দুই
চিৎকারের পর মাত্র কয়েক সেকেন্ড পেরিয়েছে, স্যান্ড ক্রীকের দরজায় পৌছুল রানা, হাতে ভি-পি-সেভেনটি।
বাঁ পায়ের প্রচণ্ড লাথিতে ভেঙে গেল হাতল, কব্জা থেকে প্রায় খসে পড়ল দরজার কবাট। লাফ দিয়ে দোরগোড়ায় পৌছুল রানা, পরমুহূর্তে স্যাঁৎ করে সরে গেল একপাশে, দু’হাতের মুঠোর ভেতর ভি-পি-সেভেনটি, ঠোঁট থেকে বেরুতে যাচ্ছে হুঙ্কার, ‘হল্ট! ‘
কিন্তু সামনে শুধু একা রিটাকে দেখল ও, বেডরুমের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে, কুঁকড়ে ছোট হয়ে গেছে শরীরটা, কাঁপতে কাঁপতে পিছিয়ে আসার চেষ্টা করছে।
লিভিংরূমে ঢুকে এগোল রানা। রিটার কাঁধ খামচে ধরল-জন্তু, সরীসৃপ, মানুষ, বেডরূমের ভেতর যাই থাক গুলি করার জন্যে তৈরি।
তারপর, আত্মরক্ষার সহজাত প্রবৃত্তি বশে, সে-ও এক পা পিছিয়ে এল। গোটা কামরা জ্যান্ত হয়ে আছে-আকারে বড়, গাঢ় রঙের, বিষাক্ত পিঁপড়েতে। মেঝে, দেয়াল, সিলিং-সব ঢাকা পড়ে গেছে। পিঁপড়ের সচল স্তূপে বিছানাটা সম্পূর্ণ কালো।
কয়েক হাজার হবে, সবচেয়ে ছোটগুলোও লম্বায় এক ইঞ্চির কম নয়, গায়ে গায়ে জড়িয়ে থেকে বিছানায় ওঠার জন্যে পরস্পরের সাথে যুদ্ধ করছে। বিছানার ওপর লম্বাটে পাহাড়ের মত লাগছে ডামিটাকে।
দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল রানা, তারপর ঝুঁকে পরীক্ষা করল দরজার কবাট আর মেঝের মাঝখানে কতটুকু ফাঁক।
‘সম্ভবত হার্ভেস্টার, রিটা। হার্ভেস্টার অ্যান্ট। নিজেদের এলাকায় নেই, কাজেই খাবার খুঁজছে।
ওগুলো যদি হার্ভেস্টার হয়, ভাবল রানা, নিজেদের ইচ্ছায় বা দুর্ঘটনাবশত এখানে আসেনি। হার্ভেস্টার পিঁপড়েরা শুকনো এলাকায় বাস করে এবং খাওয়ার জন্যে বীজ জমা করে রাখে। মরুভূমি থেকে এতদূর আসবে না ওগুলো-অন্তত একসাথে এতগুলো আসবে না।
ব্যাখ্যা করার সময় খানিক ইতস্তত করল রানা, হার্ভেস্টার পিঁপড়ের একটা মাত্র হুল যদি ফোটে ব্যথায় ছটফট করবে মানুষ, কোন কোন ক্ষেত্রে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু এখানে ওগুলো সংখ্যায় কয়েক হাজারই শুধু নয়,
নিজেদের পরিচিত পরিবেশ থেকে দূরে থাকায় উত্তেজিত হয়ে আছে, হন্যে হয়ে খুঁজেও খাবার পাচ্ছে না। অস্থির এই বিষাক্ত পিঁপড়ের গোটা কয়েক কামড় খেলে মৃত্যু হবে ভারি যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা
‘সমস্যার একটাই সমাধান আছে।’ রিটাকে জড়িয়ে ধরে কেবিন থেকে বেরিয়ে এল রানা, চট্ করে একবার পিছনে তাকিয়ে দেখে নিল লিভিংরুমে দু’একটা পিঁপড়ে ঢুকে পড়েছে কিনা। তারপর বন্ধ করে দিল দরজা।
রিটাকে নিজের কেবিনে নিয়ে এল রানা, মেইন রূমে থাকতে বলল তাকে চোখ-কান খোলা রেখে, সাবধানে, কেমন?’ ছুটে বেডরূমে ঢুকল, ব্রীফকেসটা দরকার।
ব্রীফকেস খুলে ফলস্ বটম সরাল, ভেতর থেকে বের করল ছোট একটা ডিটোনেটর আর ইঞ্চি দুয়েক ফিউজ। ব্যস্ত হাতে ডিটোনেটরের ভেতর ফিউজ ঢোকাল, তারপর সতর্কতা অবলম্বনের সমস্ত নিয়ম লঙ্ঘন করে দাঁত দিয়ে ডিটোনেটরে চাপ দিল যাতে ফিউজটা আটকে থাকে। ওকে যারা ট্রেনিং দিয়েছে সেই ইনস্ট্রাক্টররা দেখলে হাঁ হয়ে যেত। শুধু দাঁত নয়, ইকুইপমেন্টটাও বাতিল হয়ে যেতে পারে।
