তিন
আকাশ যেন স্বচ্ছ হীরে, উঠে এল সূর্য, রোদের ভেতর ঝাঁঝাল একটা ভাব দিনের প্রথম প্রহরেই টের পাওয়া গেল। আর এক ঘণ্টার মধ্যে আগুন ধরে যাবে চারদিকে। বরফ দেয়া পানীর নিয়ে ঠাণ্ডা ছায়ায় বসে থাকার একটা দিন, সময়কে অগ্রাহ্য করে কুঁড়েমিকে প্রশ্রয় দিতে পারলে মন্দ হত না, আরও ভাল হত পাশে যদি গল্প করার কেউ থাকত-বিশেষ করে পুঁইডাঁটার মত কোন লাবণ্যময়ী… অবাস্তব চিন্তাটাকে বেশি দূর বাড়তে দিল না রানা।
বেশিক্ষণ ঘুমোয়নি ও। প্রায় পুরো এক ঘণ্টা কাটিয়েছে স্যাবকে নিয়ে। এখানকার লোকদের আস্তিনে গোপন কৌশলের কোন অভাব নেই, তবে এম.আর. নাইনের স্যাব টারবোও কম যায় না, তবু অসাবধান হবার ঝুঁকি নিতে চায়নি ও। স্যাবের কোথাও কোন খুঁত আছে কিনা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হয়েছে ওকে। সঙ্গতভাবেই আত্মবিশ্বাসের মাত্রা আগের চেয়ে বেড়েছে ওর। প্রতিপক্ষ শেলবি-আমেরিকান গাড়ির এঞ্জিনে যতই কারিগরি ফলিয়ে থাকুক, স্যাবের সাথে পেরে ওঠার সুযোগ খুবই কম। পিয়েরে ল্যাচাসি যত ভাল ড্রাইভারই হোক, আজ তাকে পরাজয় স্বীকার করতে হবে।
টার্বো-চার্জার সহ সাধারণ একটা স্যাব নাইন হানড্রেড অনায়াসে ঘণ্টায় একশো পঁচিশ মাইল স্পীড তুলতে পারে। আইনে নিষেধ আছে, কমার্শিয়াল মডেলগুলো এই গতিসীমা পেরোতে পারবে না, কাজেই স্যাবগুলোকে সেভাবেই তৈরি করা হয়। কিন্তু তারপরও হাতের কারসাজি থাকে-যে জানে। ফুয়েল লাইন প্রেশার বাড়িয়ে দেয়া যায়, সাহায্য নেয়া যায় স্পেশাল র্যালি কনভারশন কিট- এর, গতিসীমা তুঙ্গে উঠে যাবে।
রানা জানে পশ্চিম ইউরোপ আর আমেরিকার পুলিস বাহিনী এ-ধরনের পরিবর্তিত স্যাবই ব্যবহার করে। ‘যদি একটা কমার্শিয়াল টার্বোকে ধরতেই না পারি, টার্বো আমাদের কি কাজে আসবে?’ এফ. বি. আই-এর একজন সিনিয়র অফিসার জিজ্ঞেস করেছিল রানাকে।
নিজের স্যাব নিয়ে এরইমধ্যে খোলামেলা একটা রাস্তায় ঘণ্টায় একশো আশি মাইল স্পীড তুলেছে রানা, নতুন ওয়াটার-ইঞ্জেকশন সিস্টেম ফিট করার পর। একই স্পীড আজও না ওঠার কোন কারণ নেই। চাকা বিস্ফোরিত হবে সে-ভয় নেই রানার, এমনকি টায়ারে ঠিকভাবে লাগা বুলেটও কোন ক্ষতি করতে পারবে না, কারণ ওর ব্যক্তিগত গাড়িটা চলে মিচেলিন অটোপোর্টার টায়ারে। গাড়ি তৈরির কারখানাগুলোয় চাপাস্বরে যে উপাদানের নাম করা হয় তা শুধু অটোপোর্টার টায়ারে আছে।
নো প্রবলেম, ভাবল রানা, পুরোদমে চালু রয়েছে এয়ার কন্ডিশনিং, সাইড রোড ধরে সিলভার বীস্টকে অনায়াসে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ও, সাইড রোডটা সার্কিটের পাশে সমান্তরালভাবে রয়েছে। মলিয়ের ঝানকে পরিষ্কার দেখা গেল, সাথে বান্না বেলাডোনা আর রিটা, গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডের সামনে। গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডে এরইমধ্যে ভিড় জমে উঠেছে। ঝানের কর্মচারীদের ডেকে আনা হয়েছে-কে জানে বেঁধে আনাও হয়ে থাকতে পারে-আজকের উত্তেজক প্রতিযোগিতার দর্শক হবার জন্যে।
স্যাব নিয়ে স্লিপ রোডে উঠে এল রানা, রোডটা পিটগুলোর দিকে চলে গেছে, থামল ঝান গ্রুপের সামনে। চারদিকে কোথাও পিয়েরে ল্যাচাসি বা শেলবি- আমেরিকানের ছায়া পর্যন্ত নেই।
‘রানা, দেখে মনে হচ্ছে আজকের দিনে তুমিই বাদশা!’ বান্না বেলাডোনার হাসি এত মিষ্টি আর আন্তরিক পুলকের একটা ধাক্কা অনুভব করল রানা, চুম্বনের লোভ হলো। পরমুহূর্তে খেয়াল করল, ওর দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে রিটা।
‘মর্নিং, রিটা,’ সহাস্যে বলল ও।
আরামের কথা ভেবে হালকা নীল আর লাল ট্র্যাক সুট পরেছে রানা, অন্যান্য আর সব কিছুর সাথে স্প্রিঙফিল্ড থেকে কেনা হয়েছিল। এয়ার কন্ডিশনিং থাকলেও, ও জানে, প্রতিযোগিতা শুরুর পর স্টিয়ারিঙের পিছনে রীতিমত ঘামতে হবে ওকে, বিশেষ করে ল্যাচাসি যদি ওর দিকে চাপার চেষ্টা করে।
‘মি. রানা, আশা করি রাতে আপনার ভাল ঘুম হয়েছে?’ স্বভাবসুলভ ভরাট গলায় হেসে উঠল মলিয়ের ঝান, রানার পিঠে সশব্দে চাপড় মারল একটা, জ্বালা ধরে গেল চামড়ায়।
‘হ্যাঁ, অবশ্যই, একেবারে মড়ার মত।’ সরাসরি ঝানের চোখে তাকাল রানা। কাল রাতের উদ্বেগ-উত্তেজনার ছিটেফোঁটাও নেই চেহারায়।
‘দু’একটা প্র্যাকটিস রান হবে নাকি, শুরু করার আগে, মি. রানা? এখান থেকে দেখে মনে হচ্ছে বটে পানির মত সহজ ব্যাপার, কিন্তু আমি আপনাকে কথা দিতে পারি যে শিকেইন আর দূর প্রান্তের আঁকাবাঁকা অংশটুকু সত্যিকার অভিশাপ। আমি জানি, নিজের হাতে তৈরি কিনা।
‘ঠিক আছে, দু’বার চক্কর দিয়ে পরিচয়টা সেরে নিই।’ পেট্রল পাম্পের দিকে ইঙ্গিত করল রানা। তারপর তেল ভরতে পারব তো?’
