আবার উ সেন – ২.১

এক

‘এখন আমরা কি করব?’ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল রিটা, স্যাবে বসে মলিয়ের ঝান আর পিয়েরে ল্যাচাসির উদ্দেশে হাসিমুখে হাত নাড়ছে। ‘একে প্রতিযোগিতা বলে? এ তো স্রেফ জুয়া!…না! জুয়া-ও নয়, খুন করার পাঁয়তারা! রানা, ওরা তোমাকে মেরে ফেলার ফাঁদ পেতেছে!’

চুপ করে বসে থাকো, সীট বেল্ট বাখো, আর হোঁচট খাওয়ার জন্যে তৈরি হও।’ রানার ঠোঁট প্রায় নড়লই না বলা যায়। জোর গলায় ঝানের উদ্দেশে বলল ও, ‘সকালে আপনাদের সাথে আবার দেখা হচ্ছে। সার্কিটে। ঠিক দশটায়।’ কোমরে হাত দিয়ে পোর্টিকোয় দাঁড়িয়ে রয়েছে মলিয়ের ঝান।

মাথা ঝাঁকিয়ে হাত নাড়ল সে। স্যাবের সামনে পিক-আপ ট্রাকটা রয়েছে, গাইড করে নিয়ে যাচ্ছে ওদেরকে।

র‍্যাঞ্চ দেখে ফেরার পর কফি আর ব্র্যান্ডি পরিবেশন করা হয়েছিল, তখনই মলিয়ের ঝান আর পিয়েরে ল্যাচাসি ক্ষমা চেয়ে নেয়। ‘জমিজমা থাকার এই এক জ্বালা,’ রানাকে বলল ঝান, ‘কাগজ পত্র নিয়ে একদিন বসতেই হয়-আজ সেই দিন। তবে আপনারাও তো ক্লান্ত, বিছানায় এক হওয়ার সময় হয়েছে। বিশেষ করে আপনার গভীর একটা ঘুম হওয়া দরকার, মি. রানা। কাল আপনার রেস আছে।’

বিছানায় এক হওয়ার, নাকি বিছানার সাথে এক হওয়ার?’ যদিও হাসিমুখে করা হলো, প্রশ্নটা রানার তীক্ষ্ণ।

চট্ করে একবার রিটার দিকে তাকিয়ে অমায়িক হাসল ঝান। ‘দুঃখিত, স্লিপ অভ টাং,’ বলল সে, রানার সংশোধনীটা মেনে নিল।

এরপর ধন্যবাদ জানাল রানা, বলল গাইড লাগবে না, ওরা নিজেরাই গেস্ট কেবিনে যেতে পারবে। কিন্তু পিক–আপটা তারপরও থাকল, ঝানও হাঁ-না কিছু বলল না।

গাইড থাকা মানে, রানা ভাবছে, বনভূমির ভেতর পথ হারিয়ে ফেলার সুযোগ নেই। অথচ গোটা র‍্যাঞ্চটাকে চারদিক থেকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা খুব জরুরী। কাল কি হয় না হয় বলা যায় না, সুযোগ নিতে হলে আজ রাতেই। পরে আর সময় না-ও পাওয়া যেতে পারে।

র‍্যাঞ্চটাকে মাঝখান থেকে দু’ভাগ করেছে মেইন হাইওয়ে, বাঁক নিয়ে সেটায় ওঠার পরপরই মাঝখানের দূরত্ব কমিয়ে পিক-আপের একেবারে পিছনে চলে এল স্যার। পিক-আপকে অনুসরণ করে কেবিনে ফিরতে পারে ওরা, পরে আবার ফাঁকা রাস্তায় স্যাব নিয়ে বেরুতে পারে, কিন্তু রানার সন্দেহ ওদেরকে পৌঁছে দেয়ার পরও পিক-আপ ফিরে যাবে না। ‘আমার ধারণা, জঙ্গলের ভেতর কোথাও লুকিয়ে থাকবে ড্রাইভার,’ রিটাকে বলল ও। ‘আমাদের ওপর নজর রাখার জন্যে আজ রাতে ওকেই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আজ বিকেলে যা দেখেছি বা দেখিনি তা থেকে ধরে নেয়া চলে ইলেকট্রনিক্সের চেয়ে জ্যান্ত মানুষের ওপর বেশি ভরসা রাখে ঝান। বিকেলে ওরা আড়িপাতা যন্ত্রের সন্ধানে কেবিনের চারদিকে তল্লাশি চালিয়েছিল, কিছুই চোখে পড়েনি। ‘লোকের কোন অভাব নেই তার, তাছাড়া হাইওয়ে পেট্রল তো আছেই।

অন্ধকার গাড়ির ভেতর নড়েচড়ে বসল রিটা। ‘তারমানে আমরা বন্দী।

‘একটা পর্যায় পর্যন্ত, হ্যাঁ। যদিও, হাতে সময় নেই বললেই চলে। ল্যাবরেটরিটা একবার দেখা দরকার। কনফারেন্স সেন্টারে কিভাবে আমরা ঢুকব সেটাও তোমাকে একবার দেখাতে চাই। ভূল হলো, তুমি না-একা আমি ঢুকব। এই, সীট বেল্ট শক্ত করে বেঁধেছ তো?’

সম্ভবত নার্ভাস বোধ করছে বলেই রেগে গেল রিটা। ‘এক কথা দু’বার বলবে না। কি করতে চাইছ শুনি?

‘যাই করি, দেখতে পাবে। আজ যা শুনেছি, তারপর আর বিবেকের কামড় খেতে হবে না। আপনমনে হাসল রানা। ‘কিছু লোককে জখম করতে আমার কোন আপত্তি নেই।

হাইওয়ে ছেড়ে এল ওরা, বাঁক নিয়ে ঢালের দিকে এগোচ্ছে, আর চার মাইলটাক সামনে। আগে শালাকে জঙ্গলের ভেতর নিয়ে যাই, ভাবল রানা, ড্যাশবোর্ডের একটা বোতাম টিপে নাইটফাইন্ডার গ্লাস রিলিজ করল। গাড়িতে সব সময় থাকে এটা, সাথে চারকোনা লম্বাটে একটা কন্ট্রোল বক্স আছে, এক দিকে প্যাড লাগানো, মাথায় পরা যায়। ফোকাস আর উজ্জ্বলতা নিয়ন্ত্রণ করা হয় ডান দিক থেকে, সামনের দিকে বেরিয়ে আছে দুটো লেন্স, ছোট এক জোড়া বিনকিউলারের মত। এক হাত দিয়ে সেটটা মাথায় পরল রানা, সুইচ অন করল।

অন্ধকারে গাড়ি চালানোর কয়েকশো ঘণ্টা অভিজ্ঞতা রয়েছে রানার, নাইটফাইন্ডারের সাহায্য নিয়ে। গ্লাসগুলোর সাহায্যে, অন্ধকার যতই গাঢ় হোক, সব কিছু প্রায় দিনের মতই উজ্জ্বল দেখা যায়। অন্তত একশো গজ দূরে কি আছে দেখতে পাওয়া ড্রাইভারের জন্যে কোন সমস্যা নয়।

