সাত
সময়ের ক্ষুদ্রতম একটি মুহূর্তে, জ্ঞান ফেরার পর, মাসুদ রানা উপলব্ধি করল কে সে-মেজর মাসুদ রানা, বি.সি.আই-এর একজন ফিল্ড এজেন্ট, যার রয়েছে মানুষ খুন করার বিশেষ লাইসেন্স।
জ্ঞানটুকু অল্পক্ষণ স্থায়ী হলো, সাথে আরামদায়ক, উষ্ণ পানিতে ভেসে থাকার একটা অনুভূতি, যেন ঝুলে আছে। একটা কণ্ঠস্বরও কানে ঢুকল, হ্যালোপেরিডল সম্পর্কে কি যেন বলছে। নামটা চিনতে পারল ও-একটা ড্রাগ, ট্র্যাংকুইলাইজার, হিপনোটিক প্রতিক্রিয়া হয়। তারপরই খোঁচাটা অনুভব করল ও, সুঁই বিধল বাহুতে। আবার চেতনা হারাল, বোধ হয় নিজেকেও।
.
গড, না জানি ক’টা বাজে! স্বপ্ন দেখছিল সে। পরিষ্কার স্বপ্ন, দুঃস্বপ্নই বলা চলে, তার প্রশিক্ষণ পর্ব সম্পর্কে। স্বপ্নের মধ্যে গলার আওয়াজ শুনল সে। মা-বাবার, বন্ধু-বান্ধবের, ছবি দেখল-ট্রেনিং, কমিশন পাবার পর তার প্রথম অ্যাপয়েন্টমেন্ট, আরও কত কিছুর।
জেনারেল বিল এইচ. পিলার নাইট টেবিল হাতড়াল, ডিজিটাল ওয়াচটা খুঁজছে। ভোর তিনটে। আসলে ওই শেষ গ্লাসের হুইস্কিটুকু খাওয়া উচিত হয়নি নাহ্, মদ্যপান অবশ্যই তার ছাড়া দরকার। নতুন প্রমোশন পাওয়ার পর থেকে এরকম বিচ্ছিরি ঘটনা বেশ ক’বারই ঘটল।
বালিশের ওপর ধপাস করে মাথা দিল সে, ঘামছে। ঘুমিয়ে পড়ল একটু পরই।
ইনফ্রা-রেড গ্লাসের ভেতর দিয়ে দেখছিল পিয়েরে ল্যাচাসি, মলিয়ের ঝানের দিকে ফিরল। ‘ভালই কাজ করছে,’ মেয়েলি গলায় ফিসফিস করে বলল সে। ‘হাতে এখনও প্রচুর সময়। এবার আমি ওকে যুদ্ধ সম্পর্কে কিছু বিশেষ অভিজ্ঞতা দান করব।’ মাইক্রোফোনটা নিজের দিকে টেনে নিল সে, কথা বলতে শুরু করল ধীরে ধীরে, নরম সুরে
ওদের নিচে একটা বেডরূম, সামরিক আদলে সাজানো-তেমন কোন ফার্নিচার নেই, নগ্ন দেয়ালে ব্যক্তিগত কয়েকটা মাত্র ছবি।
গভীর সম্মোহনী ঘুমের ভেতর, জেনারেল বিল এইচ. পিলার মোটেও বালিশ থেকে বেরিয়ে আসা যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর সম্পর্কে সচেতন নয়।
‘এখন, জেনারেল,’ কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এল, ‘আপনি জানেন আপনি কে। আপনি জানেন, এবং স্মরণ করতে পারেন আপনার ছেলেবেলা, কৈশোর, আপনার ট্রেনিং, এবং সার্ভিসে ধাপে ধাপে উন্নতির ঘটনাগুলো। উন্নতিগুলো সম্পর্কে আরও কিছ জানাব আমি। আপনার অ্যাকটিভ সার্ভিস সম্পর্কে নতুন তথ্য দেব। নতুন তথ্য দেব আপনার বর্তমান কাজ সম্পর্কে। এরপর শুরু হলো বিশদ বর্ণনা। ভিয়েতনামে কি ধরনের বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিল জেনারেল। ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা চোখের সামনে মারা গেল, তাদের বাঁচানোর জন্যে নিজ প্রাণের ওপর ঝুঁকি নিয়েছিল সে। কয়েকটা উভয়সঙ্কটের ঘটনা বর্ণনা করা হলো। কিছু কিছু ঘটনা নতুন করে ঘটানো হলো, অভিনয়ের মাধ্যমে, সমস্ত আনুষঙ্গিক শব্দ সহ।
ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে উঠল জেনারেল পিলার, পাশ ফিরল, আবার তার ঘুম ভেঙে গেল। গড, অসম্ভব ভারী হয়ে আছে শরীরটা। অথচ সকালে জরুরী একটা কাজ সারতে হবে তাকে। ঘুমালেই স্বপ্ন দেখছে সে, আবার দেখেছে। এবার ভিয়েতনাম চলে এসেছিল।
মরিয়া একটা ইচ্ছে হলো স্ত্রীকে টেলিফোনে ডাকে। কিন্তু বালিশে মাথা ঠেকার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ে তার স্ত্রী রোলা, পাক্কা আট ঘণ্টা পর চোখ মেলে। মাঝখানে কেউ যদি কোন কারণে তার ঘুম ভাঙায়, পুরো এক হপ্তা স্নায়ু-পীড়নের ঝুঁকি থাকে।
স্ত্রীর সহানুভূতি আর সেবা পাবার আশা ছেড়ে দিয়ে নিজেকে অভয় দিল জেনারেল পিলার, সকালে সব ঠিক হয়ে যাবে। তা না হলে ভূতে পাওয়া মানুষের মত টলতে টলতে ইন্সপেকশনে বেরুতে হবে তাকে। ঘুম! হ্যাঁ, আরও খানিকটা ঘুম দরকার তার। আরেকবার সময় জানতে পারলে হত। ঘড়িটা যেন কোথায়? ও, হ্যাঁ, টেবিলে। আরে, মাত্র এক ঘণ্টা পর আবার তার ঘুম ভেঙেছে! কি মুশকিল! মাত্র চারটে বাজে! না, এখন বিছানা ছাড়লে শরীরটা কথা শুনবে না। ঘুম যদি নাও আসে, চোখ বুজে বিছানায় পড়ে থাকা ভাল। বিশ্রাম দরকার।
ধীরে ধীরে আবার স্বপ্নের রাজ্যে ফিরে গেল জেনারেল পিলার। এবং সেই সাথে, বেডরূমের ওপরদিকের জানালা থেকে পিয়েরে ল্যাচাসিও আবার ফিসফিস করে কথা বলতে শুরু করল।
ঠিক এ-ধরনের কাজ আর মাত্র একবার করেছে ল্যাচাসি, তখন অবশ্য হাতে আরও বেশি সময় পাওয়া গিয়েছিল। মাইক্রোফোনে হাতচাপা দিয়ে ঝানের দিকে ফিরল সে। ‘মন্দ নয়, বুঝলে। ও এখন সত্যি সত্যি বিশ্বাস করছে, অন্তরের অন্তস্তলে, যে ও আসলেই একজন ফোর-স্টার জেনারেল। ব্যাটা সেনাবাহিনীর অফিসার ছিল বলে আমাদের কাজ অবশ্য অনেক সহজ হয়েছে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এরচেয়ে ভাল রেজাল্ট আশা করা যায় না। যাতে কোন ফাঁক না থাকে, জ্ঞানগুলো আবার সব নতুন করে দান করব ওকে।’ ল্যাচাসি যখন ঝানের সাথে কথা বলছে, নিচের বেডরূমে তখন আরেক দৃশ্য অভিনীত হলো। বেডরূমের দরজা খুলে গেল, ভেতরে ঢুকল হেনরি ডুপ্রে। গা ঢাকা দিয়ে থাকার অদৃশ্য জায়গাটার দিকে মুখ তুলে তাকাল সে, হাসল একবার। তারপর পা টিপে টিপে এগোল সে, যেমন তাকে নির্দেশ দেয়া আছে। বিছানার কাছাকাছি এসে থামল, সময় বদলে দিল ঘড়ির। ঘড়িটা আবার টেবিলে রেখে বেডরূম থেকে বেরিয়ে গেল সে।
আবার বলতে শুরু করল ল্যাচাসি। সে-ও ক্লান্তি বোধ করছে। সাধারণত, তার জানা আছে, টেকনিকটা পুরোপুরি ব্যবহার করার জন্যে চব্বিশ ঘণ্টা খুব কম সময়, কিন্তু এ-ক্ষেত্রে অল্প কিছুক্ষণের জন্যে সাবজেক্টের শুধু পারসোনালিটি বদলাতে হবে, তাই প্রথম থেকেই সাফল্য সম্পর্কে তার মনে কোন সন্দেহ ছিল না।
র্যাঞ্চে রানাকে ফিরিয়ে আনার সাথে সাথে কাজটা শুরু করেছে ওরা। শুধু হ্যালোপেরিডল ‘ইঞ্জেকশন ব্যবহার করা হয়েছে তা নয়, হিপনোটিক টেকনিকও প্রয়োগ করা হয়েছে। অডিও-হিপনোটিক ইমপ্ল্যান্টের সাহায্যে সংক্ষিপ্ত সেশন-এর আয়োজন করা হয়েছিল। প্রথমে সাবজেক্টের নিজস্ব সমস্ত স্মৃতি মুছে দেয়া হয় মন থেকে, তারপর শূন্যস্থান পূরণ করা হয় নতুন পরিচয় আর স্মৃতি দিয়ে।
নতুন স্মৃতিগুলো অল্প অল্প করে সাবজেক্টের ভেতরে ঢোকানো হয়েছে। কৃত্রিম আইডিয়া, ধ্যান-ধারণা, অভিজ্ঞতা, তথ্য, স্মৃতি ইত্যাদি, ওরা জানে, চব্বিশ ঘণ্টা পর, নারকোটিকের প্রভাব কেটে গেলে, প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করবে সাবজেক্ট। আবার সে আগের পরিচয় ও স্মৃতি ফিরে পাবে। তবে চব্বিশ ঘণ্টা প্রচুর সময়।
প্রথম থেকেই একটা কাঁটাবিশেষ ছিল মাসুদ রানা। প্ল্যান করা হয়, প্রথমে ওকে সমাজ-সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজেদের মুঠোয় আনতে হবে, তারপর ধ্বংস করতে হবে। তবে দেখে যেন মনে হয় স্বাভাবিক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে তার অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে। দুর্ঘটনাটা বিশ্বাসযোগ্য হওয়া চাই। অন্তত সও মং প্ৰথমে এ-ধরনেরই একটা নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু সও মঙের সিদ্ধান্ত বদলাতে পারে, বদলেছেও। পরিবর্তে দ্বিতীয় যে নির্দেশটা দেয় সে, তার বুঝি কোন তুলনা হয় না।
জেনারেলের ভূমিকায় অভিনয় করানোর জন্যে অন্য এক লোককে বেছে রেখেছিল ওরা। ল্যাচাসি এমনকি সেই লোকের ওপর এই টেকনিকটা ব্যবহারও করেছে। ফলাফল, বেচারা এফ.বি.আই. এজেন্ট অকালে মারা গেল।