‘বলেন কি! নিজের হাতে এ-সব কিছুই আপনাকে করতে হবে না। আপনার জন্যে পুরো একদল ক্রু-র ব্যবস্থা করা হয়েছে, মি. রানা।’ নিজের পাঁচজন লোকের দিকে ইঙ্গিত করল ঝান, সবাই ওভারঅল পরা। ‘সত্যিকার গ্রাঁ প্রি! আপনার স্পেয়ার হুইলটা বের করতে চান, যদি মনে করেন বদলানো দরকার? আপনার জন্যে সবরকম সুযোগ-সুবিধেই রাখা হয়েছে।’
‘আমি নিজেই পারব। টেন ল্যাপস, তাই না?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু ভুলবেন না, সাহায্য দরকার হলে ক্রুরা কাছে পিঠেই আছে। ট্র্যাক মার্শালরাও দাঁড়িয়ে থাকবে, যদি বড় ধরনের কোন বিপর্যয় ঘটে।
রানা কি ঝানের সুরে বা বলার ভঙ্গিতে কিছু টের পেল? কোন আভাস? ইঙ্গিতে জানিয়ে দেয়া হলো ওর বারোটা বাজাবার আয়োজন করে রাখা হয়েছে? অপেক্ষা করো, নিজেরাই দেখতে পাবে। সবশেষে দেখা যাবে ফিনিশিং লাইন পেরিয়ে গেছে সেরা ড্রাইভার, সেরা গাড়ি নয়।
গ্রুপটার উদ্দেশে হাত নাড়ল রানা, রিটার উদ্দেশে চোখ মটকাল, তারপর উঠে বসল স্যাবে। স্টার্ট দেয়ার আগে পোলারয়েড সান গ্লাস অ্যাডজাস্ট করে নিল।
পজিশন নেয়ার জন্যে গ্রিড-এ যাচ্ছে রানা, এই ফাঁকে দ্রুত, একবার ইনস্ট্রুমেন্টগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে নিল। দু’বার চক্কর দেবে ও-প্রথমবার একটু আস্তে-ধীরে, যেখানে সম্ভব ঘণ্টায় সত্তর মাইল বেগে, দ্বিতীয়বার দ্রুতগতিতে, স্যাবকে একশো মাইল স্পীডে হাঁকাবে, তবে তার বেশি নয়। তুরুপের তাসটা হাতে রাখা দরকার। ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে ফার্স্ট গিয়ার দিল ও, হ্যান্ডব্রেক রিলিজ করল, ছেড়ে দিল গাড়ি। স্পীড বাড়াল, গিয়ার বদলাচ্ছে। স্পীডমিটারের কাঁটা পঞ্চাশের ঘর ছুঁলো, ফোর্থ গিয়ার দিল রানা। রেভ কাউন্টারের কাঁটা স্পর্শ করল তিন হাজারের ঘর। এতক্ষণে টার্বোর সাহায্য নিল রানা, বোতাম স্পর্শ করা মাত্র স্পীড পৌঁছে গেল সত্তরে।
প্রথম দফায় রানা সরাসরি ফিফথ্ গিয়ার দিল না। এঞ্জিনটাকে সামলে রাখল, অল্প স্পীড তুলে ট্র্যাকের উত্থান-পতন, ঢাল ইত্যাদি অনুভব করল।
গ্রিড থেকে শিকেইন পর্যন্ত আড়াই মাইল সুন্দর সোজা-সরল ট্র্যাক, কিন্তু শিকেইনে পৌঁছুবার পর গাড়ি এবং ড্রাইভারের টনক নড়ে। দূর থেকে দেখে মনে হবে ট্র্যাক শুধুমাত্র সরু হয়ে গেছে, তারপর নিখুঁত আকৃতি নিয়ে ইংরেজী এস অক্ষরের মত বাঁক নিতে শুরু করেছে। এস-এর শেষ বাঁক নেয়ার পর রানা উপলব্ধি করল শিকেইন-এর শেষ মাথায় রয়েছে অকস্মাৎ, অপ্রত্যাশিত স্ফীতি, ঠিক যেন উটের পিঠে কুঁজ।
বাঁকগুলো কোন সমস্যা সৃষ্টি করল না, ঘণ্টায় ষাট মাইল গাড়ি ছোটাবার সময় শুধু হুইল ঘোরাতে হলো দ্রুত-বাম, ডান, বাম, ডান। বাঁকা স্পয়লার আর স্পয়লারের ওজন স্যাবকে ট্র্যাকের সাথে আঠার মত আটকে রাখল। বিপদ টের পেল রানা ফোলা কুঁজের সাথে ধাক্কা খাবার সময়
ষাট মাইল স্পীড, এক সেকেন্ডের জন্যে শূন্যে উঠে গেল গাড়ি। চাকা যদি রাস্তার সংস্পর্শ ত্যাগ করে, গাড়ির নিয়ন্ত্রণ ড্রাইভারের হাতে থাকে কি? তুমুলবেগে চারটে চাকাই ঘুরছে, ঘুরন্ত অবস্থায় রাস্তা স্পর্শ করবে, লাইন-চ্যুতি ঠেকাতে হলে গভীর মনোযোগ এবং দক্ষতা দুটোই দরকার, সেই সাথে বেশ খানিকটা ভাগ্যের সহায়তা। ধাতব-মসৃণ সারফেসের সাথে ঘর্ষণে তীক্ষ্ণ কর্কশ আওয়াজ উঠল
নিঃশ্বাস ফেলল রানা, সমস্ত বাতাস বের করে দিল, ফুসফুস থেকে, বুঝতে পারছে সত্যিকার স্পীড তুললে কুঁজটা কি ভয়ঙ্কর বিপদ হয়ে দাঁড়াবে। বাঁক নেয়া শেষ করে সামনের আরও এক মাইল সোজা ট্র্যাক পেরিয়ে এল ও। সামনে এবার ডান-হাতি বাঁক, বিপজ্জনক বটে কিন্তু অপ্রত্যাশিত নয়।
গতিসীমা সত্তরেই রাখল রানা, গিয়ার বদলের কাজটা বাকি থাকল একেবারে শেষ মুহূর্তের জন্যে। বাঁকটা ঘুরতে শুরু করার পূর্ব-মুহূর্তে থার্ড গিয়ার দিল ও, তবে পাওয়ার সাপ্লাই ঠিক রাখল যাতে সামনের দিকে পিছলে যাবার প্রবণতা দেখা না দেয়। এবারও জাদু দেখাল স্যাব। প্রিয় গাড়ি নিয়ে তুমুল বেগে বাঁক ঘুরতে ভালবাসে রানা, এ-সময়টায় ওর যেন মনে হয় অদৃশ্য একটা হাত রাস্তার সাথে চেপে রেখেছে গাড়িটাকে।
বাঁক ঘোরার পর দেখা গেল স্পীডমিটারের কাঁটা এখনও ষাটের ঘরে। সামনে আবার আধ মাইল সোজা ট্র্যাক, আরও স্পীড তোলা যাবে। ঝোঁকটা দমন করে সত্তরেই থাকল রানা, ফোর্থ গিয়ার দিল, আরেক অভিশাপতুল্য ইংরেজী অক্ষর জেড আকৃতির বাঁক ঘুরল সেকেন্ড গিয়ারে, ফলে স্পীড কমে গিয়ে দাঁড়াল পঞ্চাশে।
জেডটা আসলেও জঘন্য। উচিত ছিল, নিজেকে তিরস্কার করল রানা, আরও সময় নিয়ে প্র্যাকটিস করা। সে অধিকার তার পাওনাও বটে। এই বাঁকটা নেং র সময় আক্ষরিক অর্থেই চাকাগুলোকে হিচড়ে ঘোরাতে হলো, অথচ এমনকি এই স্পীডেও স্যারকে আবার ফোর্থ গিয়ারে তোলা সম্ভব নয়।
বাকিটা সহজ তিন মাইলের মত সোজা ট্র্যাক, ডান দিকে সহজ বাঁক, দেড় মাইল সরল নিস্তুতি, এরপর দ্বিতীয় ডান-হাতি বাঁক, শেষ মাইলের মাথায় গ্রিড।
শেষ বাঁটা, সহজেই আবিষ্কার করল রানা, খানিকটা ধোঁকায় ফেলে দেবে। আগে থেকে বোঝা যায় না, ঘুরতে শুরু করার পর হঠাৎ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। তবে যত তীক্ষ্ণই হোক, সামলাতে না পারার মত কিছু নয়। প্রথম দৌড়ে, কোণটা তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছে দেখে থার্ড গিয়ার দিল ও, এঞ্জিনের শক্তি বাড়াল, সোজা হতে শুরু করায় লম্বা ফিতের মত উদ্ভাসিত হয়ে উঠল ট্র্যাক, স্পীড আবার বাড়তে শুরু করেছে স্যাবের। স্ট্যান্ডকে পাশ কাটিয়ে এল রানা, সামনে শিকেইনের আগে সমতল আড়াই মাইল।
স্ট্যান্ড থেকে এক মাইল এসে ফিফথ্ গিয়ার দিল রানা, দ্বিতীয় দফা দৌড়ের জন্যে স্পীড তুলতে শুরু করল। স্পীডমিটারের কাঁটা একশোর ঘর ছুঁলো, স্যাঁৎ করে পিছিয়ে গেল গ্র্যান্ডস্ট্যান্ড। শিকেইন আধমাইল দূরে, স্পীড একশোই রাখল ও।