সিস্টেমটা অ্যাডজাস্ট করে নিয়ে পিক-আপের আরও কাছাকাছি চলে এল রানা। ঢাল থেকে এখন আর মাত্র এক মাইল দূরে ওরা। রিটার উত্তেজনা উপলব্ধি করে হাসল ও, কি করতে যাচ্ছে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করল। একটু পরই আরও গাঢ় হবে অন্ধকার। কিছু অ্যাকশন দেখার সুযোগ হবে তোমার। তারপর আলোর বন্যা বয়ে যাবে। ভাগ্য ভাল হলে, পিক-আপটার তেমন ক্ষতি না করে রাস্তা থেকে বিদায় নেবে লোকটা। ওটা আমাদের দরকার।’

জঙ্গলের কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা। ‘রেডি, রিটা। হোল্ড অন।’ বোতাম টিপে স্যারের আলো নিভিয়ে দিল রানা, নাইটফাইন্ডারে চোখ। মুহূর্তের জন্যে রাস্তার একধারে সামান্য একটু সরে গিয়ে আবার সিধে হলো পিক-আপ। আকস্মিক অন্ধকারে স্যাবের কাঠামো অস্পষ্টভাবে হয়তো দেখতে পাচ্ছে, তবে ঘাবড়ে গেছে ড্রাইভার।

পিছনে বেশিক্ষণ থাকল না রানা। রাস্তার একপাশে সরে এসে সাবলীলভঙ্গিতে একসিলারেটরে চাপ দিল। রেভকাউন্টারের কাঁটা দ্রুত উঠতে শুরু করে তিন হাজারের ঘর ছাড়িয়ে গেল, সেই সাথে সচল হয়ে উঠল টার্বো চার্জার।

তীরবেগে ছুটল স্যাব, অনায়াসে পাশ কাটাচ্ছে পিক-আপকে। দুটো গাড়ির মাঝখানে সামান্যই ফাঁক, সেটা আরও কমিয়ে আনল রানা, ফলে রাস্তার কিনারায় সরে গিয়ে ট্রাক থামাতে বাধ্য হলো ড্রাইভার। অন্ধকারে খুব বেশি কিছু দেখতে পায়নি সে, হয়তো ঘন কালো একটা কাঠামোকে স্যাৎ করে পাশ কাটাতে দেখেছে। পরমুহূর্তে অবশ্য হেডলাইটের আলোয় স্যাবটাকে পরিষ্কারই দেখতে পেল সে, যদিও চোখের পলকে সামনের অন্ধকারে আবার সেটাকে অদৃশ্য হতেও দেখল, পিছনে কোন আলো নেই।

‘লোকটা এতক্ষণে স্পীড বাড়াচ্ছে, আমাদেরকে ধরার চেষ্টা করবে,’ বলল রানা। শক্ত হও।’ ব্রেক চাপল ও, গিয়ার বদল করল, হুইল ঘোরাল দু’হাতে। পিছলে গেল চাকা, যদিও রানার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে গাড়ি। আবার গিয়ার বদলে স্যারকে ডান দিকে ঘোরাল ও, ঘুরে গিয়ে ফেলে আসা পথের দিকে ছুটল গাড়ি। মাত্র কয়েক গজ, তারপরই দাঁড়িয়ে পড়ল।

‘এই এল বলে।’ অভিজ্ঞ ফাইটার পাইলটের মত শান্ত আর নির্লিপ্ত রানা, যেন শত্রুঘাঁটিতে হামলা করার জন্যে এক ঝাঁক প্লেনকে নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ছোট একটা বোতামের কাছে নেমে গেল হাত গিয়ার লিভারের ঠিক নিচে। পিক-আপের আলো দেখা গেল, দ্রুত উজ্জ্বল হচ্ছে। আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে স্যাবকে পরিষ্কার দেখতে পাবে ড্রাইভার।

এখনও অন্ধকারে রয়েছে ওরা, বোতামটায় চাপ দিল রানা। স্যাবের নাম্বার প্লেট একটা ঢাকনির মত খুলে গেল, ভেতরে একটা এয়ারক্রাফট লাইট, বাম্পারের নিচে এবং নাম্বার প্লেটের পিছনে ফিট করা। দপ্ করে জ্বলে উঠল চোখ ধাঁধানো সাদা আলো।

আলোর টানেল গ্রাস করল পিক-আপকে। কল্পনায় দেখতে পেল রানা হুইলের সাথে কুস্তি লড়ছে ড্রাইভার, নিজের অজান্তেই এক হাতে চোখ ঢেকে ফেলেছে, ব্রেক আর ক্লাচ চেপে ধরেছে দুই পায়ে।

রাস্তার একদিকে সরে গেল পিক-আপ, একটা গাছের সাথে ঘষা খেলো। আলোর বন্যা থেকে বেরুতে পারলেও, এখনও চোখে কিছু দেখছে না ড্রাইভার। ভুল দিকে হুইল ঘোরাল সে, রাস্তার ধারে লাটিমের মত ঘুরতে শুরু করল পিক- আপ। রাস্তার উঁচু কিনারার সাথে বাড়ি খেলো পিছনের চাকা, গাছপালার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সামনের চাকা। মনে হলো জঙ্গলের ভেতর একটা দৈত্য উন্মাদ হয়ে উঠেছে। ঘন ঘন কয়েকটা সংঘর্ষের আওয়াজ শোনা গেল, বার কয়েক উল্টে যাবার উপক্রম করল গাড়িটা, তারপর একটা গাছের সাথে সরাসরি ধাক্কা খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

‘হেল!’ ক্ষোভ প্রকাশ করল রানা, এক ঝটকায় মাথা থেকে খুলে ফেলল নাইটফাইন্ডার। ‘কোথাও যাবে না,’ চেঁচিয়ে নির্দেশ দিল রিটাকে, ছোঁ দিয়ে তুলে নিল ফ্ল্যাশলাইট, হোলস্টার থেকে আরেক হাতে চলে এল ভি-পি-সেভেনটি অটোমেটিক। লাফ দিয়ে স্যাব থেকে নেমে ছুটল পিক-আপের দিকে।

আশ্চর্য একটা দৃশ্য-ঠিক যেন গাছে চড়তে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে পিক-আপটা, খানিকটা উঠে এক দিকে কাত হয়ে পড়েছে। একটা পাশ অনেক জায়গায় ভুবড়ে গেছে। তবে কোথাও ভাঙা কাঁচ দেখল না রানা। ছোট্ট ক্যাব-এর ভেতর ড্রাইভারকে দেখে ‘ফুস’ করে আওয়াজ করল মুখ দিয়ে। সীটের ওপর হেলান দিয়ে শুয়ে রয়েছে লোকটা, মাথাটা এমনভাবে দুলছে যেন কোন অবলম্বন নেই। গাছের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষের প্রচণ্ড ঝাঁকিতে ভেঙে গেছে ঘাড়।

টানা-হ্যাঁচড়া করে দরজাটা খুলল রানা, ড্রাইভারের পাল্স্ দেখল। তাৎক্ষণিক মৃত্যু, কি ঘটছে বুঝতেই পারেনি লোকটা। দু’এক সেকেন্ডের জন্যে মনটা খারাপ হয়ে গেল রানার। লোকটাকে মেরে ফেলার কোন ইচ্ছে ওর ছিল না। সামান্য দু’একটা আঘাত পেলেই যথেষ্ট ছিল।

