এক
আমি একজন পিশাচ৷ এ ছাড়া অন্য কোনও পরিচয় আমার নেই৷ কবে কীভাবে আমার জন্ম, তা জানি না৷ আমার বয়েস কত তাও জানা নেই৷ শুধু জানি, রক্ত আমার একমাত্র খাদ্য৷ রক্তের পিপাসা আমাকে এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়৷ এখনও যে পথ চলছি সেও ওই রক্তের টানে৷ পিপাসায় বুক শুকিয়ে আসছে আমার৷
আমাকে কেমন দেখতে?
বলছি৷ তবে শুনে যেন অবাক হয়ে যেয়ো না৷
আমার কোনও নির্দিষ্ট চেহারা নেই৷ যখন যেখানে থাকি সেইরকম চেহারা নিয়ে পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিই৷ যেমন, যখন জঙ্গলে থাকি তখন গাছের পাতা কিংবা গাছের বাকল হয়ে যাই৷ পুকুরপাড়ে থাকলে ঘাস-পাতা, আগাছা, কিংবা মাটির চেহারা নিই৷ এটা ছদ্মবেশ যদি বলো তো তাই৷
ভিজে, স্যাঁতসেঁতে, নোংরা জায়গায় আমি থাকতে ভালোবাসি৷ তাই আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হল মানুষ বা পশুর শরীর৷ ওদের শরীরের ভেতরটা নরম, স্যাঁতসেঁতে, দুর্গন্ধময়, নোংরা—আবার একইসঙ্গে রক্তের তাপে উষ্ণ৷ ওদের শরীরে আমি নিশ্চিন্তে বহুদিন থাকতে পারি৷ আর ওদের দিয়ে আমার রক্তের তৃষ্ণা মেটাই৷ আমার ইচ্ছেয় ওরা অন্যের শরীরে ধারালো দাঁত বসিয়ে রক্ত চুষে নেয়৷ ওরা বুঝতেও পারে না, ওরা আসলে আমার তেষ্টা মেটাচ্ছে৷ কারণ, ওদের শরীরে ঢুকে পড়ার পর থেকেই ওদের মস্তিষ্ক চলে আমার কথায়৷ অর্থাৎ, ওদের শরীর আর মন—দুই-ই দখল করে ফেলি আমি৷
তবে পশুর চেয়ে মানুষই আমার বেশি পছন্দ৷ কারণ, মানুষের রক্তের স্বাদ সবার সেরা৷ আর মানুষ শিকার করাও সহজ৷ তারপর, আমার হয়ে সেই মানুষ—কিংবা অমানুষ রক্তপিশাচ—যখন মানুষ শিকার করে, তখন তার কাজটাও সহজ হয়ে যায়৷
আঃ! ভাবতেই কত তৃপ্তি!
কিন্তু এ-কাজে বিপদও আছে৷
আমার দখলে থাকা অমানুষগুলো যখন ধরা পড়ে যায় তখন ওরা শাস্তি পায়৷ অন্যান্য সুস্থ মানুষ ওদের খতম করে৷ তখন আমাকে পালিয়ে বাঁচতে হয়৷ এক দেহের আশ্রয় ছেড়ে ছুটতে হয় অন্য আস্তানার খোঁজে৷
বুঝতেই পারছ, মানুষ-পিশাচগুলোর বিনাশ হলেও আমার বিনাশ নেই৷
তা হলে কি আমি অমর? কে জানে!
তবে আত্মা যদি অমর, অবিনশ্বর হয় তা হলে প্রেতাত্মা কিংবা পিশাচের অমর হতে অসুবিধে কী!
পথ চলতে-চলতে যখন ভীষণ একঘেয়ে আর ক্লান্ত লাগছে ঠিক তখনই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল৷ সকাল থেকেই মেঘের সাজ-সাজ রব চোখে পড়েছিল, দুপুর পেরোতেই তার কান্নাকাটি শুরু হল৷
চলতে আর ইচ্ছে করছিল না৷ তেষ্টায় আমার ভেতরটা ছটফট করছিল৷ তাই সামনের দোতলা বাড়িটায় ঢুকে পড়লাম৷
প্রকাণ্ড বাড়ি৷ তার লাগোয়া খেলার মাঠ আর বাগান৷ মাঠে বর্ষার সবুজ ঘাস৷ কোথাও-কোথাও জল জমে আছে৷ ব্যাঙের ডাক শোনা যাচ্ছে৷ ওরা বোধহয় এই তুমুল বর্ষার জন্যেই অপেক্ষা করছিল৷ এখন খুশিতে টগবগে হয়ে কলরোল শুরু করে দিয়েছে৷
যাক, এবার আমার কাজ হল বিশ্রাম আর আরাম৷ আর তার জন্যে চাই একজন মানুষ—যার শরীরে আমি আশ্রয় নেব৷ তারপর…৷
দুই
সত্যবানস্যার বোর্ডে অঙ্ক করছিলেন৷ কালো বোর্ডের ওপরে ওঁর চক-ধরা আঙুল তাড়াহুড়ো করে আলপনা এঁকে চলেছে৷ অঙ্ক যেন স্যারের পোষা পাখি৷ কী সুন্দর স্যারের কথা শোনে! কোনও অঙ্কই স্যারের আটকায় না৷ ধরেই স্যাটাস্যাট করে দেন৷ সেইজন্যেই অচ্যুত, ঋদ্ধিমান, বাসব, সৌরভরা সত্যবানস্যারের নাম দিয়েছে ‘স্যাটাস্যাট’৷
স্যার বোর্ডে অঙ্ক করছিলেন৷ আর ক্লাস নাইনের ছেলেরা মাথা নীচু করে চুপচাপ সেটা খাতায় টুকে নিচ্ছিল৷ অচ্যুত অঙ্কে দারুণ—সবসময় একশোয় একশো পায়৷ কিন্তু বীজগণিতের এই অঙ্কটা ওরও আটকে গেছে৷ হল অ্যান্ড নাইটের ‘হায়ার অ্যালজেব্রা’ থেকে এই অঙ্কটা স্যার আগের দিন করতে দিয়েছিলেন৷
মাথা ঝুঁকিয়ে অঙ্ক টোকা শেষ হতেই কন্দর্প অচ্যুতকে আলতো করে খোঁচা মারল৷
অচ্যুত পাশ ফিরে তাকাতেই কন্দর্প ফিসফিস করে বলল, ‘অ্যাই, আমার ব্যাগ থেকে সাত টাকা চুরি গেছে৷’
অচ্যুত অবাক হল না৷ কারণ, গত সাত-আটদিন ধরে ওদের সেকশানে এই চুরির ব্যাপারটা শুরু হয়েছে৷
প্রথম যে-চুরিটা ওদের নজরে পড়েছিল সেটা ঋদ্ধিমানের ব্যাগ থেকে চার টাকা উধাও হওয়ার ঘটনা৷ সেটা ওরা কেউই খুব একটা আমল দেয়নি৷ ভেবেছে ঋদ্ধিমানের হয়তো ভুল হয়েছে৷ ভুল করে টাকাটা অন্য কোথাও রেখে এসেছে৷
কিন্তু তারপর, ওদের বন্ধু কুলদীপের ব্যাগ থেকে বারো টাকা উধাও হতেই অচ্যুতরা নড়েচড়ে বসেছে৷
ক্লাসে কুলদীপের গায়ের জোরই সবচেয়ে বেশি৷ ওর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে কেউ পারে না৷ তা ছাড়া ও রোজ ব্যায়াম করে, বক্সিং ক্লাবে বক্সিং শেখে৷
টাকা চুরি যেতেই কুলদীপ তো রেগে আগুন৷ ও সবাইকে শাসিয়ে বলল, ‘চোর ধরা পড়লে এক ঘুসিতে নাক ফাটিয়ে বারো টাকার শোধ নেব৷’
কিন্তু চুরির ব্যাপারটা থামল না৷ যেমন আজ কন্দর্পের টাকা চুরি গেছে৷ সুতরাং দুটো পিরিয়ডের ফাঁকে ওরা চার-পাঁচজন মিলে টিচার্স রুমে গিয়ে বাংলার অমিয়স্যারকে সব জানাল৷ স্যার কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ‘হাতেনাতে তস্করকে না ধরা পর্যন্ত তো কোনও প্রমাণ নেই! যদি তোরা নক্তচরকে লাল হাতে ধরতে পারিস, তা হলে প্রধান শিক্ষক মহাশয়কে আদ্যোপান্ত অবধান করিয়ে শাস্তি দেওয়ার একটা ব্যবস্থা করা যেতে পারে৷’
অচ্যুতরা আন্দাজ করতে পারল ‘তস্কর’ আর ‘নক্তচর’ মানে চোর৷ অমিয়স্যারকে নিয়ে এই এক মুশকিল! বাংলার স্যার বলে বড্ড বেশি বাংলায় কথা বলেন৷
পরদিন থেকে ওরা পাঁচজন—অচ্যুত, কুলদীপ, প্রতীক, বাসব, আর সৌরভ—চোর ধরার নানান মতলব আঁটতে লাগল৷
এসব ব্যাপারে কুলদীপ ওদের লিডার৷ আর প্রতীক কুলদীপের সর্বক্ষণের সাথী৷ মাঝে-মাঝে কুলদীপকে দুষ্টু বুদ্ধির জোগান দেয় বলে প্রতীকের একটু কুখ্যাতি আছে৷ বাসব ক্লাসের মনিটর, এন. সি. সি-র ক্যাডেট৷ ডিসিপ্লিন নিয়ে সবসময় মাথা ঘামায়৷ হাঁটা-চলা করে সৈনিকের ঢঙে—যেন লেফ্ট-রাইট করে প্যারেড করছে৷ ক্লাসের অনেকেই ওর হাঁটার ঢং নকল করে ওকে বাঙ্গ করে—তবে আড়ালে৷ নইলে ও স্যারদের কাছে কমপ্লেন করে দেবে৷ আর যেহেতু সৌরভের ব্যাগ থেকে চব্বিশ টাকা চুরি গিয়েছিল, তাই চোর ধরার মতলবে ও একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে৷
টিফিনের সময় স্কুলের লাগোয়া খেলার মাঠে জামগাছতলায় বসে ওদের প্ল্যান আঁটার কাজ শুরু হল৷
টিফিনের সময় অচ্যুতরা বেশির ভাগই ক্লাসরুম ছেড়ে খেলার মাঠে বেরিয়ে আসে৷ টিফিনটা কোনওরকমে নাকে-মুখে গুঁজে ওদের কলরোল, খেলাধুলো শুরু হয়৷ ওদের চেঁচামেচিতে গাছে বসে থাকা বুলবুলি, শালিখ, বসন্তবৌরি আর দোয়েল পাখিরা উড়ে পালায়৷ আধঘণ্টা পর ক্লাস বসলে মাঠটা হঠাৎ আবার ফাঁকা নির্জন হয়ে যায়৷ তখন পাখিরা বোধহয় হাঁফ ছেড়ে ফিরে আসে৷
চুরির ঘটনাগুলো খতিয়ে বিচার করার পর প্রতীক বলল, ‘স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, টাকাটা যে নেয় সে টিফিনের সময় নেয়৷ ক্লাসে তখন যদি অন্যরা কেউ বসে থাকে তা হলে নেয় না৷ কিন্তু ফাঁক পেলেই ব্যাগ হাতড়ায়৷ টিফিনের সময় ক্লাসরুমটা ওয়াচ করতে হবে৷’