সহজ বাঁকগুলো নব্বুইতে পেরোল, কুঁজটার জন্যে কমিয়ে আনল সত্তরে, সত্তরেই চড়ল কুঁজের ওপর কারণ এবার ওটার জন্যে তৈরি হয়ে আছে। কুঁজের ওপর থেকে লাফ দিল স্যাব, নিক্ষিপ্ত তীরের মত সোজা, রানা অপেক্ষা করছে চারটে চাকাই ট্র্যাক স্পর্শ করবে। একযোগে, একসাথে নামল ওগুলো; সম্ভাব্য লাইন-চ্যুতি এড়াবার জন্যে হালকাভাবে হুইল ঘোরাল ও।
ধীরে ধীরে বাড়িয়ে আবার একশোয় তোলা হলো স্পীড, নিজের ডান দিকে সরে বসল রানা যাতে বাঁক নেয়ার সময় প্রচুর জায়গা পাওয়া যায়। পারব নাহয় বাতিল হয়ে যাব, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। অভিশাপের সামনে চলে এল স্যাব, আশি মাইল তীক্ষ্ণ ডান-হাতি বাঁক ঘুরে একই স্পীডে থাকল রানা, যতটুকু সম্ভব ডান দিকে কাত করে রেখেছে গাড়িটাকে-নিয়ন্ত্রিত থাকার জন্যে নির্ভর করছে ওজন, ভর, টায়ার আর স্পয়লারের ওপর।
মাথার ওপর ডিসপ্লে স্ক্রীনের সংখ্যা আর কাঁটা এক চুল নামল না, গোটা বাঁক ঘোরার প্রতিটি মুহূর্তে আশির ঘরে থাকল। যদিও, যেন খেসারত দেয়ার ভঙ্গিতে, রানার শরীর ডান দিকে কাত হয়ে থাকল সারাক্ষণ, আর সামান্য একটু বাম দিকে ঘোরার প্রবণতা থাকল চাকাগুলোর।
পারবে রানা। এই ডান-হাতি বাঁকটাকে, আশি মাইলে নয়, সম্ভবত একশো মাইলেও পেরোনো যাবে, শুধু যদি ডান দিকে সঠিকভাবে পজিশন নেয়া যায়।
জেড আকৃতির বাঁকে ব্যাপারটা অত সোজা নয়, নিজেকে সাবধান করে দিল রানা। এখানে তোমাকে গিয়ার বদলাতে হবে, তারপর দ্রুত ব্যবহার করতে হবে অ্যাকসিলারেটর, ব্রেক, অ্যাকসিলারেটর, ব্রেক-বারবার।
শেষ দুটো বাঁকের প্রথমটা ঘণ্টায় নব্বুই মাইলে পেরোল স্যাব, কোন সমস্যা হলো না; দ্বিতীয় বাঁকের তীক্ষ্ণ কোণে গিয়ার নামাল রানা। শেষ সোজা রাস্তাতেও নব্বুই মাইল গতিতে ঢুকল স্যাব, পিট আর স্ট্যান্ড নিজের দিকে ছুটে আসছে দেখে স্পীড কমাতে শুরু করল রানা-চল্লিশ, ত্রিশ, বিশ…ধীরে ধীরে থেমে গেল।
উইন্ডস্ক্রীনের ভেতর দিয়ে ঝানের মুখ দেখতে পেল রানা, দু’চোখের মাঝখানে ছোট্ট একটা ভাঁজ। ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে পিয়েরে ল্যাচাসি, পরনে পুরোদস্তুর রেসিং ওভারঅল, ঝান র্যাঞ্চের প্রতীক চিহ্ন আঁটা। রানাকে সে গ্রাহ্য করল না, যেন দেখতেই পায়নি। রূপালি শেলবি-আমেরিকান নিয়ে হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠল সচল কঙ্কাল, যদিও তার ক্রুরা ব্যস্তভাবে যত্ন নিচ্ছে গাড়িটার।
কয়েক মুহূর্ত স্যাবে বসে থাকল রানা, শেলবি-আমেরিকানের ওপর চোখ, স্মরণ করার চেষ্টা করছে গাড়িটা সম্পর্কে কতটুকু কি জানে।
ফোর্ড মাস্টাঙ নিজের যুগে অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছে, উনিশশো চৌষট্টি সালে ট্যুর দ্য ফ্রান্স প্রতিযোগিতায় প্রথম এবং দ্বিতীয় হয়েছিল, মাস্টাঙের অন্যান্য সংস্করণগুলোও চমৎকার নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রাখে। মাস্টাঙেরই নতুন আধুনিক সংস্করণ শেলবি-আমেরিকান, ডিজাইনের নামকরণ করা হয় জি-টি-থ্রী-হানড্রেড- ফিফটি। যতদূর মনে পড়ে রানার, আদি পিতা মাস্টাঙের চেয়ে নতুন গাড়িটা হালকা হলেও গতিসীমা একশো ত্রিশের ঘরকে ছাড়িয়ে যাবে।
গাড়িটাকে কাছ থেকে দেখার সময় একটা সন্দেহ জাগল রানার মনে, এটা বোধহয় অরিজিনাল নয়। বডিওঅর্ক অত্যন্ত নিরেট লাগল, কতটুকু পুরু আন্দাজ করা যায় না। ইস্পাত, ভাবল ও। দেখতে শেলবি-আমেরিকান, কিন্তু মিলটা শুধু মসৃণ বডি লাইনে। টায়ারগুলো যে হেভী-ডিউটি বোঝাই যায়। অন্তত বাহন প্রসঙ্গে একটা কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, উপলব্ধি করল রানা, স্যাবের চেয়ে শেলবি-আমেরিকান অনেক মজবুত আর শক্তিশালী। বনেটের নিচেটা একবার দেখতে পারলে হত। মলিয়ের ঝান যে-ধরনের মানুষ, স্যাব টার্বোর বিরুদ্ধে এমন একটা গাড়ি কি ব্যবহার করবে যেটাকে বাইরে থেকে দেখে যা মনে হয় ভেতরেও ঠিক তাই? শেলবি-আমেরিকানের খোলস ওটা, ভেতরে অন্য জিনিস, এবং অবশ্যই টার্বো-চার্জড়।
স্যাব থেকে নেমে এগোল রানা। শেলবি-আমেরিকানের কাছ থেকে এক গজ দূরে থাকতে পিয়েরে ল্যাচাসির নাম ধরে ডাকল।
অপ্রত্যাশিত ক্ষিপ্রতার সাথে গাড়ি আর রানার মাঝখানে চলে আসার চেষ্টা করল ঝান। শেষ পর্যন্ত বাধা দিতে পারলেও, তার আগেই হাত দিয়ে গাড়ির বনেট ছুঁয়ে ফেলল রানা। আর কোন সন্দেহ নেই, ইস্পাতই। অন্তত তালুর স্পর্শ সে-কথাই বলে। দ্রুত একবার মাত্র নিচের দিকে চাপ দেয়ার সুযোগ হওয়ায় আরও জানা গেল, সাসপেনশনটাও অত্যন্ত শক্ত।
‘গুড লাক, ল্যাচাসি…,’ শুরু করল রানা, তখুনি শেলবি-আমেরিকান আর রানার মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়াল ঝান।
আমি শুধু ল্যাচাসিকে গুড লাক জানাতে চেয়েছিলাম,’ চেহারায় রাগ এবং বিস্ময় নিয়ে বলল ও. যেন আহত হয়েছে, ঝানের বিশাল হাত তখনও ওর বাহু আঁকড়ে ধরে আছে. আক্ষরিক অর্থেই টেনে সরিয়ে নিচ্ছে ওকে।
‘রেসের আগে কেউ কথা বললে ল্যাচাসি খুব বিরক্ত হয়, মি. রানা,’ ঘেউ ঘেউ করে উঠল ঝান। ‘গত যুগের প্রফেশনালদের মত…
‘অথচ এটা একটা ফ্রেন্ডলি রেস, ঝান-গুরুত্বপূর্ণ সাইড বেটটা ওর সাথে নয়, আমার সাথে আপনার, শুনে মনে হলো শান্ত হয়ে গেছে রানা, যদিও এরইমধ্যে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে।
দেখে যা মনে হয় তারচেয়ে অনেক বেশি নৈপুণ্য দেখাবে ঝানের শেলবি- আমেরিকান, কিন্তু স্যাবের ওয়াটার ইঞ্জেকশন বা ইনক্রিজড্ বুস্ট-এর কথা জানা নেই তার। অবশ্য ল্যাচাসি সম্পর্কে রানার কোন ভুল ধারণা নেই। প্রতিপক্ষ প্রকৃত অর্থেই রেস কাকে বলে জানে, তাছাড়া ট্র্যাক সম্পর্কেও অভিজ্ঞ সে।
‘ঠিক আছে, ঝান। আপনি আপনার প্রফেশনালকে জানিয়ে দিন যে আমি আশা করছি সেরা প্রতিদ্বন্দ্বীই জিতবে। ব্যস, এইটুকুই। এবার, তেল ভরতে পারি তো?’
রানার দিকে তাকাল কিন্তু ঝানের চোখে ভাষা নেই, শূন্য দৃষ্টি। তাকাবার এই ভঙ্গির মধ্যে অশুভ কি যেন একটা আছে-মড়ার খোলা চোখ, ভাবলেশহীন, ফোলা ফোলা ভাব নিয়ে ঝুলে পড়েছে মুখ-চেহারা থেকে কোটিপতি ভাঁড়ের সমস্ত লক্ষণ উধাও। তলপেটে অকস্মাৎ শীতল অনুভূতির সাথে চিনতে পারল রানা দৃষ্টিটা!
