পাঁচ
অন্ধকার স্টেজের তলায় চুপচাপ শুয়ে আদি ও অকৃত্রিম সও মং প্রসঙ্গে ভাবছে রানা। উ সেন, হার্মিসের প্রথম নেতা। আজ যার কথা শোনা যাচ্ছে, নতুন সও মং, সে কি উ সেনের কোন আত্মীয় হতে পারে? অবশ্য এ-ধরনের একটা অর্গানাইজেশনে ক্ষমতার হাত বদল আত্মীয়তার সূত্র ধরে না-ও ঘটতে পারে। কিন্তু উ সেনকে যতটুকু চিনেছিল রানা, বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলার স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষা বিপুল পরিমাণেই ছিল তার ভেতর। রাজা মারা যায়, কিন্তু সে তার একজন উত্তরাধিকারী রেখে যায়। রাজা দীর্ঘজীবী হোন মানেই হলো পরবর্তী রাজার মধ্যে তাঁকে যেন খুঁজে পাওয়া যায়। উত্তরাধিকারী একজন আত্মীয় হলেই সেটা সম্ভব।
উ সেন মারা গেলে কে হবে তার উত্তরাধিকারী, সেটা নিশ্চয়ই রানার হাতে উ সেন মারা যাবার আগেই ঠিক করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু জানা যাচ্ছে, উ সেনের উত্তরাধিকারী সাথে সাথে উদয় হয়নি, আত্মপ্রকাশ করতে প্রচুর সময় নিয়েছে। হার্মিস প্রসঙ্গেও সেই একই কথা, পুনরুজ্জীবিত হয়েছে অনেক দেরি করে। তারমানে কি? ধরে নিতে হয় ইউনিয়ন কর্সের নেতারা নতুন সও মঙের জন্যে অপেক্ষা করছিল, কবে সে আত্মপ্রকাশ করে?
কেন যেন মনে হলো রানার, তার এই দেরি করে আত্মপ্রকাশ করাটা তাৎপর্যপূর্ণ।
উ সেন মারা যাবার সময় তার বয়স ছিল অল্প? হার্মিসের মন্ত্রে দীক্ষা নিতেই পেরিয়ে গেছে এতগুলো বছর? ইউনিয়ন কর্সের নতুন কাঠামোর সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াবার আগে অবশ্যই তাকে যোগ্যতা অর্জন করতে হয়েছে, শেষ করতে হয়েছে কঠিন-কঠিন ট্রেনিং। সেজন্যেই কি এত দেরি হলো?
কিন্তু আত্মীয় বা আপনজন হয় কি করে? উ সেন তো বিয়েই করেনি। না, রানা যতদূর জানে বিয়ে করেনি সে।
চিন্তাস্রোত অন্য খাতে বইতেই ক্লান্তি দূর হয়ে গেল রানার। বানা বেলাডোনা এমন এক দুর্লভ প্রজাতির নারী, কাছে না পেলেও শুধু তার কথা ভাবলেই আনন্দ আর পুলকের হিল্লোল বয়ে যায় দেহ-মনে। অথচ কি দুর্ভাগ্য, গোটা জীবনটাই তার নাটকীয় বিপর্যয়ের সমষ্টি। এতিমখানায় মানুষ, মা-বাবার পরিচয় জানা হলো না কোনদিন। অজ্ঞাতপরিচয় আত্মীয়ের বিপুল ধন-সম্পত্তি যদি বা পেল, শর্ত থাকল অচেনা এক লোকের প্রস্তাবে কল্যাণধর্মী কোন সংগঠনের কর্মকাণ্ডে পুঁজি বিনিয়োগ করতে হবে তাকে। উদয় হলো মলিয়ের ঝান, বান্না বেলাডোনার জীবনে আরেক অভিশাপ। টাকা-পয়সা সব হাতছাড়া করার পর বেলাডোনা জানতে পারল হার্মিসের উদ্দেশ্য কল্যাণকর তো নয়ই, বরং ঠিক তার উল্টো। বুঝল, কিন্তু ইতিমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ঝান র্যাঞ্চে নিয়ে আসা হয়েছে তাকে, বলা যায় বন্দী করেই রাখা হয়েছে। শুধু কি তাই, হার্মিসের একাধিক নেতা তাকে বিয়ে করার জন্যে পাগল।
বেচারি!