এরপর সও মং রানাকে টোপ গেলাল, হার্মিসের পুরানো শত্রুকে বড়শিতে গেঁথে নিয়ে এল টেক্সাসে, নার্ভাস করে দিয়ে লক্ষ রাখল তার প্রতিটি নড়াচড়ার ওপর।
সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। কম করেও তিন ঘণ্টা নিবিড় ঘুম দরকার নতুন জেনারেলের।
গোটা পরিকল্পনাটার কথা ভেবে আপনমনে হাসল ল্যাচাসি। সও মঙের প্রতি শ্রদ্ধায় নত হয়ে এল তার মাথা। মাসুদ রানা, জেনারেল বিল এইচ. পিলার হিসেবে চেইন পাহাড়ে খতম হয়ে যাবে। আর তার ফলে কত লোক যে বিপদে পড়বে আর বিব্রত হবে, কারও সাধ্য নেই হিসেব করে।
আরও পনেরো মিনিট কথা বলে মাইক্রোফোনের সুইচ অফ করে দিল ল্যাচাসি। ‘ডোজ আর বাড়াতে সাহস হয় না। সামান্য অস্বস্তিবোধ করবে ও, তবে দায়ী করা হবে মদ্যপানকে। সে-চিন্তাটা খুব ভালভাবে ঢুকিয়ে দিয়েছি ওর মাথায়। কোন সন্দেহ নেই, তোমার হাতে এই মুহূর্তে একজন ফোর-স্টার জেনারেল রয়েছে। আমার পরামর্শ, সও মং, হেনরি ডুপ্রেকে তুমি নিজে ব্রিফ করো। বেডরূমের ওই লোক অবশ্যই যেন চেইন পাহাড়ে মারা যায়। সবচেয়ে ভাল হয় জেনারেল বিল এইচ. পিলার থাকা অবস্থায় মারা গেলে।
সও মং হাসল। ‘আমার একটা সাধ পূরণ হতে যাচ্ছে। অবশ্যই ডুপ্রের সাথে কথা বলব আমি। সরে এসো এবার, ঘুমুতে দাও ওকে।
.
অবশেষে খানিকটা বিশ্রাম পেল জেনারেল পিলার। স্বপ্নগুলো মিলিয়ে গেল, ঘুম হলো স্বাভাবিক। তবে ঘুম ভাঙার পর, জেগে থাকা অবস্থায়, আরেক ধরনের স্বপ্ন দেখেছে সে-রীতিমত উত্তেজক, একটা মেয়েকে নিয়ে, যার চুলের গন্ধ পরিচিত এবং খুব পছন্দ করে ও। মনে হয়েছিল, মেয়েটা ওর দিকে ঝুঁকে রয়েছে। এক পর্যায়ে তার কণ্ঠস্বরও প্রায় পরিষ্কার শুনতে পেয়েছে জেনারেল পিলার। ‘রানা,’ বলল মেয়েটা। ‘মাই ডিয়ার, রানা! এই পিলগুলো খেয়ে নাও, প্লীজ। এগুলো দরকার তোমার। এই নাও…’ নরম একটা হাতের স্পর্শ পেল সে মাথার পিছনে, বালিশ থেকে তুলল মাথাটা। তারপর মুখের ভেতর কি যেন ভরে দিল, ঠোঁটে ঠেকল পানির ঠাণ্ডা গ্লাস। ভীষণ তেষ্টা পেয়েছিল তার, ঢক ঢক করে খেয়ে ফেলল পিলসহ পানিটুকু, বাধা দেয়ার কথা একবার ভাবলও না। ‘পিল কাজ শুরু করতে খানিকটা সময় নেবে,’ আবার কথা বলল মেয়েটা। ‘কিন্তু তারপর নিজের পরিচয় ফিরে পাবে তুমি, চিনতে পারবে নিজেকে। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন, রানা। আমার দায়িত্ব আমি পালন করলাম!