ব্যাজ দেখে জানা গেল ড্রাইভার ঝান সিকিউরিটির লোক ছিল। লাশটা ট্রাক থেকে নামানোর সময় হোলস্টারটাও দেখল রানা, ভেতরে স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন, পয়েন্ট ফরটি ফোর ম্যাগনাম-মডেল টোয়েনটি-নাইন রয়েছে। ওর সন্দেহই তাহলে ঠিক, ওদেরকে পাহারা দিয়ে রাখার দায়িত্ব আজ রাতে এই লোকের ওপরই ছিল।

কাঁধে করে খানিকদূর বয়ে এনে ঘাসের ওপর লাশটা নামাল রানা। টর্চের আলো ফেলে আশপাশের গাছগুলো ভাল করে দেখে রাখন, পরে ফিরে এসে যাতে খুঁজে পায়। গাছের ডাল আর পাতা দিয়ে গোপন করল লাশটা তারপর স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন নিয়ে ফিরে এল পিক-আপের কাছে, স্টার্ট নেয় কিনা দেখবে।

প্রথমবারের চেষ্টাতেই স্টার্ট নিল, গাছের খানিকটা ছাল তুলে নিয়ে পিছিয়ে এল পিক-আপ, মনে হলো এখনও এটাকে দিয়ে কাজ হবে। ট্যাংক প্রায় অর্ধেকের মত ভরা, আর সব গজ রিডিংও স্বাভাবিক। আলো থেকে দূরে রাখল চোখ, পিক-আপটাকে স্যাবের পাশে নিয়ে এল রানা।

‘পারবে, ট্রাকটাকে সামলাতে?’ রিটাকে জিজ্ঞেস করল ও। স্যাব থেকে নেমে এসেছে সে।

রিটা এমনকি জবাব দেয়ারও প্রয়োজন বোধ করল না, সোজা পিক-আপে উঠল, দায়িত্ব নেয়ার জন্যে তৈরি। রানার নির্দেশ পেল সে, তার পিছু পিছু ঢাল বেয়ে উঠবে রানা, কেবিনের সামনে থামতে হবে তাকে।

স্যাবে উঠে প্রথমে রানা নাম্বার প্লেটটা আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনল, এয়ারক্রাফট লাইট নিভিয়ে হেডলাইট জ্বালল, তারপর চালু করল এঞ্জিন। ধীরে ধীরে পিক-আপ চালাল রিটা। ওটার পিছু পিছু, কোন ঘটনা ছাড়াই, ঢালের ওপর উঠে এল স্যাব। এক সময় ওরা কেবিনের সামনে পৌঁছল।

এতক্ষণে রানা ব্যাখ্যা করল ঠিক কি করতে চায় ও। কোন পথে যাবে ওরা তাও ঠিক করা হলো। আগের জায়গাতেই রেখে যাওয়া হবে, স্যাবটাকে, তালা মারা এবং অ্যালার্ম সেনসর সেট করা অবস্থায়। অভিযানে বেরুবে ওরা পিক-আপ নিয়ে।

‘পিক-আপে ঝান সিকিউরিটির প্রতীক আঁকা রয়েছে, কেউ এটাকে বাধা দেবে বলে মনে হয় না।‘ তোবড়ানো পিক-আপের গায়ে মৃদু চাপড় মারল রানা।

ঢাল থেকে খুব তাড়াতাড়ি কনফারেন্স সেন্টারের দিকে নেমে যাবে ওরা, রিটাকে ওখানে টানেলে নামার কৌশলটা শেখানো হবে। মনো-রেল স্টেশনটাকে একবার চক্কর দিয়ে, সবশেষে, ফিরে আসবে ল্যাবরেটরি এলাকায়।

‘কাছাকাছি কোথাও পিক-আপটা লুকিয়ে রাখব, ভেতরে ঢুকব পায়ে হেঁটে, ‘ সাবধান করে দিল রানা। তারপর, এখানে ফেরার সময়, রাস্তার ধারের দুর্ভাগা বন্ধুটিকে আবার একটা অ্যাক্সিডেন্টের সাথে জড়াতে হবে।’

‘আরেকটা অ্যাক্সিডেন্ট…?’ তাকিয়ে থাকল রিটা।

‘রাস্তার কিনারা থেকে কত গাড়িই তো খাদে পড়ে যায়।’

অ্যালার্ম সিস্টেমের সেনসরগুলো জ্যান্ত করল রানা, তালা দিল গাড়িতে।

নিহত ড্রাইভারের স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন হাতে নিয়ে পিক-আপে উঠতে যাবে, হঠাৎ স্থির হয়ে গেল ও।

‘রানা! কি ব্যাপার?’

চিন্তাটা হঠাৎ করে খেলে গেছে মাথায়। ‘রিটা, পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্যে আমাদের বোধহয় বিছানায় ডামি রেখে যাওয়া উচিত। ঝান বা ল্যাচাসি আমাদের জন্যে কি চিন্তা করে রেখেছে কেউ জানি না আমরা। বিছানায় কিভাবে ডামি সাজাতে হয় তোমার জানা আছে?’

ঝাঁঝের সাথে জবাব দিল রিটা, সেই কৈশোর থেকে একবারও ধরা না পড়ে দক্ষতার সাথে কাজটা করে আসছে সে। ঘুরে দাঁড়াল, লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেল স্যান্ড ক্রীকের দিকে। একটা সিগারেট ধরিয়ে ধীরেসুস্থে ফেটারম্যান-এ ঢুকল রানা, ভারী চাদরের তলায় বালিশগুলোকে মানুষের আকৃতিতে সাজাতে খুব বেশি সময় লাগল না। কেবিনের ভেতর অন্ধকার, ফুলে থাকা আকৃতিটাকে মানুষ ছাড়া আর কিছু মনে হবে না।

পিক-আপের কাছে ফিরে এসে রানা দেখল রিটা আগেই পৌঁছে গেছে।

‘ওরা যদি কেউ আসে,’ কৌতুক করে বলল রিটা, ‘যে-কোন একটা বিছানায় একজনকেই শুয়ে থাকতে দেখবে। বলতে পারো, কি ভাববে ওরা?’

‘ভাববে তোমাকে আমি পটাতে পারিনি।’

‘অথচ তা সত্যি নয়। কিন্তু না, আমার ধারণা ওরা ভাববে তুমি একটা অক্ষম পুরুষ।

‘ভাবতে দাও,’ হেসে বলল রানা, পিক-আপে উঠতে গেল। ‘ইচ্ছে করলে তুমিও তা ভাবতে পারো।

‘ধ্যেৎ, আমি কেন তা ভাবতে যাব। আমি জানি তুমি কি…। পিছন থেকে রানার কোমরে হাত রাখল রিটা, কাছে টানল। ‘নিশ্চয়ই বলবে না কেউ আমাদেরকে দেখতে পাচ্ছে?’ নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করতে গিয়ে ঘুরে রিটার মুখোমুখি হলো রানা, অমনি মুখ তুলে ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াবার জন্যে পায়ের পাতার ওপর উঁচু হলো রিটা।

মাথা পিছিয়ে নিল রানা। ওর ঠোঁটের নাগাল না পেয়ে থতমত খেয়ে গেল রিটা, তারপর আবেদন ভরা চোখে তাকাল সে। ‘রানা?’

