ভাবছিলাম কবি আলাওলের চোখ আয়ত ছিলো কিনা;
ভাবছিলাম কাদম্বরী দেবী, জেদী মেয়ে,
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে যেদিন মরণ-গহন আফিম খেলেন,
সেদিন তিনি যে শাড়ি পরেছিলেন, কী রং ছিল তার;
ভাবছিলাম, আউসভিৎসের কন্সেনট্রেশনক্যাম্পে বন্দি ছিলেন যাঁরা
তাদের জীবনের চালচিত্র ছিল কী রকম, ভাবছিলাম
অনেক মুণ্ডিত মাথা আর ডোরাকাটা পোশাকের কথা;
উপনিষদ তর্জমা করবার সময়
যুবরাজ দারাশিকোর মনে মুঘল তরবারির ছায়া
নাকি বৈদিক ঋষির তপোবনের হরিণশিশুর কোমলতা
লতিয়ে উঠেছিলো। যে-পথে যীশু সুসমাচার শোনাতে শোনাতে
হেঁটে গেছেন, সে-পথের কথাই আমি ভাবছিলাম।
এমন সময় আমার মাতামহের শেরওয়ানীর রঙের মতো
মেঘমালায় কী যেন একটা জেগে ওঠে।
মুহূর্তের জন্য মনে হয়, হয়তো শরীরের গ্রন্থিগুলি
বিশ্রাম নিচ্ছে স্বপ্নাচ্ছন্নতায়; আমার মাথার ভেতরে
স্বপ্ন ফুটিয়ে চলেছে এমন ফুল, যার ঘ্রাণ স্থান-কাল-পাত্রকে গালিয়ে
সৃষ্টি করে একটি সোনালি ধারা। মেঘমালা থেকে
কোনো অনার্য দেবতার মাথার মতো
উঠে এলো আমার মাতামহের টাইপরাইটার।
কয়েক দশকের লতাগুল্ম গায়ে নিয়ে ভেসে ওঠে
কোন নিরুদ্দেশ থেকে; দেখেই চিনে ফেললাম, বলা যাবে না।
বলা যাবে না, ওকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যই আমি
প্রতীক্ষায় আছি। প্রথমে সে দুলতে শুরু করে
একটু একটু করে, কোনো ব্যালে নর্তকের পরিচিত ভঙ্গি
স্মরণ করিয়ে দিয়ে, তারপর সে বসে আমার বুকের ওপর,
আমার মাতামহের সেই কবেকার বিলুপ্ত টাইপরাইটার।
আমি সেই টাইপরাইটারের সঙ্গে মূসাবা করে
বললাম, হে প্রাচীন হে দানেশমন্দ, আমার এই
খারাগ্রস্ত সত্তায় নামুক আপনার দোয়ার বৃষ্টিধারা। আমার হাতের
স্পর্শ পেয়ে তিনি উচ্চারণ করলেন স্বপ্ন থেকে জেগে-ওঠা
সুদূর, গাঢ় কণ্ঠে-তোমার নানী তোমার বাজুতে
একটা তাবিজ পরিয়ে দিয়েছিলেন বালকবয়সে,
তোমার মনে পড়ে? খেলার মাঠে কোনো এক ঝোড়ো সন্ধ্যাবেলা
তুমি সে তাবিজ হারিয়ে ফেলেছিলে, মনে পড়ে? মনে পড়ে
কারুকাজময় পালঙ্কে পাতা বিছানার কথা? বালিশ-পাখির নীড়,
আর বালিশে-রাখা কারো মাথা-পাখি, তোমার মনে পড়ে?
মনে পড়ে বিধবা ফুফুর কথা, যিনি
তোমার মাথার ঘ্রাণ নিয়ে সুরাপূত করতেন তোমাকে
খোড়ো ঘরের চালঘেঁষা পেয়ারা গাছের নিচে? মনে পড়ে
তাঁর কথা, যিনি তোমাকে একবার দা-এ রাখা
নুন খাইয়েছিলেন, তুমি ঘুরঘুট্রি অন্ধকারে ভয় পেয়েছিলে বলে?
কতকাল তাবিজবিহীন আমি কাটিয়েছি দিন,
কী করে যে কেটে গেল পঞ্চাশ বছর।
আমার মাতামহের টাইপরাইটার আবৃত্তি করছেন
কোরানের আয়াত, আওড়াচ্ছেন ফার্সি বয়েত। আমার স্বপ্নের দ্বীপে
তিনি প্রস্পেরো
প্রজ্ঞাবান আর ঐন্দ্রজালিক, যিনি এইমাত্র ভেঙে ফেলেছেন
তার দণ্ড, সমুদ্রে ডুবিয়ে এসেছেন পুঁথি। তাঁর কিবোর্ড থেকে
অবিরাম ঝরছে জুঁই চামেলীর মতো শব্দমালা;
যে-আমি ছিলাম প্রেরণারহিত, বন্ধ্যা গুহায় কুঁকড়ে-পড়ে-থাকা
সে আমি তর্জমা করে চলেছি টাইপরাইটার-নিঃসৃত শিল্পিত শব্দমালা
কী মোহন ভূতগ্রস্ততায়! কখনো আস্তে-সুস্থে, কখনো-বা
খুব দ্রুত, যতক্ষণ না ক্লান্তি এসে ভর করে চলমান কলমের ডগায়।