বেলাডোনার গোটা শরীর ভেসে উঠলো চোখের সামনে, চোখে এই ছবি নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ল রানা।
আঁতকে উঠে ঘুম ভাঙল ওর। চারদিকে শব্দ, বহু লোকের মিলিত গুঞ্জন। কুকুরের মত ঝাঁকি দিয়ে ঘুম তাড়াল রানা, উপুড় হলো স্টেজের তলায়, তারপর কান পাতল। ইতিমধ্যে প্রচুর লোকজন, নারী বা পুরুষ, জড়ো হয়েছে। রোলেক্সের ওপর চোখ বুলাল ও, অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে। প্রায় ন’টা বাজে।
মিনিটখানেক পর গুঞ্জন থেমে গেল। পরিবর্তে হাততালি শুরু হলো, অবিরাম বজ্রপাতের মত পীড়াদায়ক। সেই সাথে স্টেজে, ওর ওপরে, ভারী পায়ের আওয়াজ পেল রানা।
ধীরে ধীরে হাততালির শব্দ স্তিমিত হয়ে এল। কাশির আওয়াজ হলো, কে যেন গলা পরিষ্কার করল, তারপর তার কণ্ঠস্বর ভেসে এল। রানা আশা করেছিল মলিয়ের ঝান কথা বলবে, কিন্তু গলাটা তার নয়। সরু, তীক্ষ্ণ, কর্কশ মেয়েলি কণ্ঠস্বর-ল্যাচাসির। কিন্তু আগে যেমন শুনেছে রানা ঠিক সেরকম নয়, বদলে গেছে। তার কণ্ঠস্বরে নতুন আত্মবিশ্বাস আর দাপট, হলের দেয়ালে দেয়ালে বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনি তুলতে লাগল।
‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন। ফেলো মেম্বারস অভ দা, একজিকিউটিভ কাউন্সিল অভ হার্মিস, সেকশন হেডস্ অভ আওয়ার অর্গানাইজেশন, ওয়েলকাম।’ বিরতি নিল পিয়েরে ল্যাচাসি। ‘অত্যন্ত আনন্দের সাথে আমি ঘোষণা করছি, আমাদের মহামান্য লীডার, পরমশ্রদ্ধেয় সও মং, এই মুহূর্তে আমাদের সাথে উপস্থিত রয়েছেন। তিনি তাঁর পক্ষ থেকে আমাকে আপনাদের সাথে কথা বলার দুর্লভ সুযোগ দিয়েছেন, সেজন্যে আমি কৃতজ্ঞ এবং নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করছি। আপনারা জানেন, আজ আমরা একটা অপারেশন সম্পর্কে আলোচনা করব-অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলতে চাই, প্ল্যানটা যাঁরা তৈরি করেছেন আমি তাদেরই একজন। অপারেশনের নাম দিয়েছি আমরা বুলডগ।
‘প্রাথমিক আলাপ যথাসম্ভব সংক্ষেপে সারার চেষ্টা করব আমি। সময় বড়ই মূল্যবান। আমাদের জানা ছিল যে সময় যখন আসবে খুব তাড়াতাড়িই আসবে, তারপর আর কালক্ষেপণের তেমন একটা সুযোগ পাওয়া যাবে না। মোক্ষম মুহূর্তটি উপস্থিত এখন
‘আপনাদের মানসিক প্রশান্তির জন্যে প্রথমে দুটো বিষয়ে বলব আমি। দুঃসাহসিক প্লেন হাইজ্যাকিঙের মাধ্যমে অত্যন্ত মোটা অঙ্কের টাকা আয় করেছি আমরা, আমাদের উদ্দেশ্য পূরণে ওই টাকা যথেষ্ট বলে বিবেচিত হচ্ছে।
‘দ্বিতীয়ত, আমরা একজন খদ্দের পেয়েছি। অনাদের বর্তমান অপারেশন সফল হলে আমরা যেটা অর্জন করব সেটা কেনার : রব দিয়েছে সে। আপনাদের আমি কথা দিতে পারি, শুধু যে হার্মিসের ধন-ভাণ্ডার কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠবে তাই নয়, আপনারা সবাইও-অর্গানাইজেশনের প্রত্যেক সদস্য-বিনিয়োগকৃত পুঁজির কয়েক গুণ মুনাফা ঘরে তুলতে পারবেন।’
তুমুল হর্ষধ্বনির সাথে হাততালির শব্দ পেল রানা, যেমন হঠাৎ শুরু হলো তেমনি অকস্মাৎ থেমেও গেল। খস খস আওয়াজ শুনে ওর মনে হলো ল্যাচাসি কাগজ-পত্র নাড়াচাড়া করছে। গলা ঝেড়ে নিয়ে আবার শুরু করল সে।
‘এই ব্রিফিং আমি টেনে লম্বা করতে চাই না, কিন্তু কিছু স্ট্র্যাটেজিক এবং ট্যাকটিক্যাল পয়েন্ট পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা না করলেই নয়। কারণ গোটা ব্যাপারটার সামরিক এবং রাজনৈতিক তাৎপর্য প্রত্যেকের অনুধাবন করা দরকার।
‘পৃথিবী, আমরা সবাই জানি, অশান্তি আর বিশৃঙ্খলার স্থায়ী ঠিকানায় পরিণত হয়েছে। যুদ্ধ, সন্ত্রাস, দাঙ্গা চলছে। অত্যাচার, নির্যাতন, শোষণ চলছে। দুনিয়ার মানুষ আতঙ্কিত। আজ আর কারও জানতে বাকি নেই যে সাধারণ মানুষের মনে যতগুলো আশঙ্কা আর ভীতি আছে তার প্রায় সবগুলোর জন্যে দায়ী তথাকথিত সুপারপাওয়ারগুলো।
‘বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোয় মিছিল করছে মানুষ, বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে, চেষ্টা হচ্ছে সরকারগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করার। এ-ধরনের সমস্ত তৎপরতার পিছনে কাজ করছে ভীতি-পারমাণবিক ধ্বংসযজ্ঞের ভীতি। কাজেই মানুষ যে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠবে এ তো জানা কথা। কিন্তু মানুষ, সাধারণ মানুষ, একেবারেই অজ্ঞ!
