আবার উ সেন – ২.১০

দশ

নিচে দেখা যাচ্ছে লুসিয়ানা-র জলাভূমি, ইতিমধ্যে সন্ধে হয়ে এসেছে। গলা বাড়িয়ে কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে ঝুঁকল বেলাডোনা, তারপর উইন্ডস্ক্রীন দিয়ে নিচে তাকাল-ল্যান্ডমার্কটা খুঁজছে, জানে কাছেপিঠেই আছে কোথাও।

মাত্র অল্প কয়েক মিনিট ছিল ওরা নোরাড বেস কমপাউন্ডে, একের পর এক বেলাডোনাকে শুধু প্রশ্নই করে গেছে রানা। কি ঘটেছে? কিভাবে পৌঁছল সে? রিটার কোন খবর তার জানা আছে কিনা।

শুধু যে উত্তেজিত ছিল বেলাডোনা তাই নয়, আড়ষ্টবোধ করছিল সে, লালচে হয়ে উঠেছিল চেহারা। তবে রানা যত দ্রুতই প্রশ্ন করে থাকুক, সাথে সাথে উত্তর দিয়ে গেছে সে। সাথে একজন লোক থাকলে, হেলিকপ্টার নিয়ে আকাশে উঠতে তাকে কখনও বাধা দেয়নি মলিয়ের ঝান। বেশিরভাগ সময় সে নিজেই থাকত বেলাডোনার পাশে। তার কাছ থেকে, এবং তার পেশাদার পাইলটের কাছ থেকে হেলিকপ্টার চালাতে শিখেছে সে। লাইসেন্স পেয়েছে মাস কয়েক আগে। মনে মনে একটা আশা ছিল তার, হয়তো এই হেলিকপ্টার নিয়েই একদিন পালাতে পারবে সে, যদি পালানোর ইচ্ছে এবং উপায় হয়।

রাতে ঘুম ভেঙে যায় তার। প্রায় আটচল্লিশ ঘণ্টা আগের ঘটনা। কার যেন গলা শুনতে পেল সে। মনে হলো ঝানের গলা। ওপরতলায় কোথাও ঝানকে দেখতে না পেয়ে পা টিপে টিপে নিচে নেমে আসে সে। কয়েকজন লোকের সাথে পিয়েরে ল্যাচাসিকে দেখতে পায়। ওদের সাথে রিটাও ছিল।

তারপর হাজির হলো ঝান, চিন্তা-ভাবনা করে নির্দেশ দিল সে। কি যে ঘটতে চলেছে কিছুই বুঝল না বেলাডোনা, তবে শুনল অপর হেলিকপ্টারে করে রানাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আরও শুনল, ঝান বলছে, সব কাজ শেষ হলে কোথায় তারা আবার সবাই মিলিত হবে। ‘এখনও আমি জানি না সব কাজ বলতে কি বোঝাতে চেয়েছে সে। চেইন পাহাড়ের নাম বলতে শুনেছি ওদেরকে, ব্যস ওইটুকু। লর্ড, ইউনিফর্মে তোমাকে যা লাগছে না রানা! এবার তুমি বলো। আসলে ঘটনাটা কি?

সব কথা পরে বলবে রানা। তার আগে জরুরী তথ্যগুলো পেতে হবে ওকে। ঝান কোথায়? রিটার ভাগ্যে কি ঘটেছে?

‘ঝান রিটাকে লুসিয়ানায় নিয়ে যাচ্ছে। ঠিক কোথায় আমি জানি-ল্যাচাসিও ওখানে পৌঁছুবে, দেখো।’ আনন্দে উদ্ভাসিত চেহারা হঠাৎ কালো হয়ে গেল বেলাডোনার। ‘সে যে কি ভয়ঙ্কর, তোমাকে আমি বোঝাতে পারব না, রানা! আমি জানি রিটাকে নিয়ে কি করবে ওরা। ঝান একবার ওখানে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। মাই গড!’ শিউরে উঠে দু’হাতে মুখ ঢাকল সে।

বেলাডোনার কাঁধে হাত রেখে মৃদু ঝাঁকি দিল রানা। ‘এখন ভয় পাবার বা মুষড়ে পড়ার সময় নয়। যা জানো সব বলো আমাকে। জলদি!’ তাগাদা দিল রানা, কিন্তু চেহারা ওর সম্পূর্ণ শান্ত। ‘তুমি ঠিক জানো রিটাকে ওরা লুসিয়ানায় নিয়ে যাবে?’