‘দুঃখিত,’ বলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল রানা, আর একটাও কথা না বলে ঘুরে দাঁড়াল, উঠে বসল পিক-আপে।

পাশের সীটে উঠে বসল রিটাও রাগে আর অপমানে ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছে, আড়ষ্ট হয়ে আছে শরীর, সোজা সামনের দিকে দৃষ্টি।

পরিচয়ের প্রথম দিকে রিটার ব্যবহারে তাচ্ছিল্য প্রকাশ পেয়েছিল। এক সাথে কাজ করতে হলে সম্পর্কটা স্বাভাবিক হওয়ার দরকার, তাই ভদ্রতা বজায় রেখেই একটু ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করেছিল রানা। ফল হয় বড় খারাপ, যাচ্ছেতাই বলে রানাকে রীতিমত অপমান করে রিটা। পরে নিজের ভুল বুঝতে পারে রিটা, কিন্তু অপমানটার কথা ভোলেনি রানা।

টেনশন থাকলে ঝেড়ে ফেলো,’ মৃদু কণ্ঠে বলল ও। আমার ওপর ভরসা রাখো। বিপদ এলে নিজের আগে তোমাকে রক্ষা করব।’ পরিবেশটা হালকা করার চেষ্টা। ‘দেখো দেখি, সব নেয়া হয়েছে তো?’

ধীরে ধীরে ঢিল পড়ল রিটার পেশীতে।

ভি-পি-সেভেনটি রয়েছে রানার নিতম্বের কাছে হোলস্টারে, নিহত ড্রাইভারের স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসনটা পায়ের কাছে মেঝেতে। রিটার সাথেও একটা রিভলভার রয়েছে। পিক-লক আর টুলস-এর রিঙটা নিতে ভোলেনি রানা, ভোলেনি স্যাব থেকে টর্চ আনতে। রানার দিকে তাকাল না রিটা, তবে ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল।

পিক-আপ ছেড়ে দিল রানা। প্রসঙ্গটা ও-ই আবার তুলল, ইতি টানার জন্যে। বলল, ‘দেখো সিস্টার, রাগ পুষে রেখো না। অপরাধ হয়ে থাকলে ক্ষমা করে দাও।’ অপরাধ যে হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই, এভাবে কোন মেয়েকে প্রত্যাখ্যান করা ঠিক নয়, কাজেই ক্ষমা-প্রার্থনা বিধেয়।

‘তুমি একটা অদ্ভুত মানুষ, রাগ নয়, বিস্ময়ও নয়, উপলব্ধির শান্ত প্রকাশ। যদিও মনে মনে বলা রিটার বাকি কথাগুলো রানা শুনতে পেল না, ‘তোমার সংস্পর্শে এলে ভাল না বেসে উপায় নেই, মাসুদ রানা। তোমাকে পাবার জন্যে দরকার হলে আমি তপস্যা করব।

খুক করে কেশে রানা শুরু করল, ‘দেখো সিস্টার…!

‘খবরদার!’ চোখ রাঙাল রিটা। ‘আবার যদি সিস্টার বলো…’

‘সবচেয়ে ভাল হত তোমাকে যদি মিস্টার বলা যেত…

‘ভুলে যাচ্ছ কেন, সেক্ষেত্রে আমি তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী হতাম। বেলাডোনাকে তুমি একা…’

‘ভাল কথা মনে করেছ,’ হঠাৎ চিন্তিত হয়ে পড়ল রানা। সময়ের আগে আমাদের যদি পালাতে হয়, বাননা বেলাডোনাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাব আমরা, কেমন?’

‘আগে দেখো নিজেরাই উদ্ধার পাই কিনা….

ঢাল বেয়ে নেমে এল ওরা, নাম মাত্র চালু এঞ্জিন প্রায় কোন শব্দই করছে না। পথে চাকা গড়াবার অস্পষ্ট আওয়াজের সাথে বাতাসের মৃদু শোঁ শোঁ শোনা যাচ্ছে, মাথার ওপর খিলান আকৃতির ফার গাছের পাতা কাঁপছে খস খস শব্দে। পিক- আপের শুধু সাইডলাইটগুলো জ্বালানো।

অপ্রশস্ত আরেক রাস্তায় নেমে এল পিক-আপ। ইতিমধ্যে দিগন্তরেখা ছাড়িয়ে পুরোপুরি উঠে এসেছে চাঁদ। শুধু চাঁদের আলোতেও চালানো যায়, কিন্তু তাতে সন্দেহের কারণ সৃষ্টি করা হবে, কাজেই হেডলাইট অন করল রানা। ডান দিকে বাঁক নিল গাড়ি, উঠে এল হাইওয়েতে, আর পনেরো মাইল এগোলে প্রধান প্রাচীরের কাছাকাছি এবং কনফারেন্স সেন্টারকে ঘিরে থাকা জঙ্গলের পাশে পৌঁছে যাবে ওরা।

টানেলের মুখটা খুঁজে পেতে কোন অসুবিধে হলো না। মুখ খোলার কৌশলটা রিটাকে দেখাবার পর আবার রাস্তায় ফিরে এল রানা, তারপর সারাক্ষণ র‍্যাঞ্চের আউটার পেরিমিটারের কাছাকাছি থাকল। ‘কনফারেন্সটা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে,’ রিটাকে বলল ও, আগের চেয়ে আরও সতর্কতার সাথে গাড়ি চালাচ্ছে। ‘ডেলিগেটরা এসে পৌঁছুবার আগেই জায়গাটা একবার দেখে রাখতে পারলে ভাল হত। হার্মিস যদি বড় ধরনের কোন অপারেশনের প্ল্যান করে থাকে, এজেন্টদের ব্রিফিং করার জন্যে কনফারেন্স সেন্টার আদর্শ জায়গা।’

‘ওরা কাল রাত থেকে আসতে শুরু করবে,’ বলল রিটা, কণ্ঠস্বর থেকে কৌতুকের ভাব লুকোতে পারল না।

‘কি?’

