চার
দিনের ভাপসা গরম রাত সাড়ে এগারোটাতেও তেমন একটা কমেনি।
গাঢ় রঙের স্ন্যাকস, কালো টারটল-নেক আর জ্যাকেট পরেছে রানা, জ্যাকেটের নিচে ভি-পি-সেভেনটি; জঙ্গলের ভেতর নরম ঘাসে উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছে। চারপাশে ঝোপ-ঝাড় আর গাছপালা।
রাত জাগা পাখি আর অন্যান্য প্রাণীরা শব্দ করছে, ঝিঁঝিগুলোর একটানা চিৎকারে কান ঝালাপালা, তবু কাছাকাছি এগিয়ে এলে মানুষের পায়ের বা গলার আওয়াজ় ঠিকই চিনতে পারবে ও।
এক অর্থে, কার রেসের পর, তেমন নাটকীয় কিছুই ঘটেনি আজ। পিট থেকে কেবিনে ফিরে গিয়ে চট করে শাওয়ার সেরেছে ও, কাপড় পাল্টেছে, নিশ্চিত হয়েছে মুহূর্তের নোটিশে কেটে পড়ার জন্যে সব তৈরি আছে কিনা। ডিনারে পরার জন্যে কাপড় রেখে বাকিগুলো ভরেছে সুটকেসে, প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসগুলোও নিতে ভোলেনি। ব্রীফকেসটাও নতুন করে গুছিয়েছে ও।
ব্রীফকেস নিজের জায়গাতেই আছে, স্যাবের ভেতর তালা দেয়া অবস্থায়। সুটকেসটাও।
সাথে রানা শুধু পিক-লক আর টুলস সেটটা নিয়েছে, আর স্পেয়ার ম্যাগাজিন সহ হেকলার অ্যান্ড কচ। এই মুহূর্তে যা পরে রয়েছে কেবিন থেকে বেরুবার সময় তাই ছিল পরনে, শুধু টারটল-নেকটা বাদে-ওটার বদলে গায়ে একটা কালো শার্ট ছিল।
লুকানোর ঠাঁইটাও তাড়াহুড়োর মধ্যে বেছে নিয়েছে ও-ফাঁকা জায়গাটার এক কোণে, গাছপালার ভেতর। রাস্তা কেবিন আর স্যাব, তিনটেকেই যাতে পরিষ্কার দেখতে পায়।
ছ’টা পর্যন্ত ওখানে লুকিয়ে থাকল রানা। তারপর ডিনারের জন্যে তৈরি হয়ে গাড়ি নিয়ে রওনা হলো টারার উদ্দেশে।
মলিয়ের ঝানকে হাসিখুশিই দেখতে পেল ও, বারান্দায় বসে পানীয় ধ্বংস করছে। গাঢ় নীল স্কার্ট আর ব্লাউজে শান্ত, ঠাণ্ডা লাগল রিটাকে। কিন্তু হীরকখণ্ডের মত উজ্জ্বল আলোর দ্যুতি ছড়াচ্ছে বান্না বেলাডোনা, মায়াভরা চোখে কিসের যেন ঝিলিক, মধুকণ্ঠ যেন দেহ-মনে পুলক জাগানো মিষ্টিমধুর হাসির নির্ঝর।
ও পৌছুনোর প্রায় সাথে সাথেই বান্না বেলাডোনা জিজ্ঞেস করল পান করার জন্যে কি দেয়া হবে তাকে, দুজোড়া চোখকে মিলিত হওয়ার অনুমতি দিল, এবং সেই মিলনের মধ্যে সঙ্কেত থাকল সে ভোলেনি গোপনে ওদের দেখা হবার কথা আছে।
রিটা আগাগোড়া ‘শান্তই থাকল, তবে সে-ও যেন সঙ্কেত দিল রানাকে-তার সাথে ওর কথা হওয়া দরকার।
ইনস্ট্রুমেন্টগুলোর মধ্যে বেসুরো বাজছে একা শুধু পিয়েরে ল্যাচাসি। আরও হাড্ডিসার লাগছে তাকে, কোটরে ঢোকা চোখ প্রায় নড়লই না, প্রায় কারও সাথেই কথা বলল না। আ ব্যাড লুজার, ভাবল রানা। কিংবা গুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয়ে চিন্তা- ভাবনায় মগ্ন। চিন্তা-ভাবনার মধ্যে ঝানেরও থাকার কথা, কিন্তু দেখে মনে হলো না-হাস্যরসের স্রোত বইয়ে দিচ্ছে সে, খই ফুটছে মুখে।
একটা মাত্র ড্রিঙ্ক শেষ করার পর ঝান প্রস্তাব দিল, রানা যদি প্রিন্টগুলো নিয়ে এসে থাকে, ব্যবসায়িক ঝামেলাটা চুকিয়ে ফেলাই ভাল। ‘আমি কথা দিয়ে কথা রাখি, ‘মি. রানা,’ চোখ মটকাল সে। ‘অথচ তবু, আর সব লোকের মতই, টাকা হাতছাড়া করতে পছন্দ করি না।
বারান্দা থেকে সিঁড়ি বেয়ে স্যাবের কাছে নেমে গেল রানা, প্রিন্ট নিয়ে ফিরে এল আবার, ঝানকে অনুসরণ করে ঢুকল বাড়ির ভেতর। সরাসরি প্রিন্ট রূমে চলে এল ওরা। কোন কথা হলো না, দু’জনের কারও মধ্যেই ইতস্তত কোন ভাব নেই, ঝানের হাত থেকে খোলা একটা ব্রীফকেস নিয়ে তার হাতে প্রিন্টগুলো ধরিয়ে দিল রানা।
‘যদি ইচ্ছে করেন গুনে নিতে পারেন;’ আনন্দে ডগমগ করছে ঝান। ‘তবে গুনতে শুরু করলে ডিনারটা হারাবেন, এই আর কি। পুরো টাকাটাই ওখানে আছে। এক মিলিয়ন ডলার প্রফেসর লুগানিসের জন্যে, আরেক মিলিয়ন আপনার।