পুরোপুরি ঘুম ভাঙার পর এই একটাই স্বপ্ন স্মরণ করতে পারল জেনারেল পিলার। ওর ঘুম ভাঙাল একজন সার্জেন্ট, হাতে কালো কফির কাপ নিয়ে জেনারেল বুঝতে পারল, রাতে তার ভাল ঘুম হয়নি, কিন্তু কারণটাও তার মনে পড়ল-শালার পার্টিতে বেশি মদ খাওয়া হয়ে গিয়েছিল।
মুখের ভেতরটা শুকনো লাগছে, পেটের ভেতর অস্বস্তিকর আলোড়ন, তবে কাজ করার জন্যে যথেষ্ট সুস্থ সে।
দাড়ি কামাল জেনারেল, শাওয়ার সারল, তারপর কাপড় পরতে শুরু করল। আপন মনে হাসল সে, ফোর-স্টার জেনারেল হতে তেমন কোন বেগ পেতে হয়নি তাকে। যেন সামরিক অফিসার হবার জন্যেই জন্ম হয়েছিল তার। কমব্যাট অভিজ্ঞতা প্রায় অনায়াসে আয়ত্ত করেছে সে। এই পেশা তার ভারি পছন্দ, কারণ রোমাঞ্চের ভক্ত সে। মার্কিন এয়ার স্পেস ডিফেন্সের ইন্সপেক্টর জেনারেল হতে পারা চাট্টিখানি কথা নয়, রীতিমত গর্ববোধ করা উচিত তার।
দরজায় নক হলো। ভেতরে ঢুকল পুরানো লোক, তার অ্যাডজুট্যান্ট, মেজর হেনরি ডুপ্রে। বরাবরের মত কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে জেনারেলকে স্যালুট করল সে।
‘গুড মর্নিং, জেনারেল। দিনটা আজ কেমন, স্যার?’ সবিনয়ে জানতে চাইল মেজর ডুপ্রে।
‘ভয়ঙ্কর, হেনরি, ভয়ঙ্কর! এমন লাগছে যেন নর্দমায় চুবানো হয়েছে আমাকে, পচা পানি আটকে আছে গলায়, কিংবা যেন ল্যাট্রিনের নোংরা পদার্থ গেলানো হয়েছে।’
হেসে ফেলল ডুপ্রে। ‘শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, জেনারেল, কাউকে যদি দায়ী করতে হয় তো সে আপনাকেই। কালকের পার্টিতে আপনি কোন সীমা মানেননি।
মাথা ঝাঁকাল জেনারেল। ‘জানি, জানি, আর বলতে হবে না- অ্যান্ড ফর গডস সেক, আমার ওয়াইফকে কিছু জানিও না। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, বুঝলে, এখন থেকে মাপমত খাব। অনেক কমিয়ে ফেলব, দেখো।’
‘আপনার ব্রেকফাস্ট দেব, স্যার? ইচ্ছে করলে আমরা…’
‘বাদ দাও, হেনরি, বাদ দাও। আরেক কাপ গরম কফি হলেই চলবে।’
‘এখুনি দিচ্ছি, স্যার। এখানে?’
‘নয় কেন। তারপর আমরা রওনা হয়ে যাব, কি বলো? তার আগে অবশ্য আজকের অ্যারেঞ্জমেন্ট সম্পর্কে আলাপটা সেরে নেব। আমার যা অবস্থা, সব আবার তোমার কাছ থেকে নতুন করে জেনে নিতে হবে।’
‘কি যে বলেন, স্যার!’ সশ্রদ্ধ হাসি দেখা গেল মেজর ডুপ্রের মুখে। যত মদই খান আপনি, কিছুই আপনি ভোলেন না। সার্ভিসে আপনার মত আর কেউ আছে নাকি!’