হ্যাঁ, নিজের কানে শুনেছি। স্বপ্নেও ভাবিনি ওখানে আবার যাবার কথা ভাবতে হবে আমাকে। কিন্তু রিটাকে বাঁচাতে হলে… আমাদের দেরি করা উচিত হচ্ছে না, রানা! ওখানকার লোকেরা চেনে আমাকে। আমরা যদি তাড়াতাড়ি করি, রিটাকে নিয়ে ঝান পৌঁছুনোর আগেই আমরা হয়তো…।’ মুখ থেকে হাত সরাল বেলাডোনা।

‘কেন? কিভাবে?’ দ্রুত জিজ্ঞেস করল রানা। কিসে যাচ্ছে ওরা?’

‘গাড়িতে করে, রানা। প্রথম থেকেই ওরা রিটার লাশ দেখতে চেয়েছে। আমি জানতাম। ঝান শুধু তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু রিটাকে নয়। এখন শুধু বাকি আছে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা-যেন সময়মত পৌছুতে পারি আমরা। তুমি জানো না, রানা-কিন্তু আমি জানি রিটাকে নিয়ে কি করবে ওরা…’

ক’মিনিট পর হেলিকপ্টার নিয়ে আকাশে উঠে আসে ওরা। আর এখন, দীর্ঘ যাত্রার শেষ দিকে, পৌঁছে গেছে লুসিয়ানার জলাভূমির ওপর। চারদিকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে সন্ধ্যার কালিমা।

পাইলট হিসেবে বেলাডোনার দক্ষতা লক্ষ করে একাধারে খুশি এবং বিস্মিত হলো রানা। হেলিকপ্টারটাকে খেলনার মত অনায়াসে সামলাচ্ছে সে, যেন প্রতিদিনই এটাকে নিয়ে আকাশে ওঠে ।

হেসে উঠে বলল সে, ‘অল্প সময়ের জন্যে হলেও এটার সাহায্যেই ঝানের কাছ থেকে খানিকটা দূরে সরে আসার সুযোগ হাতে আসে আমার। মজার ব্যাপার কি জানো, চালাতে শেখার সময় থেকেই আমি জানতাম, এটাই আমাকে পালাতে সাহায্য করবে। করছেও ঠিক তাই!’

মেইন ল্যান্ডিং লাইটের সুইচ অন করল সে। গতি কমিয়ে এনে শূন্যে প্রায় দাঁড় করিয়ে ফেলল হেলিকপ্টারকে। উঁকি দিয়ে নিচে তাকাল। ‘ওই!’ হঠাৎ বলে উঠল বেলাডোনা। ‘ওটাই! চিনতে পেরেছি আমি। উঁচু জমিটা—একজোড়া জলাভূমির মাঝখানে!

বাড়িটার অবস্থা খুব কাহিল, অল্প আলোয় আরও বিধ্বস্ত লাগল দেখতে। সি.আই.এ, চীফ কলিন ফর্বসের কথা মনে পড়ল রানার। ঝান র‍্যাঞ্চে তদন্ত কাজে যাকেই পাঠানো হয়েছে তারই লাশ পাওয়া গেছে লুসিয়ানার জলাভূমিতে।

‘চোখকে বিশ্বাস কোরো না, রানা!’ আবার হেসে উঠল বান্না বেলাডোনা, যেন রানার মনের কথা ধরে ফেলেছে সে। বাড়িটার দেখাশোনা করার জন্যে ঝানের দু’জন লোক আছে ওখানে। বাইরেটা স্রেফ খোলস, বুঝলে! ভেতরটা দেখলে তোমার মাথা ঘুরে যাবে! রাজপ্রাসাদের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।