তখন ঠিক হল, রোজ টিফিনের সময় সৌরভ ওদের ক্লাসরুমে ডেস্কের নীচে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকবে৷ ক্লাসে কেউ ঢুকলে সৌরভকে দেখতে পাবে না৷ ফলে চোরবাবাজি ধরা পড়বেই৷
যেমন মতলব তেমনি কাজ৷ এবং ফল পাওয়া গেল তিনদিনের মধ্যেই৷
সৌরভ ক্লাসরুমে লুকিয়ে ছিল৷ ওদের ক্লাসে দুটো করে ডেস্ক পাশাপাশি তক্তা দিয়ে জুড়ে দুজনের বসার মতো ব্যবস্থা করা আছে৷ সেই জোড়া ডেস্কগুলোকে আবার পাশাপাশি সাজিয়ে ডেস্কের সারি তৈরি করা হয়েছে৷ আর ক্লাসরুমের মাঝ-বরাবর রয়েছে যাতায়াতের প্যাসেজ৷
সৌরভ ক্লাসরুমের একেবারে শেষে এককোণে একটা জোড়া ডেস্কের নীচে লুকিয়ে ছিল৷ অত বড় ঘরে আর কেউ নেই৷ সব চুপচাপ৷ শুধু তিনটে সিলিং ফ্যান ঘোরার শব্দ হচ্ছে৷ ঘাড় গুঁজে বসে থাকতে সৌরভের বেশ কষ্ট হচ্ছিল৷ কিন্তু একটা জেদ ওকে দিয়ে এই কষ্ট সইয়ে নিচ্ছিল৷
আগের দু-দিন কোনও ঘটনা ঘটেনি৷ কিন্তু আজ ঘটল৷
মিনিটদশেক যেতে না যেতেই একজোড়া পা দেখতে পেল সৌরভ৷
খুব সাবধানে দুটো ডেস্কের পায়ার একচিলতে ফাঁক দিয়ে ও উঁকি মারল৷ দেখল, ওদেরই ক্লাসের রাজীব দাস প্রথম সারির ডেস্কের ব্যাগগুলো ব্যস্তভাবে হাতড়াচ্ছে৷ কোনও-কোনও ব্যাগের ভেতর থেকে কী যেন মুঠো করে নিয়ে পকেটে ঢোকাচ্ছে৷ আর মাঝে-মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে ক্লাসরুমের দরজার দিকে তাকাচ্ছে৷
মাত্র পাঁচমিনিট৷ তার মধ্যেই দুটো ডেস্কের সারির তল্লাশি চটপট সেরে ফেলল রাজীব৷ যা পেল, পকেটে গুছিয়ে নিল৷ তারপর তাড়াহুড়ো করে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেল৷
না, সৌরভ ‘চোর, চোর’ বলে চেঁচায়নি৷ কারণ, সেইরকমই কথা ছিল৷ ও শুধু চুরির ঘটনাটা কুলদীপ, অচ্যুতদের জানিয়ে দিল৷ বলল, এই কুকীর্তি কার৷
এই খবরটা জানার পর কুলদীপরা চোর ধরার ফাঁদ পাতল৷ ওরা পাঁচজন টিফিনের সময় ক্লাসরুমের পাঁচ জায়গায় ডেস্কের নীচে ঘাপটি মেরে রইল৷
ওদের হতাশ হতে হল না৷ কারণ, চোর এল এবং চটপট কাজ সারতে লাগল৷
কুলদীপ সকলের আগে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল৷ ওর পিঠের ধাক্কায় একজোড়া ডেস্ক দড়াম করে মেঝেতে উলটে পড়ল৷
ও চিৎকার করে রাজীবকে জাপটে ধরল, ‘ব্যাটা চোর, রোজ বন্ধুদের টাকা চুরি করিস—লজ্জা করে না!’
ততক্ষণে সৌরভ, বাসব, প্রতীক আর অচ্যুত ওদের লুকোনো জায়গা থেকে বেরিয়ে এসেছে৷ ওরা সবাই রাজীবকে ঘিরে ধরল৷ তারপর রাজীবকে টানতে-টানতে নিয়ে গেল টিচার্স রুমে৷
এখন টিফিনের সময়৷ একটা প্রকাণ্ড টেবিল ঘিরে স্যারেরা বসেছিলেন৷ কয়েকজন গল্পগুজব করছিলেন, কেউ-কেউ টিফিন সারছিলেন৷ বেয়ারা সেবকরাম একপাশে দাঁড়িয়ে চক-ডাস্টার গুছিয়ে রাখছিল৷
টিচার্স রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে কুলদীপরা চট করে ঘরের ভেতরটায় চোখ বুলিয়ে নিল৷ ওদের ক্লাসটিচার ভূগোলের কালীপদস্যারকে ওরা দেখতে পেল না৷ বোধহয় কোনও কাজে বাইরে বেরিয়েছেন৷ তবে অমিয়স্যার আর সত্যবানস্যার ছিলেন৷ সত্যবানস্যার টিফিন করছিলেন৷ আর অমিয়স্যার খবরের কাগজ পড়ছিলেন৷
টিচার্স রুমের দরজায় ওদের জটলা দেখে কেউ-কেউ অবাক হয়ে দেখছিলেন৷
বাসব অমিয়স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভেতরে আসব, স্যার?’
অমিয়স্যার কাগজ থেকে মুখ তুলে দরজার দিকে তাকালেন৷ কুলদীপ, সৌরভ, বাসবদের দেখে বুঝলেন কিছু একটা গোলমাল হয়েছে৷ কারণ, কুলদীপ রাজীবের কবজি শক্ত করে চেপে ধরে ছিল৷
চেয়ার ঠেলে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন অমিয়স্যার৷ খবরের কাগজটা একটা ডাস্টার চাপা দিয়ে রেখে চটপট চলে এলেন দরজার কাছে৷
‘কী রে, কী হয়েছে!’
ওরা হাঁফাতে-হাঁফাতে রাজীব দাসের কীর্তির কথা বলল৷
অমিয়স্যার ধৈর্য ধরে সব শুনলেন৷ ব্যাপারটা ওঁর মনে পড়ে গেল৷ তিনিই ওদের বলেছিলেন চোরকে হাতেনাতে ধরার কথা৷
তিনি রাজীবকে বললেন, ‘তুই এখানে থাক৷’ তারপর অচ্যুতদের দিকে ফিরে : ‘তোরা শ্রেণিতে যা৷ আমি ব্যাপারটা দেখছি—৷’
এমন সময় সত্যবানস্যার ওদের পাশ দিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলেন৷ কিন্তু আশ্চর্য, ওদের জটলা নিয়ে কোনওরকম কৌতূহল দেখালেন না৷ একজন অচেনা মানুষের মতো পাশ দিয়ে চলে গেলেন৷ অথচ দু-তিনদিন আগেও অচ্যুতকে দেখলে হেসে বলতেন, ‘কী রে, দিনরাত শুধু ক্রিকেট নিয়ে পড়ে আছিস, নাকি অঙ্ক-টঙ্কও একটু-আধটু হচ্ছে? ভালো করে পড়৷ মাধ্যমিকে অঙ্কে একশোয় একশো পাওয়া চাই-ই চাই৷’
অচ্যুত বেশ অবাক হয়ে গেল৷ কয়েক সেকেন্ড ধরে ও সত্যবানস্যারের চলে যাওয়া দেখল৷
আর ঠিক তখনই টিফিন শেষ হওয়ার ঘণ্টা বেজে উঠল৷ ঢং-ঢং-ঢং-ঢং৷ স্কুলের দারোয়ান বানজারা পূর্ণিমার চাঁদের মতো গোল পিতলের ঘণ্টায় কাঠের হাতুড়ি দিয়ে তাল ঠুকে জানিয়ে দিচ্ছে টিফিনের আধঘণ্টা শেষ হয়েছে৷ এখন আবার ক্লাস শুরু হবে৷
ক্লাস ফোর-ফাইভে পড়ার সময় অচ্যুতের এরকম একটা পিতলের ঘণ্টা কেনার খুব শখ হয়েছিল৷ কিন্তু বাপি আর মা সেই শখের কথাটা শুনে হেসে এমন গড়িয়ে পড়েছিল যে, অচ্যুতের আর ঘণ্টা কেনা হয়ে ওঠেনি৷
স্কুলের চওড়া বারান্দা ধরে ওরা ক্লাসের দিকে ফিরে যাচ্ছিল৷ এখন দুপুর হলেও আকাশ মেঘলা৷ যখন-তখন বৃষ্টি হতে পারে৷ গত ক’দিন ধরেই ঝেঁপে বৃষ্টি চলছে৷ মাঝে-মাঝে এক-আধ-ঘণ্টার বিরতি৷ বৃষ্টিও বোধহয় তখন টিফিন করতে যায়—নয়তো ঘুমিয়ে পড়ে৷
স্কুলের মাঠটা বৃষ্টিতে যাচ্ছেতাই হয়ে থাকে বলে এখন টিফিনের সময়ে খেলার হুল্লোড় অনেকটা মিইয়ে গেছে৷ আর সবসময় মেঘলা থাকলে অচ্যুতের কেমন যেন মনখারাপ লাগে৷
ফিফ্থ পিরিয়ডের দশ-পনেরো মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পর রাজীব ক্লাসে এসে ঢুকল৷
রমেশস্যার তখন ইতিহাস পড়াচ্ছিলেন, আর ক্লাসের অর্ধেক ছেলে তন্দ্রার টানে ঢুলছিল৷ ঘন-ঘন হাই উঠছিল সকলের৷
কিন্তু রাজীব দাসকে দেখেই সবাই সোজা হয়ে বসল৷
রাজীবের রং টকটকে ফরসা৷ ঘি-মাখন খাওয়া গোলগাল নধর চেহারা৷ চোখে চশমা৷ সবসময় ফিটফাট থাকে৷ কিন্তু এখন ওর চুল উসকোখুসকো, চোখের জল চশমার ফাঁক দিয়ে গাল বেয়ে নেমে এসেছে, হেঁচকি তুলে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছে৷
রমেশস্যার দাক্ষিণাত্যের সাতবাহন সাম্রাজ্যের সাতকাহন থামিয়ে অবাক হয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘কী ব্যাপার? তুই কোথায় গিয়েছিলি?’
প্রশ্নটা করে কুতকুতে তীক্ষ্ণ চোখে তিনি রাজীবকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিলেন৷
‘অমিয়স্যার আমাকে হেডস্যারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন৷’ ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল রাজীব৷
‘কেন রে? কী করেছিস তুই?’