‘বিশ্বাস করলাম, ব্রীফকেস বন্ধ করল রানা। আপনার সাথে ব্যবসা করা সত্যি আনন্দময় অভিজ্ঞতা, ঝান। আমার আর যদি কিছু থেকে থাকে…
‘আমার ধারণা, আবার আপনি আমার কাজে আসবেন, মি. রানা।’ দ্রুত, প্রায় সন্দিহান চোখে রানার দিকে একবার তাকাল ঝান। সত্যি কথা বলতে কি, এ- ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। এবার, যদি কিছু মনে না করেন, দয়া করে ওদের কাছে ফিরে যান-জিনিসগুলো সরিয়ে রাখব আমি। আমার সত্যিকার দুর্লভ সম্পদগুলো কোথায় রাখছি কেউ জেনে ফেলতে পারে, এই আতঙ্ক আমি কাটিয়ে উঠতে পারি না।
ব্রীফকেসে একটা টোকা দিল রানা। ‘এটাকেও তালার ভেতর, নিরাপদে রাখা দরকার। ধন্যবাদ, ঝান।’
পোর্টিকোয় ফিরে এসে রিটা বাদে আর কাউকে দেখল না ও।
‘তোমার বান্না বেলাডোনা কিচেন তদারক করতে গেছে, আর মড়ার খুলিটা কে জানে কোথায় গেল,’ ফিসফিস করে, দ্রুত জানাল রিটা।
রানা ইতিমধ্যে সিঁড়ির অর্ধেকটা নেমে গেছে, শান্তভাবে ডাকল সে, ‘এসো, আমাকে একটু সাহায্য করবে।’
গাড়ির পিছনে রানার সাথে মিলিত হলো রিটা, তার শরীর থেকে বেরিয়ে আসা ভয়ের কাঁপন সাথে সাথে অনুভব করতে পারল রানা।
‘আসলেও ওরা মারাত্মক কিছু করতে যাচ্ছে, রানা। ক্রীস্ট, রেসের সময় কি ভয় যে পাইয়ে দিয়েছিলে!’
‘আমি নিজেও খুব একটা স্বস্তিতে ছিলাম না, রিটা। শোনো। সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করল রানা, ডিনারের পর ওদেরকে যদি একা ছেড়ে দেয়া হয়, কেবিনে ফিরে যাবে ও। ‘ঠিক যা প্ল্যান করা হয়েছিল তাই করব, তবে কাল সকালে বিদায় করে দেবার কথা জানিয়েছে ঝান। সন্দেহ করছি বেরিয়ে যাবার সুযোগ দিয়ে বাইরে কোথাও ফাঁদে ফেলবে, তবে আমার ভুলও হতে পারে। হয়তো এখানেই আজ রাতে আসবে আক্রমণ। অস্ত্রটা এখনও তোমার কাছে তো?
ছোট করে মাথা ঝাঁকাল রিটা, নিচু গলায় জানাল তার ঊরুর ভেতর দিকে স্ট্র্যাপ দিয়ে আটকানো আছে জিনিসটা, খুব অস্বস্তিবোধ করছে।
‘রাইট।’ বুটে ব্রীফকেস রেখে বন্ধ করল রানা, চাবি ঘোরাল। ‘ডিনারের পর যত তাড়াতাড়ি পারো। যেভাবে হোক বেরিয়ে আসবে তুমি। ঢাল বা কেবিনের কাছাকাছি যাবে না, যে জায়গার কথা বলেছি সেখানে যাবে। স্যাবটা ওখানেই রাখব। যদি পারো গাড়ি চুরি কোরো, নাহয় হেঁটে, কিন্তু পৌঁছুতেই হবে। স্যাবের খুব কাছাকাছি যাবে না, আশপাশে লুকিয়ে থেকো, চোখ খোলা। দেখা হবার সময় যেমন ঠিক করা আছে আগে।’
‘ঠিক আছে। শোনো, আমারও কিছু কথা…’
‘তাড়াতাড়ি।’
‘আমরা কি বা কেন, সব ওরা জানে,’ শুরু করল রিটা। ‘আর কাল রাতে হেনরি ডুপ্রে এখানে পৌঁচেছে।
তার সাথে গুণ্ডা তিনটে?’
‘জানি না, তবে ল্যাচাসি শুধু মারতে বাকি রেখেছে ডুপ্রেকে, নিজের লোকদের সামলাতে পারেনি বলে। বোঝা গেল নির্দেশ ছাড়াই কাজ করছিল ওরা ওয়াশিংটনে। তোমার কোন ক্ষতি করা চলবে না, রানা। আমার ব্যাপারটা ঠিক পরিষ্কার নয়-ওরা কথা বলার সময় পুরো নামটা উচ্চারণ করছিল, রিটা হ্যামিলটন-তবে তোমাকে ওরা জ্যান্ত চায়।
‘কার রেস…?’
‘ওটার আয়োজন করা হয় তোমাকে নার্ভাস করার জন্যে। হার্ভেস্টার পিঁপড়ে-ওগুলো আনা হয় একই উদ্দেশ্যে, তুমি যাতে ঘাবড়ে যাও। ওরা জানত ওই কেবিনে তুমি থাকছ না। পিঁপড়েগুলো আমার ক্ষতি করবে, এটাই চেয়েছিল ওরা। ল্যাচাসি কি রকম রোগছিল তা যদি দেখতে তুমি! সব সত্যি, রানা, ভান বা অভিনয় নয়। ওদের সব কথা আড়াল থেকে শুনেছি আমি। হুকুম দেয়া হয়েছে তোমাকে ব্যতিব্যস্ত রাখতে হবে, কিন্তু খুন করা যাবে না।’
‘বেশ…’
‘আরও আছে। অয়্যারহাউসে, বুঝলে, কিছু একটা ঘটেছে…’
প্রশ্নবোধক আওয়াজ করল রানা, ‘উঁ?’