‘আমরা জানি, যেমন বড় বড় মিলিটারি স্ট্র্যাটিজিস্টরা জানে, পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা আসলে লোকের চোখে ধুলো দেয়ার একটা কৌশল মাত্র। যাদের আতঙ্কিত হবার রোগ আছে, যারা বোকা, যারা চোখ থাকতেও অন্ধ, তারাই শুধু পারমাণবিক হুমকি দেখতে পায়।’ তাচ্ছিল্য প্রকাশ করতে কর্কশ একটু হাসল ল্যাচাসি। ‘তারা আসলে বোঝে না যে নিউট্রন বোমা, ক্রুজ মিসাইল, ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল, এগুলো আসলে আক্রমণ আর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অস্থায়ী এবং নগণ্য হাতিয়ার, তুলনামূলক অর্থে। একই কথা বলা চলে কোস্ট-টু-কোস্ট ট্র্যাকিং সিস্টেম আর আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম সম্পর্কে-যেমন, অ্যাওয়াকস্ সেন্ট্রি এয়ারক্রাফট। এগুলো সবই প্রাথমিক অস্ত্র, সত্যিকার অস্ত্র ব্যবহার করার আগে মধ্যবর্তী সময়টায় লোককে ভয় দেখানোর জন্যে মউজুদ রাখা হয়।
‘সমস্যা হলো ভীতি-বাড়ি, দেশ, জীবন হারাবার ভয়। যারা আতঙ্কিত এবং রাস্তায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করে তারা শুধু এই গ্রহে অনুষ্ঠিতব্য যুদ্ধের কথাই ভাবতে পারে। তারা জানে না যে আর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই আই.সি.বি.এম. আর ক্রুজ মিসাইল বাতিল হয়ে যাবে, কোন কাজেই আসবে না। তথাকথিত অস্ত্র প্রতিযোগিতা চালানোর অনুমতি দেয়া হয়েছে সাধারণ মানুষের মনে চাপ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে, অপরদিকে সুপারপাওয়ারগুলোর মধ্যে গোপনে চলছে সত্যিকার আর্মস রেস। সে আর্মস রেসের লক্ষ্য হলো আসল মারণাস্ত্র অর্জন করা, যেগুলোর বেশিরভাগই এই গ্রহে, আমাদের এই পৃথিবীতে ব্যবহার করা হবে না। ‘
পিয়েরে ল্যাচাসি আবার শুরু করার আগে দর্শক শ্রোতাদের মধ্যে উসখুস একটা ভাব দেখা গেল, নড়েচড়ে বসল সবাই।
‘বিষয়টা এরইমধ্যে প্রথমসারির বিজ্ঞানী আর সামরিক বিশেষজ্ঞদের কাছে সাধারণ জ্ঞান মাত্র। অস্ত্র প্রতিযোগিতা মানে এখন আর নিউক্লিয়ার বা নিউট্রন উইপনের ট্যাকটিকাল ডেভেলপমেন্ট নয়। না!’ উঁচু ডেস্কের ওপর দুম করে ঘুসি মারল ল্যাচাসি। ‘না! অস্ত্র প্রতিযোগিতার, আসল অস্ত্র প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্য হলো চূড়ান্ত একটা মারণাস্ত্রের উন্নতিসাধন, যা কিনা সব ধরনের নিউক্লিয়ার উইপন বাতিল করে দেবে।’ সেই কর্কশ হাসি আবার হাসল সে। ইয়েস, লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন, এ হলো উন্মাদ বিজ্ঞানীদের স্বপ্ন, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর অতি পুরাতন সারমর্ম। কিন্তু এখন সেইসব গল্পকথা বাস্তব সত্যে পরিণত হয়েছে।’
দম আটকে অপেক্ষা করছে রানা, জানে এরপর কি শুনতে হবে। সন্দেহ নেই আলট্রা-সিক্রেট পার্টিকল বীম উইপন সম্পর্কে বলতে চাইছে পিয়েরে ল্যাচাসি।
‘পার্টিকল বীম উইপন। ইয়েস, পার্টিকল বীম উইপন। শোনা গিয়েছিল জিনিসটার উন্নতিসাধনে আমেরিকার চেয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন এগিয়ে আছে গবেষণায়। জিনিসটা কি?’ নাটকীয় সুরে প্রশ্ন করে কয়েক সেকেন্ড বিরতি নিল ল্যাচাসি। ‘আ চার্জড পার্টিকল ডিভাইস, প্রায় একটা লেযারের মতই, সাথে রয়েছে মাইক্রোওয়েভ প্রপ্যাগেটর। জিনিসটা নিখুঁত হওয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। কাজ করবে শীল্ড হিসেবে, অদৃশ্য একটা ব্যারিয়ার হিসেবে, সম্ভাব্য যে- কোন পারমাণবিক যুদ্ধকে ঠেকিয়ে দেবে।
‘আগেই বলেছি, মনে করা হত আমেরিকার চেয়ে গবেষণায় এগিয়ে আছে সোভিয়েত রাশিয়া। এখন আমরা জানতে পেরেছি দুটো দেশই কমবেশি একই পর্যায়ে রয়েছে। অল্প কয়েক বছরের মধ্যে, এটা কোন সময়ই না, ক্ষমতার দাঁড়ি- পাল্লা যে-কোন একদিকে কাত হয়ে পড়তে পারে। কারণ, আগেই বলেছি, পার্টিকল বীম উইপনের কাজ হবে বর্তমান সমস্ত নিউক্লিয়ার ডেলিভারি সিস্টেমকে কেজো করে দেয়া।