ছোট্ট বেলটাকে কাত করল বেলাডোনা প্রতি মুহূর্তে নিচে নামছে ওরা। বক বক করে চলেছে সে। জলাভূমির দূর প্রান্তে সমতল জায়গা থাকার কথা, সেখানে ল্যান্ড করবে সে। চারদিকে অনেকগুলো মারশ্ হপার রাখা আছে ঝানের। তবে ভুলেও মারশ্ হপার নিয়ে রাস্তার কাছাকাছি যাওয়া ঠিক হবে না। আমরা এখানে পৌচেছি সেটা তাকে জানতে দেয়া চলবে না।’

বেলাডোনার কথায় যুক্তি দেখল রানা। ঝান ওরফে নতুন সও মঙের সাথে জিততে হলে নির্ভেজাল, পরিপূর্ণ বিস্ময় একটা অস্ত্র হিসেবে কাজ করতে পারে। ফ্লাইং ড্রাগন নিয়ন্ত্রণ করার চাবি সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হবার পর হার্মিসের কি অবস্থা দাঁড়াবে আন্দাজ করার চেষ্টা করল ও। ওদের এই অপারেশনের পিছনে বহু টাকা ব্যয় হয়েছে। নতুন কাজে হাত দেয়ার জন্যে নতুন ফান্ড দরকার হবে। নিজেদের মধ্যে কোন্দল শুরু হওয়াও খুব স্বাভাবিক। লোকবলও অনেক কমে গেছে। সদস্যদের আস্থা হারাবে নেতারা। ‘এখনও তোমাকে ধন্যবাদ জানানো হয়নি।’ ঘাড় ফিরিয়ে বান্না বেলাডোনার দিকে তাকাল রানা, নিচের জলাভূমির কিনারায় স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে।

চেইন পাহাড় থেকে তোমাকে ছিনিয়ে আনার জন্যে?’ সমতল জমির দিকে নেমে যাচ্ছে ওরা। নিচে ধুলো উড়তে শুরু করল। ধীরে ধীরে মাটি স্পর্শ করল হেলিকপ্টার। আলো নিভিয়ে দিল বেলাডোনা। স্তব্ধ হয়ে গেল এঞ্জিন! মাথার ওপর রোটর ঘুরছে, নিজেদের সীটে বসে থাকল ওরা।

‘না, বান্না। তোমার ধন্যবাদ পাওনা হয়েছে অন্য কারণে। ওরা আমার ওপর ড্রাগ ব্যবহার করল, আমাকে সম্মোহিত করল, তারপরও আমি ওদের ষড়যন্ত্র বানচাল করে দিতে পারলাম-কেন? সবটাই তোমার কৃতিত্ব, বানা। আমার ঘুমের মধ্যে তুমি যা করেছ সেজন্যে আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ। আচ্ছা, আমার যে প্রতিষেধক লাগবে তুমি জানলে কিভাবে?’

বিরতি নিল বেলাডোনা। `ও, ওই ব্যাপারটা? ভেবে দেখো, ডিয়ার, তোমার জন্যে কিছু করতে পারছি না বুঝতে পেরে অস্থির হয়ে ছিলাম আমি। আসলে যা করেছি সবই বোকার মত। তোমাকে দেখে ধরে নিই, ওরা তোমাকে ড্রাগস দিয়েছে। প্রতিষেধক খুঁজে বের করি ঠিকই, কিন্তু ওখানে অনেক রকম ওষুধ ছিল। তোমাকে যেটা দিয়েছি সেটায় কাজ হয়েছে ভাগ্যগুণে। তুমি মারাও যেতে পারতে রানা।’

যাক, তুমি বোকামিটা করায় এ-যাত্রায় বেঁচে গেছি আমি-ধন্যবাদ, বান্‌না। ঝান আর ল্যাচাসির প্ল্যান তোমার দ্বারাই ব্যর্থ হয়ে গেল।’

নিরেট দেয়ালের মত রাত নামল ওদের চারপাশে। বোতাম টিপে আবার আলো জ্বালতে হলো বেলাডোনাকে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকল ওরা, তারপর বেলাডোনা বলল, ‘তুমি আমাকে সব কথা বলবে না, রানা? সব আমি জানতে চাই। কিছু কিছু জানি বটে, তাতে আরও বেশি জটিল লাগছে…জটিল আর ভীতিকর। কি করতে যাচ্ছিল ওরা-কেন? এ থেকে কি প্রচুর টাকা কামাত?’