ব্রীফকেস থেকে এরপর একটা ব্যাগ বের করল রানা, ভেতরে প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ। জিনিসটা নরম, খানিকটা নিয়ে গোল পাকাল, হাতের তালুতে গলফ বলের আকৃতি পেলো সেটা।
ফিউজ আর ডিটোনেটর প্লাস্টিকের কাছ থেকে দূরে রেখে কামরা থেকে ছুটে বেরিয়ে এল ও F আবার রিটাকে সাবধান করে দিল, জায়গা ছেড়ে নড়বে না সে, মাথা তোলা বারণ। লিভিংরুমে না থেমে চলে এল স্যাবের পাশে। প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগাচ্ছে, একটা কাজ শেষ করার আগেই জানে এরপর কি করতে হবে। অ্যালার্ম সেনসরগুলো অফ করল, তালা খুলল বুটের।
প্লাস্টিকের পাত্রে দু’গ্যালন পেট্রল সব সময় রাখে ও।
স্যান্ড ক্রীকের দরজায় পৌছে পেট্রল ভরা পাত্রের ছিপি খুলল, প্লাস্টিক বলটাকে চাপ দিয়ে বসিয়ে বন্ধ করে দিল মুখ। ফিউজের কাছ থেকে এখনও দূরে রেখেছে এক্সপ্লোসিভ, বেডরূমে থেমে প্লাস্টিকের ভেতর শক্তভাবে সেঁধিয়ে দিল ডিটোনেটরটা। এখন একটাই সমস্যা, ফিউজে আগুন দেয়ার সময় পেট্রল যেন জ্বলে না ওঠে।
সাবধানে বেডরূমের দরজা খুলল রানা। অশ্লীল ঢেউয়ের আকৃতি নিয়ে গোটা কামরা আলোড়িত হচ্ছে, মোটা তাজা কালো পিঁপড়ের সাগর যেন! গা ঘিন ঘিন করে উঠল ওর। পেট্রল ভরা পাত্রটা দরজার ঠিক ভেতরে রেখে পকেট থেকে ডানহিল লাইটার বের করল। পেট্রল আর লাইটারের মাঝখানে হাতের আড়াল তৈরি করল, তারপর লাইটার জ্বালল। আগুনের শিখা দেখা গেল। ফিউজে ঠেকাতেই জ্বলে উঠল সেটা।
দরজাটা আস্তে আস্তে বন্ধ করল রানা, তা না হলে বাতাসের ধাক্কায় হাতে তৈরি বোমাটা পড়ে যেতে পারে। ধীর পায়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে এল ও। হাঁটবে, কক্ষনো দৌড়াবে না, পই পই করে শেখানো হয়েছে ওকে। দৌড়ালে জ্যান্ত ফিউজের কাছাকাছি আছাড় খেয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
ফেটারম্যানের দরজার কাছে মাত্র পৌঁচেছে রানা, ভোঁতা একটা আওয়াজের সাথে বিস্ফোরিত হলো বোমাটা। বিস্ফোরণের ধাক্কায় আগুনে বলের মত নিক্ষিপ্ত হলো পেট্রল, কেবিনের ছাদ ভেদ করে শূন্যে উঠে গেল উজ্জ্বল শিখায় তৈরি একটা হাত, তারপর ছড়িয়ে পড়ল স্যান্ড ক্রীকের ভেতর। চোখের পলকে গোটা কেবিন এক খণ্ড আগুনে পরিণত হলো।
এক ঝটকায় খুলে গেল ফেটারম্যানের দরজা। মুহূর্তের জন্যে ভুল বুঝল রানা, দরজাটা বিস্ফোরণের ধাক্কায় খুলে গেছে। কিন্তু না, খোলা দরজার সামনে রিটা, কেউ যেন মেঝের সাথে গেঁথে রেখেছে। ধাক্কা দিয়ে তাকে ভেতরে পাঠাল রানা, চরকির মত ঘুরতে শুরু করে পড়ে গেল সে, ডাইভ দিয়ে তার ওপর পড়ল রানা। আগুনের শিখা আর জ্বলন্ত আবর্জনা বৃষ্টির মত ঝরছে ফাঁকা জায়গাটায়। রানার নিচে হাঁসফাস করছে রিটা।
‘নোড়ো না, আরও কিছুক্ষণ এভাবে থাকো, নির্দেশ দিল রানা।