‘তোমার বান্ধবী বেলাডোনা বলল। ডিনারের আগে, পাউডার রূমে। প্রথম দলটা আসবে প্লেনে করে, কাল সন্ধ্যায়-তার মানে আজ সন্ধ্যায়- দু’জনেই খেয়াল করল, ইতিমধ্যে মাঝরাত পেরিয়ে গেছে।

‘মরে না গেলে ওদের সভায় হাজির থাকবে বান্দা।

মনো-রেল স্টেশনটা ফাঁকা, কোথাও কেউ নেই: যদিও জায়গামত বসানো ভেহিকেল র‍্যাম্পসহ ট্রেনটাকে দেখে মনে হলো যে-কোন মুহূর্তে ছাড়ার জন্যে তৈরি রাখা হয়েছে। কোন গার্ড বা ঝান পেট্রল কার, কিছুই দেখা গেল না। রাস্তার ওপর গাড়ি ঘুরিয়ে নিল রানা, তারপর সাদা বাড়ি টারার লন ঘিরে থাকা বেড়া ছাড়িয়ে এল। বড়সড় বাড়িটা আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। আরও দু’মাইল এগিয়ে ঘন গাছপালার বেষ্টনীর কাছে পৌছে গেল গাড়ি, ল্যাবরেটরির পিছনের বিল্ডিংটাকে আড়াল করে রেখেছে এই বেষ্টনী, ফাঁক-ফোকর দিয়ে লোকজনকে ভেতরে কাজ করতে দেখল ওরা। পিছনের দিকটা মনে হলো নির্জন, তবে ছোট বিল্ডিংটা ক্রিস্টমাস ট্রী-র মত জ্বলছে।

গাছপালার আড়ালে পিক-আপ রাখল ওরা, বড় বিল্ডিংটা থেকে চল্লিশ ফুটের মত দূরে। কাছ থেকে বোঝা গেল, ওটা একটা অয়্যারহাউস। এককোণে, কার্নিসওয়ালা ছাদের নিচে উঁচু স্লাইডিং ডোর। পাশাপাশি অনেকগুলো জানালা. লোহার বার দিয়ে শক্তভাবে আটকানো। কিন্তু কাছ থেকেও ভেতরটা দেখা গেল না অন্ধকারে।

সতর্কতার সাথে সামনে বাড়ল ওরা, ঘাড় আর মাথা নিচু করে। চোখ কুঁচকে চাদের আলোর ভেতর তীক্ষ্ণদৃষ্টি ফেলল রানা, ছায়ার ভেতর স্থির দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডের অস্তিত্ব উড়িয়ে দেয়া যায় না। একইভাবে ওদের পিছন দিকটায় লক্ষ রাখছে রিটা, ভোঁতা-নাক রিভলভারটা ধরে আছে শক্ত হাতে।

অয়্যারহাউস আর ছোট ল্যাবরেটরি বিল্ডিংটার মাঝখানে একটা ফাঁক আছে। মাঝ বরাবর দৃষ্টি লম্বা করে রানা দেখল দুটোর মধ্যে একটা সংযোগ আছে, সম্ভবত সরু একটা প্যাসেজ। একটু পরই ল্যাবরেটরির প্রথম জানালার কাছে পৌছে গেল ওরা। অত্যন্ত উজ্জ্বল আলো বেরিয়ে আসছে, ঘাসের ওপর লম্বাটে একটা নকশা, আরেকটু হলে গাছের বেষ্টনী ছুঁয়ে দিত।

দু’জন জানালার দু’ধারে, ধীরে ধীরে সিধে হলো। উঁকি দিল একসাথে।

অনেকগুলো মেয়ে, সচল মেশিনে কাজ করছে, প্রত্যেকের পরনে সাদা ওভারঅল, হাতে চামড়া সেঁটে থাকা রাবার গ্লাভ, মাথায় জড়ানো কাপড়ের ভেতর ঢাকা সমস্ত চুল। সবার পায়ে এক ধরনের ছোট বুট, হাসপাতালের অপারেটিং থিয়েটারে দেখা যায়। শান্ত পরিবেশ, দক্ষ হাতে নীরবে কাজ করে যাচ্ছে মেয়েগুলো।

‘আইসক্রীম প্ল্যান্ট,’ ফিসফিস করল রিটা। ‘খুকী রিটাকে একবার এইরকম একটা ফ্যাক্টরিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। একেবারে শেষ মাথায় ওটা কি বলো তো? পাস্তুরাইজার—ওখানেই সব মেশানো হয়; দুধ, ক্রীম চিনি আর ফ্লেভার।

বোবার অঙ্গভঙ্গি আর নেহাত প্রয়োজনীয় দু’চারটে শব্দের সাহায্যে আইসক্রীম ফ্যাক্টরির কোন অংশের কি কাজ ব্যাখ্যা করল রিটা। রানার ভুরু সামান্য একটু কুঁচকে থাকল, মেশানোর পর পাস্তুরাইজারে সব কিভাবে গরম করা হয় সে-সম্পর্কে রিটার অভিজ্ঞতা দেখে অবাক হয়ে গেছে। গরম করার উদ্দেশ্য জীবাণু নিধন। তারপর সব ভ্যাট-এ ভরা হয়। ভ্যাট থেকে পাঠানো হয় পাইপে, ঠাণ্ডা করার জন্যে। পাইপ থেকে চলে যায় স্টেনলেস স্টীলের তৈরি বিশাল ট্যাংকে, এই ট্যাংকই স্রোতটাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে ফ্রিজারে পাঠিয়ে দেয়। এরপর আছে অসংখ্য ইউনিট, ওখানে আকৃতি পায় আইসক্রীম, প্রান্ত জোড়া সচল একটা বেল্ট ওগুলোকে পৌঁছে দেয় ধাতব দরজা লাগানো হার্ডেনিং রূমে-আইসক্রীম শক্ত করা হয় ওখানে। জানালা থেকে ওরা দেখল, প্রতিটি কাজ নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হচ্ছে।

মাথা নামিয়ে ইঙ্গিত করল রানা, নিচু হয়ে জানালাটাকে পাশ কাটিয়ে ওর পাশের দেয়ালে চলে এল রিটা। মনে হচ্ছে সবটুকুই তোমার জানা। বলতে পারো সিস্টেমটা কতটুকু প্রফেশনাল?’

‘হানড্রেড পার্সেন্ট। ওরা এমনকি খাঁটি ক্রীম আর দুধ ব্যবহার করছে। কেমিক্যাল নয়।

‘মাত্র একবার একটা ফ্যাক্টরিতে ঢুঁ মেরে এত কিছু শিখে ফেলল খুকী?

নিঃশব্দে হাসল রিটা। ‘আইসক্রীম আমি পছন্দ করি. ফিসফিস করে বলল সে। ‘আগ্রহ থাকলে খোকাও শিখতে পারত। ওটা যে প্রফেশনাল সেট-আপ তাতে কোন সন্দেহ নেই। ছোট বটে, তবে প্রফেশনাল।

‘বাজারে ছাড়ার জন্যে প্রচুর পরিমাণে বানাতে পারবে?’

মাথা ঝাঁকাল রিটা বলল, ‘ছোট আকারে, হ্যাঁ পারবে। তবে ওরা সম্ভবত স্থানীয় চাহিদা মেটাচ্ছে।’

রিটার হাত ধরে টানল রানা, পরবর্তী সেকশনের দিকে এগোল। এদিকের জানালাগুলো আকারে ছোট, উঁকি দিয়ে এবার ওরা বড় একটা ল্যাবরেটরি দেখল। প্রচুর জায়গা নিয়ে বসানো হয়েছে গ্লাস টিউবিং, ভ্যাট, জটিল ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি।

ল্যাবরেটরিটা খালি, শুধু দূর প্রান্তের দরজায় ঝান সিকিউরিটির একজন গার্ড দাঁড়িয়ে রয়েছে।

‘শালা একটা বাধা,’ রিটার কানে কানে বলল রানা। ‘যদি ধরে নিই কিছু ঘটছে, তো ওখানেই। আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে, বুঝলে। অপর দিকে যেতে হলে….’