এই অভিব্যক্তি অতীতে বহুবার লক্ষ করেছে রানা, শুধু পেশাদার খুনির চেহারাতেই ফোটে, কাজ সারার ঠিক আগের মুহূর্তে
অশুভ ভাবের এই প্রকাশ চেহারায় ফুটে উঠেই এক নিমেষে মিলিয়ে গেল, হাসল ঝান, উদ্ভাসিত হয়ে উঠল গোটা মুখ। ‘আমার ছেলেরা আপনার হয়ে সব কাজ করে দেবে, মি. রানা।’
‘না, ধন্যবাদ। গ্যাস, অয়েল, হাইড্রলিক, কূল্যান্ট-সব আমি নিজের হাতে ভরতে চাই।
শেষবার সব দেখে নিতে বিশ মিনিটের মত লাগল। কাজ শেষ করে দলটার দিকে এগোল রানা, অমায়িক হাসির সাথে বাননা বেলাডোনা আর রিটাকে চুটকি শোনাচ্ছে ঝান।
‘আমি তৈরি,’ ঘোষণা করল রানা, তিনজোড়া চোখকেই নিজের দিকে ফেরাল।
ওদের হাসির শব্দ থামল, কয়েক সেকেন্ড কথা বলল না কেউ। তিনজনকেই লক্ষ করছে রানা। তারপর মাথা ঝাঁকাল ঝান, বলল, ‘গুড, ভেরি গুড। এখন তাহলে, মি. রানা, যদি ইচ্ছে করেন, গ্রিড পজিশনের জন্যে ড্র করতে পারেন…’
‘ধুত,’ হাসল রানা। ‘ফ্রেন্ডলিই থাক না। গ্রিড পজিশনের জন্যে এখানে আমরা টস্ করতে পারি। আশা করি ল্যাচাসিও মানবে, কি…’
‘মি. রানা, নরম, অস্ফুট স্বরে বলল ঝান। তার বলার ভঙ্গি আর সুরে কি হুমকির রেশ? নাকি উত্তেজিত হয়ে আছে রানা, প্রতিপক্ষের শব্দের ভেতর দৈত্য- দানো কল্পনা করছে? ‘মি. রানা। ল্যাচাসির ব্যাপারটা আপনাকে বুঝতে হবে। ল্যাচাসি এটাকে অত্যন্ত সিরিয়াসলি নিয়েছে। দাঁড়ান, দেখি সে তৈরি কিনা।’
মেয়েদের সাথে একা হয়েও গল্প জমাবার কোন চেষ্টা করল না রানা। ‘এখুনি আমি ফেয়ারওয়েল বলছি, লেডিজ,’ বিজয়ীর হাসিতে প্রসারিত হলো ঠোঁট জোড়া। ‘রেসের পর দেখা হবে।
‘ফর গডস সেক, রানা, সাবধান হও।’ কয়েক সেকেন্ড রানার সাথে হাঁটল রিটা, নিচু গলায় কথা বলছে। ‘তোমাকে ওরা ছাড়বে না। ভুলেও কোন ঝুঁকি নিয়ো না। এটা ঝুঁকি নেয়ার মত কোন ব্যাপার নয়। প্লীজ।’
‘চিন্তা কোরো না।’ সহাস্যে হাত নাড়ল রানা, ঘাড় ফিরিয়ে দেখল ল্যাচাসিকে সাথে নিয়ে এগিয়ে আসছে ঝান।
নিয়ম পালনে দারুণ আন্তরিকতার পরিচয় দিল ল্যাচাসি। করমর্দন করল ওরা, পরস্পরকে বলল সেরা প্রতিদ্বন্দ্বী যেন জেতে, তারপর গ্রিড পজিশনের জন্যে টস্ করল। টসে হারল রানা। ভেতর দিকের, ডান-হাতি লেনটা নিল ল্যাচাসি।
আনুষ্ঠানিক ভঙ্গিতে বক্তব্য রাখল ঝান, পরিবেশে গাম্ভীর্য এবং পবিত্র ভাব আনার চেষ্টা। ‘দশবার সার্কিট চক্কর দেয়ার রেস এটা। আপনাদের ল্যাপ নাম্বার দেখতে পাবেন পিটকে পাশ কাটাবার সময়। ল্যাচাসিরটা লাল; মি. রানা, আপনারটা নীল। আমি চীফ মার্শালের ভূমিকায় থাকছি, আপনারা আমার নির্দেশ মানবেন। গ্রিডে যে যার নিজের পজিশনে চলে যাবেন, তারপর বন্ধ করবেন এঞ্জিন। আমি থাকছি স্টার্টার’স রস্ট্রামে-ওদিকে-ওখান থেকে ফ্ল্যাগ তুলব। বুড়ো আঙুল খাড়া করে আপনারা ইঙ্গিত করবেন যে আমাকে দেখতে পেতে কোন অসুবিধে হচ্ছে না। তখন আমি বৃত্তাকারে ফ্ল্যাগটা ঘোরাব মাথার ওপর, সেই সাথে আপনারাও এঞ্জিন স্টার্ট দেবেন। এরপর আবার আমি ফ্ল্যাগ তুলব, দশ থেকে শুরু করে শূন্য পর্যন্ত গুনবো, তারপর নামাব ফ্ল্যাগ। তখন আপনারা গাড়ি ছাড়তে পারেন। বিজয়ী ব্যক্তি তার গাড়ি নিয়ে রস্ট্রামকে পাশ কাটাবার আগে ফ্ল্যাগ আর নামবে না, দশ ল্যাপ পুরো হবার পর। সব পরিষ্কার?’
ধীরে ধীরে চালিয়ে গ্রিডে নিজের জায়গায় গাড়ি নিয়ে এল রানা। কৌশল, চাতুর্য ইত্যাদি নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কমই পাওয়া গেছে, একেবারে শেষ মুহূর্তে তাই ঝড় বয়ে যাচ্ছে মাথার ভেতর। প্রতিদ্বন্দ্বী এবং তার বাহন সম্পর্কে সত্যিকার কোন ধারণা নেই ওর কাজেই প্রথম কাজ হবে ল্যাচাসি আর শেলবি- আমেরিকান কতটুকু কি করতে পারে তার হিসেব রাখা।
রানা আশা করল, স্যাব সম্পর্কে ওদের একটা ভুল ধারণা আছে। প্র্যাকটিস রান-এর সময় স্যাবকে দেখে ওরা ধরে নিয়েছে ওই পর্যন্তই ওটার দৌড়-ঘণ্টায় একশো মাইল। কৌশল যদি কাজে লাগাতে হয়, এখনই ঠিক হওয়া দরকার কি হবে সেটা। তা না হলে কোন সুযোগই পাওয়া যাবে না।
রেখার ওপর স্যাবকে দাঁড় করাবার সময় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল রানা। অন্তত প্ৰথম পাঁচটা ল্যাপ ল্যাচাসিকে সামনে থাকতে দেবে ও। তাতে করে বিভিন্ন গতিতে পুরো সার্কিটটা চক্কর দেয়ার মূল্যবান অভিজ্ঞতা হবে ওর, সেই সাথে ওর একটা সন্দেহেরও নিরসন ঘটবে-ওভারটেক করার চেষ্টা হলে তা ঠেকাবার জন্যে ল্যাচাসি সত্যিকার বিপজ্জনক পদক্ষেপ নেয় কিনা
রানা যদি ল্যাচাসির নৈপুণ্যের সাথে পাল্লা দিতে পারে, আর স্যাব যদি শেলবি-আমেরিকানের পিছনে লেগে থাকার মত যথেষ্ট শক্তিশালী হয়, তাহলে ছয় নম্বর ল্যাপের শুরু থেকে আগে বাড়ার চেষ্টা করবে ও। তারপর, সামনে একবার পৌঁছুতে পারলে, রিজার্ভ পাওয়ার কাজে লাগিয়ে বাজি জিতে নেবে। রিজার্ভ পাওয়ার সবটুকু ব্যবহার না করারই চেষ্টা করবে ও, কারণ সার্কিটের কোথাও কোথাও খুব বেশি স্পীড তোলা মৃত্যুকে ডেকে আনার সমান হবে। তবু রানা আশা করছে সব ঠিকঠাক মত ঘটলে ল্যাচাসিকে অন্তত আধ ল্যাপ পিছনে ফেলতে পারবে ও। অষ্টম ল্যাপ শেষ হবার আগেই দু’জনের মাঝখানে এই ব্যবধান তৈরি করা চাই।
ওর দিকে তাকিয়ে আছে ঝান। বুড়ো আঙুল খাড়া করল রানা, বৃত্ত রচনার ভঙ্গিতে শূন্যে আন্দোলিত হলো ফ্ল্যাগ। সগর্জনে চালু হলো ল্যাচার্সির এঞ্জিন, একটা শেলবি-আমেরিকানের এঞ্জিন থেকে আরও অনেক কম শব্দ বেরুবার কথা।
গম্ভীর আওয়াজ করল স্যাব, এঞ্জিনে অস্থির কোন ভাব নেই। চারদিকে তাকাল রানা, দুই গাড়ির মধ্যবর্তী দূরত্ব দেখে নিয়ে দৃষ্টি দিয়ে বিদ্ধ করল গর্তে ঢোকা ল্যাচাসির চোখ। ল্যাচাসির দৃষ্টি রানার মুখে গেঁথে আছে, চামড়ায় ঘৃণা আর ক্রোধের স্পর্শটুকুও যেন অনুভব করতে পারল রানা।
সামনে তাকাল রানা, সঙ্কেত দিল ঝানকে।
উঠে গেল ফ্ল্যাগ। ফার্স্ট গিয়ার দিল রানা, হ্যান্ড ব্রেক রিলিজ করল, অ্যাকসিলারেটরের ওপর তৈরি ডান পা।