‘যদি বলো সারাজীবন নড়তে পারব না তাতেও আমি রাজি, রানা!’ প্রথমে পিঁপড়ে, তারপর বিস্ফোরণ, দুটো ধাক্কাই সামলে নিয়েছে রিটা, মৃদু হলেও শব্দ করে হাসতে পারল।
তাড়াতাড়ি একটা গড়ান দিয়ে রিটার ওপর থেকে নামল রানা। ‘শুয়ে থাকো,’ বলে দরজার দিকে এগোল আবার।
চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে টুকরো টুকরো জ্বলন্ত জঞ্জাল। গুরুত্ব অনুসারে প্রথমে স্যাবের দিকে দৃষ্টি দিল রানা, বড় কোন কাঠ বা জ্বলন্ত কিছু গাড়িটাকে আঘাত করেনি দেখে স্বস্তিবোধ করল। তারপর ফেটারম্যানকে ঘিরে চক্কর দিয়ে এল একটা. নিশ্চিত হলো দ্বিতীয় কেবিনটার নাগাল পায়নি আগুন।
এতক্ষণে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার তীক্ষ্ণ খোঁচা দিয়ে রানার মনোযোগ দাবি করল। প্রথমটা আগেই রানা উপলব্ধি করেছে-পিঁপড়ের এত বড় একটা কলোনি আপনাআপনি বা দুর্ঘটনাবশত এখানে আসতে পারে না। দ্বিতীয়টা আরও বেশি অর্থবহ-পিঁপড়েগুলোকে নিয়ে আসা হয়েছে হুল ফোটাবার জন্যেই অর্থাৎ এটা একটা হত্যা ষড়যন্ত্র, এবং টার্গেট ছিল রানা। মনে পড়ল, প্রশ্নের উত্তরে মলিয়ের ঝানকে মিথ্যে কথা বলেছিল ও। ঝান কথাচ্ছলে জানতে চেয়েছিল ওরা দু’জন কে কোন কেবিনে থাকছে। হাজার হোক রিটা মেয়ে, তার নিরাপত্তার কথা ভেবেই ঝানকে জানিয়েছিল স্যান্ড ক্রীকে থাকছে ও।
এরইমধো এঞ্জিনের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে রান্না। ছুটে আসছে একাধিক গাড়ি।
ঝড় উঠল রানার মনে। সাহায্য আসছে এ কথা বলা যাবে না, তবে আসছে ওরা। ওরা পৌঁছুবার পর দুটোর একটা ব্যাপার ঘটতে পারে। রানা আর রিটাকে অক্ষত দেখে ঝান চট্ করে নতুন কোন বুদ্ধি আঁটতে পারে, সাথে করে নিয়ে আসা খুনীদের দিয়ে বীভৎস কিছু ঘটিয়ে বসতে পারে। কিংবা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দু’জনকে আলাদা করতে পারে, হয় রানাকে অথবা রিটাকে কেবিন থেকে সরিয়ে টারায় তুলতে পারে ‘ যাই ঘটুক, আগামীকাল বা তারপর দিন দু’জনকে একসাথে থাকার সুযোগ অবশ্যই দেবে না ঝান। দ্রুত একটা প্ল্যান করা দরকার, কাছাকাছি কেউ চলে আসার আগেই।
ছুটে কেবিনে ফিরে এল রানা, একটা চেয়ারে বসে কড়া ব্র্যান্ডির গ্লাসে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে রিটা। ‘আমার কাপড়!’ রানা মুখ খোলার আগেই কাঁদ কাঁদ গলায় বলল সে। ‘সব গেছে, রানা! একজোড়া প্যান্টি পর্যন্ত নেই।
একমাত্র সমাধানটা চেপে রাখতে পারল না রানা। ‘চিন্তা কোরো না, রিটা-তোমার আর বেলাডোনার সাইজ বোধহয় এক।
ঝাঁঝের সাথে কিছু বলতে যাচ্ছিল রিটা, ব্যস্ত ভঙ্গিতে কথা শুরু করে তাকে থামিয়ে দিল রানা। ওদেরকে বিচ্ছিন্ন করা হতে পারে, জানাল ও, সেক্ষেত্রে যোগাযোগের একটা ব্যবস্থা থাকা দরকার। স্যাবের অতিরিক্ত চাবিটা রিটার হাতে গুঁজে দিল ও। ওকে যদি হঠাৎ করে গা ঢাকা দিতে হয় তাহলে কোথায় লুকানো থাকবে, গাড়িটা জানিয়ে রাখল। যেখানেই থাকুক রিটা, যেভাবেই হোক সেখান থেকে বেরুবার একটা ব্যবস্থা তার নিজেকেই করতে হবে।