হঠাৎ আমার চোখে পড়ে গেছে। জঙ্গলের
পড়ে গেছে। জঙ্গলের ভেতর থেকে একটা রেফ্রিজারেটেড ট্রাক বেরিয়ে এল, আজ বিকেলে। অয়্যারহাউসের পিছন থেকে। ওখানে আরও অন্তত দুটো ট্রাক ছিল। প্রথম ট্রাকটা চলে গেল এয়ারফিল্ডের দিকে। আইসক্রীম, রানা-সব ওরা সরিয়ে নিচ্ছে।’
ভুরুর মাঝখানে রেখা এঁকে বিড়বিড় করে বলল রানা, ‘আরও কিছু জানতে পারলে ভাল হত। কাল রাতের মধ্যে হয়তো সম্ভব হবে। খুব সাবধানে থাকবে, রিটা, খুব সাবধানে-সত্যি যদি ওরা ক্রিমিনাল বা টেরোরিস্ট অ্যাকটিভিটি শুরু করে থাকে, আর আমরা যদি গায়েব হয়ে যাই, আমাদের খোঁজে দরকার হলে গোটা র্যাঞ্চ খুঁড়বে ওরা। আমি…,’ হঠাৎ থামল ও. পোর্টিকোয় কারও উপস্থিতি টের পেয়েছে।
এক সেকেন্ড পর বাননা বেলাডোনার গলা ভেসে এল, ‘রানা? মিসেস লুগানিস? কেউ তোমাদের ডাকেনি? শুনছ, ডিনার সার্ভ করা হয়েছে।’
সিঁড়ি বেয়ে পোর্টিকোয় উঠে এল ওরা, বাড়ির ভেতর একা আগে ঢুকল রিটা, পিছনে রানাকে রেখে এল বেলাডোনার সাথে আস্তে-ধীরে আসার জন্যে। রিটাকে বেশ খানিকটা এগিয়ে যেতে দিল বেলাডোনা, তারপর মুখ ফেরাল রানার দিকে, নরম গলায় বলল, ‘রানা। ডিনারের পর যত তাড়াতাড়ি পারি তোমার সাথে দেখা করব। প্লীজ সাবধানে থেকো। দোহাই লাগে তোমার। ভীষণ ভয় পাচ্ছি আমি। ভারি বিপজ্জনক…তোমার সাথে জরুরী কথা আছে।’
সামান্য মাথা নত করে জানিয়ে দিল রানা, বুঝেছে সে। বেলাডোনার মায়া মায়া চোখ আবেদনে ভরা, সফিসটিকেটেড এবং অত্যন্ত সুন্দরী ফরাসী যুবতীর চরিত্রের সাথে ঠিক যেন মানায় না, বিশেষ করে কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে ডাইনিং রূমের দিকে হেঁটে যাবার এই মুহূর্তটিতে।
কাজেই ডিনারের পর এই জঙ্গলের ভেতর লুকিয়ে অপেক্ষা করছে রানা। বাননা বেলাডোনার জন্যে? প্রায় নিঃসন্দেহে তাই, ভাবল ও। যদিও বাস্তবে অন্য কিছু, আরও অনেক কিছু ঘটতে পারে। ডিনারের সময় পরিবেশে বেশ খানিকটা উত্তেজনার সৃষ্ট হয়েছিল, অন্তত দু’বার চরিত্রের সাথে বেমানান আচরণ করেছে মলিয়ের ঝান-একবার চাকরদের সাথে কথা বলার সময়, দ্বিতীয়বার বেলাডোনার সাথে। মাত্রা ছাড়ানো টেনশনই হয়তো দায়ী। রানা আর রিটা যা দেখেছে তাঁ থেকে দু’জনেই ধরে নিয়েছে, কিছু একটা ঘটতে চলেছে। মলিয়ের ঝান যদি সত্যি সও মং হয়ে থাকে তার মুখোশ খসে পড়তে আর বেশি দেরি নেই।
ঘাসের ওপর শুয়ে শুয়ে ভাবল রানা, পিয়েরে ল্যাচাসি ওদের সাথে ডিনার খায়নি. ব্যাপারটা কি তাৎপর্যপূর্ণ? ঝান কি সত্যি কথা বলেছে-কালকের জন্যে বক্তৃতা তৈরি করতে ব্যস্ত ছিল হাড্ডিসার লোকটা?
ল্যাচাসি, নাকি ঝান? মাঝে মধ্যেই প্রশ্নটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে রানার মনে। অন্ধকার সয়ে গেছে, সামান্যতম নড়াচড়াও ধরা পড়বে সতর্ক চোখে।
হাতঘড়ির ওপর চোখ বুলাল। পরিষ্কার জ্বলজ্বল করছে ডায়াল। এগারোটা পঁয়ত্রিশ। ঠিক তখুনি দূর থেকে ভেসে এল শব্দটা
এঞ্জিনের আওয়াজ। মাথা ঘোরাল রানা, কোন দিক থেকে আসছে বোঝার চেষ্টা। মনে হলো নিচে থেকে উঠে আসছে। ছোট একটা কার, আন্দাজ করল। গিয়ারের সাথে এঞ্জিনের আওয়াজও বদলে গেল, গাছপালা ঢাকা দীর্ঘ পথ বেয়ে উঠে আসছে!
মিনিট পাঁচেক পর হেডলাইটের আলো পড়ল ফাঁকা জায়গাটায়, পিছু পিছু এল ছোট গাড়িটা-কালো স্পোর্টস মডেল, দেখার সাথে সাথে চিনতে পারল রানা।
সরাসরি স্যাবের পিছনে থামল গাড়ি। বোঝাই যায়, স্যাবের নড়াচড়ায় একটা বাধা হয়ে দাঁড়াল। হুট করে যদি কেটে পড়ার দরকার হয়, সামনের অল্প জায়গায় বাঁক নিতে হবে রানাকে।
এঞ্জিন আর আলো অফ করল ড্রাইভার। রাতের স্থির বাতাসে সিল্ক-এর আওয়াজ পেল রানা। বানা বেলাডোনার কাঠামোটা অস্পষ্টভাবে দেখতে পেল গাড়ির পাশে, দাঁড়িয়ে রয়েছে স্থিরভাবে। তারপর তার গলা ভেসে এল, রানা? আছ তো, রানা?