‘সুপারপাওয়ারগুলো লাখ লাখ ক্রুজ মিসাইল আর আই.সি.বি.এম. বা কেট-পরিচালিত নিউট্রন বোমা বানাতে পারে। কোনই লাভ নেই। সেজন্যেই এ- বরনের অস্ত্রের মউজুদ তারা এখন আর বাড়াচ্ছে না। কারও হাতে পার্টিকল বীম উইপন থাকলে, তার বিরুদ্ধে কেউ কনভেনশনাল নিউক্লিয়ার আক্রমণ শুরু করতে পারবে না। পার্টিকল্ বীম মানে অ্যাবসলিউট নিউট্রালাইজেশন। চালমাত। সারা পৃথিবী জুড়ে ছুড়ানো সাইলোগুলোয় আসলে স্রেফ লোহালক্কড় রয়েছে, ধাতব আবর্জনা। পার্টিকল বীম রেসে যে জিতবে গোটা দুনিয়া চলে যাবে তার হাতের মুঠোয়।
‘তাই সময় এখানে তাৎপর্যপূর্ণ। পার্টিকল বীম রেস মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত নউক্লিয়ার অ্যাকশন অবশ্যই ঠেকিয়ে রাখতে হবে। কাজেই, প্রথমে আমাদেরকে বুঝতে হবে নিউক্লিয়ার অ্যাকশন বলতে কি বোঝায়। আর নিউক্লিয়ার অ্যাকশন ঝতে হলে মিসাইল আর বোমা সম্পর্কে নয়, জানতে হবে স্ট্র্যাটেজিক ডিভাইস সম্পর্কে, ওগুলোর ব্যবহার সম্ভব করে তোলে যেটা।’
স্টেজের তলায় লম্বা হয়েই থাকল রানা, তবে একটু কাত হলো একপাশে। অস্বস্তিবোধ করছে ও। জানে, নির্ভেজাল তথ্য আর যুক্তির সাহায্যে কথা বলছে ল্যাচাসি, যদিও বিজ্ঞানী না হওয়ায় ওর কানে কল্পকাহিনীর মতই শোনাচ্ছে। তবু ভাল যে এ-সম্পর্কে বি.সি.আই. এজেন্টদেরকে আগেই ব্রিফিং করা হয়েছে, অন্যান্য সার্ভিস অফিসারদের সাথে। পার্টিকল বীম সম্পর্কে দীর্ঘ রিপোর্ট পড়তে হয়েছে ওকে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা টেকনিকাল ডাটার ওপর চোখ বুলাতে হয়েছে। ল্যাচাসির কথা মিথ্যে নয়, গোটা ব্যাপারটা বাস্তব সত্য। আমেরিকা আর রাশিয়া পার্টিকল্ বীম রেসে সমানভাবে এগিয়ে আছে, কেউ কারও চেয়ে এক পা পিছিয়ে নেই।
ল্যাচাসি ইতিমধ্যে স্যাটেলাইট সম্পর্কে কথা বলতে শুরু করেছে। হাইলি- অ্যাডভ্যান্সড্ স্যাটেলাইট-কোনটা মহাশূন্যের দিকে মাত্র রওনা দিয়েছে, কোনটা পৃথিবীকে ঘিরে চক্কর দিচ্ছে, কোনটা স্থির হয়ে আছে দূর আকাশে।
‘ইতিহাসের এই সঙ্কটময় মুহূর্তে আমাদেরকে মাথা ঘামাতে হবে,’ বলে চলেছে ল্যাচাসি। ‘একবার এক মার্কিন সিনেটর বলেছিলেন, ‘হি হু কন্ট্রোলস্ স্পেস, কন্ট্রোলস্ দা ওয়ার্ল্ড’। সামরিক জগতে পুরানো আরও একটা কথা প্রচলিত আছে, তোমাকে সব সময় উঁচু জায়গা দখলে রাখতে হবে। উঁচু জায়গা বলতে এখন বুঝতে হবে মহাশূন্য। পার্টিকল বীম রেস মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত মহাশূন্যই নিয়ন্ত্রণ করবে নিউক্লিয়ার কার্যক্ষমতা।
কাজেই, প্রিয় হার্মিসের সদস্যবৃন্দ, আমাদের কাজ হবে আলোচ্য খদ্দেরকে সেই দুর্লভ জিনিসটা পাইয়ে দেয়া, যার সাহায্যে মহাশূন্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সে।
বর্তমানে যে-সব স্যাটেলাইট ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিল ল্যাচাসি। তার তালিকা থেকে উল্লেখযোগ্য কোন স্যাটেলাইটই বাদ পড়ল না। রিকনিসনস্ স্যাটেলাইট, রিকনসাট এবং ইলেকট্রনিক ফেরি, বিগ বাঙ ও কী হোল টু, রাডার স্যাটেলাইট-যেমন হোয়াইট ক্লাউড সিস্টেম, ব্লক ফাইভ/ডি-টু মিলিটারি ওয়েদার স্যাটেলাইট যেগুলো সোলার সেল-এর স্তর বহ করে, এরকম আরও অনেক কৃত্রিম উপগ্রহ সম্পর্কে একনাগাড়ে বলে গেল ল্যাচাসি।
রানার উদ্বেগ বাড়ছে। এ ধরনের স্যাটেলাইট সম্পর্কে অসম্পূর্ণ ডাটা আর তথ্য সংগ্রহ করা খুব কঠিন একটা কাজ নয়। কিন্তু ল্যাচাসির ব্যাখ্যা শুনে বোঝা যায়, তার তথ্যে কোন ভুল বা অসম্পূর্ণতা নেই। ক্লাসিফায়েড ইনফরমেশন ফাঁস করে দিচ্ছে সে।