‘তোমার ইনফরমেশন যদি ঠিক হয়, ডেলিগেটরা যদি আজ রাতে আসতে শুরু করে, চেষ্টা করব আমি যাতে কাল খুব ভোরে কনফারেন্স সেন্টারে ঢুকতে পারি।’ ইতস্তত করল রানা, হঠাৎ করে মনে পড়ে গেছে বাননা বেলাডোনার সাথে দেখা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ও। ‘মাঝরাতে,’ বলল ও। ‘কাল মাঝরাতে। ওখানে যদি না থাকি আমি পরের রাতে খুঁজবে আমাকে। যদি দেখো গাড়িটা নেই, ধরে নেবে তোমাকে আমি বিপদের মধ্যে ফেলে গেছি। কিন্তু রিটা, সেটা হবে একেবারে শেষ উপায়, এবং অবশ্যই আবার আমি ফিরে আসব-সম্ভবত বি.সি.আই. বা সি.আই.এ. আর স্টেট ট্রুপারদের নিয়ে। কাজেই গা বাঁচিয়ে থেকো।’
কোথায় দেখা হবে, কোথায় লুকানো থাকবে গাড়ি ইত্যাদি বিশদভাবে রিটাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে রানা তখনও, এই সময় একজোড়া পিক-আপ আর একটা কার সবেগে ঢুকে পড়ল ফাঁকা জায়গাটায়।
‘হে…হেই দেয়ার! মি. রানা, মিসেস লুগানিস… আপনারা ভাল তো?’ চেঁচামেচি আর ছুটোছুটির মধ্যে মলিয়ের ঝানের ভরাট গলা ভেসে এল।
দরজার কাছে এল রানা। ‘আমরা এখানে কাভার নিয়েছি। খুব দেখালেন বটে, ঝান! মেহমানদারির এই বুঝি নমুনা?’
‘কি!’
প্রকাণ্ড শরীর নিয়ে দরজার কয়েক ফুট সামনে উদয় হলো মলিয়ের ঝান। তার পিছনে বানা বেলাডোনার মুখ, চোখাচোখি হলো রানার সাথে। ওকে সুস্থ দেখে, রানার মনে হলো, মেয়েটার চেহারায় স্বস্তির ছায়া খেলে গেল।
‘বলি কি ঘটল কি এখানে?’ নিষ্প্রভ আগুনের দিকে একটা হাত তুলল ঝান, খানিক আগে যেখানে স্যান্ড ক্রীক কেবিনটা ছিল। ধ্বংসস্তূপের চারদিকে ছুটোছুটি করছে লোকজন। রানা লক্ষ করল, ঝানের লোকেরা তৈরি হয়েই এসেছে। একটা পিক-আপ ট্রাকে প্রেশারাইজড্ ফোমের ড়সড় ট্যাংক দেখা গেল। ঝানের কর্মচারীরা এরই মধ্যে আগুন নেভাতে শুরু করেছে।
‘ওখানে, কেবিনের ভেতর…,’ শুরু করল রিটা।
‘ছারপোকা ছিল, অল্প কয়েকটা,’ বলল রানা, সহজ ভঙ্গিতে দরজার ফ্রেমে হেলান দিয়ে রয়েছে। তাই বেরিয়ে গাড়ির কাছে আসি আমি, ওতে সব সময় একটা ফার্স্টএইড কিট থাকে। পোকা মারার খানিকটা ওষুধ দরকার ছিল আমার। শব্দ শুনে রিটা ভাবল চোর-টোর এসেছে।’ হেসে উঠল ও। ‘সত্যি মজার ব্যাপার। তাহলে ব্যাখ্যা করতে হয়-আপনাকে বলেছিলাম আমি স্যান্ড ক্রীকে আর রিটা ফেটারম্যানে থাকছি, আসলে গোলমাল হয়ে গিয়েছিল। আসলে উল্টোটা হবে। কিন্তু আজ রাতে আমরা ফেরার পর, রিটা বলল সে বরং ফেটারম্যানেই থাকবে। স্যান্ড ক্রীকের ছবিগুলো নাকি পছন্দ নয় ওর। ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম আমরা, ঘুমে বুজে আসছিল চোখ, কাজেই জিনিস-পত্র-কিছুই সরানো হয়নি। রিটা বলল সকালে যে যার জিনিস সরিয়ে নেবে। রিটার যা কিছু সব ওখানে ছিল,’ ভস্মীভূত স্যান্ড ক্রীকের দিকে হাত তুলল রানা। ‘আমারগুলো সব ঠিক আছে, কিন্তু পরনের কাপড় ছাড়া রিটার কিছু নেই…’
‘প্রিন্ট?’ তীক্ষ্ণকণ্ঠে বাধা দিল ঝান। ‘আমার প্রিন্টগুলো? ওগুলো কোথায়? ওগুলো সব ঠিক আছে তো? আপনি নিশ্চয়ই ..?