‘পিক-লক বের করো,’ রানার হাত ছুঁয়ে বলল রিটা। ‘দেখি অয়্যারহাউসের ভেতর ঢোকা যায় কিনা। আর তুমি শেষ মাথায়, কোণে চলে যাও, দেখো জানালা খুলে ঢোকা যায় কিনা

দেয়াল ধরে পিছিয়ে এল ওরা। স্লাইডিং ডোরের কাছে এসে পিক-লক কিটটা হাত-বদল করল রানা, সেটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠা রিটাকে পিছনে ফেলে সামনে এগোল, জানালা গুনতে গুনতে হিসেব পাবার চেষ্টা করছে ল্যাবরেটরির পাশের কামরা কোথায় শুরু হয়েছে। দু’বার ভুল করার পর ঠিক জানালাটা খুঁজে পেল ও। বাঁ দিকের কোণ থেকে উঁকি দিয়ে ভেতরে তাকাতেই মলিয়ের ঝান আর পিয়েরে ল্যাচাসিকে দেখতে পেল ও-ছোট একটা চেম্বারে পায়চারি করছে দু’জন। চেম্বারটা যে আসলে একটা সেল, বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল রানার। প্যাড লাগানো সেল। সেলের মাঝখানে মেঝের সাথে আটকানো নরম দুটো চেয়ার রয়েছে, দুটোতেই বসে রয়েছে ঝানের দু’জন ইউনিফর্ম পরা কর্মচারী প্রাণবন্ত আলোচনা চলছে, কর্মচারীদের সাথে ঝান আর ল্যাচাসির।

রানা, এখনও মাথা নামিয়ে, জানালায় কান ঠেকিয়ে কোন রকমে শুনতে পেল কথাগুলো, কিন্তু অর্থ করতে পারল না, তারপরই আলোচনার মাঝখানে স্বভাবসুলভ ভরাট গলায় হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল ঝান। তারপর, হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠল সে, যেন এরচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলাপ আর হয় না।

‘তাহলে, জনি,’ চেয়ারে বসা লোকদের একজনকে বলল সে, ‘তুমি আমাকে তোমার বাড়ির চাবি দেবে, গাড়ি নিয়ে ঢুকতে দেবে ভেতরে, আর তারপর আমি তোমার স্ত্রীর ওপর জোর খাটালেও তুমি আপত্তি করবে না, তাই তো?’

জনি নামের লোকটা একগাল হাসল। ‘আপনার যা খুশি, বস্। যান না, যান; কেউ আপনাকে বাধা দিচ্ছে না। স্পষ্ট স্বরে; পরিষ্কার উচ্চারণে, সুস্থ অবস্থায় সজ্ঞানে কথা বলছে সে, নিজের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।

অপর লোকটা যোগ দিল আলোচনায়, ‘সবাই খুশি থাকলেই আমি খুশি। শুধু বলে দিন কি করতে হবে। নিন না, নিন, আমার চাবিটাও নিয়ে যান। কোন সমস্যা নেই। গাড়িটা নিয়ে রওনা হয়ে যান। লোকের কিসে আনন্দ শুধু সেদিকটা দেখি আমি। আমাকে যা করতে বলা হবে ঠিক তাই করব।’ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলছে সে, কোন হুমকি, চাপ বা প্রভাবের মুখে বাধ্য হয়ে নয়।

‘তারপরও কি তুমি কাজ করবে এখানে?’ প্রশ্নটা এল পিয়েরে ল্যাচাসির কাছ থেকে।

‘কেন করব না!’ দ্বিতীয় লোকটা বিস্ময় প্রকাশ করল।

এখানের কাজ ছাড়তে আমার খুব খারাপ লাগবে। এখানকার পরিবেশ, সব কিছু আমার ভারি ভাল লাগে,’ প্রথম লোকটা অর্থাৎ জনি বলল।

‘মন দিয়ে আমার কথা শোনো, জনি।’ হেঁটে জানালার পাশে চলে এসেছে মলিয়ের ঝান, কাঁচ আর পর্দা না থাকলে বাইরে থেকে তাকে ছুঁতে পারত রানা। ‘তোমার কি একটুও দুঃখ বা রাগ হবে না আমি যদি তোমার স্ত্রীকে রেপ করি, আর তারপর তাকে খুন করে ফেলি? রাগ বা ঘৃণা, কিছুই হবে না?’

করে ফেলি না বলে করে ফেলুন, মি. ঝান, প্লীজ।’ লোকটা শুধু যে হাসছে তাই নয়, তার চেহারায় অকৃত্রিম আবেদনের ভাব ফুটে উঠল। ‘বলেছি তো, আপনার সুখই আমার আনন্দ। এই নিন, চাবি। বলেছিলাম না, দেব?’

ঘরের আরেকপ্রান্ত থেকে মলিয়ের ঝানের দিকে তাকাল পিয়েরে ল্যাচাসি। তার কণ্ঠস্বর শান্ত হলেও, বাইরে থেকে প্রতিটি শব্দ পরিষ্কার শুনতে পেল রানা। দশ ঘণ্টা, ঝান। দ-শ ঘ-অণ্টা! অথচ এখনও ওদের দু’জনের ওপরই প্রভাব রয়েছে।’

‘বিস্ময়কর। যা আশা করেছি তারচেয়ে অনেক ভাল।’ মলিয়ের ঝান তার গলা চড়াল, জনি, তোমার স্ত্রীকে তুমি ভালবাস। তোমাদের বিয়েতে আমি উপস্থিত ছিলাম। তোমরা খুব সুখী দম্পতি। কেন তুমি আমাকে এ-ধরনের জঘন্য একটা কাজ করতে দেবে?’

‘কারণ সব দিক থেকে আপনি আমার চেয়ে বড়, মি. ঝান। আপনি হুকুম করবেন, আমি পালন করব। দুনিয়াটাই তো এভাবে চলছে।

মি. ঝানের হুকুম তোমার মনে কোন প্রশ্ন তুলবে না?’ জিজ্ঞেস করল ল্যাচাসি, তার সরু গলা কানের জন্যে অত্যাচার বিশেষ।

কিসের প্রশ্ন? এই না আমি বললাম, দুনিয়াটাই চলছে এভাবে? আর্মিতে কি হয়? সিনিয়র অফিসারের কাছ থেকে অর্ডার পান আপনি, তার অর্ডার পালন করেন।’

‘কোন প্রশ্ন ছাড়াই?

‘একশোবার।

‘একশোবার।’ অপর লোকটা মাথা ঝাঁকাল। ‘তাই তো নিয়ম। আমরা নিয়মের দাস।

জানালার কাছ থেকে বিড়বিড় করে কি যেন বলল ঝান, শুনতে পেল না রানা। তবে ঘন ঘন মাথা নাড়তে দেখে বুঝল, লোক দুটোর প্রতিক্রিয়া বিশ্বাস করতে পারছে না সে।

একপাশে খানিকটা ঘুরল ল্যাচাসি, মুহূর্তের জন্যে বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠার সাথে রানার মনে হলো কাঁচ ভেদ করে তার দৃষ্টি সরাসরি ওর ওপর নিবদ্ধ হলো। ‘হতে পারে অবিশ্বাস্য, ঝান, হতে পারে প্রায় অলৌকিক-কিন্তু সত্যিকার ব্রেক-থ্র। উই হ্যাভ ডান ইট, ফ্রেন্ড! অসম্ভবকে সম্ভব করেছি! ফলাফলটা কি দাঁড়াবে ভাবো একবার!