একই ব্যাপার ঘটল ল্যাচাসি যখন মিলিটারি কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট সম্পর্কে মুখ খুলল। ডি.এস.সি.এস./টু এবং ডি. এস.সি.এস/থ্রী সম্পর্কে বলার পর ন্যাভাল কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট সম্পর্কে বক্তৃতা দিল সে। এস.ডি.এস. অর্থাৎ স্যাটেলাইট ডাটা সিস্টেমেরও বিশদ বর্ণনা পাওয়া গেল। এস.ডি.এস. মহাশূন্যের প্রতিটি স্যাটেলাইটের গতিবিধির ওপর চোখ রাখে। সন্দেহ নেই, মনে মনে স্বীকার করল রানা, আলোচ্য বিষয়ে বিস্তর জানে ল্যাচাসি। আটলান্টিকের দু’পাশেই তথ্যগুলো টপ সিক্রেট।
একটানা প্রায় দেড় ঘণ্টা অধিবেশন চলার পর হালকা নাস্তার জন্যে বিরতি ঘোষণা করল ল্যাচাসি। আবার মাথার ওপর পায়ের আওয়াজ শুনল রানা, শ্রোতারাও হল ছেড়ে বেরিয়ে গেল সবাই।
প্রথমদিকে রানা ভেবেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পার্টিকল্ বীম উইপনকে নিয়ে কোন প্ল্যান করেছে হার্মিস। কিন্তু এখন ওর মনে হচ্ছে ব্যাপারটা তা নয়। এরইমধ্যে অপারেশনে রয়েছে এমন ধরনের স্যাটেলাইট সিস্টেম সম্পর্কে উৎসাহী বলে মনে হচ্ছে ওদেরকে। যে-কোন কনভেনশনাল নিউক্লিয়ার যুদ্ধে প্রাথমিক টার্গেট হতে বাধ্য কমিউনিকেশন এবং রিকনিসনস্ স্যাটেলাইট, লং-রেঞ্জ ওঅর- ফেয়ারে সামরিক শক্তির হৃৎপিণ্ড তো ওগুলোই।
প্রশ্ন হলো ঠিক কোথায় আঘাত হানতে চায় হার্মিস? কিভাবে, কখন, কোথায়? অপারেশন বুলডগের তাৎপর্য ধীরে ধীরে উপলব্ধি করল রানা। হ্যাঁ, তাই তো, বুলডগ! ডগ, ড্রাগন! ফ্লাইং ড্রাগন, ইয়েস! এই নামই তো দেয়া হয়েছে ওগুলোর, ফ্লাইং ড্রাগন। এক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওগুলোই তাহলে হার্মিসের টার্গেট!
চিন্তার সূত্র ধরে বেশিদূর এগোনো গেল না, তার আগেই পায়ের শব্দ হলো। শ্রোতারা ফিরে আসছে হলে। খানিক পরই আবার শুরু হলো অধিবেশন, ল্যাচাসি ভাষণ দিচ্ছে।
এতক্ষণ দীর্ঘ ভূমিকা হলো, এবার আমাদের প্রজেক্টের মূল বিষয়ে কথা বলব। মহাশূন্য নিয়ন্ত্রণ করা মানে, লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন, মহাশূন্যে শত্রুপক্ষের চোখ আর কানকে অকেজো করে দেয়া। বহুদিন ধরে মনে করা হচ্ছে মহাশূন্যকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা, সীমিত হলেও, সোভিয়েত রাশিয়ার আছে। বলা হয় চব্বিশ ঘণ্টা সময়সীমার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্যাটেলাইটগুলো নষ্ট করে দিতে পারে তারা। আরও শোনা যায়, সে-ধরনের ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। কিন্তু গত আঠারো মাসে এ-সব তথ্য ভুল প্রমাণিত হয়েছে। যেমন কিলারস্যাট- এর কথা ধরা যেতে পারে, একান্ত প্রয়োজনীয় অস্ত্র হিসেবে উদয় হয়েছে। অত্যন্ত শক্তিশালী অস্ত্র। এবং এই শক্তিশালী অস্ত্র শুধু যুক্তরাষ্ট্রের কাছেই রয়েছে, যার রহস্য সম্পর্কে কিছুই জানা নেই সোভিয়েত রাশিয়ার।
‘হ্যাঁ, অস্বীকার করে বলা হচ্ছে বটে যে এ-ধরনের কোন স্যাটেলাইট কক্ষপথে নেই, কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য উৎস থেকে নিঃসন্দেহে জানা গেছে অন্তত বিশটা কিলারস্যাট এরইমধ্যে পাঠানো হয়েছে মহাশূন্যে, ওয়েদার স্যাটেলাইটের ছদ্মাবরণে। শুধু তাই নয়, মাত্র কয়েক মিনিটের নোটিসে এ-ধরনের আরও দুশো স্যাটেলাইট মহাশূন্যে পাঠাতে পারে তারা।’
বিরতি নিল ল্যাচাসি। ঘামছে রানা, অনুভব করল ভারী কি যেন একটা আটকে আছে গলায়-উদ্বেগ। ঢাকা হেডকোয়ার্টারের ব্রিফিঙে এই তথ্যগুলোও ছিল, কাগজ-পত্র দেখেছে ও, জানে ঠিক কথাই বলছে ল্যাচাসি।
‘আমাদের সমস্যা,’ শুরু করল আবার ল্যাচাসি, ‘কিংবা বলা ভাল আমাদের খদ্দেরের সমস্যা, এ-যাবৎ কালের সবচেয়ে সফল সিকিউরিটি স্কীম স্যাটেলাইটগুলোকে আড়াল করে রেখেছে। আমরা জানি স্যাটেলাইটগুলো লেযার- আর্মড়, জানি তাড়া করার সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী, আরও জানি ওগুলো সম্পর্কে নিরেট সমস্ত তথ্য কমপিউটর টেপ আর মাইক্রোফিলমে ধরে রাখা হয়-ওগুলোর নাম্বার, ঠিকানা, কক্ষপথ পরিভ্রমণের বর্তমান প্যাটার্ন, সাইলোর পজিশন, অর্ডার অভ ব্যাটল ইত্যাদি। এ-সব তথ্যের অস্তিত্ব আছে, এবং স্বভাবতই এসব আমাদের খদ্দেরের জানা দরকার।