প্রিন্ট ঠিক আছে, এটুকু বলতে পারি।’
‘থ্যাঙ্ক দা গুড লর্ড ফর দ্যাট।’ ঝানকে দেখে মনে হলো এইমাত্র ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল তার।
‘ঝান,’ কঠিন সুরে বলল রানা, ‘জাহাজডুবির পর মাতাল নাবিক যেভাবে কথা বলে আপনি ঠিক সেভাবে কথা বলছেন-’ব্র্যান্ডির বোতলগুলো ঠিক আছে তো?’ অথচ প্রশ্নটা হওয়া উচিত, ‘ক’জন বাঁচলাম আমরা?’ ঠিক না?’
‘হ্যাঁ, রানা তো ঠিক কথাই বলছে।’ দরজার কাছাকাছি দলটার দিকে এগিয়ে এল বাননা বেলাডোনা। ‘মি. ঝান, মাঝে মাঝে আপনি খেই হারিয়ে ফেলেন। বুঝতে পারছেন না, রানা মারা যেতে পারত!’
‘আরেকটু হলে গিয়েছিলাম। কেবিনগুলোয় রান্নার কাজে কি ব্যবহার করেন আপনারা? বোতলের গ্যাস?’
‘সত্যি কথা বলতে কি….’ শুরু করল ঝান।
‘বুঝলাম, কি ঘটেছে বুঝলাম! কোন গাধা সিলিন্ডার লিক করেছে কিনা চেক করেনি। আমি সিগারেট ধরিয়েছিলাম, বেডরূমের অ্যাশট্রেতে রেখে বেরিয়ে আসি। গাড়ির কাছে শুধু আসতে পেরেছি, এমন সময় হু-উ-প করে আওয়াজ হলো, তাকিয়ে দেখি স্যান্ড ক্রীক জ্বলছে।’
‘ওহ্, রানা, ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপছে!’ তাকিয়ে দেখল রানা, শুধু যে হাত-পা কাঁপছে তাই নয়, বান্না বেলাডোনার চোখ জোড়াও ভেজা ভেজা। ওর দিকে মায়াভরা চোখে তাকিয়ে রয়েছে মেয়েটা, এই দৃষ্টি রানাকে তার চুলের গন্ধ আর চুমোর তৃপ্তি স্মরণ করিয়ে দিল। বেলাডোনার দিক থেকে চোখ সরানো সত্যি কঠিন হয়ে উঠল ওর জন্যে। তারপর খেয়াল করল ও, ঢাল বেয়ে আরেকটা গাড়ি উঠে আসছে।
ঝানের দিকে এক পা এগিয়ে থামল রানা। ‘এবার শোনা যাক, ঝান,’ ঝগড়াটে, আক্রমণাত্মক সুরে বলল ও, ‘ছারপোকা সম্পর্কে আপনার কি বলার আছে।’
‘ছারপোকা?’ নিজের পায়ের চারদিকে তাকাল ঝান, যেন ভয় করছে মহামারীর ছোঁয়া লাগতে পারে।
‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, ছারপোকা। বড়, কালো, জঘন্য প্রাণী-এক একটা মস্ত পিঁপড়ের মত।’
‘ওহ্ মাই গড!’ এক পা পিছিয়ে গেল মলিয়ের ঝান। ‘হার্ভেস্টার নয় তো? ‘আমার তাই ধারণা।’ রানার চোখ-মুখ রাগে ফেটে পড়ার অবস্থা। ‘চারপাশে ওগুলো বিস্তর আছে, তাই না, ঝান? তাহলে আমাদেরকে সাবধান করে দেননি কেন? শুনেছি হার্ভেস্টার…নাকি ভুল শুনেছি?’
হ্যাঁ, হার্ভেস্টারের কামড়ে মানুষ মারা যেতে পারে।’ শিউরে উঠল ঝান। ‘তাহলে? প্রায়ই এদিকে দেখা যায়?’