রাজীব চুপ করে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল৷
অচ্যুতের ভীষণ খারাপ লাগছিল৷ আহা রে! হেডস্যার মোহনলালবাবু নিশ্চয়ই ওকে বেত দিয়ে মেরেছেন৷ কিন্তু রাজীবই-বা টাকা চুরি করে কেন? ওরা তো বেশ বড়লোক! রেল স্টেশনের কাছে ওদের সুন্দর দোতলা বাড়ি৷ মারুতি জেন গাড়ি করে স্কুলে আসে৷
মনিটর বাসবকে ডেকে রমেশস্যার ব্যাপারটা জানতে চাইলেন৷ রাজীবকে বললেন, ‘তুই ডেস্কে গিয়ে বোস৷’
রাজীব মাথা নীচু করে ডেস্কের দিকে এগোল৷
অচ্যুতের ডেস্কের সারির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রাজীব ওকে মিনমিনে গলায় বলল, ‘ছুটির পর তোকে অমিয়স্যার দেখা করতে বলেছেন৷’
অচ্যুত ঘাড় নেড়ে ‘আচ্ছা’ বলল৷
রমেশস্যার বাসবের কাছে গোটা গল্পটা শুনে তারপর আবার সাতবাহন রাজবংশের কাহিনি শুরু করলেন৷
রমেশস্যারের পিরিয়ড শেষ হতেই সবাই রাজীবকে ছেঁকে ধরল৷ কেউ-কেউ ওকে সান্ত্বনা দিল৷ আবার কেউ বলল, ‘ঠিক হয়েছে—অন্যায় করেছে তাই শাস্তি পেয়েছে৷’
কুলদীপ, সৌরভ, বাসবরা খুঁটিয়ে জানতে চাইল অমিয়স্যার ওকে হেডস্যারের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর ঠিক কী-কী হয়েছে৷
রাজীব থতিয়ে-থতিয়ে বলছিল আর ফুঁপিয়ে উঠছিল৷ হেডস্যারের দশ ঘা বেতের বাড়ি খেয়ে ও সহ্য করেছে৷ কিন্তু হেডস্যার বলেছেন, কাল ওর বাবা-মাকে স্কুলে এসে দেখা করতে৷ এটা ওকে ভীষণ ভয় পাইয়ে দিয়েছে৷ বাপি-মাম্মি এসব ঘটনা জানতে পারলে ওকে হয়তো বাড়ি থেকেই বের করে দেবে৷ রাজীব তাই ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে সিঁটিয়ে গেছে৷
কুলদীপদের ভীষণ মনখারাপ হয়ে গেল৷ ওরা রাজীবকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘দাঁড়া, দেখছি কী করা যায়৷ তুই চিন্তা করিস না৷’
সব শুনে অচ্যুত বলল, ‘অমিয়স্যার তো আমাকে ছুটির পর ডেকেছেন৷ তখন আমি স্যারকে বলব৷ হেডস্যারকে যেন রিকোয়েস্ট করেন—যাতে গার্জেন কল না হয়৷’
অচ্যুতের কথায় রাজীব তেমন ভরসা পেল বলে মনে হল না৷
চারটে বেজে দশমিনিটে বানজারা ছুটির ঘণ্টা বাজাল৷
বই-খাতা গুছিয়ে নিয়ে নানান ক্লাসের ছেলের দল পিলপিল করে বেরিয়ে এল ক্লাসরুমের বাইরে৷ তারপর স্কুল-বাড়ি ছেড়ে মাঠে নেমে এল ‘সাদা জামা কালো প্যান্টের’ ভিড়৷ সেখান থেকে সদরের লোহার গেট৷ আবার গেট পেরিয়ে রাস্তা৷
আকাশ মেঘে কালো হয়ে এসেছে৷ এখনই বোধহয় আবার বৃষ্টি নামবে৷
স্কুলের মাঠের একপাশে সারে-সারে দাঁড় করানো সাইকেল৷ এক ঝাঁক ছেলে হইহই করে ছুটল সাইকেলের দিকে৷ নীচু ক্লাসের কয়েকটা ছেলে জল-কাদাভরা মাঠে ছুটোছুটি করে খেলতে লাগল৷ মাঠের এখানে-ওখানে জমে থাকা জলের ওপর পা ফেলে দাপিয়ে ছুটে গিয়ে কাদা-জল ছিটকে দিতে লাগল চারপাশে৷
সদরের গেটের বাইরে বাবা-মায়েদের ভিড়৷ তাঁদের চোখ সাদা-কালো পোশাকের ভিড়ে নিজের-নিজের ছেলেকে খুঁজে বেড়াচ্ছে৷
স্কুল ছুটির সময় এই ভাঙাচোরা সরু রাস্তাটা সাইকেল, সাইকেল রিকশা আর স্কুটারে ছয়লাপ হয়ে যায়৷ যানজট চলে অন্তত আধঘণ্টা৷ এখন, বর্ষার সময়, তাই অবস্থা একেবারে বেহাল৷
স্কুল ছুটি হয়ে গেলেও অচ্যুতরা কয়েকজন ক্লাস থেকে বেরোয়নি৷ অমিয়স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে রাজীবের ব্যাপারে অচ্যুত ঠিক কী কী বলবে তাই নিয়েই জল্পনা-কল্পনা চলছিল৷ রাজীব কুলদীপ-অচ্যুতদের হাত ধরে একেবারে কেঁদে পড়ল : ‘তোরা আমাকে যেভাবে হোক সেভ কর৷’
প্রায় আধঘণ্টা পর ওরা ক্লাসরুম থেকে বেরোল৷
কুলদীপরা সবাই চলে গেল৷ পিঠে বই-খাতার ব্যাগ ঝুলিয়ে অচ্যুত একা রওনা হল টিচার্স রুমের দিকে৷ যাওয়ার আগে ও কুলদীপকে বলল, ‘রাজীবের ব্যাপারে অমিয়স্যারের সঙ্গে কী কথা হল, আমি তোকে রাতে ফোন করে জানাব৷ টা-টা!’
অচ্যুত খেয়াল করেনি কখন যেন বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে৷ একটু আগের হুল্লোড় হইচই থেমে গিয়ে এখন সব একেবারে নিঝুম! শুধু বৃষ্টি ঝিরঝির করে পড়ছে৷ বাইরে কলাগাছের পাতায় বৃষ্টির ফোঁটার টপটপ শব্দ হচ্ছে৷ দূর থেকে সাইকেল রিকশার ‘প্যাঁকপ্যাঁক’ ডাক শোনা যাচ্ছে৷ আর কখনও-কখনও মেঘের ‘গুডুম-গুডুম’৷
ছুটির পর স্কুল থেকে সবাই চলে যায়৷ তখন বানজারা স্কুলের সব ঘর ঘুরে-ঘুরে আলো আর পাখা অফ করে, দরজায়-দরজায় তালা দেয়৷ তারপর স্কুল বিল্ডিং-এর কোলাপসিবল গেটে তালা দিয়ে নিজের ঘরে যায়৷ ওর ছোট্ট ঘর স্কুল-বাড়ির লাগোয়া, অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া৷ পাশেই একটা টিউবওয়েল৷ আর তাকে ঘিরে নানান গাছপালা৷ বর্ষায় সেগুলো সব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে৷
টিউবওয়েল থেকে একটু দূরেই একটা ছোট গোয়ালঘর৷ সেখানে বানজারার পোষা গোরু রামুয়া আর ছোট একটা বাছুর আছে৷ ওরা বেশির ভাগ সময়েই মাঠে ঘুরে বেড়ায়, ঘাস-পাতা খায়৷
বানজারা বউ নিয়ে থাকে৷ ওর বউ স্কুলের সুইপারের কাজ করে৷ সবসময় পান খায়, আর মাথায় ঘোমটা টেনে থাকে৷
টিচার্স রুমের দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় অচ্যুতের বুটজুতোর খটখট শব্দ করিডরে কেমন যেন ফাঁপা প্রতিধ্বনি তুলছিল৷ একতলা থেকে দরজা বন্ধ করার শব্দ শোনা যাচ্ছিল৷ বানজারা ওর কাজ শুরু করে দিয়েছে৷
টিচার্স রুমের কাছে এসে অচ্যুত অবাক হয়ে গেল৷ ঘর খাঁ-খাঁ করছে৷ কেউ নেই৷
ঘরে আলো জ্বলছে, পাখা ঘুরছে৷ খোলা জানলা দিয়ে ঘোর কালো মেঘ, গাছপালা আর বৃষ্টি চোখে পড়ছে৷ দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের পাতা হাওয়ায় উড়ছে৷
তা হলে কি বৃষ্টি আসার ভয়ে অমিয়স্যার একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেছেন?
এমন সময় একটা শব্দ অচ্যুতের কানে এল৷
মেঝেতে খুচরো পয়সা পড়ে যাওয়ার শব্দ৷
টিচার্স রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে চোখ সরু করে নজর ধারালো করল অচ্যুত৷ সামান্য কুঁজো হয়ে টেবিলের নীচ দিয়ে দেখতে চেষ্টা করল৷
খুচরো পয়সা কোথায় পড়ল? কার পকেট থেকে পড়ল?
ঝুঁকে পড়ে নীচু হতেই এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল অচ্যুত৷
সত্যবানস্যার দেওয়ালের গায়ে টিকটিকির মতো হেঁটে বেড়াচ্ছেন!