‘কয়েকশো কোটি বা কয়েক হাজার কোটি ডলার,’ সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে প্রসঙ্গটা বাতিল করে দিল রানা। ‘চলো, মারশ্ হপারটা খুঁজে বের করা যাক। নোংরা লাগছে নিজেকে, শাওয়ারের নিচে দাঁড়াতে চাই। বিষধর ঝানের সামনে দাঁড়াবার আগে খানিকটা বিশ্রামও দরকার আমার।’

‘হ্যাঁ,’ স্ট্র্যাপ খুলতে খুলতে বলল বেলাডোনা। ‘হ্যাঁ, সে যে বিষধর তাতে কোন সন্দেহ নেই।

ঠিক যেখানটায় থাকার কথা বলেছিল বেলাডোনা সেখানেই পাওয়া গেল মারশ্ হপার, সামনে ছোট একটা স্পটলাইট ফিট করা রয়েছে। এঞ্জিন চালু করার পর আলো জ্বালল সে।

প্রাচীন বাড়িটাকে ঘিরে থাকা বিলের কাছাকাছি চলে এল মারশ্ হপার, এই সময় একটা আলো জ্বলে উঠল, সম্ভবত বারান্দা থেকে। অস্ত্রের জন্যে হাত বাড়াল রানা, কিন্তু বেলাডোনা ওর কব্জি চেপে ধরল।

‘ব্যস্ত হয়ো না, রানা। বাড়িটায় ঝান পুরুষ বলতে শুধু এক বোবা কালাকে রেখেছে। তার নাম ডেলাভাইল।

‘শুনে খুশি হলাম,’ বিড়বিড় করল রানা।

‘ডেলাভাইল আর একটা মেয়েলোক, সিলভিয়া-রান্নাবান্নায় সাংঘাতিক ভাল হাত।’ হেসে উঠল বেলাডোনা। ‘অন্তত খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে আমাদের কোন সমস্যা হবে না, রানা। ওই যে, ওকে দেখতে পাচ্ছি আমি। ডেলাভাইল, আলো ফেলে পথ দেখাচ্ছে আমাদের।

ছোট একটা জেটির পাশে থামল মারশ্ হপার। নরম ভঙ্গুর ধাপ বেয়ে প্রধান দরজার সামনে চলে এল ওরা। রানা পিছনে থাকল, ভেতরে ঢুকল বেলাডোনার পিছু পিছু।

বেলাডোনার কথা মিথ্যে নয়। ভেতরটা সত্যি প্রাসাদতুল্যই বটে

ডেলাভাইলের সাথে কথা বলল বেলাডোনা, সরাসরি তার দিকে মুখ করে থাকল সে, অঙ্গভঙ্গির সাহায্যে প্রকাশ করল মনের ভাব। ওদেরকে একবার দেখে নিয়ে নিজের চারদিকে চোখ ফেরাল রানা। প্রতিটি দেয়ালে ভারী সিল্কের পর্দা ঝুলছে। চারদিকে অ্যান্টিকস ফার্নিচারের ছড়াছড়ি, ফুলদানিতে তাজা ফুল।

‘মি. ঝান এসেছেন এখানে?’ জিজ্ঞেস করল বেলাডোনা।

মাথা নাড়ল ডেলাভাইল।

‘কি বলছি ভাল করে বোঝার চেষ্টা করো, ডেলাভাইল,’ বলল বেলাডোনা। মারশ্ হপারটা নিয়ে এমন কোথাও রেখে এসো যেন কেউ দেখতে না পায়। ঠিক আছে?’