সাবধানে, ধীরে ধীরে খাড়া হলো রানা। ফাঁকা জায়গাটা পেরোচ্ছে, একটা হাত হোলস্টারে ভরা ভি-পি-সেভেনটির কাছে তৈরি। একেবারে পিছনে না আসা পর্যন্ত বেলাডোনা ওর অস্তিত্ব টেরই পেল না।
‘ওহ্ গড!’ আঁতকে উঠল বেলাডোনা। ধ্যেত, রানা, এরকম করে না!’ কাঁপছে সে, রানাকে ধরে ঝুলে পড়ল।
‘তুমিই তো বলে দিয়েছ সাবধানে থাকতে।’ বেলাডোনার মুখটা দু’হাতে ধরে উঁচু করল রানা, হাসছে।
ডিনারের পোশাকটা বদলায়নি বেলাডোনা, সাদা কালো রেখা ও বৃত্তবহুল সিল্ক। সাধারণ একটা পোশাক, কিন্তু তার নিজস্ব স্টাইল আর ব্যক্তিত্ব পরিস্ফুট হবার সুযোগ পেয়েছে। হয়তো সাধারণ, মসৃণ আর উত্তেজক সিল্ক, হাত দিয়ে স্পর্শ করে ভাবল রানা, কিন্তু সন্দেহ নেই বানাতে খরচ পড়েছে তার মত লোকের কয়েক মাসের বেতন।
‘প্লীজ, রানা-আমরা ভেতরে যেতে পারি?’ বেলাডোনার ঠোঁটের বাতাস রানার ঠোঁটে লাগল। প্রথম বারের মতই, তার গায়ের বিশেষ গন্ধটি প্রাণভরে উপভোগ করল রানা। রেশমী কোমল চুলের সাথে এবার অসম্ভব দামী কি যেন একটা মেশানো হয়েছে। মুহূর্তের জন্যে নিজের আরও কাছে টানল রানা তাকে।
‘প্লীজ, রানা, প্লীজ!’ কোমল সুরে তাগাদা দিল বেলাডোনা। ‘ভেতরে, প্লীজ!’ এক পা সামনে বাড়ল রানা, কেবিনে আগে ঢুকতে দিল লোডোনাকে। তারপর বোতাম টিপে আলো জ্বালল ও। কেবিনের দরজা বন্ধ হবার সাথে সাথে রানার বাহুর ভেতর চলে এল বেলাডোনা, মৃদু কাঁপছে, তারপর নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। ‘এসে ভুল করে ফেলেছি।’ রুদ্ধশ্বাসে কথা বলার এই ভঙ্গিটি ভোলার নয়, প্রথমবার বেলাডোনাকে স্যাবে বসে চুমো খাবার সময় শুনেছিল।
‘তাহলে এলে কেন?’ দু’হাত দিয়ে বেলাডোনাকে আলিঙ্গন করল রানা, ঘুরে ওর দিকে ফিরল বেলাডোনা, শরীরে তার হাত আর পায়ের জোরাল স্পর্শ অনুভব করল রানা।
‘কেন বুঝতে পারো না?’ মুখ তুলে রানার ঠোঁটে চুমো খেলো বেলাডোনা, আবার পিছিয়ে গেল তাড়াতাড়ি। ‘না। এখুনি নয়। কি যে ঘটতে যাচ্ছে কিছুই বুঝছি না, রানা। তোমাকে শুধু এটুকু বলতে পারি যে ঝান আর ল্যাচাসি দু’জনেই মানুষ মারার প্ল্যান করেছে। ওদের প্ল্যান···মোটকথা এরচেয়ে বিপজ্জনক আর কিছু হতে পারে না, রানা। আমি শুধু এটুকুই জানি, শুধু এটুকুই তোমাকে বলতে পারি। দু’জনেই ওরা আমার কাছ থেকে সব লুকিয়ে রাখে। কালরাতে লোকজন এসেছে-পুব থেকে, নিউ ইয়র্ক থেকে। ওদের কিছু কিছু কথা কানে এসেছে আমার। ল্যাচাসিকে বলতে শুনলাম, আজ যদি সে রেসে না জেতে…’
কিন্তু রেসের আগে তোমাকে তো বেশ স্বাভাবিকই লাগছিল…’
‘তোমাকে সাবধান করার কোন উপায়ই ছিল না, রানা। কেন দেখোনি, ঝানের লোকেরা আমাকে ঘিরে রেখেছিল? দ্রুত, ঘন ঘন মাথা নাড়ল বেলাডোনা,। ‘কোন কথা শুনব না, তোমাকে পালাতে হবে, রানা।’
‘ঝান কাল সকালে বিদায় নিতে বলেছে…’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি জানি…কিন্তু …’ কাছে এসে রানার বুকের সাথে সেঁটে গেল বেলাডোনা, ‘…ওরা অপেক্ষা করবে, জানি আমি। নতুন অনেক লোককে দেখা গেছে, সাথে কুকুর নিয়ে ঘেরাও করে রাখবে গোটা র্যাঞ্চ… কাকে যেন বলতে শুনলাম হাফ-ট্রাক ব্যবহার করা হবে…হাফ-ট্রাক, তাই না?’
‘মরুভূমিতে হাফ-ট্রাক কাজের জিনিস, হ্যাঁ।’ ওর-ও যে তাই ধারণা সে-কথা বলল না রানা। কোন সন্দেহ নেই ঘুমের ভান করে পড়ে থাকবে ঝান নামের কুকুরটা, নিরাপদে বেরিয়ে যেতে দেবে ওদেরকে র্যাঞ্চের বাইরে, বেরিয়ে গিয়ে সরাসরি পেশাদার খুনীদের হাতে পড়বে ওরা।
শিউরে উঠে রানার বুকে মুখ গুঁজল বেলাডোনা।
‘শোনো, বাননা।’ দু’হাত তার কাঁধে রেখে মৃদু চাপ দিল রানা, দুটো মুখ সামনাসামনি হলো। মন দিয়ে শোনো। রিটা চলে যাচ্ছে। আমি চলে যাচ্ছি। দু’জনেই আমরা গায়েব হয়ে যাব। কাল নয়, ঝান যেমন চাইছে, আজ রাতেই-কিংবা খুব ভোরের দিকে। আমিও জানি কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, তাই ঠিক করেছি গা ঢাকা দেব, র্যাঞ্চের ভেতরই…’
‘কিন্তু. রানা… র্যাঞ্চের ভেতর তো…
‘জানি। গা ঢাকা দেব, আর চেষ্টা করব অন্তত একজন যাতে বেরিয়ে যেতে পারি…
‘ঠিক আছে, বুঝলাম…কিন্তু কিভাবে? ভেবেছ ওরা তোমাদের পালাবার খোলা রেখেছে? অসম্ভব! টাকাগুলো, তাই না, রানা? ঠিক বুঝতে পারছি না।’
ক্ষণস্থায়ী নিস্তব্ধতা শেষ হবার আগেই শোনা গেল ভারী একটা প্লেনের আওয়াজ। বেশ নিচে দিয়ে র্যাঞ্চের আকাশ পাড়ি দিচ্ছে।
কেবিনের বন্ধ জানালার দিকে তাকাল বাননা বেলাডোনা। ‘ওই আসতে শুরু করেছে ডেলিগেটরা! আজ রাতে দুটো আলাদা আলাদা ফ্লাইট। তা নয়তো ঝানের ফ্রেইটার…’
‘ফ্রেইটার?’