নিচে নামল ফ্ল্যাগ।
আঁকাবাঁকা বিদ্যুৎচমকের মত ছুটল ভুয়া শেলবি-আমেরিকান, পিছনটা অনবরত ঝাঁকি খেলো। শুরুটাই যার এত দ্রুত, বোঝাই যায় প্রতিপক্ষকে কোন সুযোগই দিতে রাজি নয় সে। স্পীড বাড়াতে শুরু করে রানা ভাবল, ঝানের ড্রাইভার সম্ভাব্য কম সময়ের মধ্যে দু’জনের মাঝখানে বিস্তর ব্যবধান আনতে চায়। অ্যাকসিলারেটরে চাপ দিয়ে তাড়াতাড়ি টার্বো চার্জারের বোতামে টিপ দিল ও, একটা চোখ স্পীডমিটারের ওপর।
শিকেইন পর্যন্ত বিস্তৃত সোজা ট্র্যাকে স্পীড সম্ভবত একশোয় তুলল ল্যাচাসি। জেট এঞ্জিনের মত গুঞ্জন তুলছে টার্বো, ফিফথ গিয়ার দিয়ে গতিসীমা একশো বিশ ছাড়িয়ে গেল রানা, শেলবি-আমেরিকানের পিছনে চলে এল স্যাব। মাত্র কয়েক ফুট দূরত্ব লক্ষ করে অ্যাকসিলারেটরে চাপ কমিয়ে গিয়ার নামাল রানা, একশোয় ফিরে এল, সরাসরি ল্যাচাসির পিছনে থাকছে। শিকেইন কাছে চলে আসতে ব্ৰেক লাইট জ্বলে উঠতে দেখল ও, এস-আকৃতিতে ঢোকার মুহূর্তে গাড়ির লাগাম টানল, কুঁজ থেকে ল্যাচাসি যখন শূন্যে উঠছে স্যাবের গতি তখন সত্তরের কাছাকাছি।
সত্তর ছুঁই ছুঁই করছে স্পীডমিটারের কাঁটা, কুঁজ স্পর্শ করল স্যাবের চাকা। হুইলের ওপর শিথিল করল রানা হাত দুটো, যতক্ষণ না ঝাঁকির সাথে নিরেট ট্র্যাকে ফিরে এল চাকা ততক্ষণ ঢিল করেই রাখল, তারপর গিয়ার বদলে চাপ দিল অ্যাকসিলারেটরে।
মনে হলো ঘণ্টায় একশো মাইল ল্যাচাসির নিরাপদ গতিসীমা। গতি না বাড়িয়ে তার পিছনে লেগে থাকল রানা, ডান-হাতি বাঁকটা ঘুরল। স্যাবকে শেলবি আমেরিকানের পিছনে খানিকটা ডান ঘেঁষে রাখল রানা, তারপর পুরোপুরি ডান দিকে সরিয়ে আনল-ট্র্যাক কামড়ে থাকতে অস্বীকার না করলেও প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠল পিছনের চাকাগুলো। এরকম আট-দশ বার হলে পুড়তে শুরু করবে রাবার, ভাবল ও। জ্ঞান চক্ষুও খুলল, জেড-আকৃতির বাঁকেও পৌছে গেল ওরা।
এখানে নিজস্ব কৌশল দেখাল ল্যাচাসি। প্রতিটি মোড়ে একাধিক ছোট ছোট বাঁক রয়েছে, এবং একজোড়া মোড়ের মধ্যবর্তী বিস্তৃতিটুকুও ঘন ঘন এঁকেবেঁকে এগিয়েছে। অনবরত ব্রেক ব্যবহার করল সে, কিন্তু স্পীড বাড়িয়ে চলেছে, এমনকি বাঁকগুলো ঘোরার সময়ও।
জেড পিছনে পড়ল, সামনে পরবর্তী সরল বিস্তৃতি। রানার ধারণা হলো জেডটা ওরা নির্ঘাত কম করেও সত্তরে পেরিয়েছে, কাঁটা আশির দিকে উঠছিল। ল্যাচাসি শুধু যে আত্মবিশ্বাসী টেকনিকাল এক্সপার্ট তাই নয়, তার নার্ভও ইস্পাতের মত শক্ত। অথচ জেড পেরিয়ে আসার পর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তার স্পীড একশোর ওপর উঠল না।
শেষ বাক দুটোর প্রথমটায় পৌছুবার আগে রানা আন্দাজ করল ঘণ্টায় প্রায় একশো মাইল গতিতে গাড়ি হাঁকালেও ল্যাচাসি চল্লিশ, সম্ভবত পঞ্চাশ মাইল হাতে রাখছে।
টেকনিকটা ভাল। সার্কিটের যে প্রকৃতি, এখানে খুব বেশি স্পীড তুলতে হলে ঝুঁকি নিতে হবে, অমানুষিক পরিশ্রম করতে হবে, সেই সাথে দরকার হবে গভীর মনোযোগ। ল্যাচাসি ঠিক করে রেখেছে তিন কি চার ল্যাপ বাকি থাকতে একশোর ঘর ছাড়াবে, স্বাভাবিকভাবেই মনে করছে ততক্ষণে ক্লান্ত হয়ে পড়বে রানা, ইতিমধ্যে স্যাবের ম্যাক্সিমাম স্পীডও জানা হয়ে যাবে তার।
স্যাঁৎ করে স্ট্যান্ডকে পাশ কাটাল ওরা। স্পীডমিটারের কাঁটার দিকে চট করে একবার তাকাল রানা, গতিসীমা একশোর সামান্য বেশি। ল্যাচাসি খানিকটা এগিয়ে গেছে।
সম্ভবত কৌশল পরিবর্তনের সময় হয়েছে, প্রতিযোগিতার শেষ দিকের জন্যে অপেক্ষা না করাই ভাল। এবারেরটায় ল্যাচাসির পিছনে থাকা যাক, তারপর পাশ কাটাবার চেষ্টা করতে হবে।
দ্বিতীয় ল্যাপ শুরু হলো। স্ট্যান্ডকে পাশ কাটিয়ে এল ওরা। দরদর করে ঘামছে রানা, কঠিন পরিশ্রম করছে, ব্রেক ব্যবহার করতে এখনও অনিচ্ছুক, গতি নিয়ন্ত্রণে রাখছে গিয়ার আর অ্যাকসিলারেটরের সাহায্যে।
শিকেইনের দিকে ছুটছে গাড়ি, রানা ভাবল এটাই আদর্শ জায়গা। এরপরের বার অর্থাৎ তৃতীয় ল্যাপ শেষ করে পাশ কাটাবে।
তৃতীয় চক্কর শেষ করার পর দেখা গেল শেলবি-আমেরিকানের ছয় ফুট পিছনে রয়েছে স্যাব। এখনই, ভাবল রানা। সামান্য বাঁ দিকে সরে গেল ল্যাচাসি। মোটেও যথেষ্ট প্রশস্ত নয় ফাকটুকু, তবে সে যদি নিয়ম মানে, ফাঁক গলে রানাকে বেরিয়ে যেতে দিতে হবে তার।
সামান্য চাপ পড়ল হুইলে, এক পলকে ডান দিকে সরে এল স্যাব, সেই সাথে বিপজ্জনকভাবে কাছে চলে এল শেলবি-আমেরিকান। আরও ডান দিকে সরে এসে বানা দেখল ট্র্যাকের কিনারা ওর সামনের ভেতর দিকের চাকার খুব কাছে, তবু ইতস্তত করল না, গিয়ার তুলে আনল ফিফথে, তারপর অ্যাকসিলারেটরে পা চাপল। সাড়া দিল টার্বো, জেট এঞ্জিনের মত ধাক্কা অনুভব করল রানা। নাক বাড়িয়ে দিয়েছে স্যাব, শেলবি-আমেরিকানের অর্ধেকটা পেরিয়ে এসেছে, সন্দেহ নেই ওভারটেক করার জন্যেই এগোচ্ছে।
তারপর রানা যেন দুঃস্বপ্ন দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। গাড়ির নাক ঘুরিয়ে স্যাবের সামনে বাধা তৈরি করল ল্যাচাসি, ওভারটেক করতে দেবে না। সংঘর্ষের ভয়ে ব্রেক চাপল রানা। এক পলকের মধ্যে পিছনে চলে এল স্যাব, পিছিয়ে পড়ছে। বাসটার্ড! দাঁতে দাঁত চাপল রানা। গিয়ার বদলাল ও, শিকেইন পেরোবার জন্যে স্পীড কমাল।
শিকেইন পেরিয়ে এসে আবার অ্যাকসিলারেটরে চাপ দিল রানা, মধ্যবর্তী দূরত্ব কমিয়ে এনে ডান-হাতি বাঁকটা ঘুরল, দুটো গাড়ির লেজে আর নাকে প্রায় কোন ব্যবধান নেই বললেই চলে।
বাঁক নেয়ার শেষ মুহূর্তে এবার রানা বাঁ দিকে সেঁটে থাকল। স্পীডমিটারের কাঁটা একশো পাঁচের ঘরে দেখে মোটেও বিস্মিত হলো না। জেড-এর কাছে চলে এসে স্পীড দাঁড়াল একশো পঁচিশ।
দরকার হলে শালাকে ট্র্যাক থেকে সরিয়ে দেব, ভাবল রানা। কাজটা করার জন্যে যে ওজন দরকার স্যাবের তা আছে।
জেড থেকে বেরিয়ে এল ওরা, ল্যাচাসি এখনও স্পীড বাড়াচ্ছে, আর রানা এক ইঞ্চিও পিছিয়ে পড়তে রাজি নয়, সেই সাথে ওভারটেক করার জন্যে পজিশন পাবার চেষ্টা করছে।