ঝানকে মনে হলো গভীর চিন্তায় মগ্ন, কথা বলছে ঘোরের মধ্যে, ‘ফলাফল সম্পর্কেই ভাবছি আমি…. বাকিটা রানা শুনতে পেল না, জানালা থেকে মাথা নামিয়ে পিছিয়ে এল ও. দেয়াল ঘেঁষে নরম পায়ে ফিরে চলল। তারপরই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ও, শরীরটা শক্তভাবে সেঁটে গেল দেয়ালের সাথে। ওর দিকে কি যেন আসছে।

অভ্যাসবশত আগেই হাতে চলে এসেছে ভি-পি-সেভেনটি।

গার্ড? কিন্তু পাহারায় থাকার সময় এত জোরে কেউ হাঁটে না। তারপর রানা চিনতে পারল। রিটা

‘চলো ভাগি। জলদি!’ রীতিমত হাঁপাচ্ছে রিটা। ‘একজন গার্ড আরেকটু হলে দেখে ফেলেছিল আমাকে। আর ওই অয়্যারহাউসে ফ্রিজিং ইউনিটে এত আইসক্রীম আছে গোটা টেক্সাস রাজ্যে এক মাস সাপ্লাই দেয়া যাবে।

ওরা যখন পিক-আপের কাছে পৌছুল, ততক্ষণে ওভারটাইম খাটতে শুরু করেছে রানার মাথা। এঞ্জিন স্টার্ট দিল ও, কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করার পর ক্লাচ ছেড়ে ধীরগতিতে এগোল।

রাস্তা ফাঁকা। ‘ওরা তাহলে আইসক্রীম স্টক করছে,’ হাইওয়ে থেকে বাঁক নেয়ার পর বলল ও।

‘হ্যাঁ।’ ইতিমধ্যে দম ফিরে পেয়েছে রিটা। ‘অয়্যারহাউসের ভেতর অনেকগুলো প্রকাণ্ড আকারের রেফ্রিজারেটর আছে, আমি মাত্র তিনটেতে উঁকি দিয়েছি। তারপরই গার্ডটা ভেতরে ঢুকল। ভাগ্যিস রেফ্রিজারেটরের কোন দরজা খুলে রাখিনি…কি যে ভারী এক একটা। মেইন ডোরটাও প্রায় বন্ধ করে রেখেছিলাম, শুধু মাথা গলাবার মত একটু ফাঁক ছিল…’

রানা জানতে চাইল, ‘গার্ড বা আর কেউ তোমাকে দেখেছে?’

‘না।’

‘ঠিক জানো?’

‘হ্যাঁ। ‘গার্ড ছাড়া আর কেউ ছিল না। দেখতে পেলে বুলেটের মত ছুটে আসত। প্রকাণ্ড একটা কোল্ড স্টোরের গায়ে লেপ্টে ছিলাম ভয়ে। দরজা খুলে উঁকি দিল সে, তারপর ফিরে গেল…ল্যাবরেটরি সেকশনের দিকে।’

‘গুড। এবার আমার তরফ থেকে কিছু দুঃসংবাদ শোনার জন্যে তৈরি হও। ঢালের কাছে পৌঁছল পিক-আপ, ওপরে ওঠার সময় কি কি দেখেছে আর শুনেছে সব রিটাকে বলল রানা।

‘প্যাড লাগানো সেল? সেলে দু’জন লোক, অস্বাভাবিক যে-কোন হুকুম মানার জন্যে একপায়ে খাড়া? স্ত্রীকে রেপ করে মেরে ফেললেও আপত্তি নেই! শিউরে উঠল রিটা।

রিটা যে ব্যাপারটাকে হেসে উড়িয়ে দেয়নি সেজন্যে কৃতজ্ঞবোধ করল রানা। হ্যাঁ, দেখে লোক দু’জনকে অত্যন্ত সুস্থ আর স্বাভাবিকই মনে হলো বটে। ঝান আর ল্যাচাসি যে ওদেরকে কিছু দিয়েছে, বোঝার কোন উপায় নেই। বলতে কনেছি দশ ঘণ্টা পর্যন্ত প্রভাবের মধ্যে রয়েছে ওরা। আর যদি প্যাড লাগানো সেনের কথা মনে রাখো, বুঝতে অসুবিধে হয় না লোক দু’জনকে আসলে হিউম্যান গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

‘চোখের মণি পর্যন্ত ওষুধে ঠাসা?’

‘হ্যাঁ। চিন্তার বিষয় হলো, ওদের চেহারায় বা কথায় ব্যাপারটা ধরা পড়ে না। হুকুম শুনছে, পালন করছে, ব্যস। যুক্তি বা বিবেকের ধার ধারছে না। কেন, রিটা? মানুষকে ওরা বিচার বুদ্ধিহীন খুনী বানাতে চাইছে, কিংবা এ-ধরনের অন্য কিছু? কেন?’

‘কিভাবে?’ জবাব জানা নেই, রিটাও প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল। ‘এই, তুমি থামছ কেন?’

রানা বলল রিটাকে পিক-আপে বসে থাকতে হবে। ‘ড্রাইভারকে ঢালের মাথায় নিয়ে যাব আমরা, আর কোন উপায় নেই। গাড়ির পিছনে আমিই ওকে ভুলব। এ-ধরনের কাজে তোমার হাত না লাগালেও চলবে।

রানাকে মহৎপ্রাণ, সাহসী ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করার পর রিটা জানাল, তাকে লাশ দেখে ভয় পাবার পাত্রী মনে করার কোন কারণ নেই। যদিও রানার সাথে তর্ক না করে ক্যাবেই বসে থাকল সে। নেমে গেল রানা, লাশ নিয়ে ফিরে এল একটু পরই। ট্রাকের পিছন থেকে নেমে আবার গাছপালার ভেতর ফিরে গেল ও. চিহ্ন থাকলে নষ্ট করে আসবে।

‘ওরা যদি এমন কোন ওষুধ বানিয়ে থাকে, বাইরে থেকে যার প্রভাব ধরা পড়ে না…, রানা ফিরে আসতেই শুরু করল রিটা।

‘হ্যাঁ।’ ঢাল বেয়ে ওপরে উঠছে পিক-আপ। ‘হ্যাঁ।’ এরই মধ্যে সামান্য হলেও যেন অর্থবহ হয়ে উঠছে ধারণাটা। ‘কোন পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া নেই। চোখ ঢুলুঢুলু নয়, মুখে কথা আটকাচ্ছে না, হাত কাঁপছে না। ওষুধ দেয়ার পরও যদি মানুষ স্বাভাবিক কাজ কর্ম করতে পারে…’

‘শুধু একটা ব্যাপার বাদে,’ চিন্তার ঘোড়াটাকে রানার সাথে রিটাও ছুটিয়ে নিতে চেষ্টা করছে। তারা এমন সব হুকুম পালন করতে রাজি, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যেগুলো সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হবে, বা মনে বাধার সৃষ্টি হবে….

