি।
খলিফা হারুন—অল—রসিদ একদিন তাঁর মন্ত্রী জাফরকে বললেন, ‘উজির তুমি দিন দিন অকর্মণ্য হচ্ছে, তোমার দ্বারা রাজকার্য চলবে না। তোমাকে আস্তাবলের ঘেসেড়া করব স্থির করেছি।’
জাফর হাত জোড় করে বললেন, ‘কেন প্রভু, আমি তো প্রাণপণে রাজকার্য চালাচ্ছি।’
‘ছাই চালাচ্ছ। আমার রাজ্যে ভাল মেওয়া মেলে না কেন?’
‘বলেন কি হুজুর, আপনার রাজ্য হ’ল বাদাম পেস্তা আজির খোবানি কিশমিশ মনাক্কা খেজুরের অক্ষয় ভাণ্ডার। এত ফল আর কোন মুলুকে পাওয়া যায়?’
খলিফা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তুমি দিন দিন বেকুফ হচ্ছ। ওসব শুঁটকি ফল, রস কিচ্ছু নেই।’
জাফর বললেন, ‘কেন বেদনাতে তো রস আছে।’
‘চার ভাগ বিচি, এক ভাগ রস। রস গিলব না বিচি ফেলব? আমের নাম শুনেছ।’
জাফর সভয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আম? সে কি চিজ?’
‘তুমি কোনও খবরই রাখ না। আম হচ্ছে হিন্দুস্থানের ফল, কেতাবে পড়েছি তার তুল্য মেওয়া দুনিয়ায় নেই। আমার রাজধানী এই বোগদাদে তার আমদানি নেই কেন?’
‘প্রভু যদি হুকুম দেন তবে আমি নিজে হিন্দুস্থানে গিয়ে আনতে পারি।’
‘তবে এখনই রওনা হও। এক বছরের মধ্যে ফিরে আসা চাই। খরচ যা লাগবে খাজানা থেকে নাও।’
জাফর ভাবলেন, শাপে বর হ’ল। পথখরচের টাকা থেকে কিছু মোটা রকম লাভ হবে, নূতন মুলুক দেখা হবে, কিছুকাল খলিফার ধমক থেকেও রেহাই পাওয়া যাবে। তিনি পাঁচ শ উট, এক হাজার অনুচর, দশজন সুয়ো বেগম, চল্লিশজন দুয়ো বেগম আর বিস্তর টাকা নিয়ে রওনা হলেন। কুর্দিস্থান, ইরান, আফগানিস্থান পার হয়ে অবশেষে পেশোআরে পৌঁছলেন। সেখান থেকে আমের সন্ধান নিয়ে বেনারস গেলেন, তারপর ত্রিহুত, মালদহ, মুরশিদাবাদ।
নানারকম আম বিস্তর কেনা হ’ল। নিজেরা ঢের খেলেন আর খলিফার জন্য দু হাজার ঝুড়ি উটে বোঝাই করে বোগদাদের দিকে ফিরলেন।
দুদিন পরেই দেখা গেল যে আম মেওয়া নয়, বেশী দিন টিকবে না। জাফর ভাবলেন, এমন উত্তম জিনিস নষ্ট করে কি হবে, খেয়ে ফেলা যাক। তার পর তিনি সদলে আম সাবাড় করতে শুরু করলেন। নিজে আর সুয়ো বেগমরা খান আমের চাকা, দুয়োরা আঁটি চোষেন, আর পচা আম খায় লোক—লশকর। বোগদাদ পৌঁছবার ঢের আগেই আম নিঃশেষ হয়ে গেল।
শেষ আমটি খেয়ে জাফর মাথা চাপড়ে বললেন, ‘ইয়া আল্লা, খলিফাকে আমি কি বলব? হায় হায়, আমাকে তিনি নিশ্চয় কতল করবেন।’
বেগম আর অনুচরদের ভিতর কান্নাকাটি প’ড়ে গেল। তখন দুয়ো বেগমদের ভিতর যিনি সবচেয়ে দুয়ো, তিনি একটু ভেবে বললেন, ‘প্রভু, কোনও চিন্তা নেই, বোগদাদে চলুন, সেখানে আমি নিস্তারের উপায় বাতলে দেব।’
জাফর বললেন, ‘যদি আমার প্রাণ রক্ষা করতে পার তবে তোমাকেই এক নম্বর সুয়ো করব।’
খলিফা হারুন—অল—রসিদ রাজসভায় বসেছেন। বিস্তর পাত্র মিত্র সভাসদ হাজির হয়েছে। আজ আম এসে পৌঁছবে, সকলেই তার আস্বাদনের জন্য লোলুপ হয়ে আছেন।
খলিফা হাঁক দিলেন, ‘জাফরটা এখনও হাজির হ’ল না কেন? তার গর্দানের ওপর কটা মুণ্ড আছে?’
জাফর আস্তে আস্তে রাজসভায় প্রবেশ করলেন। তাঁর হাতে একটা বোঁচকা। তিনবার কুর্নিশ ক’রে খলিফাকে বললেন, ‘খোদাবন্দ, গোলাম হাজির। আপনি কেতাবে আমের যে সুনাম পড়েছেন তা একেবারে মিথ্যা।’
খলিফা বললেন, ‘ওসব শুনতে চাই না, নিকালো আম।’
জাফর বললেন, ‘এই যে হুজুর, এখনই আপনাকে আম চাখিয়ে দেখাচ্ছি।’ এই ব’লে তিনি বোঁচকা খুলে দুটো মালসা বার করলেন, তার একটাতে তেঁতুলের মাড়ি, আর একটাতে গুড়। দুটো একসঙ্গে চটকে নিয়ে নিজের লম্বা দাড়িতে জুবড়ে মাখালেন। তার পর খলিফার কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে ব’সে দাড়িটি এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘প্রভু চুষতে আজ্ঞা হ’ক।’
খলিফা বললেন, ‘বিসমিল্লাহ, এ কিরকম বেয়াদবি!’
জাফর বললেন, ‘হে দীনদুনিয়ার মালিক, আম অতি ওয়াহিয়াত অপবিত্র ফল, কাফেররা খায়, আপনাকে কি তা দিতে পারি? তাই আমার এই বৃদ্ধ বয়সের ফসল, আমার মান—ইজ্জতের নিশান, এই দাড়িতে আমের স্বাদ গন্ধ স্পর্শ মিশিয়ে আপনাকে নিবেদন করছি। এতে আমের অপবিত্রতা নেই, কিন্তু মিষ্টতা অম্লতা ছিবড়ে আর গন্ধ এই চার লক্ষণই হুবহু বর্তমান। একবারটি চুষে দেখুন।’
খলিফা মুখ ফিরিয়ে বললেন, ‘তোঁবা তোঁবা।’
জাফর তখন সভাসদবর্গের দিকে দাঁড়িটি নেড়ে বললেন, ‘আপনারা একটু ইচ্ছে করেন কি? চেটে দেখতে পারেন।’
তাঁরাও বললেন, ‘তোঁবা তোঁবা।’
খলিফা বললেন, ‘খবরদার, আর আমের নামও কেউ ক’রো না। যাও জাফর, তোমার দাড়ি ধুয়ে ফেল।’
সেই অবধি খলিফার হুকুমে আরব দেশে আমের আমদানি নিষিদ্ধ হ’ল। তবে জাফরের সেই দুয়ো বেগম, যিনি বুদ্ধিবলে সুয়োতমা হলেন, তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে আমসত্ত্ব আনিয়ে খেতেন।
১৯—৭—৪২
______
* ‘হনুমানের স্বপ্ন’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত নয়।