এরপরই ঘটল ব্যাপারটা।
রানা জানে, পরে কিছুই সে প্রমাণ করতে পারবে না। জোরাল যুক্তি দেখিয়ে ওভারহিটেড টার্বোকে দায়ী করা হবে, কিংবা অন্য কোন অজুহাত তৈরি করা হবে। তবে ঘটনাটা ঘটার সময় প্রতিটি দৃশ্য পরিষ্কার দেখতে পেল ও।
হঠাৎ করে সামান্য এগিয়ে গেল শৈলবি-আমেরিকান, তিন কি চার ফুটের মত। রানাও স্যাবের অ্যাকসিলারেটরে চাপ দিল, ঠিক সেই মুহূর্তে ছোট্ট জিনিসটাকে ল্যাচাসির পিছনে বাম্পার থেকে পড়তে দেখল ও। এক সেকেন্ডের ও কম সময়ের জন্যে ওর মনে হলো, ল্যাচাসি বোধহয় বিপদে পড়েছে, তীব্রগতির ধকল সহ্য করতে না পেরে তার গাড়ির পিছনের কোন অংশ ভেঙে পড়ছে। কিন্তু স্যারের নিচে হুস করে একটা আওয়াজ উঠল, ফাঁস হয়ে গেল আসল সত্য।
এমন একটা কিছু ফেলেছে ল্যাচাসি, ট্র্যাকে পড়ার সাথে সাথে যেটা থেকে আগুন বিস্ফোরিত হয়।
রানা শুধু দেখল আগুনের একটা পর্দা চারদিক থেকে গ্রাস করছে স্যাবকে, কমলা রঙের পর্দার ভেতর আটকা পড়ে যাচ্ছে ও। মাত্র কয়েক মুহূর্ত, তারপরই লকলকে শিখাগুলো আকারে ছোট হতে শুরু করল, দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
শেষ দুটো বাঁকের একটায় রয়েছে ওরা, রানা ধারণা করল বিপদ বোধহয় কেটে গেছে। আগুন মাত্র এক সেকেন্ডের জন্যে ঘিরে রেখেছিল স্যাবকে, সম্ভবত প্রচণ্ড গতিবেগের সাহায্যেই সেটাকে নিভিয়ে দিতে পেরেছে ও। পরমুহূর্তে ফায়ার অ্যালার্ম বেজে ওঠার সাথে ছ্যাৎ করে উঠল বুকটা। ড্যাশবোর্ডের লাল আলো ঘন ঘন জ্বলছে আর নিভছে।
স্যাবে ফায়ার ডিটেকশন ও ফায়ার এক্সটিংগুইশার সিস্টেম নতুন লাগিয়েছে রানা, সাথে টেমপারেচার ডিটেকটর-এঞ্জিন আর গাড়ির নিচের অংশ মনিটর করে। সিস্টেমটার প্রধান অংশ রয়েছে স্যাবের বড়সড় বুটের ভেতর। ক্রোম আর স্টীল দিয়ে তৈরি একটা কনটেইনারে রয়েছে সেরা এক্সটিংগুইশ্যান্টগুলোর একটা-হ্যালোন বারোশো এগারো। কনটেইনার থেকে স্প্রে পাইপ বেরিয়ে চলে গেছে এঞ্জিন কমপার্টমেন্টে আর গাড়ির চারদিকে, বিশেষ করে নিচের অংশে।
ডিটেকটর আগুন লাগার সঙ্কেত দিলে এক্সটিংগুইশার নিজে থেকেই স্প্রে শুরু করে, যদিও গোটা সিস্টেমটা ড্যাশবোর্ডের একটা বোতাম টিপে হাত দিয়েও চালু করা যায়। এক্ষেত্রে অবশ্য গাড়িটাকে গ্রাস করেছিল আগুন, নিচের দিকটায় ছড়িয়ে পড়ে, সেই সাথে রানার সাহায্য ছাড়াই চালু হয়ে যায় সিস্টেমটা।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দশ কিলোগ্রাম হ্যালোন বারোশো এগোরো মুড়ে ফেলে স্যাবকে, ঢেকে ফেলে এঞ্জিন কমপার্টমেন্ট, সাথে সাথে নিভে যায় আগুন। হ্যালোন এঞ্জিন, ইলেকট্রিক অয়্যারিং বা মানুষের কোন ক্ষতি করে না, লোহাতে মরচেও ধরায় না। কাজ শেষ করে পদার্থটি দ্রুত মিলিয়ে যায় বাতাসের সাথে।
কি ঘটছে পরিষ্কার জানা আছে রানার; গিয়ার বদলাল, ব্রেক করল, এবং শেষ বাঁক দুটো পেরোল ঘণ্টায় পঁয়ষট্টি মাইল স্পীডে। দীর্ঘ বিস্তৃতিতে আসার পর-স্ট্যান্ডকে পাশ কাটিয়ে-খেয়াল হলো পঞ্চম ল্যাপে প্রবেশ করছে সে, স্পীড আবার বাড়াতে শুরু করলেও ঠিকভাবে সাড়া দিচ্ছে এঞ্জিন। তারমানে আগুন কোন ক্ষতি করতে পারেনি। স্বস্তিবোধ করল রানা।
যদিও অনেকটা সামনে এগিয়ে গেছে ল্যাচাসি, প্রায় দু’মাইলের মত, এইমাত্র শিকেইনে ঢুকছে সে। মাথার গভীরে ক্রোধ টগবগ করে ফুটলেও, নিজেকে শান্ত থাকার পরামর্শ দিল রানা। ট্র্যাকের ওপর ওকে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল ল্যাচাসি, ভেবেছিল আগুনে বোমাটা স্যাবের পেট্রল ট্যাংক এবং সম্ভবত টার্বো চার্জার ফাটিয়ে দেবে।
নড়েচড়ে শক্ত হয়ে বসল রানা, সামনের রাস্তা থেকে মুহূর্তের জন্যেও চোখ তুলল না। দ্রুত গিয়ার বদলে স্পীড বাড়াল, সরল বিস্তৃতি ধরে শিকেইনের দিকে ছুটছে। বাড়তে বাড়তে স্পীডমিটারের কাঁটা একশো ত্রিশের ঘর ছুঁয়ে ফেলল।
গিয়ার নামালেও, এবার শিকেইন পেরোবার গতি সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেল। প্লেনের মত ট্র্যাক ত্যাগ করল স্যাব, শূন্যে উঠে গেল, তারপর চার চাকা দিয়ে পড়ল আবার ট্র্যাকে, নিয়ন্ত্রণ প্রায় থাকলই না। হুইলের সাথে কুস্তি শুরু করল রানা। ট্র্যাকের কিনারা থেকে গাছপালার পর্দাগুলো খিলানের আকৃতি পেল চোখে। প্রতিবাদে সোচ্চার হলো টায়ার, যতক্ষণ না আবার স্যাবকে লাইনে ফিরিয়ে আনতে পারল রানা। অসমসাহসের পরিচয় দিয়েছে ও, কয়েকটা মুহূর্ত মৃত্যুর কিনারায় ছিল, তবু স্পীড বাড়িয়ে গেছে। একটু কমাতে হলো, সামনে জেড।
এরপর থেকে ব্যাপারটা দাঁড়াল শুধু সরল বিস্তৃতিতে স্পীড বাড়ানো, স্যাবের সবটুকু ক্ষমতা ব্যবহার না করে। আগে থাকার সুবিধেটুকু পুরোমাত্রায় ধরে রাখার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ল্যাচাসি, আর রানা ঠিক তার পিছনে পৌছানোর চেষ্টা করছে।
প্রতিপক্ষকে নাগালের মধ্যে পেল স্যাব আরও দুটো ল্যাপ শেষ’ করার পর। গাড়ি দুটো অষ্টম ল্যাপ পেরোল, ঠিক যেন জোড়া লাগা অবস্থায়। পিছনে থেকে সুযোগের সন্ধান করছে রানা, ফাঁক খুঁজছে নাক গলাবার, আর প্রতি মুহূর্তে স্পীড বাড়িয়ে নাগালের বাইরে থাকার ব্যর্থ চেষ্টা করছে ল্যাচাসি।
ঘাবড়ে গেছে হারামজাদা, ধারণা করল রানা। যত বেশি চাপ সৃষ্টি করল ও, তত বেশি ঝুঁকি নিচ্ছে সে। এখনও সে দক্ষতার সাথে ড্রাইভ করছে, রানার প্রতিটি চালের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে, কিন্তু তবু ফাঁস হয়ে গেছে, গতি-ই তার একমাত্র অবলম্বন। শিকেইন, ডান-হাতি আর জেড বাঁকগুলোতেও স্পীডের সেফটি লিমিট মানল না সে।
ল্যাপ নাইন। আর মাত্র একটা বাকি, তারপর শেষ। স্যাঁৎ করে পিছিয়ে গেল স্ট্যান্ড। চোয়াল ব্যথা করছে রানার, নিজের অজান্তেই দাঁতে দাঁত পিষছে। পরিণতি যাই হোক, ল্যাচাসিকে ওভারটেক করার নিশ্চয়ই কোন না কোন উপায় আছে।