‘ওই আবার শুরু হলো! এই অভ্যেসটা ছাড়ো এবার, বুঝলে। আমার প্রশংসা না করলেও আমি জানব তুমি আমার ভক্ত এবং লোক হিসেবেও কারও চেয়ে খারাপ নও।’
অনেক আগে আরও কয়েকজন জেনারেলের অ্যাডজুট্যান্ট ছিলাম আমি, স্যার,’ একটু গম্ভীর হয়ে বলল হেনরি ডুপ্রে। ‘কেউ বলতে পারবে না তাঁদের আমি প্রশংসা করেছি। তবে সবাই জানে আপনার প্রশংসায় আমি পঞ্চমুখ। যার প্রাপ্য তার প্রশংসা করতে না পারাটা এক ধরনের নীচতা…’
‘এবার কিন্তু তুমি আমাকে লজ্জায় ফেলে দিচ্ছ, হেনরি!’
‘বেয়াদপি হয়ে থাকলে মাপ করে দেবেন, স্যার,’ বলে, হাসতে হাসতে কামরা থেকে বেরিয়ে এল হেনরি ডুপ্রে।
কামরার বাইরে তার জন্যে অপেক্ষা করছে পিয়েরে ল্যাচাসি। ‘কেমন দেখলে?’ ব্যাকুল স্বরে জানতে চাইল সে।
‘তুলনাহীন, অবিশ্বাস্য!’ ঘন ঘন মাথা নাড়ল হেনরি ডুপ্রে। ‘এমন সাফল্য আশা করা যায় না! কিন্তু স্থায়ী হবে তো?’
হবে, মেজর ডুপ্রে, হবে- প্রয়োজনের চেয়ে বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে। ভাল কথা, সও মঙের কাছ থেকে নির্দেশ পেয়েছ তুমি?’
‘কাজটা আমি নিজে করব, আনন্দের সাথে। আপনি চিন্তা করবেন না।’ ফিক্ করে হাসল সে। ‘জেনারেল আরেক কাপ কফি চাইছে…’
.
প্রায় ঘণ্টা দুই আগের ঘটনা। একজন ক্যাপটেন, বয়সে তরুণ, পেন্টাগনের স্পেস ইন্টেলিজেন্সে কাজ করে-নির্দিষ্ট সময়ের কিছু আগেই ডিউটিতে এল। রাতে যারা কাজ করেছে তাদের কেউ কেউ এখনও রয়েছে চারপাশে, তবে ক্যাপটেনকে তারা কেউ বিশেষভাবে লক্ষ করল না। কাজ পাগল বলে খ্যাতি আছে তার।
সকালের এই সময়টায় মেইন কমিউনিকেশন্স টেলিটাইপ মেশিনটা ব্যবহার করা হচ্ছে না। ওটা তার বসের, তিনি একজন জেনারেল, এয়ার অ্যান্ড স্পেস ডিফেন্সের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এর দায়িত্বে আছেন। দুই গোছা অতিরিক্ত চাবি রয়েছে ক্যাপটেনের সাথে, জেনারেলের অফিস আর টেলিটাইপ মেশিনের।
ভেতরে ঢুকে ক্যাপটেন দেখল ছোট অফিস স্যুইটটা খালি। আস্তে করে দরজায় তালা লাগিয়ে দিল সে, টেলিটাইপের তালা খুলে ট্রান্সমিট শুরু করল।
প্রথম মেসেজটা গেল অফিসার কমান্ডিং মুভমেন্টস, ইউ.এস. এয়ার ফোর্স বেস, পিটারসন ফিল্ড, কলোরাডোয়। মেসেজটা হলো:
Be prepared one small armed contingent
consisting approx two officers four sergeants
and thirty enlisted men at Air Space Admin staff
arrive by road this morning Stop The General
Bill H Pillar inspector Air Space Defence arrive
by helicopter flight clearance four-one-two to