বেলাডোনার গলায় সংক্ষিপ্ত, নার্ভাস হাসি। ‘বুঝলে না, লোকটার আইসক্রীম! জানি ক্রিমিন্যাল একটা কিছুর মধ্যে ব্যস্ত সে, কিন্তু আইসক্রীমের কথা ভোলেনি। নতুন আরেকটা ফ্লেভার আবিষ্কার করেছে,
করেছে, কে জানে কোথাকার এক ডিসট্রিবিউটরকে বিক্রিও করে দিয়েছে। টন টন আইসক্রীম, রানা। আজ রাতেই তো ডেলিভারি দেয়ার কথা।
ডিসট্রিবিউটরের কাছে আইসক্রীম পাঠানো হচ্ছে, তাৎপর্যটা কি? সাদামাঠা, নির্দোষ আইসক্রীম? নাকি ঝান আর ল্যাচাসির উদ্ভাবিত ওষুধ মেশানো আইসক্রীম? ওষুধের প্রতিক্রিয়া চাক্ষুষ করেছে রানা, নিজের অজান্তেই মানুষ শয়তানে পরিণত হয়, নিজের প্রিয়জনকেও খুন করতে পারে হাসিমুখে।
‘কোথায়, রানা? কোথায় তুমি লুকাবে? বেলাডোনা জিজ্ঞেস করল।
‘না!’ তীক্ষ্ণ, প্রতিবাদের সুর রানার কণ্ঠে। ‘সে-কথা তোমার না জানাই ভাল। কিছুই যদি না জানো, ওরা তোমার ওপর টরচার করার সুযোগ পাবে না। স্রেফ গায়েব হয়ে যাব আমরা, কোথায় এই মুহূর্তে আমি নিজেও তা জানি না। তুমি অপেক্ষা করবে, বান্না। কোন রকম ঝুঁকি নেবে না, শুধু অপেক্ষা করবে। কেউ না কেউ আসবে, কথা দিলাম তোমাকে। তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘তোমার সাথে আমার আর দেখা হবে না?’
‘কেন হবে না!’ বেলাডেনাকে কাছে টানল রানা, চুমো খেলো ঠোঁটে। ‘বেঁচে থাকলে অবশ্যই হবে।’
রানা অনুভব করল তার একটা হাত ওর ঊরুতে আঙুল বুলাচ্ছে। ‘সময় ফুরিয়ে আসছে, রানা! জায়গা নেই আর, কিন্তু তবু আরও সরে আসার চেষ্টা করছে বেলাডোনা, যেন সেঁধিয়ে যেতে চায় রানার ভেতর, ফিসফিস করছে রানার কানে, ‘রানা, তোমার যদি কিছু ঘটে…আমাদের কি হবে? আমি কি নিয়ে…? নরম ঠোঁট দিয়ে রানার গলা ছুঁলো সে, মৃদু কামড় দিল চিবুকে। … বলে দাও! আমার স্বপ্ন কি তাহলে পূরণ হবার নয়? তোমাকে চেয়েছি…যদি কিছু ঘটে…’ একটু যেন ফোঁপাচ্ছে বেলাডোনা, রানার গালের সাথে গাল ঘষছে।
বেলাডোনাকে জড়িয়ে ধরে, ধীর পায়ে বেডরূমের দিকে এগোল রানা। বিছানায় ওঠার আগে নাইট-টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে দিল ও।
‘না, ননা!’ কোমল সুরে আবদার জানাল বেলাডোনা। ‘প্লীজ রানা, আমি আলো চাই না…অন্ধকার।
‘একটু সেকেলে হয়ে যায় না…?’
‘প্লীজ, রানা,’ সুর করে বলল বেলাডোনা, অনুরোধ।
ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল রানা, বোতাম টিপে নিভিয়ে দিল আলো, মেঝেতে খসে পড়া কাপড়চোপড় ছেড়ে উঠে এল, বেলাডোনার মাথা গলে বেরুতে থাকা সিল্কের খসখস শুনতে পাচ্ছে।
বিছানায় শুয়ে, নাগালের মধ্যে অটোমেটিকটা রাখতে গিয়ে হঠাৎ রানার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সতর্ক হয়ে উঠল, স্যাৎ করে হাতটা লম্বা করে আবার আলো জ্বালল ও।
‘কি হলো!’ লজ্জায় কুঁকড়ে গেল বেলাডোনা, চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। দুঃখিত, বাননা খানিকটা আলো না থাকলে আমার চলবে না।’
এক গড়ান দিয়ে রানার ওপর উঠে এল বেলাডোনা। ‘ওরে পাজি! ওরে নির্লজ্জ!’ প্রতিবার নতুন নতুন নামে ডাকছে সে রানাকে, আর পাগলের মত চুমো খেয়ে অস্থির করে তুলছে।
.