দ্রুত বিকশিত হলো আইডিয়াটা। হাজার বারে একবার সফল হবার আশা, এমন একটা ঝুঁকি যার শেষ পরিণতি হতে পারে ধ্বংস। শিকেইন পেরোচ্ছে ওরা, কুঁজ স্পর্শ করার সময় এবার ল্যাচাসি স্পীড কমাল। এতক্ষণে হয়তো ড্রাইভারের নার্ভ ভোঁতা হতে শুরু করেছে। সামনে এবার বিপজ্জনক মৃত্যুফাঁদ, ডান-হাতি বাঁক।
বাঁক নেয়ার জন্যে শেলবি-আমেরিকানকে পজিশনে আনল ল্যাচাসি, ডান দিকে সবটুকু ঘেঁষে রয়েছে সে-ট্র্যাকের কিনারায় গজানো ঘাস ছুঁই ছুঁই করছে তার চাকা-কঠিন বাঁকটা একশো মাইলে পেরোতে যাচ্ছে।
ঘুরতে শুরু করল শেলবি-আমেরিকান, ডান দিকেই সেঁটে থাকল ল্যাচাসি, যতক্ষণ পারা যায় কিনারা ঘেঁষে থাকার ইচ্ছে, অন্তত যতক্ষণ প্রেশার আর স্পীড জোর করে গাড়িটাকে বাঁ দিকে ঠেলে না দেয়। যতটা ঘোরার ক্ষমতা সবটুকু ঘুরল চাকাগুলো; কোণ, গতি আর মোচড়ের চাপে বাইরের দিকে পিছলাতে শুরু করল। ব্রেকের ওপর ক্ষীণ একটু চাপ, পলকের জন্যে মন্থর হলো শেলবি-আমেরিকান।
ঠিক এই মুহূর্তটির জন্যেই অপেক্ষা করছিল রানা-কখন ল্যাচাসি বাঁ দিকে সরে আসতে এবং স্পীড কমাতে বাধ্য হবে। প্রথম এবং শেষ সুযোগ, লুফে নিল রানা।
আমেরিকানের সরাসরি পিছনে না থেকে, অকস্মাৎ লাইন থেকে বেরিয়ে এল স্যাব, স্যাৎ করে সরে এল বাঁ দিকে। চাকার ঘূর্ণন নিয়ন্ত্রণ করল ও, অনুভব করল কঠিন চাপের মুখে যতটুকু চেয়েছিল তারচেয়ে বেশি বাঁ দিকে সরে যাচ্ছে স্যাব, হুইল ঘুরিয়ে সেটা থামাল, জানে এখন যদি হুইলগুলো লক হয়ে যায়, লাটিমের মত পাক খেতে শুরু করবে গাড়ি, ছিটকে বেরিয়ে যাবে ট্র্যাক থেকে।
উড়ে চলেছে স্যার। তারপর, মাত্র এক সেকেন্ডের জন্যে, একটা ফাঁক তৈরি হলো -বাঁকের মধ্যে, ল্যাচাসির বাঁ দিকে ফাঁকা রাস্তা।
এখুনি, যে-কোন মুহূর্তে, ফাঁকা জায়গাটায় পৌঁছে যাবে ল্যাচাসির গাড়ি, ঠিক যেমন ডান-হাতি বাঁক নেয়ার সময় প্রতিবার পৌঁছে গেছে। সময়ের ক্ষুদ্রতম ওই মুহূর্তটিতে রানা অনুভব করল. সিধে হয়ে গেছে স্যাব। অ্যাকসিলারেটরে লাথি মারল রানা, চেপে রাখল পা, টের পেল স্যাবের স্পয়লার গাড়ির পিছনটা রাস্তার দিকে ঠেসে ধরেছে। এতক্ষণে, এই প্রথম, স্যাবের ফুল পাওয়ার কাজে লাগতে যাচ্ছে। চাপ খেয়ে ড্রাইভিং সীটের সাথে সেঁটে গেল রানা।
রানার এখন একটাই প্রার্থনা, আবার যদি গাড়ি বাঁদিকে পিছলে যেতে শুরু করে, বিরতিহীন বাড়তে থাকা টার্বোর সম্মুখগতি যেন তাতে বাধা দেয়, এবং বাঁকের মধ্যে ট্র্যাকের কিনারা স্পর্শ না করেও যেন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে স্যাবকে। বিড়বিড় করছে ও।
তারপর, চোখের পলকে ব্যাপারটা ঘটল। পিছলে যাচ্ছে শেলবি-আমেরিকান, সেটা বাইরের দিকের ফাঁক গলে পাশ কাটাল স্যাব, স্পীডমিটারের কাঁটা একশো চল্লিশের ঠিক নিচে। গাড়ি সিধে করে নিল রানা, আরও শক্তি জোগাল এঞ্জিনে।
পাশ কাটাবার সময়, সন্দেহ নেই, একটুর জন্যে স্যাবের পিছনে নাক ঘষতে পারেনি আমেরিকান। মুহূর্তের জন্যে দ্বিতীয় গাড়ির বড়ি আর উইন্ডস্ক্রীন স্যাবের রিয়্যার-ভিউ মিররে ফুটে উঠল, তারপরই কয়েক ফুট পিছিয়ে পড়ল। জেড বাঁক ঘোরার সময় স্পীড কমাল ওরা, কাছাকাছি থাকতে সমর্থ হলো ল্যাচাসি, যেন স্যাবের পিছনে রশি দিয়ে বাঁধা রয়েছে আমেরিকান। কিন্তু বাঁক ঘোরা শেষ করে টপ গিয়ার দিল রানা, পা চেপে রেখেছে অ্যাকসিলারেটরে।
সামনে অবশেষে ফাঁকা রাস্তা পেয়ে লাফ দিল স্যাব। সরল বিস্তৃতিতে স্পীড তুলল রানা একশো পঞ্চাশ, বাঁক দুটোয় নামিয়ে আনল। তারপর, শেষ ল্যাপে, আবার স্পীড বাড়াতে শুরু করে একশো পঞ্চাশকেও ছাড়িয়ে গেল। শিকেইনের আগে, এক পর্যায়ে, জাদু দেখাল স্পীডমিটারের কাঁটা-ছুঁয়ে দিল একশো পঁচাত্তরের ঘর। পরের সরল বিস্তৃতিতে আরও সামান্য বাড়ল গতি। ইতিমধ্যে তিন কি চার মাইল পিছিয়ে পড়েছে ল্যাচাসি।
শেষ দুটো বাঁকের কাছাকাছি না আসা পর্যন্ত স্পীড কমাল না রানা। দশম ল্যাপ শেষ করার পর অতিরিক্ত আরেকটা ল্যাপ ঘুরে এল ও, এঞ্জিনকে শান্ত আর নিজেকে মানিয়ে নেয়ার জন্যে। ইতিমধ্যে মলিয়ের ঝানের মুখ দেখে নিয়েছে ও, টকটকে লাল আর রাগে ফোলা, ফ্ল্যাগ নামাবার সময়। রানাকে বিজয়ী ঘোষণা করেছে সে।
তবে রানা পিটে ফিরে আসার পর ঝান অভিনন্দন জানাল ওকে। শান্তই দেখাল তাকে, অবশ্য খুব গম্ভীর। গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডে দাঁড়ানো লোকগুলো হাততালি দিচ্ছে, যদিও তাদের নিজেদের লোক হেরে গেছে।
‘ফেয়ার রেস, সন্দেহ নেই, মি. রানা,’ বলল ঝান। ‘আ ফেয়ার অ্যান্ড একসাইটিং রেস। আপনার ওই গাড়ি কিভাবে ছুটতে হয় জানে।’
সারা শরীর থেকে ঝর ঝর ঘাম ঝরছে, সাথে সাথে কিছু বলল না রানা, ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ল্যাচাসির দিকে। হাড়সর্বস্ব মুখ আগের চেয়ে ভীতিকর, ওর পিছনে পাথর হয়ে আছে।
‘কতটুকু ফেয়ার বলতে পারব না, ঝান, অবশেষে মুখ খুলল রানা। ওটা যদি অরিজিন্যাল শেলবি-আমেরিকান হয়, চিবিয়ে এই সুট খেয়ে ফেলব। আর যদি আতসবাজির কথা তোলেন…’
‘হ্যাঁ, কি হয়েছিল ওখানে?’ নিরীহ ভালমানুষের মত সরল চেহারা ঝানের।
আমার ধারণা তাড়াহুড়ো করে সিগারেট ধরাতে গিয়েছিল ল্যাচাসি, দিয়াশলাইটা পড়ে যায়। আমার বোনাসের কথা মনে রাখবেন, ঝান। আ গ্রেট রেস। এবার, আপনি যদি ক্ষমা করেন…
ঘুরল রানা, দৃঢ় পায়ে হেঁটে ফিরে এল স্যাবের কাছে। গাড়িটার যত্ন নেয়া দরকার। ওর পিছু নিয়েছে ঝান।
‘সমস্ত ঋণ আজ রাতেই হিসেব করব, মি. রামা-টাকা, বলতে চাইছি। প্রিন্টগুলো তো আমারই, শুধু আনুষ্ঠানিকতাটুকু বাকি। ও, হ্যাঁ, আরও একটা কথা মনে দুঃখ নিয়ে বলতে হচ্ছে-আতিথেয়তার পর্ব এবার শেষ করতে হয়। আজ রাতে সাড়ে সাতটার ডিনারে সাতটায় হাজির হলেই চলে, তাহলে খেতে বসার আগে ব্যবসায়িক আলোচনাটা সেরে ফেলা যাবে? ঠিক আছে তো?’