মেঝে থেকে অন্তত হাতদুয়েক ওপরে মেঝের সঙ্গে সমান্তরালভাবে স্যারের শরীরটা আঠার মতো আটকে রয়েছে৷ ঠিক সাঁতার দেওয়ার ভঙ্গিতে তিনি এগিয়ে চলেছেন৷
এরকম একটা মজার দৃশ্য দেখে অচ্যুতের হাসি পাওয়ার কথা৷ কিন্তু ও ভয় পেল৷ ওর হাত-পা ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল, বুকের ভেতরে বাতাস আটকে গেল৷ কারণ, সত্যবানস্যারের মুখে এক অদ্ভুত নিষ্ঠুর উল্লাস৷ ঠোঁটজোড়া লাল টুকটুক করছে, চোখে এক অলৌকিক সবুজ আলো৷
আর ঠিক তখনই কড়-কড়-কড়াৎ শব্দে বাজ পড়ল কোথাও৷ অচ্যুত চমকে উঠল৷ ওই অবস্থাতেও ও বুঝতে পারল খুচরো পয়সাগুলো স্যারের পকেট থেকেই পড়েছে৷
এরকম একটা বিচিত্র ভয়ঙ্কর দৃশ্য অচ্যুতকে পাগল করে দিল৷ ও হেঁচকি তুলে শ্বাস টানল, বুক ভরে বাতাস নিতে চাইল৷ তারপরই ছুট লাগাল দোতলার বারান্দা ধরে৷ ওর বুটের শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল কোনও পাগলা ঘোড়া মৃত্যুভয়ে ছুটে পালাচ্ছে৷
অচ্যুত যদি পিছন ফিরে তাকাত তা হলে দেখতে পেত সত্যবানস্যার ওর হেঁচকির শব্দে দেওয়ালের গা থেকেই মুখ ফিরিয়ে তাকিয়েছেন৷ সবুজ আগুনভরা চোখে ওর ছুটে পালানো দেখছেন৷
আর স্যারের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে রহস্যময় হাসি৷
তিন
পরদিন সাইকেল চালিয়ে স্কুলের গেটে পৌঁছে অচ্যুতের মনে হচ্ছিল গতকাল ও যা দেখেছে সবটাই স্বপ্ন—অথবা দুঃস্বপ্ন৷
রং-চটা সীমানা-পাঁচিলের গায়ে বসানো জং-ধরা লোহার গেটের একটা পাল্লা খোলা৷ অচ্যুত সাইকেল থেকে নেমে পড়ল৷ তারপর সাইকেলটা হাঁটিয়ে নিয়ে ভেতরে ঢুকল৷
মাঠের এখানে-সেখানে বৃষ্টির জল জমে রয়েছে৷ মাঝখানের খানিকটা ফাঁকা জায়গা বাদ দিলে মাঠের বাকি অংশে বড়-বড় ঘাস আর আগাছা৷ এ ছাড়া পাঁচিলের ধার ঘেঁষে কয়েকটা বট, অশ্বত্থ, কদম, কৃষ্ণচূড়া, দেবদারু গাছ৷ আর প্রকাণ্ড জামগাছটা আছে বানজারাদের ঘরের কাছাকাছি৷ গরমকালে পাকা জাম পড়ে-পড়ে গাছের নীচটা বেগুনি হয়ে থাকে৷ গাছটার নীচে বসার জন্য কয়েকটা সিমেন্টের বেদি আছে৷
বৃষ্টি না-হলে এই মাঠেই স্কুলের প্রেয়ার হয়৷ আর বৃষ্টি হলে যার-যার ক্লাসরুমে৷
মাঠের বাঁদিকে একটা দোলনা আর স্লিপ—নীচু ক্লাসের ছেলেদের খেলার জন্য৷ আর তার পিছনেই সাইকেল রাখার জায়গা৷
সাইকেল রেখে অচ্যুত স্কুল-বাড়ির দিকে এগোল৷
বড় মাপের ছড়ানো দোতলা বাড়ি৷ তার পলেস্তারা-খসা রং-চটা চেহারার দিকে খুব খুঁটিয়ে নজর করলে বোঝা যায় একসময়ে বাড়িটার রং গোলাপি ছিল৷
স্কুল-বাড়ির একতলার দেওয়ালে তেল রঙে বড়-বড় করে আঁকা মনীষীদের রঙিন ছবি৷ বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিবেকানন্দ, রামমোহন, সবাই সেখানে হাজির৷ বৃষ্টির জলে ধোয়া ছবিগুলো ঝকঝক করছে৷
ওঁদের ছবির দিকে তাকিয়ে সত্যবানস্যারের ব্যাপারটা অচ্যুত কিছুতেই সত্যি বলে মেনে নিতে পারছিল না৷
গায়ে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়তেই আকাশের দিকে তাকাল অচ্যুত৷ আবার শুরু হল৷ এবার পুজোয় বৃষ্টির পিছু ছাড়াতে পারলে হয়! ও একতলার বারান্দায় ওঠার সিঁড়ির ধাপের দিকে এগোল৷
বানজারার ঘণ্টার পর ক্লাস শুরু হল বটে তবে অচ্যুত ভীষণ আনমনা হয়ে রইল৷ গতকালের ঘটনাটা ওর বুকের ভেতরে ঘুরপাক খেয়ে মাথা খুঁড়ে মরছিল৷
প্রথম পিরিয়ডের ঘণ্টা পড়তেই ও চমকে উঠল৷ কারণ, সেকেন্ড পিরিয়ডটা অঙ্কের—সত্যবানস্যারের ক্লাস৷
অচ্যুত কুলদীপের দিকে তাকাল৷ কুলদীপ দুটো সারি পিছনে বসে৷ ওর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই কুলদীপ ইশারা করল৷ যার অর্থ, এক্ষুনি স্যাটাস্যাট আসছেন৷
এখনও পর্যন্ত অচ্যুত শুধু কুলদীপকেই ঘটনাটা বলেছে৷ আর কাউকে নয়৷ এমনকী বাপি-মা-কেও নয়৷
সত্যবানস্যার ক্লাসে এসে ঢুকলেন৷
টকটকে ফরসা রং৷ পিছনদিকে টেনে আঁচড়ানো তেলচকচকে চুল৷ চোখে সরু কালো ফ্রেমের চশমা৷ গাল সামান্য ভাঙা—চোয়ালের হাড় উঁচু হয়ে রয়েছে৷ লম্বাটে নাকের নীচে সরু গোঁফ৷ গালে দাড়ির নীলচে আভা৷
সত্যবানস্যারের পরনে সাদা হাফশার্ট আর গাঢ় বাদামি প্যান্ট৷ চেহারা বেশ রোগা হওয়ায় প্যান্টটা ঢলঢল করছে৷ গতকাল স্যার এই পোশাকই পরেছিলেন৷
অচ্যুত খুব খুঁটিয়ে স্যারকে দেখছিল৷ অঙ্ক করতে-করতে মাঝে-মাঝেই কেমন আনমনা হয়ে যাচ্ছেন আর জিভ বের করে ঠোঁটজোড়া চেটে নিচ্ছেন৷ তেষ্টা পেলে মানুষ যেমন করে৷
কিন্তু এরপরই এক অবাক কাণ্ড হল৷
বীজগণিতের অনুপাত আর সমানুপাতের কুড়ি প্রশ্নমালার অঙ্কগুলো বোর্ডে স্যার বোঝাচ্ছিলেন৷ সেই অঙ্ক হঠাৎই আটকে গেল!
অচ্যুত যতদূর জানে সত্যবানস্যারের অঙ্ক কখনও আটকায়নি৷ কিন্তু আজ এ কী কাণ্ড!
সত্যবানস্যার বোর্ডের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে মাথা চুলকোতে লাগলেন৷ আঙুলে ধরা চকটা শূন্যে ঘুরিয়ে মনে-মনে যেন অঙ্কটা কষে ফেলতে চাইলেন৷
অচ্যুতের মনে পড়ে গেল গতকালের কথা৷ টিচার্স রুম থেকে বেরিয়ে সত্যবানস্যার একজন অচেনা মানুষের মতো ওদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন৷ তারপর স্কুল ছুটির পর টিচার্স রুমের দেওয়ালে ওই কাণ্ড! আর এখন, বরাবর যিনি স্যাটাস্যাট অঙ্ক করেন, তাঁর অঙ্ক গেছে আটকে!
স্যারের কি তা হলে কিছু হয়েছে?
সত্যবানস্যার অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর চেয়ারে বসে পড়লেন৷ অঙ্ক কষা নিয়ে এলোমেলো ধানাইপানাই করে চললেন৷ তারপর, ক্লাস শেষ করে চলে যাওয়ার সময়, কুলদীপকে বললেন, ‘কুলদীপ, তোরা কাল সন্ধেবেলা তো কোচিং-এ আসছিস, তখন ভালো করে এটা বুঝিয়ে দেব৷’
অচ্যুত, কুলদীপ, প্রতীক, রাজীব আর সৌরভ সত্যবানস্যারের কোচিং-এ একই ব্যাচে পড়ে৷ স্যারের বাড়ি নৈহাটি৷ তবে প্রতিদিন স্কুলের পর কোচিং সেরে রাতের ট্রেন ধরেন৷ তবে কখনও-কখনও রাত হয়ে গেলে কোচিং-এর ঘরটাতেই থেকে যান৷
পরের দুটো পিরিয়ড অচ্যুতের আর কাটতে চাইছিল না৷ ও ভাবছিল, কতক্ষণে টিফিন হবে আর ও কুলদীপকে নিয়ে আলোচনায় বসবে৷
গতকাল বাড়ি ফিরে পড়াশোনায় মন বসাতে পারেনি অচ্যুত৷ সত্যবানস্যারের দেওয়ালে হাঁটার দৃশ্যটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল৷ একটা লতানে গাছ যেন সাপের মতো এঁকেবেঁকে সড়সড় করে বেড়ে চলেছে৷
লেখাপড়ার চেষ্টা ছেড়ে টিভিতে ই.এস.পি.এন. আর স্টার স্পোর্টস চ্যানেল দেখতে বসে গিয়েছিল, কিন্তু স্যার টিভির পরদাতেও হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন৷
মা রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে চোখ সরু করে ওকে দেখছিল৷ অনেকক্ষণ দেখার পর কাছে এসে জিগ্যেস করল, ‘তোর কী হয়েছে রে?’
‘কিচ্ছু না৷’ অচ্যুত মায়ের চোখের দিকে তাকাতে পারল না৷ শূন্য দৃষ্টিতে টিভির পরদার দিকে চেয়ে রইল৷
‘তখন থেকে দেখছি কেমন উসখুস করছিস?’
কোনও জবাব দিল না অচ্যুত৷
‘স্কুলে ঝগড়া-মারপিট করেছিস?’
‘না৷’ মাথা নাড়ল অচ্যুত৷ টিভির দিক থেকে চোখ সরাল না৷
মা কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল৷ ছেলের মনের ভেতরটা বুঝতে চেষ্টা করল৷ তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে সরে গেল রান্নাঘরের দিকে৷ ভাবল অচ্যুতের বাবা এলে ব্যাপারটা নিয়ে একটু কথা বলবে৷ ছেলে বড় হচ্ছে৷ স্কুলে কী সমস্যা বাধিয়ে এসেছে কে জানে!
অচ্যুতের বাবা এখন বাড়িতে নেই৷ অফিস থেকে ফিরে বটতলার মিষ্টির দোকানের কাছে তাসের আড্ডায় মেতে আছে৷ ফিরতে-ফিরতে রাত দশটা৷
অচ্যুত যখন টিভি, রেডিয়ো, ওয়াকম্যান, বারান্দা, এ-ঘর, ও-ঘর করে ক্লান্ত হয়ে নিজের ঘরে গিয়ে পড়ার টেবিলে বসেছে, ঠিক তখনই কুলদীপের ফোন এল৷
অচ্যুত ফোন করেনি দেখে কুলদীপই ওকে ফোন করেছে৷
নীচুগলায় ওর সঙ্গে কথা বলল অচ্যুত৷
বলল, অমিয়স্যারের দেখা পায়নি৷ আর সত্যবানস্যারকে ওইরকম করতে দেখেছে৷
কুলদীপ ও-প্রান্তে শিস দিয়ে উঠল, বলল, ‘কীসব যা-তা বলছিস!’
অচ্যুত বলল, ‘মা-কালীর দিব্যি—৷’
কুলদীপ আবার চাপা শিস দিল৷ উত্তেজিত হয়ে উঠলে ও শিস দেয়৷ আর মেজাজ ভালো থাকলে শিস দিয়ে গান শোনায়৷
অচ্যুত এলোমেলোভাবে ওকে সব খুলে বলল৷ জট পাকানো হলেও গোটা গল্পটা বুঝতে কুলদীপের অসুবিধে হল না৷ সব শোনার পর ও বিড়বিড় করে শুধু বলল, ‘স্যাটাস্যাট আগের জন্মে বোধহয় টিকটিকি ছিল…’
কুলদীপের রসিকতায় অচ্যুতের হাসি পেল না৷ ওর মনে পড়ল, টিচার্স রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে ওর হাত-পা ঠকঠক করে কেঁপেছিল৷
টিফিনের ঘণ্টা পড়তেই অচ্যুতের চমক ভাঙল৷
ক্লাসের অন্যান্য ছেলে বই-খাতা ডেস্কে ঢুকিয়ে হুড়মুড় করে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে পড়ল৷ করিডরে ওদের হুটোপাটি ছুটোছুটিতে হুল্লোড় বেধে গেল৷ কার টিফিন বক্স ছিটকে পড়ল মেঝেতে৷ ঠং করে আওয়াজ হল৷ লুচি আর আলুভাজা ছড়িয়ে পড়ল৷ বুট পরা ছুটন্ত পা-গুলো নিমেষে সেগুলো মাড়িয়ে চলে গেল৷ কারও সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই৷ কতক্ষণে নীচের মাঠে গিয়ে পৌঁছবে সেই চিন্তায় সব মশগুল৷
কুলদীপ আর অচ্যুত বেরোল সকলের শেষে৷ ওদের হাতে টিফিন বক্স৷
সিঁড়ি দিয়ে নামার মুখে রাজীব দাসের সঙ্গে ওদের দেখা হল৷ মুখ কালো করে এক-পা এক-পা করে নামছে৷
গতকাল অমিয়স্যারের সঙ্গে দেখা না হওয়ায় হেডস্যারকে ম্যানেজ করার ব্যাপারটা ভেস্তে গেছে৷ অচ্যুত রাজীবকে সেটা বলতেই ও কাচুমাচু মুখ করে বলল, ‘আমি স্কুলে এসেই হেডস্যারের সঙ্গে দেখা করেছি৷ বলেছি, আজ মাম্মি আর বাপি কলকাতায় গেছে, কাল এসে দেখা করবে৷ বিপদে পড়ে মিছে কথা বলতে হল৷ তোরা আমাকে সেভ কর৷ তোরা আজ অমিয়স্যারকে একটু বল—প্লিজ! আচ্ছা, মানুষের কি ভুল হয় না?’