‘কিলারস্যাট সম্পর্কিত সমস্ত ইন্টেলিজেন্স রয়েছে পেন্টাগনে। কিন্তু তথ্যভাণ্ডারের প্রতিটি বিভাগকে এমন সতর্কতার সাথে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে আমেরিকানরা যে পেন্টাগনের ভেতর আমাদের একাধিক উৎস মাস কয়েক আগেই রিপোর্ট করেছে, চুরি করা এক কথায় অসম্ভব। স্বীকার করতে আপত্তি নেই, কারণ উদ্দেশ্য যদি মহান হয় তাহলে চৌর্যবৃত্তি অপরাধ নয়-তথ্যগুলো চুরি করার পিছনে প্রচুর মূল্যবান সময় নষ্ট করেছি আমরা, এবং আমাদের প্রতিটি চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
‘যাই হোক, আরেকটা উপায় আছে। উনিশশো পঁচানব্বুই সালের দিকে এই অস্ত্রগুলো, সামরিক পরিভাষায় যেগুলোকে ফ্লাইং ড্রাগন বলা হয়, নিয়ন্ত্রণ এবং অপারেট করবে সী-সক। সী-সক হলো নর্থ আমেরিকান এয়ার ডিফেন্স কমান্ডের কনসলিডেশন স্পেস অপারেশনস সেন্টার।’
মৃদু হাসির আওয়াজ উঠল, সেই সাথে শিথিল হলো হলের পরিবেশ। আবার শুরু করল ল্যাচাসি। এরইমধ্যে সী-সকের কাজ শুরু হয়ে গেছে। ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে পিটারসন এয়ার ফোর্স বেসে। পিটারসন এয়ার ফোর্স বেস নোরাড় হেডকোয়ার্টার থেকে বেশি দূরে নয়, কলোরাডোর চেইন পাহাড়শ্রেণীর গভীর প্রদেশে। নোরাড হলো, সবাই জানে, নর্থ আমেরিকান ডিফেন্স কমান্ড।
‘এবং, যতদিন না সী-সক কাজ শুরু করছে,’ আবার তীক্ষ্ণ এবং কর্কশ হয়ে উঠল ল্যাচাসির কণ্ঠস্বর, ‘চেইন পাহাড় থেকে নোরাড হেডকোয়ার্টারই ফ্লাইং ড্রাগনগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এখানে, প্রিয় সদস্যবৃন্দ, একটা দুর্বলতার সন্ধান পাওয়া যায়।
‘কারণ নোরাড যদি ফ্লাইং ড্রাগন নিয়ন্ত্রণ করে, সমস্ত তথ্য হেডকোয়ার্টারে থাকতে বাধ্য। আছেও তাই। পেন্টাগনে ব্যাপারটা কি? সেখানেও সমস্ত তথ্য আছে, কিন্তু ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায়। নোরাড হেডকোয়ার্টারে কিন্তু সেভাবে নেই—সব এক জায়গায় রাখা আছে, কমপিউটর টেপে।’
রানা সাক্ষ্য দিতে পারে, ল্যাচাসির সব কথাই সত্যি। তবে এখনও আসল প্রশ্নটার উত্তর বাকি রয়েছে। সুরক্ষিত নোরাড হেডকোয়ার্টারে বিনা অনুমতিতে ঢোকা প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার, ফ্লাইং ড্রাগনের সমস্ত তথ্য সহ টেপ চুরি করা তো আরও অসম্ভব। সেই অসম্ভবকে কিভাবে সম্ভব করবে হার্মিস? সও মঙের নির্দেশে উত্তর একটা তৈরি করা আছে ল্যাচাসির, আন্দাজ করল রানা। ল্যাচাসিকে এখন আর ছোট করে দেখার কোন উপায় নেই, ঝানের চেয়ে কোন অংশে কম নয় লোকটা। বহু বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সে, তবে চূড়ান্ত প্ল্যান আসছে হার্মিসের নেতার কাছ থেকে-মলিয়ের ঝান, আইসক্রীম প্রস্তুতকারক, ঝান সাম্রাজ্যের অধিপতি।
‘অপারেশন বুলডগ,’ বলে চলল ল্যাচাসি। উদ্দেশ্য-নোরাড হেডকোয়ার্টারে অনুপ্রবেশ করে ইউ.এস. ফ্লাইং ড্রাগন সম্পর্কে যাবতীয় তথ্যসমৃদ্ধ কমপিউটর টেপ নিয়ে বেরিয়ে আসা।
‘পদ্ধতি? দুটো সম্ভাবনা বিবেচনা করেছি আমরা, বাদ দিয়েছি একটাকে। হার্মিসের সবগুলো শক্তিকে কাজে নামিয়ে হামলা করার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু সে-ধরনের কিছু করতে গেলে শুরুতেই সব ভেস্তে যাবে। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় পদ্ধতিটাই গ্রহণ করেছি আমরা। আমি পরম কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি, এই পদ্ধতি আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় লীডার সও মঙের অবদান।’
অপারেশন বুলডগ সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে শুরু করল ল্যাচাসি, সেই সাথে অনেক ছোটখাট প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল রানা।