‘ফাইন।’
সত্যি দুঃখিত, কিন্তু সকালে আপনাদেরকে বিদায় না জানিয়ে উপায় নেই। জানেনই তো, আমাদের একটা কনফারেন্স হতে যাচ্ছে…প্রথম দলটা আজ রাতে এসে পৌঁছচ্ছে…’
‘আমার ধারণা ছিল কনফারেন্স ইত্যাদি এড়িয়ে চলেন আপনি।’ স্যাবের ভেতর শরীরের অর্ধেকটা গলিয়ে বনেট রিলিজে টান দিল রানা।
ইতস্তত করল ঝান, তারপর হাসল-স্বভাবসুলভ অট্টহাসি নয়, অপ্রতিভ হে হে। ‘হ্যাঁ। হ্যাঁ, তা সত্যি। কনফারেন্স আমার সহ্য হয় না। আসলে লোকজনকেই আজকাল আর তেমন সহ্য করতে পারি না। আমার মনে হয় এটাই আমাকে চূড়ান্তভাবে বুঝতে সাহায্য করে যে রাজনীতি আমার বিষয় নয়। আপনি কি জানেন এক সময় রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ছিল আমার?’
‘না, তবে বিশ্বাস করা যায়,’ মিথ্যে বলল রানা।
‘সাধারণত এখানকার কনফারেন্সগুলো এড়িয়ে চলি আমি।’ যেন শব্দের অভাবে কথাগুলো গুছিয়ে নিতে অসুবিধে হচ্ছে ঝানের। ইউ সি,’ বলে চলেছে, ‘মানে, আজ যে লোকগুলো আসছে তারা সবাই অটোমোটিভ এঞ্জিনিয়ার। এ বিষয়ে ল্যাচাসি একজন এক্সপার্ট।’ মৃদু, ধূর্ত হাসির আধার হয়ে উঠল মুখ। ইতিমধ্যে সেটা আপনি নিজেও আশা করি ধরতে পেরেছেন। বিশ্বাস করবেন, শেলবির ওই নকলটা নিজের হাতে তৈরি করেছে ও?’
‘এক্সট্রাজ্ অ্যান্ড অল?’ রানার ভুরু টলে উঠল
ঝানের কণ্ঠ ফুঁড়ে বেরিয়ে এল অট্টহাসি, গোটা ব্যাপারটা যেন মজাদার কৌতুক। ওই গাড়িটার কারণে দু’জনের একজন ট্র্যাকে মারা যেতে পারতাম আমরা, চিন্তা করল রানা, অথচ ঝানের কাছে ব্যাপারটা হাসির খোরাক।
হাসি থামার পর প্রকাণ্ড ভাল্লুক আকৃতির লোকটা এমনকি নিঃশ্বাস ফেলার জন্যেও থামল না। ‘যা বলছিলাম…লোকগুলো এঞ্জিনিয়ার, এবং… তাদের উদ্দেশে ল্যাচাসি একটা বক্তৃতা দিচ্ছে কাল সকালে-মেকানিকস্-এর ওপর অত্যন্ত অ্যাডভান্সড্ কথাবার্তা, ঠিক কি জিনিস আমার জানা নেই। বলতে পারেন নির্বোধের মত-এবং ওকে খুশি করার জন্যে-কথা দিয়েছি ওখানে আমি উপস্থিত থাকব…কাজেই, বুঝতেই পারছেন, মিসেস লুগানিস বা আপনার খাতির যত্ন করার সময় হবে না আমার।
মাথা ঝাঁকাল রানা। ‘ওকে। সকালে চলে যাব আমরা, ঝান।’ গাড়ির দিকে পিছন ফিরল ও।
‘হেলপ ইওরসেলফ ফ্রম দা বারবিকিউ,’ ফিরে যাবার সময় কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে বলল ঝান।
দশাসই লোকটার গমনপথের দিকে তাকিয়ে থেকে রানা ভাবছে, কে জানে কখন শুরু হবে অ্যাকশন। দুটোর একটা কাজ করতে পারে ঝান। হয় তাদেরকে র্যাঞ্চ থেকে বেরিয়ে যেতে দেবে সে, হামলা করবে বাইরে কোথাও; নয়তো অত ঝামেলার মধ্যে না গিয়ে এখানে তার নিজের ঘাঁটিতেই একজোড়া কবর খুঁড়বে।
যাই ঘটুক, তৈরি থাকতে হবে রানাকে। হাতে অনেক কাজ, তার মধ্যে একটা হলো বান্না বেলাডোনার সাথে কথা বলা। কনফারেন্সে উপস্থিত থাকার জন্যে টানেলেও ঢুকতে হবে ওকে, নিরেট প্রমাণ সংগ্রহ করার ওটাই ওর শেষ আশা। কিন্তু ঝান যদি প্রথম আঘাত হানে, ব্যর্থ হয়ে যাবে মিশন
প্রথম থেকেই নিশ্চিত ছিল রানা, নিখুঁত, দর্শনীয় প্লেন হাইজ্যাকগুলো পুনরুজ্জীবিত হার্মিসের কীর্তি—আরও ভয়ঙ্কর কিছু করার জন্যে টাকা সংগ্রহের চেষ্টা। আমেরিকায় আসার পর থেকে যা দেখেছে বা উপলব্ধি করেছে ও, বিশেষ করে ঝান র্যাঞ্চে, প্রায় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে হার্মিস – পরিচালিত খুব বড় ধরনের একটা অভ্যুত্থান ঘটতে চলেছে। ঝান র্যাঞ্চকে বলা যায় চক্রের মাঝখানটা, এখানে সও মঙের টাইটেলধারীও উপস্থিত।
ঝান যা বলে গেল তারপর আর প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানো একদম উচিত নয়। তৈরি থাকতে হবে, যে-কোন মুহূর্তে গা ঢাকা দেয়ার দরকার হতে পারে। রিটাকে বাঘের মুখে রেখেই হয়তো আড়াল নিতে হবে।
‘ঝান না ল্যাচাসি? কে ওদের মধ্যে নতুন সও মং? দু’জনের মধ্যে কার হাতে চাবি?
স্যাব নিয়ে কাজ করার সময় উদ্বেগ বাড়তেই লাগল রানার। কাজ শেষ করে পেট্রল পাম্পের দিকে রওনা দিল। ট্যাংকটা অন্তত ভরে রাখতে হবে, কখন কি প্রয়োজন হয়।
বিজয়ীকে অভিনন্দন জানাবার জন্যে হ্যান্ডশেক করতে আসেনি ল্যাচাসি ।
রানার সাথে একটাও কথা না বলে অদৃশ্য হয়েছে রিটাও-সিকিউরিটি স্টাফরা প্রায় জোর করেই নিয়ে গেছে ওদেরকে। রিটার সাথে বানা বেলাডোনাকেও।
চারদিকে চোখ বুলিয়ে মলিয়ের ঝানকেও কোথাও দেখল না রানা। বিপজ্জনক প্রতিযোগিতার পর কেমন যেন নিস্তেজ আর মনমরা লাগছে নিজেকে ওর। খোলা জায়গায় আস্ত গরু আর ভেড়া আগুনে ঝলসানো হচ্ছে-পরিত্যক্ত বারবিকিউ, দু’জন মাত্র শেফ দাঁড়িয়ে আছে নির্বোধের মত। এগিয়ে গিয়ে বড় একটা স্টেক, রুটি আর কফি নিল রানা। খিদের জ্বালায় কষ্ট পেতে রাজি নয়।
স্যাবে তাড়াতাড়ি তেল ভরল রানা, চোখ তুলে খালি হয়ে যাওয়া স্ট্যান্ডটা দেখে নিল একবার। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে-পিঠ বাঁচিয়ে ফিরে যাবে কেবিনে, দু’একটা কাজ সেরে তাড়াতাড়ি আবার বেরিয়ে এসে রাত না নামা পর্যন্ত লুকিয়ে থাকবে কোথাও। তারপর টারায় যাবে ডিনার খেতে, সাথে অস্ত্র নিয়ে।
ডিনারের পর গা ঢাকা দেবে আবার, ঢুকবে কনফারেন্স সেন্টারে। আশা-তার আগে ওর ওপর হামলা হবে না।
পিট থেকে বেরিয়ে দূরে সরে যাচ্ছে স্যাব। ঠোঁটের নিচে সামরিক অফিসারদের মত চওড়া গোঁফ নিয়ে এক লোক, পরনে সাদা সিল্ক জ্যাকেট, উঁচু গ্র্যান্ডস্ট্যান্ড থেকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল গাড়িটা, বনভূমি ঘেরা ঢালের দিকে ছুটছে।
মুচকি হেসে গ্র্যান্ডস্ট্যান্ড থেকে নেমে এল হেনরি ডুপে।