রাজীবের চোখে জল এসে গেল৷
কুলদীপ বলল, ‘অ্যাই, বাংলা সিনেমার লাস্ট সিনের মতো কাঁদবি না৷ আজ তোর ব্যাপারটা ফয়সালা করে দেব৷ এখন টিফিন খেয়ে বল খেল গিয়ে৷’
অচ্যুত আর কুলদীপ জামগাছতলার সিমেন্ট বাঁধানো বেদির ওপরে গিয়ে বসল৷ প্রতীক ওদের কাছে বসতে এসেছিল, কিন্তু কুলদীপ ওকে বলল, ‘কিছু মনে করিস না—অচ্যুতের সঙ্গে আমার একটু প্রাইভেট টক আছে৷’
প্রতীক সন্দেহের চোখে কুলদীপকে দেখল৷ আজকাল ওকে মাঝে-মাঝেই ‘কমলাবালা গার্লস হাইস্কুল’-এর গেটের কাছে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যাচ্ছে৷ সে-ব্যাপারে প্রাইভেট কথা কি না কে জানে!
কিছু না বলে প্রতীক ভুরু উঁচিয়ে ঘাড় নেড়ে চলে গেল৷
মিহি বরফের গুঁড়োর মতো বৃষ্টি পড়ছে৷ বাদলা হাওয়ায় সেই গুঁড়ো মুখে উড়ে এসে আরাম ছড়িয়ে দিচ্ছে৷ মেঘের চাপা গুড়গুড় শোনা যাচ্ছে কখনও-কখনও৷ একটু দূরে, স্কুলের বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে, বানজারার গোরু রামুয়া আর তার বাছুর আপনমনে ঘাস খাচ্ছে৷
দুজনের টিফিন মিলিয়ে-মিশিয়ে খেতে-খেতে কুলদীপ বলল, ‘স্ট্রেটকাট বল তো, স্যাটাস্যাটের এগেইনস্টে কী অ্যাকশন নিতে চাস?’
অচ্যুত কুলদীপের চোখের দিকে তাকাল : ‘অ্যাকশন নেব কী, ব্যাপারটা ঠিক কী, সেটাই তো বুঝে উঠতে পারছি না৷’
‘স্যাটাস্যাটকে একটু ওয়াচ রাখতে হবে৷’
‘যদি আমাকে ধরে কিছু বলে?’ অচ্যুতের বুকের ভেতরে কেমন যেন শব্দ হচ্ছিল৷
‘ধুস, কী আর বলবে! বলবে যে, আমি দেওয়াল বেয়ে টিকটিকির মতো হাঁটছিলাম! তুমি কিছু মাইন্ড কোরো না৷…তা ছাড়া তোকে তো আর একা পাচ্ছে না যে বলবে!’
অচ্যুতের মুখ দেখে মনে হল না ও খুব একটা ভরসা পেয়েছে৷ ও চুপচাপ বসে বর্ষাভেজা প্রকৃতি দেখতে লাগল৷
কিছুক্ষণ পর কুলদীপ তাড়া লাগাল, ‘চল, অমিয়স্যারের সঙ্গে দেখা করে তারপর ক্লাসে যাব৷ রাজীবের ব্যাপারটা আগে বলা দরকার৷ নইলে ওর প্রবলেম হয়ে যাবে৷’
বেদি ছেড়ে ওঠার সময় অচ্যুত বলল, ‘সত্যবানস্যারের কেসটা কিন্তু কাউকে বলিস না৷’
কুলদীপ মাথা নেড়ে সায় দিল৷
মনিটর বাসব আর প্রতীককে সঙ্গে নিয়ে অচ্যুত আর কুলদীপ টিচার্স রুমে গেল৷ অমিয়স্যারকে অনেক করে বলে-কয়ে ওরা রাজীবের গার্জেনকল ঠেকাল৷ অমিয়স্যার অচ্যুতকে বললেন, ‘অ্যাই, তোর বাংলা খাতাটা আমার দেখা হয়ে গেছে৷ এত বানান ভুল করিস কেন রে? অভিধান অবলোকন করবি৷ ছুটির পর এসে খাতাটা নিয়ে যাস৷ কাল বর্ষণের জন্যে আমি একটু আথিবিথি বেরিয়ে গিয়েছিলাম৷’
আবার সেই ‘ছুটির পর’! তার ওপর আবার ‘আথিবিথি’! অমিয়স্যারের সঙ্গে পরিচয় না-হলে অচ্যুত কোনওদিন জানতেই পারত না ওর মাতৃভাষায় এত মারপ্যাঁচ আছে৷
অচ্যুতের চোখ অনেকক্ষণ ধরেই চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছিল৷ স্যারদের বসার বিশাল টেবিলের শেষ প্রান্তে সত্যবানস্যার বসে আছেন৷ কী একটা বইয়ের পাতায় ডুবে আছেন৷ চারপাশের জগৎ সম্পর্কে কোনও হুঁশ নেই৷
অচ্যুত অমিয়স্যারের কথার ওপরে কথা বলতে পারল না৷ শুকনো মুখে ঘাড় নাড়ল৷ ছুটির পরই ও স্যারের সঙ্গে দেখা করতে আসবে৷
টিফিন শেষের ঘণ্টা একটু আগেই বেজেছে৷ ওরা চারজন তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ক্লাসে ফিরে চলল৷
অচ্যুতের মনে অশান্তির ঝড় দ্বিগুণ হয়ে গেল৷ ও কি স্যারের সঙ্গে দেখা করতে একা যাবে, নাকি কুলদীপ, বাসব, কিংবা সৌরভকে সঙ্গে নিয়ে যাবে? কিন্তু সঙ্গে কাউকে নিয়ে গেলে অমিয়স্যার বিরক্ত হতে পারেন৷ তা ছাড়া টিচার্স রুমে সত্যবানস্যার তো ওকে আর একা পাচ্ছেন না!
সুতরাং ছুটির ঘণ্টা পড়তে-না-পড়তেই অচ্যুত পা চালাল টিচার্স রুমের দিকে৷ দেরি করে গেলে টিচার্স রুম ফাঁকা হয়ে যেতে পারে৷ সেই ঝুঁকি অচ্যুত নিতে চায় না৷
টিচার্স রুমে গিয়ে দেখল অমিয়স্যার ছাড়া আরও অনেক স্যারই তখন সেখানে রয়েছেন৷ যদিও সত্যবানস্যারকে অচ্যুত দেখতে পেল না৷
অনুমতি নিয়ে অমিয়স্যারের কাছে গেল অচ্যুত৷ স্যারের কাছ থেকে খাতা নিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে করিডর ধরে হাঁটা দিল৷
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় ওর কাঁধে কে যেন হাত রাখল৷
মুখ তুলে তাকাল অচ্যুত৷
সত্যবানস্যার৷ মুখে এক চিলতে হাসি৷ জিভের ডগা দিয়ে ঠোঁট চাটছেন৷
আশেপাশে আরও কয়েকজন ছেলে সিঁড়ি বেয়ে নামছে৷ কিন্তু ওরা নিজেদের মধ্যে গল্প করতেই মশগুল৷
সত্যবানস্যার ওর সঙ্গে-সঙ্গে নামতে লাগলেন, আর চাপা গলায় কথা বলতে লাগলেন৷
‘জানিস তো, মানুষ অনেক সময় ভুল দ্যাখে! যেমন, তুই কাল বিকেলে যা দেখেছিস ভুল দেখেছিস৷ কারণ, তুই যা দেখেছিস সেটা প্রমাণ করতে পারবি না৷ আর প্রমাণ দিতে না পারলে কেউ তোর কথা বিশ্বাসও করবে না৷’ স্যার হিসহিস শব্দ করে হাসলেন : ‘এখন বিজ্ঞানের যুগ৷ সবাই শুধু প্রমাণ চায়৷’
গলা শুকিয়ে কাঠ৷ কাঁধের ওপরে স্যারের আঙুলের চাপে ব্যথা লাগছে৷ মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে৷ অচ্যুতের মনে হচ্ছিল এখুনি বুঝি ও অজ্ঞান হয়ে যাবে৷
একতলায় নেমে সত্যবানস্যার বাঁদিকে কয়েক পা হেঁটে গেলেন৷ ক্লাস ফাইভের বি সেকশানের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন৷
অচ্যুত কাঠের পুতুলের মতো স্যারের পাশে-পাশে হাঁটছিল৷ স্যার থমকে দাঁড়াতেই ও-ও দাঁড়িয়ে পড়ল৷
এদিকের বারান্দাটা এর মধ্যেই ফাঁকা হয়ে গেছে৷ সুতরাং ওদের কথা শুনতে পাবে কাছাকাছি এমন কেউ নেই৷
ক্লাসরুমের দরজার কাছটায় অচ্যুতকে একরকম ঠেলেই নিয়ে গেলেন সত্যবানস্যার৷ চাপা গলায় বললেন, ‘শোন, কাউকে কোনও কথা বলবি না৷ অবশ্য বললেও কেউ আমল দেবে না৷ ওরে, মানুষের কি ভুল দেখার কোনও শেষ আছে! এই দ্যাখ!’ বলেই স্যার অচ্যুতের চোখের দিকে তাকালেন৷
অচ্যুত দেখল, সেখানে ধকধক করছে দুটো সবুজ টুনি বাল্ব৷ আর তার মধ্যে দুটো কালো ফুটকি হল চোখের মণি৷
‘এটাও তুই ভুল দেখছিস৷’ মিহি সুরেলা গলায় সত্যবানস্যার বললেন, ‘কারণ, তুই এটা প্রমাণ করতে পারবি না৷ সুতরাং তোর কথা কেউ বিশ্বাস করবে না৷’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সত্যবানস্যার৷ তার হিমেল ঝাপটা অচ্যুতের মুখ ছুঁয়ে গেল৷ অচ্যুতের গায়ে কাঁটা দিল৷
ও লক্ষ করল, স্যারের চোখের সবুজ রং ধীরে-ধীরে ফিকে হয়ে সাদাটে হয়ে গেল৷ তারপর সামান্য ছাই-রং হয়ে কটা চোখের চেহারা নিল৷ তারপর কালচে হয়ে আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল৷
সত্যবানস্যার হাসলেন, ‘তুই কাউকে কিচ্ছু বলবি না! কারণ, তুই আসলে কিছুই দেখিসনি৷ কাল সন্ধেবেলা কোচিং-এ আসবি, কামাই করবি না৷ ভাবিস না, তুই পালিয়ে বাঁচবি৷ আমাদের হাত থেকে পালানো যায় না—৷’
অচ্যুত ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছিল৷ ওর মুখ থেকে কোনও শব্দ বেরোল না৷ কাঁধের ওপর স্যারের বাঁকানো আঙুলের চাপ যেন ছুরি বিঁধিয়ে দিচ্ছিল৷
‘এখন যা৷’ সত্যবানস্যার ওর কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে ওকে আলতো করে ঠেলে দিলেন : ‘তুই কিন্তু কিছুই দেখিসনি—৷’
অচ্যুত আর-একটু হলে টলে পড়ে যাচ্ছিল৷ কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে ও মাঠে নামার সিঁড়ির ধাপের দিকে এগোল৷ ভয়ে পিছন ফিরে তাকাতে পারল না৷
জল-কাদা পেরিয়ে যখন ও সাইকেল-স্ট্যান্ডের কাছে পৌঁছল তখন প্রতীক ওকে পিছন থেকে ডাকল৷
অচ্যুত ফিরে তাকাতেই প্রতীক জিগ্যেস করল, ‘তোকে স্যাটাস্যাট ওরকম হাসতে-হাসতে কী বলছিল রে?’