‘এখানে, এই র্যাঞ্চে বসে, গুরুত্বপূর্ণ দুটো কাজ করেছি আমরা,’ বলে চলল ল্যাচাসি। ‘যার ফলে আমাদের হাতে চেইন পাহাড়ের চাবি চলে এসেছে। প্রথম কাজটা সম্পর্কে আপনারা জানেন, এখানে আমরা একটা আইসক্রীম প্ল্যান্ট চালু করেছি। দ্বিতীয় কাজটা ছিল-যোগাযোগ এবং চুক্তি-সম্পাদন। বহু মিলিটারি বেসে খাদ্যবস্তু সাপ্লাই দিচ্ছি আমরা। প্রতিটি বেসে একজন করে ডিসট্রিবিউটর নিয়োগ করা হয়েছে। এরকম একজন ডিসট্রিবিউটর নোরাড হেডকোয়ার্টারেও আছে আমাদের।’
বিরতি নিল ল্যাচাসি, কল্পনায় তার হাড়সর্বস্ব মুখে ভৌতিক হাসি দেখতে পেল রানা।
‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন, এইমাত্র সেই ডিসট্রিবিউটরের কাছে চার দিন চলার মত আইসক্রীম সাপ্লাই দিয়েছি আমরা। নোরাডে ওরা প্রচুর আইসক্রীম হজম করে-পাহাড়ী পরিবেশ কিনা, তাছাড়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকতে হয়। আমাদেরকে জানানো হয়েছে যে একশো জনের মধ্যে নব্বুই জনই ওখানে নিয়মিত আইসক্রীম খায়।
‘বলাই বাহুল্য, ওগুলো সাধারণ আইসক্রীম নয়। এখানে আপনাদের অনেকের জন্যে একটা বিস্ময় অপেক্ষা করছে। আমরা অদ্ভুত একটা জিনিস আবিষ্কার করেছি, যার নাম দেয়া যেতে পারে-আনন্দের উৎস। হালকা একটা নারকোটিক, নির্দোষ, এবং কোন রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। খেলে কি হয়? আনন্দানুভূতি আর প্রাণ শক্তি কয়েক গুণ বেড়ে যায়, আদেশ পালনের স্বাভাবিক প্রবণতা দৃঢ় হয়; কিন্তু একই সাথে ভাল-মন্দ জ্ঞান সাময়িকভাবে লোপ পায়। কাউকে সামান্য একটু ডোজ দেয়া হলেও সে নির্দেশ পালন করবে, কোন প্রশ্ন ছাড়াই। সে এমনকি তার প্রাণপ্রিয় ঘনিষ্ঠ বন্ধুকেও নির্দ্বিধায় খুন করবে, কিংবা ভালবাসবে পরম শত্রুকে।
আপনমনে মাথা ঝাঁকাল রানা, প্যাড লাগানো সেলে নিজের চোখেই সব দেখেছে ও।
‘আরও আছে,’ গলার আওয়াজ শুনে মনে হলো খুশিতে ডগমগ করছে ল্যাচাসি। সর্বশেষ টেস্ট থেকে জানা গেছে, আমাদের আনন্দের উৎস ক্রীমের প্রতিক্রিয়া বারো ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হবে। আগামীকাল, এই দুপুরের দিকে, চেইন পাহাড়ে পৌছে যাবে আইসক্রীম। বিশ্বস্তসূত্রে জানতে পেরেছি, কাল রাতে সরবরাহ করা হবে। তারমানে হলো আমাদের অপারেশন বুলডগ শুরু হবে পরশু দিন লাঞ্চের পর। স্রেফ হাসতে হাসতে ভেতরে ঢুকব আমরা, ফ্লাইং ড্রাগন কমপিউটর টেপ চাইব-ওরাও হাসতে হাসতে টেপগুলো তুলে দেবে আমাদের হাতে। সহজ, পানির মত সহজ।’
‘সত্যিই কি এতটা সহজ?’ শ্রোতাদের মধ্যে থেকে জানতে চাইল একজন।
‘ঠিক অতটা হয়তো নয়,’ স্বীকার করল ল্যাচাসি, গলাটা আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। ‘স্বভাবতই কিছু অফিসার, টেকনিশিয়ান, তালিকাভুক্ত লোক থাকবে যারা আইসক্রীম খায় না। শতকরা দশ ভাগ, অন্তত আমাদের সর্বশেষ রিপোর্ট তাই বলে। কাজেই, সামান্য অপ্রীতিকর ঘটনার জন্যে তৈরি থাকতে হবে আমাদেরকে। আরেকটা ব্যাপার। ওষুধ কাজ করবে শুধু যদি কর্তাব্যক্তি বা বসের কাছ থেকে নির্দেশটা আসে। তাই একজন ফোর-স্টার জেনারেলকে দিয়ে নোরাড হেডকোয়ার্টার ভিজিট করাবার ব্যবস্থা করেছি আমরা। তিনি হবেন এয়ার অ্যান্ড স্পেস ডিফেন্স-এর নতুন ইন্সপেক্টর-জেনারেল। নোরাড হেডকোয়ার্টারের কমান্ডিং অফিসার ইন্সপেক্টর-জেনারেলের ভিজিট সম্পর্কে খবর পাবেন ঠিকই.. তবে মাত্র এক ঘণ্টা আগে। এই ধরুন, বিশ কি ত্রিশজন এইড আর সামরিক অফিসার নিয়ে ভেতরে ঢুকবেন ইন্সপেক্টর-জেনারেল। সবাই সশস্ত্র থাকবে, অবশ্যই। তাদের কাজ হবে. যারা আমাদের আইসক্রীম অর্থাৎ আনন্দের উৎস গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করেছে তাদের ব্যবস্থা করা। সত্যি কথা বলতে কি, এ-ধরনের একটা সুস্বাদু জিনিস খেতে অস্বীকার করে মৃত্যুবরণ করা ভারি দুঃখজনক ব্যাপার।’
হলের চারদিকে হাসির ছররা ছুটল, কেউ একজন জিজ্ঞেস করল কে সেই ভাগ্যবান যে ইন্সপেক্টর-জেনারেলের ভূমিকায় অভিনয় করবে?
