আমার বয়স আমি পান করে চলেছি সর্বদা। বয়সের
ওষ্ঠে ঠোঁট রেখে দেখি দূরে
বয়স দাঁড়িয়ে থাকে বালকের মতো
আলোজ্বলা গলির ভেতরে,
কখনো আর্মেনিয়ান গির্জের সমীপবর্তী মাঠে
বৃষ্টিভেজা কিশোরের ভঙ্গিমায়, কখনো-বা রোদে
আমার বয়স যুবা ভাঙা মন্দিরের পাশে থরথর বুকে
নিসর্গ, নারীর কাছে সমর্পিত। এখন তোমরা যারা খুব
জ্বলজ্বলে তীরে ব’সে গপ্পো করো হাওয়ায় উড়িয়ে
বাদামের খোসা,
বাতাসের মুখে দাও মেখে গোল্ড-ফ্লেক-ঘ্রাণ কিংবা
মধ্যরাতে শহরের পথে দ্যাখো সুনীল নাবিক,
দ্যাখো নিজেদের স্বপ্ন হেনরি মুরের
মূর্তির ভেতরে নিরালায় কী সবুজ ঘুমায় এবং শোনে
শ্মশানে সানাই,
তাদের নিকট এই বয়স আমার গালগল্প কিংবা কোনো
ম্যানিফোস্টো এলেবেলে রচিত।
আমার বয়স আজ চায়ের কাপের ঠোঁটে সাতচল্লিশটি
চুমো খায়, পদযুগ দেয় মেলে ডাগর সূর্যাস্তের,
এক বুক জলে একা দাঁড়িয়ে কখনো দ্যাখে সূর্যোদয় আর
কখনো টেবিলে হাত, হাতে ঠেকিয়ে চিবুক
আমার বয়স পড়ে অপরূপ মানচিত্র আকাঙ্ক্ষার, সুদূর স্বপ্নের।
মাঝে-মাঝে বয়সের চোখে পাতায় ক্যাকটাস
বসায় বিষাক্ত দাঁত, অকস্মাৎ বয়সের মাথা থেকে
খুসকি ঝরে যায়, খুসকি ঝরে যায়, খুসকি ঝরে যায়।
আমার বয়স গোনে এক দুই তিন চার পাঁচ ছয় সাত
আট নয় দশ
এক দুই তিন চার, গোনে, শুধু গোনে, মাঝে-মধ্যে
কড়িকাঠে রাখে চোখ, রাখে
আস্তিনে উচ্ছিষ্ট কণা স্বাপ্নিকের, অজস্র বিমর্ষ কাকাতুয়া
তার বুকে নেমে আসে। আমার বয়স ঘোরে গোলক ধাঁধায়,
দ্যাখে কিছু নেই, এমনকি ক্রূর মিনোটরের অস্পষ্ট
পদচ্ছাপও নেই।
আমার বয়স কাশে একা ঘরে মধ্যবয়সের
তামাটে প্রহরে
এবং প্রসেপ্স খেলে, বেড়ালের পিঠে হাত রেখে
কখনো ভাবুক হয়, মুখ ধোয়া স্বপ্নের বেসিনে বারংবার।
আমার বয়স কাঁধে ঈগল-কপোত নিয়ে হাঁটে
ফুটপাতে, কখনো-বা থমকে দাঁড়ায়, যেন কোনো
একান্ত নিঃসঙ্গ ঘোড়া মোটরের ভিড়ে;
কখনো সিংহের পিঠে চ’ড়ে বেড়ায় সমুদ্রতীরে
আয়ুভুক বয়স আমার।
আমার বয়স শার্ট, ট্রাউজার, গেঞ্জি, আন্ডারওয়ার খুলে
মেঝেতে গড়ায়, ভাবে কেন এত হিংসা দ্বেষ গ্রন্থের পাতায়?
কেন হু হু জল অবিরল পাবলিক লাইব্রেরির দু’চোখ বেয়ে ঝরে?
ফুটপাতগুলি কেন এমন ঔদাস্যে ভরপুর?
আমার বয়স জন্ম শাসনের বিজ্ঞাপনগুলিকে নিমেষে
বানায় বৈষ্ণব পদাবলি,
বন্দুককে ম্যান্ডোলিন, জংধরা কৌটাকে ললিপপ।
আমার বয়স চোখ হ’লে পরিপার্শ্ব হয়ে যায় সহসা ডিজনিল্যান্ড,
আমার বয়স চোখ হ’লে ক্লোজ শট, লং শটে
বিভক্ত, সম্পূর্ণ ফের চিত্রময় বিশদ জগৎ।
কারা কী ফোঁড়ন কাটে, বাঁকা চোখে তাকায় ক’জন,
কারা করে নফরৎ ইত্যাদিকে কখনো দেয় না পাত্তা আমার বয়স।
বলে সে, কী লাভ এই খিস্তি খেউড়ের প্রতি মনোযোগী হয়ে?
বরং রঙিন নুড়ি কুড়িয়ে বেড়াব একা-একা
অথবা ঝরনার পাশে শুয়ে শুনব পাখির রাঙা
প্রেমালাপ; কারো মুখচ্ছবি-ফেউ ইন-
স্বপ্নের জোয়ারে
আসবে সোনালি ভেসে। আমার বয়স কিছু ফেড আউটের
স্মৃতি বয়ে দূরবর্তী সুবর্ণরেখার দিকে ছুটে যায়।
আমার বয়স কৃষকের রৌদ্রদগ্ধ মুখের মতন স্পষ্ট
চেয়ে থাকে ফসলের দিকে,
দ্যাখে পঙ্গপাল আসে ঝাঁক ঝাঁক, কী হিংস্র ঝাঁপিয়ে
পড়ে মাঠে সর্বনাশা ক্ষুধায়, মেঘ না পোকামাকড়ের দল, বোঝা দায়।
আমার বয়স আজ কবির চোখের মতো নাচে
চরাচরে, যায় দূরে নক্ষত্রটোলায়, পাতালের
অন্ধকারে, মাছ আর বনহংসীর হৃদয়ে আর
কবরের নিস্তব্ধ গভীরে।
আমার বয়স তার করতলে অদৃশ্য মোহর পেয়ে খুশি,
আমার বয়স তস্করের মতো চতুষ্পার্শ্ব থেকে
এলেবেলে কত কিছু নিয়ে যায় ধ্বনি-প্রতিধ্বনিময় স্মৃতির গুহায়।
প্রাচীন পাথর আর লতাগুল্মের ভেতর হেঁটে যেতে যেতে
আমার বয়স ক্রমাগত মেপে চলে
একান্ত আপন মহাদেশ।