‘কিছু না৷ কাল কোচিং-এর খাতা-বই ঠিকমতো নিয়ে যাওয়ার কথা বলছিল৷’ অচ্যুতের গলা সামান্য কেঁপে গেল৷
‘তোকে স্যার হেভি ফেভার করে৷’ বেজার মুখে বলল প্রতীক, ‘অবশ্য ফেভার তো করবেই! তুই অঙ্কে একশোয় একশো পাস, আর আমার নম্বরটা চার কি পাঁচ দিয়ে গুণ করলে তবে একশো হয়৷ তবে অঙ্ককে আমি মোটেই ভয় পাই না৷ পারি-না-পারি, লড়ে যাই৷’
অচ্যুত হাসতে পারল না৷
কারণ, সত্যবানস্যারের একটা কথা বারবার ওর মনে কাঁটার মতো বিঁধছিল৷
বাড়ি ফিরেও ওর খচখচানিটা গেল না৷
স্যার বলেছেন, ‘…আমাদের হাত থেকে পালানো যায় না—৷’
এর মানে কী?
চার
অচ্যুত রাতে কুলদীপ আর সৌরভকে ফোন করল৷ পড়াশোনা নিয়ে কথা বলল, কোচিং নিয়ে কথা বলল, কিন্তু সত্যবানস্যারের কথা বলল না৷ বরং কুলদীপ উৎসাহ নিয়ে সত্যবানস্যারের রহস্য ভেদ করার ব্যাপারে নানান উদ্ভট পরামর্শ দিল৷ বলল, ‘স্যারকে ফলো করতে হবে, বুঝলি! সবসময় নজরে-নজরে রাখতে হবে৷ তা হলেই কেসটা বোঝা যাবে৷’
অচ্যুত তখন ভাবছিল, কুলদীপ তো আর স্যারের সবুজ চোখ দ্যাখেনি! দেখলে বোঝা যেত ওর এখনকার এত সাহস কতটা চুপসে যায়৷
রাতে বিছানায় শুয়ে অচ্যুত একরকম জেগেই রইল৷ ওর ভেতর থেকে ভয়টা কিছুতেই যেতে চাইছিল না৷ পরদিন স্কুলে যাওয়া নিয়ে সামান্য ভয় করলেও সেটা মা-বাপিকে বুঝতে দিল না৷ মনে-মনে ঠিক করল, স্কুলে কখনও ও আর একা থাকবে না৷ যেখানেই যাক, দু-একজন বন্ধুকে সঙ্গে নেবে৷ এমনকী টয়লেটে গেলেও৷
স্কুলের সময়টা শান্তিমতোই কেটে গেল৷ তবে একবার সত্যবানস্যার করিডরে অচ্যুতের পাশ দিয়ে হেঁটে গেছেন—কিন্তু ওকে চিনতে পারেননি৷
অচ্যুতের সঙ্গে প্রতীক ছিল৷ পরশুদিন সত্যবানস্যারের এরকম অদ্ভুত আচরণ ও নিজের চোখে দেখেছে৷ স্যার চলে যাওয়ার পর ও চাপা গলায় বলল, ‘যা-ই বল, স্যাটাস্যাট কিন্তু একেবারে চেঞ্জ হয়ে গেছে!’
অচ্যুত চুপ করে রইল৷ এই দেড় দিনে চুপ করে থাকাটা ওর দিব্যি অভ্যেস হয়ে গেছে৷
স্কুল ছুটির পর একটা বিচিত্র দৃশ্য অচ্যুতের চোখে পড়ল৷ ওরা যখন বেরোচ্ছে তখন দেখল সত্যবানস্যার মাঠের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে বানজারার গোরু আর বাছুরকে আদর করছেন৷ ওদের গলার কাছে কুঁচি দেওয়া যে নরম চামড়া থাকে—যাকে গলকম্বল বলে—সেখানে হাত বোলাচ্ছেন৷ আর অবোলা জীব দুটো চুপটি করে দাঁড়িয়ে স্যারের আদর খাচ্ছে৷
গোরু-বাছুরকে আদর করা নিশ্চয়ই খারাপ নয়৷ কিন্তু সত্যবানস্যারকে আগে কখনও কেউ এরকম আদর করতে দ্যাখেনি৷
সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফেরার পথে নানান দুশ্চিন্তা অচ্যুতের মাথার ভেতরে ছোটাছুটি শুরু করে দিল৷
ঘণ্টাদুয়েক পর যখন ও সত্যবানস্যারের কোচিং-এ রওনা হল তখনও চিন্তাগুলো ওর মাথা থেকে যায়নি৷
আকাশ ঘোলাটে মেঘলা৷ ভেজা মেঘের আড়ালে আবছাভাবে চাঁদ দেখা যাচ্ছে৷ বেহিসেবি বাদলা হাওয়া কখনও-কখনও গাছগাছালির পাতা দুলিয়ে দিচ্ছে৷ ভাঙাচোরা রাস্তায় এখানে-ওখানে জল-কাদার নকশা৷ দোকানপাটে খদ্দেরের তেমন ভিড় নেই৷
পথচলতি সাইকেল রিকশা আর স্কুটারকে পাশ কাটিয়ে সাবধানে সাইকেল চালাচ্ছিল অচ্যুত৷ সত্যবানস্যারের কোচিং-এ স্কুলের পাশ দিয়েই যেতে হয়৷ যাওয়ার সময় দেখল, অন্ধকারে ভূতের মতো দোতলা স্কুল-বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে৷ শুধু বানজারার ঘরে আলো জ্বলছে৷
কোচিং-এ পৌঁছে প্রথম-প্রথম একটা ‘কী হয়, কী হয়’ ভাব থাকলেও শেষ পর্যন্ত কোচিং-এর সময়টা বেশ স্বাভাবিকভাবেই কাটল৷ গত সপ্তাহের মতো তুখোড় পেশাদার ঢঙেই পড়ালেন সত্যবানস্যার৷ অচ্যুতের অঙ্ক কষার কেরামতিকে তারিফ করলেন, ওর পিঠ চাপড়ে দিলেন৷ প্রতিটা অঙ্ক বেশ সহজ করে সবাইকে বুঝিয়ে দিলেন৷ মনোযোগ দিয়ে খাতা দেখে দিলেন৷ সব মিলিয়ে কোথাও কোনও ছন্দপতন নেই৷
তবে একটা ব্যাপারে সামান্য খটকা লাগল অচ্যুতের৷
রাজীবের অঙ্কের অবস্থা প্রতীকের মতোই৷ তার ওপর রাজীবের আবার অঙ্ক নিয়ে আতঙ্ক আছে৷ অঙ্ক কষতে গিয়ে ও ঘন-ঘন আটকে যাচ্ছিল৷ সত্যবানস্যার অনেকক্ষণ ধরে ওকে লক্ষ করছিলেন৷ তারপর ওর কাছে গিয়ে আলতো করে ঘাড়ে হাত বোলাতে লাগলেন : ‘চেষ্টা কর, ঠিক পারবি৷ পৃথিবীতে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়—৷’
রাজীবকে আজ যেন স্যার বড্ড বেশি যত্ন নিয়ে অঙ্ক দেখাচ্ছেন৷ আগে কখনও এই যত্ন অচ্যুতের চোখে পড়েনি৷ তার ওপর ঘাড়ে যেরকম মোলায়েম করে হাত বোলাচ্ছেন তাতে বানজারার গোরু-বাছুরকে আদর করার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল৷
অচ্যুত মনে-মনে নিজেকে ধমক দিল৷ আজকাল ওর কী হয়েছে! সবকিছুতেই শুধু খটকা লাগছে! একজন স্যার কি হঠাৎই স্নেহপ্রবণ হতে পারেন না?
কিন্তু ধমক খেয়েও অচ্যুতের মন মানতে পারছিল না৷ বরং ভাবছিল, হঠাৎ করে কেউ যদি দেওয়াল বেয়ে হাঁটতে শুরু করে তা হলে তার আচমকা স্নেহপ্রবণ হয়ে উঠতে বাধা কী!
কোচিং শেষ করে ফেরার সময় রাজীব বলল, ‘অচ্যুত, আমি তোর সঙ্গে যাব৷ আমাকে পরেশদার কেকের দোকানে নামিয়ে দিবি৷’
রাজীবের সাইকেল নেই৷ অ্যাক্সিডেন্ট হবে এই ভয়ে বাবা-মা কিনে দেননি৷
কুলদীপ কোচিং ক্লাস চলার সময় অনেকবার অচ্যুতের দিকে তাকিয়ে হতাশভাবে ইশারা করেছে৷ ঠোঁট উলটে মাথা নেড়েছে৷ অর্থাৎ, সন্দেহজনক কিছু নজরে পড়ছে না৷
অচ্যুত কোনও উত্তর দেয়নি৷
কোচিং-এর বাইরে বেরিয়ে অচ্যুতের কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে কুলদীপ বলল, ‘ধৈর্য চাই, ধৈর্য৷ সহজে এ-রহস্যের জট খুলবে না৷’
অচ্যুত ‘হুঁ—’ বলে সায় দিল৷
ওর সাইকেলে সামনের রডে বসার সময় রাজীব জিগ্যেস করল, ‘আমাকে ক্যারি করতে পারবি তো? এই জল-কাদায় যদি ফেলে দিস তা হলে জামা-প্যান্টের বারোটা বেজে যাবে৷ তারপর মাম্মির হাজারটা কোশ্চেন—৷’
‘তোর কোনও ভয় নেই৷ আমি তিনমাস ধরে ডাবল ক্যারি করছি৷’
ওকে বসিয়ে নিয়ে অচ্যুত সাবধানে সাইকেল চালাতে লাগল৷
এখন বৃষ্টি নেই৷ তবে কখন শুরু হবে কেউ বলতে পারে না৷ কাগজে লিখেছে, কোথায় যেন নিম্নচাপ হয়েছে—তার জন্যই নাকি এরকম বাজে অবস্থা৷
একটু পরেই ওরা স্কুলের কাছাকাছি চলে এল৷
স্কুলের একরকম পাশেই এক প্রকাণ্ড পুকুর৷ তার ঢালু পাড়ে বড়-বড় মানকচু গাছ আর আগাছার ঝোপ৷ নাম-না-জানা লতানে গাছের দল আধো-অন্ধকারে সাপের মতো জড়াজড়ি করে রয়েছে৷
পুকুরপাড়ের বেড়ে ওঠা আগাছার রমরমাকে রুখে দিয়েছে ছোট-ছোট চার-পাঁচটা দোকান৷ দরমা, বাঁশ আর চাটাই দিয়ে ঘেরা চা-সিগারেট-পান-বিড়ির দোকান৷ সেখানে হ্যারিকেন বা কুপির আলো জ্বলছে৷
দোকানগুলোর ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ছে অন্ধকার আর কচু পাতার কালো ছায়া৷ সেখান থেকে নানান সুরে ভেসে আসছে ব্যাঙের ডাক৷
পুকুর পেরিয়ে স্কুলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গোরুর ‘হাম্বা’ ডাক অচ্যুতের কানে এল৷
অচ্যুত বলল, ‘স্যাটাস্যাট আজ তোকে ব্যাপক আদর করছিল৷’
‘হ্যাঁ রে, আমিও তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি৷ অন্যদিন কীরকম বকুনি দেয়! বলে, বাপিকে রিপোর্ট করবে…৷’
‘এবার তুই অ্যানুয়ালে অঙ্কে এইট্টি পারসেন্ট পাবি৷’
‘ভ্যাট!’