ঝান উত্তর দিল অন্য দিকে তাকিয়ে, ‘মাঝে মধ্যে। তবে খুব বেশি নয়। ‘ওখানে কয়েক হাজার ছিল। দু’জনেই আমরা মারা যেতে পারতাম। অথচ দেখতে পাচ্ছি ব্যাপারটাকে আপনি বেশ সহজভাবেই নিচ্ছেন।’
উত্তরে কি বলতে যাচ্ছিল ঝান জানা হলো না, পৌছুবার সাথে সাথে ওদের মনোযোগ কেড়ে নিল শেষ গাড়িটা। হুইলে রয়েছে পিয়েরে ল্যাচাসি, সাথে দু’জন সঙ্গী। গাড়িটা তখনও থামেনি, ব্রেক করায় ধুলোর মেঘে ঢাকা রয়েছে, ঝানের উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠল ল্যাচাসি।
ঝান এত ব্যস্ততার সাথে চলে গেল, লক্ষ করে চিন্তায় পড়ে গেল রানা। তবে কি ল্যাচাসিই নেতৃত্ব দিচ্ছে?-প্রশ্ন জাগল মনে। অদূরে দাঁড়িয়ে নিভৃতে আলাপ করছে তারা, ঘন ঘন ঝাঁকি খাচ্ছে ল্যাচাসির খুলি।
‘আজ রাতে তুমি এখানে নিরাপদ, রানা?’ কেবিনে ঢুকেছে বান্না বেলাডোনা।
‘এখানে আমরা দু’জন থাকতে পারি,’ মাঝখান থেকে তাড়াতাড়ি বলল রিটা। টস করে জেনে নেব কে সোফায় শোবে।’
‘তা আমি শুনব না, মাই ডিয়ার।’ বেলাডোনা মিষ্টি করে হাসল। আপনি ভাই টারার গেস্টরুমে থাকবেন। তবে প্রথমে দেখতে হবে আপনার কাপড়চোপড়ের কি ব্যবস্থা করা যায়। সাইজ জানতে পারলে আমার বুদ্ধিমতীদের একজনকে শহরে পাঠিয়ে সব আনিয়ে নেয়া যাবে। আর কাজ চালাবার জন্যে আমার কিছু কাপড় নিতে পারবেন…তবে একটু বোধহয় লম্বা আর আঁটসাঁট হবে।’
‘আপনার খুব দয়া,’ বলল বটে রিটা, কিন্তু প্রায় শুনতে না পাবার মত করে। বেলাডোনা ঘুরল, মলিয়ের ঝান ফিরে এসেছে। ‘রাতটুকু মিসেস লুগানিস টারায় থাকবেন, মি. ঝান।’
‘গুড।’ ঝান অন্যমনস্ক। ‘মি. রানা, আরেক কাণ্ড ঘটেছে। ভারি অপ্রীতিকর যে লোকটা আপনাদের পথ দেখিয়ে এখানে এনেছিল, যাকে আপনারা অনুসরণ করে এসেছিলেন, পিক-আপ ট্রাক চালিয়ে…
‘হ্যাঁ, বলুন!’
‘সে চলে যাবার পর কি ঘটেছিল?’
কাঁধ ঝাঁকাল রানা, ভুরু কোঁচকাল। ‘কি বলতে চান ঠিক বুঝলাম না। হাত নেড়ে গুডনাইট বলে চলে গেল, তারপর আবার কি?’
‘তার চলে যাবার পর কিছু শুনেছেন?’
কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করল রানা। ‘না। দু’জন আমরা আমার কেবিনে ঢুকি, খানিকক্ষণ গান শুনি, গলা ভেজাই-তখনই তো ঠিক করলাম কেবিন বদল করব। মিসেস লুগানিস বলল স্যান্ড ক্রীকের চেয়ে এটাই তার বেশি পছন্দ। আমার মনে হয় ছবিগুলো দেখেই ওর এই ধারণা হয়ে থাকবে-প্রচুর সাদা লোক ঘোড়ায় চড়ে চক্কর দিতে দিতে পাইকারীভাবে ছেলে-বুড়ো-মেয়ে যাকে পাচ্ছে তাকেই খুন করছে। কিন্তু এ প্রশ্ন কেন, ঝান?’