ভোর চারটের দিকে চলে গেল বাননা বেলাডোনা। যাবার আগে একশো একবার, পইপই করে সাবধান করে দিল, রানা যেন সতর্ক থাকে। ‘আবার আমাদের দেখা হবে, রানা? বলো আবার দেখা হবে আমাদের।’
আলতো একটা চুমো খেয়ে কথা দিল রানা, অবশ্যই আবার মিলিত হবে ওরা।
‘যদি,’ সবশেষে রানাকে বলল সে, ওরা যখন গাড়ির কাছে পৌঁছুল, ‘যদি খারাপ কিছু ঘটে, রানা, আমার ওপর ভরসা রেখো। তোমাকে সাহায্য করব আমি। সাধ্যের বাইরে চেষ্টা করব। তোমাকে ভাল…
শেষ চুমো দিয়ে তাকে থামিয়ে দিল রানা। ‘বলাটা খুব সহজ।’ অন্ধকারে হাসল ও। ‘তারচেয়ে কি উপভোগ করলাম আমরা সেটার কথা ভাবো, আশা করো, আরও পাব।।‘
স্যাবের পাশে, অন্ধকারে দাঁড়িয়ে, গাছপালার ভেতর ছোট গাড়িটার আলো হারিয়ে যেতে দেখল ও। প্রেমময় সংস্পর্শে পরিচ্ছন্ন এবং সতেজ হয়ে ওঠা মাসুদ রানা এরপর নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে স্যাবে উঠে বসল, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল যার অর্থ নিজের কাছেও তেমন পরিষ্কার নয়, ছেড়ে দিল গাড়ি, শুধু পার্কিং লাইটগুলো ব্যবহার করছে। ঢালু পথ বেয়ে নেমে এল ও, তারপর ঢাল ঘিরে থাকা রাস্তা ধরল। সেই আগের জায়গায় ফিরে এল রানা, যেখানে বসে বাননা বেলাডোনার সাথে কথা হয়েছিল ওর, শুনেছিল কিভাবে তার সব টাকা-পয়সা হজম করে ফেলেছে মলিয়ের ঝান।
গাছপালার ভেতর গাড়িটা যতটা সম্ভব লুকাল রানা, বাকি সামান্য পথটুকু হেঁটে এল। বেলাডোনার প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করা উচিত ওর, সে-ই তো কনফারেন্স সেন্টারে ঢোকার পথটা দেখিয়েছে ওকে।
সকাল হতে খুব বেশি দেরি নেই, বড়জোর দু’ঘণ্টা, কাজেই জগিঙের ভঙ্গিতে নিঃশব্দে দৌড়ানোর কৌশলটা কাজে লাগাল রানা, দ্রুত হাঁটার বিকল্প, কমান্ডো ট্রেনিং-এর সময় শিখেছিল। পরনে এখনও ওর হালকা পোশাক, সাথে শুধু হেকলার অ্যান্ড কচ, স্পেয়ার অ্যামুনিশন, পিক-লক আর টুলস্ সহ রিঙটা রয়েছে।
যতটা ধারণা করেছিল তারচেয়ে লম্বা পথ, জঙ্গলের কিনারায় ম্যানহোলের কাছে যখন পৌছুল আকাশের ঘন কালো রঙ একটু যেন হালকা লাগল চোখে। ধাতব ঢাকনি সহজেই উঠে এল, ভেতরের বড়সড় হাতলটা ধরল রানা!
প্রবেশপথের মুখ খুলে গেল। মেটাল কভার জায়গামত রেখে গর্তের ভেতর নামল ও, সন্ধানী চোখে চারদিকে তাকাল-বেলাডোনার কথামত ভেতর থেকে পাথরটা প্রবেশপথের মুখে ফিরিয়ে আনার জন্যে একটা মেকানিজম আছে। রাস্তা থেকে প্রায় বারো ফুট নিচে নেমে এসেছে ও, টানেলে ঢোকার মুখটা দেখতে পাচ্ছে পরিষ্কার, দূরে ছোট একটা নীল বালব জ্বলছে।
শেষ ধাতব আঙটার কাছাকাছি দেখা গেল মেকানিজম। লিভার ধরে টান দিতেই একবারে কাছ থেকে শোনা গেল হাইড্রলিক গুঞ্জন, মাথার ওপর প্রবেশপথের মুখে ভারী পাথরটা ফিরে আসতে শুরু করায় থরথর করে কাঁপতে লাগল চারপাশটা।
চেম্বার থেকে খিলান আকৃতির প্রবেশপথ পেরিয়ে টানেলে ঢুকল রানা। সিলিংটা প্রায় আট ফুট উঁচু, দু’হাত দু’দিকে লম্বা করে দিয়ে দু’পাশের দেয়ালের স্পর্শ পেল রানা আঙুলের ডগায়। খুব বেশিদূর এগোয়নি, লক্ষ করল টানেলের মেঝে নিচের দিকে সামান্য ঢালু হতে শুরু করেছে। কোথাও কোন শব্দ নেই, নড়াচড়া নেই, তবু ঘন ঘন থেমে কান পাতল রানা। কনফারেন্স সেন্টারটা ব্যবহার করা শুরু হয়েছে, তারমানে ঝানের লোকেরা এ-পথে আসা-যাওয়া করছে। র্যাঞ্চ থেকে সেন্টারে ঢোকার এই একটাই তো পথ।
কারও সাথে দেখা হলো না, প্রায় এক মাইল হেঁটে এসেছে ও। নিচের দিকে নেমে যাবার পর মেঝেটা মাঝখানে সমতল হয়েছিল, তারপর শেষ দিকে উঁচু হয়ে উঠে গেছে। আগেও বেশ খানিকটা হাঁটা হয়েছে রানার, অনুভব করল কিছুটা আড়ষ্ট লাগছে ঊরুর পেশী।
আগের চেয়ে আরও সাবধান রানা, হাঁটার গতি কমিয়ে দিয়েছে। ধরে নিতে হবে সামনে লোকজন আছে। এদিকে আরও খাড়াভাবে উঠে গেছে মেঝে, ধীরে ধীরে এক দিকে-বেঁকে গেছে টানেল। তারপর, কোন আভাস ছাড়াই, হঠাৎ করে গোটা টানেল চওড়া হয়ে গেল, শেষ মাথা পর্যন্ত পরিষ্কার। খিলান আকৃতির আরেকটা প্রবেশপথ, ভেতরে চেম্বার। পথের প্রথম মাথাটার চেয়ে আকারে বড় এটা।
রানার সামনে মসৃণ দেয়াল, সাদা মার্বেল পাথরের তৈরি। গোটা চেম্বারটা পরীক্ষা করল রানা, মনে আছে বেলাডোনা বলেছিল এদিকের মাথাতেও একটা মেকানিজম থাকবে, যার সাহায্যে দারোয়ানের ক্লজিটে যাওয়া যায়। কিন্তু ডিভাইসটা সম্পর্কে বিশদ কিছু বলেনি সে। রানা শুধু সাদা পাথরের মসৃণ দেয়ালে নীল আলো দেখতে পাচ্ছে-কোথাও কোন বাক্স, ধাতব ঢাকনি বা সুইচ নৈই।