iv with this group and proceed NORRAD Hq Stop
Request you afford all courtesies and assistance
Stop Acknowledge and destroy Stop
মেসেজটার নিচে সই থাকল ক্যাপটেনের বসের, নাম এবং পদ সহi প্রাপ্তিস্বীকার করে পাল্টা একটা মেসেজ এল দশ মিনিটের মধ্যেইi দ্বিতীয় মেসেজটা পাঠানো হলো নোরাড হেডকোয়ার্টারের কমান্ডিং অফিসারের কাছে, ঠিকানা-চেইন মাউন্টেইন, কলোরাডোi মেসেজটা এরকম:
As favor i advise you my inspector-General-
General Bill H Pillar-will visit you today for
non-scheduled inspection Stop Please give him
every courtesy Stop Do not Repeat not inform him
of this previous warning Stop Acknowledge and
destroy stop
এটাতেও সই থাকল ক্যাপটেনের বসের, নাম এবং পদ সহi খানিক পর জবাবও এসে পৌছুল
Regret Officer Commanding on leave for one day this day Stop i shall personally see all is in order Stop
মেসেজটার নিচে সই করেছে একজন কর্নেল, অ্যাকটিং কমান্ডিং অফিসার হিসেবে। আপনমনে মুচকি হাসল ক্যাপটেন, সমস্ত কপি ছিঁড়ে ফেলল সে, তারপর ফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করল টেক্সাসের একটা নম্বরে। অপরপ্রান্ত থেকে সাড়া পাবার পর জানাল এদিক থেকে ক্যাপটেন জিম কথা বলছে।
অপরপ্রান্ত থেকে বলা হলো, ‘আমি দুঃখিত, স্যার আমার বিশ্বাস আপনি রং নাম্বারে ডায়াল করেছেন।’ একটু মেয়েলি কণ্ঠস্বর, কিন্তু কর্কশ।
দুঃখিত আমিও, স্যার, তবে আশা করি কোন ক্ষতি হয়নি, স্যার-ডায়াল করতে ভুল করে ফেলেছি। আশা করি আপনাকে বিরক্ত করলাম না।’
‘না-না, মোটেও না,’ জবাব দিল পিয়েরে ল্যাচাসি। ‘গুডবাই, স্যার।
.
জেনারেল পিলার এবং তার অ্যাডজুট্যান্ট মেজর হেনরি ডুপ্রে অফিসার্স মেস থেকে বেরিয়ে এল, পাহারায় দাঁড়ানো দু’জন প্রাইভেট সোলজার চৌকশভঙ্গিতে স্যালুট করল তাদের। মেস থেকে বেরুবার সময় বেশ কয়েকজন অফিসার জেনারেলকে অভিনন্দন জানাবার জন্যে জড়ো হয়েছিল। তাদের মধ্যে থেকে অন্তত দু’জন কথাচ্ছলে জেনারেলকে বলেছে, ‘জেনারেল, কাল রাতের পার্টিটা কিন্তু দারুণ জমেছিল।’
‘এবং চারদিকে আমার সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে,’ চেহারায় গাম্ভীর্য নিয়ে মন্তব্য করল জেনারেল। ‘আজ রাতে এক ফোঁটাও গিলছি না, হেনরি-সেদিকে লক্ষ রাখবে তুমি।’
‘আপনি যা বলেন, স্যার।’
অফিসার্স মেসের সামনের প্যাডে কিওয়া (KIOWA) হেলিকপ্টার অপেক্ষা করছিল ওদের জন্যে, দেখে প্রায় গুঙিয়ে উঠল জেনারেল। ‘ওহ্ নো! ওটায় চড়ে রওনা হব আমরা! সেরেছে! হেনরি?’