দৃষ্টিতে অভিযোগ, কণ্ঠস্বরে বিদ্বেষ নিয়ে ঝান বলল, ‘আপনাদের গাইড অত্যন্ত ভাল একজন লোক ছিল…’
‘টমসন?’ জিজ্ঞেস করল বেলাডোনা, সামান্য উদ্বিগ্ন।
মাথা ঝাঁকাল ঝান। ‘হ্যাঁ। আমাদের সেরা লোকদের একজন।
‘কি ঘটেছিল?’ বেলাডোনা যে ঘাবড়ে গেছে এখন আর তাতে কোন সন্দেহ নেই, চমকে ওঠা ভাবটা সে গোপন করতে পারল না।
বড় করে শ্বাস টানল ঝান। মনে হচ্ছে আজ রাতে মাত্রা ছাড়িয়েছিল। ওই একটাই অসুবিধে ছিল টমসনকে নিয়ে-মাঝে মধ্যেই বেশি খেয়ে ফেলত।’
‘মদ!’ রানাও শব্দ করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। মূড ভাল থাকলে অতিরিক্ত কয়েক গ্লাস টানত। লক্ষণগুলো আমার জানা আছে।’ চেহারায় কাতর কোন ভাব নেই।
‘আপনাকে বোধহয় বলে ফেলাই ভাল। টমসনের কাজ ছিল…কিভাবে বলা যায়…মানে, আপনাদের ওপর নজর রাখার দায়িত্ব ছিল তার ওপর। জঙ্গলের ভেতর গা ঢাকা দিয়ে থাকতে বলা হয়েছিল তাকে, লক্ষ রাখবে আপনাদের যেন কোন সমস্যা না হয়। এদিকে বুনো জন্তু-জানোয়ার দু’একটা আছে কিনা।’
‘হার্ভেসটার পিঁপড়ের মত?’
‘জন্তু-জানোয়ার,’ পুনরাবৃত্তি করল ঝান।
‘তার বদলে সে মদ নিয়ে বসে?’ জিজ্ঞেস করল রিটা।
মাথা নাড়ল ঝান। ‘বসেনি। খেয়েও যদি থাকে, এখানে আসার আগেই দু’চার গ্লাস খেয়েছিল। হতে পারে আরও খাবার জন্যে যাচ্ছিল সে।’
‘যাচ্ছিল?’ প্রশ্নটা বেলাডোনার।
‘রাস্তা থেকে পড়ে গেছে পিক-আপ। ঢালের নিচে, জঙ্গলের কিনারায় আগুন ধরে গিয়েছিল। এত তাড়াহুড়ো করে এসেছি আমরা, চোখেই পড়েনি। কিন্তু ল্যাচাসি ঠিকই দেখতে পেয়েছে।’
‘আর টমসন?’ তাকিয়ে আছে বেলাডোনা।
দুঃখিত, হানি। জানি ওকে তুমি খুব পছন্দ করতে। টমসন পুড়ে গেছে।’
‘ওহ্ মাই গড! আপনি বলতে চাইছেন…?’
‘ছাই। অত্যন্ত দুঃখজনক, অত্যন্ত।’ রানার দিক থেকে রিটার দিকে, তারপর আবার রানার দিকে তাকাল ঝান। আপনারা ঠিক বলছেন, কিছুই শোনেননি?’
‘কিচ্ছু না।’
‘কিছুই না।’
‘বেচারা টমসন,’ ঘুরে গেল বেলাডোনা, চেহারায় ভাঁজ। ‘ওর বউ…’
‘খুব ভাল হয় তুমি যদি খবরটা দাও তাকে, মাই ডিয়ার,’ দীর্ঘশ্বাস চাপতে চাপতে ঘুরে দাঁড়াল ঝান।
‘হ্যাঁ, ঠিক আছে, মি. ঝান। আগে মিসেস লুগানিসকে টারায় পৌছে দেয়া দরকার।
‘গুড়। ইয়েস।’ বোঝাই যায় মলিয়ের ঝান অন্য কিছু নিয়ে চিন্তিত। আপনি এখানে নিরাপদ থাকবেন তো. মি. রানা?’