মাথা ঝাঁকাল ডেলাভাইল।

‘তারপর সিলভিয়াকে বোলো, খাবার আর পানীয় দরকার আমাদের। মেইন বেডরূমে। কেমন?’

ওপর-নিচে ঘন ঘন মাথা- দোলাল ডেলাভাইল, ঠোঁটের কোণ দু’কান পর্যন্ত বিস্তৃত করে খিখিক্ শব্দে হাসল সে।

‘এবার, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা বলি তোমাকে। বুঝতে পারছ তো? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। মি. ঝান এখানে আসছেন। পাহারায় থাকবে, যাতে সে দূরে থাকতেই তুমি তাকে দেখতে পাও। সে মারশ্ হপার নিয়ে আসবে, তাই না? তাকে আসতে দেখলে কি করবে তুমি? ছুটে এসে আমাদের ঘুম ভাঙাবে। তাকে দেখামাত্র সাথে সাথে, কেমন? তারমানে তোমাকে হয়তো সারারাত জেগে পাহারা দিতে হবে। বিনিময়ে কি পাবে তুমি, ডেলাভাইল? কি তোমার শখ?’

আনন্দে ও শ্রদ্ধায় চোখ বুজে হাসতে লাগল বোবা লোকটা, মাথা নাড়ছে।

‘ঠিক আছে, উপহারটা কি হবে আমি নিজেই ঠিক করব। কিন্তু কাজটা তুমি পারবে তো, ডেলাভাইল?’

আবার মাথা ঝাঁকাল ডেলাভাইল, এত জোরে যে মনে হলো ঘাড় থেকে মাথাটা ছিঁড়ে পড়ে যাবে।

‘ডেলাভাইল খুব ভাল লোক, যা বলা হয় তাই করে।’ রানার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসল বেলাডোনা। ‘আমরা এখন সম্পূর্ণ নিরাপদ, রানা। নিশ্চিন্ত মনে বিশ্রাম নিতে পারি। ঝান আসছে দেখলেই ডেলাভাইল আমাদেরকে জাগিয়ে দেবে। খবর পেলে আর চিন্তা কি, তার জন্যে তৈরি থাকব আমরা।’

‘ঠিক জানো…?’

‘ঠিক জানি।’ রানার হাত চেপে ধরল বেলাডোনা, মৃদু টান দিল, সিঁড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

মাস্টার বেডরুমটা বিশাল, কার্পেটটা এত পুরু যে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ডুবে যায়। এমনকি বিছানাতেও ঝান বৈশিষ্ট্যের ছাপ রয়েছে—এত বড় যে গোটা একটা পরিবার ঘুমাতে পারবে। চারকোণের স্ট্যান্ড চারটে রূপোর তৈরি, খাটের মাথা থেকে বিছানার দিকে নেমে এসেছে সোনালি পাতাবাহার, খাটের গায়ে সূক্ষ্ম কারুকাজ, বহুরঙে রাঙানো।

বাথরুমটাও বিশাল, বাথটাব সহ অন্যান্য আধুনিক ফিটিংস দিয়ে সাজানো। বাথটাবে নিজেদের নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিল ওরা, সিলভিয়ার প্রথম এবং দ্বিতীয় ডাক ওদের কানেই ঢুকল না। মেয়েটা জানিয়ে গেল, বেডরূমে ওদের খাবার দেয়া হয়েছে।

তারপর কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে বিছানায় বসল ওরা খাবার সামনে নিয়ে প্রচণ্ড খিদে লেগেছে, সেটাই কারণ, নাকি সুন্দরী নারীর সান্নিধ্য পেয়ে ব্যাপারটা ঘটল ঠিক বলতে পারবে না রানা, তবে রাক্ষসের মত খেলো ও।

শুধু যে খেলো তাই নয়, প্রেমও করল ওরা। প্রথমবার অস্থিরতার সাথে, ব্যাকুলভাবে। পরের বার আস্তে-ধীরে, পরস্পরের ভাল লাগার প্রতি লক্ষ রেখে, তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করল একে অপরকে। তারপর আলো নেভাল বেলাডোনা, রানাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল নিশ্চিন্তে।

.