‘জ্বী, স্যার, হেলিকপ্টার ছাড়া তো…’
‘বেশ, বুঝলাম। এখন আবহাওয়া ভাল হলেই বাঁচি। বুঝতেই তো পারছ খুব বেশি ঝাঁকি আজ আমার সইবে না।’
‘ওয়েদার রিপোর্ট চমৎকার, স্যার।’
হেলিপ্যাডের দিকে হাঁটছে ওরা, আজকের কর্মসূচী সম্পর্কে বিশদ ব্যাখ্যা দিচ্ছে অ্যাডজুট্যান্ট মেজর হেনরি ডুপ্রে। ‘হেলিকপ্টারে করে এখান থেকে সরাসরি পিটারসন এয়ার বেসে পৌছুব আমরা, স্যার। ওখানে একটা ট্রাক থাকবে, ট্রাকে থাকবে ত্রিশজন এনলিস্টেড সৈনিক, কিছু নন্-কমিশনড্ অফিসার, দু’জন অফিসার-তাদের মধ্যে একজন ক্যাপটেন পিয়েরে ল্যাচাসি। ওরা আসলে শো হিসেবে থাকবে, স্যার আপনি যদি মনে করেন যে নোরাড কমব্যাট অপারেশনস সেন্টারের সিকিউরিটি পরীক্ষা করা দরকার শুধু তাহলেই ওদের কাজে লাগানো হবে। আপনার গাড়ি এবং ড্রাইভারও অপেক্ষা করছে ওখানে, স্যার।’
‘গুড। তারপর আমরা সরাসরি চেইন পাহাড়ে চলে যাব?’
‘নাম্বার টু এন্ট্রান্সে পৌঁছুব আমরা, স্যার। সেটাই সবচেয়ে ভাল হবে, ওখান থেকে সরাসরি মেইন কমান্ড পোস্ট লেভেলে চলে যাওয়া যায়। আপনি আপনার মেমোতে বলেছেন কমান্ড পোস্ট স্ট্রাকচারের সতর্কাবস্থা পরীক্ষা করাই আসল উদ্দেশ্য-প্রায়োরিটি নাম্বার ওয়ান।’
‘হ্যাঁ, একটু একটু মনে পড়ছে যেন…’
হাসল মেজর ডুপ্রে। আপনার মনে পড়বে না তো কার মনে পড়বে, স্যার। আমি তো জানি, কিছুই আপনি বেশিক্ষণ ভুলে থাকেন না। প্রমাণও করা যায়। দেখুন, আমি শুধু আভাস দেব, অমনি বাকিটুকু আপনার মনে পড়ে যাবে। ফ্লাইং… ‘
ভুরু কুঁচকে কি যেন চিন্তা করল জেনারেল। ‘না হে, হেনরি, স্মরণ শক্তির বারোটা বেজে গেছে। ব্যাপারটা কি এরকম-ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখার জন্যে কমপিউটর টেপগুলো সরাসরি চাইব আমি, তাই কি?
হেসে উঠল ডুপ্রে। ঠিক তাই, স্যার। ফ্লাইং ড্রাগন টেপ সম্পর্কে কিছু বিধি- নিষেধ আছে। ‘মোস্ট সিক্রেট’ তালিকার একটা আইটেম। কড়া পাহারায় রাখা হয়। ওখানে যারা আছে তাদের কোন ক্ষমতা বা অধিকার নেই হস্তান্তর করার। এমনকি দেখতে দেয়ার ক্ষমতাও নেই। আমাদের উদ্দেশ্য হলো, অত্যন্ত সিনিয়র একজন অফিসারের প্রতিক্রিয়া টেস্ট করা।
‘ঠিক আছে, দেখা যাক কাজ হয় কিনা।’ কথা বলতে বলতে হেলিকপ্টারে উঠে বসল জেনারেল। পাইলটের কুশল জানতে চেয়ে স্ট্র্যাপ দিয়ে আটকাল নিজেকে। জেনারেলের পিছু পিছু ডুপ্রেও উঠল, বসল পাশের সীটে।
একটু পরই আকাশে উঠে গেল হেলিকপ্টার। উত্তর-পশ্চিম দিকে রওনা হলো। ওদিকেই কলোরাডোর চেইন পাহাড়।