রানা জানাল কোন সমস্যা হবে না, তারপর সহাস্যে জানতে চাইল, গ্রাঁ প্রি-র আয়োজন ঠিক আছে কিনা। ‘মানে এত কিছু ঘটে গেল, তাই জানতে চাইছি।’
কেবিন আর হেডলাইটের আলোয় ঠিক বোঝা গেল না, ঝানের মুখে যেন মেঘের ছায়া পড়েই সরে গেল। বিশালদেহী লোকটা জবাব দিল আকস্মিক উৎসাহের সাথে, ‘ওহ্, ইয়েস, মি. রানা! টমসনের মৃত্যু…বিদায়, দুঃখজনক বটে, কিন্তু গ্রাঁ প্রি অবশ্যই অনুষ্ঠিত হবে। সকাল দশটায়। ল্যাচাসি তো অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, আমি জানি।’
‘তাহলে দেখা হচ্ছে আমাদের। ট্র্যাকে। নাইট, রিটা। যা ঘটেছে ঘটেছে, এ- সব নিয়ে চিন্তা কোরো না-ঘুমিয়ো।
‘ধ্যেৎ, আমার চিন্তা করার কি আছে।’ রিটার মুখে কৃত্রিম হলেও উজ্জ্বল হাসি।
‘আর আমিও কাল তোমার সাথে দেখা করব, রানা।’ রানার গোটা শরীরে চোখ বুলাল বেলাডোনা। বনভূমিতে আলোর কারসাজি ছিল, কিন্তু এখন বেলাডোনার মায়াভরা চোখের গভীরে কোমল আগুন পরিষ্কারই দেখতে পেল রানা। তার হাসি যেন অনেক রঙিন সম্ভাবনার আগাম ইঙ্গিত।
সবাই চলে যাবার পর পরীক্ষা করে স্যাবের নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত হলো রানা, তারপর ফিরে এল কেবিনে। দরজায় একটা চেয়ার ঠেকিয়ে রাখল, জানালার সরু ফাঁকগুলো বন্ধ করল মোম দিয়ে। ঘুমের মধ্যে হার্ভেস্টার পিঁপড়ের দ্বিতীয় ডোজ সহ্য করা কঠিন হয়ে উঠবে।
ব্রীফকেসটা নতুন করে গোছাতে মিনিট দশেক লাগল। এরপর বিছানায় লম্বা হলো রানা, পুরোদস্তুর কাপড় পরে আছে, হেকলার অ্যান্ড কচ অটোমেটিকটা নাগালের মধ্যে।
ষড়যন্ত্র, অশুভশক্তি ইত্যাদি সম্পর্কে আভাস দিয়েছিল বান্না বেলাডোনা। রানা নিজেও এখন ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারছে, যেন গোটা ঝান র্যাঞ্চে পাপাচারীরা আড্ডা গেড়েছে, দুষ্কর্মে মেতে উঠেছে। প্রথম দিকে এখানে হার্মিসের অস্পষ্ট ছায়া দেখতে পেয়েছিল ও, এখন তীব্র গন্ধ পাচ্ছে। ইউনিয়ন কর্সের সাথে আগেও লড়তে হয়েছে ওকে, ওদের উপস্থিতি সহজেই ধরা পড়ে ওর চেতনায়, ওদের লীডার উ সেন ওরফে সও মং-এর গন্ধও দূর থেকে চিনতে পারত রানা। এমনকি এখনও, মরুভূমির মাঝখানে বনভূমি ঘেরা ঢালের মাথায় একা বসে, তার গন্ধ পাচ্ছে ও-বহুদূর নরক থেকে উঠে আসছে, যে নরকে ও-ই তাকে পাঠিয়েছিল।
মলিয়ের ঝান আর পিয়েরে ল্যাচাসি। পুরানো শত্রু উ সেনের সাথে এই দু’জনের একজনের সম্পর্ক আছে। কার সাথে? ঝান, নাকি ল্যাচাসি? রানা বলতে পারে না। তবে জানে সত্য চাপা থাকবে না।
ডেলিগেটদের কথা ভাবল ও, বারো ঘণ্টার মধ্যে এসে পৌঁছুবে। কারা তারা? কি তাদের উদ্দেশ্য? প্যাড লাগানো সেলের কথা মনে পড়ল, আইসক্রীম প্ল্যান্টের পাশের ল্যাবরেটরিতে। কি আবিষ্কার করেছে ওরা? কি ধরনের মেডিসিন? এক ধরনের হিপনোটিক ড্রাগ-’হ্যাপি পিল’? খেলে নৈতিক বোধ-বুদ্ধি সব লোপ পায়? বাইরে থেকে দেখলে ওষুধের কোন প্রভাব ধরা পড়ে না, কিন্তু যে-কোন আদেশ পালনে সাবজেক্ট অবিশ্বাস্য রকম তৎপর।
হাতঘড়ির ওপর চোখ বুলাল রানা। ভোর পাঁচটা বাজতে চলেছে, খানিক পরই দিনের আলো ফুটবে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আন্ডারগ্রাউন্ডে লুকাতে হবে ওকে, আক্ষরিক অর্থেই। টানেল হয়ে কনফারেন্স সেন্টারে ঢুকবে। অন্ধকারে আপনমনে হাসল রানা। গোটা ব্যাপারটা হাস্যকর প্রহসনের মত লাগবে যদি দেখা যায় ডেলিগেটরা আসলে সত্যি সত্যি নির্দোষ ব্যবসায়িক আলোচনার জন্যে মিলিত হয়েছে। যদিও ওর ট্রেনিং আর হার্মিস সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারল ব্যাপারটা সেরকম হবে না।