‘দেখিস…৷’
পরেশদার কেকের দোকান এসে গিয়েছিল৷ অচ্যুত দোকানের কাছ ঘেঁষে সাইকেল থামাল৷ কাঁচা ড্রেনের ওপরে পাতা সিমেন্টের স্ল্যাবে ওর সামনের চাকা ঠেকে গিয়ে সামান্য ঝাঁকুনি লাগল৷
রাজীব সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়াল : ‘কাল টিফিনের জন্যে কেক আর প্যাটিস কিনব৷’
অচ্যুত টিফিনে মায়ের হাতে তৈরি লুচি কিংবা পরোটা নিয়ে যায়—সঙ্গে আলুর তরকারি বা আলুভাজা৷ মাসে দু-একদিন কেক বা প্যাটিস৷ আর দু-তিন টাকা পকেটে থাকলে টিফিনের সময় স্কুলের দরজায় ভিড় করে দাঁড়ানো বিভিন্ন ‘ওলাদের’ কাছ থেকে ঝালমুড়ি, ঘুগনি বা বাদাম খায়৷
রাজীব হঠাৎ জিগ্যেস করল, ‘একটা সিগারেট টেস্ট করে দেখবি নাকি?’
‘না না—আমার ওসব ভালো লাগে না৷’
‘সেদিন কুলদীপ দু-চার টান দিয়েছিল৷ মন্দ নয়৷ জানিস তো, ও মাঝে-মাঝে স্মোক করে!’
‘জানি!’
রাজীব আবদারের গলায় বলল, ‘যাই বল, আজ এরকম বৃষ্টি-বাদলার দিন…একটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে করছে৷ অচেনা দোকান থেকে কিনব৷ তারপর দুটো টফি খেয়ে বাড়ি যাব—কেউ গন্ধ পাবে না৷ তুই খাবি না—শিয়োর?’
অচ্যুত হেসে বলল, ‘না৷’
তারপর রাজীবকে টা-টা করে চলে গেল৷
রাজীব পরেশদার দোকানে ঢুকতে যাচ্ছে, এমন সময় পিছন থেকে কে যেন ওকে নাম ধরে ডাকল৷
ঘুরে তাকাল রাজীব৷
সত্যবানস্যার৷ সাইকেল পাশে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন৷ রাজীবের দিকে তাকিয়ে অল্প-অল্প হাসছেন৷
রাজীব স্যারের কাছে এগিয়ে গেল, ‘কিছু বলবেন, স্যার?’
‘হ্যাঁ৷ কী কিনবি কিনে নে, তারপর চল, যেতে-যেতে বলছি৷ তোর বাড়ি তো স্টেশনের দিকে৷ চল, তোকে বাড়ির কাছে নামিয়ে দেব৷’
‘সিগারেট খাওয়াটা ভোগে গেল’, মনে-মনে ভাবল রাজীব৷ স্যার যে পিছন-পিছন আসবেন তা ও কেমন করে জানবে! এরকম আগে কখনও হয়নি৷
কিন্তু রাজীব অবাক ভাবটা চেপে রাখল৷ ছোট্ট করে বলল, ‘একমিনিট ওয়েট করুন, স্যার, আমি এক্ষুনি আসছি৷’
তারপর ছুট্টে ঢুকে পড়ল পরেশদার দোকানে৷
পরদিন স্কুলে ঢুকে অচ্যুত দেখল বানজারার ঘরের সামনে অনেক ছাত্রের ভিড়৷ দু-একজন গার্জেন আর স্যারও দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে৷
সাইকেল জায়গামতো রেখে মাঠের কোণের দিকটায় ছুটে গেল অচ্যুত৷ ভিড় ঠেলে সরিয়ে ভেতরে ঢুকল৷
দৃশ্যটা দেখার আগেই বানজারার বউয়ের কান্না শুনতে পাচ্ছিল অচ্যুত৷ কাঁদছিল আর দেশোয়ালি ভাষায় বিলাপ করছিল৷ ওর কথার একটি বর্ণও অচ্যুত বুঝতে পারছিল না৷ শুধু ‘রামুয়া’ শব্দটা শুনতে পাচ্ছিল আর এটুকু বুঝতে পারছিল, ভালোবাসার কেউ মারা গেলে মানুষ এরকম বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ে৷
বৃত্তের ভেতরে ঢুকে দৃশ্যটা দেখতে পেল অচ্যুত৷
রামুয়া আর ওর বাছুর মাটিতে পাশাপাশি পড়ে আছে৷ ওদের চোখ বোজা৷ বানজারার বউ ওদের ওপর শরীর এলিয়ে কাঁদছে৷
বানজারা একপাশে বেজার মুখে উবু হয়ে বসে ছিল৷ চোখ ছলছল৷ মাথাটা ডানহাতে ভর দিয়ে হেলানো৷
অচ্যুত অবাক হয়ে দেখল, রামুয়ার ধপধপে সাদা গলায় রক্তের দাগ৷ খানিকটা রক্ত শুকিয়ে জমাট বেঁধে রয়েছে৷ ওর বাছুরের দশাও তাই৷ ঠিক মনে হচ্ছে, কোনও হিংস্র জন্তু ওদের নরম গলায় কামড় দিয়েছে৷
কিন্তু এই সামান্য ক্ষত থেকে কি এতবড় মাপের একটা গোরু মরে যেতে পারে?
তা ছাড়া কোন জানোয়ারই-বা গোরুর গলায় এভাবে কামড়ায়? সাপ, নাকি কুকুর?
বানজারা এবং আশেপাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের কথাবার্তার টুকরো জুড়ে গোটা গল্পটা মোটামুটি আঁচ করতে পারল অচ্যুত৷
আজ ভোর-রাতের দিকে গোয়ালঘর থেকে একটা ঝটাপটির শব্দ বানজারা শুনতে পায়৷ ব্যাপারটা কী বোঝার জন্য ও বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে৷ কিন্তু ততক্ষণে সব আবার চুপচাপ হয়ে গেছে৷ তখন বানজারা আর ঘর ছেড়ে বেরোয়নি৷ অনেক সময় রামুয়া আচমকা খেপে উঠে পা ছোড়াছুড়ি করে৷ ব্যাপারটা সেইরকম কিছু একটা ভেবে বানজারা আবার শুয়ে পড়ে৷ পাশে ঘুমিয়ে থাকা বউকেও আর ডাকেনি৷
সকালবেলা ঘর থেকে বেরিয়েই বানজারার বউ চিৎকার করে ওঠে৷ সেই চিৎকার শুনে বানজারা ছুটে যায়৷ দ্যাখে রামুয়া গোয়ালঘরের বাইরে জলকাদার ওপরে কাত হয়ে পড়ে আছে—তখনও দেহ একেবারে অসাড় হয়ে যায়নি৷ আর ওর বকনা বাছুরটা গোয়ালঘরের ভেতরে চোখ কপালে তুলে শেষ৷
বানজারা আর ওর বউ মিলে বাছুরটার দেহ গোয়ালঘরের গুমোট অন্ধকার থেকে বাইরের খোলা হাওয়ায় নিয়ে আসে৷ তারপর ঘটির পর ঘটি জল ঢেলে মা-মেয়েকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করে, কিন্তু সবই বেকার৷ দুজনেরই দেহান্ত হয়ে যায়৷
অচ্যুতের দৃশ্যটা ভালো লাগছিল না৷ ও ভিড় ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এল৷
পিছন থেকে কুলদীপ ওর কাঁধে হাত দিল৷
অচ্যুত চমকে উঠল৷ কুলদীপ কখন এসেছে ও টের পায়নি৷
কুলদীপ হাতঘড়ি দেখে বলল, ‘চল, ক্লাস বসে যাবে৷ আজ তো আর ঘণ্টা পড়বে না৷’
‘ওই গোরু আর বাছুরটার কী করে এমন দশা হল বল তো!’
‘কী জানি!’ ঠোঁট ওলটাল কুলদীপ : ‘শোন, আজ সকালে মউলি ফোন করেছিল৷ ও আজ হিস্ট্রি কোচিং-এ যাবে না৷ তোর নোটটা নেক্সট উইকে ফেরত দেবে৷’
অচ্যুতরা কয়েকজন সুপারমার্কেটের কাছে ইতিহাস পড়তে যায়৷ ওখানে নগেনস্যারের কোচিং আছে৷ নগেনস্যার চিত্তরঞ্জন হাইস্কুলের টিচার ছিলেন—প্রায় বছরদশেক হল রিটায়ার করেছেন৷ নগেনস্যার যখন ইতিহাস পড়ান তখন অচ্যুতদের মনে হয়, ওরা যেন সিনেমা দেখছে৷ ওদের চোখের সামনে চন্দ্রগুপ্ত, চাণক্য, মেগাস্থিনিস চলে-ফিরে বেড়াচ্ছে৷
মউলি কমলাবালা গার্লস হাইস্কুলে পড়ে৷ অচ্যুতদের পাশের বাড়িতেই থাকে, অথচ সবসময় কুলদীপকে ফোন করে অচ্যুতকে খবর দেয়৷
মউলি খুব ছটফটে, শাড়ি পরতে ভালোবাসে না, বেণী দুলিয়ে হাঁটে৷ একদিন বিকেলে ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল অচ্যুত৷ খেয়াল করেনি যে, ওদের ছাদে দাঁড়িয়ে মউলি ওর ঘুড়ি ওড়ানোর হাস্যকর চেষ্টা দেখছে৷
‘যারা সবসময় লেখাপড়া করে তারা ঘুড়ি ওড়াতে গেলে এরকমই হয়—৷’
ঘুড়ি ওড়ানো থামিয়ে ফিরে তাকাল অচ্যুত৷ ওর ময়ূরপঙ্খী ঘুড়িটা গোঁত খেয়ে সামনের বাড়ির শিউলি গাছে আটকে গেল৷
তাই দেখে মউলি খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়েছিল৷
অচ্যুত বলল, ‘আমি মোটেই সবসময় লেখাপড়া করি না—তা হলে এখন ঘুড়ি ওড়াচ্ছি কী করে৷’
ঠোঁট ব্যাঁকাল মউলি : ‘আজকের ব্যাপারটা তো একটা অ্যাক্সিডেন্ট৷ তুমি দিনরাত লেখাপড়া করো বলেই তো আমার পড়ায় মন বসে না—৷’
ধুত, যত্তসব উলটোপালটা কথা৷ ওর অভিযোগ হেসে উড়িয়ে দিতে চাইল অচ্যুত৷ বলল, ‘এরকম আবার হয় নাকি!’
‘হয়৷ দেখবে, আজ আমার কী দারুণ পড়ায় মন বসবে৷ মাঝে-মাঝে এরকম অ্যাক্সিডেন্ট হলে বেশ হয়…তা হলে সব কাজে আমার মন বসবে৷’
অচ্যুত কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না৷ ও ছাদের পাঁচিলের কাছে এসে সাত-আট ফুট দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মউলিকে দেখছিল৷ মউলির মাথার পিছনে সূর্য অস্ত যাবে বলে তৈরি হচ্ছিল৷
মাঝে-মাঝে এরকম অ্যাক্সিডেন্ট হলে বেশ হয়…৷ তার মানে?