দীর্ঘ নিস্তব্ধতার ভেতর উত্তেজনায় টান টান হয়ে উঠল পরিবেশ। আর সবার মত প্রশ্নকর্তাও বোধহয় উপলব্ধি করতে পারল, মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে তার, এ-ধরনের প্রশ্ন করাটাই বোধহয় অপরাধ।
মলিয়ের ঝান, ভাবল রানা-সও মং স্বয়ং-ইন্সপেক্টর-জেনারেলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। আর কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তারপর শোনা গেল ল্যাচাসির ঠাণ্ডা কণ্ঠস্বর, কানে যেন আইসক্রীম ফেলা হলো।
‘ওই কাজের জন্যে বিশেষ এক ব্যক্তিকে বাছাই করে রেখেছি আমরা,’ বলল সে। ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লোক, কিন্তু দুর্ভাগা। বেচারার জন্যে সত্যি আমার দুঃখ হচ্ছে। আশঙ্কা করি, কাজটা শেষ করার পর তাকে আমরা জীবিত দেখব না। এবার আমরা শিডিউল, সময়, অস্ত্র আর এস্কেপ রুট সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেব। ম্যাপটা পেতে পারি, প্লীজ?’
প্রায় দুপুর হয়ে গেছে। আর বারো ঘণ্টা পর, রানা ভাবল, রাস্তার ধারে টানেলে ঢোকার মুখের কাছে স্যাব নিয়ে অপেক্ষা করবে রিটা। যদি ভাগ্য তাকে সহায়তা করে। ইতিমধ্যে, এই বারো ঘণ্টা গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে রানাকে। প্ল্যান করার জন্যে যথেষ্ট সময় কিন্তু কারও চোখে ধরা না পড়ে লুকিয়ে থাকার জন্যে সময়টা খুব লম্বা।
হল খালি হয়ে গেলে প্রথম কাজ লুকিয়ে থাকার নিরাপদ একটা জায়গা খুঁজে বের করা। তারপর সময় হলে টানেলের প্রবেশমুখে যাওয়া যাবে। রিটা যদি সময় মত ওখানে পৌঁছুতে পারে, দু’জন মিলে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করবে র্যাঞ্চ থেকে। না, দু’জনের হয়তো বেরুনো সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে ফাঁকা গুলি করে ঝান সিকিউরিটির দৃষ্টি কাড়বে রিটা, সেই ফাঁকে পালাবে রানা। তার আগে অবশ্য তথ্যগুলো সব জানাতে হবে রিটাকে।
যেভাবেই হোক, একজনকে অন্তত বেরিয়ে যেতে হবে। পার্টিকল বীম উইপন প্রতিযোগিতা জেতা বা হারার আগে ফ্লাইং ড্রাগন টাইপের স্যাটেলাইট আমেরিকা বা রাশিয়া, দু’পক্ষের হাতেই থাকা দরকার, কারণ ওগুলোই দুই পরাশক্তির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করছে। মার্কিন ফ্লাইং ড্রাগনের সমস্ত রহস্য রাশিয়া যদি জেনে ফেলে তাহলে আর ওগুলোর কোন মূল্য থাকে না, আমেরিকাকে পায়ের নিচে ফেলে রাশিয়া একক শক্তি হিসেবে উদয় হবে পৃথিবীতে। ঠিক উল্টোটা ঘটবে আমেরিকানরা যদি ফ্লাইং ড্রাগন পাইপের রাশিয়ান স্যাটেলাইট সম্পর্কে সমস্ত রহস্য জেনে ফেলে।
নিরপেক্ষ ভূমিকায় মাসুদ রানা দুটোর কোনটাই ঘটতে দিতে পারে না। ওর কাছে রাশিয়া বা আমেরিকা দুটোই এক কথা, কাজেই পক্ষপাতিত্বের প্রশ্ন ওঠে না।
কমপিউটর টেপ চুরি করে সও মং সেটা বিক্রি করবে রাশিয়ার কাছে, ধরেই নিতে হয়। যেভাবে হোক ওদের ঠেকাতে হবে।
এ-সব চিন্তা করতে করতে উত্তেজিত হয়ে পড়ল রানা, এবং হঠাৎ করে উপলব্ধি করল পৃথিবীকে ভারসাম্যহীনতার অভিশাপ থেকে রক্ষা করার মত লোক এই মুহূর্তে একজনই আছে সারা দুনিয়ায়।
ও নিজে।