সাধারণ বুদ্ধিতে বলে চেম্বারে ঢোকার সময় নাক বরাবর সামনে যে দেয়াল পড়ে, ওটাতেই বেরিয়ে যাবার পথ করা আছে। আরও বলে, দরজাটা যদি ক্লজিটের পিছন দিকে হয়, ডান হাতের বরাবর থাকবে হ্যান্ডেল।
দেয়ালের মাঝখান থেকে শুরু করল রানা, চৌকো মার্বেল পাথর পরীক্ষা করল একটা একটা করে। তিন সারি পাথর পরীক্ষা করলেই হবে, তার নিচ আর ওপরেরগুলো বাদ। প্রতিটি পাথর চাপ দিল, খোঁচা দিল জয়েন্টগুলোয়। পনেরো মিনিট পর ঠিক জায়গায় চাপ পড়তেই খানিকটা পিছিয়ে একপাশে সরে গেল পাথরটা, ভেতরে সাধারণ একটা দরজার নব।
আস্তে করে নবটা ঘোরাবার চেষ্টা করল রানা। এবার একসাথে অনেকগুলো মার্বেল সরে গেল, দেখা গেল গোটা একটা কাঠের দরজা, গায়ে আরেকটা নব। নব ঘুরিয়ে কবাট খুলল ও, দূর প্রান্তে প্লাস্টার করা দেয়াল, দেয়ালের গায়ে শেলফ, ধনুকের মত বাঁ দিকে বাঁকা হয়ে আছে।
চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল রানা, শেলফের ভেতর আড়াল করা নবটা খুঁজে বের করল।
ক্লজিটের ভেতর জায়গা খুব কম, দরজার পিছনে কোন রকমে একজন লোক লুকিয়ে থাকতে পারে।
রানার সামনে শেলফ, শেলফের পাশে প্লাস্টার করা দেয়ালে আরেকটা দরজা। গোপন দরজাটা বন্ধ করার পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল ও, অন্ধকার সয়ে নেয়ার জন্যে সময় দিল চোখ দুটোকে।
নব ধরে ধীরে ধীরে ঘোরাল রানা, সেই সাথে চাপ বাড়াল সামনের দিকে । টানেলের নীল আলো আর নিস্তব্ধতার পর আওয়াজ শুনে প্রায় চমকে উঠল ও। লোকজনের গলা ভেসে আসছে-নারী-পুরুষকণ্ঠ। ক্লজিটের খোলা দরজার সামনে প্যাসেজ, আলোয় উদ্ভাসিত। প্রায় সংলগ্ন খোলা একটা জানালা জানিয়ে দিল ভোর হয়ে গেছে, উজ্জ্বল রোদ ঢুকছে ভেতরে।
হাতঘড়ি দেখল রানা। ঢাল থেকে এখানে পৌঁছুতে এতটা সময় লাগবে ভাবতে পারেনি ও। সাড়ে সাতটা বাজে। তবে লাভ হয়েছে এই যে অপেক্ষার সময়টা কমল। কিন্তু কোথায় অপেক্ষা করবে সে? কারও চোখে না পড়ে কিভাবে সে কনফারেন্সে হাজির থাকবে?
ক্লজিটের দরজাটা খোলা রাখল রানা, যদি তাড়াহুড়োর মধ্যে পালানোর দরকার হয়। প্যাসেজ ধরে এগোল কয়েক পা। খুব কাছাকাছি কোথাও থেকে আসছে শব্দগুলো, হয়তো বিশ ফুট সামনের বাঁক ঘুরলেই লোকজন দেখে ফেলবে ওকে। মনোযোগ দিয়ে শব্দগুলো শুনল ও হাসল আপনমনে। চিনতে পারছে-প্লেট, কাপ-পিরিচের আওয়াজ। ডাইনিং রূমের কাছাকাছি কোথাও রয়েছে সে।
জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিল রানা। চওড়া একটা লন, মাঝখানে ইংরেজী অক্ষর এইচ-এর আকৃতি নিয়ে সাদা পাথুরে একটা কাঠামো। দূরে উঁচু তারের বেড়া। তারপর একটা দেয়াল, ওপাশে সবুজ বনভূমি পরিষ্কার দেখা গেল। সরাসরি একটা হেলিপ্যাডের দিকে তাকিয়ে রয়েছে রানা।
ঘুরে ক্লজিটের দিকে ফিরল ও, একজোড়া দরজা দেখতে পেল। প্রতিটি দরজার ওপরের অর্ধেকে মোটা স্বচ্ছ কাঁচের প্যানেল রয়েছে। গোটা গোটা সোনালি হরফের লেখাগুলো পড়ে জানা গেল এই পথেই কনফারেন্স সেন্টারে যাওয়া যায়। প্যানেলে চোখ রাখার জন্যে প্যাসেজ ধরে ফিরে এল রানা।
উঁকি দিয়ে সরে এল রানা একপাশে, প্যাসেজ আর দরজার আড়ালে। দুই কি তিন সেকেন্ডের মধ্যে যা দেখার সব দেখে নিয়েছে ও। দরজার ভেতর বিশাল একটা হল, আধুনিক থিয়েটারের মত। প্রকাণ্ড অর্ধচন্দ্র আকৃতিতে
সাজানো হয়েছে গদিমোড়া আসন, মধ্যবর্তী প্যাসেজগুলোয় চোখ ধাঁধানো রোদের মত উজ্জ্বল আলো। আসনগুলোর সামনের অংশে চওড়া স্টেজ, এরইমধ্যে লম্বা টেবিল আর ডজনখানেক চেয়ার ফেলে সাজানো হয়েছে সেটা। টেবিলের সামনে মাইক্রোফোন, বুক সমান উঁচু ডেস্কটাকে যেন পাহারা দিচ্ছে। স্টেজের পিছন দিকে, পর্দার মত দেখাল ঝুলে থাকা সিনেমা স্ক্রীনটাকে।
কনফারেন্স হল খালি নয়। কম করেও ঝান সিকিউরিটির দশ-বারো জন লোক চারদিকে ঘুর ঘুর করছে, তাদের দু’জনের সাথে একটা করে কুকুর, কারও হাতে এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন ডিভাইস বা অ্যান্টি-বাগিং স্নিফার্স। সন্দেহ নেই ব্যবহারের আগে ছেঁকে পরিষ্কার করে নিচ্ছে হলটাকে। অটোমোটিভ এঞ্জিনিয়ারদের সামনে কাগজ পড়বে পিয়েরে ল্যাচাসি, সে জন্যে? নাকি খোদ মলিয়ের ঝানই বক্তৃতা দেবে মীটিঙে?