মউলি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, ‘সকালে আর বিকেলে ছাদে এসে একটু ফ্রেশ বাতাস তো নিতে পারো৷ তা হলে দেখবে, ভালো হবে৷’
‘কার?’
‘দুজনেরই৷’
মউলির মুখে সূর্যের তেরছা আলো পিছলে গেল৷ ও চটপট ঘুরে দাঁড়িয়ে একরকম ছুটেই চলে গেল৷
সেদিন অচ্যুত ছাদে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেছিল৷ ঘুড়ি-লাটাই হাতে নিয়ে মউলির এলোমেলো কথার মানে বোঝার চেষ্টা করেছিল৷
তারপর থেকে অচ্যুত লক্ষ করেছে, মউলির কাজের কিছু বলার থাকলে ও কুলদীপের মারফত বলে পাঠায়৷ ইতিহাস কোচিং-এ যখন পড়তে যায় তখনও ও অচ্যুতের সঙ্গে খুব একটা কথা বলে না৷ বরং ছাদে যখন দেখা হয় তখন অনেক সহজভাবে অনেক উলটোপালটা অকাজের কথা বলে৷ বলে, ‘তুমি ভিতু, তোমার মাথায় বুদ্ধি নেই৷ কী করে অঙ্কে একশোয় একশো পাও কে জানে!’
অচ্যুত জবাব না দিলেও ওর কথাগুলো নিয়ে চুপচাপ বসে ভাবে৷
এখন কুলদীপ যে-নোটটার কথা বলেছে সেটা মউলি চেয়ে পাঠিয়েছিল কুলদীপের মারফত৷ আবার সেটা ফেরতও আসবে কুলদীপের হাত দিয়ে৷ তা হলে তো মউলি কুলদীপের কাছ থেকেই নোটটা নিতে পারত! কারণ, নগেনস্যারের ডিকটেশান থেকে ওরা সবাই নোট নিয়েছিল৷ সেদিন মউলি আসেনি৷
আবার একদিন ছাদে দেখা হতে অচ্যুত এই অদ্ভুত ‘যোগাযোগ ব্যবস্থা’ নিয়ে প্রশ্ন করেছিল৷ উত্তরে মউলি হেসে বলেছিল, ‘এতে একটা অন্যরকম মজা আছে—তুমি বুঝবে না৷’
ওর ভ্যাবাচ্যাকা মুখের দিকে তাকিয়ে একটু পরে মউলি বলেছে, ‘ঠিক আছে, আমি দুটো এক্স্যাম্পল দিয়ে তোমাকে বোঝাচ্ছি৷ সামনাসামনি কথা বলার চেয়ে টেলিফোনে কথা বললে কত ভালো লাগে৷ আবার সেই কথাগুলো চিঠি দিয়ে বলাবলি করলে…ওঃ, ফ্যান্টাস্টিক৷’
একটু চুপ করে থেকে অচ্যুতকে দেখল মউলি৷ তারপর জিগ্যেস করল, ‘কিছু বুঝলে?’
অচ্যুত মাথা নাড়ল৷ সত্যিই ও কিছু বোঝেনি৷
তাই এখন কুলদীপের কথায় ও শুধু ঘাড় হেলাল৷
তখনই ওর চোখ গেল স্কুলের দোতলার বারান্দার দিকে৷
সত্যবানস্যার বারান্দার রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন৷ আকাশের দিকে তাকিয়ে একমনে সিগারেট খাচ্ছেন৷ নীচে বানজারার ঘরের কাছে যে অত হইচই, ভিড়, সেদিকে কোনও ভ্রূক্ষেপও নেই৷
হঠাৎই মাঠে একটা শোরগোল ব্যস্ততা শুরু হল৷ ছাত্রের দল প্রায় ছুটে চলে গেল স্কুল বিল্ডিং-এর কাছে৷ হুড়মুড় করে যার-যার ক্লাসরুমের দিকে রওনা হল৷
ওদের কথাবার্তার টুকরো শুনে অচ্যুতরা বুঝল হেডস্যার এসে গেছেন৷ পিছন ফিরে তাকাতেই ওরা হেডস্যারকে দেখতে পেল৷
হেডস্যার মোহনলাল পুরকায়স্থ রোগা শরীরটাকে টান-টান করে মাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে আসছেন৷ মাথায় টাক, চোখে চশমা, ভাঙা গাল, চোয়াল শক্ত৷ দেখলেই বোঝা যায় বেশ কড়া ধাতের মানুষ৷ সবসময় ডিসিপ্লিন বজায় রাখতে চান৷ কিন্তু আজ প্রেয়ার হবে কি না কে জানে! বানজারা ঘণ্টা বাজাতে পারেনি৷ তা ছাড়া অনেকটা দেরিও হয়ে গেছে৷
কিন্তু প্রেয়ারের ঘণ্টা বাজল—দেরিতে হলেও৷ হেডস্যার পরিস্থিতির দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন৷ এখন বানজারার গোরু-বাছুরের মৃতদেহের নিশ্চয়ই একটা গতি হবে৷ কিন্তু কোন প্রাণী ওদের গলার অমন হিংস্র কামড় বসিয়েছে সেটা জানা যাবে কী?
ক্লাস বসল৷ অচ্যুত ভালো করে পড়ায় মন দিতে পারছিল না৷ বারবার ভাবছিল, স্কুলে হঠাৎ এসব কী শুরু হল!
টিফিনের সময় প্রতীক ওকে জিগ্যেস করল, ‘কী রে, রাজীব আজ এল না?’
অচ্যুত বলল, ‘দেখছি তো আসেনি—৷’ একইসঙ্গে ওর মনে পড়ে গেল, রাজীব আজ টিফিনের জন্য কেক-প্যাটিস কিনতে পরেশদার দোকানে নেমেছিল৷
তা হলে কি হঠাৎ করে ওর জ্বর-টর হল!
চুরির ব্যাপারটা ধরা পড়ার পর থেকে রাজীব ওদের অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে৷ নিজের অন্যায়ের জন্য বারবার ওদের কাছে দুঃখ করেছে, ক্ষমা চেয়েছে৷ অচ্যুত ভাবল, রাতে একবার ফোন করে রাজীবের খবর নেবে৷ কিন্তু তখনই খেয়াল হল, ওর কাছে তো রাজীবের ফোন নম্বর নেই৷ তখন ও প্রতীককে বলল ফোন করে রাজীবের খবর নিতে৷
টিফিনের সময় প্রতীক পকেট থেকে একটা পাতলা ক্যালকুলেটর বের করে অচ্যুতদের দেখাল : ‘আমার ছোটমামা পরশু আমেরিকা থেকে ফিরেছে—আমার জন্যে এটা নিয়ে এসেছে৷’
ওরা একে-একে ওটা হাতে নিয়ে বোতাম টিপে দেখতে লাগল৷
কুলদীপ বলল, ‘এই, তোরা ক্যালকুলেটর পরে দেখবি—আগে শোন, সামনের শনিবার দুটোর সময় “সি” সেকশনের সঙ্গে আমাদের ফুটবল ম্যাচ ঠিক করেছি৷ আজ ছুটির পর টিম ফাইনাল করে ফেলতে হবে৷’
বাসব আর সৌরভ হইহই করে উঠল৷ ওরা দুজনে ফুটবলের পোকা৷
তারপর ফুটবল নিয়ে জোরালো আলোচনা শুরু হয়ে গেল৷ কিছুক্ষণের জন্য বিপজ্জনক অশুভ ঘটনাগুলো মুছে গেল ওদের মন থেকে৷
সেদিন ছুটির পর অচ্যুত যখন সাইকেল করে বাড়ি ফিরছিল তখন ওর মনটা বেশ হালকা লাগছিল৷ আজ সাতটার সময় নগেনস্যারের কাছে পড়া আছে৷ মউলি আজ আসবে না৷ কুলদীপকে দিয়ে মউলি যেমন খবর পাঠায়, অচ্যুতেরও কি পালটা কোনও খবর পাঠানো উচিত? নাকি কাল বিকেলে ছাদে উঠে ওর জন্য অপেক্ষা করবে? যদি অ্যাক্সিডেন্ট হয়! মউলিকে সত্যবানস্যারের ব্যাপারটা একটুও বলা হয়নি৷ বলতে পারলে অচ্যুতের মন হালকা হত৷
ইতিহাসের কোচিং সেরে অচ্যুত বাড়ি ফিরল প্রায় পৌনে ন’টা নাগাদ৷ আর ফিরেই শুনল প্রতীক ওকে ফোন করেছিল৷ কোচিং থেকে ফিরলে ফোন করতে বলেছে৷ খুব জরুরি দরকার৷
বই-খাতা গুছিয়ে রেখে প্রতীককে ফোন করল অচ্যুত৷
একবার রিং বাজতে-না-বাজতেই প্রতীক রিসিভার তুলে ‘হ্যালো’ বলল৷
‘আমি অচ্যুত—৷’
‘ওঃ, তোর ফোনের জন্যেই ওয়েট করছিলাম৷ এক্ষুনি রাজীবের বাড়িতে যেতে হবে৷’
‘কেন?’ অচ্যুত অবাক হয়ে গেল৷
‘সে অনেক ব্যাপার—গেলে সব জানতে পারবি৷ আমি কুলদীপকে ফোন করে দিচ্ছি, ও দশ মিনিটের মধ্যে রাজীবের বাড়ি পৌঁছে যাবে৷ তুইও চলে আয়৷’
অচ্যুতের বুকের ভেতরে একটা ধকধকানি শুরু হল৷ রাজীব কাল টিফিনের কেক-প্যাটিস কিনেছিল, কিন্তু আজ স্কুলে আসেনি! ওর কি কোনও বিপদ হয়েছে?
‘কী হয়েছে রাজীবের?’ অচ্যুতের গলার স্বরটা খসখসে হয়ে গেল৷
‘বললাম তো, গিয়ে সব শুনবি—৷’
ফোন রেখে দিল প্রতীক৷
অচ্যুত মায়ের কাছে গিয়ে বলল, ‘আমাকে এখুনি একবার সাইকেল নিয়ে বেরোতে হবে৷’
‘কেন রে, রাত ন’টার সময় কোথায় বেরোবি?’
অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে মিথ্যে কথা বলল অচ্যুত, ‘প্রতীকের কাছে আমার একটা নোট রয়ে গেছে৷ সেটা আজ রাতেই লাগবে—পড়তে হবে৷ বেশিক্ষণ লাগবে না—আমি দশটার মধ্যেই ফিরে আসব৷’
সাইকেল নিয়ে রাস্তায় বেরোল অচ্যুত৷ আকাশের দিকে একবার তাকাল৷ সেখানে ঘোলাটে লালচে মেঘ অপেক্ষা করছে৷
তখনই চোখ গেল মউলিদের বারান্দায়৷ একটা মেয়েলি ছায়া সেখানে দাঁড়িয়ে আছে—হাতে ধরা রেডিয়ো বাজছে৷
সাইকেল চালিয়ে রাজীবদের বাড়ির দিকে যাওয়ার সময় অচ্যুত বেশ বুঝতে পারছিল ওর বুকের হালকা ভাবটা কখন যেন মিলিয়ে গেছে৷ তার বদলে মেঘলা আকাশটা চুপিচুপি সেখানে ঢুকে পড়েছে৷