প্রথমে রানার মনে হলো স্বপ্ন দেখছে। গুলির শব্দ। ধ্যেৎ, অতীতের কোন দুঃস্বপ্ন হবে। তারপরই ঝট্ করে খুলে গেল চোখের পাতা। এক মুহূর্ত স্থির হয়ে থাকল ও, অন্ধকারে কান পাতল।

বুঝতে পারল, স্বপ্ন নয়। আরও দু’বার জোরাল শব্দ হলো গুলির। বেলাডোনার দিকে হাত বাড়াল রানা। কিন্তু বিছানায় নেই সে।

আলো জ্বালল ও, মেঝেতে পা পড়ার আগেই তোয়ালে আর পয়েন্ট ফরটি- ফাইভের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।

তোয়ালেটা আছে, কিন্তু অটোমেটিকটা নেই। বিছানার পাশে নাইট টেবিলে রেখেছিল ওটা।

কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে আবার আলো নেভাল রানা, অন্ধকারে হাতড়ে দরজার দিকে এগোল। গুলির আওয়াজ এখনও যেন বাড়ির ভেতর প্রতিধ্বনি তুলছে। নিচতলায়, ভাবল ও। সচল হাঁটু ভাঁজ হলো, খালি পা কার্পেটের ওপর কোন শব্দ করছে না।

থামল রানা, আবার কান পাতল, ইতিমধ্যে পৌছে গেছে সিঁড়ির মাথায়। সিঁড়ির নিচে, একপাশে একটা দরজা। মনে হলো দরজার পিছন থেকে শব্দ আসছে। আলো যে আসছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বান্না, ভাবল রানা। ধড়াস ধড়াস করছে বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ড। ঝান পৌঁচেছে, কিন্তু বোবা লোকটা ওদেরকে সাবধান করে দেয়নি। ঠিক তাই ঘটেছে, আর নয়তো বেলাডোনা একাই দাঁড়িয়েছে ঝানের সামনে।

নামতে শুরু করল রানা, সাবধানে। দরজার ঠিক বাইরে থামল ও। ভোঁতা শব্দ বেরিয়ে আসছে ভেতর থেকে। ধীরে ধীরে শব্দগুলো চেনা গেল, ফোঁপানোর আওয়াজ়, দুর্বোধ্য শব্দ করে কে যেন করুণা ভিক্ষা চাইছে। আর দেরি না করে আস্তে ঠেলা দিল রানা। খুলে গেল কবাট।

দেখল ঝান নাটকের শেষ দৃশ্য অভিনীত ‘হচ্ছে।

কামরাটা লম্বা। বেশিরভাগ জায়গা দখল করে রেখেছে পালিশ করা ওক কাঠের একটা টেবিল, সেটার চারদিকে অনেকগুলো চেরার সাজানো রয়েছে। দূরের দেয়ালটা মনে হলো কাঁচের তৈরি। এই বিশাল জানালার কাছে এমন একটা দৃশ্য দেখল রানা, স্থির পাথর হয়ে গেল ও, যেন দোর-গোড়ায় পৌঁছে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়েছে।

দৃশ্যটা ভীতিকর। দেয়াল ঘেঁষে পড়ে রয়েছে মলিয়ের ঝানের বিশাল শরীর, একটা কাঁধ আর দুটো পা ঢাকা পড়ে আছে তাজা রক্তে। একটা বুলেট কাঁধের হাড় গুঁড়ো করে দিয়েছে, বাকি দুটো চুরমার করেছে দু’পায়ের হাঁটু। ঝানের শিশুর মত সরল, লালচে মুখ আমূল বদলে গেছে, এখন সেটা ব্যথা আর আতঙ্কে বিকৃত একটা মুখোশ।

তার সামনে উঁচু টাওয়ারের মত দাঁড়িয়ে রয়েছে, সম্পূর্ণ নগ্ন, বান্‌না বেলাডোনা।