এক সেকেন্ডের জন্যে আবার একবার উঁকি দিল রানা, দরজার কাছাকাছি ঝান সিকিউরিটির কয়েকজনকে দেখে তাড়াতাড়ি ক্লজিটের ভেতর ঢুকল ও, হাতে বেরিয়ে এসেছে হেকলার অ্যান্ড কচ, সেফটি ক্যাচ অফ। সিকিউরিটির লোকেরা এই পথেই যেতে পারে, ঝানের অন্যান্য সহকারীরাও ব্যবহার করতে পারে এই প্যাসেজ।
ক্লজিটে ঢুকছে রানা পাঁচ সেকেন্ডও হয়নি, এখনও পুরোপুরি বন্ধ নয় দরজা, আওয়াজ শুনে বোঝা গেল প্যাসেজে বেরিয়ে আসছে সিকিউরিটির লোকগুলো। গলার আওয়াজ পরিষ্কার শোনা গেল, মাত্র কয়েক ফুট দূরে থেকে।
‘ও.কে.?’ জিজ্ঞেস করল একজন।
‘ওরা বলছে সব পরিষ্কার, টড,’ দ্বিতীয় কণ্ঠস্বর থেকে জবাব এল।
আরেকটা নতুন কণ্ঠস্বর, ‘স্টেজের তলাটা, জনি? খুঁটিয়ে সব দেখা হয়েছে তো?’
হ্যাঁ, হয়েছে-তলা-ওপর কিছুই বাদ দেয়া হয়নি। বাঁ দিকে অ্যাকসেস ফ্ল্যাপ-এর ভেতরটা পর্যন্ত দেখা হয়েছে। টর্চ নিয়ে আমি নিজে ঢুকেছিলাম। মোড়ক খোলা সাবানের মত পরিষ্কার দেখে এসেছি-ধুলো আর মাকড়সার জালগুলো যদি বাদ দাও।’
কয়েকজনের মিলিত হাসি শোনা গেল, সেই সাথে ধারণা করল রানা অনুসন্ধানের কাজ শেষ হয়েছে।
‘ওঁরা আসছেন কখন?’ কেউ একজন জানতে চাইল।
‘মহিলা আর পুরুষ শ্রোতারা আসন গ্রহণ করবেন আটটা পঁয়তাল্লিশে, তারপর যতক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। কড়া নির্দেশ-আটটা পঁয়তাল্লিশের পর কাউকে আর ঢুকতে দেয়া হবে না।’
‘তাহলে আর চিন্তা কি, হাতে প্রচুর সময়। চলো কিছু খেয়ে নিই।’
‘সও মং কি আসছেন?’ প্রশ্নটা করল জনি, এবং রানা অনুভব করল জোরাল প্রত্যাশায় ওর ঘাড়ের চুল দাঁড়িয়ে গেল।
‘আন্দাজ করা হচ্ছে। যদিও কথা বলবেন না। কখনোই বলেন না।’
‘না। আফসোস। ঠিক আছে, বন্ধুরা, কার কি কাজ মনে থাকে যেন, কোন রকম বেয়াদপি বা গাফলতি নয়-কাকে কোথায় বসাতে হবে জানোই তো। আর যখন…’
দূরে সরে যেতে যেতে মিলিয়ে গেল ওদের গলা, এক সময় বুটের আওয়াজও আর শোনা গেল না।
পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে চিন্তা করার প্রয়োজন পড়ল না, হাতে অটোমেটিক নিয়ে ক্লজিট থেকে বেরিয়ে এল রানা। প্যাসেজটা ভাল করে দেখে নিল একবার, ফাঁকা। কয়েক সেকেন্ড পর, কনফারেন্স হলের ভেতরে রয়েছে রানা, মধ্যবর্তী একটা প্যাসেজ ধরে হন হন করে এগোচ্ছে। মনে মনে জনিকে ধন্যবাদ দিল ও, স্টেজের বাঁ দিককার অ্যাকসেস্ ফ্ল্যাপ-এর কথা সেই জানিয়েছে।
পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে জিনিসটা খুঁজে নিল রানা। সাধারণ একটা পর্দা, দু’পাশে খানিক পর পর রিঙ আটকানো আছে, রিঙের ভেতর রশি, টানলে সরে যাবে গোটা পর্দা। খানিকটা অংশ উঁচু করে হামাগুড়ি দিয়ে স্টেজের তলায় ঢুকে পড়ল রানা, ক্লজিট থেকে বেরুবার পর সময় পেরিয়েছে মাত্র ষাট সেকেন্ড।
এখন থেকে শুধু অপেক্ষার পালা। পৌনে ন’টা বা কিছু আগে ডেলিগেটরা আসবে। তার খানিক পর আসবে সও মং। সও মং ওরফে উ সেন নয়, এ লোক নতুন সও মং। নামটা এখন ফাঁস হয়ে গেছে, অচিরেই রানা তাকে চাক্ষুষ দেখে চিনে নিতে পারবে- সন্দেহভাজন দু’জনের একজন।
দু’জনের মধ্যে কে? ঝান, নাকি ল্যাচাসি?