‘হাজার অস্ত্রের সেরা অস্ত্র হতে পারে,’ বলল রানা। তারপর, কেবিনের সামনে পৌছে, জিজ্ঞেস করল, ‘আইসক্রীম, তাই না? তোমার ধারণা ওটাই ডেলিভারি সিস্টেম?

মুহূর্তের জন্যে কাঁপ উঠল রিটার শরীরে, যেন গা ঘিন ঘিন করছে। ‘পরিমাণে বিষটা যথেষ্ট।

আমি ভেবেছিলাম আইসক্রীম তুমি পছন্দ করো।’

‘করতাম। এখন ঘেন্না লাগছে।

গাড়ি থেকে নামল ওরা, লাশটাকে ক্যাবে এনে হুইলের পিছনে বসাতে রানাকে এবার সাহায্য করল রিটা। পিক-আপে নিজেদের কিছু রয়ে গেছে কিনা পরীক্ষা করে দেখল রানা, ড্রাইভারের হোলস্টারে ফেরত দিল রিভলভারটা। লাশের পাশে বসে হুইল ধরল রানা, এঞ্জিন স্টার্ট দিল। রিটা জেদ ধরে চেপেচুপে রানার পাশে বসল। লাশের ওপর ঝুঁকে ট্রাক ছেড়ে দিল রানা, ধীরগতিতে টাল কোয় নামাতে লাগল ওরা।

ঢালগুলোর মধ্যে যেটা সবচেয়ে খাড়া সেটার মাথায় পৌছে হ্যান্ডব্রেকের সাহায্যে পিক-আপ দাঁড় করাল রানা, নামতে সাহায্য করল রিটাকে সাবলীলভাবে চালু রয়েছে এঞ্জিন, চাকাগুলো রয়েছে একটু তেরছাভাবে। রিটার উদ্দেশে মাথা ঝাঁকাল ও, পথ থেকে যেন সরে থাকে সে। ড্রাইভারের পাশের জানালা দিয়ে ঝুঁকে পড়ল ও, তারপর হ্যান্ডব্রেক ছেড়ে দিল।

কয়েক গজ এগোল ট্রাক, তারপর লাফ দিল রানা। ঘাসের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে দেখল পিক-আপের গতি বাড়ছে, রাস্তার একদিক থেকে চলে যাচ্ছে আরেক দিকে।

কি ঘটবে দেখার জন্যে এতই মগ্ন, খেয়ালই নেই যে পাশে চলে এসে ওর একটা হাত চেপে ধরেছে রিটা 1

হেডলাইটের আলোর ওপর চোখ রেখে পিক-আপের গতি ঠাহর করছে ওরা। ঢাল বেয়ে দ্রুত নেমে যাচ্ছে ট্রাকটা, অস্থির এবং দিকভ্রান্ত। প্রথম কর্কশ আওয়াজটা শুনে বুঝতে পারল, গাছের সাথে ধাক্কা খেয়েছে। হেডলাইটের আলো শূন্যে ছুটোছুটি করার ভঙ্গিতে নাচল কিছুক্ষণ। শব্দ শুনে বোঝা গেল গাছের সাথে ধাক্কা খেতে খেতে একটু একটু করে ভাঙছে পিক-আপ!

ব্যাপারটা শেষ হতে প্রায় বিশ সেকেন্ডের মত সময় লাগল। দূর থেকে বোঝা গেল না ট্রাকটা উল্টে গেছে কিনা, তবে সংঘর্ষ বা পতনের জোরাল একটা আওয়াজ পেল ওরা। ট্যাংক বোধহয় ফেটে গিয়েছিল, দপ করে আগুন জ্বলে উঠল।

‘রানা, গাছগুলোকে জ্যান্ত মনে হচ্ছে আমার বিড়বিড় করে উঠল রিটা।

‘শুধু জ্যান্ত নয়, প্রাচীন মানুষ ওগুলোকে পবিত্র বলেও মনে করত, বলল রানা। আগুন জুলে ওঠায় জঙ্গলের ভেতর নানারকম ছায়া আর নড়াচড়া লক্ষ করল ও, সব কেমন যেন পুরানো আর ভীতিকর। ‘আধুনিক মানুষও-কেউ কেউ। গাছ তো আসলেও জ্যান্ত জিনিস। কি বলতে চাইছ বুঝতে পারছি।’

‘চলো ফিরি।’ রানার হাত ছেড়ে দিয়ে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াল রিটা, হন হন করে এগোল, যেন দৃশ্যটা সহ্য করতে পারছে না। ‘গোটা র‍্যাঞ্চ থেকে দেখা যাবে এই আগুন। দেখো না কত তাড়াতাড়ি লোক চলে আসে।

লম্বা লম্বা পা ফেলে রিটাকে ধরে ফেলল রানা, দু’জন পাশাপাশি কেবিনের দিকে উঠতে শুরু করল ওরা।

‘কয়েকটা ব্যাপারে মাথা ঘামানো দরকার’ স্যান্ড ক্রীকের দরজায় পৌঁছে বলল রিটা।

‘ঠিক বলেছ। প্রথম যে চিন্তাটা খোঁচা দিচ্ছে, কেন এখুনি আমরা পালাবার চেষ্টা করছি না? যোগাযোগ করার কোন উপায় নেই, কাজেই আমাদেরকে বেরুতে হবে। তারপর পুলিসের সাহায্যে, দলবল নিয়ে ফিরে আসা যাবে…। বলার সময়ই জানে রানা, এটা কোন উপায় নয়।

এখুনি যদি এখান থেকে পালাতে পারি তো আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হবে না। হঠাৎ উঁচু হলো রিটা, চুমো খেলো রানার ঠোঁটে, আলতোভাবে। কাছে সরে এসে আরও ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করছিল. আলতোভাবে তাকে দূরে সরিয়ে রাখল রানা। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রিটা। ‘আমি জানি, রানা। আমি জানি। আমাকে তুমি সহ্য করতে পারছ না। ভয় পাচ্ছ আবার যদি অপমান করে বসি যেমন জানি, নিরেট কোন প্রমাণ হাতে না পেলে এই জায়গা ছেড়ে তুমি পালাবে না।

মৃদু হেসে রানা বলল, দেরি করে হলেও রিটা তাকে চিনতে শুরু করেছে। তোমার সম্পর্কে আরও কিছু জানি আমি, মাসুদ রানা,’ সহাস্যে বলল রিটা। ড্রাগন লেডি বাননা বেলাডোনাকে এ-সবের সাথে ঠিক কিভাবে জড়াবে ভেবে পাচ্ছ না তুমি। সে-ও যে জড়িত, তোমার নিজের এই বিশ্বাস তুমি মেনে নিতে পারছ না…

‘পাগল নাকি!’ জোর করে হাসল রানা।

যদি জড়াতে পারো, সবচেয়ে সুখী হব আমি। গুডনাইট, রানা। ভাল ঘুমিয়ো।’

স্যাবকে পাশ কাটিয়ে হাঁটা ধরল রানা, সোজা যাচ্ছে ফেটারম্যানের দিকে। দরজার হাতলে হাত দিয়েছে, এই সময় অপর কেবিনের ভেতর থেকে শুরু হলো রিটার আর্তচিৎকার।